অন্ধকারে দুজনে
অন্ধকারে দু’জনে কুমড়োর মতো গড়াগড়ি খেলুম কিছুক্ষণ। ক্যাবলা যতই বলে, ছাড়—ছাড়—আমি ততই গোঁ-গোঁ করতে থাকি : বা—বা–বা–
এর ভেতরে লণ্ঠন হাতে টেনিদা, হাবলা আর কুট্টিমামা এসে হাজির। ছোট্টুলালও সেইসঙ্গে।
–কী হল? কী হল?
—আরে ই ক্যা ভৈল বা?
ক্যাবলা তড়াক করে উঠে পড়ে বললে, দেখুন না কুট্টিমামা, ঘুমের ঘরে প্যালাটা আমাকে জাপটে ধরে খাট থেকে নীচে ফেলে দিলে। কিছুতেই ছাড়ে না। খালি বলছে : বা—বা–বা–
বা—বা–বা?—টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, তার মানে, বাঃ—বেশ মজার খেলা হচ্ছে! এই প্যালাটাকে নিয়ে সব সময় একা কেলেঙ্কারি হবে। ওর গাধার মতো লম্বা কান দুটোকে ইপের মতো পেঁচিয়ে দিলে তবে ঠিক হয়। এই প্যালা, এই গাড়লরাম উঠে পড় বলছি
আমি কি উঠি নাকি অত সহজে? ক্যাবলার পাশেই তো সেই একজোড়া বড় বেড়াল বসে আছে।
চোখ বুজেই বলি, ওই জা–জা–জা—
হাবুল বললে, কারে যাইতে কস? কেডা যাইব?
বললুম, জা—নালায়!
হাবুল বিচ্ছিরি চটে গেল। বললে, কী, আমি নালায় যামু? ক্যান, আমি নালায় যামু ক্যান? তর ইচ্ছা হইলে তুই যা–নালায় যা, নর্দমায় যা–-গোবরের গাদায় যা–
আমি তেমনি চোখ বুজে বললুম, দুত্তোর! জানালায় তা—তাকিয়ে দ্যাখো না একবার! বা–বাঘ বসে আছে ওখানে।
—অ্যাাঁ, জানালায় বাঘ! বলেই টেনিদা লাফ দিয়ে প্রায় হাবুলের ঘাড়ে গিয়ে পড়ল।
হাবুল বললে, ইঃ-খাইছে, খাইছে!
কুট্টিমামা হেসে উঠলেন।
–জানালায় বাঘ? এই বাগানের ভেতর? ঘুমের ঘোরে তুমি স্বপ্ন দেখেছ প্যালারাম।
ক্যবলা খিকখিক করে হাসতে লাগল, হাবুল খ্যাখ্যা করে হাসতে লাগল, টেনিদা খ্যাঁচর-খ্যাঁচর করে হেসে চলল। আর পেট চেপে ধরে খৌ-খৌ করে সবচেয়ে বেশি করে হাসতে লাগল ছোট্টুলাল।
—খৌ—খো—খৌ! আরে খৌ—খৌ-বাঘ কাঁহাসে আসবে! বাঘের মাসি এসেছিল হোবে— খৌ —খৌ—খৌ-! কী খুশি সবাই, আর কী হাসির ধুম! যেন আমাকে পাগল পেয়েছে ওরা!
রাগে গা জ্বলে গেল, আমি উঠে বসলুম।
–চলে গেছে কিনা, তাই সবাই হাসছে। যদি দেখতে—
টেনিদা বললে, আমিও তো দেখেছিলুম। এই একটু আগেই। দুটো গণ্ডার আর তিনটে জলহস্তী আমার দিকে তেড়ে আসছিল। আমি এক ঘুষিতে একটা গণ্ডারকে মেরে ফেললুম—দুই চড়ে দুটো জলহস্তী কাত হয়ে গেল। বাকি দুটো ল্যাজ তুলে পাঁই-পাঁই করে দৌড়ে পালাল। অবিশ্যি স্বপ্নে।
আবার হাসি। ছোট্টুলাল তো প্রায় নাচতে লাগল। আমার এত রাগ হল যে ইচ্ছে করতে লাগল ছোটুলালের ঠ্যাঙে ল্যাং মেরে মাটিতে ফেলে দিই কিংবা ওর কানের ভেতরে কতগুলো লাল পিঁপড়ে ঢেলে দিই।
কুট্টিমামা বললেন, থামো—থামো। সবটা ওকে বলতে দাও। আচ্ছা প্যালারাম, তুমি তো ঘুমুচ্ছিলে?
-মোটেই না। আমি শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ছিলুম।
—তারপরে?
–জানালায় একটা গর আওয়াজ। তাকিয়ে দেখি—
বলতে বলতে আমি থেমে গেলুম। বুকের ভেতর দুরুদুরু করে উঠল।
–কী দেখলে?
