৭১তম অধ্যায়
যুধিষ্ঠির-প্রতি পার্থের “তুমি” শব্দ প্রয়োগ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অর্জ্জুন বাসুদেবকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া তাঁহার বাক্যের প্রশংসা করিয়া পরুষবাক্যে ধর্ম্মরাজকে কহিতে লাগিলেন, ‘হে রাজন! তুমি রণস্থল হইতে একক্রোশ অন্তরে অবস্থান করিতেছ; অতএব আমাকে তিরস্কার করা তোমার কর্ত্তব্য নহে। মহাবলপরাক্রান্ত শত্ৰুসূদন ভীমসেন কৌরবপক্ষীয় বীরগণের সহিত যুদ্ধ করিতেছেন, তিনিই আমাকে তিরস্কার করিতে পারেন। ঐ মহাবীর অসংখ্য রথী, গজারোহী ও অশ্বারোহী মহীপালগণকে নিপীড়িত ও নিপাতিত করিয়া মৃগনিহন্তা সিংহের ন্যায় বহু সহস্র কুঞ্জর এবং অযুত কাম্বোজ ও পাৰ্বতীয়কে সংহারপূর্ব্বক তোমার অসাধ্য অতি দুষ্কর কার্য্য সম্পাদন করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতেছেন। উনি ইন্দ্র, যম ও কুবেরের ন্যায় প্রভাবশালী। ঐ মহাবীর রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া গদা ও খড়্গের আঘাতে চতুরঙ্গিণী সেনা নিপাতিত করিয়া হস্তপদের আঘাতে অসংখ্য অরাতির প্রাণসংহার করিতেছেন এবং রথে আরোহণপূর্ব্বক শাসননিম্মুক্ত শরনিকরে শত্রুগণকে সহসা দগ্ধ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। ঐ মহাবীর একাকী দুর্য্যোধনের চতুরঙ্গবল প্ৰমথিত করিয়া নীলমেঘসদৃশ কলিঙ্গ, বঙ্গ, অঙ্গ, নিষাদ, মাগধ ও অন্যান্য শত্রুগণের প্রাণসংহার এবং যথাসময়ে রথে আরোহণপূর্ব্বক জলধারাবর্ষী জলদের ন্যায় শরবর্ষণ করিতেছেন। অদ্য তাঁহার নিশিতশরে. অষ্টশত গজ নিপাতিত হইয়াছে। অতএব সেই বীরই আমাকে তিরস্কার করিতে পারেন। কিন্তু তুমি সতত সুহৃগণকর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়া থাক; সুতরাং আমার নিন্দা করা তোমার কদাচ কৰ্ত্তব্য নহে। হে রাজন্! পণ্ডিতেরা দ্বিজগণের বাক্যবল ও ক্ষত্রিয়গণের বাহুবল প্রকৃষ্ট বলমধ্যে নির্দ্দিষ্ট করিয়াছেন। তুমি ক্ষত্রিয় হইয়াও বাক্য প্রকাশ করিয়া নিতান্ত নিষ্ঠুরের ন্যায় আমাকে বলহীন করিতেছ। সত্যসন্ধ পিতামহ তোমার প্রিয়কামনায় স্বয়ং আপনার মৃত্যুর উপায় নির্দেশ করাতে দ্রুপদনন্দন মহাবীর শিখণ্ডী সেই মহাত্মাকে নিপাতিত করিয়াছেন। শিখণ্ডী ভীষ্মের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলে আমিই তাহাকে রক্ষা করিয়াছিলাম; নচেৎ দ্রুপদতনয় কদাপি পিতামহকে সংহার করিতে পারিতেন না। ফলতঃ আমি স্ত্রী, পুত্র, শরীর ও জীবন পর্যন্ত পণ করিয়া তোমার হিতার্থে যত্নবান্ রহিয়াছি; তথাপি তুমি আমাকে বাক্যবাণে নিপীড়িত করিতেছ। আমি তোমার নিমিত্ত মহারথগণকে নিহত করিতেছি, কিন্তু তুমি নিঃশঙ্কচিত্তে দ্রৌপদীর শয্যায় শয়ন করিয়া আমার অবমাননায় প্রবৃত্ত হইয়াছ। তুমি নিতান্ত নিষ্ঠুর। তোমার নিকট থাকিয়া কোনমতেই সুখী হইতে পারি না। হে রাজন! তুমি অক্ষক্রীড়ায় আসক্ত হইয়া স্বয়ং অসাধুব্যবহৃত ঘোরতর অধর্ম্মানুষ্ঠান করিয়া এক্ষণে আমাদিগের প্রভাবে অরাতিগণকে পরাজিত করিতে অভিলাষ করিতেছ; অতএব আমি তোমার রাজ্যলাভে সন্তুষ্ট নহি। সহদেব অক্ষক্রীড়াতে বহুতর দোষ ও অধর্ম্ম কীৰ্ত্তন করিয়াছিল, তথাপি তুমি তাহা পরিত্যাগ কর নাই; সেই নিমিত্তই আমরা এইরূপ পাপগ্রস্ত হইয়াছি। তুমি দ্যূতক্রীড়ায় মত্ত হইয়া স্বয়ং দুঃখোৎপাদনপূর্ব্বক অদ্য আমার প্রতি নিষ্ঠুর বাক্য প্রয়োগ করিতেছ; অতএব জানিলাম, তোমা হইতেই আমাদিগের কিছুমাত্র সুখলাভের প্রত্যাশা নাই। তোমার অপরাধেই শত্রুপক্ষীয় সৈনিকগণ আমাদিগের শরে নিহত হইয়া চীৎকার করিয়া ছিন্নগাত্রে ভূমিতলে পতিত হইতেছে। তোমা হইতেই কৌরবগণের বিনাশ উপস্থিত হইয়াছে। তোমার দোষেই উদীচ্য, প্রাচ্য, প্রতীচ্য ও দাক্ষিণাত্যগণ নিহত হইয়াছে এবং উভয়পক্ষীয় যোধগণ সমরে অদ্ভুত কার্য্য সম্পাদন করিয়া পরস্পরকে সংহার করিতেছে। হে রাজন্! তুমি দ্যূতক্রীড়ায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলে; তোমার নিমিত্তই আমাদের রাজ্যনাশ ও যারপরনাই দুঃখ উপস্থিত হইয়াছে, অতএব তুমি পুনরায় ক্রূরবাক্যদ্বারা আমাকে ব্যথিত করিও না।
“হে কুরুরাজ! ধর্ম্মভীরু, স্থিতপ্রজ্ঞ [স্থিরবুদ্ধি] সব্যসাচী ধর্ম্মরাজকে এইরূপ পরুষবাক্য শ্রবণ করাইয়া অল্পমাত্র পাপের অনুষ্ঠানপূর্ব্বক, নিতান্ত বিমনায়মান হইয়া অনুতাপ করিতে লাগিলেন এবং অবিলম্বেই দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক কোষ হইতে অসি নিষ্কাশন করিলেন। তখন বাসুদেব কহিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! তুমি কি নিমিত্ত পুনরায় এই আকাশসদৃশ শ্যামল অসি নিষ্কাশিত করিলে? তুমি অবিলম্বে তোমার অভিপ্রায় প্রকাশ কর; আমি তোমার প্রয়োজনসিদ্ধির সহজ উপায় উদ্ভাবন করিতেছি। মহাবীর ধনঞ্জয় বাসুদেবকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া তাঁহাকে কহিলেন, ‘হে কৃষ্ণ! আমি জ্যেষ্ঠভ্রাতার অবমাননা করিয়া নিতান্ত গর্হিত কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছি; অতএব এক্ষণে আত্মবিনাশ করিব।’ তখন পরমধাৰ্মিক বাসুদের অর্জ্জুনের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘হে পার্থ! তুমি রাজাকে এইরূপ দুর্ব্বাক্য কহিয়া আপনাকে মহাপাপে লিপ্ত জ্ঞান করিয়া আত্মবিনাশে উদ্যত হইয়াছ; কিন্তু আত্মহত্যা সাধুজনের সর্ব্বতোভাবে নিন্দনীয়। দেখ, যদি আজ তুমি খড়্গাঘাতে ধর্ম্মাত্মা জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে বিনাশ করিতে, তাহা হইলে তোমার ধর্ম্মভীরুতা কোথায় রহিত এবং তুমি পরিশেষেই বা কি করিতে? সূক্ষ্মধর্ম্ম অতিশয় দুরবগাহ; অজ্ঞ ব্যক্তি উহা কখনই সহসা বুঝিতে পারে না। হে অর্জ্জুন! তুমি আত্মঘাতী হইলে ভ্রাতৃবধ অপেক্ষা ঘোরতর নরকে নিপতিত হইবে। অতএব এক্ষণে স্বয়ং আপনার গুণকীর্ত্তন কর, তাহা হইলে তোমার আত্মবিনাশ করা হইবে।’
অর্জ্জুনের আত্মঘাত-অনুকল্প আত্মপ্রশংসা
“হে মহারাজ! তখন মহাত্মা ধনঞ্জয় বাসুদেবের বাক্য অনুমোদনপূর্ব্বক শরাসন অবনত করিয়া ধর্ম্মরাজকে কহিলেন, ‘হে রাজন! পিনাকপাণি মহাদেব ভিন্ন আমার তুল্য ধনুর্দ্ধর আর কেহই নাই। আমি তাঁহার অনুগৃহীত ও মহাত্মা। আমি ক্ষণকালমধ্যে এই স্থাবরজঙ্গমাত্মক জগৎ নষ্ট করিতে পারি। আমিই ভূপতিগণের সহিত সমুদয় পৃথিবী জয় করিয়া আপনার বশীভূত করিয়াছি। আমার পরাক্রমেই আপনার দিব্যসভা নির্ম্মিত ও সমাপ্তদক্ষিণ [দক্ষিণাদানদ্বারা সর্ব্বাঙ্গসুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত] রাজসূয়যজ্ঞ সুসম্পন্ন হইয়াছিল, আমার করে নিশিত শরনিকর ও জ্যাযুক্ত সশর শরাসন এবং পদদ্বয়ে রথ ও ধ্বজের চিহ্ন বর্ত্তমান রহিয়াছে; মাদৃশ ব্যক্তিকে সমরে পরাজিত করা কাহারও সাধ্য নহে। আমি কৌরবপক্ষীয় উদীচ্য, প্রতীচ্য, প্রাচ্য ও দাক্ষিণাত্যগণকে নিপাতিত করিয়াছি। সংশপ্তকগণের কিঞ্চিন্মাত্র অবশিষ্ট রহিয়াছে; বস্তুতঃ আমি কৌরবপক্ষের অর্ধাংশ সৈন্য ধ্বংস করিয়াছি। দেবসেনাসদৃশ বিক্রমসম্পন্ন কৌরবসৈন্যগণ আমার শরে নিহত হইয়া মরণশয্যায় শয়ন করিয়াছে। আমি অস্ত্রজ্ঞদিগকেই অস্ত্রদ্বারা বিনষ্ট করিয়া থাকি, এই নিমিত্তই সমুদয় লোককে ভস্মসাৎ করিতেছি না। এক্ষণে কৃষ্ণ ও আমি—আমরা উভয়ে জয়শীল ভীষণরথে আরোহণ করিয়া কর্ণবিনাশার্থ গমন করিতেছি। আপনি সুস্থির হউন। আমি অবশ্যই শরনিকরে কর্ণকে নিপাতিত করিব। অদ্য হয় কর্ণের মাতা পুত্রহীন হইবে, না হয় আমার মৃত্যুনিবন্ধন জননী কুন্তী নিতান্ত বিষন্ন হইবেন। হে ধর্ম্মরাজ! আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, অদ্য কর্ণকে নিপাতিত না করিয়া কদাচ কবচ পরিত্যাগ করিব না।
“হে কুরুরাজ! মহাত্মা অর্জ্জুন ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে এইরূপ কহিয়া শরাসন ও শস্ত্র পরিত্যাগ এবং অসি কোষমধ্যে সংস্থাপনপূর্ব্বক লজ্জায় অধোমুখ হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, ‘হে মহারাজ! আমি আপনাকে নমস্কার করিতেছি। আপনি প্রসন্ন হইয়া আমাকে ক্ষমা করুন। আমি কি নিমিত্ত আপনাকে এরূপ কহিলাম, তাহা আপনি পরিণামে বুঝিতে পারিবেন। হে মহারাজ! সূতপুত্র আমার সহিত সংগ্রামার্থ আগমন করিতেছে। আমি অচিরাৎ তাহাকে সংহার করিব। আমি কেবল আপনার হিতসাধনার্থ জীবনধারণ করিয়াছি। এক্ষণে ভীমসেনকে সমর হইতে মুক্ত ও সূতপুত্রকে বিনষ্ট করিতে চলিলাম। মহাত্মা ধনঞ্জয় এইরূপে জ্যেষ্ঠভ্রাতার পাদবনানন্তর সমরে গমন করিবার মানসে সমুত্থিত হইলেন।
কৃষ্ণকর্ত্তৃক অর্জ্জুনাপমানিত যুধিষ্ঠিরের সান্ত্বনা
“হে কুরুরাজ! ঐ সময় ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ভ্রাতার পূর্ব্বোক্ত পরুষবাক্যে নিতান্ত অবমানিত হইয়া শয্যা হইতে গাত্রোত্থানপূর্ব্বক দুঃখিতচিত্তে কহিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! আমি অতি অসকার্য্য করিয়াছিলাম, তাহাতেই তোমরা বিষম দুঃখে পতিত হইয়াছ। আমি নিতান্ত ব্যসনাসক্ত, মূঢ়, অলস, ভীরু ও পরুষ, আমা হইতেই আমাদের কুল বিনষ্ট হইল; অতএব তুমি অচিরাৎ আমার মস্তকচ্ছেদন কর। কি সুখে আর আমার অধীন থাকিবে? অথবা আমি অচিরাৎ বনে গমন করিতেছি; তুমি সুখী হও। মহাত্মা ভীমসেন রাজ্যলাভের উপযুক্ত। আমি অকর্ম্মণ্য, আমার রাজকার্য্যে প্রয়োজন কি? আমি আর তোমার পরুষবাক্য সহ্য করিতে পারিব না। এক্ষণে ভীমসেনই রাজা হউক। অপমানিত হইয়া আমার জীবনধারণের প্রয়োজন নাই। ধর্ম্মরাজ এই বলিয়া সহসা গাত্রোত্থানপূর্ব্বক বনগমনে উদ্যত হইলেন।
“তখন মহামতি বাসুদেব ধর্ম্মরাজকে প্রণতিপুরঃসর কহিলেন, ‘হে মহারাজ! সত্যসন্ধ গাণ্ডীবধন্বা গাণ্ডীববিষয়ে যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন, তাহা ত’ আপনার অবিদিত নাই। যে ব্যক্তি উহাকে অন্যের হস্তে গাণ্ডীব প্রদান করিতে কহিবে, উনি তাহাকে বিনাশ করিবেন। আপনি ধনঞ্জয়কে অন্যের হস্তে গাণ্ডীব সমর্পণ করিতে কহিয়াছেন, সেই নিমিত্তই উনি স্বীয় প্রতিজ্ঞা প্রতিপালনার্থ আমার প্রবৰ্ত্তায় আপনার অপমান করিয়াছেন। গুরুলোকের অপমানই মৃত্যুস্বরূপ। হে মহারাজ! এক্ষণে আমরা উভয়ে আপনার শরণাপন্ন হইলাম। অর্জ্জুনের প্রতিজ্ঞারক্ষার্থে আমরা যে অপরাধ করিয়াছি, তাহা ক্ষমা করুন। আমি আপনার নিকট প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, অদ্য পৃথিবী কর্ণের শোণিত পান করিবে। এক্ষণে আপনি সূতপুত্রকে নিহত বোধ করুন।
“ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির বাসুদেবের এই বাক্যশ্রবণে সসম্ভ্রমে তাঁহাকে উত্থাপিত করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, ‘হে কৃষ্ণ! তুমি যাহা কহিলে, সকলই যথার্থ। আমি অর্জ্জুনকে অন্যের হস্তে গাণ্ডীব প্রদান করিতে বলিয়া নিতান্ত কুকর্ম্ম করিয়াছি; এক্ষণে তোমার বাক্যে প্রবোধিত হইলাম। অদ্য তুমি আমাদিগকে ঘোরতর বিপদ হইতে মুক্ত করিলে। আজ অর্জ্জুন ও আমি আমরা উভয়েই অজ্ঞানপ্রভাবে মোহিত হইয়াছিলাম। এক্ষণে তোমার প্রভাবে এই ভীষণ বিপত্সাগর হইতে উত্তীর্ণ হইলাম। তোমার বুদ্ধি প্লবস্বরূপ হইয়া আমাদিগকে অমাত্য ও বন্ধুবান্ধবগণের সহিত দুঃখ শোকার্ণব হইতে উদ্ধার করিল।’ ”