৭৩তম অধ্যায়
অর্জ্জুনের যুদ্ধযাত্রা শুভ লক্ষণ প্রকাশ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! মহাবীর ধনঞ্জয় এইরূপে প্রহৃষ্টমনে ধর্ম্মরাজকে প্রসন্ন করিয়া সূতপুত্রের বধাভিলাষে বাসুদেবকে কহিলেন, সখে! তুমি পুনরায় আমার রথ সুসজ্জিত এবং উহাতে অশ্বসকল সংযোজিত ও সমুদয় অস্ত্রশস্ত্র সন্নিবেশিত কর। সুশিক্ষিত অশ্বসকল শ্ৰমাপনোদনের [যুদ্ধশ্রম দূরীকরণের] নিমিত্ত ভূপৃষ্ঠে বারংবার বিলুণ্ঠিত হইতেছে। এক্ষণে উহাদিগকে সুসজ্জিত করিয়া শীঘ্র আনয়ন কর এবং সূতপুত্রকে সংহার করিবার নিমিত্ত অবিলম্বে আমাকে রণস্থলে লইয়া চল।
“মহাত্মা ধনঞ্জয় এইরূপ কহিলে মহামতি বাসুদেব স্বীয় সারথি দারুককে আহ্বানপূর্ব্বক তাঁহাকে অর্জ্জুনের বাক্য অবিকল বলিয়া অবিলম্বে রথানয়নে আদেশ করিলেন। দারুক বাসুদেবের আদেশ প্রাপ্ত হইবামাত্র তৎক্ষণাৎ রথে অশ্ব সংযোজনপূর্ব্বক মহাত্মা অর্জ্জুনকে সংবাদ প্রদান করিলেন। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় রথ সংযোজিত হইয়াছে দেখিয়া ধর্ম্মরাজকে আমন্ত্রণপূর্ব্বক উহাতে আরোহণ করিলেন। ব্রাহ্মণগণ তাঁহার স্বস্তিবাচন ও রাজা যুধিষ্ঠির তাঁহাকে আশীর্ব্বাদ করিতে লাগিলেন। অনন্তর মহাবীর ধনঞ্জয় সূতপুত্রের রথাভিমুখে গমন করিতে আরম্ভ করিলেন। সকলে তাঁহাকে মহাবেগে ধাবমান দেখিয়া সূতপুত্রকে নিহত বলিয়া বোধ করিল। ঐ সময় সমুদয় দিগবিদিক্ নির্ম্মল হইল, চাস [স্বর্ণচাতক-সোনাচাতক], শতপত্র ও ক্রৌঞ্চপক্ষিগণ অর্জ্জুনকে প্রদক্ষিণ করিতে লাগিল; পুংনামক মঙ্গলজনক বিহঙ্গমগণ ধনঞ্জয়কে যুদ্ধে ত্বরা প্রদর্শনপূর্ব্বক হৃষ্টচিত্তে শব্দ করিতে প্রবৃত্ত হইল। নিতান্ত ভীষণদর্শন গৃধ্র, শ্যেন ও বায়সগণ মাংসলোলুপ হইয়া অৰ্জ্জুনের অগ্রে অগ্রে গমনকরতঃ অর্জ্জুনের অরিসৈন্যবিনাশ ও সূতপুত্রসংহাররূপ শুভ নিমিত্ত সূচিত করিতে লাগিল।
কৃষ্ণের যুদ্ধিবিষয়ক উপদেশ
“হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর ধনঞ্জয় সংগ্রামস্থলে গমন। করিতে আরম্ভ করিলে, তাঁহার কলেবর হইতে অনবরত স্বেদজল নির্গত হইল এবং তিনি কিরূপে এই দুষ্কর কার্য্য সম্পাদন করিবেন, মনে মনে তাহারই আন্দোলন করিতে লাগিলেন। তখন মধুসূদন ধনঞ্জয়কে চিন্তায় আক্রান্ত নিরীক্ষণ করিয়া কহিলেন, সখে! গাণ্ডীবপ্রভাবে তুমি যাহাদিগকে পরাজয় করিয়াছ, তোমা ভিন্ন অন্য কোন মনুষ্যই তাহাদিগকে জয় করিতে সমর্থ নহে। দেবরাজসদৃশ বলবীৰ্য্যসম্পন্ন বহুসংখ্যক বীর তোমার সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়া পরম গতি লাভ করিয়াছেন। তোমা ভিন্ন অন্য কোন বীর ভীষ্ম, দ্রোণ, ভগদত্ত, শ্রুতায়ু, অচ্যুতায়ু, কাম্বোজদেশীয় সুদক্ষিণ এবং অবন্তিদেশীয় বিন্দ ও