কেমন লোক তুমি? অভিযোগের সুরে বলল মুসা। ছুটে পালালে কেন অমন করে?
কালো লম্বা চুল, চকচকে কালো চোখ, ঠোঁট সামান্য কুঁচকানো, সব মিলিয়ে ইনডিয়ান ছেলেটার চেহারা দেখলে ভয় লাগে। মুসাকে চিনতে পেরে চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার। নরম হয়ে এল মুখের ভাব। ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসল।
এখানে এলে কি করে? ছেলেটা জিজ্ঞেস করল। আমার পিছু নিয়ে?…না না, তা হতে পারে না।…যা-ই হোক পেয়ে তো গেছ। অবশ্য আবার ফিরে যেতাম তোমাদের কাছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তোমাদেরকে ওভাবে ফেলে রেখে আসতে হলো। সরি।
এবার অবাক হওয়ার পালা মুসার। আসতে হলো মানে?
বলছি। গায়ের ফতুয়া টেনে সোজা করল সে। পুরানো হয়ে রঙ চটে গেছে জিনসের। কোমরের বেল্টের বাকলসটা খুব সুন্দর, সচরাচর দেখা যায় না ওরকম। রূপা দিয়ে তৈরি, ডিম্বাকৃতি, মাঝখানে বসানো একটা নীলকান্তমণি। বাকলসটায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, আমি গিয়েছিলাম ভিশন কোয়েস্টে…
এই সময় সেখানে এসে হাজির হলো রবিন আর কিশোর।
আমার নাম নরম্যান জনজুনস, ভদ্র গলায় নিজের নাম জানাল ইনডিয়ান ছেলেটা। আমি…
তোমাদের এখানে টেলিফোন আছে? বাধা দিয়ে বলল রবিন, ফরেস্ট সার্ভিসকে খবর দিতে হবে। পাহাড়ের ভেতরে ভেঙে পড়েছে আমাদের প্লেন। আমার বাবা হারিয়ে গেছে। অনেক খুঁজেছি, পাইনি।
মাথা নেড়ে জন বলল, সরি, টেলিফোন নেই। এমনকি রেডিওও নেই। কোন জিনিসের প্রয়োজন হলে গাড়ি নিয়ে চলে যাই আমরা।
সবচে কাছের রেঞ্জার স্টেশনটায় নিয়ে যেতে পারবে?
এখন কারও বেরোনো চলবে না, পেছন থেকে বলে উঠল ভারি, খসখসে একটা কণ্ঠ। জন, ছেলেগুলো কে?
ফিরে তাকাল তিন গোয়েন্দা। মাঝারি উচ্চতার একজন মানুষ। বিশাল চওড়া কাঁধ, পেশীবহুল শরীর। চোখের মণি ঘিরে রক্ত জমে লাল একটা রিং তৈরি করেছে। মনে হয় মণিতে পানি টসটস করছে, নাড়া লাগলেই গড়িয়ে পড়বে।
চাচা, এদের কথাই তোমাকে বলেছিলাম, জন বলল।
ওদের সঙ্গে কথা বলেছ?
জঙ্গলে বলিনি।
ভাল। জনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন তার চাচা। তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরতেই আবার গম্ভীর হয়ে গেল মুখ, হাসিটা মিলিয়ে গেছে।
নিজেদের পরিচয় দিল কিশোর, রবিন আর মুসা।
গাঁয়ের মোড়ল আর সর্দার শিকারি তার চাচা ডুম সবলের পরিচয় দিল জন।
আমার বাবা হারিয়ে গেছে। কি হয়েছে অল্প কথায় জানাল রবিন। তাড়াতাড়ি খুঁজতে বেরোনর জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে সে।
চাচা, ডুমকে জিজ্ঞেস করল জন, ওদের কি সাহায্য করতে পারি আমরা?
উদ্বিগ্ন হয়ে মোড়লের দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন।
সমস্যাই! বললেন মোড়ল। বুঝতে পারছি না কি করা উচিত। কথা বলতে হবে।
যেমন নিঃশব্দে আচমকা এসেছিলেন ডুম, তেমনি করেই চলে গেলেন। আবার। হতাশায় কালো হয়ে গেল রবিনের মুখ।
জোর করে কিছুই করার উপায় নেই আমাদের। সান্ত্বনা দিয়ে জন বলল, গাঁয়ে পঞ্চায়েত আছে। শামান আছে। চুপ করে থাকো। আশা করি ভাল খবরই আসবে।
মাথা ঝাঁকাল রবিন। খুব একটা সান্ত্বনা পেয়েছে বলে মনে হলো না।
হ্যাঁ, তখন মুসার সঙ্গে কি যেন বলছিলে? আগের কথার খেই ধরল। কিশোর। ভিশন কোয়েস্টে গিয়েছিলে… জনের দিকে তাকাল সে। কি দেখতে? মোচড় দিয়ে উঠল ওর পেট। রান্না হচ্ছে কোথাও, সুগন্ধ এসে নাকে লেগেছে।
বলব, সবই বলব, জন বলল। আগে কিছু খেয়ে নাও।
নিশ্চয়ই! অধৈর্য কণ্ঠে বলে উঠল কিশোর, মুসার আগেই।
আসছি, বলে চলে গেল জন। খোলা জায়গাটার দিকে, যেখানে ঢাক বাজছে।
বাপরে বাপ! ভুরু কুঁচকে ইনডিয়ান ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা, চলে কি! হাঁটে না তো, মনে হয় পিছলে চলে যায়!
রবিন ওসব কিছু দেখছে না। তার একটাই ভাবনা। সাহায্য করবে তো ওরা?
তা করবে, যতটা জোর দিয়ে বলল কিশোর, ততটা আশা অবশ্য করতে পারল না। এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, ঢাক বাজছে কেন।
তাড়াতাড়িই ফিরে এল জন। এসো। খাবার দেয়া হয়েছে। প্রথমে নাচব। আমরা, তারপর খাওয়া। সব শেষে অনুষ্ঠান। তোমরা আমাদের অতিথি, কাজেই তোমাদের আগেই খেয়ে ফেলতে হবে।
তোমরা পরে খাবে? রবিন বলল, সেটা উচিত না।
আমরাও অপেক্ষা করি, মুসা বলল। তোমাদের ফেলে রেখে একলা খাব, তা হয় না।
ঢোক গিলল কিশোর। এত খিদে পেয়েছে তার, অপেক্ষা করাটা কঠিন। তবু মুসার টিটকারি শুনতে চায় না বলে কোনমতে বলল, ঠিক। পরেই খাব।
জন হাসল। অত ভদ্রতার দরকার নেই। খাবার তৈরি। তোমাদেরও খুব। খিদে পেয়েছে, আমি জানি। আগে খেয়ে নিলেই বরং সম্মান দেখানো হবে। এটাই নিয়ম।
পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল তিন গোয়েন্দা।
ওদের অপমান করা উচিত হবে না আমাদের, কিশোর বলল, কি বলো?
তাই তো মনে হচ্ছে, একমত হলো মুসা।
থ্যাংকস, জন, ভদ্রতা দেখাল রবিন। সে ভাবছে বাবার কথা। কোথায় কি ভাবে পড়ে আছেন কে জানে! খাওয়া নিশ্চয় হয়নি। ইস্, তাঁকেও যদি কেউ এখন। খাবার দিত!
জনের পেছন পেছন এগোল তিন গোয়েন্দা। কৌতূহলী চোখে ওদের দিকে তাকাচ্ছে গাঁয়ের লোক, বিশেষ করে বাচ্চারা। খোলা জায়গায় জমায়েত হয়েছে নারী-পুরুষ-শিশু। পুরুষদের খালি গা, মাথায় পাখির পালকের মুকুট, গলায় পাখির পালক আর পাথরে তৈরি মালা। মেয়েদের গলায় পুঁতির মালা। পুঁতি আর ছোট পাথর খচিত জামা পরেছে। ঢাকের সঙ্গে তাল রেখে দুটো করে কাঠি বাজাচ্ছে কয়েকজন লোক।
ওগুলোকে বলে ক্ল্যাপ স্টিক, জন বলল। বাজনার এখনও কিছুই না। জোর অনেক বাড়বে। এদিকে এসো। বাসন নিয়ে যার যার খাবার নিজেরাই তুলে নাও। খেতে খেতে দেখ। যেটা না বুঝবে, আমি বলে দেব।
বড় বড় কাঠের পাত্রে খাবার রাখা। বাঁশের তৈরি ঢাকনা দিয়ে ঢাকা। সরিয়ে নিল মেয়েরা। কয়েক পদের ভাজা মাংস, আলু, সীম আর রুটি। খাবার দেখে এতটাই খুশি হল কিশোর, ভাবনাচিন্তা আর করল না, তুলে নিতে লাগল প্লেটে।
মুসা অতটা অস্থির হয়নি, খাবার দেখলে যে সব চেয়ে বেশি হয় সাধারণত। মাংসের একটা পাত্র দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, শুয়োর?
