৭. আজ পুটু খাসনবিশের সঙ্গে

আজ পুটু খাসনবিশের সঙ্গে পুকুরে সাঁতার শিখতে নেমেছিল। জলে তার খুব ভয়। তবে খাসনবিশ খুব পাকা লোক। প্রথম কিছুক্ষণ দাপাদাপি করার পর খাসনবিশ তাকে একটু গভীর জলে নিয়ে গিয়ে পট করে ছেড়ে দেয়। তখন ভয় খেয়ে এমন হাত-পা ছুঁড়েছিল পুটু যে, বলার নয়। চিৎকারও করেছিল। তাই দেখে গুটকের সে কী হাসি!

কিন্তু ওই একবারেই সাঁতারটা শিখেও গেল সে। তারপর অনেকক্ষণ সাঁতার কেটে চোখ লাল করে ফেলল। খাসনবিশ জোর করে তুলে না আনলে পুটুকে আজ জল থেকে তোলাই যেত না।

সাঁতার শিখে আজ পুটুর এমন আনন্দ হল যে, সারাটা দিন তার যেন পাখা মেলে উড়তে ইচ্ছে করছিল। সাঁতার যে এত সোজা জিনিস তা এতকাল জানত না সে।

দুপুরে খাওয়ার সময় সে দাদুকে সাঁতার শেখার গল্পটা খুব জাঁক করে বলছিল।

কিন্তু দাদু ভারী অন্যমনস্ক। কেবল হুঁ দিয়ে যাচ্ছিলেন। “ও দাদু, তুমি খুশি হওনি?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব খুশি হয়েছি।”

“তবে হাসছ না যে!”

“হাসিনি। ও, আচ্ছা, এই যে হাসছি।”

“ওটা হাসি হল? মুখ ভ্যাংচানো হল তো?”

গগনবাবু এবার সত্যিই একটু হেসে বললেন, “কী জানো ভাই, আজ আমার মনটা ভাল নেই।”

“কেন নেই দাদু?”

“ঘটনাটা মাথা থেকে তাড়াতে পারছি না যে?”

“কোন ঘটনা দাদু?”

“ভাবছি আমার বাড়িতে বোমা রেখে গেল কে? আমার এমন শত্রু কে আছে? তার ওপর মিলিটারির হ্যান্ডগ্রেনেড। গাঁয়ের লোক এ-জিনিস পাবে কোথায়?”

পুটু গম্ভীর হয়ে বলল, “তুমি ভয় পেয়ো না দাদু। আমার তো এয়ার পিস্তল আছে। আজ রাতে আমি বাড়ি পাহারা দেব।”

গগনবাবু একটু বিষণ্ণ হেসে বললেন, “তা দিয়ো, তবু দুশ্চিন্তাটা যাচ্ছে না।”

আজ বিকেলে অনেক লোক এসে গগনবাবুর কাছে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে গেছে। রামহরিবাবু তো বলেই ফেললেন, “এর পর তো দেখব শীতলাতলার হাটে অ্যাটম বোমা বিক্রি হচ্ছে। দিনকালটা কী পড়ল বলুন তো! জগার হাতে পিস্তল! আপনার বাগানে বোমা! এ তো ভাল কথা নয়!”

হরিশবাবু বললেন, “একে রামে রক্ষে নেই। সুগ্রীব দোসর। ওদিকে ভূতের উৎপাতও নাকি শুরু হয়েছে। বাতাসা দ্বীপের ঢ্যাঙা ভূতটা নাকি ডাঙাতেও হানা দিচ্ছে আজকাল।”

স্কুলের বিজ্ঞানশিক্ষক ব্যোমকেশবাবু বললেন, “ভূতটুত সব বাজে কথা। লম্বা লোকটা মানুষই বটে! শীতলাতলার হাটে তাকে অনেকেই দেখেছে। লোকটার নাম শিবরাম নস্কর, নয়াগঞ্জে বাড়ি, হাটে-হাটে গামছা ফিরি করে বেড়ায়।”

এই নিয়ে একটা তর্কও বেধে উঠল বেশ। রামহরিবাবু বললেন, “এ, খুব ঢ্যাঙা দেখালেন মশাই! শিবরাম নস্করকে

আমিও চিনি। ও আবার লম্বা নাকি? অজিত কুণ্ডুকে তো দেখেননি। বাজিতপুরে বাড়ি। সেও হাটে আসে মাঝে-মাঝে। শিবরাম তো তার কোমরের কাছে পড়বে।”

মনসাবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “উঁহু উঁহু, অজিত কুণ্ডু লম্বা বটে, কিন্তু সাতকড়ির কাছে কিছু নয়। পয়সাপোঁতা গাঁয়ের সাতকড়ি গো, আমাদের শিবগঞ্জের শিবেনের জামাই। সে তো হাত বাড়িয়ে গাছ থেকে নারকেল পারতে পারে, গাছে উঠতে হয় না।”

ব্যোমকেশবাবু টেবিলে চাপড় মেরে বললেন, “কথাটা লম্বা নিয়ে নয়, ভূত নিয়ে। কথা হল, বাতাসা দ্বীপে একটা ঢ্যাঙ। ভূতের কথা শোনা যাচ্ছে। যারা মাছ-টাছ ধরতে যায় তারা নাকি দেখেছে। তা গাঁয়েগঞ্জে এরকম ভূত দেখা নতুন কিছু নয়। এসব কুসংস্কার ভেঙে ফেলা দরকার।”

রামহরি খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “আপনি কি বলতে চান ভূত নেই!”

ব্যোমকেশবাবু বুক চিতিয়ে বললেন, “নেই-ই তো।”

“তা হলে বলি, আপনার বিজ্ঞান-পড়া বিদ্যে দিয়ে ওসব বুঝতে পারবেন না। সাহস থাকলে নীলগঞ্জে প্রতাপরাজার বাগানবাড়িতে একটা রাত কাটিয়ে আসুন, বিজ্ঞান ভুলে রাম নাম নিতে পথ পাবেন না। শুনেছি সেখানে প্রতি রাতে ভূতের জলসা হয়। গানাদার বাজনদার ভূতরা সব আসে।”

“ওঃ, যত্ত সব।” বলে ব্যোমকেশবাবু রাগ করে গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন।

তা সে যাই হোক, বয়স্ক মানুষদের ঝগড়া শুনতে পুটুর খুব ভাল লেগেছিল আজ। সে হিহি করে হাসছিল। কিন্তু দাদুর মুখে হাসি নেই।

মহেশবাবু ভালমানুষ। তিনি কোনও ঘটনার খারাপ দিকটা দেখতে পছন্দ করেন না। বললেন, “আচ্ছা, ধরুন, এমনও তো হতে পারে, বিদ্যাধরপুরের ওপর দিয়ে নিশুত রাতে পথ ভুলে কোনও এরোপ্লেন যাচ্ছিল। ধরুন, প্লেনের পাইলটের খুব ঘুম পেয়ে গিয়েছিল। সে হয়তো ঘুম চোখে বোমা ফেলার বোতামটা টিপে দিয়েছিল। ঘুম চোখে ভুল তো হতেই পারে। আর সেই বোমাটাই এসে গগনবাবুর বাগানে পড়েছে। হয়তো বোমাটা মেঘের ভেতর দিয়ে আসার সময় ভিজে সেঁতিয়ে গিয়েছিল, তাই আমাদের ভাগ্যে ফাটেনি। হতে পারে না এরকম?”

রামহরিবাবু বললেন, “হতে পারবে না কেন? তবে হয়নি।”

গগনবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, “এরোপ্লেন থেকে এ ধরনের বোমা ফেলা হয় না মহেশবাবু।”

দাদুর মুখে একটুও হাসি না দেখে আজ পুটুর মনটা বড্ড খারাপ লাগছিল। গাঁয়ের লোকেরা বিদেয় হলে সে দাদুর গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি এত ভাবছ কেন দাদু? কী হয়েছে?”

গগনবাবু তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “অনেক কথা ভাবছি দাদু। একটা গভীর ষড়যন্ত্র। নইলে প্রতাপরাজার শুলটা হাতাতে চাইবে কেন? বুঝলে ভাই, আমার মনটা আজ সত্যিই ভাল নেই।”

রাতে যখন পুটু খেয়েদেয়ে মায়ের পাশে শুতে গেল, তখনও দাদুর গম্ভীর মুখটা সে ভুলতে পারছে না। বিদ্যাধরপুরে এলে দাদুই তার সারাদিনের সঙ্গী। কত গল্প হয়, হাসিঠাট্টা হয়, খেলা হয় দাদুর সঙ্গে। কিচ্ছু হচ্ছে না সকাল থেকে।

পুটু হয়তো ঘুমিয়েই পড়ত, কিন্তু সাঁতার কেটে আজ তার হাত-পায়ে খুব ব্যথা। মা ঘুমিয়ে পড়ার পরও সে অনেকক্ষণ জেগে রইল। তারপর ভাবল, উঠে বরং বাড়িটা পাহারা দিই।

সে গিয়ে প্রথমেই খাসনবিশকে জাগাল, “ও খাসনবিশদাদা, ওঠো! ওঠো!”

