সাধুবাবার ভীমরতি যে দিনদিন বাড়ছে বই কমছে না, সে বিষয়ে গদাইয়ের কোনও সন্দেহ নেই। এখন তিন-তিনটে দানো শিবমন্দিরের চাতালে বাঁধাছাদা হয়ে পড়ে আছে। কারও চেতনা নেই। আরক খাইয়ে তাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। সাধুবাবা তাদের দিকে আড়ে-আড়ে চায়, আর মাথা চুলকোয়। বোঝা যায়, বাবাজি কিছু ধন্দে পড়েছে।
গদাই একদিন সকালবেলায় জিজ্ঞেস করল, “তা হাঁ বাবা, এত দিনেও কী সাব্যস্ত করা গেল না? কোন দানোটা আসল, আর কোনটা নকল? ত্রিকালদর্শী মানুষ আপনি, মন্তরের এত জোর, ধ্যানে বসলে শরীর হালকা হয়ে তিন হাত শূন্যে উঠে বসে থাকেন–নিজের চোখেই দেখেছি। তা আপনার মতো সাধকেরও যদি ভীমরতি হয়, তা হলে আমাদের মতো পাপী-তাপীর কোন দুর্গতি হবে কে জানে!”
সাধুবাবা একটু ভোমতোলা চোখে চেয়ে থেকে বলল, “তা গণ্ডগোল একটু হচ্ছে বাপু। দেহ ছাড়ার সময় হলে বিভূতিগুলো একটু-একটু করে দেহ ছেড়ে পালাতে থাকে কিনা!”
গদাই একটু আশার আলো দেখে ভারী গদগদ গলায় বলল, “দেহ ছাড়ার সময় কি এসে গেল নাকি বাবা? তা হলে আপনার জিনিসগুলোর একটা বিলিব্যবস্থা এইবারে করে ফেললে হয় না?”
সাধুবাবা রোষকষায়িত লোচনে তাকে ভেদ করে বলল, “দুর ব্যাটা পাষণ্ড, আমার দেহ ছাড়তে-ছাড়তে আরও সত্তর-পঁচাত্তর বছর। তাও ক’টা বছর পর্বতগুহায় ধ্যানাসনে কাটিয়ে দিতে হবে।”
ভারী হতাশ হয়ে গদাই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আহা, শুনে ধড়ে প্রাণ এল। সত্তর-পঁচাত্তর বছর লম্বা সময়।”
“সে তোদের কাছে। আমার কাছে ও তো চোখের পলক ফেলার সমান।”
“কিন্তু বাবা, এই কেষ্টর জীবগুলোকে এইভাবে কষ্ট দেওয়া ঠিক হচ্ছে? এদের মধ্যে কোনটা পিদিমের দানো সেটা তো মন্ত্রবলে ধ্যানযোগেই আপনার জানবার কথা।”
“ওইখানেই তো হয়েছে মুশকিল। কী জানিস, মাথার যে প্রকোষ্ঠে মন্তরগুলো থাকে, ইদানীং দেখছি, সেটা একটু ফঁকা-ফাঁকা ঠেকছে। কিছু-কিছু মন্তর কোন ফাঁকে যেন বেরিয়ে গিয়েছে।”
গদাই চোখ বড়-বড় করে বলল, “তা হলে তো সর্বনাশ! মন্তর পালিয়ে গিয়ে থাকলে উপায় কী হবে বাবা?”
“আরে পালিয়ে যাবে কোথায়! বেশি দূর যায়নি, আশপাশেই ঘঘারাফেরা করছে। ওসব আমার পোষা মন্তর, গায়ে একটু হাওয়া লাগিয়ে ফের ঠিক ফিরে আসবে।”
“আমি খবর নিয়ে দেখেছি বাবা, যাদের বেঁধে রেখেছেন তাদের একজন পায়েসপুরের পালোয়ান বটেশ্বর, আর-একজন রিটায়ার দারোগা রাধাগোবিন্দ। তাদের বাড়িতে-বাড়িতে বড্ড কান্নাকাটি
হচ্ছে বাবা। আর তিন নম্বর দানুও বলেছিল বটে যে, সে মোটেই দানোটানো নয়। তার মৃগীর ব্যারাম ছিল। রমেশ কোবরেজ এক প্রাচীন পুঁথি থেকে নিদান বের করে পাঁচন গুলে খাওয়ায়। তাতে সে ঢ্যাঙা হয়ে পড়েছে, আর গায়ে খুব জোরও হয়েছে।”
সাধু গম্ভীর হয়ে বলল, “তোর কথায় বিশ্বাস কী? তুই ফন্দিবাজ মানুষ।”
“না বাবা, আপনার ভীমরতিটা দেখছি বেশ গেড়ে বসেছে। ভুল লোককে পাকড়াও করছেন, মন্তর ভুলে যাচ্ছেন, তৃতীয় নয়নে চালসে ধরেছে, এ যে বড় বিপদের কথা প্রভু! এরকম গুরু ধরে আমারই বা কী গতি হবে কে জানে বাবা?”
সাধু হুংকার দিয়ে বলল, “তুই অতি বজ্জাত!” কিন্তু হুংকারটা বড় মিয়নো শোনাল। অর্থাৎ ভুলভাল যে হচ্ছে, সেটা সাধু নিজেও টের পাচ্ছে।
গদাই সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “আপনি তো কিছু এলেবেলে সাধু নন বাবা। ক্ষমতা বড় কম নেই আপনার। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে যখন ভুলচুক হচ্ছে তখন উপযুক্ত শিষ্যকে সব শিখিয়ে-পড়িয়ে দিলেই তো হয়। তারপর আপনি নিশ্চিন্তে হিমালয়ে গিয়ে লম্বা তপস্যায় বসে যান। ইদিকে আমি আপনার সব কাজকর্ম সামলে দিয়ে, লোককে নানারকম বুজরুকি দেখিয়ে একটু নামডাক করে ফেলি। তারপর আরও একটু বয়স হলে না হয় সাধন-ভজনে মন দেওয়া যাবে।”
সাধু গম্ভীর গলায় বলল, “তুই খুব ঘড়েল লোক।”
.
আজ সকালবেলায় পায়েসপুরে ঢুকেই গদাই ভারী অবাক হয়ে গেল। আগের দিন পায়েসপুরের আকাশে-বাতাসে, পাখির ডাকে দুঃখের ফুলঝুরি দেখে গিয়েছিল। আজ দুঃখের চেয়েও বেশি কিছু যেন চেপে বসে আছে পায়েসপুরের বুকে। সেটা শোক। পায়েসপুর একেবারে স্তব্ধ। গাছ নড়ছে না, কাক ডাকছে না, মানুষজন মাথা নত করে বসে আছে।
নগেনবাবু ধরা গলায় বললেন, “ওরে গদাই, পায়েসপুরের আর আশা নেই রে।”
হারাধনবাবু আবেগমথিত গলায় শুধু বলতে লাগলেন, “যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলল, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ…,” ইত্যাদি।
ব্যাপারটা বুঝতে একটু সময় লাগল গদাইয়ের। তবে শেষ অবধি টুকরোটাকরা কথা, দীর্ঘশ্বাস, কোটেশন এই সব জুড়ে বোঝা গেল যে, গাব্বু নামে একটা গুন্ডা প্রদীপের দৈত্যকে নিয়ে চারদিকে দাপিয়ে বেড়াতে লেগেছে। তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বুকে ডুগডুগি বাজতে লাগল, উত্তেজনায় হাতে-পায়ে কাঁপুনি ধরে গেল।
গদাই দশগা ঘোরা লোক। গাব্বুর খবর করতে তার খুব বেশি দেরি হল না। রাঘবগঞ্জের খাল পেরিয়ে হিরাপুরের জঙ্গল! তার মাইলটাক উত্তরে বিদড়িহাটের সীমানায় একটা ফলসা জঙ্গলের মধ্যে গাব্বুর কুঁড়েঘর। বেলাবেলি রওনা হলে বড়জোর ঘণ্টাটাক লাগবে।
গদাই পা চালিয়ে রওনা হয়ে পড়ল।
ঘণ্টাটাক পর সে বিদড়িহাটের ফলসাবনে ঢুকে হাঁ হয়ে গেল। কোথায় কুঁড়েঘর! এ তো বেশ একখানা আঁকের বাড়ি! সামনে বাগান, বাগানে ফোয়ারা। ফুলটুলও ফুটে আছে মেলা। ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে সে খুব ভাল করে পরখ করল চারদিকটা। কেউ কোথাও নেই।
গদাই সাহস করে ঢুকে পড়ল ফটক ঠেলে।
সন্তর্পণে বারান্দায় উঠে কড়া নাড়তে যাবে বলে হাতটা বাড়িয়েছিল গদাই, ফস করে হঠাৎ সামনে উঁই কুঁড়ে একটা সাত আট হাত লম্বা আর অতিকায় চেহারার একটা লোক তার পথ জুড়ে দাঁড়াল। মেঘগর্জনের মতো গলায় বলল, “কী চাই?”
গদাই এমন ভড়কে গিয়েছিল যে, ধাত ছাড়ার উপক্রম। বুকের ধুকপুকুনি রেলগাড়িকে হার মানিয়ে এমন বেগে হতে লাগল যে, দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়।
একটু সামলে নিয়ে সে একগাল হেসে বলল, “প্রাতঃপ্রণাম, প্রাতঃপ্রণাম। তা শরীরগতিক সব ভাল তো?”
দৈত্যটা ভাবলেশহীন চোখে তার দিকে চেয়ে রইল শুধু। একটাও কথা বলল না।
হেঁ হেঁঃ করে হাত কচলাতে কচলাতে গদাই গলাখাকারি দিয়ে বলল, “যা শুনেছিলাম, আপনি দেখছি তার চেয়েও সরেস! আহা, কী শালগাছের মতো হাত! কী থামের মতো পা! ফুটবল মাঠের মতো কী বিরাট ছাতি! আর লম্বাটাও বলতে নেই, তালগাছকেও লজ্জা দেয়। আপনার কাছে কোথায় লাগে বটেশ্বর, কোথায় লাগে রাধাগোবিন্দ, আর ঢ্যাঙাদানু তো আপনার কোমরের কাছে পড়বে!”
দৈত্যের বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে, নিশ্চুপ।
“তা লোকে বলাবলি করছে বটে, হ্যাঁ, এত দিনে একটা মানুষের মতো মানুষ এসেছে বটে এ তল্লাটে! যেমন বুকের পাটা, তেমনই খ্যামতা। চারদিকে যে একেবারে ধন্যি-ধন্যি পড়ে গিয়েছে মশাই!”
“কী চাই?”
“না, বিশেষ কিছু চাইতে আসা নয়। গাব্বুদাদার সঙ্গে পুরনো চেনা তো! তা শুনলুম, গাব্বোয়া এখন অনেক উন্নতি করে ফেলেছে। তাই একটু দেখে গেলুম আর কী। তবে কিনা মশাই, কেউ উন্নতি করলেই পাঁচজনের বড় চোখ টাটায়। আড়ালে আবডালে কেউ-কেউ পিছনে লাগবারও চেষ্টা করে কিনা! তা গাব্বুয়া কি ঘুম থেকে উঠেছে মশাই?”
“আমার মনিব বিশ্রাম নিচ্ছেন। কারও দেখা করার হুকুম নেই।”
গদাইয়ের মুখ শুকনো। দৈত্যের চোখ এড়িয়ে ভিতরে যাওয়ার উপায় নেই। একেবারে তীরে এসে তরী বুঝি ডোবে! গদাই ঘাড় কাত করে বলল, “তা বিশ্রাম নেওয়াই উচিত। মেহনত বড় কম যায় না। আজও হয়তো রাতবিরেতে বেরোতে হবে।”
দৈত্য নিশ্চুপ। “আচ্ছা মশাই, আপনার কি সাধুবাবুকে মনে আছে? সেই যে, আপনি যখন ছোট্টটি ছিলেন, তখন সাধুবাবা আপনাকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াতেন, ঝিনুকে করে দুধ খাওয়াতেন, ছোট বাইরে বড় বাইরে পরিষ্কার করতেন। সেই যে লম্বা-চওড়া চেহারার মন্ত সাধু!”
“আমি কোনও সাধুকে চিনি না। আমি কখনও ছোট্ট ছিলাম না। আমি চিরকাল একই রকম।”
“বাঃ। তা হলে বোধ হয় ভুলই শুনেছি। তবে এটা জানি যে, সাধুবাবা আপনাকে খোঁজাখুঁজি করছেন। কারণটা ঠিক জানা নেই বটে। তবে মনে হল, আপনাকে ছাড়া তার বেশ কষ্ট হচ্ছে। শত হলেও মায়ার বাঁধন তো?”
“তুমি মিথ্যেবাদী।”
সঙ্গে-সঙ্গে ঘাড় কাত করে সায় দিয়ে গদাই বলল, “তা মিছে কথাও মাঝে-মাঝে বলে ফেলি বটে, তবে লোকের ভালর জন্যই
বলা। সেই সঙ্গে গাবুয়ার সঙ্গে একটু কাজের কথাও ছিল।”
“কী কথা?”
“সে বড় গুহ্য কথা।”
“আমাকে বলল। আমি তার হুকুমদাস।”
“ওরে বাবা, সে উপায় নেই মশাই। গুরুতর খবর, গাব্বুয়া ছাড়া আর কারও কাছে বলা যাবে না।”
“তুমি দাঁড়াও।” বলেই দৈত্য অদৃশ্য হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড পরেই আবার ফস করে সামনে ফলিত হয়ে বলল, “ভিতরে এসো।”
ভিতরে দিব্যি সব ব্যবস্থা। ভাল-ভাল চেয়ার, টেবিল, আরামকেদারা, দেওয়ালগিরি, দামি গালিচা। টেবিলে থরেথরে আপেল, আঙুর, বেদানা মজুত। শরবত-টরবতও আছে, দেখা গেল।
একটা সিংহাসনের মতো চেয়ারে পোশাক পরা গাব্বু ঘাড় হেলিয়ে বসা! চুল এলোমেলো, চোখ দুটো যেন লাল, মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ এবং ক্লান্তি। গদাইয়ের দিকে ক্রুর চোখে চেয়ে বলল, “তুমি কে?”
গদাই ভারী বিনয়ের সঙ্গে বলল, “ভুলে গেলে নাকি ভাই? আমি হলুমগে গদাই।”
কাহিল চোখে চেয়ে থেকে বেশ ক্লান্ত গলায় গাম্বু বলল, “তুমি জড়িবুটিওলা গদাই না?”
গদাই একগাল হেসে বলল, “এই তো ভাইটির মনে পড়ে গিয়েছে। আমার তো ভয় ছিল, বড়মানুষ হয়ে আমাকে বোধ হয় চিনতেই পারবে না! তা ভায়া, তোমার উন্নতি দেখে ভারী খুশি হলুম। কিন্তু তোমার চেহারাটা তেমন ভাল দেখছি নাশরীরটা কি খারাপ যাচ্ছে? খুব হয়রান হয়ে পড়োনি তো!”
গাবু অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলল, “আঃ! বাজে কথা ছাড়ো। এখন বলো তো, কী মতলবে এসেছ?”
গদাই একটু থমমত খেয়ে ফের বিগলিত হয়ে বলল, “মতলবেই আসা বটে, তবে মতলব কিছু খারাপ নয় রে ভাই। বলতে এলুম যে, জীবনে উন্নতি করলেই তো হল না, সেইসঙ্গে পথের কাঁটাও তো নিকেশ করা চাই, নাকি?”
গাব্বু সোজা হয়ে বসে বলল, “কে আমার পথের কাঁটা?”
“দ্যাখো ভাই, তোমার ভাল ভেবেই কষ্ট করে হাঁফাতে-হাঁফাতে এত দূর এসেছি। তাও তো তোমার পাহারাদার আমাকে গলাধাক্কাই দিচ্ছিল আর কী?”
“কিছু মনে কোরো না ভাই। চারদিকে আমার বিরুদ্ধে নানারকম যড়যন্ত্র হচ্ছে বলে খবর পেয়েছি, তাই সাবধান হতে হয়েছে। এবার বলো।”
“বলি, গলা ভিজনোর জন্য একটু জল পাওয়া যাবে কি?”
“আহা, জল কেন, ভাল শরবত আছে, খাও। ওরে গোলাম, শরবত দে।”
দৈত্যটা চট করে এক গেলাস শরবত এনে দিল। মুখে দিয়েই গদাই বুঝল এ বড় উঁচু জাতের জিনিস, জন্মেও এরকম কখনও খায়নি। তবে তার জল বা শরবতের দরকার ছিল না। কী বলবে সেটা এঁচে নিতে একটু সময়ের দরকার ছিল মাত্র। শরবত খেতে খেতেই সে বয়ানটা গুছিয়ে ফেলল।
তারপর গেলাস রেখে জামায় মুখ মুছে গলাটা খাটো করে বলল, “খবরটা ঠিকই পেয়েছ ভায়া। তোমাকে নিকেষ করে পিদিমটা কেড়ে নেওয়ার একখানা পাকা ছক কষা হয়ে গিয়েছে।”
“কে? কার এত সাহস?”
“প্রতাপগড়ের জঙ্গলে একটা ভাঙা শিবমন্দির আছে জানো তো?”
“জানি।”
“সেখানে ক’দিন হল এক সাধু আস্তানা গেড়েছে। পেল্লায় চেহারা। সাক্ষাৎ নরখাদক। সে পিদিমটার সন্ধানেই এসেছে। তার মেলা চেলা-চামুণ্ডা। ভূত-প্রেতও তার বশ। যদি সাবধান না হও, তা হলে পিদিম রক্ষে করতে পারবে না।”
গাব্দু একটা অট্টহাসি হেসে পাশের একটা সোনার পাত্র থেকে একমুঠো মোহর তুলে তার হাতে দিয়ে বলল, “এই নাও বখশিস। সাধুর জারিজুরি কী করে ভেঙে দিই তাও দ্যাখো। ওরে গোলাম, যা, গিয়ে প্রতাপগড়ের জঙ্গলের ভাঙা শিবমন্দির থেকে সাধুটাকে ধরে নিয়ে আয়।”
দৈত্য হুশ করে অদৃশ্য হল। এবং এক লহমায় ফিরে এল। ঘাড় ধরে সাধুকে নিয়ে এসেছে। সাধু ত্রিশূলটা অবধি রেখে আসার ফুরসত পায়নি। সেটা এখনও এক হাতে ধরা। সাধুকে গাবুর সামনে নামিয়ে দিয়ে সে সসম্ভ্রমে সরে দাঁড়াল।
গাব্দু সাধুর দিকে রক্তচোখে চেয়ে বলল, “কী হে সাধুবাবাজি, তোমার মতলবখানা কী?”
সাধুবাবা মিটমিট করে একবার গাবু আর একবার গদাইয়ের দিকে চেয়ে দেখল। তারপর বজ্রগম্ভীর গলায় বলল, “আমার পিদিম দে।”
হোঃ হোঃ করে হেসে গাবু তার আলপাকার পোশাকের পকেট থেকে পিদিমখানা বের করে হাতের তেলোয় রেখে বলল, “এইটে চাই বুঝি তোমার?”
সাধু গমগমে গলায় বলল, “যার জিনিস তাকে ফেরত দে পাপী। নইলে কপালে কষ্ট আছে।”
“বটে! ওরে গোলাম, সাধুটাকে তুলে কয়েকটা আছাড় দে তো।”
দৈত্য চকিতে এগিয়ে এসে সাধুকে তুলে বিশাল জোরে মেঝের উপর আছড়ে ফেলল। সেই আছাড়ের শব্দে কেঁপে উঠল গোটা বাড়ি। গোটাপাঁচেক আছাড়ের পর গাব্বু বলল, “যাক, আর নয়। কী সাধু, পিদিম চাই?”
“চাই, দে। নইলে তোর সব যাবে। পিদিমের জোরে যদি রাজা হতে চাস, তবে লোকে তোর গায়ে থুথু দেবে। এই সব ভোজবাজির আয়ু বেশি দিন নয়। এখনও সময় আছে। পিদিম ফেরত দে।”
“এই দিচ্ছি। ওরে গোলাম, ওর ত্রিশূল দিয়েই ওকে ছুঁড়ে দে তো। এ-ফোঁড় ওফোঁড় করে তবে ছাড়বি।”
গদাই সভয়ে চোখ বন্ধ করে চিৎকার করল, “না! না!”
দৈত্য বিনা দ্বিধায় শূলটা তুলে নিয়ে সাধুর বুকে ভীমবেগে বসিয়ে দিল। সাধুকে ভেদ করে পিঠ থেকে শুলের ডগা বেরিয়ে রইল।
সাধু ফের অবিচল কণ্ঠে বলল, “তোর মনস্কামনা পূর্ণ হওয়ার নয়। আমার মরার যখন সময় হবে তখনই আমি মরব। ইচ্ছামৃত্যু। তার আগে কারও হাতেই আমার মরণ নেই। পিদিমটা দে।”
গাব্দুর মুখ হাঁ, চোখ বিস্ফারিত। সে যে ভয় পেয়েছে তাতে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। তোতলাতে-তোতলাতে সে বলল, “তু-তুমি মরলে না?”
সাধু একটানে শূলটা বের করে বলল, “দে।”
গাল্লু পিদিমটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে বিকট চিৎকার করে বলতে লাগল, “গোলাম, ওকে মেরে ফ্যাল, শিগগির মেরে ফ্যাল! যেমন করেই হোক মেরে ফ্যাল।”
কিন্তু হঠাৎ সাধু বিদ্যুৎ-বেগে শূলটা ছুঁড়ে দিল গাবুর দিকে। সেটা নিখুঁত নিশানায় তার ডান হাতের কবৃজি ভেদ করে যেতেই পিদিমটা ঠং করে পড়ে গেল মেঝেয়। ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটা অতি তৎপরতায় তুলে নিল গদাই। তারপর চোখ পাকিয়ে দৈত্যের দিকে চেয়ে বলল, “চুপচাপ ঘরের কোণে গিয়ে হাঁটুগেড়ে বসে থাক।”
দৈত্য বলল, “জো হুজুর। তারপর গিয়ে ঘরের কোণে হাঁটু মুড়ে বসল।”
সাধু জ্বলজ্বলে চোখে গাব্বুর দিকে চেয়ে হাত তুলে বলল, “পুনর্বিগত ভবঃ।”
হঠাৎ ঘরদোর সব মিলিয়ে গেল। দেখা গেল একটা দীন-দরিদ্র খোড়োঘরে তারা রয়েছে। গদাই চোখ কচলে বলল, “বাবা, এসব কি হাওয়াবাজি ছিল নাকি?”
“দুনিয়ার সব কিছুই হাওয়াবাজি রে ব্যাটা। যত তাড়াতাড়ি তোর জ্ঞান হবে তত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবি।”
গাঙ্কু কবজি চেপে ধরে কাতরাতে-কাতরাতে অবিশ্বাসের চোখে সাধুবাবার দিকে চেয়ে ছিল। হিংস্র গলায় বলল, “আমার পিদিম কেড়ে নিয়েছ! ওরে গোলাম, পিদিমটা উদ্ধার করে আমাকে দে।”
গোলাম নড়লও না। সাধু বলল, “আমার কাজ শেষ হয়েছে। আমি যাচ্ছি। শোক কোরো না। ও পিদিম তোমার নয়, আর ও জিনিস হজম করার ক্ষমতাও তোমার নেই। কয়েক দিনেই সারা এলাকার সর্বনাশ করতে বাকি রাখোনি। বাকি জীবন আধপেটা খেয়ে থাকবে, এই তোমার শাস্তি।”
তারপর সাধু গদাইয়ের দিকে ফিরে বলল, “এই খাড়া দুপুরে এতটা পথ হেঁটে ফিরতে পারব না রে বাপু। দত্যিটাকে বল, একটু পৌঁছে দিক।”
জিভ কেটে গদাই তাড়াতাড়ি পিদিমখানা সাধুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “আপনি বলুন বাবা, জীবনে কখনও দাসদাসী খাটাইনি তো। ও আমার সইবে না।”
সাধু একটু হাসল।
দৈত্যের পিঠে চেপে এক লহমায় প্রতাপগড়ের জঙ্গলে শিবমন্দিরের চাতালে পৌঁছে গেল তারা।
সাধুবাবা দৈত্যকে বলল, “তোর কাজ শেষ হয়েছে বাবা, এবার পিদিমের ভিতরে গিয়ে ঘুমিয়ে থাক।”
“যথা আজ্ঞা মহারাজ।” বলেই দৈত্যটা একেবারে ধোয়াক্কার হয়ে গিয়ে পাক খেয়ে-খেয়ে সুতোর মতো সরু হয়ে সুড়সুড় করে পিদিমের মধ্যে ঢুকে মিলিয়ে গেল।
পিদিমখানা ঝোলায় পুরে সাধুবাবা বলল, “ওই তিনটে লোকের বাঁধন খুলে দে বাপু। এই ওষুধটা খাইয়ে দে। আমি রওনা দেব রে!”
“সে কী বাবা! এখনই যাবেন কি? আমার যে সাধন-ভজন শেখা এখনও অনেক বাকি।”
সাধুর দাড়ি-গোঁফের ফাঁক দিয়ে এবার একটু হাসি দেখা গেল। বলল, “সাধন-ভজন কী আর একরকম রে? নানাজনের নানারকম। লোভটোভ করিসনি বাবা, দুনিয়াটাকে একটু ভালবাসিস, আমাকে মনে রাখিস, আর শোন, অল্পে আনন্দ পেতে শিখে নিস। তোর ওতেই হবে রে। আর এই আমার ঝোলাখানা আজ থেকে তোর কাঁধে ঝুলবে।”
“উরেব্বাস রে! ওতে যে ওই সব সাংঘাতিক জিনিস আছে?”
“তা আছে। পরশপাথর, আশ্চর্য পিদিম, উড়ুক্কু গালিচা আর অক্ষয় থালা। দুনিয়ার সব ঐশ্বর্য তোর হাতের নাগালে রেখে গেলাম। আজ আর আমার কোনও ভার নেই।”
“আমি কিন্তু বেশ লোভী লোক বাবা?”
“তা আমি জানি। তুই লোভী, পেটুক, একটু ঘড়েল। তবু এই কলিযুগের পক্ষে তুই তেমন খারাপ লোক নোস। কত লোককেই তো কত জিনিস দিয়ে নিরপরখ করলাম। তোকেও না হয় একটু বাজিয়ে দেখা যাক।” তারপর সাধু হাত তুলে বলল,
“আনন্দম!”
সাধু চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ মনটা বড় খারাপ হয়ে রইল গদাইয়ের। তার পর সে ধীরে-সুস্থে বটেশ্বর, রাধাগোবিন্দ আর দানুর বাঁধন খুলল, তাদের ওষুধ খাওয়াল। জ্ঞান ফেরার পর তাদের হটিয়ে নিয়ে জঙ্গলের সীমানা পার করে দিয়ে এল।
তারপর শিবমন্দিরে ফিরে সাধুর ঝোলা খুলে জিনিসগুলো বের করে চাতালে পরপর সাজিয়ে রেখে চেয়ে রইল। পিদিমের দৈত্য তাকে লহমায় রাজা করে দিতে পারে। পরশপাথর পারে মন-মন সোনা তৈরি করতে। উড়ুক্কু গালিচায় চেপে আকাশে উড়ে যেখানে খুশি চলে যাওয়া যায়। আর অক্ষয় থালার কাছে চাইলে পাওয়া যায় দুনিয়ার সবরকম খাবারদাবার। বুকটা বড় দুরদুর করে উঠল তার। সাধুবাবার কি উচিত হল এত সম্পদ তাকে দিয়ে যাওয়া?
অনেকক্ষণ বসে-বসে ভাবল সে। ভাবতে-ভাবতে চোখে জল এল।