৭০তম অধ্যায়
যুধিষ্ঠির-ধিকৃত অর্জ্জুনের তদীয় বধোদ্যম
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! যুধিষ্ঠির এইরূপ কহিলে মহাবীর অর্জ্জুন রোষাবিষ্ট হইয়া তাঁহার বিনাশবাসনায় সত্বর অসি গ্রহণ করিলেন। অন্তৰ্য্যামী হৃষীকেশ অর্জ্জুনকে ক্রুদ্ধ দেখিয়া কহিলেন, ‘হে পার্থ! তুমি কি নিমিত্ত খড়্গ গ্রহণ করিলে? এক্ষণে ত’ তোমার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী উপস্থিত নাই। ধীমান্ ভীমসেন কৌরবগণকে আক্রমণ করিয়াছেন। তুমি মহারাজের দর্শনার্থ রণভূমি হইতে সমাগত হইয়াছ। এক্ষণে সেই সিংহবিক্রান্ত মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে কুশলী দেখিয়া এই আহ্লাদ সময়ে কেন বিমোহিতের ন্যায় কাৰ্য্য করিতেছ? এখানে ত’ তোমার বধ্য কেহ উপস্থিত নাই; তবে কি নিমিত্ত প্রহারে উদ্যত হইতেছ? অথবা বোধ হয়, তোমার চিত্তবিভ্রম উপস্থিত হইয়া থাকিবে; নচেৎ তুমি কি নিমিত্ত সত্বর করে করবারি [তরবাল] গ্রহণ করিলে?”
“হে মহারাজ! মহাত্মা হৃষীকেশ এইরূপ কহিলে মহাবীর ধনঞ্জয় যুধিষ্ঠিরের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া ক্রুদ্ধ সর্পের ন্যায় নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া কেশবকে কহিলেন, “হ‘ জনার্দ্দন! “তুমি অন্যকে গাণ্ডীব শরাসন সমর্পণ কর” এই কথা যিনি আমাকে কহিবেন, আমি তাঁহার মস্তকচ্ছেদন করিব, এই আমার উপাংশুব্রত [গুপ্ত প্রতিজ্ঞা]। এক্ষণে তোমার সমক্ষেই মহারাজ আমাকে সেই কথা কহিয়াছেন। অতএব আমি এই ধর্ম্মভীরু নরপতিকে নিহত করিয়া প্রতিজ্ঞা প্রতিপালন ও সত্যের আনৃণ্যলাভ [ঋণমুক্তি] করিয়া নিশ্চিত্ত হইব। আমার খড়্গ গ্রহণ করিবার এই কারণ। তোমার মতে এক্ষণে কি করা কর্ত্তব্য? তুমি এই জগতের সমস্ত বৃত্তান্ত বিদিত আছ, এ সময়ে বিবেচনাপূর্ব্বক যেরূপ কহিবে, আমি তাহাই করিব।
অর্জ্জুনের প্রতি ধিক্কারপূর্ব্বক কৃষ্ণের উপদেশ
“হে মহারাজ! মহাত্মা কেশব অর্জ্জুনের বাক্যশ্রবণে তাঁহাকে বারংবার ধিক্কার প্রদানপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে ধনঞ্জয়! এক্ষণে তোমাকে রোষপরবশ দেখিয়া নিশ্চয় জানিলাম যে, তুমি যথাকালে জ্ঞানবৃদ্ধ ব্যক্তির উপদেশ গ্রহণ কর নাই। তুমি ধর্ম্মভীরু; কিন্তু ধর্ম্মের প্রকৃত তত্ত্ব সম্যক অবগত নহ। ধর্ম্মজ্ঞ ব্যক্তিরা কখন ঈদৃশ কার্য্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়েন না। আজি তোমাকে এরূপ অকাৰ্য্যে প্রবৃত্ত দেখিয়া মূর্খ বলিয়া বোধ হইতেছে। যে