সর্বশেষে ডাক পড়ল সুবালাদির। সুবালা।
পদশব্দে মুখ তুলে তাকিয়েই কিরীটী কয়েকটা মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইল।
কিরীটীরই ভাষায়–
স্তব্ধ নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম যেন প্রথমটায়। একটা জ্বলন্ত আগুনের রক্তাভ শিখা যেন আমার সামনে এসে দাঁড়াল হঠাৎ।
এত রূপ মানুষের দেহে কখনও সম্ভব কি!
শুভ্র পরিধেয় শ্বেতবস্ত্রে সে রূপ যেন আরও স্পষ্ট আরও প্রখর হয়ে উঠেছিল।
বিস্ময় ও আকস্মিকতায় কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেলে আবার ভাল করে ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকালাম এবং তখুনি আমার মনে হল সে রূপ বা দেহশ্রীর মধ্যে এতটুকু স্নিগ্ধতা নেই। জ্বলন্ত উগ্র উষ্ণ। তৃষ্ণা মেটে না, চোখ যেন ঝলসে যায়।
আরও একটা জিনিস যেটা আমার চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, তার ছোট কপাল, বঙ্কিম জ্ব-যুগল ও ঈষৎ চাপা নাসিকার মধ্যে যেন একটা উগ্র দাম্ভিকতা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। দৃঢ়বদ্ধ চাপা ওষ্ঠ ও সরু চিবুক নিদারুণ একটা অবজ্ঞায় যেন কুটিল কঠিন।
এমন কি তার দাঁড়াবার ভঙ্গিটির মধ্যেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে একটা তাচ্ছিল্যের ও অবজ্ঞার ভাব।
কপাল পর্যন্ত স্বল্প ঘোমটা টানা।
তার ফাঁকে ফাঁকে কুঞ্চিত কেশদাম উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।
বয়স ত্রিশের বেশী নয়।
কিরীটীই প্রথম কথা বললে, আপনিই সুবালা দেবী?
হ্যাঁ। নিম্নকণ্ঠে শব্দটা উচ্চারণ করলে সুবালা।
বসুন।
কিরীটীর বলা সত্ত্বেও উপবেশন না করে সুবালা নিঃশব্দে বারেকের জন্য ঘরের মধ্যে উপস্থিত কিরীটী, শিউশরণ ও সুব্রত সকলের মুখের দিকে দৃষ্টিটা যুগপৎ বুলিয়ে নিয়ে কিরীটীকেই প্রশ্নটা করল, আমাকে আপনারা ডেকেছেন কেন?
অতুলবাবুকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে, শুনেছেন বোধ হয়? কথাটা বললে কিরীটী।
শুনেছি। তেমনি নিম্ন শান্ত কণ্ঠের জবাব।
গত রাত্রে আপনি মণিকা দেবীর সঙ্গে একই ঘরে শুয়েছিলেন, তাই না?
হ্যাঁ।
কাল রাত কটা আন্দাজ আপনি ঘুমোতে যান মনে আছে কি আপনার?
ও ঘরে আমি রাত দশটায় সকলের খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলেই যাই। বিছানায় যাই রাত এগারোটা আন্দাজ।
সারদা দেবী—মানে মণিকা দেবীর দিদিমা তো ওই একই ঘরে ছিলেন?
হ্যাঁ।
সারদা দেবীর আফিমের অভ্যাস আছে শুনলাম!
হ্যাঁ।
সারদা দেবী সাধারণত রাত্রে ঘুমোন কেমন?
সাধারণতঃ ভাল ঘুম হয় না তাঁর। নেশায় একটা ঝিমানো ভাব থাকে।
কানেও তো একটু কম শোনেন উনি শুনলাম!
সে এমন বিশেষ কিছু নয়।
রাত সাড়ে এগারোটার পর মণিকা দেবী ঘরে ঢুকে আলো জ্বালান। তার আগে পর্যন্ত মানে রাত এগারোটা পর্যন্ত আপনি কি করছিলেন?
একটু আগেই তো আপনাকে বললাম রাত এগারোটায় আমি শুতে যাই।
হ্যাঁ, কিন্তু ঘরে গিয়েছেন আপনি রাত দশটায়। দশটা থেকে এগারোটা এই এক ঘণ্টা আপনি কি করছিলেন?
একটা বই পড়ছিলাম।
তারপর?
তারপর আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ি।
শুয়েই নিশ্চয়ই ঘুমোননি?
না। তবে বোধ হয় মিনিট দশেকের মধ্যেই ঘুম এসে গিয়েছিল।
মণিকা দেবী রাত সাড়ে এগারোটায় যখন ঘরে ঢোকেন, জানেন আপনি?
ঠিক কখন সে ঘরে প্রবেশ করেছে জানি না। তবে মাঝরাত্রে একবার ঘুম ভেঙে যেতে দেখেছিলাম ঘরে আলো জ্বলছে—মণি বিছানায় শুয়ে শুয়ে কি একটা বই পড়ছে।
আবার আপনি ঘুমিয়ে পড়েন?
হ্যাঁ।
কখন ঘুম ভাঙল?
ভোর পাঁচটায়।
অত ভোরে কি সাধারণত আপনি বিছানা ত্যাগ করেন?
হ্যাঁ, ভোর-ভোরই আমি ঘরের কাজকর্ম সেরে রাখি।
আজও তাই করেছেন?
হ্যাঁ। ঘুম ভাঙতেই নিচে চলে যাই কাজকর্ম সারতে।
মণিকা দেবী তখন কি করছিলেন?
ঘুমোচ্ছিল।
সারদা দেবী?
তিনি তার কিছুক্ষণ বাদেই উঠে গঙ্গাস্নানে যান।
অতুলবাবু যে মারা গিয়েছেন আপনি জানলেন কখন?
দিদিমণি গঙ্গাস্নান থেকে ফিরে আসবার পর তাঁকে যখন মণি বলে সেই সময়।
তার আগে টের পাননি?
সুবালা নিরুত্তরে দাঁড়িয়ে থাকে।
কিরীটী আবার প্রশ্ন করে, তার আগে টের পান নি?
অ্যাঁ! সুবালা যেন চমকে ওঠে, কি বলছেন?
বলছিলাম তার আগে কিছু টের পাননি?
না।
কিরীটী মুহূর্তকাল যেন কি ভাবে, তারপর প্রশ্ন করে, কাল রাত্রে কোনো রকম শব্দ শুনেছেন সুবালা দেবী?
শব্দ! কই না তো!
এ-বাড়িতে আপনি কতদিন আছেন?
বছর পাঁচেক হবে।
অতুলবাবু, রণেনবাবু ও সুকান্তবাবু এঁদের তো আপনি ভাল করেই চেনেন?
হ্যাঁ। ওঁরা মধ্যে মধ্যে এখানে এসে থাকেন।
দেখুন সুবালা দেবী, যে ঘটনা ঘটেছে এবং সেই ঘটনার সঙ্গে পাকেচক্রে যাঁরা জড়িত হয়ে পড়েছেন তাঁদের মধ্যে একমাত্র আপনিই সম্পূর্ণ তৃতীয় পক্ষ। তাই কয়েকটা কথা আপনাকে বলতে চাই এবং আপনার কাছ হতে চাই তার নিরপেক্ষ জবাব।
আমি কিছুই জানি না।
আমার প্রশ্ন না শুনেই বলছেন কি করে যে জানেন না?
বুঝতেই পারছেন এদের আশ্রয়েই আমি আছি। ত্রিসংসারে আমার আপনার কেউ নেই।
কিন্তু এটা নিশ্চয়ই চান হত্যাকারী ধরা পড়ুক?
হত্যাকারী! মানে?
মানে অত্যন্ত সহজ। অতুলবাবুকে কেউ নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে—
হত্যা!
হ্যাঁ।
এই ধরনের কিছু যে হবে এ আমি পূর্বেই অনুমান করেছিলাম।
কেন বলুন তো?
এই তো স্বাভাবিক।
স্বাভাবিক!
তাছাড়া কি? নেহাৎ এদের আমি আশ্রিত নচেৎ একটি মেয়েকে নিয়ে তিনটি অবিবাহিত পুরুষ—ক্ষমা করবেন। বলতে বলতে হঠাৎ সুবালা থেমে গেল।
থামলেন কেন? বলুন কি বলছিলেন?
লেখাপড়া জানা সব শিক্ষিত এরা। এদের হাবভাবই আলাদা। আমরা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন অশিক্ষিত গেঁয়ো মেয়েমানুষ।
সুবালার প্রতিটি কথার উচ্চারণে তীক্ষ্ণ একটা চাপা শ্লেষ অত্যন্ত বিশ্রীভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যেটা কিরীটীর শ্রবণেন্দ্রিয়কে এড়ায় না।
কিরীটী তার স্বাভাবিক তীক্ষ্ণ বিচারবুদ্ধি ব্যাপারটা সহজেই অনুমান করে নেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে কথার মোড়টা একটু ঘুরিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে, আচ্ছা সুবালা দেবী, এদের চারজনকেই, মানে আমি মৃত অতুলবাবুর কথাও বলছি—কি রকম মনে হয়?
তা সকলেই ভদ্র মার্জিত শিক্ষিত—
এদের পরস্পরের সম্পর্কটা?
প্রত্যেকের সঙ্গেই তো প্রত্যেকের গলায় গলায় ভাব দেখেছি। তবে কার মনে কি আছে কেমন করে বলি বলুন?
তা বটে। আচ্ছা মণিকা দেবী তাঁর তিনটি বন্ধুকেই সমান চোখে দেখতেন বলে আপনার মনে হয়?
মনে কিছু অন্যরকম আছে কিনা বলতে পারি না, তবে বাইরে কারও প্রতি মণির কোনো বিশেষ পক্ষপাতিত্ব দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না।
গত দু-একদিনের মধ্যে এঁদের পরস্পরের মধ্যে বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটেছে কিনা বলতে পারেন?
না।
এঁদের তিন বন্ধুর মধ্যে সব চাইতে কাকে বেশী ভাল বলে আপনার মনে হত সুবালা দেবী?
অতুলবাবুকেই।
অতঃপর ক্ষণকাল আপন মনে কিরীটী কি যেন ভাবে। তারপর সুবালার দিকে তাকিয়ে বলে, আচ্ছা আপনি যেতে পারেন সুবালা দেবী।
সুবালা ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
কিরীটী ঘরের মধ্যে নিঃশব্দে পায়চারি করতে শুরু করে।
সুব্রত ও শিউশরণ কেই কোনো কথা বলে না।
মণিকা দেবীকে আর একবার ডাক তো শিউশরণ?
হঠাৎ যেন কি একটা কথা মনে পড়ায় কিরীটী শিউশরণকে কথাটা বললে।
শিউশরণ কিরীটীর নির্দেশমতই মণিকাকে ডাকতে গেল।
মিনিট খানেকের মধ্যেই শিউশরণের সঙ্গে মণিকা এসে ঘরে ঢুকল।
আসুন মণিকা দেবী। আপনাকে আবার কষ্ট দিচ্ছি বলে দুঃখিত। কিরীটী বললে।
মণিকা কিরীটীর কথার কোনো জবাব দিল না। নিঃশব্দে দাঁড়িয়েই থাকে।
আচ্ছা মণিকা দেবী, এইবারের ছুটির মত আর কখনও আগে আপনারা সকলে এই বাড়িতে কি একত্রে এসে কাটিয়েছেন?
কিরীটীর প্রশ্নে মণিকা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর মৃদুকণ্ঠে জবাব দেয়, হ্যাঁ।
কতদিন আগে?
তিন বছর আগে।
কতদিন সেবারে আপনারা এখানে ছিলেন?
এক মাস প্রায় হবে।
অনেকদিন সেবারে ছিলেন তো?
হ্যাঁ। আমার সেবারে টাইফয়েড হয়, তাই বাধ্য হয়েই বাকী কথাটা আর শেষ করে না মণিকা।
হুঁ। আচ্ছা তিনজনেই মানে তিন বন্ধুই আপনার সেবা করতেন সমান ভাবে, না? প্রশ্ন করে আবার কিরীটী।
তা করত। তবে বেশীর ভাগ সময় অতুল ও সুবালাদিই আমার ঘরে থাকত।
আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, মনে যদি অবিশ্যি কিছু না করেন?
বলুন?
বলছিলাম আপনার সুবালাদিকে কি রকম মনে হয়? প্রশ্নটা করে কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মণিকার দিকে তাকিয়ে থাকে।
হঠাৎ যেন চমকে মণিকা কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
এ-কথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন! হিন্দুঘরের ব্রতচারিণী বিধবা সুবালাদি—
কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে মৃদু হাসির একটা বঙ্কিম রেখা জেগে উঠেই মিলিয়ে যায়। আপনি নারী হয়ে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, অন্য এক নারী সম্পর্কে আমার প্রশ্নটা ঠিক–
না, সেরকম কিছু থাকলে অন্তত আমার দিদিমার নজর এড়াত না, মিঃ রায়। দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দেয় মণিকা কিন্তু তথাপি কিরীটীর মনের সংশয়টা যেন যায় না। অদৃশ্য একটা কাঁটার মতই একটা সংশয় যেন কিরীটীকে বিঁধতে থাকে।
আচ্ছা আপনি যেতে পারেন।
মণিকা চলে গেল।
.
মণিকা ঘর থেকে চলে যাবার পর কিরীটী নিঃশব্দে আপন মনেই কিছুক্ষণ ধূমপান করে। তারপর অর্ধদগ্ধ চুবরাটের ছাইটা ঝাড়তে ঝাড়তে শিউশরণের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে, শিউ, চল আর একবার অতুলবাবুর ঘরটা দেখে আসা যাক।
চল। কিরীটী যখন পাকেচক্রে একবার এই ব্যাপারে এসে মাথা দিয়েছে, মীমাংসায় একটা পৌঁছনো যাবেই। তাই কিরীটীর উপরেই সব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ছিল শিউশরণ।
সকলে পুনর্বার যে ঘরে মৃতদেহ ছিল সেই ঘরে এসে প্রবেশ করল। চাদরে আবৃত মৃতদেহটা তেমনি রয়েছে চেয়ারের উপরে উপবিষ্ট। কিরীটী তার অভ্যস্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘরটার চতুর্দিকে তাকাতে লাগল আর একবার। ঘরের পূর্ব কোণে একটা জলচৌকির উপরে একটা মাঝারি আকারের চামড়ার সুটকেস। এগিয়ে গিয়ে কিরীটী সুটকেসটার সামনে দাঁড়াল।
সুটকেসের উপরে অতুলের নাম ও পদবীর আদ্যক্ষর ইংরাজীতে লেখা। নীচু হয়ে কিরীটী সুটকেসটা খোলবার চেষ্টা করতেই ডালা খুলে গেল। বোঝা গেল সুটকেসে চাবি দেওয়া ছিল না। তালাটা খোলাই ছিল। ডালাটা সুটকেসের তুলল কিরীটী। কতকগুলো জামাকাপড়, খানকতক ইংরাজী বই।
একটা একটা করে কিরীটী বইগুলো তুলে দেখতে লাগল। একান্ত শিথিল ভাবেই কিরীটী সুটকেস হতে ইংরাজী বইগুলো একটা একটা করে তুলে দেখতে শুরু করে।
বইগুলো বিখ্যাত বিদেশী গ্রন্থকার কর্তৃক রচিত নামকরা সব সাইকোলজি ও সেকসোলজি সংক্রান্ত।
বইগুলো অন্যমনস্কভাবে উলটে দেখতে দেখতে আচমকা কিরীটীর মনের চিন্তা-আবর্তে এসে উদিত হয় একটা কথা এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় কিরীটী সুটকেসের পাশে হাতের বইগুলো নামিয়ে রেখে পুনবার এগিয়ে যায় চেয়ারের ওপরে উপবিষ্ট ও চাদরে আবৃত মৃতদেহের সন্নিকটে এবং নীচু হয়ে চেয়ারের পায়ার কাছেই ভূপতিত বইটা হাত বাড়িয়ে তুলে নিতে গিয়ে সহসা চেয়ারের পায়ার দিকে দৃষ্টি পড়ে।
শিউশরণ তখন তার নোটবুকে ক্ষণপূর্বে শোনা জবানবন্দির কতকগুলো পয়েন্টস্ টুকে নিতে ব্যস্ত। কিরীটীর প্রতি তার নজরটা ছিল না।
যে চেয়ারটার উপরে মৃতদেহ উপবিষ্ট ছিল তারই একটা পায়ার সঙ্গে ও দেখতে পেল জড়ানো সরু একটা তামার পাত।
চেয়ারটা যদিও তৈরী ষ্টীলের এবং রঙটা তার অনেকটা তামাটে, সেই কারণেই সেই তামাটে বর্ণের সরু স্টীলের পায়ার সঙ্গে জড়ানো সরু একটা তামার পাত চট করে সহজে কারও দৃষ্টিতে না পড়বারই কথা। সেই কারণেও বটে এবং প্রথম দিকে মৃতদেহ ও তৎসংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যাপারে কিরীটীর মন বেশী নিবিষ্ট ছিল বলেই ব্যাপারটা ওর নজর এড়িয়ে গিয়েছে প্রথম দিকে।
কৌতূহলভরে কিরীটী হাত দিয়ে চেয়ারের পায়া থেকে সরু তামার পাতটা খুলে নেবার চেষ্টা করল। এবং খুব বেশী শক্ত করে জড়ানো না থাকায় অল্প আয়াসেই সেটা খুলে নিল।
তামার পাতটা হাতে নিয়ে কিরীটী পরীক্ষা করে।
তার মস্তিষ্কের গ্রে-সেলগুলো বিশেষ ভাবেই সক্রিয় হয়ে ওঠে। পুরাতন একটা তামার পাত!
বুঝতে কষ্ট হয় না চেয়ারের পায়াটার দিকে তাকিয়ে যে, পায়ার সঙ্গে তামার পাতটা বরাবর জড়ানো ছিল না।
শিউশরণের নজর পড়ে কিরীটীর দিকে।
কি দেখছ অমন করে, রায়?
একটা সরু তামার পাত—
তামার পাত! বিস্মিত শিউশরণ পাল্টা প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ। বলতে বলতে কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘরের এদিক-ওদিক আবার তাকায়।
চোখের শ্যেন অনুসন্ধানী দৃষ্টিটা একসময় ঘুরতে ঘুরতে দরজার পাশেই দেওয়ালের গায়ে যেখানে আলোর সুইচটা তার উপরে গিয়ে নিবদ্ধ হল।
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল কিরীটী সইটার সামনে দেওয়ালের কাছে।
সাধারণ প্ল্যাস্টিকের সুইচ।
সুইচের উপরের অংশটা কোনো একসময় ভেঙে গিয়েছিল বোধ হয়। খানিকটা অংশ নেই। অথচ আশ্চর্য, জানা গিয়েছে পরশু এ ঘরের আলোটা নাকি খারাপ হয়ে গিয়েছিল, মিস্ত্রীও এসেছিল, তবু ভাঙা সুইচটা বদলানো হয়নি বোঝাই যাচ্ছে।
অন্যমনস্ক ভাবেই কিরীটী সুইচটা টিপল কিন্তু দেখা গেল ঘরের বালটা জ্বলছে না। আবার এগিয়ে গেল কিরীটী ঝুলন্ত বালবটার কাছে এবং তাকিয়ে রইল ঝুলন্ত বালবটার দিকে।
শিউশরণ অবাক হয়ে কিরীটীকে প্রশ্ন করে, কি হল?
সুটকেসটা মাটিতে নামিয়ে রেখে, ঐ চৌকিটা এনে ঐ বালবটা খোল তো শিউশরণ!
কেন হে? হঠাৎ বালবটার কি আবার প্রয়োজন হল?
খোল না বালবটা! যা বলি কর!
শিউশরণ আর কথা বাড়ায় না। কিরীটীর নির্দেশমত চৌকিটা এনে তার উপরে দাঁড়িয়ে বালবটা খুলে কিরীটীর হাতে দিল।
বালবটা হাতে করে একবার ঘুরিয়ে দেখেই গম্ভীর কণ্ঠে আত্মগত ভাবেই যেন কিরীটী মৃদুভাবে বলে, ফিউজ হয়ে গিয়েছে!
কি বললে?
কিছু না!
বলতে বলতে কিরীটী আবার এগিয়ে যায় দেওয়ালের গায়ে সুইচটার সামনে।
সুইচটা নিয়ে আবার নাড়াচাড়া শুরু করে। এবারে হঠাৎ কিরীটীর দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে, একটা সরু তারের অংশ সুইচের তলা দিয়ে বেরিয়ে আছে।
এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা বৈদ্যুতিক ক্রিয়া ঘটে যায় তার মস্তিষ্কের গ্রে-সেলগুলিতে কম্পন তুলে। চোখের তারা দুটো চচক্ করে ওঠে। ও নিম্নকণ্ঠে বলে, so this is that!
কি হল হে?
পেয়েছি—
কি পেলে?
তামার পাত ও ফিউজ বালবের রহস্য।
হেঁয়ালি গাঁথছ কেন বল তো?
হেঁয়ালি নয় শিউশরণ, সাধারণ সাংকেতিক নিয়ম।
তারপর হঠাৎ আবার কি মনে পড়ায় কথাটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই যেন এগিয়ে গিয়ে ক্ষণপূর্বে রাখা মাটি হতে বইটা হাতে তুলে নিল।
বইটা কিন্তু সাইকোলজি বা সেকসোলজি সংক্রান্ত নয়। শরৎচন্দ্রের একখানা বহুখ্যাত উপন্যাস। চরিত্রহীন।
বইটা হাতে করে অন্যমনস্ক ভাবে বইয়ের পাতাগুলো ওলটাতে লাগল কিরীটী।
অনেক হাতে ঘুরেছে। অনেক হাতের ছাপ বইটার সর্বত্র।
পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে হঠাৎ বইয়ের একটা পাতার মার্জিনে লাল কালিতে বাংলায় লেখা একটি টিপ্পনী নজরে পড়তেই কিরীটীর চোখের দৃষ্টি সজাগ হয়ে ওঠে। মন হয়ে ওঠে সচেতন।
সুন্দর মুক্তার মত ছোট ছোট হরফে গোল গোল লেখা।
কিরণময়ী, দুঃখ করো না। উপীন্দ্র নপুংসক।
ক্ষণকাল স্থির একাগ্র দৃষ্টিতে লাইনটার দিকে তাকিয়ে থাকে কিরীটী। তারপর আবার একসময় বইটার বাকি পাতাগুলো বেশ একটু মনোযোগ সহকারেই উলুটে চলে। কিন্তু আর কোথায়ও কোন টিপ্পনী ওর চোখে পড়ে না।
কি ভেবে কিরীটী চরিত্রহীন বইখানা হাতে নিয়েই পুনরায় সুটকেসটার কাছে এগিয়ে এল। এক এক করে এবারে সুটকেস হতে জামাকাপড়গুলো বের করে পাশে নামিয়ে রাখতে লাগল।
শুধু কাপড়জামা ও বই-ই নয়, নিত্য প্রয়োজনীয় টুকিটাকি অনেক কিছুই সুটকেস হতে বের হয়। এবং শেষ পর্যন্ত একেবারে তলায় পাওয়া গেল বইয়ের আকারে একটা মরোক্কো লেদারে বাঁধানো সুদৃশ্য খাতা।
সাগ্রহে কিরীটী খাতাটা তুলে নিয়ে মলাটটা ওল্টালো।
প্রথম পাতাতেই লেখা: ছিন্নপাতার দল।
তবে নিচে লেখা: অতুল।
মনের মধ্যে একটা কৌতূহল উঁকি দেয়। কিরীটী খাতার পৃষ্ঠাগুলো উলুটে চলে সাগ্রহ উত্তেজনায়। অতুলের ডায়েরী।
কোথাও তারিখ বড় একটা নেই। অসংলগ্ন স্মৃতির পৃষ্ঠাগুলো যেন এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে আছে।
লেখা কখনও ইংরাজীতে, কখনও বাংলায়।
দু-একটা পৃষ্ঠা এদিক-ওদিক থেকে পড়ে কিরীটী।
তারপর একসময় ডায়েরীটা জামার পকেটে ভরে নেয়।
.
আরও কিছুক্ষণ পরে।
কিরীটীর নির্দেশক্রমেই শিউশরণ সকলকে ডেকে আপাতত তার বিনানুমতিতে যেন কাশী কেউ না ত্যাগ করে নির্দেশ দিয়ে ও মৃতদেহের উপরে পাহারার ব্যবস্থা করে সকলে বিদায় নিয়ে ঐ বাড়ি হতে বের হয়ে এল।