বনবাসে উদ্যতা দ্রৌপদীর প্রতি কুন্তীর উপদেশ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, যুধিষ্ঠির প্রস্থান করিলে পর দ্রৌপদী বিষঃ-মনে পৃথসন্নিধানে উপনীত হইয়া তাঁহাকে এবং তত্ৰত্য অন্যান্য প্রমদাদিগকে যথাৰ্থ বন্দনা ও আলিঙ্গনপূর্ব্বক স্বামীর অনুগমনের প্রার্থনা করাতে পাণ্ডবান্তঃপুরে মহান আর্তনাদ হইতে লাগিল। কুন্তী দ্রৌপদীকে গমনোদ্যতা দেখিয়া শোকে বিহ্বলা ও সাতিশয় কাতরা হইয়া গদগদম্বরে অতিকষ্টে কহিলেন, “বৎসে! দুঃখ উপস্থিত হইয়াছে বলিয়া শোক করিও না, তুমি স্ত্রীধর্ম্মভিজ্ঞ, সুশীলা, সাধ্বী ও সদাচারব্ৰতী, তোমার গুণে উভয় কুল অলঙ্কৃত হইয়াছে, অতএব স্বামীর প্রতি কিরূপ ব্যবহার করিতে হয়, তাহা তোমাকে উপদেশ দিবার আবশ্যক নাই। হে অনঘে! কৌরবেরা পরম ভাগ্যবান, যেহেতু তোমার কোপানলে তাহারা দগ্ধ হয় নাই। বৎস্যে! আমি সর্ব্বদাই তোমার শুভানুধ্যান করিতেছি; তুমি স্বচ্ছন্দে গমন কর; পথে কিছুমাত্ৰ অমঙ্গল হইবে না। ভবিতব্যতা অখণ্ডনীয় জানিয়া বুদ্ধিমতী স্ত্রীর চিত্ত কখনই বিকৃত হয় না; তুমি গুরুজন ও ধর্ম্ম র্কৃক পরিরক্ষিত হইয়া অচিরপূর্ব্বক শ্রেয়োলাভ করিবে সন্দেহ নাই। বনে সর্ব্বদা যত্নপূর্ব্বক সহদেবের রক্ষণাবেক্ষণ করিও; তিনি যেন এই দুঃসহ দুঃখ পাইয়া বিষণ্ন না হয়েন।” মুক্তবেণী দ্রৌপদী “যে আজ্ঞা’ বলিয়া শোণিতাক্ত একমাত্র বস্ত্ৰ পরিধানপূর্ব্বক অবিরল- বিগলিত- জলধারাকুল- লোচনে অনাথার ন্যায় প্রস্থান করিলেন।
পুত্ৰাদির বনবাসে কুন্তীর বিলাপ
দৌপদী অশ্রুমুখী হইয়া দীনহীনের ন্যায় গমন করিতেছেন দেখিয়া পৃথা দুঃখে তাঁর পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন, কিয়দ্দূর গমন করিয়া দেখিলেন যে, তাহার পুত্রেরা বস্ত্রাভরণবিহীন; মৃগচর্ম্ম পরিধান করিয়া লজ্জানম্রমুখে গমন করিতেছেন; শত্রুবর্গ হৃষ্টচিত্তে চতুর্দিক বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে এবং বন্ধুবান্ধবগণ শোকার্ত হইয়া বিলাপ ও পরিতাপ করিতেছেন। পুত্রবৎসলা কুন্তী ও পুত্ৰদিগকে তদাবস্থ নিরীক্ষণ করিয়া তাঁহাদিগের সমীপস্থ হইয়া আলিঙ্গনপূর্ব্বক নানাপ্রকার বিলাপ ও পরিতাপপূর্ব্বক কহিলেন, “হায়, কি বিধিবিপৰ্য্যয়; যাহারা ভ্ৰমেও অধর্ম্মপথে পদার্পণ করে নাই, সর্ব্বদা যাগ-যজ্ঞের অনুষ্ঠানে তৎপর, অকপট ভক্তিসহকারে দেবাৰ্চনা করে, উদারস্বভাব ও সচ্চরিত্রের অগ্রগণ্য, তাহাদিগের এই বিষয় ব্যাসন উপস্থিত হইল; এক্ষণে কাহাকে অপরাধী করিব, আমারই ভাগ্যদোষ বলিতে হইবে। আমি অতি হতভাগিনী; আমার গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছ, এই নিমিত্ত অশেষগুণালঙ্কৃত হইলেও তোমাদিগকে এই দুঃসহ দুঃখ ও অসহ্য ক্লেশ ভোগ করিতে হইল। তোমরা অসাধারণ বল, বীৰ্য্য তেজ ও উৎসাহসম্পন্ন হইয়া দীনহীনের ন্যায় কিরূপে দুৰ্গম বনস্থলীতে বাস করিবে? যদ্যপি পূর্ব্বে জানিতে পারিতাম যে তোমাদিগকে বনবাস