মাথা ঝাঁকাল জন। হ্যাঁ।
থমকে গেল কিশোর। একবার চিন্তাও করেনি, মাংসটা সুন্দর দেখে ওটার দিকেই হাত বাড়িয়েছিল নেয়ার জন্যে। আর কিছু নেই? হতাশ হয়েছে সে।
থাকবে না কেন? জন বলল, শুয়োর খাও না নাকি?
মাথা নাড়ল মুসা, কিশোর দুজনেই।
অসুবিধে নেই, জন আরেকটা পাত্র দেখিয়ে বলল, ওটা খরগোশ। আর ওটা কাঠবোলি। এগুলোও পছন্দ না হলে, একটা পাত্রের ঢাকনা তুলতে তুলতে বলল সে, মাছ নাও। অনেক আছে। টুয়ক থেকে ধরেছি। আমাদের ভাষায় টুয়ক বলে নদীকে।
হাসি ফুটল আবার মুসা আর কিশোরের মুখে। মাংস নিয়ে রবিনের কোন অসুবিধে নেই। সে শুয়োরও খায়।
বিশাল এক রেডউড গাছের নিচে নিচু বেঞ্চিতে বসেছে ওরা। টেবিল হল বড় বড় কাঠের বাক্স। গায়ে লেখা রয়েছেঃ ইঞ্জিন পার্টস, জোনস ট্রাকিং কোম্পানি। কাছেই দাঁড়িয়ে আছে একটা শেভ্রলে ট্রাক, বনেট তোলা। ইঞ্জিন খুলে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে কয়েকটা বাক্সের ওপর। তার ওপাশে, বেশ কিছুটা দূরে টুয়ক, যেটাকে নদী না বলে বরং চওড়া বড় ধরনের নালা বললেই ঠিক হয়। গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কুলকুল করে। টলটলে পানি। গভীরও বেশ।
উত্তরের বিশাল উপত্যকা থেকেই কি এসেছে ওই নদী? জিজ্ঞেস করল রবিন।
চেনো নাকি তুমি উপত্যকাটা? জনের কণ্ঠে সন্দেহ।
চিনি, মানে, সতর্ক হয়ে গেল রবিন। একটুকরো মাংস চিবিয়ে গিলল। দূর থেকে দেখেছি আরকি।
বাইরের কেউ যেতে পারে না ওখানে। ওটা পবিত্র জায়গা। আমরা ওর নাম দিয়েছি পূর্বপুরুষের উপত্যকা। জায়গাটা সংরক্ষিত করে রেখেছি আমরা। ইনডিয়ানদের গোরস্থান। মাঝে মাঝে ওখানে গিয়ে অনুষ্ঠানও করি।
আমি যাইনি, জনকে নিশ্চিন্ত করল রবিন। আরেক টুকরো মাংস মুখে পুরল। তোমরা নিশ্চয় অনেক কাল ধরে আছ এখানে?
কি করে জানলে?