খাসনবিশ প্রথমটায় উঠতে চায় না। ঠেলাঠেলি করায় হঠাৎ একসময়ে জেগে সটান হয়ে বসে বলল, “কী! কী! হয়েছেটা কী? আবার বোমা নাকি? উরেব্বাস! আবার বোমা! নাঃ, এবার আমি বৃন্দাবন চলে যাব!”

পুটু হিহি করে হেসে বলল, “ভয় পাচ্ছ কেন? এবার কেউ বোমা ফেলতে এলে এই দ্যাখো আমার পিস্তল। ঠাঁই করে গুলি চালিয়ে দেব।”

নিজের এয়ার পিস্তলটা তুলে খাসনবিশকে দেখাল পুটু। খাসনবিশ বলল, “ওরে বাবা, এয়ার পিস্তল দিয়ে কি আর ওদের ঠেকানো যাবে?”

পুটু খাসনবিশকে ঘুমোতে দিল না। জোর করে বাড়ির বারান্দায় এসে দুটো চেয়ারে বসল দুজনে।

“একটা ভূতের গল্প বলো তো খাসনবিশদাদা।”

খাসনবিশ একটা হাই তুলে গল্পটা সবে ফাঁদতে যাচ্ছিল। ঠিক এই সময়ে, টমি কুকুরটা ঘাউ-ঘাউ করে গেটের দিকে তেড়ে গেল।

খাসনবিশ আঁতকে উঠে বলল, “ওই রে! এসে গেছে বোমারু!”

পুটু ভয় খেল না। পিস্তলটা তুলে সে চেয়ার থেকে নেমে গেটের কাছে ছুটে গিয়ে আবছা অন্ধকারে একটা লোককে দেখতে পেল।

লোকটা একটা ছোট বন্দুকের মতো জিনিস বাগিয়ে ধরে আছে। অন্য হাতে একটা কী জিনিস দোলাতে-দোলাতে টমিকে বলছে, “আয়, আয়, খাবি আয়।”

গোয়েন্দা-গল্পে কুকুরকে বিষ-মেশানো খাবার খাওয়ানোর গল্প অনেক পড়েছে পুটু। সে চেঁচিয়ে উঠল, “এই তুমি কে? কী চাই?”

লোকটা ভয় পেল না। বলল, “রোসো বাপু, রোসো। অত চেঁচামেচি কোরো না। আমি ভূত ছাড়তে এসেছি। অনেক শক্ত কাজ আছে হাতে। আগে এই মাংসের টুকরোটা তোমাদের কুকুরটাকে খাওয়াতে হবে। তারপর ভূত ছাড়তে হবে। তারপর আরও আছে।”

বলে লোকটা টমির দিকে মাংসের টুকরোটা ছুঁড়ে দিতেই পুটু চেঁচাল, “অ্যাই খবর্দার!”

বলেই সে তার পিস্তল চালিয়ে দিল।

“বাপ রে! মরে গেলুম রে!” বলে লোকটা চেঁচাতে শুরু করতেই চারদিক প্রকম্পিত করে লোকটার হাতের বন্দুকটা থেকে ফুলঝুরির মতো গুলি ছুটতে লাগল।

পুটু দাদুর কাছে মিলিটারির অনেক কায়দা শিখে নিয়েছে। গুলি চলতেই সে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। আর টমি ভয় পেয়ে ভীষণ চেঁচাতে লাগল।

লোকটা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তেই দৌড়ে পালিয়ে গেলে পুটু উঠে মাংসের টুকরোটা তুলে দেওয়ালের বাইরে ফেলতে যাচ্ছিল। হঠাৎ খেয়াল হল, রাস্তার কুকুররা বা কাকটাকেরা যদি খায়?

বিকট শব্দে বাড়িসুদ্ধ নোক উঠে পড়েছে। গগনবাবু বেরিয়ে এসে থমথমে মুখ করে সংক্ষেপে ঘটনাটা শুনে নাতিকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “তুমি আমাদের বাঁচিয়েছ বটে, কিন্তু খুব বিপদের ঝুঁকি নিয়েছ। খাসনবিশের বদলে আমাকে ডেকে নিলেই পারতে! তোমার হাতে ওটা কী?”

