৭৯তম অধ্যায়
মণিপুরে—অর্জ্জুনযাত্রা—পুত্র বভ্রুবাহন সমাগম
বৈশম্পায়ন বলিলেন, মহাত্মা ধনঞ্জয় মণিপুরে সমুপস্থিত হইলে তাঁহার পুত্র মহারাজ বভ্রুবাহন তাঁহার আগমনবৃত্তান্ত শ্রবণ করিবামাত্র, ব্রাহ্মণগণকে অগ্রসর করিয়া বিনীতভাবে তাঁহার নিকট সমুপস্থিত হইলেন। তখন ক্ষাত্রধর্ম্মাবলম্বী মহাবীর ধনঞ্জয় পুত্রকে বিনীতভাবে আগমন করিতে দেখিয়া তাঁহার কিছুমাত্র সমাদর করিলেন না, প্রত্যুত ক্রোধাবিষ্টচিত্তে তাঁহাকে সম্বোধনপুৰ্ব্বক কহিলেন, “বৎস! এরূপ বিনীতভাব আশ্রয় করা তোমার কখনই কর্ত্তব্য নহে। যখন আমি মহারাজ যুধিষ্ঠিরের অশ্বরক্ষায় নিযুক্ত হইয়া যুদ্ধকামনায় তোমার অধিকারমধ্যে সমুপস্থিত হইয়াছি, তখন তুমি কি নিমিত্ত আমার সহিত যুদ্ধ করিবে না? তোমার এইরূপ ব্যবহার দেখিয়া তোমাকে ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মবহিষ্কৃত [যুদ্ধবিমুখতা ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মের অনুপযুক্ত] বলিয়া আমার বোধ হইতেছে; তোমাকে ধিক্! যখন তুমি আমাকে যুদ্ধার্থ সমাগত জানিয়াও বিনীতভাবে আমার নিকট আগমন করিয়াছ, তখন তোমার জীবিত থাকা বিড়ম্বনামাত্র। তোমাতে কিছুমাত্র পুরুষকার নাই। তুমি স্ত্রীজাতির ন্যায় নিতান্ত অসার। যদি আমি অস্ত্রশস্ত্রবিহীন হইয়া তোমার অধিকারমধ্যে সমুপস্থিত হইতাম, তাহা হইলে আমার নিকট এইরূপ বিনীতভাবে আগমন করা তোমার পক্ষে দোষাবহ হইত না।”
উলুপীর উত্তেজনায় বভ্রুবাহনের যুদ্ধ
মহাবীর অর্জ্জুন বভ্রুবাহনকে এইরূপে তিরস্কার করিলে তিনি অধোমুখ হইয়া কর্ত্তব্যবিষয় চিন্তা করিতে লাগিলেন। ঐ সময় নাগকন্যা উলুপী ঐ বৃত্তান্ত পরিজ্ঞাত হইয়া পৃথিবী বিদারণপূৰ্ব্বক আগমন করিয়া দেখিলেন, তাঁহার সপত্নীপুত্র অর্জ্জুনকর্ত্তৃক বারংবার তিরস্কৃত হইয়া অধোমুখে চিন্তা করিতেছেন। তখন নাগনন্দিনী সপত্নীপুত্রকে তদবস্থ দেখিয়া অচিরাৎ তাঁহার সমীপে সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “বৎস! আমি তোমার বিমাতা উলুপী, তোমাকে এই সময়ের উপযুক্ত উপদেশ প্রদান করিবার নিমিত্ত তোমার নিকট সমুপস্থিত হইয়াছি। এক্ষণে তুমি আমার বাক্য শ্রবণ ও তদনুরূপ কার্য্যানুষ্ঠান কর, তাহা হইলে নিশ্চয়ই পরমধর্ম্মলাভে সমর্থ হইবে। তোমার পিতা যখন যুদ্ধার্থী হইয়া তোমার অধিকারমধ্যে সমুপস্থিত হইয়াছেন, তখন উহার সহিত যুদ্ধ করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। তুমি সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলে উনি তোমার প্রতি নিতান্ত প্রীত হইবেন, সন্দেহ নাই।”
