ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

৬. মোগলির শত্রু

৬. মোগলির শত্রু

অরণ্যের গ্রাসে মানুষের বসতি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর থেকেই মোগলির জীবনে এল বৈচিত্র্যের স্বাদ এবং জীবনকে সে উপভোগ করতে শুরু করল তখন থেকে। সেই সময়ে যে-সব বিচিত্র ঘটনা ঘটেছিল তার জীবনে, তার সম্পূর্ণ বিবরণ দেওয়ার মতো জায়গা এখানে নেই। তাই তোমরা কখনোই জানতে পারবে না কেমন করে মান্দালার পাগলা হাতির কবল থেকে মোগলি আত্মরক্ষা করেছিল, উত্তরের জলাভূমিতে একরাত্রে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে কেমন করে ভেঙে গিয়েছিল তার ছুরি; তারপর আবার কেমনভাবে জঙ্গলের মধ্যে বুনো শুয়োরের আক্রমণে নিহত একটি মানুষের গলায় বাঁধা একটা মস্ত ছুরি পেয়ে, ওই ছুরিটা দিয়েই কেমন করে সে হন্তারক শূকরকে মেরে প্রতিশোধ নিয়েছিল– এসব কথা সবিস্তারে বলার জায়গা এখানে নেই।

আপাতত যে-গল্পটা এখানে বলতে যাচ্ছি, সেটাই হচ্ছে মোগলির জীবনে সংঘটিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাহিনি– এই ঘটনায় জড়িত হওয়ার ফলে তার প্রাণসংশয় ঘটেছিল এবং মৃত্যুপুরীর দরজা থেকে সে ফিরে এসেছিল বললে সত্যের অপলাপ হয় না কিছুমাত্র।

…অরণ্যের গ্রাসে গ্রামটা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর অনেকগুলো বৎসর চলে গেছে, মারা গেছে মা-নেকড়ে আর বাবা-নেকড়ে, বালু নামে ভালুকটি বয়সের ভারে প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে, এমনকী কালো চিতা বাঘিরা- যার স্নায়ু আর পেশি ইস্পাতের মতো কঠিন সে-ও আর আগের মতো চটপট শিকার ধরতে পারে না, সময়ের স্রোত তাকেও কিছুটা কাবু করে দিয়েছে। আকেলা নামে যে-নেকড়েটি একসময়ে দলপতি ছিল, এখন সে দল ছেড়ে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করে বয়সের ভার তার ধূসর চামড়াকে করেছে দুধের মতন সাদা, পাঁজরের হাড় ঠেলে উঠছে চামড়ার উপর এবং সে এখন চলাফেরা করে কাঠের মূর্তির মতো আড়ষ্ট হয়ে। মোগলি প্রায়ই তার জন্য শিকার করে। সেই শিকারের মাংস খেয়েই বেঁচে আছে আকেলা। সিওনী নেকড়েদের যে-দলটা বিশৃঙ্খলভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, তাদের বাচ্চারা এখন বড়ো হয়েছে। তারা আর বাচ্চা নয়- সর্বসমেত চল্লিশটি প্রাণী– কঠিন মাংসপেশী, দৃঢ় চোয়াল, সঞ্চরণ বিদ্যুত্বৎ ক্ষিপ্র। আকেলা তাদের বলল এইবার দল বাঁধা উচিত এবং সেইজন্য একটি দলপতি স্থির করা দরকার এখনই।

বনের নিয়ম অনুসারে দলপতি নির্বাচন হয় মৃত্যুপণ যুদ্ধে। দলপতি হতে যারা ইচ্ছুক, তারা সবাই যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ফাও নামে বলিষ্ঠ নেকড়েটি অন্য প্রতিযোগীদের পরাস্ত করে দলপতির স্থান অধিকার করল।

নেকড়ের দলের সঙ্গে খুবই ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল মোগলির সম্পর্ক। তবু যে-সব রাতে মন্ত্রণাসভায় সমবেত নেকড়েদের ঐকতান সংগীত বনের বাতাসে আলোড়ন জাগাত, সেইসময় মন্ত্রণাসভার আহ্বান উপেক্ষা করতে পারত না মোগলি- শৈশবের স্মৃতি তাকে ডেকে আনত অকুস্থলে। অন্য সময়ে সে বনে বনে ঘুরে বেড়াত। কখনো কখনো তার সঙ্গে থাকত মা-নেকড়ের চারটি সন্তান মোগলির চার দুধ-ভাই। তোমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, বহুদিন আগে যখন মোগলি নেকড়ে-সমাজ ছেড়ে চলে যায়, সেইসময় ওই চারটি নেকড়ে তাদের মানুষ-ভাইয়ের সঙ্গী হয়েছিল এবং বুনো নেকড়েদের সাহচর্য ত্যাগ করেছিল স্বেচ্ছায়। ফাও-এর নেতৃত্বে গঠিত নেকড়েবাহিনীর সঙ্গে মোগলি ও তার অনুগত চার নেকড়ের যথেষ্ট সদ্ভাব থাকলেও তারা দলের সঙ্গে বসবাস করে না শুধু প্রয়োজনের সময় হাজিরা দেয়, প্রয়োজন শেষ হলেই আবার দলের সান্নিধ্য ত্যাগ করে চলে যায় গভীর জঙ্গলে।

একদিন সন্ধ্যার সময়ে পূর্বোক্ত চার নেকড়ের সঙ্গে সদ্য-নিহত একটি হরিণের অর্ধাংশ নিয়ে মোগলি যাচ্ছিল আকেলার কাছে হঠাৎ বনের ভিতর থেকে ভয়ংকর একটা শব্দ ভেসে এল তাদের কানে। মুহূর্তের মধ্যে সকলেই স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। শেরখানের জীবিতকালে ওই শব্দটা মাঝে মাঝে বনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিত। কিন্তু বাঘটার মৃত্যুর পর ওই শব্দ আর শোনা যায়নি। জঙ্গলের চতুস্পদ বাসিন্দারা ওই জান্তব ধ্বনির নাম দিয়েছে ফীয়াল। বাঘের উচ্ছিষ্টভোগী শৃগাল ওইভাবে ডাক দেয় তার ভোরাদার প্রভুর পিছনে পথ চলতে চলতে। অন্য আর একটি কারণেও শেয়াল ওইভাবে চিৎকার করে। অরণ্যের কোনো জায়গায় বিরাট হত্যাকাণ্ডের সম্ভাবনা দেখলে শেয়ালরা ফীয়াল ধ্বনি তুলে বনচারী পশুদের সতর্ক করে দেয়। ওই অশুভ শব্দের সঠিক বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। তোমরা যদি ঘৃণা, জয়ের উল্লাস, আতঙ্ক আর হতাশার সঙ্গে কিছুটা চতুর ব্যঙ্গবিদ্রুপের মিশ্রণ দিয়ে একটা জাম্ভব ধ্বনি কল্পনা করতে পার, তাহলে ওই শব্দটার কাছাকাছি একটা ধারণা হবে তোমাদের। সেই তীব্র অশুভ ধ্বনি ওয়েনগঙ্গার বহমান জলস্রোতের উপর দিয়ে ভেসে গেল বন থেকে বনে, দূর-দূরান্তরে।

চার নেকড়ের গায়ের নোম ফুলে উঠল, গলা থেকে বেরিয়ে এল চাপা গর্জনধ্বনি। মোগলির হাত চলে গেল ছুরিটার কাছে, সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল অচল পাথরের মতো।

এখানে ডোরাদার জন্তুটা নেই, মোগলি বলল, এই অঞ্চলে শিকার করার সাহস তার হবে না।

এই শব্দ বাঘের আগমন-বার্তা ঘোষণা করছে না, ধূসর ভাই বলল, একটা ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বনের মধ্যে। শোনো।

আবার জাগল সেই ভয়ংকর শিবাধ্বনি– চাপাকান্নার সঙ্গে অস্ফুট হাসির মিশ্রণে ভয়ংকর শব্দ! বুক ভরে শ্বাস নিয়ে মোগলি ছুটল, বনের মধ্যে ধাবমান বহু নেকড়ের পাশ কাটিয়ে সে উপস্থিত হল মন্ত্রণাসভার পাথরের উপর। ফাও আর আকেলা পাথরটার উপর পাশাপাশি বসেছিল, তলায় হাজির ছিল দলের অনেকগুলো নেকড়ে। যারা তখনও উপস্থিত হতে পারেনি তারাও এসে পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যে। নেকড়ে-মায়েরা বাচ্চা নিয়ে গর্তের ভিতর ঢুকল। ফীয়াল যখন শোনা যায়, দুর্বল প্রাণীরা তখন আত্মগোপন করে।

কিছুক্ষণ পর্যন্ত ওয়েনগঙ্গার প্রবাহিত জলধারার কলধ্বনি আর গাছের মাথায় বাতাসের শান্ শান্ শব্দ ছাড়া কোনো আওয়াজ শোনা গেল না। তারপর হঠাৎ নদীর ওপার থেকে ভেসে এল নেকড়ের চিৎকার। দলের কোনো নেকড়ের গলা থেকে শব্দটা আসেনি, কারণ সকলেই সেখানে উপস্থিত ছিল- শব্দের উৎপত্তি হয়েছে দূর অরণ্যে অবস্থিত অপরিচিত আগন্তুকের কণ্ঠে। ক্রমশ শব্দটা দূর থেকে কাছে এগিয়ে এসে স্পষ্ট হল, তীব্র হতাশায় ক্লিষ্ট করুণ আর্তস্বর, ঢোল! ঢোল! ঢোল!

কয়েক মিনিট পরে সমবেত চতুষ্পদ জনতা শুনতে পেল পাথরের উপর দিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে ক্লান্ত পদধ্বনি… জলে-ভেজা শরীর নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই আত্মপ্রকাশ করল একটি নেকড়ে- তার সর্বাঙ্গ রক্তাক্ত, সামনের ডান পা ক্ষতবিক্ষত ও অকেজো। নেকড়েটা একেবারে দলের মধ্যে ঢুকে পড়ল এবং মোগলির পায়ের কাছে পড়ে হাঁফাতে লাগল।

উত্তম শিকার! কোন দল থেকে আসছ? কে তোমার নেতা? উপযুক্ত গাম্ভীর্য নিয়ে প্রশ্ন করল ফাও।

উত্তম শিকার! আমার নাম ওয়ন-টোলা, উত্তর দিল আগন্তুক। ওই নামের অর্থ নিঃসঙ্গ–অর্থাৎ যে-নেকড়ে কোনো দলের সঙ্গে থাকে না, স্বাধীনভাবে বসবাস করে নিজস্ব পরিবারের সঙ্গে।

কে এসেছে এই বনে? জানতে চাইল ফাও। অশুভ শিবাধ্বনি ফীয়াল শুনলে জঙ্গলের বাসিন্দারা ওই প্রশ্নই করে।

ঢোল। দাক্ষিণাত্য থেকে এসেছে ঢোল নামে ওই বুনো কুকুরের দল, ওয়ন-টোলা বলল, আমার স্ত্রী আর চারটি বাচ্চাকে তারা হত্যা করেছে।

কতগুলো কুকুর আছে ওই দলে? জানতে চাইল মোগলি।

জানি না। তবে তাদের মধ্যে তিনজন আর কোনোদিন কারুকে হত্যা করতে পারবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিন পায়ে ভর দিয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছি আমি। স্বাধীন জনগণ দেখ!