পাহাড়ে সিঁড়ি, দেখেছি আমি। বেয়ে ওঠার জন্যে পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে। ওখান দিয়ে উঠতে গিয়ে আরেকটু হলেই ধসের কবলে পড়েছিলাম। ধস না নামলে অবশ্য সিঁড়িটা দেখতে পেতাম না। অনেক কাল আগে কাটা হয়েছে।
হ্যাঁ, অনেক অনেক আগে এখানে এসেছিল আমাদের পূর্বপুরুষেরা, স্রষ্টা ওদের সৃষ্টি করার পর পরই। অজ্ঞান লোকেরা পাহাড়ে চড়তে চেষ্টা করলে ঈশ্বরই ধস নামিয়ে ওদের সরিয়ে দেন, কিংবা মেরে ফেলেন। তিনিই উইলো গাছ তৈরি করেছেন, যাতে আমরা বুড়ি বানাতে পারি, সেই ঝুড়িতে করে লাশ নিয়ে যেতে পারি উপত্যকায়। সব কিছুই সৃষ্টি করেছেন ঈশ্বর। হাসল জন। ওহহো, ভুলে গিয়েছিলাম, তুমি তোমার বাবাকে খুঁজছ। ভেব না। গাঁয়ের বুড়ো জ্ঞানী লোকেরা সেটা বুঝবেন।
কিন্তু বাইরের মানুষের সমস্যা তারা বুঝতে চান না।
চান না, তার কারণ টুরিস্টদের পছন্দ করেন না তো। বড় বিরক্ত করে।
একটা কথাও বলেনি এতক্ষণ কিশোর। চুপচাপ খেয়েছে। পেট কিছুটা শান্ত হলে বলল, কিছু একটা ঘটছে নিশ্চয় এখন তোমাদের গায়ে।
ঘটছে। অসুস্থ হয়ে পড়ছে লোকে, জন জানাল। চোখ লাল হয়ে যায়, কাশি হয়, বুক ব্যথা করে। কারও কারও পেটে যেন আগুন জ্বালানো শয়তান ঢুকেছে। ভীষণ জ্বালাপোড়া করে পেটে। তাই জ্ঞানীরা ভেবেচিন্তে ঠিক করেছে, ভয়াবহ ওই রোগ তাড়ানর জন্যে একটা উৎসব করা দরকার। গ্রাম থেকে বেরোনো নিষিদ্ধ। করে দেয়া হয়েছে। কাল দুপুরের আগে কেউ বেরোতে পারবে না।
ডাক্তারের কাছে যাও না কেন তোমরা? মুসার প্রশ্ন। রোগ হলে ডাক্তারই তো-..
মুসার পায়ে লাথি মারল কিশোর।
আউ করে উঠে থেমে গেল মুসা। ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল।
একটা মুহূর্ত অবাক হয়ে মুসার দিকে তাকিয়ে রইল জন। মুসাকে হাসতে দেখে আরও অবাক হলো। তবে ব্যাপারটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাল না। বলতে লাগল, তোমাদের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, আমাদেরও তেমন ডাক্তার আছে। গান গাওয়া ডাক্তার, শামান। এখনকার যে শামান, আমার জন্মের। আগে থেকেই আছে, চিকিৎসা করছে বহু বছর ধরে। অনেক জানে, অনেক জ্ঞানী। মাঝে মাঝে অবশ্য বেকারসফিল্ডের ক্লিনিকে পাঠায় আমাদের, তবে সব সময় না। স্বাস্থ্যটাস্থ্য ভালই থাকে আমাদের, রোগ বালাই তেমন হয় না, আর হলেও অল্পতেই সেরে যায়। মানে যেত আরকি। এবারের অসুখটা আর সারতে চাইছে না। কয়েক মাস ধরে চলছে।
গা থেকে যে বোরোনো যাবে না বললে, শঙ্কিত হয়ে উঠেছে রবিন, সেটা কি আমাদের বেলায়ও? জরুরী অবস্থায়ও কি বেরোনো যাবে না?
সেটাই শামানের কাছে জানতে গেছেন চাচা।
হঠাৎ ঢাকের আওয়াজ বেড়ে গেল। সেই সঙ্গে বাড়ল ক্ল্যাপ স্টিকের খটাখট। সম্মিলিত বিকট চিৎকার উঠল, মানুষের গলা থেকে যে ওরকম শব্দ বেরোতে পারে না শুনলে বিশ্বাস করা কঠিন, ছড়িয়ে গেল গাঁয়ের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। তাকিয়ে রয়েছে তিন গোয়েন্দা।
নাচ আরম্ভ হয়েছে। অনেক বড় চক্র তৈরি করে নাচছে নর্তকেরা। কাঁচা চামড়ায় তৈরি মোকাসিন পায়ে থাকায় পায়ের শব্দ তেমন হচ্ছে না। আরেকটা ব্যাপার অবাক করল গোয়েন্দাদেরকে। চক্রের এক প্রান্তের লোকেরা যখন নাচছে, আরেক প্রান্ত চুপ থাকছে। কারণটা জিজ্ঞেস করল জনকে।
ও, জান না। বুঝিয়ে দিল জন, পৃথিবীটা হলো একটা নৌকার মত। পানিতে ভাসার সময় নৌকার এক পাশে যদি ভার বেশি হয়ে যায়, তাহলে কাত হয়ে যায়। আর সবাই একসাথে একপাশে চলে গেলে তো উল্টেই যাবে। সে জন্যে দুই দিকেই সমান ভার রাখতে হবে। নাচের বেলায়ও তাই। সবাই একধারে গিয়ে একসাথে নাচলে চলবে না।
তাহলে কাত হয়ে যাবে নাকি পৃথিবীটা? ফস করে জিজ্ঞেস করে বসল। মুসা। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, আবার লাথি খেল পায়ে। চোখের ইশারায়। বুঝিয়ে দিল কিশোর, যা বলছে চুপচাপ শুনে যাও না, এত কথা বলার দরকার কি?