উলুপী এইরূপ উপদেশ প্রদান করিলে মহাবীর বভ্রুবাহন তাঁহার বাক্যে উত্তেজিত হইয়া যুদ্ধে কৃতনিশ্চয় হইলেন এবং অচিরাৎ কাঞ্চনময় বৰ্ম্ম ও সমুজ্জ্বল শিরস্ত্রাণ ধারণ করিয়া অসংখ্য তূণীর সম্পন্ন স্বর্ণালঙ্কারভূষিত, দ্রুতগামী-অশ্ব চতুষ্টয়যুক্ত, হিরন্ময়, সিংহধধ্বজ-পরিশোভিত, বিচিত্র রথে আরোহণপূর্ব্বক পিতার অভিমুখে ধাবমান হইয়া অস্ত্রশিক্ষাবিশারদ অনুচরদিগকে সেই যজ্ঞীয় অশ্ব ধারণ করিতে আজ্ঞা করিলেন। অনুচরগণ তাঁহার আজ্ঞাপ্রাপ্তিমাত্র সেই তুরঙ্গমকে ধারণ করিল। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় প্রীতমনে সেই রথারূঢ় পুত্রের প্রতি বাণ নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবীর বভ্রুবাহনও আশীবিষতুল্য নিশিত শরনিকরদ্বারা অর্জ্জুনকে প্রপীড়িত করিতে লাগিলেন। ক্রমে সেই পিতাপুত্রের সংগ্রাম দেবাসুর-যুদ্ধের ন্যায় তুমুল হইয়া উঠিল।
পুত্রহস্তে অর্জ্জুনের পরাজয়
অনন্তর মহাবীর বভ্রুবাহন হাস্যমুখে মহাত্মা কিরীটির জত্রু [কন্টাস্থি—কষ্ঠের উভয়পার্শ্বস্থ হাড়] দেশ লক্ষ্য করিয়া এক আনতপর্ব্ব শরনিক্ষেপ করিলেন। ঐ বাণ অর্জ্জুনের জত্রুদেশ বিদীর্ণ করিয়া, পন্নগ যেমন বল্মীক [উইমাটির ঢিপি] মধ্যে প্রবেশ করে, তদ্রূপ পাতালতলে প্রবিষ্ট হইল। তখন মহাবীর অর্জ্জুন সেই শরাঘাতে নিতান্ত ব্যথিত ও মৃতকল্প হইয়া গাণ্ডীব শরাসন অবলম্বন ও দিব্যতেজ ধারণপূৰ্ব্বক কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। তৎপরে তিনি পুনরায় সংজ্ঞালাভ করিয়া স্বীয় পুত্র বস্তুবাহনকে বারংবার সাধুবাদ প্রদানপূৰ্ব্বক সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “বৎস! আজ আমি তোমার উপযুক্ত কৰ্ম্ম দর্শন করিয়া তোমার প্রতি পরম পরিতুষ্ট হইলাম। এক্ষণে আমি তোমার প্রতি বাণ নিক্ষেপ করিতেছি; তুমি স্থিরভাবে আমার সহিত সংগ্রাম কর।” এই বলিয়া ধনঞ্জয় বস্তুবাহনের প্রতি অসংখ্য নারাচ পরিত্যাগ করিলেন। মহাবীর বভ্রুবাহনও অচিরাৎ ভল্লাস্ত্রদ্বারা সেই গাণ্ডীবনির্ম্মুক্ত বজ্রতুল্য নারাচনিকর দুই-তিন খণ্ডে ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় ঈষৎ হাস্য করিয়া নিশিত শরনিকরদ্বারা বভ্রুবাহনের সুবর্ণময় তালতরুসদৃশ ধ্বজযষ্ঠি ছেদন করিয়া বৃহৎকায় অশ্বগণের প্রাণ সংহার করিলেন।
এইরূপে রথ-ধ্বজশূন্য ও অশ্ববিহীন হইলে মহাবীর বভ্রুবাহন অচিরাৎ রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া ভূতলে অবস্থানপূৰ্ব্বক ক্রোধাবিষ্টচিত্তে অর্জ্জুনের সহিত ঘোর সংগ্রাম করিতে আরম্ভ করিতে লাগিলেন। মহাত্মা ধনঞ্জয়ও পুত্রের সেই অসাধারণ পরাক্রমদর্শনে অতিশয় প্রীত হইয়া শরনিকরদ্বারা তাঁহাকে নিতান্ত নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। পরিশেষে মহাবলপরাক্রান্ত বভ্রুবাহন পিতাকে সংগ্রামে বিমুখ বোধ করিয়া আশীবিষতুল্য শরনিকরদ্বারা তাঁহাকে নিপীড়নপূৰ্ব্বক বালসুলভ [বালকোচিত চাঞ্চল্যহেতু] চপলতানিবন্ধন তাঁহার হৃদয়ে এক সুপুঙ্খ [পাখাযুক্ত] নিশিত বাণ নিক্ষেপ করিলেন। ঐ বাণে অৰ্জ্জুনের মর্ম্মভেদ হওয়াতে মহাত্মা ধনঞ্জয় মোহে একান্ত অভিভূত হইয়া ভূতলে নিপতিত হইলেন। মহাত্মা বভ্রুবাহন ইতিপূৰ্ব্বে বহু পরিশ্রমসহকারে যুদ্ধ করিয়া অৰ্জ্জুনের শরে ক্ষতবিক্ষত হইয়াছিলেন। এক্ষণে অর্জ্জুনকে নিহত দর্শন করিবামাত্র তিনিও মোহাবিষ্ট হইয়া ধরাতলে নিপতিত হইলেন।