ব্যক্তি অকর্ত্তব্য কাৰ্য্যকে কর্ত্তব্য ও কর্ত্তব্য কাৰ্য্যকে অকর্ত্তব্য বলিয়া স্থির করে, সে নরাধম। বহুদর্শী পণ্ডিতগণ ধর্ম্মানুসারে যে উপদেশ প্রদান করিয়া থাকেন, তুমি তাহা অবগত নহ। অনিশ্চয়জ্ঞ ব্যক্তি কার্য্যাকাৰ্য্য অবধারণ সময়ে তোমার মত নিতান্ত অবশ ও মুগ্ধ হইয়া থাকে, কার্য্যাকার্য্যের যাথার্থ্য নির্ণয় করা অনায়াসসাধ্য নহে। শাস্ত্রদ্বারাই সমস্ত জ্ঞান জন্মিয়া থাকে। তুমি যখন মোহবশতঃ ধর্ম্মরক্ষা মানসে প্রাণীবধরূপ মহাপাপপঙ্কে নিমগ্ন হইতে উদ্যত হইয়াছ, তখন নিশ্চয়ই তোমার শাস্ত্রজ্ঞান নাই। আমার মতে অহিংসাই পরমধর্ম্ম বরং মিথ্যাবাক্যও প্রয়োগ করা যাইতে পারে; কিন্তু কখনই প্রাণীহিংসা করা কর্ত্তব্য নহে। তুমি কিরূপে প্রাকৃত পুরুষের ন্যায় পুরুষপ্রধান, ধর্ম্মকোবিদ জ্যেষ্ঠভ্রাতার প্রাণসংহারে উদ্যত হইলে? সজ্জনেরা সমরে অপ্রবৃত্ত, শরণাগত, বিপদগ্রস্ত, প্রমত্ত ও রণপরাঙ্মুখ শত্রুকেও বিনাশ করা নিন্দনীয় কহিয়া থাকেন; কিন্তু তুমি যুদ্ধে অপ্রবৃত্ত গুরুর প্রাণসংহারে সমুদ্যত হইয়াছ। পূর্ব্বে তুমি বালকত্ব প্রযুক্ত এই ব্রত অবলম্বন করিয়াছ এবং এক্ষণে মূর্খতাবশতঃ অধর্ম্মকার্য্যের অনুষ্ঠানে উদ্যত হইয়াছ। তুমি অতি দুৰ্জেয় সূক্ষ্মতর ধর্ম্মপথ অবগত না হইয়াই গুরুর বিনাশে অভিলাষ করিতেছ। হে ধনঞ্জয়! কুরুপিতামহ ভীষ্ম, ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির, বিদুর ও যশস্বিনী কুন্তী যে ধর্ম্মরহস্য কহিয়াছেন, আমি যথার্থরূপে তাহাই কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।
‘সাধু ব্যক্তিই সত্যকথা কহিয়া থাকেন, সত্য অপেক্ষা আর কিছুই শ্রেষ্ঠ নাই। সত্যতত্ত্ব অতি দুর্জ্ঞয়ে। সত্যবাক্য প্রয়োগ করাই অবশ্য কর্ত্তব্য। কিন্তু যে স্থানে মিথ্যা সত্যস্বরূপ ও সত্য মিথ্যাস্বরূপ হয়, সেস্থলে মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করা দোষাবহ নহে। বিবাহ, রতিক্রীড়া, প্রাণবিয়োগ ও সর্ব্বস্বাপহরণকালে এবং ব্রাহ্মণের নিমিত্ত মিথ্যা প্রয়োগ করিলেও পাতক হয় না। যে সত্য ও অসত্যের বিশেষ মর্ম্ম অবগত না হইয়া সত্যানুষ্ঠানে সমুদ্যত হয়, সে নিতান্ত বালক; আর যে ব্যক্তি সত্য ও অসত্যের যথার্থ নির্ণয় করিতে পারেন, তিনিই যথার্থ ধর্ম্মজ্ঞ। কৃতজ্ঞ ব্যক্তি অন্ধবধকারী বলাকব্যাধের ন্যায় দারুণ কর্ম্মানুষ্ঠান করিয়াও বিপুল পুণ্য লাভ করিতে পারেন। আর অকৃতজ্ঞ ব্যক্তি ধর্ম্মাভিলাষী হইয়াও কৌশিকের ন্যায় মহাপাপে নিমগ্ন হয়!
কৃষ্ণকর্ত্তৃক বলাক-ব্যাধবৃত্তান্ত বর্ণন
“অর্জ্জুন কহিলেন, ‘হে জনার্দ্দন! আমি বলাক ও কৌশিকের যথাবৎ বৃত্তান্ত শ্রবণ করিতে বাসনা করি, কীৰ্ত্তন কর।’
“বাসুদেব কহিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! পূর্ব্বকালে বলাকনামে এক সত্যবাদী অসূয়াশূন্য ব্যাধ ছিল। সে কেবল বৃদ্ধ পিতা, মাতা ও পুত্র, কলত্র প্রভৃতি আশ্রিত ব্যক্তিদিগের জীবিকানির্ব্বাহের নিমিত্ত মৃগ বিনাশ করিত। একদা ঐ ব্যাধ মৃগয়ায় গমন করিয়া কুত্রাপি মৃগ প্রাপ্ত হইল না। পরিশেষে এক অপূর্ব্ব নেত্রবিহীন শ্বাপদ [হিংস্ৰজন্তু] তাহার নয়নগোচর হইল। ঐ শ্বাপদ ঘ্রাণদ্বারা দূরস্থ বস্তুও অবগত হইতে পারিত। ব্যাধ উহাকে একাগ্রচিত্তে জলপান করিতে দেখিয়া তৎক্ষণাৎ বিনাশ করিল। তখন সেই অন্ধ শ্বাপদ নিহত হইবামাত্র আকাশ হইতে পুষ্পবৃষ্টি নিপতিত হইতে লাগিল। অপ্সরাদিগের অতিমনোহর গীতবাদ্য হইতে লাগিল এবং সেই ব্যাধকে স্বর্গে সমানীত করিবার নিমিত্ত বিমান সমুপস্থিত হইল। হে অর্জ্জুন! সেই শ্বাপদ তপঃপ্রভাবে বরলাভ করিয়া প্রাণীগণের বিনাশহেতু হওয়াতে বিধাতা উহাকে অন্ধ করিয়াছিলেন। বলাক সেই ভূগণনাশক মৃগকে বিনাশ করিয়া অনায়াসে স্বর্গারোহণ করিল। অতএব ধর্ম্মের মর্ম্ম অতি দুৰ্জ্জেয়।
কৌশিক বিপ্ৰবৃত্তান্ত
‘আর দেখ, কৌশিকনামে এক বহুশ্রুত [বেদপারগ] তপস্বীশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ গ্রামের অনতিদূরে নদীসমূহের সঙ্গমস্থানে বাস করিতেন। ঐ ব্রাহ্মণ সর্ব্বদা সত্যবাক্য প্রয়োগরূপব্রত অবলম্বনপূর্ব্বক তৎকালে সত্যবাদী বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছিলেন। একদা কতকগুলি লোক দস্যুভয়ে ভীত হইয়া বনমধ্যে প্রবেশ করিলে দস্যুরাও ক্রোধভরে যত্নসহকারে সেই বনে তাহাদিগকে অন্বেষণ করিয়া সেই সত্যবাদী কৌশিকের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া কহিল,-হে ভগবন্! কতকগুলি ব্যক্তি এইদিকে আগমন করিয়াছিল, তাহারা কোন্ পথে গমন করিয়াছে, যদি আপনি অবগত থাকেন, তাহা হইলে সত্য করিয়া বলুন। কৌশিক দস্যুগণকর্ত্তৃক এইরূপে জিজ্ঞাসিত হইয়া সত্যপালনার্থ তাহাদিগকে কহিলেন,—কতকগুলি লোক এই বৃক্ষ, লতা ও গুল্ম পরিবেষ্টিত অটবীমধ্যে গমন করিয়াছে। তখন সেই ক্রূরকর্ম্মা দস্যুগণ তাহাদের অনুসন্ধান পাইয়া তাহাদিগকে আক্রমণ ও বিনাশ করিল। সুক্ষ্মধর্ম্মানভিজ্ঞ সত্যবাদী কৌশিকও সেই সত্যবাক্যজনিত পাপে লিপ্ত হইয়া ঘোর নরকে নিপতিত হইলেন।
কৃষ্ণের ধর্ম্মবিষয়ক বিবিধ উপদেশ
‘হে ধনঞ্জয়। ধর্ম্মনির্ণয়ানভিজ্ঞ [ধর্ম্মনিশ্চয়ে অপটু] অল্পবিদ্য ব্যক্তি জ্ঞানবৃদ্ধদিগের নিকট সন্দেহভঞ্জন না করিয়া ঘোরতর নরকে নিপতিত হয়। ধর্ম্ম ও অধর্ম্মের তত্ত্ব নির্ণয়ের বিশেষ লক্ষণ নির্দ্দিষ্ট আছে। কোন কোন স্থলে অনুমানদ্বারাও নিতান্ত দুর্ব্বোধ ধর্ম্মের নির্ণয় করিতে হয়। অনেকে শ্রুতিকে ধর্ম্মের প্রমাণ বলিয়া নির্দেশ করেন। আমি তাহাতে দোষারোপ করি না; কিন্তু শ্রুতিতে সমুদয় ধর্ম্মতত্ত্ব নির্দ্দিষ্ট নাই, এই নিমিত্ত অনুমান দ্বারা অনেক স্থলে ধর্ম্ম নির্দ্দিষ্ট করিতে হয়। প্রাণীগণের উৎপত্তির নিমিত্তই ধর্ম্ম নির্দেশ করা হইয়াছে। অহিংসাযুক্ত কাৰ্য্য করিলেই ধর্ম্মানুষ্ঠান করা হয়। হিংস্রদিগের হিংসানিবারণার্থেই ধর্ম্মের সৃষ্টি হইয়াছে। উহা প্রাণীগণকে ধারণ করে বলিয়া ধর্ম্ম নামে নির্দ্দিষ্ট হইতেছে। অতএব যদ্বারা প্রাণীগণের রক্ষা হয়, তাহাই ধর্ম্ম। যাহারা অন্যের সন্তোষ উৎপাদনই ধর্ম্ম, ইহা স্থির করিয়া অন্যায়সহকারে পরদারাপহরণাদি কার্য্যে প্রবৃত্ত হয়, তাহাদের সহিত আলাপ করাও কর্ত্তব্য নহে। যদি কেহ কাহাকে বিনাশ করিবার মানসে কাহারও নিকট তাহার অনুসন্ধান করে, তাহা হইলে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তির মৌনাবলম্বন করা উচিত। যদি একান্তই কথা কহিতে হয়, তাহা হইলে সে স্থলে মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করা কর্ত্তব্য। ঐরূপ স্থলে মিথ্যাও সত্যস্বরূপ হয়। যে ব্যক্তি কোন কাৰ্য্য করিবার মানসে ব্রত অবলম্বন করিয়া তাহা সেই কার্য্যে পরিণত না করে, সে কখনই তাহার ফললাভে সমর্থ হয় না। প্রাণবিনাশ, বিবাহ, সমস্ত জ্ঞাতিনিধন এবং উপহাস—এই কয়েক স্থলে মিথ্যা কহিলেও উহা দোষাবহ হয় না। ধর্ম্মতত্ত্বদর্শীরাও উহাতে অধর্ম্ম নির্দেশ করেন না।
যে স্থলে মিথ্যা শপথদ্বারাও চৌরসংসর্গ হইতে মুক্তিলাভ হয়, সে স্থলে মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করাই শ্রেয়। সে মিথ্যা নিশ্চয়ই সত্যস্বরূপ হয়। সমর্থ হইলেও চৌরাদিকে ধনদান করা কদাপি বিধেয় নহে। পাপাত্মাদিগকে ধনদান করিলে অধর্ম্মাচরণনিবন্ধন দাতাকেও নিতান্ত নিপীড়িত হইতে হয়। হে অর্জ্জুন! আমি তোমার হিতার্থ শাস্ত্র ও ধর্ম্মানুসারে আপনার বুদ্ধিসাধ্যানুরূপ ধর্ম্মলক্ষণ কীৰ্ত্তন করিলাম। ধর্ম্মার্থে মিথ্যা কহিলেও যে অনৃত নিবন্ধন পাপভাগী হইতে হয় না, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। এক্ষণে ধর্ম্মরাজ তোমার বধার্হ কি না, তাহা বিবেচনা করিয়া বল।
“অর্জ্জুন কহিলেন, ‘হে বাসুদেব! তুমি অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন; তুমি আমাদের হিতার্থে যাহা কহিলে, তাহা নিশ্চয়ই সত্য। তুমি আমাদের পিতামাতার সদৃশ এবং তুমি আমাদের গতি ও আশ্রয়। ত্রিলোকমধ্যে তোমার অবিদিত কিছুই নাই; অতএব সত্যধর্ম্ম যে তোমার বিশেষ বিদিত আছে, ইহা আশ্চর্য্যের বিষয় নহে। ধর্ম্মরাজ যে আমার অবধ্য, তাহা আমার বোধগম্য হইয়াছে। এক্ষণে তুমি আমার মনোগত অভিপ্রায় শ্রবণ করিয়া অনুগ্রহপূর্ব্বক তাহার উপায় নির্দেশ কর। হে কৃষ্ণ! যদি কোন মনুষ্য আমাকে কহে যে,—হে পার্থ! তুমি তোমা অপেক্ষা সমধিক অস্ত্রবল ও ভুজবীৰ্য্যসম্পন্ন ব্যক্তিকে এই গাণ্ডীব প্রদান কর, তাহা হলে আমি তৎক্ষণাৎ তাহাকে সংহার করিব; আমার এই ব্রত তোমার অবিদিত নাই। মহাত্মা ভীমসেনেরও এই প্রতিজ্ঞা যে, যদি কেহ তাঁহাকে তুবরক [১] বলে, তাহা হইলে তিনি তাহাকে বিনাশ করিবেন। এক্ষণে ধর্ম্মরাজ তোমার সমক্ষেই আমাকে বারংবার অন্যকে গাণ্ডীব প্রদান করিতে কহিলেন। এক্ষণে যদি আমি ইহাকে সংহার করি, তাহা হইলে ক্ষণকালও এই জীবলোকে অবস্থান করিতে সমর্থ হইব না। হে কেশব! আমি বিমোহিত হইয়া ধর্ম্মরাজের বধচিন্তা করিয়াও পাপাসক্ত হইয়াছি সন্দেহ নাই। এক্ষণে যাহাতে আমার প্রতিজ্ঞা মিথ্যা না হয় এবং আমার ও ধর্ম্মরাজের জীবনরক্ষা হয়, তাহার উপায়বিধান কর।’
কৃষ্ণের অর্জ্জুন-প্রতিজ্ঞাপালন-মধ্যস্থতা
“বাসুদেব কহিলেন, ‘হে সখে! ধর্ম্মরাজ সূতপুত্রের নিরন্তর নিক্ষিপ্ত শরনিকরে সাতিশয় তাড়িত ও ক্ষতবিক্ষতকলেবর হইয়া একান্ত পরিশ্রান্ত ও দুঃখিত হইয়াছেন, এই নিমিত্তই ইনি রোষভরে তোমার প্রতি এইরূপ অসঙ্গত বাক্য প্রয়োগ করিয়াছেন। তুমি উহার বাক্যে কুপিত হইয়া কর্ণকে বিনাশ করিবে, এই উহার অভিপ্রায়। পাপাত্মা সূতপুত্র একান্ত দুর্দ্ধর্ষ; আজ কৌরবগণ তাহাকে পণস্বরূপ করিয়া যুদ্ধরূপ দ্যূতক্রীড়ায় প্রবৃত্ত হইয়াছে; সুতরাং এক্ষণে সেই দুর্দ্ধর্ষ কর্ণের বিনাশ সাধন করিতে পারিলেই কৌরবেরা অক্লেশে পরাজিত হইবে। মহাত্মা ধর্ম্মনন্দন এই বিবেচনা করিয়াই কটুবাক্যদ্বারা তোমাকে কোপিত করিয়াছেন। এই নিমিত্ত ইহাকে বিনাশ করা তোমার উচিত নহে; কিন্তু প্রতিজ্ঞা প্রতিপালন করাও তোমার অতি কর্ত্তব্য। অতএব এক্ষণে ইনি জীবিত সত্ত্বেও যাহাতে মৃত বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইতে পারেন এইরূপ এক উপায় কহিতেছি, শ্রবণ কর। হে পার্থ! এই জীবলোকে মাননীয় ব্যক্তি যতদিন সম্মান লাভ করেন, ততদিন তিনি জীবিত বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইতে পারেন। তিনি অপমানিত হইলেই তাহাকে জীবন্মৃত বলিয়া নির্দেশ করা যায়। দেখ, বৃদ্ধবর্গ ও অন্যান্য বীরগণ, তুমি, ভীম, নকুল ও সহদেব-তোমরা সকলেই ধর্ম্মরাজকে সম্মান করিয়া থাক, আজ তুমি তাহাকে অণুমাত্র অপমানিত কর। হে অর্জ্জুন! গুরুকে “তুমি” বলিয়া নির্দেশ করিলে তাহাকে বধ করা হয়, অতএব তুমি পূজ্যতম ধর্ম্মরাজকে “তুমি” বলিয়া নির্দেশ কর। এক্ষণে আমি যে প্রকার কহিলাম অথৰ্ব্ববেদে এইরূপ নির্দ্দিষ্ট আছে এবং মহর্ষি অঙ্গিরাও এইরূপই কহিয়া গিয়াছেন। ফলতঃ গুরুলোককে “তুমি” বলিয়া নির্দেশ করিলে তাঁহাকে একপ্রকার বধ করা হয়; অতএব মঙ্গললাভার্থী ব্যক্তি অবিচারিতচিত্তে আবশ্যক সময়ে ইহার অনুষ্ঠান করিবে। হে ধনঞ্জয়! এক্ষণে তুমি আমার বাক্যানুসারে ধর্ম্মনন্দনকে “তুমি” বলিয়া নির্দেশ কর, তাহা হইলেই ইনি অপমানিত হইয়া আপনাকে তোমার হস্তে নিহত জ্ঞান করিবেন। তৎপরে তুমি ইহার চরণে প্রণত হইয়া সান্ত্বনা করিবে। তুমি এইরূপ করিলে এই ধর্ম্মরাজ ধৰ্মার্থ পর্যালোচনা করিয়া কখনই রোষাবিষ্ট হইবেন না; অতএব তুমি এক্ষণে এইরূপে স্বীয় সত্যপ্রতিপালন ও ভ্রাতার প্রাণরক্ষা করিয়া সূতপুত্রকে বিনাশ কর।”