৬. রাজবাড়ি দেখে সকলেই থ

রাজবাড়ি দেখে সকলেই ‘থ’। চারদিকে জঙ্গল হাসিল করে বিরাট সাতমহলা বাড়ি উঠেছে। প্রাসাদের মাথায় সোনার চুড়ো। চারদিকে ফুলের বিরাট বাগান। মস্ত দিঘি। মৃগদাব। হাতিশালে হাতি। আস্তাবলে ঘোড়া। চারদিক ঝকঝক, তকতক করছে। বিশাল শামিয়ানার নিচে অতিথিদের জন্য সার-সার চেয়ার। নিচে গালিচা বিছানো। একটা বেদির ওপর নতুন সোনার মুকুট। সোনার রাজদণ্ড। গোলাপজল আর আতরের গন্ধে চারদিক মাত।

বিশিষ্ট গণ্যমান্য অতিথিদের চেয়ারে বসানো হল। সাধারণ লোরো বাইরে দাঁড়িয়ে রইল ভিড় করে। ঘন-ঘন দিনুরাজার নামে জয়ধ্বনি উঠছে। রাজকর্মচারীদের ছোটাছুটির বিরাম নেই।

বেলা দশটা বাজতেই দিনুরাজা এসে সিংহাসনের পাশে একটা নিচু আসনে বসল। চারদিক ফেটে পড়ল জয়ধ্বনিতে। দিনুরাজা হাসি-হাসি মুখ করে হাত তুলে সকলের অভিনন্দন গ্রহণ করল।

এর পরই উঠলেন রাজপুরোহিত চন্দ্ৰমাধব। লম্বা, রোগাটে চেহারা। দুধসাদা দাড়ি-গোঁফ, শ্বেতশুভ্র লম্বা চুল। তাঁর চেহারাটা অনেকেরই চেনা-চেনা মনে হল। কিন্তু শোনা গেল, ইনি এ-অঞ্চলের লোক নন। তিব্বত থেকে এসেছেন। মস্ত সাধক। শশীবাবুর হাতই তাঁকে সংগ্রহ করে এনেছে।

স্বস্তিবাচন পাঠের পর চন্দ্ৰমাধব জলদ গম্ভীর স্বরে বললেন, “আজ বড় আনন্দের দিন। আজ আমাদের দিন বিশ্বে এই রাজ্যের রাজা হচ্ছেন।”

তুমুল হর্ষধ্বনি।

দিনু-বিরোধীদের নিয়ে কবরেজমশাই সামনের দিকে দ্বিতীয় সারিতে বসে ছিলেন। কবরেজমশাই পাশে বসা সদাশিবকে কনুই দিয়ে একটা ঠেলা দিয়ে বললেন, “তৈরি থাকবেন।”

“আছি। হাতে পিস্তল। সেপাইরা বেদির পেছনে লুকিয়ে আছে।”

“বাঃ।” রাজপুরোহিত চন্দ্ৰমাধব তাঁর লম্বা দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, “আমি জানি, দিনু বিশ্বেসকে অনেকেই পছন্দ করে না। কিন্তু আজ আমি তাদের সাবধান করে দিচ্ছি যে, কোনও হঠকারিতা করবেন না। দিনুর একখানা ঈশ্বরদত্ত জিনিস আছে। হঠকারিতা করলে রেহাই পাবেন না।”

সদাশিব বললেন, “আর তো সহ্য হচ্ছে না কবরেজমশাই!”

“আর একটু। রাজপুরোহিতটা কে বলুন তো! চেনা-চেনা লাগছে।”

“সে আমারও লাগছে। কিন্তু এখানকার লোক নয়।” চন্দ্রমাধব বললেন, “দিনু বিশ্বেস আজ রাজা হয়েছে, এ অতি আনন্দের কথা। কিন্তু আপনারা অনেকেই দিনু বিশ্বেসের অতীতকে জানেন না। কোন সামান্য অবস্থা থেকে সে আজ এক সংগ্রামী জীবনের ভেতর দিয়ে এতদূর পৌঁছেছে, তা রহস্যাবৃত অনেকেরই কাছে। আপনারা হয়তো জানেন না এই দিনু বিশ্বেস একসময়ে শশী গাঙ্গুলির বাড়িতে ভৃত্যের কাজ করত। একবার চুরি করে ধরা পড়ায়–”

দিনুর মুখখানা হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি উঠে। চন্দ্ৰমাধবকে চুপিচুপি কী যেন বলল। চন্দ্রমাধব বললেন, “আচ্ছা, আচ্ছা। সেসব কথা প্রকাশ করা দিনুর পছন্দ নয়। সুতরাং সেসব কথা আজ থাক।”

সবাই বলল, “সাধু, সাধু।”

চন্দ্রমাধব নিজের পাকা দাড়িতে হাত বোলাতে-বোলাতে বললেন, “দিনুর জীবনটাই এক সংগ্রামী জীবন। সেই সংগ্রামী জীবনের অনেকটাই তাকে কাটাতে হয়েছে জেলখানায়। অন্ধ কারার অন্তরালে

ফের দিনু উঠে চন্দ্ৰমাধবকে কী যেন বলল।

চন্দ্ৰমাধব সামলে গিয়ে বললেন, “সেকথাও আজ থাক। শুধু বলি, দিনুর কীর্তি আমাদের কাছে একটা দৃষ্টান্ত হয়েই থাকবে। কত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সে যে আজ এই রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে, তা ভাবলেও অবাক হতে হয়। যে হাতের জোরে সে আজ এত ওপরে উঠেছে, সেই হাতও সহজে তার হাতে আসেনি। নন্দ কবিরাজের নাতিকে চুরি করে…”

এবার দিনু আর থাকতে না পেরে পেল্লায় একটা ধমক দিল, “চুপ করুন তো ঠাকুরমশাই। ভীমরতি ধরেছে নাকি?”

“তাই তো! বুড়ো বয়সে মুখ বড় আলগা হয়ে যায় কিনা! তা সেসব গুহ্য কথাও আজ মুলতুবি থাক। আমি শুধু আজ দিনুকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করব।”

এই বলে চন্দ্ৰমাধব হাত বাড়িয়ে দিনুর মাথায় পরম স্নেহে হাত বোলাতে লাগলেন। বললেন, “দেখতে এইটুকু হলে কী হবে, সে একজন মস্ত মানুষ। ঠিক যেন ছোট্ট একটু বেলুন ফুলে এই এত বড় হয়েছে।”

শুনে সকলে হেসে উঠল।

দিনুর চোখ-মুখ রাগে লাল হয়ে উঠল। চন্দ্রমাধব সেদিকে খেয়াল না করেই বললেন, “আজ আনন্দের দিনে দিনুর অতীত ইতিহাসকে টেনে না আনাই ভাল। সে-ইতিহাস হয়তো সকলের পছন্দ হবে না। কিন্তু আমি আজ দৃঢ়কণ্ঠে দিনুর বিরোধীদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, তারা যেন হুট করে কিছু করে না বসেন। দিনু চোর বা জোচ্চোর হতে পারে, নানারকম পাপের কাজও করে থাকতে পারে, তবু সে কিন্তু আজ রাজা।”

দিনু আর সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে বলে উঠল, “ওরে হাত, আয় তো। এই ব্যাটা পুরুতের গলাটা টিপে ধরে দে তো ঘা কতক।”

আদেশমাত্র সাঁ করে হাত চলে এল শূন্যপথে। কিন্তু হাত কিছু করার আগেই কবরেজমশাই আর সদাশিব লাফিয়ে উঠলেন। সদাশিব পিস্তল বাগিয়ে ধরে বললেন, “সাবধান দিনু, খুলি উড়িয়ে দেব।”

কবরেজমশাই ধাঁ করে গিয়ে হাতটাকে চেপে ধরে বললেন, “কিছুতেই রাজপুরোহিতের কোনও ক্ষতি করতে দেব না। কিছুতেই না।”

নিয়ম অনুযায়ী ওই কালান্তক হাতের সঙ্গে নন্দবাবুর এটে ওঠার কথাও নয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, হাতটা তিনি চেপে ধরতেই হাতটা যেন তাঁর হাতে নেতিয়ে পড়ল।

চন্দ্ৰমাধব পাকা দাড়িতে হাত বোলাতে-বোলাতে সহাস্যে বললেন, “আজ বড় আনন্দের দিন। দিনু-চোর রাজা হবে। আপনারা সবাই তো তাই চান, নাকি?”

হঠাৎ সভাস্থলে অনেকেই গর্জে উঠল, “না, চাই না। ও লোকটা ভয়ঙ্কর বদমাশ।”

“বদমাশ!” চন্দ্ৰমাধব দিনুর দিকে চেয়ে বললেন, “তাই নাকি?”

নানা কণ্ঠ বলতে লাগল, “ও একটা শয়তান। ও ডাকাত। আমাদের ধান, চাল লুট করে নেয়। টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে যায়। দোকানের জিনিস তুলে নিয়ে যায়।”

দিনু লাফিয়ে উঠে চেঁচিয়ে তার হাতকে বলতে লাগল, “ওরে হাত, ম্যাদামারা হয়ে আছিস যে বড়। সব কটাকে পিটিয়ে ঢিট করে দিয়ে আয়। যা বলছি শিগগির।”

কিন্তু হাত কবরেজমশাইয়ের হাতে দিব্যি জমিয়ে বসে রইল। নড়ল না।

রাজপুরোহিত হাত তুলে সবাইকে শান্ত হতে ইশারা করে বললেন, “হাত তো দেখি দিনুর কথা শুনছে না। তা এইবেলা কি দিনুর মাথায় মুকুটটা পরাব? আপনারা কী বলেন?”

“নাঃ, নাঃ কক্ষনো না?”

দিনু কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ চারদিকের পরিস্থিতি বেগতিক দেখে বেদি থেকে একটা পেল্লায় লাফ মেরে পালানোর চেষ্টা করতেই সদাশিব তার ওপর গিয়ে পড়লেন। তারপর দু-তিনটে রদ্দা মেরে হাতে হাতকড়া পরিয়ে সেপাইদের হাতে দিয়ে বললেন, “সোজা লক আপে নিয়ে তোলো। আমি বাকি বদমাশদের দেখছি।”

চন্দ্ৰমাধব স্মিতহাস্যে বললেন, “আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে। যার দেখবার, সেই দেখবে।”

বলে চোখের একটা ইশারা করতেই কবরেজমশাইয়ের হাত থেকে শশীবাবুর হাত ছিটকে বেরিয়ে গেল এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে ভীম দাস, জটেশ্বর, গৌরহরি ইত্যাদি দশ বারোটা বদমাশকে আধমরা করে নিয়ে এসে, দমাস-দমাস করে বেদির ওপর ফেলল।

কাণ্ড দেখে সবাই হতবাক! পেছনে মানুষজন হর্ষধ্বনি করে উঠল।

হঠাৎ কবরেজমশাই সোজা গিয়ে চন্দ্ৰমাধবের পায়ের ওপর পড়ে বললেন, “চিনতে পেরেছি শশীখুড়ো। এ আপনি ছাড়া, আর কেউ নন!” বলে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলেন।

চন্দ্ৰমাধব তাঁর নকল দাড়ি-গোঁফ আর চুল খুলে ফেলতেই চারদিকে তুমুল চিৎকার উঠল, “শশীদাদু, শশীজ্যাঠা, শশীখুড়ো, শশীভায়া যে!”

শশীবাবু নন্দ কব্রিাজকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “কোনও অপরাধ করোনি ভাই। তোমার অবস্থায় পড়লে যে-কোনও মানুষই এমনটি করত। বাবলুর জন্য চিন্তা কোরো

। আমার হাত গিয়ে আজ সকালেই তাকে উদ্ধার করে এনে তার মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। বাড়ি গিয়েই তাকে দেখতে পাবে।”

“কিন্তু শশীখুড়ো, হাতটা যে দিনু বিশ্বেসের হয়ে গিয়েছিল?” শশীবাবু স্মিতহাস্যে বললেন, “কোনওদিনই হয়নি। দিনু মন্ত্র জানত না। যে মন্ত্র বলেছিল, তাও ভুল। হাতটাকে আমিই বলেছিলাম ওর কথামতো চলতে।”

“কেন শশীখুড়ো?”

“তোমাদের এলেম পরীক্ষা করতে। আমার হাতের ওপর নির্ভর করতে করতে তোমাদের আত্মশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। কমে যাচ্ছিল নিজেদের ওপর নির্ভরতা। তাই অসুখের ভান করতাম।”

লোকজন ঘিরে ধরেছে শশীবাবুকে। একজন বলল, “কিন্তু আপনি যে মারা গেলেন?”

শশীবাবু হেসে বললেন, “ও তো সাজানো ব্যাপার।”

কবরেজ বললেন, “আর তান্ত্রিক। সেও কি সাজানো? আপনার যে নাড়ি বন্ধ ছিল, শ্বাস চলছিল না?”

শশীবাবু স্মিতহাস্যে বললেন, “তান্ত্রিক তো নয়াগঞ্জের জগা। যাত্রার দলে ভাল পার্ট করে। আর নাড়ি যে-কেউ কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করে দিতে পারে। সহজ প্রক্রিয়া আছে। আর শ্বাস? তুমি যখন আমার নাকের কাছে হাত দিলে, শুধু তখন আমি দমটা বন্ধ করে দিলাম।”

“কিন্তু এসব করলেন কেন? দিনু যে এত কাণ্ড করল!”

লে তোমরা প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারো কি না! তাই হাতটাকেও তোমাদের বিরুদ্ধেই প্রয়োগ করলাম। দেখলাম, নাঃ, তোমরা ততটা অপদার্থ হয়ে যাওনি সবাই। বেশির ভাগ যদিও দিনুর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, তবু কয়েকজন যে রুখে দাঁড়িয়েছিল তাইতেই আমি খুশি। সমাজে সত্যিকারের সাহসী কয়েকজনই থাকে। তারা যদি গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে, তবে বাদবাকিরা তাদেরই অনুসরণ করে।”

“তা হলে এখন থেকে হাতটা আগের মতোই কাজ করবে তো?”

শশী গাঙ্গুলি একটু হাসলেন। বললেন, “এতদিন হাতের রহস্য তোমাদের বলিনি। আজ বলতে বাধা নেই। প্রায় ষাট বছর আগে আলাস্কায় এক রাতে আমি তুষারঝড়ে পড়ে যাই। তেমন ব্লিজার্ড বোধ হয় খুব কমই হয়। পথ হারিয়ে কোন প্রান্তরে গিয়ে যে পড়েছিলাম, কে জানে! দু হাত দূরের জিনিস দেখা যায় না। বাতাসের সে কী শোঁ-শোঁ শব্দ। প্রাণ যায়। প্রাণপণে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করছি। কিন্তু শুনবে কে? ভগবানকে ডাকা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। যখন সব আশা জলাঞ্জলি দিয়ে ধীরে-ধীরে তুষারে কবরস্থ হয়ে যাচ্ছি, তখন কোথা থেকে একটা শক্তিমান হাত এসে আমাকে হাত ধরে তুলল, তারপর টেনে নিয়ে চলল। খানিক দূর নিয়ে গিয়ে সে একটা গোলাকার ঘরের মধ্যে আমাকে ঢুকিয়ে দিল। ঘরের মধ্যে বেশ গরম। আলো জ্বলছে। তখন দেখি, যে আমাকে এনেছে সে একটা কাটা হাত! আমি তো আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম। সেই সময়ে ঘরের ও পাশের একটা আবডাল থেকে বিরাট চেহারার একজন লোক বেরিয়ে এল। অত বড় মানুষ দেখা যায় না। সাত ফুট লম্বা তো হবেই, তেমনই দশাসই চেহারা। আমার দিকে চেয়ে প্রথমে অং বং করে কী বলল, কিছুই বুঝতে পারলাম না। খানিকক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ পরিষ্কার বাংলায় বলল, “কোথায় যেতে চাও বলো, পৌঁছে দেব।’ কিন্তু বাংলা বললেও সে কস্মিনকালেও বাঙালি নয়। আমি তখন তাকে আমার ঠিকানা বললাম। তখন হঠাৎ সেই গোল ঘরখানা শুন্যে উঠে চলতে শুরু করল। ব্লিজার্ডে তার কিছু হল না। আমাকে জায়গামতো যখন নামিয়ে দিল, তখন হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কোথাকার লোক? লোকটা বলল, “আন উনো সাম্রাজ্যের। সে অনেক দূর। আমি তখন বললাম, এই কাটা হাতটা কি ভূত? সে বলল, “না। এটা এক অগ্রণী বিজ্ঞানের অবদান।’ আমি লোভে পড়ে বললাম, আমাকে দেবে? লোকটা হেসে বলল, “নেবে? নাও। কিন্তু ওটা তোমাদের ক্ষতিও করতে পারে।”

শশীবাবু একটু দম নিয়ে তারপর বললেন, “আমি বললাম, কী ক্ষতি করবে? লোকটা বলল, তোমার কাজ করার ইচ্ছে কমে যাবে, অলস হয়ে পড়বে। তবু নাও। তবে মনে রেখো, যখন দেখবে তোমার আয়ু শেষ হয়ে আসছে, তখন এটা নষ্ট করে ফেলো। আমি তোমাকে দু রকম মন্ত্র শিখিয়ে দিচ্ছি। একটাতে এটাকে ক্রিয়াশীল করা যাবে। দ্বিতীয় মন্ত্রটা প্রয়োগ করবে এটাকে ধ্বংস করার সময়। আজ সেই সময় উপস্থিত হয়েছে।”

সবাই সমস্বরে বলে উঠল, “না! না! না! না!”

শশী গাঙ্গুলি বললেন, “হাতটাকে ধ্বংস করে ফেলাই উচিত কাজ। তোমাদের তাতে ভালই হবে। দুঃখ কোরো না। পরনির্ভরতা যত কমে যাবে, তোমরা ততই শক্তপোক্ত হবে।”

শশীবাবু হাত বাড়াতেই শূন্য থেকে হাতটা তাঁর হাতে নেমে এল। তিনি শেষবারের মতো হাতটার গায়ে একবার হাত বুলিয়ে আদর করলেন। তারপর বিড়বিড় করে কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করলেন।

অমনই হাতটা শূন্যে উঠে একটা ডিগবাজি খেল। তারপর প্রচণ্ড শব্দে ফেটে শতখণ্ড হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তারপর সেই টুকরোগুলো আবার ফটাস-ফটাস করে ফেটে আরও ছোট-ছোট টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। তারপর সেই টুকরোগুলোও ফাটতে লাগল। ফাটতে-ফাটতে ক্রমে-ক্রমে অণু-পরমাণু হয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। আর তার অস্তিত্ব রইল না।

জড়ো হওয়া মানুষজন হরষে-বিষাদে যে যার বাড়ি ফিরে গেল।

ফেরার পথে কবরেজমশাই জিজ্ঞেস করলেন, “শশীখুড়ো, আপনার অসুস্থতাটা না হয় সাজানো হতেই পারে, কিন্তু আমি নাড়ি ধরে বুঝতে পারলাম না কেন?”

“বলেছি তো, নাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া আছে। অভ্যাস করলেই হয়।”

“আর আপনার গলায় আঙুলের ছাপটা? সেটাও কি নকল?”

“বটেই তো! হাতটাকে বলেছিলুম, গলায় ছাপ ফেলতে। সে আলতোভাবে এমন সুন্দর ছাপ ফেলল যে, তুমি অবধি ধরতে পারোনি।”

“ক্ষান্তমণি কি সবই জানত?”

“জানবে না? খুব জানত।”

.

কুঞ্জপুকুরে আজ ভারি আনন্দের দিন। হাতটা নেই বটে, কিন্তু শশী গাঙ্গুলির এই বেঁচে-ওঠায় গাঁয়ের লোক খুব খুশি। খুশির আরও কারণ আছে। সদাশিব দারোগা এখন খুব তৎপরতার সঙ্গে গাঁয়ের শান্তিরক্ষা করছেন। চোর-গুণ্ডা বদমাশরা আর ত্রিসীমানায় নেই। গাঁয়ের লোকেরা এখন সদা সতর্ক। চণ্ডীমণ্ডপে বিকেলবেলায় শশীবাবুকে একটা সংবর্ধনা দেওয়া হল। শশীবাবু অনেক স্মৃতিচারণ করে বললেন, “আমার আজ এই ভেবে খুব আনন্দ হচ্ছে যে, নন্দ কবিরাজের তেতো পাঁচনগুলো এখন আর খেতে হবে না।”

সবাই খুব হাততালি দিল।

সদাশিব বললেন, “দেশে চোর-ডাকাতের প্রয়োজন আছে। তাতে লোক তৎপর আর সতর্ক হতে শেখে।”

।সবাই হাততালি দিল।

কবরেজমশাই বললেন, “পাঁচন অতি ভাল জিনিস। আমি শশীখুড়োর জন্য চমৎকার একটা পাঁচন তৈরি করেছি। কাল থেকেই খাওয়াব। কারণ, তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের নিজেদের স্বার্থেই দরকার।”

ফের তুমুল হাততালি পড়ল।