–প্রথমে একটা বাচ্চা বড়সড় বেড়ালের মতো দেখতে। তারপরে আর একটা। জালার মতো মাথা-ভাঁটার মতো চোখ, কাঁটার মতো গোঁফ–
ক্যাবলা বললে, ধামার মতো পিলে—
টেনিদা বললে, শিঙিমাছের মতো শিং—
হাবুল জুড়ে দিলে, আর পটোলের মতন দাঁত–
বুঝতে পারছ তো? আমার সেই পালা-জ্বরের পিলে আর পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোলকে ঠাট্টা করা হচ্ছে।
শুনে কুট্টিমামা পর্যন্ত মুচকে মুচকে হাসলেন, আর খৌয়া—খৌ-খেী বলে আবার নাচতে শুরু করে দিলে ছোট্টুলাল।
ভাবছি ছোট্টুলালকে এবার সত্যিই ঘ্যাঁচ করে একখানা ল্যাং মেরে দেব যা থাকে কপালে, এমন সময় টেনিদা বললে, না কুট্টিমামা, প্যালাকে আর এখানে রাখতে ভরসা হচ্ছে না!
ক্যাবলা বললে, ঠিক। বাঘের কথা শুনেই যেমন করছে, তাতে তো—
হাবুল বললে, বাঘ একখান চক্ষের সামনে দেখলে ভয়েই মইরা যাইব নে।
টেনিদা বললে, কালই ওকে প্লেনে তুলে দেওয়া যাক।
ক্যাবলা বললে, বেয়ারিং পোস্টে।
হাবুল বললে একটা বস্তার মইধ্যে কইর্যা তুইল্যা দিলেই হইব—পয়সা লাগব না।
অপমানে আমার কান কটকট করতে লাগল, খালি মনে হতে লাগল নাকের ডগায়। কতগুলো উচ্চিংড়ে লাফাচ্ছে। কিন্তু এদের কোনও কথা বলে লাভ নেই—এরা বিশ্বাস করবে না। আমি রেগে গোঁজ হয়ে বসে রইলুম।
কুট্টিমামা বললেন, যাও–যাও, সব শুয়ে পড় এখন। আর রাত জেগে শরীর খারাপ করে লাভ নেই।
আমি শেষবার বলতে চেষ্টা করলুম : আপনারা বিশ্বাস করছেন না—
টেনিদা ভেংচি কেটে বললে, ঝা—যা খুব হয়েছে। আর ওস্তাদি করতে হবে না তোকে! রাক্ষসের মতো খাবি আর শেষে পেট-গরম হয়ে উমধুটুম স্বপ্ন দেখবি! দরজা-জানালা বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে পড়। কাল ভোরের প্লেনে যদি তোকে কলকাতায় চালান না করি তো
দাঁত বের করে আরও কী সব বলতে যাচ্ছিল, ঠিক এমনি সময় একটা বিকট হইহই চিৎকার। সেটা এল কুলি লাইনের দিক থেকে। তারপরেই জোর টিন-পেটানোর আওয়াজ।
আমরা সবাই ভীষণভাবে চমকে উঠলুম। সবচাইতে বেশি করে চমকালেন কুট্টিমামা।
—ও কী! ও আওয়াজ কেন?
চিৎকারটা আরও জোরালো হয়ে উঠল। আকাশ ফেটে যেতে লাগল টিন-পেটানোর শব্দে! তারপরেই কে একজন ছুটতে ছুটতে এসে বাইরে থেকে হাঁক পাড়ল : বাবু-ছোট ম্যানেজারবাবু–
ছোট্রলাল দরজা খুলে দিলে। দেখা গেল, লণ্ঠন হাতে কুলিদের একজন সর্দার।
কুট্টিমামা বললেন, কী হয়েছে রে? অমন চেঁচামেচি করছিস কেন?
–কুলি-লাইনে বাঘ এসেছিল বাবু!
বাঘ!
ঘরে যেন বাজ পড়ল। আর দেখি—সবাই যেন হাঁ করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আর ছোট্টলালের চোখ দুটো একেবারে গোল গোল হয়ে গেছে টিকিটা খাড়া হয়ে ওঠবার চেষ্টা করছে।
এইবারে জুত পেয়ে আমি বললুম, কেমন বাপু ছোট্টলাল—আভি খেয়া-খৌয়া করকে হাসছ না কেন?
কুলি-সর্দার বললে, একটা চিতা, সঙ্গে বাচ্চাও ছিল। একটা গোরুকে জখম করেছে আর একটা ছাগল মেরে নিয়ে পালিয়েছে।
কারও মুখে আর কথাটি নেই।
আর তক্ষুনি আমি ঘর কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করলুম। সেই হাসির আওয়াজে টেনিদা লাফিয়ে হাবুলের ঘাড়ের উপর পড়ল হাবুল গিয়ে পড়ল ছোটুলালের গায়ে, আর—আঁই দাদা বলে চিৎকার ছেড়ে একেবারে চিৎপাত হল ছোট্টুলাল।