আগন্তুক তার আহত ডান পা বাড়িয়ে দিল। সবাই দেখল, সেখানে রক্ত শুকিয়ে আছে। শরীরের অন্যান্য স্থানে এবং গলাতেও রয়েছে নিষ্ঠুর দংশন-চিহ্ন।

খাও? বলল আকেলা, মোগলি যে মৃগমাংস এনেছিল আলোর জন্য, সেইটাকে এগিয়ে দিল সে।

আগন্তুক মাংসটার উপর যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তাতে সবাই বুঝল দীর্ঘকাল উপবাসী ছিল সে।

এই ক্ষতিটা আমি পূরণ করে দেব, কিছুটা খাদ্যগ্রহণের পর ক্ষুধার তীব্র অনুভূতি যখন একটু কমে এল তখন ওয়ন-টোলা বলল, স্বাধীন জনগণ, তোমরা আমায় একটু সময় দাও। কয়েক দিনের মধ্যেই আমি হারানো-শক্তি ফিরে পাব। তখন দেখবে আমিও লড়াই করতে জানি। আমার আস্তানা একসময়ে আমার স্ত্রী ও বাচ্চাদের সান্নিধ্যে পরিপূর্ণ ছিল, এখন সেটা শূন্য। সেই রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়েই শোধ করব। শুধু একটু সময় চাই।

আগন্তুকের দাঁতগুলো সশব্দে ভেঙে ফেলল মৃত হরিণের পিছনদিকের একটি হাড়। শব্দটা শুনে মাথা নাড়ল ফাও, হা, ওই শক্ত চোয়াল যুদ্ধের সময়ে আমাদের কাজে লাগবে। আচ্ছা, ঢোলদের সঙ্গে বাচ্চা আছে?

না। সকলেই পূর্ণবয়স্ক শিকারি। ওদের গায়ের রং লাল। (ভারতীয় বুনো কুকুরের গায়ের রং লাল। তাই ইংরেজিতে ওদের রেড ডগ বলা হয়।)

ওই ভয়ংকর বুনো কুকুরদের সম্পর্কে ভালোভাবেই ওয়াকিবহাল ছিল নেকড়ের দল। ডোরাদার বাঘও ওই কুকুরদের ভয় পায়। ওরা যখন এখানে এসেছে তখন নেকড়ের দলও যে বিপন্ন হবে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। ঢোল নামক বুনো কুকুর যেমন হিংস্র তেমনই নিউঁকি। অন্তত একশো কুকুর জমায়েত না হলে ঢোলরা সেটাকে দল বলেই গণ্য করে না, কিন্তু নেকড়েদের সবচেয়ে বড়ো দলেও চল্লিশটির বেশি নেকড়ে দেখা যায় না কখনোই। বন থেকে বনে, দূর-দূরান্তে ভ্রমণ করার অভ্যাস ছিল বলে দাক্ষিণাত্যের সীমানায় বহুবার ঢোলদের দেখেছে মোগলি। ওই কুকুরগুলোকে সে অত্যন্ত ঘৃণা করত- কারণ, তাদের গায়ের গন্ধ নেকড়ের মতো নয়, নেকড়ের মতো গুহায় বাস করে না তারা এবং তাদের পায়ের আঙুলের ফাঁকগুলো হয় রোমশ। তবে অপছন্দ করলেও বুনো কুকুরের দল যে কী ভয়ংকর, তা জানত মোগলি। হাতির কাছেই সে শুনেছে ঢোলদের কথা। তারা মারতে ও মরতে ভয় পায় না। হাতির মতো শক্তিমান পশুও বুনন কুকুরের দলকে পথ ছেড়ে দেয়। যে-বনে কুকুরের দল প্রবেশ করে, সেই বনে ওঠে মৃত্যুর হাহাকার। আকেলাও জানত ওই ঢোলদের। তাই মোগলিকে সে স্থানত্যাগ করে চলে যেতে অনুরোধ করল। ঢোলরা চলে যাওয়ার পরেও কোনো নেকড়ে যদি বেঁচে থাকে, তাহলে তার মুখ থেকেই লড়াই-এর খবর পাবে মোগলি একথাও জানিয়ে দিল আলো।

আকেলার প্রস্তাবে অসম্মতি জানিয়ে মোগলি বলল, তার ছুরিটা এখনও ভোতা হয়ে যায়নি– যদি ঢোলরা এসে চড়াও হয় নেকড়েদের উপর, তখন মোগলিও চুপ করে বসে থাকবে না তার ছুরিটা লাল হয়ে যাবে ঢোলদের রক্তে।

দলের সঙ্গে থাকো, সঙ্গী চার নেকড়েকে বলল মোগলি, এখন কারো আলাদা থাকা উচিত নয়। যুদ্ধ বাধলে সবাইকে একসঙ্গে লড়তে হবে। আমি যাচ্ছি- ঢোলদের সংখ্যা গুণে দেখব। আকেলা আর ফাও, তোমরা যুদ্ধের জন্য সকলকে প্রস্তুত কর।

তুমি মারা পড়বে, ওয়ন-টোলা চেঁচিয়ে উঠল, এমন জীব, যার দেহে লোম গজায়নি, সে কী করতে পারে ভয়ংকর লাল কুকুরদের বিরুদ্ধে? অমন যে ডোরাদার বাঘ, সে পর্যন্ত—

তুমি বাইরে থেকে এসেছ, তাই আমাকে জানো না, বাধা দিয়ে মোগলি বলল, ঢোলরা যখন সকলেই মারা পড়বে, তখন আবার আমরা গল্পগুজব করব। এখন চলি। উত্তম শিকার!