“এটা মনে হচ্ছে বিষ-মেশানো মাংস। লোকটা টমিকে দিতে চাইছিল।”

“সর্বনাশ! ওরে খাসনবিশ, ওটা মাটিতে পুঁতে ফেল তো এক্ষুনি।”

খাসনবিশ দৌড়ে শাবল এনে বাগানের কোণে মাংসের টুকরোটা পুঁতে দিয়ে এল।

গগনবাবু সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ব্যাপারটায় তোমরা ভয় পেয়েছ জানি। বোমার পর স্টেনগান। কেউ আমাকে দুনিয়া থেকে সরাতে চাইছে। কেন চাইছে তা বুঝতে পারছি না। তবে একটা সন্দেহ আমার হচ্ছে। যদি সেই সন্দেহ সত্য হয় তবে বেশ গণ্ডগোলের ব্যাপার।”

ঠিক এই সময়ে রসময় এসে ঢুকলেন। থরথর করে কাঁপছেন। মুখে কথা সরছে না।

গগনবাবু একটু হেসে বললেন, “আসুন ঠাকুরমশাই, মনে-মনে আপনাকেই খুঁজছি। আমার একজন বিচক্ষণ লোক দরকার।”

রসময় কপালে জোড়হাত ঠেকিয়ে বললেন, “বেঁচে যে আছেন এই ঢের। দুগা, দুর্গা।”

“লোকটা কে ঠাকুরমশাই? চেনেন?”

রসময় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “চিনি। ও হল জগাপাগলা।”

গগনবাবু অবাক হয়ে বললেন, “জগাপাগলা! বলেন কী ঠাকুরমশাই?”

“ঠিকই বলছি। তবে ওর দোষ নেই। পেছনে অন্য লোক আছে।”

“কে লোক?”

“কখনও তার নাম বামাচরণ, কখনও পরেশবাবু। কিন্তু হাতে আর সময় নেই গগনবাবু। এখনই একবার রাজবাড়ির দিকে যাওয়া দরকার।”

গগনবাবু হঠাৎ টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “শূল! অ্যাাঁ! শূলটা নিয়ে যাবে না তো! চলুন তো, দেখি!”

.

ভূত-যন্ত্রটা হাতে নিয়ে দৌড়তে-দৌড়তে জগা খুব হাসছিল। গগনবাবুর বাড়ির আশপাশে মেলা ভূত ছেড়ে এসেছে আজ। আর ভূতগুলোর কী তেজ বাপ! আগুনের ঝলক তুলে রে-রে ৭২

করতে করতে সব বেরোতে লাগল। গগনবাবুর ঘরের মধ্যে ছাড়তে পারলে ভাল হত। লোকটা বড় ছ্যাঁচড়া। মেয়ের বিয়েতে জগাকে মোটেই ভাল করে খেতেই দিল না! যা হোক, বাড়ির সামনে যে ভূতগুলো জগা ছেড়ে এল তারা কি আর গগনবাবুকে ছেড়ে কথা কইবে?

নষ্টের গোড়া ওই ছেলেটা এসে যে পিড়িং করে কী একটা জিনিস ছুঁড়ে মারল! জগার কপালের ডানদিকটা এখন ফুলে বড্ড টনটন করছে। রক্তও পড়ছে বটে। তবে আনন্দটাও তো হচ্ছে। কম নয়। শক্ত শক্ত কাজ করতে ভারী আনন্দ হয় জগার।

রাজবাড়ির কাছাকাছি যখন এসে পড়েছে তখন কে যেন তার পাশে-পাশে দৌড়তে লাগল। সেই ভূতগুলোর একটা নাকি? অন্ধকারে আবছায়ায় তাই তো মনে হচ্ছে!

জগা চোখ পাকিয়ে বলল, “যাঃ, যাঃ, এখানে কী? যেখানে ছেড়ে এসেছি সেখানে গিয়ে দাপাদাপি কর।”

ভূতটা বেশ বিরক্ত গলায় বলল, “এবারও পারলে না তো?”

“পরেশবাবু যে! ও, ভূত যা ছেড়ে এসেছি আর দেখতে হবে। এতক্ষণে ভূতেরা দক্ষযজ্ঞ লাগিয়ে দিয়েছে গিয়ে দেখুন গগনবাবুর বাড়িতে।”

পরেশবাবু বললেন, “মোটেই তা নয় জগা। ভূতগুলো সব মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।”

জগা অবাক হয়ে বলল, “বলেন কী মশাই? মুখ থুবড়ে তো পড়ার কথা নয়!”

পরেশবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “তোমার ওপর বড় ভরসা ছিল হে! এ-গাঁয়ে তোমার মতো বীর আর কে?”

“আজ্ঞে, সে তো ঠিক কথা।”

“নিজে পারলে অবশ্য তোমাকে কষ্ট দিতাম না। কিন্তু ওইখানেই যে মুশকিল। নিজে হাতে মশা-মাছিটা অবধি মারতে পারি না আমি। সেইজন্যই তো চাকরিটা ছাড়তে হল।”

জগা কথাটার প্যাঁচ ধরতে পারল না। তবে হাসির কথা ভেবে খুব হাসল। বলল, “মশা-মাছি আমি খুব মারতে পারি।”

রাজবাড়ির দেউড়ির উলটো দিকে জগাকে নিয়ে ঠেলে দাঁড় করিয়ে পরেশবাবু বললেন, “এবার যেন ভুল না হয়, দেখো।”

জগা বলল, “না, না ভুল হবে কেন? সোজা কাজ। তবে কাজটা যেন কী পরেশবাবু?”

“ওই যে দেউড়ির বাইরে হরুয়া আর রামুয়া দু’ভাই পাহারা দিচ্ছে দেখেছ? দুজনের হাতেই পাকা বাঁশের লাঠি।”

“ও আর দেখব কী? রোজ দেখছি।”

“তা হলে এবার এগিয়ে যাও। একেবারে কাছাকাছি গিয়ে যন্ত্রটা ভালমতো তাক করে ভূতগুলো ছেড়ে দিয়ে এসো। এবার যেন আর কাজ পণ্ড করে দিয়ো না।”

“না, না, আর ভুল হবে না। তা এর পর আরও শক্ত শক্ত কাজ দেবেন তো পরেশবাবু?”

“মেলা কাজ পাবে। কাজের অভাব কী?”

জগা খুশি হয়ে বলল, “কেউ কাজ দেয় না মশাই, তাই বসে থেকে-থেকে আমার গতরে শুয়োপোকা ধরে গেল। এইসব কাজকর্ম নিয়ে থাকলে সময়টা কাটেও ভাল।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, এবার যাও, কাজটা উদ্ধার করে এসো।”

“যে আজ্ঞে!”

ভূত ছাড়া ভারী মজার কাজ। জগা ভূত-যন্ত্রটা বগলে নিয়ে গটগট করে এগিয়ে গেল। কাজ খুবই সোজা। দেউড়ির মাথায় একটা ডুম জ্বলছে। সেই আলোয় হরুয়া আর রামুয়াকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

জগা যন্ত্রটা তুলে ঘোড়া টিপে ধরল। আর সঙ্গে সঙ্গেই আগুনের ঝলক তুলে রাশি রাশি ভূত ছুটে যেতে লাগল হরুয়া আর রামুয়ার দিকে। ভূতগুলোর কী তেজ! কী শব্দ! বাবা রে! যন্ত্রটা তার হাতের মধ্যে লাফাচ্ছে যেন!

দেউড়ির আলোটা চুরমার হয়ে অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক। ঝপঝপ করে কী যেন খসে পড়ল। হরুয়া আর রামুয়া বিকট চিৎকার করে উঠল, “বাপ রে! গেছি রে।”

তারপরই জায়গাটা একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

পরেশবাবু পেছন থেকে এসে যন্ত্রটা জগার হাত থেকে নিয়ে বললেন, “বাঃ, এই তো দিব্যি পেরেছ।”

জগা একগাল হেসে বলল, “এ আর এমন কী? তা আর ভূতটুত ছাড়তে হবে না?”

পরেশবাবু যন্ত্রটা একটু নাড়া দিয়ে বললেন, “ভূত শেষ হয়ে গেছে। আবার ভূত ভরলে তবে ভূত ছাড়তে পারবে। এখন চলো, অনেক কাজ আছে।”

পরেশবাবু একটা টর্চ জ্বেলে দেখলেন, হরুয়া আর রামুয়া মাটিতে চিতপটাং হয়ে পড়ে আছে। দুজনেরই কপাল আর শরীর রক্তে মাখামাখি। পরেশবাবু নিচু হয়ে হরুয়ার ট্যাঁক থেকে একট ভারী চাবির গোছা বের করে নিয়ে বললেন, “এবার শূল!”

