৭৩তম অধ্যায়
যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞদীক্ষা—অর্জ্জুনের দিগ্বিজয় যাত্রা
বৈশম্পায়ন বলিলেন, অনন্তর দীক্ষাকাল সমুপস্থিত হইলে। পুরোহিতগণ ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে অশ্বমেধযজ্ঞে দীক্ষিত করিলেন। তখন তিনি ঋত্বিকগণের সহিত একত্র উপবেশন করিয়া প্রদীপ্ত পাবকের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। ঐ সময় ধৰ্ম্মরাজ সুবর্ণমাল্য, কৃষ্ণাজিন, দণ্ড ও ক্ষৌমবস্ত্র ধারণ করাতে তাঁহাকে যজ্ঞদীক্ষিত প্রজাপতির ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। তাঁহার ঋত্বিক্গণ ও মহাবীর অর্জ্জুনও তাঁহার তুল্য বেশভূষা ধারণ করিয়া হুত হুতাশনের ন্যায় শোভমান হইলেন। অনন্তর মহাত্মা বেদব্যাস শাস্ত্রানুসারে যজ্ঞীয় অশ্ব উন্মুক্ত করিয়া দিলেন। তখন অৰ্জ্জুন অশ্বের অনুগমনে উদ্যত হইয়া তাহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “অশ্ব! তোমার মঙ্গললাভ হউক, তুমি এক্ষণে নির্ব্বিঘ্নে গমন কর; অচিরাৎ এই স্থানে প্রত্যাগমন করিও।” মহাবীর ধনঞ্জয় এই বলিয়া ধৰ্ম্মরাজের আদেশানুসারে অঙ্গুলি ধারণপূর্ব্বক গাণ্ডীব শরাসন কম্পিত করিয়া মহাহ্লাদে সেই অশ্বের অনুগমন করিতে লাগিলেন।
ঐ সময় হস্তিনা-নগরস্থ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই সেই যজ্ঞীয় অশ্ব ও অর্জ্জুনকে দর্শন করিবার নিমিত্ত তথায় আগমন করিল। তাহাদিগের গাত্রসংমর্দ্দে দারুণ উত্তাপ সমুন্থিত এবং কোলাহলে দিঙ্মণ্ডল ও আকাশমণ্ডল প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। ঐ সময় উহারা “ঐ অশ্ব গমন করিতেছে, ঐ ধনঞ্জয় গাণ্ডীব ধারণ করিয়া উহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতেছেন; মহাবীর অর্জ্জুন ঘোটকের সহিত নির্ব্বিঘ্নে গমন ও প্রত্যাগমন করুন” বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিল। কেহ কেহ কহিল, “অত্যন্ত জনতা হওয়াতে আমরা অর্জ্জুনকে দেখিতে পাইতেছি না; উহার সৰ্ব্বলোকবিশ্রুত ভীমনিনাদ [ভীষণ শব্দযুক্ত] গাণ্ডীব-শরাসনই আমাদের দৃষ্টিগোচর হইতেছে। পথিমধ্যে উহার ও ঐ অশ্বের যেন কোন বিপদ না হয়। উনি নিশ্চয়ই অশ্ব লইয়া নির্ব্বিঘ্নে প্রত্যাগমন করিবেন, তখন আমরা উহাকে দর্শন করিব।”
উদারবুদ্ধি মহাবীর ধনঞ্জয় পুরবাসী স্ত্রী-পুরুষদিগের এইরূপ মধুর বাক্য শ্রবণ করিতে করিতে গমন করিতে লাগিলেন। যাজ্ঞবল্ক্যর একটি বেদপারদর্শী শিষ্য ধনঞ্জয়ের শান্তিকার্য্যের নিমিত্ত তাঁহার সমভিব্যাহারে গমন করিলেন এবং অন্যান্য বেদপারদর্শী ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়গণ ধৰ্ম্মরাজের আদেশানুসারে তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন।
অনন্তর সেই যজ্ঞীয় অশ্ব প্রথমতঃ উত্তরদিকে গমন করিয়া অসংখ্য রাজ্য বিমর্পিত করিতে করিতে পূৰ্ব্বদিকে গমন করিল। মহাত্মা অৰ্জ্জুনও ক্রমে ক্রমে পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। ঐ সময়ে যে কত শত নরপতি ধনঞ্জয়ের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া নিহত হইলেন, তাহার আর ইয়ত্তা নাই। পূৰ্ব্বে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কিরাত, যবন, ম্লেচ্ছ ও আর্য্য প্রভৃতি যে সমুদয় ধনুর্দ্ধর পরাজিত হইয়াছেন, এক্ষণে তাহারা সকলেই অর্জ্জুনের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন। এইরূপে নানাদেশসমাগত নরপতিদিগের সহিত অৰ্জ্জুনের অনেক যুদ্ধ হইয়াছিল, কিন্তু তিনি ঐ সমুদয় যুদ্ধে কিছুমাত্র ক্লেশভোগ করেন নাই। অতঃপর যে যে যুদ্ধ উভয়পক্ষের সন্তাপকর হইয়াছিল, সেই ঘোরতর সংগ্রামসমুদয়ের কথা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।