পাণ্ডবনির্ব্বাসনে ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়খেদোক্তি
বৈশম্পায়ন কহিলেণ, পাণ্ডবেরা দ্যূতক্রীড়ায় পরাজিত হইয়া বনে গমন করিলে পর ধৃতরাষ্ট্র দুঃখিত হইয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক একাগ্রচিত্তে চিন্তা করিতেছেন, ইত্যবসরে সঞ্জয় আসিয়া কহিলেন, “মহারাজ! আপনি পাণ্ডবদিগকে বহিস্কৃত করিয়া সসাগরা বসুন্ধরার অধীশ্বর হইয়াছেন, অতএব বিষাদের কারণ কি?” ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “মহারথ মহাবীর যুদ্ধবিশারদ পাণ্ডবগণের সহিত যাহাদের শক্রতা তাহাদের নির্বিষাদ স্বপ্নের অগোচর।” তখন সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! আপনারই অদৃষ্টক্রমে এই মহতী শক্ৰতা সমুপস্থিত হইয়াছে, তাহাতে অনবরত লোক বিনাশ হইবে। যৎকালে আমার পুত্ৰ দুৰ্য্যোধন পাণ্ডবসহধর্মিণী দ্রৌপদীকে সভামধ্যে আনয়ন করিবার পরামর্শ করে; মহাত্মা ভীষ্ম ও দ্রোণ ও বিদুর তাহাকে বার বার নিষেধ করিয়াছিলেন। দুরাত্মা তাঁহাদের বাক্যে কৰ্ণপাত না করিয়া পাঞ্চালীকে আনয়ন করিতে আদেশ দিয়া প্ৰাতিকামী সূতপুত্রকে প্রেরণ করিল। দেবগণ যাহাকে পরাভব করিতে বাঞ্ছা করেন, ক্ৰমে তাহার বুদ্ধিভ্রংশ হয়, সে ইতিকর্তব্যতা বিমূঢ় হইয়া যায়। বুদ্ধি কলুষিত ও বিনাশ সমুপস্থিত হইলে পর অন্যায় ন্যায়ের ন্যায়, অনৰ্থ অর্থের ন্যায় ও অর্থ অনর্থের ন্যায় বোধ হইতে থাকে। কাল স্বয়ং দণ্ড উদ্যত করিয়া কাহারও মস্তক চুৰ্ণ করেন না; তাহার প্রভাবেই লোকে বিপরীত-বুদ্ধি হইয়া উৎপন্ন হয়। দুরাত্মা সভামধ্যে পাঞ্চালীর কেশাকর্ষণ করিয়া এই অতি ভয়ানক তুমুলকাণ্ড সমুপস্থিত করিয়াছে। অসামান্য রূপলাবণ্যসম্পন্না, সর্ব্বধর্ম্মজ্ঞা, যশস্বিনী, অযোনিজ, সূৰ্য্যবংশসম্ভূতা দ্ৰৌপদীকে সভামধ্যে আনয়ন করিতে দুরাত্মা দ্যূতাসক্ত প্ৰবঞ্চক ব্যতীত আর কাহার সাহস হয়? রাজস্বলা, শোণিতপরিপ্লুতা দ্রুপদনন্দিনী সেই সময় পাণ্ডবগণের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়াছিলেন। তাঁহারা তৎকালে হৃতরাজ্য, হৃতবন্ত্র, হৃতশ্ৰীক, সর্ব্বকামবিহীন ও দাসভাবাপন্ন হইয়াছিলেন; কি করেন, সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়াও ধর্ম্মরক্ষানুরোধে অগত্যা বলবিক্রমপ্রকাশে ঔদাসীন্য অবলম্বন করিলেন। দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন ও কর্ণ সেই মহাত্মা পাণ্ডবগণ ও দ্রুপদতনায়াকে কটুক্তি করিতে লাগিল। হে মহারাজ! এই সমুদয় নিতান্ত অনর্থের মূল বোধ হইতেছে।”