ঘুরতে ঘুরতে কয়েকজন নর্তক এসে ঢুকে পড়ল চক্রের মাঝখানে। যতটা জোরে সম্ভব লাফাতে লাগল। যেন কার চেয়ে কে কত বেশি উঁচুতে উঠতে পারবে সেই প্রতিযোগিতা চলছে।
এরও কারণ ব্যাখ্যা করে দিল জন, আগে একবার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল পৃথিবী। তারপর আবার সৃষ্টি করলেন ঈশ্বর। কাঠঠোকরার ওপর ভার দিলেন, কোথায় কেমন চলছে, সেই খবর নিয়মিত দিয়ে আসার। কাজেই আমাদের মধ্যে যাদের অন্তর খুব ভাল, ঈশ্বরের ভক্ত, তাদের রাখা হয়েছে কাঠঠোকরার অনুকরণ করার জন্যে। দেখছ না, মাথা আগেপিছে করছে কেমন ভাবে? কাঠঠোকরা ওরকম করেই গাছ ঠোকরায়, নিশ্চয় দেখেছ। কাঠঠোকরা যেভাবে ডানা ছড়িয়ে দিয়ে গান গায়, ওরাও তেমন করেই গাইছে। এর কারণ জানো? কাঠঠোকরারা এই গান শুনতে পেয়ে ঈশ্বরকে গিয়ে খবর দেবে, এখানে কিছু মানুষের বড় দুর্ভোগ, অসুখ করেছে তাদের। ঈশ্বর শুনলে একটা ব্যবস্থা করবেনই। যাদের তৈরি করেছেন, তাদের তো আর কষ্টে রাখতে পারেন না। হয় রোগ সারিয়ে দেবেন, নয় তো শামানের ওপর ভার দিয়ে দেবেন, তাকে শক্তিশালী করে দেবেন যাতে মানুষের এই রোগ সারিয়ে দিতে পারে।
নাচ চলছে। দরদর করে ঘামছে নাচিয়েরা। মেয়েরা আর বাচ্চারা নাচে অংশ। নিচ্ছে না, তারা বসে বসে দেখছে, মাঝে মাঝে হাততালি দিচ্ছে, গানের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে। এর বেশি আর কিছু করণীয় নেই তাদের। বেশি অসুস্থ রোগীদেরকে মাদুরে শুইয়ে রাখা হয়েছে। কম্বল পাকিয়ে তাদের মাথার নিচে দিয়ে দেয়া হয়েছে, যাতে আরাম করে শুতে পারে, আর মাথাটা কিছুটা উঁচু হয়ে থাকায় নাচ দেখতে সুবিধে হয়। বেশ জমজমাট উৎসব, আন্তরিকতার অভাব নেই।
একসময় শেষ হলো নাচ।
ঢাক বাজানো বন্ধ হলো। নর্তক এবং দর্শকেরা খাবারের দিকে এগিয়ে এল। তাড়াতাড়ি এসে খাবারের পাত্রের ওপর থেকে ঢাকনা সরিয়ে দিল মেয়েরা। কিশোর লক্ষ করল, নর্তকদের অনেকেরই চোখ লাল, কেউ কেউ কাশছে।
জনের চাচা মোড়ল আরেকজন বুড়ো মানুষকে নিয়ে হাজির হলেন। দুজনেরই পরনে উৎসবের পোশাক। লোকে যেভাবে ভক্তিতে গদগদ হয়ে সরে। জায়গা করে দিচ্ছে বুড়ো মানুষটাকে, শ্রদ্ধার চোখে তাকাচ্ছে, তাতে বুঝতে অসুবিধে হয় না এ লোকই গাঁয়ের শামান, গান গাওয়া ডাক্তার।
কথা বলতে বলতে তিন গোয়েন্দার দিকে এগিয়ে এল দুজনে।
কাছে এসে থামল।
মোড়ল ডুম সবল ঘোষণা করলেন, তোমাদেরকে সাহায্য করতে পারছি না। আমরা। একাই যেতে হবে তোমাদের। এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত।