৭১তম অধ্যায়
পাণ্ডবগণের প্রত্যক্ষ পরিচয়
বিরাট কহিলেন, “য়দি ইনিই রাজা যুদ্ধিষ্ঠীর তাহা হইলে ইঁহার ভ্রাতা ভীম, অর্জ্জুন, নকুল ও সহদেব এবং সহধর্ম্মিণী যশস্বিনী দ্রৌপদীই বা কে? তাঁহার দূত্যক্রীড়ায় পরাজিত হইয়া কোথায় গমন করিয়াছেন, ইহা ত কেহই অবগত নহে।”
অর্জ্জুন কহিলেন, “হে নরাধিপ! যিনি আপনার সূপকারকার্য্যে নিযুক্ত হইয়া বল্লবনামে পরিচয় প্রদান করিয়াছেন, তিনি এই ভীমপরাক্রম ভীম। ইনি দ্রৌপদীর নিমিত্ত গন্ধমাদন-পর্ব্বতে ক্ৰোধবশে যক্ষগণকে বধ করিয়া দিব্য সৌগন্ধিক কুসুম সকল আহরণ করিয়াছিলেন। যিনি দুরাত্মা কীচকগণকে সংহার করিয়াছিলেন, ইনি সেই গন্ধর্ব্ব৷ ইনি আপনার অন্তঃপুরের ব্যাঘ্ৰ, ভালুক ও বরাহগণকে হনন করিয়াছিলেন। যিনি আপনার অশ্বপাল, তিনি এই নকুল এবং যিনি আপনার গোপালক, তিনি এই সহদেব। ইঁহারা পরম রূপবান ও প্রত্যেক সহস্ৰ যোদ্ধার সমকক্ষ। এই অলোকসামান্য-রূপসম্পন্ন পতিপরায়ণা সৈরিন্ধ্রীই দ্রুপদনন্দিনী, কীচকগণ ইঁহার নিমিত্তই নিহত হইয়াছে। আর আমিই ভীমসেনের অনুজ ও নকুল-সহদেবের পূর্ব্বজ অর্জ্জুন, আপনি আমার বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া থাকিবেন। হে রাজন! সন্তান যেমন জননীর গর্ভে অবস্থান করে, সেইরূপ আমরা আপনার আলয়ে পরমসুখে অজ্ঞাতবাস করিয়াছি।”
অর্জ্জুনের পরিচয়প্রদান পরিসমাপ্ত হইলে বিরাটতনয় উত্তর পুনরায় তাঁহাদিগের পরিচয়প্রদানে প্রবৃত্ত হইলেন, “তাত! এই যে সুবর্ণের ন্যায় গৌরবর্ণ, সিংহের ন্যায় প্রবৃদ্ধ উন্নতনাসাসম্পন্ন লোহিতায়তনেত্রী [রক্তাভ বিস্তৃতলোচন] পুরুষকে দেখিতেছেন, ইনি রাজা যুধিষ্ঠির। এই যে মত্তমাতঙ্গগামী, তপ্তকাঞ্চনবর্ণ, স্থূলস্কন্ধ ও দীর্ঘবাহু পুরুষকে দেখিতেছেন, ইনি বৃকোদার। ইঁহার পার্শ্বে যে বারণযূথপতি-সদৃশ সিংহের ন্যায় উন্নতস্কন্ধ, গজরাজগামী, কমলায়তলোচন, শ্যামকলেবর যুবা দণ্ডায়মান আছেন, ইনিই মহাধনুৰ্দ্ধর অর্জ্জুন। ঐ যে উপেন্দ্র ও মহেন্দ্ৰ সদৃশ দুইটি পুরুষ রাজা যুধিষ্ঠিরের পার্শ্বদেশ উজ্জ্বল করিয়া উপবিষ্ট আছেন, মনুষ্যলোকে যাঁহাদিগের রূপলাবণ্য, বলবিক্রম ও সুশীলতার তুলনা নাই, ইঁহারাই নকুলসহদেব। আর ঐ যে মূর্ত্তিমতী পার্ব্বতীর ন্যায় স্নিগ্ধদৰ্শনা, ইন্দীবারের [কৃষ্ণ-কুমুদ] ন্যায় মনোহারিণী, সুরকামিনীর ন্যায় বিগ্ৰহবতী [শরীরধারিণী] লক্ষ্মীর ন্যায় যে রমণী ইঁহাদিগের পার্শ্বদেশে উপবেশন করিয়া আছেন, ইনিই দ্রুপদনন্দিনী কৃষ্ণা।”
এইরূপে রাজকুমার উত্তর সমক্ষে পরিচয়প্রদান করিয়া পরিশেষে অর্জ্জুনের বলবিক্রম বর্ণন করিতে লাগিলেন, “ইনিই মৃগকুলসংহারকারী কেশরীর ন্যায় অরাতিগণকে নিপাতিত করিয়াছেন এবং রথ-সমূহ ভগ্ন করিয়া অক্ষুব্ধচিত্তে সমরে বিচরণ করিয়াছিলেন, প্ৰকাণ্ড-কলেবর মাতঙ্গগণ ইঁহার একমাত্ৰ বাণে আহত হইয়া বিশাল দশনদ্বয় ধরাতলে প্রোথিত করিয়া প্ৰাণ পরিত্যাগ করিয়াছে; ইনিই গো সমস্ত প্রত্যানীত ও কৌরবগণকে পরাজিত করিয়াছেন; ইঁহারই শঙ্খনাদে আমার কর্ণদ্বয় বধির হইয়াছিল।”
পাণ্ডবসৎকার–পার্থকে উত্তরা-প্রদানে-প্ৰস্তাব
মৎস্যরাজ উত্তরের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “তবে পাণ্ডবগণকে প্রসন্ন করিবার প্রকৃত সময় সমুপস্থিত হইয়াছে, অতএব যদি তোমার মত হয়, বল, আমি এক্ষণেই ধনঞ্জয়কে উত্তরা প্ৰদান করি।
উত্তর কহিলেন, “আমার মতে মহাত্মা পাণ্ডবগণ পূজনীয় ও মাননীয় এবং প্রকৃত সময়ও সমুপস্থিত হইয়াছে, অতএব সৎকারোচিত মহাভাগ পাণ্ডবগণকে পূজা করুন।”
বিরাট কহিলেন, “আমিও শক্রগণের হস্তগত হইয়া ছিলাম; ভীমসেন আমাকে মুক্ত করিয়া গোধন সকল প্রত্যানয়ন করিয়াছেন। ফলতঃ আমরা ইঁহাদিগেরই বাহুবলে সংগ্রামে জয়ী হইয়াছি। অতএব এক্ষণে আমার অমাত্যগণ সমভিব্যাহারে রাজা যুধিষ্ঠির তাঁহার অনুজগণের সৎকার করি। আমরা অজ্ঞাতসারে ইঁহাদিগকে যাহা কিছু কহিয়াছি, বোধ হয়, ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির তৎসমুদয় ক্ষমা করিবেন, তাহাতে সন্দেহ নাই।” বিরাটরাজ এই কথা কহিয়া প্ৰফুল্লবদনে প্রথমে রাজা যুধিষ্ঠিরের সমীপবর্তী হইয়া তাঁহাকে শিষ্টাচারসহকারে সৎকারপূর্ব্বক দণ্ড, কোষ ও নগর-সমেত সমস্ত রাজ্য প্ৰদান করিলেন এবং ‘কি সৌভাগ্য! কি সৌভাগ্য!’ বলিয়া অর্জ্জুন, যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল ও সহদেবের মস্তক আঘ্রাণ, তাঁহাদিগকে আলিঙ্গন ও বারংবার দর্শন করিয়াও পরিতৃপ্ত হইলেন না। অনন্তর রাজা বিরাট প্রীতিপূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, “মহাভাগ! ভাগ্যক্রমে আপনারা নির্বিঘ্নে অরণ্য হইতে আগমন এবং দুরাত্মাদিগের অজ্ঞাতসারে অবস্থান করিয়াছেন। আমার রাজ্যাদি যাহা কিছু আছে, আপনারা নিঃশঙ্কচিত্তে তৎসমুদয় প্রতিগ্রহ করুন। সব্যসাচী ধনঞ্জয় উত্তরার উপযুক্ত ভর্ত্তা, এক্ষণে ইনিই তাহার পাণিগ্রহণ করুন।”
রাজা যুধিষ্ঠির বিরাটরাজের বাক্য শ্রবণ করিয়া অর্জ্জুনের প্রতি দৃষ্টিপাত করিবামাত্র তিনি মৎস্যরাজকে কহিলেন, “হে রাজন! মৎস্য ও ভরতকুলের পরস্পর সম্বন্ধ নিবদ্ধ হওয়া একাত্ত সমুচিত, অতএব আজি আমি স্নুষার্থ [পুত্রবধু] আপনার কন্যাকে গ্ৰহণ করিলাম।”