অনুবিন্দের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া শ্ৰেয়োলাভে সমর্থ হয়? তোমার দিব্য অস্ত্র, হস্তলাঘব, বাহুবল, যুদ্ধে অসম্মোহ, বিজ্ঞান, দৃঢ়ভেদিতা, লক্ষ্যে অঙ্খলন ও প্রহারবিষয়ে সবিশেষ নিপুণতা আছে। তুমি দেবগন্ধর্ব্বসমবেত সমুদয় স্থাবরজঙ্গমাত্মক ভূত বিনাশ করিতে পার। এই পৃথিবীতে তোমার তুল্য যোদ্ধা আর নাই। অধিক কি, সমরদুর্ম্মদ ধনুর্দ্ধর ক্ষত্রিয়গণের কথা দূরে থাকুক, দেবতাদিগের মধ্যেও তোমার তুল্য বীর কখন শ্রবণ বা দর্শনগোচর হয় নাই। সর্ব্বলোকস্রষ্টা পিতামহ গাণ্ডীবশরাসন নির্ম্মাণ করিয়াছেন। তুমি সেই গাণ্ডীব লইয়া যুদ্ধ করিতেছ; অতএব তোমার অনুরূপ বীর আর কেহই নাই। যাহা হউক, তোমার যাহা হিতকর, তাহা নির্দেশ করা আমার অবশ্য কর্ত্তব্য। হে মহাবাহো! তুমি কর্ণকে অবজ্ঞা করিও না। মহারথ সূতপুত্র মহাবলপরাক্রান্ত, নিতান্ত গর্ব্বিত, সুশিক্ষিত, কাৰ্য্যকুশল, বিচিত্র যোদ্ধা ও দেশকালকোবিদ। আমি এক্ষণে সংক্ষেপে তাহার গুণের বিষয় কহিতেছি, শ্রবণ কর। ঐ বীর আমার মতে তোমার তুল্য বা তোমা অপেক্ষা সমধিক বলশালী হইবে, সন্দেহ নাই। অতএব পরম যত্নসহকারে তাহাকে সংহার করা তোমার কর্ত্তব্য। ঐ মহাবীর তেজে হুতাশনসঙ্কাশ, বেগে বায়ুসদৃশ ও ক্রোধে অন্ততুল্য; ঐ বিশালবাহুশালী বীরবরের দৈর্ঘ্য আট অরত্নি [তিনপোয়া হাতে এক অরত্নি] পরিমিত; বক্ষঃস্থল অতি বিস্তৃত এবং সে নিতান্ত দূর্জয়, অভিমানী, প্রিয়দর্শন, যোধগণে সমলঙ্কৃত, মিত্রগণের অভয়প্রদ, পাণ্ডবগণের বিদ্বেষী ও ধাৰ্তরাষ্ট্রদিগের হিতানুষ্ঠাননিরত আমার বোধ হইতেছে, এক্ষণে তোমা ব্যতিরেকে অন্য কেহই ঐ মহাবীরকে বিনাশ করিতে সমর্থ নহেন, অতএব তুমি অদ্য তাহাকে বিনাশ কর। ইন্দ্রাদি সমুদয় দেবতা মিলিত হইয়াও যত্নসহকারে ঐ মহারথকে বিনাশ করিতে পারিবেন না। হে ধনঞ্জয়! সূতপুত্র অতিশয় দুরাত্মা, পাপস্বভাব, ক্রুর ও তোমাদিগের প্রতি বিদ্বেষবুদ্ধিসম্পন্ন; সে এক্ষণে অকারণ তোমাদিগের সহিত এইরূপ বিরোধ করিতেছে; অতএব তুমি অবিলম্বে তাহাকে বিনাশ করিয়া কৃতকার্য্য হও। ঐ দুরাত্মাকে পরাজয় করে, এমন আর কেহই নাই; অতএব তুমি তাহাকে সংহার করিয়া ধর্ম্মরাজের প্রতি প্রীতি প্রদর্শন কর। দুরাত্মা সূতপুত্র বলদৰ্পে গর্ব্বিত হইয়া সতত পাণ্ডবগণকে অপমান করিয়া থাকে। পাপপরায়ণ দুৰ্য্যোধনও উহার বীৰ্য্যপ্রভাবে আপনাকে মহাবীর বলিয়া বিবেচনা করে। অতএব আজ তুমি সেই শরশাসন খড়্গধারী, গর্ব্বিতস্বভাব, পাপকাৰ্য্যের মূলস্বরূপ সূতপুত্রকে বিনাশ করিয়া আমার প্রতিভাজন হও। আমি তোমার বলবীৰ্য্য সম্যক অবগত আছি, এক্ষণে দুৰ্য্যোধন যাহার ভুজবীৰ্য্য আশ্রয় করিয়া তোমার বলবীর্য্যে অনাদর প্রদর্শন করিয়া থাকে, তুমি সেই সূতপুত্রকে কেশরী যেমন মাতঙ্গকে বিনাশ করে, তদ্রূপ অচিরাৎ সংহার কর।”