জগা হরুয়া আর রামুয়ার রক্তাক্ত অবস্থা দেখে বলল, “আচ্ছা মশাই, ভূতেরা কি এদের মারধর করেছে?”

“তা করেছে।”

“কিন্তু মারধরের তো কথা ছিল না। শুধু ভয় দেখানোর কথা।”

“বে-আদবদের মারধরও করতে হয়। এবার চলো, চটপট কাজ সেরে ফেলি।”

জগার একটু ধন্ধ লাগছিল। তার মাথাটাও হঠাৎ যেন ঝিমঝিম করছে। তবু সে পরেশবাবুর পিছু পিছু চলল।

দেউড়ির ফটক ঠেলে পরেশবাবু ঢুকলেন। রাজবাড়ির মস্ত কাঠের দরজা চাবি দিয়ে খুলতে তাঁর মোটেই সময় লাগল না। পরপর কয়েকটা ঘর পার হয়ে একটা ঘরের বন্ধ দরজা খুললেন পরেশবাবু। টর্চের আলোয় দেখা গেল, ঘরের দেওয়ালে কাঠের স্ট্যান্ডে থরেথরে প্রতাপরাজার অস্ত্রশস্ত্র সাজানো। বিশাল ধনুক, মস্ত তলোয়ার, প্রকাণ্ড ভল্ল, বিপুল গদা। কোনওটাই মানুষের ব্যবহারের উপযোগী নয়, এতই বড় আর ওজনদার সব জিনিস। পরেশবাবুর টর্চের ফোকাসটা স্থির হল শূলটার ওপর। শুলটাও দেওয়ালের গায়ে একটা কাঠের মস্ত স্ট্যান্ডে শোওয়ানো।

“এসো হে জগা, একটু কাঁধ দাও।”

“যে আজ্ঞে!” দুজনে মিলেও শুলটা তুলতে বেশ কষ্টই হল।

শূলটা বয়ে দুধসায়রের দিকে হাঁটতে-হাঁটতে জগা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা পরেশবাবু, হরুয়া আর রামুয়া মরে যায়নি তো?”

পরেশবাবু চাপা গলায় বললেন, “মরলে তো তুমি বাহাদুর। আজ অবধি আমি কাউকে মারতে পারলাম না, তা জানো? আমার ওই একটাই দুঃখ।”

দুধসায়রের অনেক ঘাট। সব ঘাট ব্যবহার হয় না। সেরকমই একটা অব্যবহৃত ঘাটে একটা ডিঙি নৌকো বাঁধা। পরেশবাবু সাবধানে ডিঙির ওপর শুলটা শুইয়ে রাখলেন। তারপর জগার হাতে পাঁচটা টাকা দিয়ে বললেন, “যাও, গিয়ে ঘুমোও। কাল সকালে ওই টাকা দিয়ে জিলিপি খেয়ো।”

কিন্তু জগাপাগলার হঠাৎ যেন কিছু পরিবর্তন ঘটে গেল। টাকাটা হাত ঝেড়ে ফেলে দিয়ে হঠাৎ জগা চেঁচিয়ে উঠল, “মোটেই ওটা ভূতযন্ত্র নয়! ওটা বন্দুক। আপনি আমাকে দিয়ে খুন করালেন পরেশবাবু?”

পরেশবাবু একগাল হেসে বললেন, “কেন, খুন করে তোমার ভাল লাগছে না? একটা খুন করতে পারলে আমার কত আনন্দ হত জানো?”

জগা হঠাৎ পরেশবাবুকে জাপটে ধরে চেঁচিয়ে উঠল,

“আপনাকে আমি ছাড়ব না। পুলিশে দেব।”

ঠিক এই সময়ে পেছনের অন্ধকার থেকে একজন লম্বা, খুব লম্বা লোক এগিয়ে এল। তার হাতে উলটো করে ধরা একটা পিস্তল। লোকটা পিস্তলটা তুলে তার ভারী বাঁটটা দিয়ে সজোরে জগার মাথার পেছনে মারল। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল জগা। লোকটা জগার দেহটা টেনে ঘাটের আগাছার জঙ্গলে ঢুকিয়ে দিয়ে নৌকোয় উঠে পড়ল।

তারপর দুজনে চটপট হাতে বৈঠা মেরে তীর গতিতে বাতাসা দ্বীপের দিকে এগোতে লাগল।