০৬.
তারকবাবুকে অভ্রকে নিয়ে প্রথমে উঠেছিলেন রেলকলোনিতে ওঁর বন্ধুর বাসায়। বন্ধু জগমোহনও রিটায়ার করেছেন। কিন্তু ছেলের দৌলতে কোয়ার্টার ছাড়তে হয়নি। ছেলে রেলের বুকিং ক্লার্ক, তাই কোয়ার্টারটা বড্ড ছোট্ট। সে বেলা ওখানে কাটিয়ে সন্ধ্যায় তারকবাবু ওঠেন একটি বাঙালি হোটেলে। মোহনপুর এখন শিল্পকেন্দ্র হয়ে ওঠায় লোকসংখ্যা আর ঘরবাড়ি বেড়েছে। ব্যাপার-স্যাপার দেখে প্রথমে খুব ঘাবড়ে যান তারকবাবু। কিন্তু অভ্র মরিয়া। সে একাই খুঁজে বার করার জেদ নিয়ে বিকেলে বেরিয়ে গিয়েছিল। অগত্যা তারকবাবু মনমরা হয়ে ভেবেছিলেন, জগমোহনকে সব কথা খুলে বলা যাক।
সবে জয় মা কালী হোটেল থেকে বেরোচ্ছেন, হন্তদন্ত হয়ে অভ্র এসে হাজির হল। তার চেহারায় কেমন উদ্ভ্রান্ত ভাব। তারকবাবুকে দেখে সে বলল কাকাবাবু! গার্গীকে দেখতে পেয়েছি!
তারকবাবু লাফিয়ে উঠলেন। কোথায়, কোথায় দেখলে?
–একটা গাড়িতে। গাড়িটা জোরে যাচ্ছিল। ফলো করা অসম্ভব। …অভ্র রুদ্ধশ্বাসে জানাল। জলের ট্যাঙ্কের কাছে গিয়ে ওপাশে একটা টিলার ওপর গার্গীকে বসে থাকতে দেখেছিলুম। পাশে কে একজন বসেছিল। চোখের ভুল। নয়। রোদ পরিষ্কার ছিল। তারপর টিলার দিকে এগোতে গিয়ে দেখি, ওরা ওপাশ দিয়ে নামছে। ছুটে গিয়েও পৌঁছতে পারলুম না সময়মতো। গাড়িটা জোরে বেরিয়ে গেল আমার সামনে দিয়ে।
–তুমি চেঁচামেচি করলে না কেন?
করা উচিত ছিল। কিন্তু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম।
–কোনদিকে গেল গাড়িটা?
নতুন কলোনির দিকে।
তারকবাবু ব্যস্তভাবে বললেন–তাহলে চলো বাবা, ওদিকে গিয়ে খোঁজখবর নেওয়া যাক্। নিশ্চয় পেয়ে যাব। বাড়ি বাড়ি ঘুরে জিজ্ঞেস করব বরং। আমি মেয়ের বাবা। দোষ কী এতে?
অভ্র একটু ভেবে বলল–হ্যাঁ। ঠিকই বলেছেন। আপনি মেয়ের বাবা। দৈবাৎ ওকে খুঁজে পেলে কোন গণ্ডগোল যদি হয়, সবাই আপনার পক্ষে কথা বলবে।
দুজনে পায়ে হেঁটে এগোলেন। তারপর তারকবাবু বললেন–আচ্ছা অভ্র, আজ দুপুরবেলা নাকি কোথায় একজন বাঙালি ভদ্রলোকের ডেডবডি পাওয়া গেছে। জগমোহন বলছিল। তুমিও তো শুনলে তখন! শুনে আমার কেমন মনে হচ্ছে..
অভ্র বাধা দিয়ে বলল–মনে হবে কী! যা ভাবছেন তাই। সেই রিপোটার ভদ্রলোকই বটে। বডি দেখতে পাইনি। একে ওকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি।
তারকবাবু দাঁড়িয়ে গেলেন। বল কী! অশনিবাবু খুন হয়ে গেছে?
–হ্যাঁ। কাল সন্ধ্যায় হাওড়া স্টেশনে ওকে দেখিয়ে আপনি বললেন—
… তারকবাবু ওর কথা থামিয়ে বললেন–চেপে যাও, অভ্র। হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। পুলিশ যদি জানতে পারে, আমরা ওকে চিনি, তাহলেই সব কেলেঙ্কারি ফাস হতে দেরি সইবে না।
অভ্র গত সন্ধ্যায় হাওড়া স্টেশনে যা ঘটেছিল, তা ভাবতে থাকল। গার্গীর তিন প্রেমিকের কথা তারকবাবু মোটামুটি জানিয়েছিলেন। তারপর হঠাৎ তারকবাবু অভ্রের হাত চেপে ধরে বলেন–অশনিবাবুকে দেখছি! অভ্র সাবধান করে দেয়–থা। লক্ষ্য রাখব ভদ্রলোক কোথায় যাচ্ছেন। অশনি ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রী। ওরা সেকেন্ড ক্লাসের। তবে সারা পথ অভ্র বড় স্টেশনে গাড়ি দাঁড়ালে তখুনি নেমে গেছে এবং লক্ষ্য রেখেছে ভদ্রলোক বেরুচ্ছেন কি না। মোহনপুরে ওকে নামতে দেখেছিল অভ্র। তারকবাবুও দেখেছিলেন। কিন্তু তারপর ভিড়ে অশনি হারিয়ে যায়। তারকবাবুর বদ্ধমূল ধারণা, ওরা গার্গীকে গুণ্ডা দিয়ে ধরে নিয়ে গেছে দীপঙ্কর সেন আর অশনি দুজনেরই কোন বদ মতলব আছে। গার্গীকে হয়তো বেচে-টেচে দেবে। আজকাল মেয়ে কেনাবেচার খবর কাগজে বেরুচ্ছে কি না। দীপঙ্কর আর অশনির নিশ্চয় গোপনে মেয়ে বিক্রির কারবার আছে। অভ্র বলেছিল, কিন্তু গার্গী তো লেখাপড়া জানা মেয়ে। তার সায় না থাকলে তাকে মোহনপুরে নিয়ে যায় কী ভাবে? তারকবাবুর মতে, হিপ্নেটাইজড করে রেখেছে যে! ওরা সব পারে।
নতুন কলোনির দিকে যাবার পথে ফের তারকবাবু সেই মতামতই ব্যক্ত করলেন অভ্রের কাছে। হাওরা গার্গীকে এখনও হিপোটাইজড করে রেখেছে। আর অশনি দাশগুপ্ত খুন হওয়ার কারণ বখরা নিয়ে গণ্ডগোল।
অভ্র তারকবাবুর মতামতে মনে মনে হেসেছে। লোকটা বড্ড বোকা– হয়তো অতিমাত্রায় সরল!
বাঁদিকে কারখানা অঞ্চল ছাড়িয়ে যেতে যেতে সূর্য ডাইনে পাহড়ের পিছনে অস্ত গেল। ধূসর আলোয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছিল। কিন্তু তা লক্ষ্য করার মতো মন নেই তারকবাবুর। অনর্গল বকবক করছিলেন। একটা চৌমাথা এসে গেল। ডাইনে-বাঁয়ে সামনে তিনদিকেই রাস্তা। হঠাৎ তারকবাবু অভ্রের একটা হাত চেপে ধরলেন। ফিসফিস করে বললেন–অভ্র। অভ্র, আরেক বাস্টার্ড। সুনীথ ব্যানার্জি। যার মেমসায়েব বউ আছে বলেছিলুম। ওই দেখবেটা রেলিঙে হেলান দিয়ে পাইপ কুঁকছে। ওই যে পার্কের রেলিঙে! দেখতে পাচ্ছ? অভ্র! ও ব্যাটাও এসেছে যে।
অভ্র বাধা না দিলে তারকবাবুকে সামলানো যেত না। দৌড়ে গিয়ে সুনীথ ব্যানার্জির ওপর চড়াও হনে। অভ্র রাস্তার ধারে একটা পিপুল গাছের তলায় টেনে নিয়ে গেল তারকবাবুকে। তারপর বলল–আপনি চুপচাপ থাকবেন কিন্তু। ওর সামনে যাবেন না। আমি গিয়ে আলাপ করছি। কিন্তু ফের সাবধান করে দিচ্ছি, গিয়ে নাক গলাবেন না। বরং এই বেঞ্চটায় অন্যদিকে ঘুরে বসে থাকুন। আলো কমে যাচ্ছে। তাহলেও আপনাকে যেন চিনতে না পারে।
তারকবাবু বসে রইলেন। অভ্র বেড়াবার ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। তারপর দেশলাই নেই–এই হতাশার ভাব মুখে ফুটিয়ে হনহন করে সুনীথের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ইংরিজিতে বলল– দয়া করে যদি আপনার লাইটারটা…
সুনীথ প্যান্টের পকেট থেকে লাইটার বের করে জ্বেলে দিল। অভ্র সিগারেট টেনে ধোঁয়া ছেড়ে বলল–অসংখ্য ধন্যবাদ।
তারপর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বাংলায় বলল–কিছু মনে যদি না করেন। দাদা কি বাঙালি?
সুনীথ মাথা দোলাল মাত্র।
–এখানেই থাকেন? নাকি নতুন এসেছেন?
সুনীথ বিরক্ত হয়ে বলল–কেন বলুন তো?
অভ্র কাচুমাচু হেসে বললনা। মানে, আমি নতুন এসেছি। ভালমতো চেনাজানা নেই। একটা বাঙালি হোটেলে উঠেছিলুম–তো সেখানে সব জিনিসপত্র চুরি গেল। একেবারে নিঃস্ব অবস্থায় পড়েছি। এখানে বাঙালিরা যেন কেমনধারা–কেউ এতটুকু সিমপ্যাথি দেখালেন না! পুলিশও তাই। এখন কী ভাবে ফিরব–সেই সমস্যা।
সুনীথ ওর পা থেকে মাথা অবধি দেখে নিয়ে বলল-কী ব্যাপারে এসেছিলেন?
বুঝতেই পারছেন দাদা। বাঙালি যুবকদের যা ব্যাপার। যেকার, চাকরির খোঁজেই এসেছিলুম। ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউন–যদি দৈবাৎ পেয়ে যাই কিছু। এনি ড্যাম জব!
কদ্দুর পড়াশোনা করেছেন?
অভ্র সত্যি কথাটাই বলল–এম. এ. অব্দি। ইংরেজিতে।
সুনীথ একটু হাসল। বুঝলাম। কিন্তু কারখানায় ওই লেখাপড়া তো কাজে লাগবে না ভাই। বরং এখানে বাঙালি স্কুলে চেষ্টা করুন।
অভ্র অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলল।– দাদা, আপনি নিশ্চয় এখানকার লোক। কোন একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারেন না? একেবারে অসহায় অবস্থায় পড়ে গেছি।
সুনীথ রেলিংয়ে পাইপ ঠুকে ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে যেন আপন মনে বলল–আমিও এখানে আপনার মতো নবাগত। তবে চাকরি খুঁজতে আসিনি। এসেছি ছুটি নিয়ে বেড়াতে। কলকাতায় যা বিশ্রি গরম চলছে! ক্লাইমেটটা মোটামুটি ভালই। যাই হোক, আপনাকে আমি কলকাতা ফেরার পাথেয়টা দিতে পারি। নাসাহায্য নয়! জাস্ট ধার। পরে শোধ করে দেবেন। ইজ ইট?
বলে সে অভ্রের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। অভ্র বলল–অনেক ধন্যবাদ।
কিন্তু আমার কলকাতা ফেরা মানেই বুঝতে পারছেন, সেই পারিবারিক গঞ্জনার মধ্যে পড়া। বাড়ি থেকে তাহলে আর বেরিয়ে পড়লুমই বা কেন বলুন?
সুনীথ একটু ভেবে ওর আপাদমস্তক আবার দেখে নিল। তারপর বলল– কলকাতায় কোথায় থাকেন?
অভ্র সোজা বলে দিল–কৈলাস বোস স্ট্রিটে।
সুনীথ একটু চমকাল। কৈলাস বোস স্ট্রিটে!
–কেন দাদা?
–আপনার নামটা এখনও জানতে পারিনি!
অভ্র ঝটপট বলল–দেবপ্রসাদ গুপ্ত। ডাকনাম দেবু। আপনার নামটাও যদি বলেন…
সুনীথও ঝটপট বলল–নিশীথ ব্যানার্জি। তো-ইয়ে, আপনাদের বাড়ির নাম্বার কত বলুন তো? আমার পরিচিত একজন থাকে ও রাস্তায়।
–আঠারো বাই ই বাই থ্রি, কৈলাস বোস স্ট্রিট।
সাত বাই এক সিএর কাকেও চেনেন?
নাম বললে বলতে পারি হয়তো!
–গার্গী রায় নামে কোন মেয়েকে?
অভ্র জোরে মাথা দোলাল। –না তো! দেখতে কেমন বলুন তো? আমরা অবিশ্যি ও বাড়িতে মোটে মাস দুই গেছি। বাবার রিটায়ার করার পর।
সুনীথ বলল–হালকা ছিপছিপে গড়ন। দেখতে মোটামুটি ভালই। বয়স কুড়ি বাইশের মধ্যে। সাদাসিধে ভাবে থাকে। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। অবিবাহিতা।
অভ্র একটু হেসে বলল–দাদা, সাহস দিলেন বলে বলছি। আপনার ফিঁয়াসে বুঝি?
সুনীথ গম্ভীরভাবে মাথা মেড়ে বলল না। আমার এক বন্ধুর সঙ্গে বিয়ের কথা। হচ্ছে। তবে মেয়েটি আমার চেনা। ওর সম্পর্কে আরও খবর জানার দরকার ছিল। তাই বলছি।
–চিনতে পারলুম না দাদা। দুঃখিত। অমন ড্রেসক্রিপশানের অনেকগুলো অবিবাহিতা মেয়েই তো আছে।
সুনীথ পাইপে আবার তামাক ভরতে থাকল। রাস্তার আলো সবে জ্বলে উঠেছে! অভ্র দেখল, দূরে তারকবাবু তেমনি পুঁটুলির মতো বসে রয়েছেন। কিন্তু কী উদ্দেশ্যে সুনীথ এসব প্রশ্ন করেছে, অভ্র একটুও বুঝতে পারল না।
হঠাৎ সুনীথ বলল–আচ্ছা দেবুবাবু, আপনি তারকবাবু নামে কাকেও চেনেন?
না তো? কে তিনি?
–ওই রাস্তাতেই থাকেন।
—না দাদা, চিনি না। ড্রেসক্রিপশান না দিলে বরং…
—ঠিক আছে। …বলে সুনীথ লাইটার জ্বেলে পাইপ ধরাল। কিছুক্ষণ চুপচাপ পাইপ টানল। অভ্রের সিগারেটও শেষ হয়ে গেল। সে জ্বলন্ত টুকরোটা পায়ে দলে তারপর সুনীথের মুখের দিকে করুণাপ্রত্যাশী মানুষের ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল।
কিছুক্ষণ পরে সুনীথ বলল–আপনি আমার সঙ্গে আসুন। থাকারও জায়গা নেই বলছেন যখনরাত্তিরটা কী করতে পারি দেখা যাক্।
অভ্র তার সঙ্গ ধরল। কিন্তু সুনীথ তারকবাবুর ওদিকে যাচ্ছেন দেখে সে বিব্রত বোধ করল। তারকবাবুর ওপর বাকিটা নির্ভর করছে। উনি যদি মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকেন, তবেই রক্ষা।
যেতে যেতে সুনীথ আবার বলল–একা বেড়াতে এসে বড় ফাঁকা লাগছিল। যাক গে, আপনাকে পাওয়া গেল–ভালই হল।
সুনীথ তারকবাবুর কাছ অবধি গেল না–একটু দূর থেকেই রাস্তা পেরিয়ে ওপাশে চলে গেল। অভ্র ঘুরে দেখল, তারকবাবু উঠে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু পা বাড়াবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
সুনীথ চড়াইয়ের রাস্তা ধরে উত্তর-পশ্চিমে এগোল। তারপর ডানপাশে একখানা গেটের ভিতর ঢুকে বলল–চলে আসুন। এই বাংলো বাড়িটা আমার এক বন্ধুর। ওরা কলকাতায় থাকে! মাঝে মাঝে বেড়াতে আসে। একা থাকা বেশ কঠিন। সে চাপা হাসল। অভ্র ঘুরে অনেকটা নিচে তারকবাবুকে দেখতে পেল। এখনও পাথরের মূর্তির মতো এদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
বাংলোবাড়ির লন আর বাগিচা দেখে মনে হল, পোড়ো জমির অবস্থা হয়েছে। বাংলোর বারান্দা ও দেয়ালেও অযত্নের ছাপ। কোন মালী বা দরোয়ানকে দেখা গেল না। বুক একটু কাপল অভ্রের। এ বাড়িতে সত্যি কি এই সুনীথ ব্যানার্জি বাস করছে? কোথায় নিয়ে এল তাকে? সে মনে মনে তৈরি হয়েই রইল।
সুনীথ বারান্দায় উঠে বলল–পেছনে দিয়ে ঘুরে যেতে হবে। ওপাশের একটা ঘরেই আমি আছি। ঘরে না ঢুকলে আলো জ্বালা যাবে না।
কোন আলো জ্বলছে না বাংলোয়। রাস্তা থেকে আলোর ছটা যেটুকু আসছে তাতে সামনের দিকটা মোটামুটি স্পষ্ট। বারান্দাটা চারিদিকেই রয়েছে। ওদিকটা এখনই অন্ধকার হয়ে গেছে। কিন্তু বারান্দার যা অবস্থা, কতকাল ঝাড়পোঁছ হয়নি। কে জানে! নোংরা হয়ে আছে গাছের পাতা আর চামচিকের নাদিতে। শুকনো পাতাগুলো নিশ্চয় ঝড়ে বাতাসে উড়ে এসে জমেছে। দুপাশে গাছপালা ঘিরে অন্ধকার কালো পাঁচিলের মতো থমথম করছে। এই বাংলোটায় যে অনেক কাল মানুষ বাস করেনি, তা স্পষ্ট। তবু অভ্র কোন প্রশ্ন তুলল না। কোন কথা বলল না। তার রক্তে আজীবন যে আদিম বন্যতা আছে, সে যেন প্রতি সেকেন্ডে পা ফেলে ফেলে তার সচেতন মনে আত্মপ্রকাশ করছে। সুনীথের জুতোর শব্দ হচ্ছে। চাপা শুকনো পাতার শব্দ ভৌতিক করে তুলছে পরিবেশকে।
পিছনের দিকে একখানে হঠাৎ দাঁড়াল সুনীথ। তারপর হেসে বলল–ভয় পেলে নাকি দেবুবাবু?
অভ্রও হাসল! কী যে বলেন দাদা! আপনি থাকতে ভয় কিসের?
সুনীথ অন্ধকারে তালা খুলতে খুলতে বলল–আমার এসব জায়গাই বড্ড পছন্দ। কেমন নিরিবিলি দেখছেন? ওরা যখন আসে, তখন সাফ করে জেল্লা ঠিকঠাক করে নেয়। খুব হইচই করে কাটায়। তখন এই বাংলার অবস্থা দেখে মনে হবে বিয়েবাড়ি। এক মিনিট। আলো জ্বালি।
সে কপাট খুলল। বিশ্রি রকমের একটা আওয়াজ হল তাতে। বুক ধড়াস করে উঠেছিল অভ্রের। ইচ্ছে হল, থাক দরকার নেই, এক্ষুনি দৌড়ে পালিয়ে যাই। কিন্তু পরমুহূর্তে সে নিজেকে হিংস্র করে তুলল। বোঝা যাচ্ছে লোকটার মতলব ভাল নয়। একটা কিছু ঘটতে চলেছে। প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা হচ্ছে, লোকটা এবার তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বেনয়তো গুলি ছুড়বে। রিভলবার থাকা খুবই সম্ভব ওর পক্ষে। অভ্রের সঙ্গে একটা ছোরা আছে শুধু। সে পকেটে অনেক আগেই হাত ঢুকিয়ে রেখেছে। বের করে একটা বোতাম টিপলেই ফলাটা বেরিয়ে পড়বে।
কিন্তু তেমন কিছু ঘটল না। ভেতরে সুনীথ সুইচ টিপছে বার বার। দেখেছেন কাণ্ড? কানেকশান নেই। বাইরে সবখানে আলো আছে–অথচ…।
তারপর সে লাইটার জ্বালল। অভ্র দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল–মোম নেই দাদা?
না তো! সুনীথ বিরক্তি প্রকাশ করল। এলুম যখন সব ঠিকঠাক ছিল ফ্যান চলছিল। অথচ হঠাৎ গণ্ডগোল কেন বুঝতে পারছিনে। এখন কী করি বলুন তো ভাই! বড্ড মুশকিলে পড়া গেল দেখছি।
অভ্র ভেতরে লাইটারের অল্প আলোয় যেটুকু দেখতে পাচ্ছিল, তাতেই বুঝল সুনীথ ব্যানার্জি এ ঘরে থাকে। একটা খাটে বিছানা পাতা আছে। একটা কিটব্যাগ ঝুলছে পাশের দেয়ালে। বিছানার ওপর একটা খবরের কাগজ রয়েছে। অভ্র। বলল বরং আমি গিয়ে মোমবাতি নিয়ে আসি।
সুনীথ বলল কিন্তু সে তো বাজার ছাড়া কোথাও পাবেন না! বাজার বেশ দূরে।
–তাতে কী! আপনি বসুন। আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি।
–তার আগে বরং মেন সুইচটা চেক করা যাক্।
–সেটা কোথায়?
–জানিনে। খুঁজে বের করতে হবে।
–ঠিক আছে। দুজনেই খুঁজি।
সুনীথ লাইটার নিয়ে ভেতরে এগোল। ঘরটা বেশ বড়। কিন্তু এ ঘরে মেন সুইচ নেই। চারিদিকে দরজা আছে চারটে। প্রথম দরজাটায় ওরা বাইরে থেকে ঢুকেছে। বাকি তিনদিকের প্রজা দিয়ে সম্ভবত ভেতরের ঘরগুলোতে যাওয়া যায়। সুনীথ একটা দরজা ঠেলে দেখে বলল–ওপাশ থেকে বন্ধ রয়েছে। সে অন্য দরজায় গেল। সেটাও ভিতর থেকে বন্ধ। সুনীথ বিস্মিতভাবে বলল–এই দরজাটা তো বন্ধ ছিল না! নাকি ভুল দেখেছিলুম?
অভ্র তৃতীয় দরজাটা ঠেলতেই খুলে গেল। সে বলল–এটা ভোলা আছে দেখছি।
সুনীথ নিবু নিবু লাইটার নিয়ে এসে বলল–তাহলে এটাই ভোলা দেখেছিলুম। বাস্! খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম মশাই! যাক্ গে। চলুন–দেখি।
অভ্র বলল–আপনার লাইটারটা তো গেল!..বলেই সে চমকে ওঠার ভঙ্গিতে অস্ফুট চিৎকার করল–মাই গুডনেস! এই তো আমার দেশলাই রয়েছে। আসলে প্যান্টের পকেটটা এত টাইট। বোঝা যায় না কিছু।
সে দেশলাই জ্বালল। আড়চোখে দেখল, সুনীথের চাহনিতে কী যেন আছে। অভ্র গ্রাহ্য করল না। এই ঘরটা ছোট। ভ্যাপসা গন্ধ আছে। ব্যবহারযোগ্য কোন জিনিস নেই। কয়েকটা ভাঙা চেয়ার-টেবিল আর দোমড়ানো বিছানার গদি পড়ে আছে। ইঁদুর দৌড়ে গেল পায়ের কাছ দিয়ে। সোজা এগিয়ে সামনে আবার দরজা দেখা গেল ঠেলতেই খুলে গেল সেটা। অভ্র ইতিমধ্যে তিনটে কাঠি পুড়িয়েছে। অন্ধকার মেঝেয় এখনও তার চিহ্ন জ্বলজ্বল করছে। অভ্র ডাকল–দাদা, আসুন।
সুনীথের কোন সাড়া পাওয়া গেল না। যে দরজা দিয়ে ঢুকেছে, সেই দরজার কাছে তাকে শেষবার দেখেছে অভ্র। এখন ঘুরে দেখল, সুনীথ নেই। সে একটু জোরে ডাকল–দাদা, কোথায় গেলেন? নিশীথদা!
কোন জবাব নেই। নিজের গলার ডাকটা ঘরে ভুতুড়ে প্রতিধ্বনি তুলল। ভারি অবাক কাণ্ড তো! সে আরেকবার ডাকল–নিশীথবাবু!
কিন্তু কোন সাড়া পেল না। তখন তার আগের অস্বস্তি আর আতঙ্ক আবার জেগে উঠল। সে হিংস্রভাবে ছোরাটা বাঁহাতে বের করে বোতাম টিপল। সেইমুহূর্তে ডান হাতে ধরা দেশলাইকাঠিটা নিবে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঘন অন্ধকার এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। অস্বাভাবিক স্তব্ধতায় তার নিজের শ্বাসপ্রশ্বাস শুনে মনে হল চিরকালের সে অবাধ্য মানুষটা অর্জন করছে।
দীর্ঘ দু মিনিট দাঁড়িয়ে রইল অভ্র। তারপর দেশলাই জ্বালল।
কিন্তু আর ভেতরের দিকে এগোল না। ঘুরে যে দরজা দিয়ে এ ঘরে ঢুকেছিল, সেই দরজার কাছে গেল। আবার দেশলাই জ্বালল। সেই ঘরে সুনীথ নেই। বিছানাটা তেমনি রয়েছে–কিটব্যাগটাও ঝুলছে। ভারি অদ্ভুত ব্যাপার তো! এভাবে তাকে এখানে ঢুকিয়ে লোকটা বেমালুম কেটে পড়ল কেন?
হঠাৎ তার মনে হল লোকটা তাকে কোন ফাঁদে ফেলল না তো? অমনি সে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। দরজাটা তেমনি খোলা রয়েছে। বারান্দায় গিয়ে বুক ভরে দম নিল সে। সাহসটাও বেড়ে গেল।
বারান্দা ঘুরে সে দক্ষিণে সামনের দিকটায় গেল। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে যত দ্রুত পারে, হাঁটতে শুরু করল। রাস্তায় কোন লোক অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে গাড়ি যাচ্ছে। সে গেট পেরিয়ে রাস্তা ধরে সেই চৌমাথায় গেল। তারকবাবুকেও খুঁজে পেল না।
একটা খালি রিকশো আসছিল। সেটা থামিয়ে হোটেলে ফিরে চলল। বারবার ঘরে সেই বাংলোটা দেখছিল সে। খানিকটা উঁচুতে গাছপালার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ভুতুড়ে বাড়িটা। এখন আর ওখানে ফিরে যাওয়ার সাধ্য অভ্রর নেই।
চারদিকে ঝোঁপঝাড় গাছপালা আর উঁচু-নিচু জমি–তার মধ্যে একটা করে বাড়ি। অজস্র সুন্দর রাস্তা রয়েছে। কিন্তু সন্ধ্যা হতে না হতেই নির্জনতা থমথম করছে। অভ্র সুনীথের এই কাণ্ডটার কোন মাথামুণ্ডু খুঁজে পেল না। তাকে যদি সুনীথের সন্দেহই হয়ে থাকে এবং এড়াতে চায়, অন্য কোন ভাবে এড়াতে পারত। তাকে নির্জন বাংলোয় ঢুকিয়ে দিয়ে কেটে পড়ল কেন? আর ওই বিছানা, খবরের কাগজ, কিটব্যাগই বা কার? দরজায় কি সত্যি তখন সুনীথ তালা খুলছিল? নাকি তালা খোলার ব্যাপারটা স্রেফ অভিনয়? হয়তো দরজার তালাটা খোলাই ছিল।
কিন্তু বিছানাটা কার? অভ্র এই ধাঁধার জবাব কিছুতেই খুঁজে পেল না। হোটেলে পৌঁছে দেখল, তারকবাবু গুম হয়ে ঘরে বসে আছেন। ওকে দেখে লাফিয়ে উঠলেন। বললেন কী কাণ্ড! তুমি বদমাশটার সঙ্গে কোথায় যে উধাও হলে, চারদিক খুঁজে পাত্তা করতে পারলুম না। ভীষণ ভয় হল–বিপদে টিপদে পড়লে নাকি? শেষ অব্দি কী করব, ঘরে এসে বসে বসে ভাবছিলুম, যাই একবার জগমোহনের কাছে।….
অভ্র একটু হাসল। তাকে নার্ভাস দেখাচ্ছিল। বসে বলল–আগে এক গ্লাস জল দিন তো কাকাবাবু! তারপর সব বলছি।
তারকবাবু ব্যস্ত হয়ে কোনার টেবিলে রাখা জগ থেকে জল ঢেলে আনলেন। তারপর বললেন–কোন হাঙ্গামা হয়েছিল নাকি?
অভ্র জল খেয়ে গ্লাস রেখে বলল-হাঙ্গামার মতোই। আপনার ওই সুনীথ ব্যানার্জি বড় অদ্ভুত! বাক্স! ভাবা যায় না কী মাল!
তারকবাবু বললেন কী হয়েছিল বল তো শুনি?
অভ্র বলল বলছি। এক মিনিট। বাথরুম থেকে আসি। ওঃ। হরিবল!
সারারাত অভ্র ঘুমোতে পারেনি। সুনীথ ব্যানার্জির কাণ্ডটা নয়–বিকেলে গার্গীকে। দেখেছিল–সেই দৃশ্যটা বারবার মনে পড়েছে আর তাকে উত্যক্ত করেছে। গার্গীর এ রকম কাণ্ডকারখানা সে কল্পনাও করতে পারেনি। বড় সহজে সে তাকে ধরা দিয়েছিল, আবার বড় সহজেই হাতের বাইরে চলে গেল। কিন্তু ওভাবে সে চলে এল কেন? চিঠিটা যদি সত্যি সত্যি তার হাতের লেখা না হয়, তাহলে বলতে হয় যে, তাকে জোর করে নিয়ে এসেছে কেউ অর্থাৎ কিডন্যাপ করা হয়েছে। কিডন্যাপড় মেয়ে এখানে এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এটা একটা জটিল ধাঁধা নয় কি?
অভ্র ঠিক করেছিল, তারকবাবুর সঙ্গ ছেড়েই তাকে কাজে নামতে হবে। ভদ্রলোক বুড়ো মানুষ। তাকে আর কষ্ট দেওয়া কেন? একবার যখন গার্গীর দেখা মিলেছে, আবার মিলবে। এ এমন কিছু বড় শহর নয়। একদিনেই সব মোটামুটি চেনা হয়েছে। আর গাড়ির নাম্বারটাও তার মুখস্থ আছে। অসুবিধে হবে না।
সকালে সে তারকবাবুকে তার মতলবটা জানাল। তারকবাবুর বাপের মন। বললেন–তা কি হয় বাবা অভ্র? আমিও খুঁজব। বরং আমি স্টেশনে গিয়ে বসে থাকব। যদি গার্গীকে নিয়ে অন্য কোথাও পাচার করে দেয়?
অগত্যা অভ্র বলল ঠিক আছে আপনি স্টেশনেই লক্ষ্য রাখুন।
সে বেরিয়ে পড়ল। তখন সকাল আটটা। প্রতিটি গাড়ির নাম্বার সে লক্ষ্য রাখছিল। নেশাগ্রস্ত মানুষের মতো ঘুরতে-ঘুরতে একসময় সে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। যেন এক উদ্দেশ্যহীনতা তাকে পেয়ে বসেছে। কেন গার্গীকে খুঁজছে সেখড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতো?
হঠাৎ তার মনে হল, সেই পোড়ো বাংলোবাড়িতে গিয়ে এখন দেখে আসা যায় বিছানাটা কার?
অভ্র দক্ষিণের রাস্তা ধরল। একসময় সেই চৌমাথায় পৌঁছাল। এখন ট্রাফিক পুলিশ রয়েছে ওখানে। গাড়ির ভিড়ও আছে। লোকজন চলাচল করছে। এলাকার গ্রামাঞ্চল থেকে লোকেরা টাঙাগাড়ি বোঝাই করে শাকসবজি নিয়ে আসছে। অভ্র কাছাকাছি গিয়ে ডাইনে তাকাল। উঁচুতে টিলার গা কেটে অনেক রাস্তা রয়েছে। গাছপালার মধ্যে একটা করে বাড়ি। কোনটা সেই বাংলো সে প্রথমে চিনতে পারল না। তখন ডানহাতি রাস্তায় এগিয়ে কিছুদূর ওঠার পর যে বাড়ি আর গেটটা সামনে এল, সে চিনে ফেলল–এটাই বটে। বারান্দায় শুকনো পাতা ছড়িয়ে আছে। চারপাশে ও সামনের লনে আগাছা আর ঘাসের জঙ্গল।
এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে, কাছাকাছি লোক নেই দেখে সে সোজা বারান্দায় চলে গেল। তারপর বারান্দা ঘুরে পিছনে সেই ঘরাটার সামনে দাঁড়াল। দরজাটা তেমনি ভোলা রয়েছে দেখে সে অবাক হল। ভিতরে তেমনি বিছানা পাতা এবং বিছানায় খবরের কাগজ–এমন কি দেয়ালে কিটব্যাগটাও ঝুলছে। অভ্র একটু ভেবে নিয়ে ডাকল–নিশীথবাবু আছেন নাকি?
কোন সাড়া নেই। তখন সে ঢুকে পড়ল ভেতরে। কিটব্যাগ নামিয়ে খুলতেই তার চোখ জ্বলে গেল। ব্যাগের মধ্যে একটা রক্তমাখা শাড়ি রয়েছে। শাড়িটা টেনে বের করতেই বেরিয়ে এল একটা সাত-আট ইঞ্চি ফলা ড্যাগার–সেটাও রক্তমাখা।
অভ্র কাঁপতে কাঁপতে ব্যাগটা যেমন ছিল, তেমনি করে সব ঢুকিয়ে হুকে টাঙিয়ে দিল।…