স্কাউটশিপের প্লাজমা ইঞ্জিন দুটো গুমগুম শব্দ করছে, আমরা উপগ্রহটা ঘুরে এসে এইমাত্র সেখান থেকে ফোবিয়ানের দিকে রওনা দিয়েছি। স্কাউটশিপের যোগাযোগ মডিউল ঠিকভাবে ফোবিয়ানের সাথে যোগাযোগ করে স্বয়ংক্রিয় ফিডব্যাক চালু করেছে নিশ্চিত হওয়ার পর আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছি। ঠিক এরকম সময়ে আমি অনুভব করলাম আমার গলায় শীতল একটা ধাতব জিনিস স্পর্শ করেছে, জিনিসটা কী বুঝতে আমার অসুবিধে হলো না। ম্যাঙ্গেল ক্বাসের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি। আমার কাছে ব্যাপারটি খুব অস্বাভাবিক মনে হলো না, আমি এরকম কিছুর জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস শীতল গলায় বলল, আহাম্মক কোথাকার।
আমি কোনো কথা বললাম না। ম্যাঙ্গেল ক্বাস দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, আমাকে যে দরজা খুলে স্কাউটশিপে ঢুকতে দিয়েছ সেটা প্রমাণ করে তুমি কত বড় আহাম্মক। কত বড় নির্বোধ।
আমি এবারও কোনো কথা বললাম না। ম্যাঙ্গেল ক্বাস এবারে যেন একটু ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল, তার অস্ত্রটি দিয়ে আমার গলায় একটা খোঁচা দিয়ে বলল, আমি এই মুহূর্তে তোমার মাথায় গুলি করে ঘিলু বের করে দিতাম। কেন সেটা করছি না জানো?
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, না, জানি না।
কারণ তা হলে কন্ট্রোল প্যানেলটা তোমার মস্তিষ্কের টিস্যু আর রক্তে মাখামাখি হয়ে যাবে। বুঝেছ?
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, বুঝেছি।
আমি নির্বোধ মানুষ সহ্য করতে পারি না।
আমি এবারে হাত দিয়ে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের উদ্যত অস্ত্রটা অবহেলার সাথে সরিয়ে বললাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস— তুমি খুব ভালো করে জান কেন তুমি আমাকে সহ্য করতে পার না। আমি নির্বোধ সে-কারণে নয়।
তাহলে কেন?
কারণ আমি তোমার প্রাণ রক্ষা করেছি। সেজন্যে। আমি এবারে ঘুরে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি বুঝতে পারছ না কেন আমি তোমার প্রাণ রক্ষা করেছি। সেটা বুঝতে না পেরে তুমি ছটফট করছ।
আমি খুব ভালো করে বুঝতে পারছি আহাম্মক।
না, তোমার বোঝার ক্ষমতা নেই ম্যাঙ্গেল ক্বাস। তবে তোমার মানসিক শান্তির জন্যে আমি সেটা তোমাকে বলব।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস সর চেখে আমার চোখের দিকে তাকাল। আমি বললাম, এই উপগ্রহের প্রাণীরা বুদ্ধিমান। যদি এরা বুদ্ধিমান না হতো তাহলে ছয়জন মৃত মানুষের মস্তিষ্ক থেকে সকল তথ্য বের করে নিয়ে এসে তাদেরকে জীবন্ত মানুষের মতো ব্যবহার করতে পারত না। আমি নিশ্চিত এই প্রাণীদের সাথে আবার আমাদের দেখা হবে, যোগাযোগ। হবে এমনকি বন্ধুত্ব হবে। আমি তাদের একটা ভুল ধারণা দিতে চাই নি।
কী ভুল ধারণা?
যে বিপদের সময় একজন মানুষ অন্য মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায় না।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস কোনো কথা না বলে আমার দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে রইল তারপর হিসহিস করে বলল, আমি তোমাকে শেষ করব। ইবান প্রত্যেকটা শব্দে আলাদা করে জোর দিয়ে বলল, সারাজীবনের জন্যে শেষ করব।
আমি মাথা ঘুরিয়ে নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের দিকে তাকিয়ে বললাম, তাতে কিছু আসে যায় না ম্যাঙ্গেল জ্বাস। আমি তোমাকে আগেই বলেছি, তাতে কিছু আসে যায় না।
স্কাউটশিপটা ফোবিয়ানের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে মনিটরে ফোবিয়ান ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আমি অনেকটা অন্যমনস্কভাবে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম এরকম সময় হঠাৎ করে কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। স্কাউটশিপে কেউ একজন কাঁদছে। পিছনে ঘুরে না তাকিয়েও আমি বুঝতে পারলাম সেটি মিত্তিকা। মিত্তিকা কেন কাঁদছে?
রিতুন ক্লিস আমার ঘরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি একটি হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবি তাই তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন প্রয়োজন হলে বসেও থাকতে পারেন। ভরশূন্য পরিবেশে একজন সত্যিকারের মানুষ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না বা বসে থাকতে পারে না। তাকে ভেসে থাকতে হয়। আমি ঘরের দেওয়াল স্পর্শ করে তার সামনে স্থির হয়ে থাকার চেষ্টা করছিলাম। রিতুন ক্লিস আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। আমি বললাম, মহামান্য রিতুন, আপনার কী মনে হয়? আমি কি ভুল করেছি?
রিতুন ক্লিস মাথা নাড়লেন, বললেন, না ইবান। তুমি ভুল করো নি।
আপনি কি সত্যিই বলছেন, নাকি আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে বলছেন।
মহামান্য রিতুন হেসে মাথা নাড়লেন, আমি যখন একজন সত্যিকার মানুষ ছিলাম তখনো মিছিমিছি কাউকে সান্ত্বনা দিই নি এখন তো কোনো প্রশ্নই আসে না!
শুনে খুব শান্তি পেলাম। ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার পর থেকে খুব অশান্তিতে ছিলাম, শুধু মনে হচ্ছিল কাজটা কি ঠিক করলাম? বিশেষ করে যখন মিত্তিকার কান্নার কথা মনে হচ্ছিল তখন নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল।
সেটা খুবই স্বাভাবিক। মহামান্য রিতুন নরম গলায় বললেন, পুরোপুরি একশ ভাগ বিবেকহীন অপরাধী যখন হাইব্রিড মানুষ হয়ে একটা মহাকাশযান দখল করে ফেলে তখন সেটা খুব ভয়ের ব্যাপার হতে পারে। তুমি যে নিজেকে অপরাধী ভাবছ সেটা এমন কিছু অস্বাভাবিক নয়।
কিন্তু কিন্তু মিত্তিকা এত ভেঙে পড়ল কেন?
সম্ভবত সে কিছু একটা জানে যেটা তুমি জানো না। সে কিছু একটা অনুভব করতে পারছে যেটা তুমি অনুভব করতে পারছ না।
আমি চমকে উঠে বললাম, আপনি কী বলছেন মহামান্য রিতুন?
রিতুন ক্লিস একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমি কিছুই বলছি না ইবান, আমি অনুমান করার চেষ্টা করছি।
আপনি কী অনুমান করেছেন?
মিত্তিকা অপূর্ব সুন্দরী একটি মেয়ে। ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিঃসঙ্গ একজন পুরুষ মানুষের আদিম প্রবৃত্তি অনুমান করা তো কঠিন কিছু নয়।
আমি কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলতে পারলাম না, হতবাক হয়ে রিতুন ক্লিসের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শুকনো ঠোট জিব দিয়ে ভিজিয়ে বললাম, আপনি বলেছিলেন জীবনকে সহজভাবে নিতে। আমি নিজের জীবনকে সহজভাবে নিতে পারি কিন্তু মিত্তিকার জীবন?
রিতুন ক্লিস কিছু বললেন না। আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। আমি কাতর গলায় বললাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে যদি ঐ ভয়ঙ্কর উপগ্রহটাকে ছেড়ে আসতাম তাহলে আমরা বেঁচে যেতাম! আমি নিজের হাতে এই দানবটাকে নিয়ে এসেছি
রিতুন ক্লিস মাথা নাড়লেন, বললেন, হ্যাঁ। এই দানবটাকে এখন তোমার নিজের হাতে খুন করতে হবে।
এটি কি একটি স্ববিরোধী কাজ হলো না? একজন মানুষকে বাঁচিয়ে এনেছি তাকে খুন করার জন্যে?
কোনো হিসেবে নিশ্চয়ই স্ববিরোধী। তুমি সেই হিসেবে যেও না ইবান।
আমি অসহায়ভাবে মাথা নেড়ে বললাম কিন্তু ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে খুন করা যায় না মহামান্য রিতুন। তার শরীর থেকে গুলি ফিরে আসে।
আমি দুঃখিত ইবান, মানুষকে কীভাবে খুন করতে হয় সে-সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।
কিন্তু তাহলে কেমন করে হবে? আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, আপনার আমাকে সাহায্য করতে হবে মহামান্য রিতুন। দোহাই আপনাকে–
আমি একটি হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবি ইবান। আমার অস্তিত্ব একটি নিউরাল নেটওয়ার্কে।
কিন্তু আপনি নিজেই বলেছেন আপনি সত্যিকার রিতুন ক্লিস। আপনি সর্বকালের সবচেয়ে প্রতিভাবান মানুষ—
সেটি অতিরঞ্জন। সেটি ভালোবাসার কথা। আমি আসলে সাধারণ মানুষ।
কিন্তু আপনি যেটা জানেন সেটা নিশ্চিতভাবে জানেন, সেটা বিশ্বাস করেন। আপনি বলুন আমি কী করব?
রিতুন ক্লিস দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বললেন, ম্যাঙ্গেল ক্বাসের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে সে হাইব্রিড মানুষ। সেই শক্তিকে তার দুর্বলতায় পরিণত করে দাও।
কীভাবে করব সেটা।
আমি জানি না। সেটা আমি জানি না ইবান। সেটা তোমাকে ভেবে বের করতে হবে।
রিতুন ক্লিস চলে যাবার পরও আমি স্থির হয়ে একজায়গায় ভেসে রইলাম। আমি এখন কী করব? ম্যাঙ্গেল ক্বাসের। শক্তিকে কীভাবে আমি দুর্বলতায় পরিণত করব? আমি ঠাণ্ডামাথায় পুরো ব্যাপারটি ভাবতে চাইলাম এবং হঠাৎ করে আবিষ্কার করলাম আমার হাঁটার ইচ্ছে করছে, আমি যখন কোনো কিছু নিয়ে ভাবি তখন আমি একা-একা হাঁটি। এই ভরশূন্য পরিবেশে ভেসে থাকা যায় কিন্তু হাঁটা যায় না— আমি তাই ভেসে ভেসে মহাকাশে শরীর ঠিক রাখার জন্যে ছোট ব্যায়ামের ঘরটিতে গিয়ে হাজির হলাম। গোলাকার এই ঘরটিকে তার অক্ষের উপর ঘুরিয়ে এর ভেতরে কম বা বেশি মাধ্যাকর্ষণ তৈরি করা যায়। দীর্ঘ মহাকাশ অভিযানে যেতে হলে সবাইকে সময় করে নিয়মমাফিক এখানে প্রবেশ করতে হয়। আমি দেয়ালে সুইচটি স্পর্শ করতেই গোলাকার ঘরটি ঘুরতে শুরু করল এবং আমি কিছুক্ষণের মাঝেই ঘরের দেয়ালে পা দিয়ে দাঁড়ালাম। দুই হাত ছড়িয়ে শরীরে রক্ত চলাচল করিয়ে আমি এবারে হাঁটতে শুরু করি, হাঁটতে হাঁটতে পুরো ব্যাপারটি একেবারে গোড়া থেকে ভাবা দরকার।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস একজন হাইব্রিড মানুষ যার অর্থ সে একই সাথে মানুষ এবং যন্ত্র। তার শরীরে কী ধরনের যান্ত্রিক ব্যাপার আছে আমি জানি না। কিন্তু তার মস্তিষ্কে একটা কপোট্রন বসানো আছে সে-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তাই যখন। তার দেহের তাপমাত্রা শীতল করে তাকে ক্যাপসুলে ভরে রাখা হয়েছিল সে তার ভেতর থেকে বের হতে পেরেছিল। একজন সাধারণ মানুষ অচেতন হয়ে যায় ম্যাঙ্গেল জ্বাস কখনো অচেতন হয় না— তার কপোট্রন তখন তার শরীরের দায়িত্ব নিয়ে নেয়। সেই কপোট্রনটি কতটুকু বুদ্ধিমান? যেহেতু তার মাথার মাঝে বসানো আছে সেটি বাড়াবাড়ি কিছু হতে পারে না, নিশ্চয়ই কাজ চালানোর মতো একটি কপোট্রন। যদি কোনোভাবে ম্যাঙ্গেল ক্বাসকে অচেতন করে তার। কপোট্রনকে বের করে আনা যেত তাহলে কী বুদ্ধিমত্তার একটা প্রতিযোগিতা করা যেত না?
আমি গোলাকার ঘরের মাঝে আরো দ্রত হাঁটতে থাকি এবং আমার হাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে ঘরটি আরো দ্রত ঘুরতে থাকে এবং মাধ্যাকর্ষণ শক্তিও বেড়ে যায় আমার মনে হতে থাকে আমার শরীর ভারী হয়ে আসছে। ম্যাঙ্গেল কাসকে অচেতন করতে হলে তাকে বিষাক্ত কোনো গ্যাস দিয়ে অচেতন করতে হবে কিংবা খাবারের মাঝে কোনো বিষাক্ত জিনিষ মিশিয়ে দিতে হবে। কিন্তু এগুলো তৃতীয় শ্রেণীর অপরাধীর কাজ আমি কেমন করে সেটা করব?
আমি আরো দ্রত হাঁটতে থাকি এবং অনুভব করতে থাকি আমার শরীরের ওজন আরো বেড়ে যাচ্ছে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নিশ্চয়ই অনেকগুণ বেড়ে গেছে। আমার হঠাৎ একধরনের ছেলেমানুষি ঝোক চাপল, আমি আমার শারীরিক ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্যে আরো দ্রত হাঁটতে থাকি এবং দেখতে দেখতে আমার শরীর সিসার মতো ভারী হয়ে আসে, আমার মাথা হালকা লাগতে থাকে এবং আমার মনে হয় আমি বুঝি অচেতন হয়ে পড়ব। আমি তবুও দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে টেনে নিতে থাকি আমার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে আমার সারা শরীর ঘামতে থাকে। আমি পাথরের মতো ভারী দুটি পাকে আরো দ্রত টেনে নিতে থাকি, ধাতব দেয়ালে পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসতে থাকে আমার মনে হতে থাকে লাল একটা পর্দা বুঝি চোখের সামনে নেমে আসতে চাইছে, তবু আমি থামলাম না, আমি ছুটেই চললাম।
হঠাৎ করে কোথায় জানি কর্কশ স্বরে একটা এলার্ম ভেজে ওঠে এবং একটা লাল বাতি জ্বলতে-নিভতে শুরু করে। আমি সাথে সাথে ফোবিয়ানের কথা শুনতে পেলাম, মহামান্য ইবান, আপনি থামুন না হয় অচেতন হয়ে যাবেন।
আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠে বললাম, কী বললে তুমি ফোবি? কী বললে?
বলেছি আপনি এক্ষুনি যদি না থামেন তাহলে অচেতন হয়ে যাবেন, আপনার মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ কমে আসছে।
অচেতন? তুমি বলছ অচেতন হয়ে যাব?
হ্যাঁ।
ফোবি আমি দেখতে চাই আমি অচেতন না হয়ে কতদূর যেতে পারি—
কেন মহামান্য ইবান?
কারণ আছে, একটা কারণ আছে।
কী কারণ?
সময় হলেই তোমাকে বলব। এখন আমাকে আরো বেশি মাধ্যাকর্ষণে নিয়ে চলো–আরো বেশি–
ব্যাপারটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আপনি যে ভয়ঙ্কর মাধ্যাকর্ষণ শক্তিতে দাঁড়িয়ে আছেন, বেশিরভাগ মানুষ এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। তার অনেক আগেই অচেতন হয়ে পড়বে।
আমি হিংস্রভাবে একটু হেসে বললাম, আমি সেটাই চাই ফোবি, সব মানুষ যে মাধ্যাকর্ষণ বলে অচেতন হয়ে পড়বে আমি সেখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চাই।
আমি বুঝতে পারছি না মহামান্য ইবান।
তোমার বোঝার দরকার নেই। তুমি মূল তথ্যকেন্দ্র থেকে সব তথ্য নিয়ে এসে আমাকে সাহায্য করো ভয়ঙ্কর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মাঝে আমাকে স্থির থাকার শক্তি এনে দাও। মানুষের শরীরের যেটুকু শক্তি থাকতে পারে, যেটুকু সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে পারে তার পুরোটুকু আমার মাঝে এনে দাও। আমাকে পাথরের মতো শক্ত করে দাও।
সেজন্যে সময়ের প্রয়োজন মহামান্য ইবান। রাতারাতি মানুষকে অতি-মানবে রূপান্তর করা যায় না।
আমার কতটুকু সময় আছে আমি জানি না, কিন্তু আমি জানি নষ্ট করার জন্যে এক মাইক্রোসেকেন্ডও নেই।
ফোবি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বেশ।
আমি মুখ হা করে বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে গোলাকার ঘরটিতে নিজেকে টেনে নিতে থাকি আমাকে যেভাবেই হোক জ্ঞান না হারিয়ে থাকতে হবে। মানুষের পক্ষে যেটা অসম্ভব আমাকে সেই অসম্ভব শক্তি অর্জন করতে হবে। মিত্তিকাকে বাঁচানোর এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
ঘুম থেকে উঠে আমি মিত্তিকাকে খুঁজে বের করলাম। মহাকাশযানের এক নির্জন কোনায় গোল জানালার পাশে শুয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। বাইরে অসংখ্য নক্ষত্র কালো মহাকাশের মাঝে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। মহাকাশযানটি নিউট্রন স্টারের কাছাকাছি চলে আসছে, আমরা বুঝতে পারছি না কিন্তু মহাকাশযানটির গতিবেগ দ্রত বেড়ে যাচ্ছে। নিউট্রন স্টারটি এত ছোট যে এটিকে দেখা যাচ্ছে না। দূরে একটি নেবুলা তার সমস্ত বিচিত্র রূপ নিয়ে ফুটে আছে। আমি মিত্তিকার পাশে গিয়ে নরম গলায় ডাকলাম, মিত্তিকা।
সে ঘুরে আমার দিকে তাকাল, কিছু বলল না।
আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, তুমি আমার উপর খুব রেগে আছ তাই না?
মিত্তিকা এবারেও কোনো কথা বলল না। আমি অপরাধীর মতো বললাম, তোমার সাথে আমি একটু কথা বলতে চাইছিলাম মিত্তিকা।
মিত্তিকা বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুতভাবে একটু হেসে বলল, তোমার মতো একজন মহাপুরষ আমার মতো তুচ্ছ একজন মানুষের সাথে কথা বলবে?
আমি একটু হতচকিত হয়ে বললাম, তুমি কী বলছ মিত্তিকা?
আমি ঠিকই বলছি। তুমি অন্য ধরনের মানুষ— তুমি দশজন সাধারণ মানুষের মতো নও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বড় বড় জিনিস নিয়ে তোমাকে ভাবতে হয়। মহাজাগতিক প্রাণীরা যেন মানুষকে ভুল না ভাবে সেজন্যে আমার মতো তুচ্ছ একজন মানুষকে তুমি আবর্জনার মতো জঞ্জালের মতো ফেলে দাও।
কী বলছ তুমি মিত্তিকা?
মিত্তিকা গলার স্বরে শ্লেষ ফুটিয়ে এনে বলল, আমি ভুল বলেছি? নিশ্চয়ই ভুল বলেছি। আমি তুচ্ছ সাধারণ অশিক্ষিত মূখ একজন মেয়ে, আমি কি এই মহাজগতের বড় বড় জিনিস বুঝতে পারি? পারি না–
মিত্তিকা–
মিত্তিকা মুখ ফিরিয়ে বলল, আমাকে একা থাকতে দাও ইবান। দোহাই তোমার—
কিন্তু মিত্তিকা তোমার সাথে আমার কথা বলতেই হবে।
না ইবান। মিত্তিকা মাথা নেড়ে বলল, আমার সাথে তোমার কথা বলার কিছু নেই ইবান। আমাকে একা থাকতে দাও। দোহাই তোমার।
মিত্তিকা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তার চোখ মুছে নিল – আমার সামনে সে কাঁদতেও রাজি নয়।
আমি ভেসে ভেসে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ফিরে এলাম, হঠাৎ করে আমার নিজেকে একজন সত্যিকারের অপরাধী বলে মনে হতে থাকে।
নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ম্যাঙ্গেল ক্বাস চিন্তিত মুখে বসেছিল, আমাকে দেখে সে সর চোখে বলল, ইবান, তোমার সাথে আমার কথা রয়েছে।
আমি দেখতে পেলাম সে কোমরে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ঝুলিয়ে রেখেছে। আমি কাছাকাছি গিয়ে বললাম, কী কথা?
তুমি জানো আমি উপগ্রহে আটকা পড়ে থাকা আমার দলের লোকজনকে উদ্ধার করে আনতে চেয়েছিলাম।
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, জানি।
কিন্তু দেখতেই পাচ্ছ আমি আমার লোকজনকে উদ্ধার করতে পারি নি। ম্যাঙ্গেল ক্বাস একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তার মানে বুঝতে পারছ?
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, বুঝতে পারছি। তোমাকে আবার নতুন করে তোমার দল দাঁড়া করাতে হবে।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস একটু চমকে উঠে আমার দিকে তাকাল, সে আমার কাছে এই উত্তর আশা করে নি। কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, হ্যাঁ। তুমি ঠিকই বলেছ, আমাকে আবার নতুন করে আমার দল তৈরি করতে হবে। দল তৈরি করার জন্যে দরকার মানুষ। কাজেই আমার কিছু মানুষ দরকার।
আমি মুখে বিদ্রুপের একটা হাসি ফুটিয়ে বললাম, তোমার কিছু মানুষ দরকার নেই, তোমার দরকার কিছু দানবের।
ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মুখ পাথরের মতো শক্ত হয়ে উঠল, সে কঠোর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোমার সাহস দেখে মাঝে মাঝে বেশ অবাক হয়ে যাই। বেশি সাহস কারা দেখায় জানো।
জানি।
কারা?
দুই ধরনের মানুষ যারা সাহসী এবং যারা নির্বোধ। আমি জানি আমি সাহসী নই। কাজেই আমি নিশ্চয়ই নির্বোধ। কথা শেষ করে আমি দাঁত বের করে হাসার ভঙ্গি করলাম।
না, তুমি নির্বোধ নও। আমি প্রায় মন স্থির করে ফেলেছি যে তোমাকে আমি আমার দলে নেব।
আমি ভয়ানক চমকে উঠলাম, একজন পুরোদস্তুর দস্যু আমাকে তার দলে নেবে সে-ধরনের কথা আমি শুনতে পাব কখনো কল্পনা করি নি। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম— মানুষটি কি আমার সাথে ঠাট্টা করছে? আমি কয়েকবার চেষ্টা করে শেষপর্যন্ত বললাম, তুমি কী বলছ?
তুমি শুনেছ আমি কী বলেছি। এখন তুমি ভাবছ ব্যাপারটা অসম্ভব। তোমার মতো একজন নীতিবান সৎ ভালোমানুষ কেমন করে দস্যুদলে যোগ দেবে? কিন্তু ব্যাপারটা আসলে অন্যরকম।
অন্যরকম?
হ্যাঁ। সেই বিংশ শতাব্দীতে মানুষ আবিষ্কার করেছিল মস্তিষ্কের সামনের দিকে একটা অংশ রয়েছে যেটি মানুষের নৈতিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোবে ট্রান্সক্ৰানিয়াল ম্যাগনেটিক স্টিমুলেটর৩৬ দিয়ে সেই অংশটি নিখুঁত ভাবে খুঁজে বের করা হয়েছে। আমি সেই অংশটির অবস্থান জানি– মস্তিষ্কের এই অংশটি নষ্ট করে দেয়া হলো মানুষকে মুক্তি দেয়া হয়।
মুক্তি?
হ্যাঁ। তোমাদের তথাকথিত নৈতিকতার বন্ধন থেকে মুক্তি। একবার যখন মুক্তি পাবে তখন তোমাদের আর ভালো কাজ করতে হবে না, মহত্ত্ব দেখাতে হবে না, নৈতিকতা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। একেবারে ঠাণ্ডা মাথায় তখন তুমি মানুষ খুন করতে পারবে।
আমি কিছুক্ষণ বিস্ফারিত চোখে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দিকে তাকিয়ে রইলাম, মানুষটির কথাবার্তায় রহস্য বা বিদ্রুপের এতটুকু চিহ্ন নেই। সে যে কথাটি বিশ্বাস করে ঠিক সেই কথাটিই বলছে। ম্যাঙ্গেল ক্বাস হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, আমি ছোট একটা যন্ত্র তৈরি করিয়েছি, কপালের উপর বসিয়ে দিতে হয়, মাথার তিনদিক দিয়ে স্ক্যান করে মস্তিষ্কের মাঝে নির্দিষ্ট অংশটি খুঁজে বের করে। তারপর কপালে ড্রিল করে মস্তিষ্কে ঢুকে যায়, সেখানে নির্দিষ্ট অংশটিতে উচ্চ চাপের বিদ্যুৎ দিয়ে নিউরনগুলোতে ঝলসে দেয়া হয়। চব্বিশ ঘণ্টার মাঝে তুমি পুরোপুরি অন্য মানুষ হয়ে সেরে উঠবে। ম্যাঙ্গেল কাস কথা শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে মধুরভাবে হাসার চেষ্টা করল।
আমি হঠাৎ অনুভব করলাম ভয়ের একটা শীতল স্রোত আমার মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমার আতংকটি বুঝতে পারল, মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে মাথা নেড়ে বলল, আসলে ব্যাপারটি তোমার কাছে যত ভয়ঙ্কর। মনে হচ্ছে সেটা মোটেও তত ভয়ঙ্কর নয়। পুরো ব্যাপারটি দুই ঘণ্টার মাঝে শেষ হয়ে যায়, মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশটা খুঁজে বের করতে একঘণ্টা, মাথায় ড্রিল করে ফুটো করতে একঘণ্টা। নিউরনগুলো চোখের পলকে ঝলসে দেয়া যায়। সেরে উঠতে চব্বিশ ঘণ্টার মতো সময় লাগে। পুরো ব্যাপারে সেটাই সবচেয়ে সময়সাপেক্ষ। তোমার কাছে এখন মনে হচ্ছে অন্যায় কাজ করা খুব কঠিন, কিন্তু তুমি দেখবে কত সহজ।
আমি কোনো কথা না বলে বিস্ফারিত চোখে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ম্যাঙ্গেল কাস জিব বের করে ঠোট দুটো ভিজিয়ে নিয়ে প্রত্যেকটি শব্দ আলাদাভাবে উচ্চারণ করে বলল, ভূমিকা শেষ হয়েছে, এবারে আসল কাজের কথায় আসা যাক। সে একটা নিঃশ্বাস নিল তারপর নিজের নখের দিকে তাকাল তারপর ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ইবান, আমি বড় নিঃসঙ্গ।
আমি ভেতরে শিউরে উঠলেও বাইরে শান্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইলাম। ম্যাঙ্গেল ক্বাস মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, তোমার মহাকাশযান ফোবিয়ানের মেয়েটিকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। নামটিও খুব সুন্দর, মিত্তিকা।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি ঠিক করেছি মিত্তিকাকে আমার সঙ্গী করে নেব। কী বল?
তোমার মতো একজন দানবের চরিত্রের সাথে মানানসই একটা সিদ্ধান্ত।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস কোমরে বেঁধে রাখা অস্ত্রটি খুলে এবারে হাতে নিয়ে বলল, তোমার নিজের মঙ্গলের জন্যে বলছি ইবান, সীমা অতিক্রম করো না। ব্যাপারটি নিয়ে দুঃখিত হবারও সুযোগ পাবে না।
তুমি আমার মতামত জানতে চেয়েছিলে–
আসলে মতামত জানতে চাই নি, তোমাকে জানিয়ে রাখছিলাম। তোমার আসল সমস্যাটি কোথায় জানো?
ঠিক কোন সমস্যার কথা বলছ জানালে হয়ত বলতে পারতাম।
না, পারতে না। কারণ তুমি জানো না। ন্যায়-অন্যায় অপরাধ-মহত্ত্ব এসবের সংজ্ঞার পরিবর্তন হয়েছে। মস্তিষ্কের একটি ছোট অংশ আছে কি নেই সেটা হচ্ছে অপরাধী এবং নিরপরাধীর মাঝে পার্থক্য। যার সেই ছোট অংশ নেই তাকে কি আর অপরাধী হিসেবে ঘৃণা করা যায়, নাকি শাস্তি দেয়া যায়?
আমি কোনো কথা বললাম না। ম্যাঙ্গেল ক্বাস কয়েকমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, প্রাচীনকালে অপরাধী ছিল, নীতিবান মানুষও ছিল, এখন ওসব কিছু নেই। যেমন মনে করো মিত্তিকার কথা। মেয়েটিকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু আমি কি তাকে জোর করে আমার সঙ্গী করব? ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কখনোই না। আমি তার মস্তিষ্কে ছোট একটা অস্ত্রোপচার করব, মিত্তিকা তখন তার চারপাশের জগৎকে নতুন চোখে দেখবে।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস হাত দিয়ে নিজের বুক স্পর্শ করে বলল, মিত্তিকার তখন মনে হবে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সবচেয়ে সুদর্শন সবচেয়ে আকর্ষণীয় মানুষ হচ্ছে ম্যাঙ্গেল ক্বাস। পতঙ্গ যেভাবে আগুনের দিকে ছুটে যায়, গ্রহাণু যেভাবে ব্ল্যাকহোলের দিকে ছুটে যায় ঠিক সেভাবে সে আমার কাছে ছুটে আসবে। বুঝেছ?
আমি মাথা নেড়ে জানালাম যে আমি বুঝেছি।
ঠিক এরকম সময়ে মহাকাশযানটি একটু কেঁপে উঠল, ম্যাঙ্গেল ক্বাসের ভুর একটু কুঞ্চিত হয়ে উঠল, সে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
আমরা নিউট্রন স্টারের মাধ্যাকর্ষণের কাছাকাছি চলে আসছি। ফোবিয়ানের গতিবেগ বেড়ে যাচ্ছে, এই ভয়ঙ্কর গতিবেগের জন্যে এটা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। আমরা নিউট্রন স্টারের মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে ব্যবহার করে গ্যালাক্সির এই অংশ পাড়ি দেব।
স্লিং শট প্রক্রিয়া?
হ্যাঁ।
অত্যন্ত অস্থিতিশীল সময়?
খানিকটা। তোমার হিসেবে ভুল হলে নিউট্রন স্টারে গিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে।
আমি শান্ত গলায় বললাম, হিসেবে ভুল হবে না। ফোবিয়ান পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযান, এর নিউরাল নেটওয়ার্ক হিসেবে ভুল করে না।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস উঠে দাঁড়াতে গিয়ে খানিকদূর ভেসে গেল, ঘুরেফিরে এসে বলল, ইবান, এই ভরশূন্য পরিবেশ আমার আর ভালো লাগছে না। তুমি মহাকাশযানটিকে অক্ষের উপর ঘুরিয়ে মাধ্যাকর্ষণ ফিরিয়ে এনো।
আমি বললাম, আনব। নিশ্চয়ই আনব।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস চলে যাবার পর আমি নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের সামনে বসে দীর্ঘ সময় নিয়ে ফোবিয়ানের যাত্রাপথ পর্যবেক্ষণ করলাম। ফোবিয়ানের জ্বালানি সীমিত কাজেই যাত্রাপথে প্রতিটি বড় গ্রহ, নিরাপদ নক্ষত্র বা নিউট্রন স্টারকে ব্যবহার করা হয়, কোনো বিপদ না ঘটিয়ে যতটুকু সম্ভব কাছাকাছি যাওয়া হয়, প্রবল মহাকর্ষণে ফোবিয়ানের গতিবেগ বাড়িয়ে নেয়া হয়। গতিপথটি খুব যত্ন করে ছক করে নিতে হয় যেন নির্দিষ্ট দিকে নির্দিষ্ট বেগে যাওয়া যায়। ফোবিয়ানের নিউরাল নেটওয়ার্ক হিসেবে কোনো ভুল করবে না সে-ব্যাপারে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত, তবুও পুরোটা নিজের চোখে দেখতে চাইলাম। ম্যাঙ্গেল ক্বাসের দলকে উদ্ধার করার জন্যে খানিকটা ঘুরে আসতে হয়েছে। জ্বালানি। নষ্ট না করে সেই ক্ষতিটুকু পূরণ করার জন্যে এই নিউট্রন স্টারের বেশ কাছাকাছি যেতে হচ্ছে, যে ব্যাপারটি আমার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। এখান থেকে যে পরিমাণ বিকীরণ হচ্ছে সেটা ফোবিয়ান কতক্ষণ সহ্য করতে পারবে কে জানে। আমি নিয়ন্ত্রণ প্যানেলে নিউট্রন স্টারের অবস্থানটুকু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম, এর আকর্ষণে মহাকাশযানটির গতিবেগ প্রতিমুহূর্তে বেড়ে যাচ্ছে। মহাকাশযানে একধরনের কম্পন অনুভব করা যাচ্ছে, যতই সময় যাচ্ছে সেটা ততই বেড়ে যাচ্ছে। এরকম সময়ে যদি কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে যায়, সেটা নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন হবে।
আমি নিয়ন্ত্রণ প্যানেল থেকে সরে এসে ব্যায়াম করার ঘরটিতে ঢুকে সেটা ঘুরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করলাম। দেখতে দেখতে ঘূর্ণি বেড়ে গেল আমি সাথে সাথে দেয়ালে এসে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণের মাঝেই আমার দেহের ওজন বেড়ে যেতে শুরু করে, আমি আবার আমার শরীরের সহ্য করার ক্ষমতা পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করে দেই।
কিছুক্ষণের মাঝেই আমার শরীর সিসার মতো ভারী হয়ে আসে, আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, আমার চোখের সামনে লাল পর্দা কাঁপতে থাকে, আমি কোনোমতে পা টেনে টেনে দৌড়াতে থাকি, আমি টের পাই আমার সমস্ত শরীর ঘামতে শুরু করেছে। যখন মনে হলো আমি লুটিয়ে মাটিতে পড়ে যাব ঠিক তখন আমার কানের কাছে ফোবির কথা শুনতে পেলাম, মহামান্য ইবান।
আমি হাঁপাতে হাঁপাতে কোনোভাবে বললাম, বল ফোবি।
আপনি আবার নিরাপত্তার সীমা অতিক্রম করছেন।
ইচ্ছে করেই করছি ফোবি।
আমি এখনো বুঝতে পারছি না কেন।
সময় হলেই বুঝবে। এখন আমার একটা কথা শোন।
বলুন মহামান্য ইবান।
আমার কথা কি পুরোপুরি গোপনীয়? আর কেউ কী শুনতে পাবে?
না মাহামান্য ইবান, আর কেউ শুনতে পাবে না।
বেশ, তাহলে শোন আমি তোমাকে সপ্তম মাত্রার একটি জরুরি নির্দেশ দিচ্ছি।
ফোবি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সপ্তম মাত্রার নির্দেশ? আপনি কি সত্যিই বলছেন?
আমি সত্যিই বলছি।
সপ্তম মাত্রার নির্দেশে মহাকাশযানকে ধ্বংস করার পর্যায়ে নেয়া হয়।
হ্যাঁ। আমি জানি। অধিনায়ক হিসেবে আমার সেই ক্ষমতা আছে।
আপনি কেন সপ্তম মাত্রার আদেশ দিচ্ছেন মহামান্য ইবান?
তুমি নিশ্চয়ই জানো ম্যাঙ্গেল ক্বাস মিত্তিকার মস্তিষ্কে একটা অস্ত্রোপচার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জানি। অত্যন্ত দুঃখজনক একটি সিদ্ধান্ত।
সে যদি সত্যিই অস্ত্রোপচার শুরু করে তোমাকে এই আদেশ কার্যকরী করতে হবে। যদি না করে তাহলে প্রয়োজন নেই।
আমি কীভাবে আদেশ কার্যকরী করব?
ফোবিয়ানের গতিবেগ কমিয়ে আনতে শুরু করবে।
তার জন্যে ইঞ্জিন চালু করার প্রয়োজন রয়েছে।
আমি তোমাকে ইঞ্জিন চালু করার অনুমতি দিচ্ছি।
ফোবিয়ান দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, ফোবিয়ানের গতিবেগ কমিয়ে আনার অর্থ আমরা নিউট্রন স্টারে গিয়ে আঘাত করব।
হ্যাঁ, আমার ধারণা আত্মহত্যার জন্যে সেটি চমৎকার একটি উপায়।
আপনি আত্মহত্যা করতে চাইছেন মহামান্য ইবান?
না, চাইছি না। তবে অনেক সময় কিছু একটা না চাইলেও সেটা করতে হয়।
ফোবি আবার দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, আপনি সত্যিই এটা করতে চাইছেন?
হ্যাঁ। ফোবি আমি চাইছি।
বেশ তবে আমার কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রয়োজন। কী হারে গতিবেগ কমাব।
আমি বলছি, তুমি মন দিয়ে শোনো।
আমি আমার পাথরের মতো ভারী দেহকে টেনে নিতে নিতে ফোবিকে নির্দেশ দিতে শুরু করলাম।