সঞ্জয়বাক্যে ধৃতরাষ্ট্রের নির্ব্বেদ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, হে সঞ্জয়! পতিব্ৰতা দ্রুপদনন্দিনী দুঃখিতন্তঃকরণে দীননয়নে নিরীক্ষণ করিলে সমস্ত মেদিনীমণ্ডল দগ্ধ হইয়া যায়; বোধ হয়, অদ্য আমার পুত্ৰগণ একেবারে বিধ্বস্ত হইল। ধর্ম্মচারিণী, রূপযৌবনশালিনী, পাণ্ডবপ্রণয়িনী পাঞ্চালরাজনন্দিনীকে সভায় সমাগত দেখিয়া গান্ধারী প্রভৃতি ভরতবংশীয় মহিলাগণ ও সমুদয় প্ৰজাগণ উচ্চৈঃস্বরে ক্ৰন্দন করিয়াছিল। তাহারা প্রত্যহই দ্রৌপদীর নিমিত্ত অনুশোচনা করে। জনপদনিবাসী ব্ৰাহ্মণগণ পাঞ্চালীর কেশাকর্ষণ দর্শনে যৎপরোনাস্তি ক্রুদ্ধ হইয়া সায়াহ্নে অগ্নিহোত্রে হোম করেন নাই। তৎকালে মহাঘোর নির্ঘাতশব্দ, উল্কাপাত, সূর্য্যগ্ৰহণ প্রভৃতি সমূহ অমঙ্গল উপস্থিত হইতে লাগিল; প্ৰজাগণের অন্তঃকরণে অকারণে মহাভয় উপস্থিত হইল; হঠাৎ রথশালা দগ্ধ হইতে লাগিল; কুরুকুলক্ষয়ের নিমিত্ত ধ্বজ-সমুদয় ভগ্ন হইয়া ভূমিসাৎ হইল; শৃগাল-সকল দুৰ্য্যোধনের অগ্নিহোত্ৰ-গৃহমধ্যে ভয়ানক স্বরে চীৎকার করিতে লাগিল এবং গর্দভগণ চতুর্দিকে শব্দ করিতে লাগিল। মহামতি ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, সোমদত্ত ও বাহ্লীক তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। তখন আমি বিদুরের পরামর্শানুসারে দ্ৰৌপদীকে তাহার অভিলষিত বর প্রার্থনা করিতে কহিলাম; পাঞ্চালীও আমার নিকট সরথ সশরাসন পাণ্ডবগণের অদাসত্বরূপ বর লইলেন।
হে সঞ্জয়! তদনন্তর সর্ব্বধর্ম্মবিৎ বিদুর আমাকে কহিলেন যে, পাঞ্চালরাজনন্দিনী কৃষ্ণা সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। ইনি যখন সভামধ্যে আনীত হইয়াছেন, তখন আর নিস্তার নাই; কুরুবংশের এই পৰ্য্যন্ত শেষ হইল। ঐ দেখ, পাঞ্চালী পাণ্ডবগণের সহিত গমন করিতেছেন; উহার এতাদৃশ ক্লেশ দর্শন করিয়া পাণ্ডবেরা কখনই ক্ষান্ত থাকিতে পরিবেন না। বৃষ্ণি ও মহারথ পাঞ্চালগণ সত্যসন্ধ বাসুদেব কর্তৃক সুরক্ষিত। অর্জ্জুন পাঞ্চালগণে পরিবৃত হইয়া আসিবেন এবং মহাবল-পরাক্রান্ত ভীমসেন তাহাদিগের মধ্যে যমদণ্ডের ন্যায়। গদা ঘূর্ণন করিতে করিতে আগমন করিবেন। তখন ভূপতিগণ কখনই অর্জ্জুনের গাণ্ডীবনিৰ্ঘোষ ও ভীমের ভীম গদা বেগ সহ্য করিতে পরিবেন না। অতএব আমার মতে পাণ্ডবগণের সহিত বিগ্ৰহ অপেক্ষা সন্ধি করাই শ্ৰেয়ঃ। পাণ্ডবগণ কৌরবগণ অপেক্ষা অধিকতর বলবান, একাকী ভীমসেন মহাবলপরাক্রান্ত মহারাজ জরাসন্ধকে বাহুযুদ্ধে সংহার করিয়াছেন। অতএব হে মহারাজ! আপনি পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধি করুন; নিঃশঙ্কচিত্তে উভয় পক্ষ যোগ করিয়া দিন; ইহা করিলে আপনার শ্ৰেয়োলাভ হইবে।” হে সঞ্জয়, বিদুর আমাকে এই ধর্ম্মার্থসংযুক্ত উপদেশ-বাক্য কহিয়াছিলেন, কিন্তু আমি পুত্ৰগণের হিতচিকীৰ্ষায় তখন তাহার সেই উপদেশ, গ্রহণ করিলাম না।”
অনুদৃতপর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত
সভাপর্ব্ব সমাপ্ত