….ভীষণ উত্তেজনায় অসাবধান হয়ে পড়েছিল মোগলি, অন্ধকারে কোথায় পা পড়ছে, খেয়াল করছিল না সে, ফলে যা হওয়ার তা-ই হল হরিণদের যাতায়াতের পথে নদীর কাছে যেখানে শিকারের জন্য অপেক্ষা করছিল কা, সেইখানে অজগরের কুণ্ডলীতে পা লেগে সশব্দে ছিটকে পড়ল মোগলি।

আঃ! ক্রুদ্ধ কা বলে উঠল, শিকার যখন সহজভাবে যাতায়াত করছে, তখন ধুপধাপ শব্দে শিকারকে চমকে দেওয়ার শিক্ষা কোন জঙ্গল থেকে শিখে এসেছ তুমি?

ধরাশয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে মোগলি বলল, দোষটা আমার। তোমার কাছেই আসছিলাম আমি। তোমাকেই খুঁজছিলাম হন্যে হয়ে। কিন্তু যতবার তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, ততবারই অবাক হয়ে দেখেছি, তুমি আগের চাইতে লম্বা আর চওড়া হয়ে গেছ। বাস্তবিক, সারা জঙ্গলে তোমার মতো জ্ঞানি, বলিষ্ঠ আর সুন্দর কেউ নেই।

তোষামোদে সবাই খুশি হয়, কা-ও হল। মোগলির কাছে বুনো কুকুরদের আগমন-সংবাদ শুনে সে বলল, আমি জ্ঞানী হতে পারি, কিন্তু এখন নির্ঘাত কানে কালা হয়ে গেছি। শ্রবণশক্তি ভালো থাকলে ফীয়াল শুনতে পেতাম। সেইজন্যই তৃণভোজী জন্তুগুলো অস্থির হয়ে পড়েছে। তা, ঢোলরা সংখ্যায় কত?

এখনও জানি না। খবরটা পেয়েই তোমার কাছে আসছি। ওঃ, কা! মোগলি দারুণ খুশিতে ছটফট করে উঠল, লড়াইটা জবর হবে। আমাদের মধ্যে অনেকেই আগামী রাতের চাঁদ দেখতে পাবে না।

তুমি কি নেকড়েদের হয়ে লড়াই করতে চাও? ভুলে যেও না, এই নেকড়ের দল একদিন তোমাকে দল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। কুকুর আর নেকড়ের লড়াইতে তুমি যোগ দিও না। দূরে থেকো। মনে রেখো, তুমি মানুষ।

আমি মানুষ, একথা সত্যি। কিন্তু ঢোলরা যতক্ষণ এই বনে থাকবে, ততক্ষণ আমি স্বাধীন জনগণের একজন।

স্বাধীন জনগণ! একটা ক্রুদ্ধ গোঙানির আওয়াজ ভেসে এল অজগরের গলা থেকে, স্বাধীন চোরের দল! আমি জানি, কয়েকটা মৃত নেকড়ের স্মৃতিকে সম্মান দেওয়ার জন্যেই নেকড়েদের হয়ে লড়াইতে নামতে চাইছ তুমি। এটা আদৌ উত্তম শিকার হবে না। সময় থাকতে সরে পড়ো।

কিন্তু সরে পড়তে রাজি হল না মোগলি। মা-নেকড়ে আর বাবা-নেকড়ে যদি তাকে নেকড়ের দলে স্থান দেওয়ার চেষ্টা না করত, তাদের বাচ্চারা যদি তার হয়ে লড়াই না করত, তাহলে শৈশবেই যে তার মৃত্যু হত, সে-বিষয়ে মোগলির সন্দেহ ছিল না কিছুমাত্র। তাই যারা তার প্রাণ বাঁচিয়েছে, বিপদের সময় তাদের পাশে দাঁড়ানো অবশ্য করণীয় কর্তব্য বলেই মনে করেছিল মোগলি। কিছুতেই তাকে নিরস্ত করতে না পেরে অবশেষে মোগলিকে সাহায্য করতে সম্মত হল কা।

মোগলিকে নিয়ে কা নামল ওয়েনগঙ্গা নদীতে, সাঁতার কাটবে না। আমার গলাটা ভালো করে জড়িয়ে ধর। নির্দেশ দিয়েই ধনুক থেকে নিক্ষিপ্ত তীরের মতো ছুটল কা এবং কিছুক্ষণের মধ্যে উপস্থিত হল একটা সঙ্কীর্ণ গিরিখাতের মধ্যে। জলমগ্ন পাথরে লেজটা জড়িয়ে, মোগলির দেহের চারপাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে স্থির হয়ে রইল কা। তীব্র জলস্রোত সেখানে সগর্জনে ছুটছে, কিন্তু অজগরের কুণ্ডলীর মাঝখানে স্থির হয়ে রইল মোগলি- স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিতে পারল না।

দক্ষ সাঁতারু মোগলি কখনো জলকে ভয় পায় না, কিন্তু এখানে আসার পর থেকে অস্বস্তি বোধ করছিল সে। দুধারে মার্বেল পাথরের খাড়া পাড় উঠে গেছে আশি থেকে একশো ফুট উঁচু হয়ে এবং তারই মাঝখান দিয়ে খরবেগে ছুটে চলেছে ওয়েনগঙ্গা নদী।

এটা হচ্ছে মৃত্যুপুরী, মোগলি বলল, আমরা এখানে এসেছি কেন?

ভয় নেই, ওরা এখন ঘুমিয়ে পড়েছে, কা বলল, ডোরাদারকে হাতি ভয় পায় না। ভোরাদার আর হ। কিন্তু ঢোলদের পথ ছেড়ে দেয়। শোনা যায়, ঢোলরা কাউকে ভয় করে না, কাউকে তারা পথ ছাড়ে না। আচ্ছা, বলতে পারো, ওই পাথরগুলোর মধ্যে যারা বসবাস করে, সেই ক্ষুদ্র জনগণ কাকে ভয় পায়? কাকে পথ ছেড়ে দেয় তারা?

মোগলি ফিস ফিস করে বললে, এটা মৃত্যুপুরী। চল, এখান থেকে যাই। এখানে থাকলে মৃত্যু নিশ্চিত।

না। ভালো করে তাকিয়ে দেখ ওরা এখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। জায়গাটার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। আমি যখন তোমার হাতের মতন লম্বা ছিলাম, সেই তখন থেকে আজ পর্যন্ত জায়গাটা একই রকম আছে, কিছুই বদলায়নি।

ওয়েনগঙ্গা নদীর দুইধারে গিরিখাতের মধ্যে সূর্যরশ্মি ও বৃষ্টিপাত যে-পাথরগুলোকে ক্ষতবিক্ষত করেছে, তার মধ্যে বাস করে অসংখ্য বুনো মৌমাছি! অরণ্যের চতুম্পদ বাসিন্দারা তাদের নাম দিয়েছে, ক্ষুদ্র জনগণ। জঙ্গলের সব পশু এই জায়গাটা এড়িয়ে চলে। কারণ, লক্ষ লক্ষ মৌমাছি যাকে আক্রমণ করবে তার মৃত্যু নিশ্চিত। মহাপরাক্রান্ত হস্তীও মৌমাছিদের ভয় পায়। গিরিখাতের দুইধারে খাড়া পাথরের দেয়ালে কালো মখমলের মতন যে-আস্তরণ দেখা যাচ্ছে, সেদিকে তাকিয়ে মোগলির মতো দুঃসাহসীর বুকেও জাগল আতঙ্কের শিহরণ– ওগুলো হচ্ছে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মৌমাছির জট-পাকানো দেহ নিদ্রিত অবস্থায় পরস্পরের সঙ্গে জড়াজড়ি করে ঝুলছে খাড়া পাথরের গায়ে। মাঝে মাঝে পুরানো চাকগুলো ভেঙে পড়ছে, পচা গলিত নরম জিনিসগুলো পাথরের গায়ে গজিয়ে-ওটা গাছ আর শিকড়বাকড়ে আটকে থেকে ঝুলছে কখনো বা অন্ধকার-আচ্ছন্ন খাদগুলোর মধ্যে সশব্দে গড়িয়ে পড়ছে মধুভর্তি মৌমাছির চাক– সঙ্গেসঙ্গে জেগে উঠছে অসংখ্য মৌমাছির ডানায় ক্রুদ্ধ গুঞ্জন! সে যেন অদৃশ্য মৃত্যুর রণহুঙ্কার! নদীর একদিকে তীরের উপর প্রায় পাঁচ ফুট চওড়া হয়ে যে-আবর্জনার রাশি বছরের পর বছর জমে জমে জঞ্জালে পরিণত সেগুলো তৈরি হয়েছে অসংখ্য মধুলোভী পোকা, মথ, মৌমাছি, মৌমাছির বাচ্চা আর ভেঙে-পড়া চাক থেকে। ওই জঞ্জাল থেকে যে তীব্র গন্ধের নিঃসরণ হচ্ছে, সেই গন্ধ পেয়েই জন্তুরা। সভয়ে সরে যায় সেই জায়গা থেকে। স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কেটে কা এইবার গিরিখাত যেখানে শুরু হয়েছে, সেইখানে বালিতে ভরা নদীতটে নিয়ে গেল মোগলিকে।

এই বছরে মৌমাছিদের শিকার, কা বলল, দেখ। মোগলি তাকিয়ে দেখল দু-টি হরিণ ও একটি মহিষের কঙ্কাল পড়ে আছে নদীতটে। কোনো শেয়াল বা নেকড়ে ওই হাড়গুলো চর্বণ করতে আসেনি।

নিরাপদ সীমানা পেরিয়ে বিপজ্জনক এলাকার মধ্যে না-জেনে পা দিয়েছিল ওই হতভাগ্য পশুরা, মোগলি বলল, তাই ক্ষুদ্র জনগণ ওদের হত্যা করেছে। চল কা, এখান থেকে চল। ঘুমন্ত মৌমাছিরা জেগে উঠলে আমরা বিপদে পড়ব।

না, সকালের আগে ওরা জাগবে না, কা বলল, এখন আমি যা বলি, মন দিয়ে শোনো। বহুদিন আগে একটা হরিণ একদল নেকড়ের তাড়া খেয়ে দক্ষিণদিক থেকে এই অঞ্চলে এসে পড়েছিল। হরিণটা এদিকের জঙ্গলে কখনো আসেনি, ক্ষুদ্র জনগণের কথাও সে জানত না পিছনে ধাবমান দলবদ্ধ নেকড়ের আক্রমণ থেকে প্রাণ বাঁচাতে দিশাহারা হয়ে ছুটতে ছুটতে সে এইখানে এসে পড়ে এবং উপর থেকে ঝাঁপ দেয় ওয়েনগঙ্গা নদীর জলে। সূর্য তখন মধ্যগগনে, ক্ষুদ্র জনগণ ছিল সংখ্যায় অগণিত এবং অতিশয় ক্রুদ্ধ। নেকড়ের দল হরিণটাকে তাড়া করে অকুস্থলে এসে পড়তেই তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ক্ষুদ্র জনগণ। নেকড়েবাহিনীর মধ্যে অনেকেই ওয়েনগঙ্গার জলে ঝাঁপ দিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করল কিন্তু নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার সময়ে শূন্যপথেই তারা আক্রান্ত হল এবং মৃত্যুবরণ করল জলের মধ্যেই। যারা জলে ঝপায়নি, তারাও রক্ষা পেল না। ক্ষুদ্র জনগণের বিষাক্ত দংশনে জর্জরিত হয়ে পাথরগুলোর উপরেই তারা মৃত্যুশয্যায় শুয়ে পড়ল। দলের মধ্যে একটি নেকড়েও প্রাণ নিয়ে পালাতে পারেনি, কিন্তু হরিণটা বেঁচে গেল।

কেমন করে?

কারণ, ক্ষুদ্র জনগণ হরিণটার অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়ার আগেই নেকড়ের তাড়ায় দিশাহারা জন্তুটা ছুটে এসে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। পাথরের উপর দ্রুত ধাবমান কঠিন খুরের সংঘাত-ধ্বনি মৌমাছিদের চমকে দিয়েছিল; ক্রুদ্ধ গুঞ্জন বাতাস কাঁপিয়ে তারা যখন জেগে উঠেছে, পলাতক হরিণ তখন তাদের নাগালের বাইরে– কিন্তু শিকারকে তাড়া করে ঠিক সেই সময়েই অকুস্থলে হল নেকড়েবাহিনীর আবির্ভাব। শিকারের নেশায় অন্ধ নেকড়ের দল যখন তাদের ভুল, বুঝতে পারল, তখন তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে ক্ষুদ্র জনগণ অতএব ভ্রম-সংশোধনের সুযোগ পেল না মাংসলোলুপ নেকড়েবাহিনী, দলের প্রত্যেকেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করল প্রাণ দিয়ে।

হরিণটা বেঁচে গেল? একই প্রশ্নের অবতারণা করল মোগলি দ্বিতীয়বার।

– হ্যাঁ, বাঁচল। অন্তত তখন সে মারা পড়েনি। যদিও ওয়েনগঙ্গার নিষ্ঠুর জলস্রোত থেকে তাকে বাঁচাবার জন্য নদীতে তার কোনো শক্তিমান বন্ধু উপস্থিত ছিল না, তবু সে বাঁচল। তবে হরিণটার মতো স্রোতের মুখে বিপন্ন হবে না মানুষের বাচ্চাটা- কারণ, ক্ষুধার্ত নদীর গ্রাস থেকে ওই বাচ্চাটাকে বাঁচাতে এখানে উপস্থিত থাকবে একটা হোঁৎকা, কানে-কালা, হলদে চ্যাপ্টা মাথা– বাচ্চাটার পিছনে যদি দক্ষিণদেশের তাবৎ বুনো কুকুর তাড়া করে আসে, তবু ওই চ্যাপ্টা মাথা এই জায়গা থেকে একটুও নড়বে না। মোগলি তুমি কি ভাবছ?

মোগলি অনেকক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, মূর্তিমান মৃত্যুর গোঁফ ধরে টানতে বলছ তুমি। এই জঙ্গলের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী, সবচেয়ে বিজ্ঞ প্রাণী যে তুমি, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।

কথাটা অনেকেই বলে। তবে ঢোলরা যদি তোমায় তাড়া করে

করবেই। আমার জিভে ধারালো কাটা আছে। সেগুলো তাদের চামড়ায় বিধলেই বুনো কুকুরের দল তেড়ে আসবে আমার দিকে।

তোমার মাথার উপর ওই পাথরগুলো তুমি কখনো ভালো করে দেখেছ কী? অবশ্য ডাঙ্গার দিক থেকে এসে ওগুলোকে দেখতে হবে।

না। ওগুলো আমি দেখিনি।

তাহলে দেখে এস। জমির অবস্থা খুব খারাপ। ফেটে-ফুটে অজস্র ফাটল জন্মে গেছে ওখানে। তাছাড়া রয়েছে বড়ো বড়ো গর্ত। একবার ওই ফাটল বা গর্তে যদি পা পড়ে যায়, তাহলেই তোমার দফা রফা। উঠে দাঁড়ানোর আগেই তোমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে ক্ষুদ্র জনগণ। তোমাকে এখানে রেখে আমি নেকড়েদের জানাতে যাচ্ছি, কোথায় দাঁড়ালে তারা জংলি কুত্তাগুলোকে দেখতে পাবে। তোমার খাতিরেই এই কাজটা করছি আমি। যদিও নেকড়েদের আমি পছন্দ করি না। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেও আমি ইচ্ছুক নই।

পাথরের উপর যেখানে ফাও আর আলো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রাতের অরণ্য থেকে ভেসে আসা বিভিন্ন ও বিচিত্র শব্দের তরঙ্গ কান পেতে শুনছিল– জলস্রোতে গা ভাসিয়ে নিঃশব্দে সেখানে উপস্থিত হল অজগর কা।

ওহে নেকড়েরা, শুনে রাখো, কা বলল, ঢোলরা জোয়ারের জলে ভেসে আসবে। ওয়েনগঙ্গার তীরের কাছে অগভীর জলে দাঁড়িয়ে তোমরা তাদের হত্যা করতে পারবে অবশ্য যদি ভয় না পাও।

কখন আসবে তারা? ফাও জানতে চাইল।

আমার মানুষের বাচ্চাটা কোথায়? আকেলা জিজ্ঞাসা করল।

ওরা যখন আসবে তখন তাদের দেখতে পাবে, কা বলল, অপেক্ষা করো। আর যে মানুষের বাচ্চাটা তোমাদের হয়ে লড়াই করবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে এবং তার ফলে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে গেছে সেই বাচ্চাটাকে আমিই আশ্রয় দিয়েছি; আর এখনও পর্যন্ত যদি সে জীবিত থাকে, তাহলে সেই কৃতিত্ব তোমাদের নয়। টেলদের জন্য এখানেই অপেক্ষা করো। তোমাদের ভাগ্য ভালো যে, আমি আর মানুষের বাচ্চাটা তোমাদের হয়ে লড়াই করছি।

স্রোতের বিরুদ্ধে আবার দ্রুত সাঁতার কেটে গিরিখাতের মাঝখানে এসে স্থির হয়ে ভেসে রইল কা- তার একাগ্র দৃষ্টি তখন নিবন্ধ হয়েছে পাহাড়ের চূড়ার মতো প্রস্তরসজ্জিত উচ্চভূমির দিকে….।

নক্ষত্রখচিত আকাশের পটভূমিতে দেখা দিল মোগলির চলমান দেহ, পরক্ষণেই নদীর জলে জাগল সশব্দ আলোড়ন- অজগরের কুণ্ডলীর মধ্যে বিশ্রাম নিতে লাগল পরিশ্রান্ত মোগলি।

জায়গাটা অতি ভয়ংকর,মোগলি বলল, নীচু ঝোপঝাড় আর খাদের ভিতর বাসা বেঁধেছে ক্ষুদ্র জনগণ। তিনটি খাদের পাশে আমি কয়েকটা বড়ো পাথর সাজিয়ে রেখেছি। ছুটে যাওয়ার সময়ে পায়ের ধাক্কায় আমি পাথরগুলোকে খাদের ভিতর ফেলে দেব। সঙ্গেসঙ্গে আমার পিছনে পাখা মেলে লাফিয়ে উঠবে ক্রোধে ক্ষিপ্ত ক্রুদ্ধ জনগণ। কিন্তু আমার পরিবর্তে তাদের ক্রোধের শিকার হবে ধেয়ে-আসা বুনো কুকুরের দল।

একেই বলে মানুষের বুদ্ধি, কা বলল, তুমি যথেষ্ট বিজ্ঞ ও সতর্ক। ক্ষুদ্র জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলার দরকার হবে না, তারা সর্বদাই ক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকে।

গোধূলিবেলায় মৌমাছিরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। ওই সময়েই আমি ঢোলদের সঙ্গে খেলব। কুকুরগুলো দিনের আলোতেই শিকার করতে ভালোবাসে। এখন তারা ওয়ন-টোলার রক্তাক্ত পায়ের ছাপ অনুসরণ করছে।

ঢোলরা যখন রক্তাক্ত পদচিহ্নের অনুসরণ করে, তখন সেই পদচিহ্নের মালিক আর জীবিত থাকতে পারে না।

আমি ঢোলদের নতুন ধরনের রক্তমাখা পায়ের ছাপ অনুসরণ করতে শিখিয়ে দেব। সেগুলো হবে তাদের নিজস্ব পদচিহ্ন তাদেরই রক্তে ভেজা। আমি যতক্ষণ ঢোলদের নিয়ে এখানে হাজির না হব, ততক্ষণ পর্যন্ত আশা করি আমার জন্য তুমি অপেক্ষা করবে, কা?

কিন্তু ঢোলরা যদি তোমাকে জঙ্গলের মধ্যে হত্যা করে? অথবা নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার আগেই যদি ক্ষুদ্র জনগণের আক্রমণে তোমার মৃত্যু হয়?

আমি মারা গেলে তোমরা মৃত্যুসংগীত গাইবে। এখন আমি যাচ্ছি। উত্তম শিকার, কা!

…ওয়ন-টোলার রক্তমাখা পায়ের ছাপ ধরে কিছুদূর এগিয়ে একটা গাছের উপর চড়ে বসল মোগলি। তার আগে বন থেকে বেশ কিছু রসুন সংগ্রহ করে থলিতে ভরেছিল সে। বালুর সঙ্গে মাঝে মাঝে জঙ্গলের গাছ থেকে এক-আধটা মৌচাক ভেঙে মধু খেয়েছে মোগলি। সে জানে, বুনো রসুনের গন্ধ সহ্য করতে পারে না মৌমাছি জঙ্গলের ভাষায় ক্ষুদ্র জনগণ। রসুনের থলি গাছের ডালে ঝুলিয়ে পায়ের তলার চামড়ায় ঘষে ঘষে ছুরিটাকে শাণ দিতে লাগল মোগলি আর অপেক্ষা করতে লাগল ঢোলদের জন্য…

মধ্যাহ্নের একটু আগে ওয়ন-টোলার রক্তাক্ত পদচিহ্ন অনুসরণ করতে করতে মোগলির দৃষ্টির সম্মুখে আত্মপ্রকাশ করল একদল ঢোল বা বুনো কুকুর। গাছের উপর থেকে তাদের উপর নজর রাখতে লাগল মোগলি। লাল-রঙা ঢোল নেকড়ের চাইতে আকারে ছোটো, কিন্তু মোগলি জানত ঢেলের পা আর চোয়াল অত্যন্ত শক্তিশালী। টেলদের দলপতি শত্রুর পায়ের ছাপ শুঁকতে শুঁকতে এগিয়ে যাচ্ছিল, গাছের উপর থেকে মোগলি তাকে অভ্যর্থনা জানাল, উত্তম শিকার!

জন্তুটা মুখ তুলে তাকাল। তার সঙ্গীরাও চমকে থেমে গেল পিছনে, তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ। হল ঊর্ধ্বে বৃক্ষশাখায় উপবিষ্ট মানুষটার দিকে। মোগলি দেখল, দলটার মধ্যে শিশু বা বাচ্চা নেই সেখানে জমায়েত হয়েছে দুশো পরিণত বয়সের কুকুর, প্রত্যেকেই বলিষ্ঠ এবং হত্যার আগ্রহে উন্মুখ। দলের যারা নেতৃত্ব দিচ্ছিল তারা মোগলিকে অগ্রাহ্য করে দলটাকে ওয়ন-টোলার পদচিহ্নের দিকে আকৃষ্ট করতে সচেষ্ট হল। মোগলি প্রমাদ গুনল সর্বনাশ! ওরা যদি এখন

