হাসপাতালের গেটে আরিফের জিপ পৌঁছুলে কর্নেল বললেন, “ব্যস! এখানেই আমাকে নামিয়ে দাও। এবার আমি একলা হতে চাই।”
কর্নেল জিপ থেকে নামলে আরিফ বলল, “ঠিক আছে বস্! কিন্তু আপনি কি ওই হ্যাভারস্যাকটা হাতে নিয়েই ঘুরবেন?”
কর্নেল হাসলেন। “হ্যাঁ। জিনিসটা হাল্কা। নিয়ে বেড়াতে অসুবিধা নেই।”
“কিন্তু আপনার মতো সায়েবসুবো লোকের হাতে ভাঙাচোরা এবং যথেষ্ট নোংরা জিনিসটা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। তাছাড়া, আই’ম আফ্রেড কর্নেল, য়ু আর টেকিং টু মাচ রিস্ক।”
“এটা একটা ফাঁদ, ডালিং! দেখা যাক, অন্তত একটা মাছিও এতে পড়ে কি না।”
“ইভনিং ভিলায় আপনার ফাঁদটা কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে।”
কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, “হয়তো হয়নি।”
“কর্নেল! প্লিজ একটু হিন্ট দিয়ে যান, সো দ্যাট উই ক্যান টেক আপ দা নেক্সট কোর্স অফ অ্যাকশন।”
কর্নেল ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি বরাবর লক্ষ করেছি, আমার সংসর্গে এলেই তুমি ওভার-স্মার্ট হয়ে যাও। দ্যাটস ব্যাড, ডার্লিং!”
আরিফ হেসে ফেলল। “ওকে! উইশ য়ু গুড লাক।” বলে সে জিপ ঘোরাল এবং জোরে বেরিয়ে গেল।
এখানে রাস্তাটা নতুন এবং চওড়া তবে দুধারে নোংরা ঘিঞ্জি দোকানপাট, ফিরিওয়ালাদের গাড়ি এবং সুস্থ-অসুস্থ লোকেদের ভিড়। রাস্তায় ট্রাক-বাস টেম্পো-সাইকেল রিকশো মিলেমিশে একটা তুমুল বিশৃঙ্খলা। হাসপাতালটা বড়। পেরিয়ে গিয়ে আরও একটা ছোট গেট এবং তারপর স্টাফ কোয়ার্টার এলাকা। মধ্যিখানে নির্মীয়মাণ পার্ক। চতুর্থ শ্রেণী’-র হাসপাতালে কর্মীদের জন্য অ্যাজবেস্টসের চাল দেওয়া সারবন্দি খোপরিগুলো সহজে চেনা যায়। একটি পুকুর দুটি শ্রেণীকে পৃথক করেছে। কর্নেল পুকুরপাড়ের বটতলায় ঘাটের মাথায় দাঁড়ালেন। পুকুরের জলে কমবয়সীরা বড্ডবেশি স্বাধীনতার আনন্দ উচ্ছ্বঙ্খলতায় ভোগদখল করছে। হু, এখনও যদি স্বাধীনতা বলে মানুষের জন্য কিছু টিকে থাকে, তা প্রকৃতিতেই আছে। বয়স্কদের ধমক ওরা গ্রাহ্য করছিল না। ঘাটে যারা কাপড় কাঁচছিল, তারা কর্নেলকে একবার দেখে নিল মাত্র। আশেপাশে একদঙ্গল শুয়োরও যথেচ্ছ স্বাধীনতাভোগী। বটতলার গোড়া মাটি দিয়ে বাঁধানো এবং যথারীতি সেটা দেবস্থান। সন্ন্যাসী চেহারার একটা লোক উদাসীন বসে ছিল। কর্নেলের চোখে চোখ পড়লে কেন কে জানে সে সেলাম দিল। কর্নেল এগিয়ে গিয়ে দেবস্থানে একটা দু’টাকার নোট অর্ঘ্য দিয়ে হ্যাভারস্যাক বগলদাবা করে করজোড়ে মাথা নোয়ালেন। লোকটির উদাসীনতা পুরো চিড় খেল। প্রসন্ন হেসে সে বলল, “আপ কঁহাসে আতা হ্যায়, স্যার? মালুম, আপ কৈ বাহারকা আদমি।”
“হ্যাঁ ভাই! কলকাত্তাসে আতা। হসপিটালমে মেরা এক দোস্ত বিমার হ্যায়।”
“জি। হম সমঝা।” সে ঘুরে সন্ত রবিদাসের ছোট্ট বাঁধানো ছবিটা দেখাল। “উনহিকা কিরপা মিলে তো জলদি বিমার উমার ভাগ যাতা।”
“আপ হেঁয়া রহতে হেঁ?”
“জি। উও দেখিয়ে মেরা কোয়ার্টার।”
“হসপিটালকি স্টাফ?”
“জি।” সে কর্নেলের হাতের হ্যাভারস্যাকটা দেখিয়ে বলল, “ইয়ে কেয়া চিজ হ্যায়, স্যার?”
কর্নেল হাসলেন। “কভি দেখা নেহি ইয়ে চিজ?”
“নেহি তো!”
“হাওয়াই আড্ডিকি জঙ্গলমে মিলা।”
“হাঁ, হাঁ।” লোকটি একটু সিরিয়াস হল। “উও জঙ্গলমে কভি কভি হরকিসিমকি চিজ মিল যাতা। হম শুনা, ছুপে হুয়ে খাজনা ভি হ্যায়।”
লোকটা গুপ্তধনের কথা বলছে। কর্নেল একটু আগ্রহ দেখালে সে একটা গল্প ফেঁদে বসল। এর আগে হাথিয়াগড়ে এসে গল্পটা শুনেছিলেন কর্নেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ছকবাঁধা এই গল্প পৃথিবীর সর্বত্র চালু। বেশির ভাগ পপ্লেই গুপ্তধনটা সোনার বাট। কোনও সৈনিক বোমাবিধ্বস্ত ব্যাঙ্ক লুট করে সোনার বাট হাতিয়ে কোথাও পুঁতে রাখবে এবং সে মারা পড়বে। ফলে পুঁতে রাখা সোনাটা গুপ্তধন হয়ে উঠবে। এ নিয়ে অসংখ্য থ্রিলার লেখা হয়েছে। যুদ্ধের পরবর্তীকালে। কিছু গপ্পে হিরে-জহরত মণিমুক্তো হয়েছে গুপ্তধন। কিন্তু কাঠামোটা একই। বোমা-বিধ্বস্ত কোনও শহরে কোনও জুয়েলারি থেকে লুঠ।
লোকটার নাম হরিয়া। জগৎ-সংসার তাকে আকৃষ্ট করে না। মাঝেমাঝে সে ঠিক করে ফেলে, চাকরি ছেড়ে সাধু হয়ে চলে যাবে। ঝগড়াটে বউ। একদঙ্গল কাচ্চাবাচ্চা। আজ সকালেই তার বউ হাসপাতালের ভেতর গিয়ে তার সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছে। জমাদারনি রঙ্গিয়া না আটকালে একটা কিছু ঘটে যেত। ডিউটি শেষ করে তাই সে কোয়ার্টারে ফেরেনি। এখানে বসে প্রভু রবিদাসের সান্নিধ্যে শান্তি খুঁজছে। হা–প্রথম সে কিছুটা শান্তি পেয়েছে।
রঙ্গিয়ার স্বামী নানকুকে নাকি কর্নেল চিনতেন। শুনে হরিয়া বলল যে, রঙ্গিয়া ভাল মেয়ে বলেই নানকুর সদ্গতি হয়েছিল। নানকু ছিল বেজায় নেশাখোর লোক। তাই রাজ্যের নেশাখোর লোকেরা ছিল তার বন্ধু।
নানকুর সঙ্গে এক বাঙালিবাবুকে দেখেছিলেন কর্নেল। হরিয়া কি তাঁকে চিনত?
হরিয়া নড়ে বসে বলল যে, আশ্চর্য ব্যাপার। রঙ্গিয়া বলছিল, তার স্বামীর এক বাঙালি বন্ধু খুন হয়ে গেছে। সে মরা লোকটাকে চিনতে পেরেছে। হরিয়া তার কাছে খবরটা জেনেছে সকালে তার ডিউটির সময়। এও আশ্চর্য মনে হয়েছে হরিয়ার, রাতে তো রঙ্গিয়ার ডিউটি ছিল না।
তাছাড়া মর্গেই বা সে গেল কেন অত রাতে? মর্গ তো হাসপাতালের প্রায় বাইরে একটেরে। ওই যে দেখা যাচ্ছে।
হরিয়া কি কিছু জিজ্ঞেস করেনি রঙ্গিয়াকে, কেন অত রাতে সে মর্গে গিয়েছিল?
ঝুটঝামেলা পছন্দ করে না হরিয়া। তবে তার বরাবর সন্দেহ, মর্গের মরা মানুষগুলোর পোশাক আর পকেটের জিনিসপত্র হাতিয়ে নেবার জন্য হাসপাতালে যে চক্রটি আছে, রঙ্গিয়া তার সঙ্গে জড়িত। অবশ্য রঙ্গিয়া বলেছে, সিধুয়া ডোমের কাছে সে পাঁচটা টাকা পায়। সিধুয়া দিচ্ছে না। গত রাতে চরম বোঝাপড়া করতে গিয়েছিল নাকি। হরিয়া এ কথা বিশ্বাস করে না। হ্যাঁ, রঙ্গিয়া ভাল মেয়ে তার বিচারে। কারণ সে হরিয়ার বউয়ের মত মুখরা দজ্জাল আউরত নয়। তাই বলে সে বাড়তি রোজগারের ফিকির খুঁজবে না, এমন তো। নয়। হরিয়া বাদে এই হাপসাতালের সব্বাই, এমন কি চুহা-ছুছুন্দরগুলো (ইঁদুর ছুঁচো) পর্যন্ত বাড়তি রোজগারের ফিকিরে আছে। ওই খুদে জীবগুলো মর্গের মড়ার আঙুল খায়। চোখ খেয়ে ফেলে। নাকও খায়।
খুন হওয়া বাঙালিবাবুকে কি কখনও দেখেছে হরিয়া?
দেখে থাকতেও পারে। মনে পড়ছে না। এখানে তো অনেক বাঙালি বাবু। বাস করেন। সবাইকে হরিয়া চেনে না। চেনার কথাও না! বলে হরিয়া হাসল। “উও দেখিয়ে, রঙ্গিয়া জমাদারনি আতি হ্যায়। বারাহতক ডিউটি। লেকিন মালুম আভি এগারা ভি বাজা নেহি।”
কর্নেলও হাসলেন। “তো ভাই, তুম ভি রঙ্গিয়াকি বহুত আগাড়ি ডিউটি ছোড় কর আয়া।”
“হুম ছুটি লেকে আয়া স্যার! হাঁ।” হরিয়া অভিমানে বলল। “হম কভি এইসা না করতা, হাঁ।”
প্রৌঢ়া জমাদারনি কর্নেলকে দেখতে দেখতে এগিয়ে আসছিল। কাছাকাছি এসে মুখ টিপে হেসে বলল, এ হরিয়া! তেরা বহু ভাগ যায়গি! যা, যা। ঘর যা।”
“হম দুসরি বহু আনে গা দেহাতসে।” হরিয়ার ত্বরিত জবাব। “আ রি রঙ্গিয়া, ইয়ে দে। ইয়ে সাবলোগ তেরা বুডটা নানকুয়াকো পচানতা।
রঙ্গিয়া কর্নেলের দিকে তাকাল। আস্তে বলল, “আপ কঁহাসে আতা সাব?”
হরিয়া বলে দিল, “কালকাত্তা। ইনহে উও বাঙালিবাবুকো ভি পহচানতা। যো মার্ডার হো গেয়া–”
“সাচ?”
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, “হাঁ। তো ইস লিয়ে হম্ তুমহারি পত্তা করনে আয়া!”
“হসপিটালমে থি। পত্তা উহা পর মিল যাতা। আপ পুছা নেহি কিসিকো?”
রঙ্গিয়া জিজ্ঞাসু মুখে বলল। তারপর আরও কাছে এগিয়ে এল। কর্নেল বললেন, “বসন্তবাবু মেরা পাশ কুছ রুপেয় উধার লিয়া।”
রঙ্গিয়া এসে হরিয়ার পাশে বসল। করুণ হেসে বলল যে, “আর সে টাকা ফেরত পাওয়ার আশা ছেড়ে দেওয়াই ভাল। বাবু খুব নেশাখোর লোক ছিল। রঙ্গিয়া মানুষ চেনে। মাঝেমাঝে বাঙালিবাবুর কাছে সে অনেক টাকা দেখতে পেত। নানকু আড়ালে বলত, বাবুজি খুব ফিকিরবাজ লোক। আর বোসোবের কোঠিতে ড্রাইভার আছে, তার নাম শ্যামলাল। শ্যামলালের মা ছিল বাঙালি আউরত। রঙ্গিয়ার সন্দেহ, শ্যামলালের মায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বাবুর। বাবু তাকে দিদি বলত। তাছাড়া শ্যামলালের মা মারা গেলে বাবু খুব কেঁদেছিল। শ্যামলাল ওই বাবুকে বলত মামা। হয়তো বসন্তবাবু আর শ্যামলালের মা ভাই বোনই ছিল। নৈলে অমন করে সে কাঁদবেই বা কেন? তো সায়েব শ্যামলালকে গিয়ে বলতে পারেন, ভাগ্নে মামার ধারের টাকা শোধ করুক। করলে মামার পরকাল মুক্তি। শ্যামলাল লোকটা খারাপ নয়।”
“রঙ্গিয়ার স্বামীর কাছে বসন্তবাবু কি শুধু নেশা করার জন্যই আসত?”
“হ্যাঁ। যারা মরে গেছে, তাদের নিন্দা করা উচিত নয়। তবে অমন গাঁজাখোর আর দেখেনি রঙ্গিয়া। গাঁজা খেয়ে বাবু বারান্দার মেঝেয় পড়ে থাকত।” কিন্তু ভোরে উঠে তাকে আর দেখতে পেত না রঙ্গিয়া। অজিব আদমি।
এই হ্যাভারস্যাক জিনিসটা কি কখনও রঙ্গিয়া দেখেছে?
রঙ্গিয়া একটু অবাক হল। কেন এ কথা তাকে জিজ্ঞেস করছেন সায়েব?
এটা বসন্তবাবু কর্নেলের কাছে জিম্মা রেখে টাকা ধার করেছিলেন।
হরিয়া চমকে উঠে বলল, “আপ হমরে বোলা–”
কর্নেল হাসলেন। “হাঁ। হাওয়াই আড়িকি জঙ্গলমে মিলা। লেকিন বসন্তবাবু পায়া ঔর হমকো দিয়া। দেখো ভাই, হম তো তুমকো ইয়ে বোলা নেহি কি হম পায়া। বোলা?”
“জি নেহি।”
“হম সির বোলা কি হাওয়াই আড্ডিকি জঙ্গলমে মিলা।”
হরিয়া মাথা দোলাল। “জি, জি! আপ ওহি বাত বোলা। সাম্।”
রঙ্গিয়া কিছু ভাবছিল। কর্নেল তা লক্ষ্য করে বললেন যে, “জিনিসটা বসন্তবাবুর কাছে রঙ্গিয়ার দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।”
রঙ্গিয়া জোর দিয়ে বলল যে, না। জিনিসটা সে দেখেনি। কোথাও দেখেনি। তবে হাওয়াই আড্ডির জঙ্গল বলায় তার একটু-একটু মনে পড়ছে, তার স্বামী নানকু যেন বলেছিল, বসন্তবাবু একসময় নাকি হাওয়াই আড্ডিতে চাকরি করতেন।
বসন্তবাবু হাওয়াই আড্ডিতে চাকরি করতেন? কী চাকরি?
তা রঙ্গিয়া জানে না। শ্যামলাল জানতে পারে। সবজিকাটরায় গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়।
আমরিকান সাব’কে কি রঙ্গিয়া চেনে?
না। এ কথাই বা তাকে কেন জিজ্ঞেস করা হচ্ছে?
হরিয়া বলে উঠল, “আমেরিকান সাব বহত জবরদস্ত আদমি থা। হম ইয়ে ভি শুনা, হাথিয়াগড় মুলুককা মালিক থে আমরিকান সাবকা খান্দান। উনহিকা পিতাজিকো রাজাসাব বোলতা সাবলোগ।”
রঙ্গিয়া সায় দিয়ে বলল যে, রাজাসাবের কথা তারও জানা। কিন্তু তার মতে, ওঁদের বংশ পাপী বংশ। তাই দিনে-দিনে হালত খারাপ হয়ে গেছে। এই কলকাতার সায়েব যদি তাকে জিজ্ঞেস করেন পাপটা কী, তা হলে রঙ্গিয়া তার প্রমাণ দিতে পারে। কী প্রমাণ? রঙ্গিয়া বাঁকা হেসে হরিয়ার দিকে কটাক্ষ করল। “এ হরিয়া। সমঝা দে ইনহিকো।”
হরিয়া খুব গম্ভীর হয়ে ব্যাখ্যা দিল। রাজাসাবের খান্দান বাঙালি নয়। এই মুলুকের ভূঁইহার ব্রাহ্মণ। তাদের পদবি হল রায়। পরে বাঙালি মেয়ে বিয়ে করে আধুবাঙালি হয়ে যায়। তো এই ব্রাহ্মণবংশের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। একজন অব্রাহ্মণের। এটা পাপ নয়। সেই অব্রাহ্মণও আবার বাঙালি। হরিয়ার মতে, এই এলাকাতে অনেক কায়েথ আছে। কিন্তু বাঙালি কায়েথ আর এই এলাকায় কায়েথ এক জাত নয়। হ্যাঁ, হরিয়া বোসোবের কথাই বলছে। বোসোব কেমন লোক জানতে চাইলে হরিয়া শুধু বলবে যে, তিনি কেতন সিংয়ের দোস্ত। কে কেতন সিং জানতে চান কি?
হরিয়াকে চোখ কটমট করে থামিয়ে দিল রঙ্গিয়া। কর্নেল একটু ইতস্তত করে বললেন, “হম শুনা, বসন্তবাবু বোসসাবকো কোঠিমে খুন হোগেয়া।
রঙ্গিয়া চাপা স্বরে বলল, “হাঁ। মালুম, কোই ফিকিরমে ঘুস গয়ে থে। ঔর বোসসব উনকো মারা। মারতে মারতে জান নিকাল দিয়া। তো এহি হালত হ্যায়, বড় আদমি যে কুছ করনা চাহে, কর সকে। উসকা হাথমে পুলিশ, উঁচা উঁচা আফসার, মিনিস্টারভি। গরিবোকো রাখনেওয়ালা কৌন হ্যায়?”
হরিয়া একটু হেসে সন্ত রবিদাসের ছবিটা দেখিয়ে বলল, “আ রি। তেরা বাত শুনকর ঠাকুরবাবা হাস রহা। দেখ, দেখ। গরিবকো রাখনেওয়ালা ঠাকুরবাবা রি, ঠাকুরবাবা।”
সে করজোড়ে ঠাকুরবাবার উদ্দেশে প্রণাম নিবেদন করল। কর্নেলও ফোঁস করে শ্বাস ফেলে করজোড়ে প্রণাম করে পা বাড়ালেন। স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে বললেন যে, এ সব কথা শোনার পর তিনি বেচারা বসন্তবাবুকে ক্ষমা করে দিলেন। ধার দেওয়া টাকার কথা আর ভুলেও মুখে আনবেন না।
কর্নেল যেতে-যেতে শুনতে পেলেন হরিয়া ও রঙ্গিয়া এবার স্ট্যান্ডার্ড হিন্দি ছেড়ে মাতৃভাষা ঠেঠবোলিতে কী সব আলোচনা শুরু করেছে। আঁচ করলেন, রঙ্গিয়ার মতে, বসন্তবাবু কোনও ফিকিরবাজি করতে ওই কোঠিতে ঢুকেছিল এবং হরিয়ার মতে, চুরি করতেই ঢুকেছিল। তবে দুজনেই একমত যে, ধরা পড়ে বেদম ঠ্যাঙানি খেয়ে মারা পড়েছে বাঙালিবাবু। নেশাখোর আদমির প্রাণ বেজায় ঠুনকো।
হাসপাতাল এলাকা থেকে বেরিয়ে কর্নেল একটা সাইকেলরিকশো নিলেন। বললেন, “সবজিকাটরা।”
একটা নতুন তথ্য জানা গেল। বসন্ত হাজরা মার্কিন ঘাঁটি হাওয়াই আড্ডি’-তে চাকরি করত। তখন তার বয়স ছিল পুলিশি মতে পঁচিশ থেকে সাতাশের মধ্যে। তা হলে তখন সে ছিল সদ্য যুবক। হুঁ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দলে দলে তরুণরাও যুদ্ধসংক্রান্ত নানা ধরনের চাকরির সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু বসন্ত হাজরা কি মিলিটারিতে চাকরি পেয়েছিল? চাকরিটা কেরানির হতে পারে না। ক্যান্টিনবয়ের হওয়া সম্ভব। অথবা আর্দালি-বেয়ারার? কারণ তার হাতের লেখা নেহাত সাক্ষর। লোকের। এদিকে ‘আমরিকান সাব’ সর্বেশ রায় ছিলেন সেখানকার এক কন্ট্রাক্টর। ইভনিং ভিলার সঙ্গে কি বসন্ত হাজরার যোগাযোগের ক্ষীণ সূত্র এটি? কিন্তু সে কর্নেলের ঠিকানা জানল কীভাবে? এর পরের অনিবার্য প্রশ্ন : কর্নেলের ঠিকানাটা ফের সে লিখল কেন? এর একটা জবাব হয়তো দেওয়া যায়। হলঘরে বসে সোমনাথ দাশগুপ্তের ফেলে যাওয়া সিগারেট প্যাকেটের ভেতরের কাগজ ছিঁড়ে ওটা লেখার কারণ সম্ভবত এই যে, সেই মুহূর্তে তার হাতের কাছে কোনও কাগজ ছিল না। কিন্তু কাগজটা রোল করে নিজের দেশলাইয়ের ভেতর লুকিয়ে রাখল কেন? তা কি পুলিশকে একটা সূত্র দিতে যে কর্নেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে’? আপাতদৃষ্টে তা-ই দাঁড়াচ্ছে। যেহেতু সে কর্নেলকে কলকাতায় বেনামী চিঠিটা লিখেছিল, তাই সাংঘাতিক আহত অবস্থায় কর্নেলকেই তার ত্রাণকর্তা ভাবা স্বাভাবিক।
তা হলে ঘুরে ফিরে সেই একই প্রশ্নে ফিরে আসতে হয়; কর্নেলকে সে চিনত। কিন্তু কোন সূত্রে?
এবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন : ইভনিং ভিলার ককটেল-ডিনার পার্টি হবে সে জানতে পেরেছিল এবং সেই পার্টিতে কাকেও খুন করা হবে কোন ছলে, তা ও সে জেনেছিল। রঙ্গিয়ার মতে, বসন্ত হাজরা ফিকিরবাজ লোক ছিল। মাঝেমাঝে তার কাছে অনেক টাকা থাকত। সে কোনও ফিকিরবাজি করতে বোসসায়েবের কোঠিতে গিয়েছিল।
বসন্ত হাজরা কি তাহলে ব্ল্যাকমেলার ছিল এবং ইভনিং ভিলায় কাকেও ব্ল্যাকমেল করত? তাই একজন ব্ল্যাকমেলারকে চিরকালের মতো চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে?
আপাতদৃষ্টে ঘটনাটা এরকম দাঁড়াচ্ছে; ইভনিং ভিলায় যাকে বসন্ত হাজরা ব্ল্যাকমেল করত, সে ভাড়াটে গুণ্ডা দিয়ে তাকে মেরেছে। গেটের কাছে রক্তের দাগ ছিল। তার মানে, ব্ল্যাকমেলার গতকাল বিকেলে আসার কথা ছিল এবং ভাড়াটে গুণ্ডা ওত পেতে ছিল। গেটের কাছে আসতেই সে বসন্ত হাজরার পেছন থেকে মাথায় ডাণ্ডা মারে (মর্গের রিপোর্টে ভোতা জিনিসের আঘাত)। দৈবাৎ গেট খোলা পেয়ে আক্রান্ত ও আহত ব্ল্যাকমেলার ইভনিং ভিলায়। ঢোকে।
কিন্তু ইভনিং ভিলায় তো তার শত্রু আছে। সেখানে সে ঢুকবে কেন?
এর দুটো সম্ভাব্য জবাব হয়। এক : আঘাত মারাত্মক হওয়ায় সে বুঝতে পেরেছিল মারা পড়ার চানস আছে এবং ইভনিং ভিলার যাকে ব্ল্যাকমেল করত, তাকে তার মৃত্যুর সঙ্গে জড়াতে চেয়েছিল।
পোর্টিকোর সামনে ফোয়ারার একপাশে বেঁকে পড়া এবং উঁটাভাঙা ঘাস চোখে পড়েছে কর্নেলের। বোঝা যাচ্ছে, সেইসময় হলঘরের ভেতরে বা দরজায় এমন কেউ ছিল, যাকে দেখে বসন্ত হাজরা ফোয়ারার ট্যাংকে আত্মগোপন করে। তারপর হলঘরে ঢোকার সুযোগ পায়।
হলঘরে ঢোকার কি বিশেষ কারণ ছিল? এটাই বোঝা যাচ্ছে না। বোঝা যাচ্ছে না কালো চিতার পায়ের ফাঁকে এই হ্যাভারস্যাক থাকার কারণ কী? চিতার পায়ের ফাঁকে রক্তের দাগ দেখেছেন কর্নেল। সোমনাথ অন্ধকারে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনেছিল। বসন্ত হাজরা কর্নেলের ঠিকানা লিখে দেশলাই। বাক্সে লুকিয়ে ফেলার পর এই হ্যাভারস্যাকটা হাতাতে গিয়েই হয়তো পড়ে যায়। তার মৃতদেহ অবশ্য সোফার কাছে পাওয়া গেছে। এমন তো হতেই পারে, উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করার সময় তার অন্তিম মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে এবং সে ছিটকে এসে সোফার কাছেই পড়ে যায়। সম্ভবত সোমনাথের কাছে কথাটা শোনার পর আরিফ খুব শিগগির গিয়ে পড়ায় ইভনিং ভিলা থেকে বসন্ত হাজরার বডি বাইরে পাচারের সুযোগ মেলেনি।
দুই : নাকি ইভনিং ভিলায় বসন্ত হাজরার কোনও হিতৈষীও আছে, যার কাছে পৌঁছুতে চেয়েছিল?
“ইয়ে সবজিকাটরা সাব! আপ কাহাপর উতরেগা?”
রিকশোওয়ালার কথায় কর্নেল চোখ খুললেন। হাসি পেল। কিছু চিন্তার সময় তার চোখ নিজের অজান্তে বুজে যায়। ভারি বদঅভ্যাস। চুরুটটাও নিভে গেছে। সেটা জ্বেলে নিলেন। রিকশো দাঁড়িয়ে গেছে। প্রচণ্ড ভিড় আর হল্লা এখানে। সবজির বাজার। কর্নেল বললেন, “আচ্ছা ভাই, ইহা কোই শ্যামলাল ড্রাইভারকা ঘর হ্যায়। পছানতা উসকো?”
“জি হাঁ।” রিকশোওয়ালা বলল। “উও গলিমে পয়দল যানা পড়েগা আপকো। থোড়াসা দূর।”
গলিটা হাত তিনেক চওড়া। কর্নেল ভাড়া মিটিয়ে হাঁটতে থাকলেন। একে ওকে জিজ্ঞেস করতে করতে একটা খাপরার চালের বাড়ির সামনে পৌঁছুলেন। বস্তি এলাকা এটা। একটা মেয়ে শ্যামলালকে ডেকে দিল। রোগা টিঙটিঙে চেহারা, দেখার মতো গোঁফ এবং পরনে মোটামুটি ধোপদুরস্ত প্যান্ট, স্পোর্টিং গেঞ্জি, বছর পঁচিশেক বয়সের এক যুবক। অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, “বোলিয়ে!”
কর্নেল ইচ্ছে করেই বাংলায় বললেন, “আমি শ্যামলালের খোঁজে এসেছি।”
“সে আমি। বলুন।”
“বসন্ত হাজরা আমার চেনা লোক। সে তোমার ঠিকানা দিয়ে বলেছে, তুমি নাকি ওর ভাগ্নে। সে তোমার বাড়িতেই থাকে।” কর্নেল কাচুমাচু মুখে হাসলেন। “আমার কাছে একটা জিনিস বেচেছে। জিনিসটা মেকি।” বলে কর্নেল সেই পান্নাটা বের করে দেখালেন। “পুলিশের কাছে যাওয়ার আগে ভাবলুম”
শ্যামলাল বলল, “মামা গতরাতে মার্ডার হয়ে গেছে।”
“সে কী! কোথায়? কী সর্বনাশ!”
“থানায় যান সব জানতে পারবেন। মামা হারামিপনা করত। সাজা পেয়েছে। আমি কী করব?”
সে দরজা বন্ধ করতে কপাটে হাত রেখেছে, কর্নেল বললেন, “এক মিনিট শ্যামলাল! তুমি তো ইভনিং ভিলায় ড্রাইভারের চাকরি করো।”
“আর করি না। বোসসায়েব হারামি লোক আছে। পরশু রোজ ঝামেলা করল। চলে এলাম।”
শ্যামলালের বাংলায় হিন্দিভাষীর টান স্পষ্ট। কর্নেল বললেন, “তোমার মামা বলছিল, আমার ভাগ্নে শ্যামলাল ইভনিং ভিলায় মেমসায়েবের গাড়ি চালায়। জিনিসটা যদি মেকি হয় আমার ভাগ্নের কাছে গেলেই আমার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবে। ভাগ্নেকে না পেলে ইভনিং ভিলায় মেমসায়েবের কাছে যাবেন।”
“মামা খুব চিটিংবাজ ছিল।” শ্যামলাল রুষ্টমুখে বলল। “মেমসাবের কাছে যেতে বলেছিল তো তার কাছেই যান।”
“কিন্তু সত্যিই কি মেমসায়েবের সঙ্গে তোমার মামার খাতির ছিল?” কর্নেল মুখে উদ্বেগ ফুটিয়ে বললেন। “বুঝে দেখ শ্যামলাল, মেকি জুয়েল বেচে আমার কাছে হাজার টাকা নিয়েছে তোমার মামা! তোমার কি মনে হয়, মেমসায়েব-”
“মেমসায়েব মামাকে যতই খাতির করুক, টাকা স্যার আপনি আর পাচ্ছেন না।”
“মেমসায়েবেরই জিনিস এটা। মামা বলেছিলেন।”
“ঝুট। মিথ্যা কথা।”
“কেন, কেন?”
শ্যামলাল উত্তেজিতভাবে বলল, “মেমসায়েব জুয়েল বেচবে কেন? সব প্রপার্টি মেমসায়েবের। হারামি বোসসায়েব মুখে লম্বে লম্বে বাত করে। মেমসায়েবের নোকর আছে সে। আপনি জানেন? নিমকহারাম বোসসায়েব ডাকু কেতন সিংহকে বন্ধু করেছে। কোনও খারাপ মতলব আছে। জরুর আছে। বেচারি মেমসায়েবের জন্য আমার ভয় হয়।” সে ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। ফের বলল, “তো আপনি কোথায় থাকেন? আপনাকে মামা কোথায় ঝুটা জুয়েল বেচল?”
কর্নেল বললেন, “আমি কলকাতায় থাকি। এখানে বেড়াতে এসেছি। গতকাল সকালে তোমার মামার সঙ্গে নিউটাউনশিপে একটা চায়ের দোকানে আলাপ হল। কথায় কথায় সে চুপিচুপি বলল, সস্তায় দামি জুয়েল কিনতে চাই কি না। এখানকার রায়রাজাদের ফ্যামিলি আছে। তাদেরই–”
“থানায় চলে যান।” বলে শ্যামলাল মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল।
কর্নেল রাস্তায় এসে আবার একটা সাইকেল রিকশো নিলেন। বললেন, “নিউ টাউনশিপ জলদি যানা ভাই।” রিকশোর চাকা গড়ালে কর্নেলের মাথায় এল, শ্যামলাল তাঁর হাতের হ্যাভারস্যাকটা সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন করল না। লক্ষ্যও করল না।
আরিফের জিপে আসার সময় ‘জয়রাম ইলেকট্রোপ্রিন্টো’-তে ক্রিস্নানের ফিল্মটা দিয়েছিলেন। সঙ্গে অ্যাডিশনাল পুলিশ সুপার থাকার সুবিধা অনেক। যাবার পথে নেগেটিভ দেখে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল।
ব্যাগি প্যান্টশার্ট পরা স্মাট তরুণটি কর্নেলকে দেখে হাসল। “সরি মিস্টার! নাথিং ক্যান বি ডান। লাইট পাসড থ্রু ইওর ক্যামেরা গট্টা হোয়াইট লট ওনলি।”
ক্যামেরা থেকে ফিল্মের রোল বের করতে গিয়েই আলো ‘পাস করেছে এবং সব ছবি নষ্ট হয়ে গেছে, এই তার মত। নষ্ট রোলটা নিয়ে কর্নেল ডেভলাপ করার খরচ দিতে গেলেন। সে নিল না। “থ্যাংকস স্যার! দ্যাটস ওকে। প্লিজ কাম এগেন। বাট স্যার, বি ভেরি কেয়ারফুল নেক্সটাইম।”
“ও! শিওর!” কর্নেল চুরুট ধরালেন। তারপর অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে থাকলেন। এ কি ক্রিস্নানের ইচ্ছাকৃত, নাকি তাড়াহুড়োয় দৈবাৎ ঘটে গেছে?…