ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

৬. রাজকুমারীর মৃত্যু

৬.

রাজকুমারীর মৃত্যু ছিল নিশ্চিত কিন্তু সদাসতর্ক আর্সাসেস বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে এসে নিজের অসি তুলে ঘাতকের তরবারিকে বাধা দিল এবং ব্যাপারটা কি হচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই অদ্ভুত কৌশলে তরবারি দ্রুত সঞ্চালনে ঋক্ষরাজের অসিকে করচ্যুত করে ছিটকে ফেলে দিল কয়েক হাত দূরে!

ভূমিপৃষ্ঠে শায়িত তরবারির দিকে স্তম্ভিত নেত্রে দৃষ্টিপাত করল ঋক্ষরাজ;- তাকে অক্ষত রেখে কোনো যোদ্ধা যে তাকে নিরস্ত্র করতে পারে এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা তার কল্পনার অতীত!

আর্সাসেস একবারও ছায়ার দিকে তাকাল না, সহযোদ্ধা সুবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বলল, হে আর্যযোদ্ধা সুবন্ধু! নিরস্ত্র শত্রুর দেহে অস্ত্রাঘাত করতে আমিও তোমার মতোই সংকোচ বোধ করি। কিন্তু এই বিশ্বাসঘাতক দুর্বৃত্তকে নিষ্কৃতি দেওয়াও অনুচিত বলো, এখন কী কর্তব্য?

সুবন্ধুর পরিবর্তে উত্তর দিল ছায়া, পিতৃব্য এখন নিরস্ত্র, তার দুই সহকর্মীর মধ্যে একজন নিহত, অপর ব্যক্তি মারাত্মক ভাবে আহত হয়ে অস্ত্রধারণে অসমর্থ। অতএব এই যুদ্ধে আমি জয়ী, পিতৃব্যকে হত্যা করার প্রয়োজন নেই।

না, চিৎকার করে উঠলেন রাজপুরোহিত, বাকিরাজ এখনও জীবিত। তিনি নিজমুখে পরাজয় স্বীকার করেন নি। অতএব এই যুদ্ধ এখনও অমীমাংসিত। রাজকুমারী এখনও রাজকুমারী আছেন, তিনি মহারানির পদে এখনও অধিষ্ঠিত হয়ে বাহ্রিকরাজ্যের সিংহাসন অধিকার করতে পারেননি।

উত্তম, বজ্রগম্ভীর স্বরে আর্সাসেস বলল, এই মুহূর্তে আমি রাজকুমারীকে বাহ্রিকরাজ্যের সিংহাসনে মহারানির ভূমিকায় প্রতিষ্ঠা করছি

সশব্দে তরবারিকে কোষবদ্ধ করল আর্সাসেস এবং চোখের পলক ফেলার আগেই তার বাঁ হাত সজোরে আঘাত হানল বাকিরাজের মুখে;- মট করে নাকের হাড় ভাঙার শব্দ পরক্ষণেই ডান হাতের বজ্রমুষ্ঠি ছোবল দিল বাহিকরাজের বক্ষ ও উদরের সন্ধিস্থলে, পর পর দুবার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে স্থির হয়ে গেল ঋক্ষরাজের প্রাণহীন দেহ!

পুরোহিতের দিকে ফিরে ভীষণকণ্ঠে আর্সাসেস বলল, বাহিকরাজ জীবিত নেই। এখন আপনি রাজকুমারীর ছায়াকে বাহ্লিকরাজ্যের সিংহাসনে অধিষ্ঠাতা মহারাণী বলে ঘোষণা করতে পারেন।

কিন্তু পুরোহিত কিছু বলার আগেই অকুস্থলে সমাগত অশ্বারোহী বাহিনীর ভিতর থেকে এক গ্রীক সৈনিক ঘোড়া ছুটিয়ে আর্সাসেস নামক বণিকের সামনে এসে থামল এবং এক লাফে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে ভূমিপৃষ্ঠে অবতরণ করেই নতজানু হয়ে অভিবাদন জানাল, সম্রাট! দুদিন আগে আপনি বহির্গত হয়েছিলেন পারসীক বণিকের ছদ্মবেশে আপনার উদ্দেশ্য ছিল চতুর্দিকের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং নিরুদ্দেশ গ্রীকসৈন্য আজাক্সের অনুসন্ধান। কথা ছিল, গতকল্য প্রভাতে গ্রীকশিবিরে আপনি উপস্থিত না হলে আপনার নির্দিষ্ট সরাইখানায় আমরা যেন অনুসন্ধান করি। যথাসময়ে যথাস্থানে আপনার অনুপস্থিতি আমাদের অতিশয় উদবিগ্ন করে তুলেছিল। তাই সন্ধ্যার সময়ে সরাইখানায় হানা দিয়ে মলিকের মুখ থেকে জানতে পারি প্রত্যূষে বাহিকরাজ্য অভিমুখে রওনা হয়েছে এক পারসীক বণিক এবং তার সঙ্গী হয়েছে এক অনার্য রমণী ও এক পেশাদার আর্যযযাদ্ধা। অবশ্যই পারসিক বণিকের স্বরূপ নির্ধারণ করতে আমাদের বিলম্ব হয় নি; অতএব তৎক্ষণাৎ একজন পথপ্রদর্শককে সঙ্গে নিয়ে আমরা বাহিকরাজ্যের পথে অগ্রসর হয়ে সম্রাটের সাক্ষাৎলাভ করতে সমর্থ হয়েছি। ভগবান জিউসের আশীর্বাদে আপনাকে আমরা অক্ষত ও নিরাপদ দেখে যৎপরোনাস্তি স্বস্তিবোধ করছি।

সৈনিকের বক্তব্য শুনে উপস্থিত জনমণ্ডলী হল স্তম্ভিত বণিকের ছদ্মবেশে তাদের সম্মুখে অবস্থান করছেন স্বয়ং গ্রীকসম্রাট আলেকজান্ডার!

সম্রাট! গ্রীক সৈনিক বলল, আজাক্স নামে গ্রীকসৈনিকের সন্ধান পেয়েছেন কী?

 পেয়েছি, আলেকজান্ডার বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন, তাকে নিয়ে আর চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।

স্তম্ভিত জনতা ও রাজপুরোহিতের দিকে ফিরলেন তিনি, বাহ্রিকরাজ্যের সমাগত প্রজাগণ! আশা করি তোমাদের রাজকন্যাকে রানি হয়ে রাজ্যের সিংহাসন অধিকার করতে দেখে তোমরা সুখী হয়েছ। পুরোহিত! এইবার বোধ হয় বাহ্লিকরাজ্যের সিংহাসনে অধিষ্ঠিতা রাজ্ঞীর নাম ঘোষণা করতে আপনার আপত্তি হবে না।

কয়েক মুহূর্তের স্তব্ধতা, তারপরই বহুকণ্ঠের কলবর, জয়তু মহারানি ছায়া! জয়তু বাকিরাজ্ঞী ছায়া!

সেই কলরব ডুবিয়ে জাগল রণভেরীর— প্রচণ্ড নিনাদ, পরক্ষণেই পুরোহিতের তীব্রকণ্ঠের ঘোষণা, ফাল্গুনী পূর্ণিমার রাত্রে সংঘটিত যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন রাজকুমারী ছায়া– আজ হয়ে তিনি বাহিঙ্করাজ্যের অবিসংবাদিত রাজ্ঞী মহারানি ছায়া।

আবার প্রচণ্ড উল্লাসে জনতা সম্বর্ধনা জানাল তাদের রাণীকে। এগিয়ে এসে উপস্থিত প্রজাবৃন্দকে সম্বোধন করল ছায়া, প্রজাবর্গ তোমাদের প্রীতি ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু এই আর্যযোদ্ধা আর ছদ্মবেশি গ্রীকসম্রাটের সাহায্য না পেলে আমি পিতৃরাজ্যের অধিকার করতে পারতুম না। আমি এই দুজনের কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।

সম্রাট বললেন, মহারাণী। ভারতভূমিতে এসে ফাল্গুনী-পূর্ণিমার রাতে আমার যে অভিজ্ঞতা হল তা জীবনে ভুলব না। এখন আমি বিদায় গ্রহণ করছি। আশা করি অদূর ভবিষ্যতে তুমি তোমার প্রতিশ্রুতি পালন করতে সচেষ্ট থাকবে।

ছায়া হাসল, রাজকুমারী ছায়া –বণিক আর্সাসেসকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, মহারানি ছায়া সম্রাট আলেকজান্ডারের কাছে সেই প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ থাকবে চিরজীবন। সম্রাট আমি অকৃতজ্ঞ নই যে আমার প্রাণরক্ষা করেছে, তার জন্য রাজ্য তো অতি তুচ্ছ- প্রয়োজন হলে আমি প্রাণবিপন্ন করতেও কুণ্ঠিত হব না।

আলেকজান্ডার এবার সুবন্ধুর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন, আর্যযযাদ্ধা! তোমার নির্ভীক আচরণ এবং শত্রুর প্রতি মহত্ব দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। তুমি পেশাদার সৈনিক; উপযুক্ত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে যদি গ্রীকবাহিনীতে যোগ দাও, তাহলে আমি খুবই খুশি হব।

অভিবাদন জানিয়ে সুবন্ধু বলল, সম্রাট! আপনার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাতের চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু গ্রীকশিবিরের প্রহরী আমাকে ফিরিয়ে দেয়। শুনেছি সেনাধ্যক্ষদের মধ্যে কেউ অনুমতি না দিলে অপরিচিত পুরুষ সম্রাটের সাক্ষাৎলাভ করতে পারে না।

–বেশ। এখন তো তুমি সম্রাটের সাক্ষাৎলাভ করেছ। বলো, কী তোমার বক্তব্য?

সম্রাট! আমার কিছু গোপন কথা আছে। যদি নিভৃতে আপনার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেন, তাহলে সব কথা খুলে বলতে পারি।

আলেকজান্ডার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে যুবকের আপদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন, অবশেষে তাঁর মুখে ফুটল হাসির আভাস, কাল সন্ধ্যার সময়ে আমার শিবিরে এস। তোমার গোপন কথা শুনব।

ছায়ার দিকে ফিরে সহাস্যে বিদায় গ্রহণ করলেন সম্রাট তারপর তার জন্য আনীত অশ্বের পৃষ্ঠে আরোহণ করে বাহনকে চালিত করলেন এবং অশ্বারোহী গ্রীকবাহিনীর সঙ্গে অন্তর্ধান করলেন পর্বতশ্রেণির অন্তরালে…

সুবন্ধু! ছায়ার উচ্চকণ্ঠের সম্বোধনে ফিরে তাকাল আর্যযোদ্ধা, আজ রাতে আশা করি বাহ্লিকরাজ্যের অতিথি হতে তুমি অসম্মত হবে না?

–মহারাণীর অতিথি হব, এতে আমার সৌভাগ্য!

–তাহলে আমায় অনুসরণ করো।