করিতে হইবে, তাহা হইলে পাণ্ডুর মরণানন্তর আর আমরা বারণাবতে প্রত্যাগমন করিতাম না। তোমাদিগের পিতাই ধন্য, তাহাকে এই দুর্বিষহ যন্ত্রণা সহ্য করিতে হইল না; তিনি পরমসুখে স্বৰ্গারোহণ করিয়াছেন এবং সেই অতীন্দ্ৰিয়জ্ঞানসম্পন্ন মাদ্রীও পরম ধন্যা, যেহেতু, তাহাকেও পুত্রদিগের দুরবস্থা সন্দর্শন করিতে হইল না। আমি অতি পাপীয়সী, মাদৃশ হতভাগিনী রমণী ধরণীতলে আর কেহই নাই; আমার জীবিত তৃষ্ণায় ধিক, অদৃষ্ট যে কত ক্লেশ আছে কিছুই বলিতে পারি না। হে পুত্ৰগণ! আমি বহুকষ্টে তোমাদিগকে লাভ করিয়াছি, তোমরা আমার প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয়তম, আমি তোমাদিগের সহিত বনে গমন করিব, তথাপি এমন সৎপুত্ৰদিগকে কখনই পরিত্যাগ করিতে পারিব না। হা বৎসে দ্রৌপদী! তুমিও কি আমাকে পরিত্যাগ করিবে? বুঝি, বিধাতা আমার নশ্বর জীবন ধারণের অন্ত-বিধান করিতে বিস্মৃতি হইয়াছেন, নতুবা এখনও কেন জীবিত রহিয়াছি? হা কৃষ্ণ । তুমি কোথায় রহিলে? শীঘ্র আমাদিগকে পরিত্রাণ কর, তুমি সকলের ত্ৰাণকর্তা, এই নিমিত্ত লোকে বিপদে পতিত হইলে ভক্তিভাবে তোমাকে স্মরণ করে, অতএব দেখিও, যেন তোমার বিপদভঞ্জন নামে কলঙ্ক হয় না। পাণ্ডবেরা পরম ধার্মিক, ইহারা দুঃখ-ভোগ করিবার উপযুক্ত নহে, উহাদিগের প্রতি করুণা প্রকাশ কর। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচাৰ্য্য প্রভৃতি নীতিবিশারদ ব্যক্তিসকল থাকিতে কেন এমন বিপদ উপস্থিত হইল? হা মহারাজ পাণ্ডো! তুমি কোথায় রহিয়াছ? বিপক্ষেরা তোমার নিরপরাধ পুত্রদিগকে কপটদ্যূতে পরাজিত করিয়া নির্ব্বাসিত করে। নাথ! এমন সময়ে কি উপেক্ষা করা উচিত? বৎস সহদেব! তুমি নিবৃত্ত হও, কুপুত্রের ন্যায় আমাকে পরিত্যাগ করিও না, তোমাকে না দেখিলে আমি ক্ষণকালও জীবনধারণা করিতে পারিব না। যদি তোমার ভ্রাতারা সত্যকেই পরমধর্ম্ম বিবেচনা করিয়া থাকেন তাঁহারা গমন করুন, তুমি নিকটে থাকিয়া আমার পরিত্ৰাণ কর, তাহা হইলে এই স্থানেই অনুত্তম ধর্ম্ম প্রাপ্ত হইবে।”
পাণ্ডব-বনযাত্রা-বিদুরগৃহে কুন্তীর অবস্থান
পুত্ৰবৎসল কুন্তী এইরূপ বিলাপ ও পরিতাপ করিতে লাগিলেন, পাণ্ডবেরা তাঁহাকে অভিবাদনপূর্ব্বক অরণ্যাভিমুখে প্রস্থান করিলেন। বিদুর পাণ্ডবদিগের শোকে অত্যন্ত কাতর হইয়া
তাঁহাকে অন্তঃপুরে প্রবেশ করাইলেন। ধৃতরাষ্ট্রের পত্নীগণ কৃষ্ণার বনপ্রয়াণ ও দ্যূতমণ্ডলে তাহার কেশাকর্ষণ-বৃত্তান্ত সমস্ত অবগত হইয়া কৌরবদিগকে নিন্দা করিয়া মুক্ত-কণ্ঠে রোদন করিতে লাগিলেন এবং কপালে করাপণ করিয়া অনেকক্ষণ চিন্তা করিলেন। তখন রাজা ধৃতরাষ্ট্র পুত্রদিগের অন্যায়াচরণ সবিশেষ পৰ্য্যালোচনা করিয়া সাতিশয় উদ্বিগ্ন হইলেন। তিনি শোকাকুল ও ইতিকর্তব্যতা বিমূঢ় হইয়া শীঘ্ৰ বিদুর সন্নিধানে দূত প্রেরণ করিলেন। অনন্তর বিদুর ধৃতরাষ্ট্র-সদনে উপনীত হইলে রাজা উদ্বিগ্নচিত্তে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন।