॥ ৬ ॥
হজরতগঞ্জে সাল্ডান্হা অ্যান্ড কোম্পানিতে পৌঁছে একটু হক্চকিয়েই গেলাম। এতো পুরানো দোকান সেটা ভাবতে পারিনি। আর পনেরো মিনিট পরেই দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। ভদ্রলোক একটা ডেস্কের পিছনে বসে ছিলেন, দোকানে কোনও খদ্দের নেই, খালি একজন কর্মচারী এদিক ওদিক ঘুরছে। সাল্ডান্হা আমাদের দেখেই হেসে দাঁড়িয়ে উঠলেন।
‘আসুন, বসুন, মিঃ মিটার।’
আমরা তিনজনে তিনটে চেয়ারে বসলাম।
‘এখানে এসে আপনাকে অসুবিধায় ফেললাম না ত?’ ইংরাজিতে জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
‘মোটেই না। এখন ত ক্লোজিং টাইম এসে গেল। এখানে আপনার কী কথা আছে বলে নিন, তারপর আপনাদের আমার গাড়িতে করে আমার বাড়ি নিয়ে যাব। সেখানে কফি খাবেন, আমার স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করবেন।’
‘তা হলে ভালোই হবে,’ বলল ফেলুদা, কারণ আপনার স্ত্রীকেও দু-একটা প্রশ্ন করার আছে। কালকের পার্টির সকলকেই আমরা প্রশ্ন করছি।’
‘দ্যাট্স অল রাইট। আই ডোন্ট থিংক সি উইল মাইন্ড।’
‘আমার প্রথম প্রশ্ন—আপনার এ দোকান কতদিনের?’
‘তা প্রায় সত্তর বছর হল। আমার ঠাকুরদাদা দোকানটার পত্তন করেন। লখ্নৌ-এর প্রথম মিউজিক শপ।’
‘কিন্তু এখন নিশ্চয়ই আরও মিউজিক শপ হয়েছে?’
‘আরও দুটো হয়েছে—দুটোই আমাদের জাতভাইদের করা। একটার মালিক ডিমেলো, আরেকটার নরোন্হা। এদের মধ্যে একটা আবার হজরতগঞ্জেই—আমার দোকানের কাছেই। দুঃখের বিষয় আমরা ঠিক সময়ের সঙ্গে তাল রেখে চলতে পারিনি। সেটা বোধহয় দোকানের চেহারা দেখেই বুঝতে পারছেন।’
‘আপনাদের ব্যবসা তার মানে ভালো চলছে না?’
‘কী আর বলব, মিঃ মিটার। এটা কম্পিটিশনের যুগ। আমার ছেলেকে যদি দোকানে বসাতে পারতাম তা হলে তার ইয়াং আইডিয়াজ অনেক কাজে দিত। কিন্তু সে ডাক্তারি পাশ করে চলে গেল আমেরিকা। এখন অবশ্য সে সেখানে খুব ভালোই রোজগার করছে। আর আমি বুড়ো মানুষ একাই দোকান সামলাচ্ছি। বিক্রি যে একেবারে হয় না তা নয়, আমার কিছু ফেইথফুল কাস্টমারস আছে। কিন্তু আজকাল যুগ অনেক বদলে গেছে। অনেস্টির আর দাম নেই; লোকে চায় চটক।’
ফেলুদা সহানুভূতি প্রকাশ করে আসল প্রশ্নে চলে গেল।
‘কাল যে দুর্ঘটনা ঘটে গেল সেটা সম্বন্ধে আপনার কিছু বলার আছে?’
‘কী আর বলব বলুন। ও হার যখন আমার স্ত্রী না পেয়ে আমার শালী পেল, তখন মার্গারেট একেবারে ভেঙে পড়ে। সী লাভ্ড দ্যাট নেকলেস। কার না ভালো লাগবে বলুন—এমন একটা আশ্চর্য সুন্দর প্রাইসলেস জিনিস?’
‘আপনি বলছেন ঈশ্বরের চোখেও এটা একটা অন্যায় বলে মনে হয়েছিল?’
‘তা না হলে প্যামেলার এ ক্ষতি হবে কেন? শকুন্তলা দেবীর পক্ষপাতিত্ব ভগবানের চোখেও দৃষ্টিকটু বলে মনে হয়েছিল নিশ্চয়ই।’
‘কিন্তু কে এই হারটা নিতে পারে সে বিষয় আপনার কোনও ধারণা আছে?’
‘নো, মিঃ মিটার। সে বিষয় আমি আপনাকে কোনওরকম ভাবে সাহায্য করতে পারব না। আমার কোনও ধারণা নেই।’
‘সুনীলা দেবীর ছেলে যে কুপথে যাচ্ছে সেটা আপনি জানেন?’
‘আমি সেটা আন্দাজ করেছি।’
‘সে বোধহয় নেশা করে। আর তার জন্য তার প্রায়ই টাকার দরকার হয়।’
সাল্ডান্হা চুক্চুক্ করে আক্ষেপসূচক শব্দ করলেন। তারপর বললেন, ‘দ্যাট মে বি সো। কিন্তু তাই বলে সে তার মা-র এমন একটা সাধের জিনিস চুরি করবে? এটা আমার কাছে একটু বাড়াবাড়ি বলে মনে হচ্ছে।’
‘কাল ফিল্মটা চলার সময় কাউকে ঘর থেকে বেরোতে দেখেছিলেন?’
‘নো। বাট আই স সুকিয়াস কামিং ইন।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ।’
দোকান বন্ধ করার সময় হয়ে গিয়েছিল, তাই আমরা উঠে পড়লাম।
মিঃ সাল্ডান্হার গাড়িতে তাঁর বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলাম যখন, তখন সোয়া ছ’টা—সবে সন্ধে হয়েছে।
সাল্ডান্হার বাড়ি জয়ন্তবাবুর বাড়ির তুলনায় অনেক ছোট। এটাও এক তলা বাংলো টাইপের বাড়ি। ভেতরে ঢুকে বৈঠকখানায় গিয়ে হাজির হলাম। এ বৈঠকখানায় জয়ন্তবাবুর বাড়ির বৈঠকখানার বাহার নেই। বোঝাই যায় সাল্ডান্হার অবস্থা তেমন ভালো না। এবং তাঁর গৃহিণীর বাড়ি সুন্দর করে সাজিয়ে রাখার দিকে তেমন ঝোঁক নেই।
‘মার্গারেট—ইউ হ্যাভ ভিজিটরস’ বলে একটা হাঁক দিয়ে সাল্ডান্হা আমাদের পাশের সোফায় বসে পড়লেন। আমাদের অবিশ্যি পরমুহূর্তেই দাঁড়াতে হল। কারণ ঘরে মিসেস সাল্ডান্হা, অর্থাৎ মার্গারেট সুশীলা দেবী, এসে ঢুকেছেন।
‘ও—মিঃ মিত্র!’
ভদ্রমহিলার ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা দিল। তবে সে হাসি মুখ আলো করা হাসি নয়। কারণ হাসা সত্ত্বেও একটা অবসাদের ভাব মুখে থেকে গেল।
ফেলুদা বলল, ‘বসুন, সুশীলা দেবী। আপনি বোধহয় জানেন না যে জয়ন্তবাবু কালকের চুরির ব্যাপারে আমাকে তদন্ত করতে বলেছেন।’
‘সেটা আজ সকালেই আন্দাজ করছিলাম।’
‘সেই ব্যাপারেই আমি আপনাকে দু-একটা প্রশ্ন করতে চাই।’
সাল্ডান্হা এই সময় উঠে পড়ে বললেন, ‘আমি আপনাদের জন্য কফি বলছি, আর আমার পোশাকটা বদলে একটু মুখটা ধুয়ে আসছি। ততক্ষণ আপনারা কথা বলুন।’
সাল্ডান্হা চলে গেলেন ভিতরে।
সুশীলা দেবী বললেন, ‘কী প্রশ্ন করবেন করুন।’
‘আপনার বিয়ে হয়েছে কতদিন?’
‘পঁয়ত্রিশ বছর।’
‘আপনার একটি ছেলে আমেরিকায় আছে শুনলাম।’
‘হ্যাঁ।’
‘এ ছাড়া আর কোনও সন্তান আছে?’
‘একটি মেয়ে আছে। তার বিয়ে হয়ে গেছে। সে কুলুতে থাকে। তার স্বামীর সেখানে অ্যাপ্ল অর্চার্ড আছে।’
‘আপনার বোনের চেয়ে আপনি কত বড়?’
‘দু’ বছরের।’
‘তার মানে আপনারা প্রায় পিঠোপিঠি?’
‘হ্যাঁ।’
‘আপনার বোনের প্রতি আপনার কীরকম মনোভাব ছিল?’
‘একেবারে ছেলেবয়সে আমরা দু’জন ভীষণ বন্ধু ছিলাম। প্যামের আমাকে ছাড়া চলতই না। আমরা দু’জনে একসঙ্গে পুতুল খেলতাম, নার্সারি স্কুলে যেতাম, একরকম জামা কাপড় পরতাম।’
‘তারপর?’
‘আমার যখন বছর পনেরো বয়স তখন থেকেই আমি বুঝতে পারি যে মা-র টান আমার চেয়ে প্যামের উপর বেশি। তা ছাড়া প্যামের মধ্যে তখন থেকে অনেক গুণের প্রকাশ পেতে থাকে। ও খুব ভালো আবৃত্তি করত, অভিনয় করত, পড়াশুনায় আমার চেয়ে ভালো ছিল, দেখতেও আমার চেয়ে অনেক সুন্দর হয়ে উঠেছিল। দেখলাম প্যামই মা-র আদরের হয়ে উঠছে। আমার উপরে ভালোবাসা কমে যাচ্ছে। অবিশ্যি বাবা আমাকে খুব ভালোবাসতেন, কিন্তু মা-র ভালোবাসা পেলাম না বলে আমার মনে একটা হিংসার ভাব জেগে ওঠে যেটা আমি তখন কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সব শেষে মা যখন তাঁর হারটা প্যামকে দিয়ে দিলেন তখন আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। এ দুঃখ ভুলতে আমার অনেক সময় লেগেছে।’
‘এখন মনে হিংসের ভাব নেই?’
‘না। এক এক সময় ছেলেবেলার কথা মনে হলে জেলাস লাগে। কিন্তু এমনিতে দু’জনের মধ্যে যথেষ্ট সদ্ভাব আছে। কাল ত দেখলেন আমাদের—কী মনে হল?’
‘দিব্যি সদ্ভাব।’
‘শুধু তাই না। ওর সম্বন্ধে একটা অনুকম্পার ভাবও বোধ করি।’
‘কেন বলুন ত?’
‘কারণ আমার ভগ্নীপতি। তাঁর টাকার টানাটানি যাচ্ছে।’
‘তাই বুঝি?’
‘এটা কিন্তু আপনাকে গোপনে বলছি।’
‘আপনি আমাদের উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে পারেন।’
‘আমার ভগ্নীপতি অনেক দেনা করে ফেলেছেন। সেই সঙ্গে ড্রিঙ্কিং বেড়ে গেছে।’
‘কিন্তু কাল ওরকম পার্টি দিলেন?’
‘কী করে দিলেন জানি না। আমি এবং আমার স্বামী নেমন্তন্ন পেয়ে খুব আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম।’
‘হয়তো এর মধ্যে অবস্থার উন্নতি হয়েছে।’
‘তা হতে পারে। কিন্তু আমি দু’ মাস আগের কথাও জানি। আমার বোন আমার কাছে এসে কান্নাকাটি করেছে। তার উপর ওদের ছেলের গোলমাল ত আছেই। সে ব্যাপার জানেন ত?’
‘শুনেছি।’
‘আশা করি আপনার কথাই ঠিক—ওদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে।’
‘হারটা কে চুরি করতে পারে সে সম্বন্ধে আপনার কোনও বক্তব্য আছে?’
‘একেবারেই না। ওটা আমার কাছে একটা বিরাট রহস্য।’
‘প্রসেনজিৎকে আপনার সন্দেহ হয় না?’
‘প্রসেনজিৎ?’
ভদ্রমহিলা যেন একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘একটা ব্যাপার আছে। ফিল্মটা যখন দেখানো হচ্ছিল তখন প্রসেনজিৎ আমার কাছেই ছিল। ফিল্ম চলা অবস্থায় সে উঠে কোথায় যেন যায়।’
‘অন্য কোনও লোককে জায়গা বদলাতে দেখেছিলেন?’
‘না। তা ছাড়া আমার দৃষ্টি পর্দার উপর ছিল। প্রায় কুড়ি বছর পরে দেখছিলাম ছবিটা।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ, সুশীলা দেবী—আমার প্রশ্ন শেষ।’
আমরা কফি খেয়ে উঠে পড়লাম। বাড়ির বাইরে এসে ফেলুদা বলল, ‘এবার আলবার্ট রতনলাল। তা হলেই আজকের মতো আমার কাজ শেষ।’
সাল্ডান্হার বাড়ি থেকে আমরা রতনলালের ফ্ল্যাটে গেলাম। অত্যন্ত সুসজ্জিত ফ্ল্যাট, আর একজনের পক্ষে বেশ বড়। ভদ্রলোক সোফায় বসে একটা হাই-ফাই স্টিরিওতে গজল শুনছিলেন, পরনে একটা বেগুনি ড্রেসিং গাউন, মুখে পাইপ। ভদ্রলোক যে আতর ব্যবহার করেন সেটা জানতাম না। ঘরে বেশ ঝাঁঝালো আতরের গন্ধ।
ভদ্রলোক আমাদের দেখে স্টিরিওটা বন্ধ করে বললেন, ‘কী ব্যাপার?’
ফেলুদা বলল, ‘কালকে চুরির ব্যাপারে কয়েকটা প্রশ্ন করার ছিল। আমরা সকলকেই করেছি।’
‘এভরিওয়ান?’
‘শুধু মিঃ সুকিয়াসকে বাকি। সেটা কাল করব।’
‘আপনার কি ধারণা আমি চুরিটা করে থাকতে পারি?’
‘মোটেই না। তবে চোর ধরতে আপনি সাহায্য করতে পারেন।’
‘আই অ্যাম নট ইন দ্য লীস্ট বিট ইন্টারেস্টেড ইন দ্য থেফ্ট।’
‘এত দামি আর ভালো একটা জিনিস চুরি হল, আর তাতে আপনার ইন্টারেস্ট নেই?’
‘মাইসোরের দেওয়া জিনিস ত দামি হবেই, তাতে আশ্চর্যের কী আছে?’
‘আপনার মা-র এত সাধের জিনিস ছিল!’
‘আমার মা-র ফিল্ম কেরিয়ার সম্বন্ধেও আমার কিছুমাত্র উৎসাহ নেই। আই থিংক অল ফিল্মস আর রট্ন। সাইলেন্ট ফিল্মস ত বটেই।’
‘আপনার পেশাটা কী জানতে পারি?’
‘তা পারেন। আমি একটা মার্কেনটাইল ফার্মের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার।’
‘তা হলে আপনি আর কোনওরকমে সাহায্য করতে পারছেন না আমাদের?’
‘আই অ্যাম ভেরি সরি। আমার কিছু বলার নেই।’
‘একটা শেষ প্রশ্ন আছে।’
‘কী?’
‘কাল ফিল্মটা চলার সময় আপনি কাউকে জায়গা পরিবর্তন করতে দেখেছিলেন?’
‘আমি ত ফিল্ম দেখছিলাম না। আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিলাম। আই স মিঃ সুকিয়াস কাম ইন।’
‘ধন্যবাদ। আপনি দেখছি আপনার পিতামহের মতো হিন্দি গানের ভক্ত।’
রতনলাল কোনও মন্তব্য না করে আবার স্টিরিওটা চালিয়ে দিলেন। আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।