রওনা হয়, তাহলে দিনের আলো ম্লান হওয়ার আগেই পৌঁছে যাবে নেকড়েদের আস্তানায়। উঁহু, তা হতে পারে না। অন্তত সন্ধ্যা পর্যন্ত দলটাকে এই গাছের তলায় আটকে রাখতে না পারলে মোগলির উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না।

কার অনুমতি নিয়ে এই বনে ঢুকেছে তোমরা? মোগলি জানতে চাইল।

সমস্ত বনই আমাদের। তাই কারো অনুমতির দরকার হয় না, উত্তর এল। যে-কুকুরটা উত্তর দিল, তার দাঁতগুলো প্রখর সূর্যালোকে ঝকঝক করে উঠল। মোগলি হাসল, তারপর নিখুঁতভাবে ইঁদুরের কণ্ঠস্বর অনুকরণ করে কিছু কি শব্দে চেঁচিয়ে উঠল। ওইভাবে সে বুঝিয়ে দিল ঢোলদের যে, ইঁদরের চাইতে উচ্চশ্রেণির জীব বলে মনে করে না সে। মোগলি যে-গাছে বসেছিল, তৎক্ষণাৎ সেই গাছটাকে ঘিরে ফেলল বুনো কুকুরের দল। দলের সর্দার চিৎকার করে বলল, ওরে লোমশূন্য গেছো বাঁদর! একবার নেমে আয় না দেখি। উত্তরে মোগলি গাছের ডাল থেকে একটা পা নামিয়ে দলপতির মাথার উপর আঙুলগুলো নাচিয়ে দিল। ব্যস! দারুণ ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল ঢোলের দল। দলপতি মোগলির পা লক্ষ্য করে লাফিয়ে উঠতেই মোগলি পা টেনে নিল নাগালের বাইরে, তারপর খুব মিষ্টস্বরে বলল, কুত্তা রে! লাল কুত্তা! চলে যা দক্ষিণে তোর দেশে। সেখানে গিয়ে গিরিগিটি ধরে খা। তোর ভাই চিকা (ইঁদুর) সেখানে আছে। তার কাছে চলে যা লাল কুত্তা। তোর পায়ের আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে বিশ্রী লোম। দূর হয়ে যা এখান থেকে লাল কুত্তা। আবার সে পা নাচিয়ে দিল দলপতির মাথার উপর।

নীচে নেমে আয়, চেঁচিয়ে উঠল অনেকগুলো কুকুর, তুই গাছ থেকে না নামলে আমরাও এখান থেকে নড়ব না। গাছের উপরেই খেয়ে শুকিয়ে মরবি তুই।

মোগলি তখন ঢোলদের চেহারা, বংশ চরিত্র প্রভৃতি বিশ্লেষণ করতে লাগল অত্যন্ত অপমানজনক ভাষায়। অজগর-বন্ধু কা-এর কাছে মোগলি বলেছিল তার জিভে কাটা আছে। কথাটা মিথ্যা নয়– তার জিভ যে-ভাষা উচ্চারণ করছিল ঢোলদের মনে সেগুলো বিধে যাচ্ছিল কাটার মতোই। মোগলি যা চাইছিল, তাই হল– ওয়ন-টোলার কথা ভুলে গেল কুকুরের দল গাছে-চড়া লোমশূন্য মানুষটাকে হত্যা করার জন্য হন্যে হয়ে উঠল তারা। ঢোলদের দলপতি তলা থেকে বার বার লাফ মারছিল মোগলিকে লক্ষ্য করে। অবশেষে নিদারুণ ক্রোধ তার স্বাভাবিক ক্ষমতাকে অতিক্রম করে গেল প্রায় আট ফুট উঁচুতে মোগলির কাছাকাছি পৌঁছে গেল সে। এই সুযোগের জন্যই অপেক্ষা করছিল মোগলি, বাঁ হাত দিয়ে টপ করে দলপতির ঘাড় চেপে ধরল সে। দলপতির শরীরটা মাধ্যাকর্ষণের ফলে সজোরে ঝাঁকি দিয়ে শূন্যপথে কিছুটা নেমে এল, তার দেহের ওজনে যে-গাছের ডালটার উপর আশ্রয় নিয়েছিল মোগলি, সেটা কেঁপে উঠল– আর একটু হলেই ভারসাম্য হারিয়ে মোগলি ছিটকে পড়ত তলায়। নিজেকে কোনোরকমে সামলে নিল সে, তার বদ্ধমুষ্টি কুকুরটার ঘাড়ের উপর একটুও শিথিল হল না– একহাতে জন্তুটার ঘাড় চেপে ধরে অন্যহাতে সজোরে ছুরির কোপ মেরে তার রোমশ চামরের মতো লাল লেজটা কেটে ফেলল মোগলি; তারপর লেজকাটা জানোয়ারটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল তলায় মাটির উপর। মোগলি যা চাইছিল তাই হল ওরা এখন আর ওয়ন-টোলার পিছু নেবে না। এখন ঢোলের দল মোগলিকে হত্যা না করে এখান থেকে নড়বে না। মোগলি আরও উঁচুতে উঠে গাছের একটা আরামদায়ক ডাল বেছে নিয়ে চোখ বুজল এবং কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল।

তিন চার ঘণ্টা ঘুমিয়ে জেগে উঠল মোগলি। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখল, কুকুরের দল থাবা পেতে তার জন্য অপেক্ষা করছে।

গাছের একটা ডালের উপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দলটাকে আবার বিদ্রূপতি তীব্র ভাষায় আক্রমণ করল মোগলি। উত্তরে দলপতি জানাল সে নিজেই লোমহীন বাঁদরটার পেট চিরে তাকে হত্যা করবে– একবার তাকে নাগালের মধ্যে পেলে হয়।

মোগলি বাঁদরের মতোই পাশের গাছে ঝাঁপ দিল। সঙ্গেসঙ্গে তলায় মাটির উপর তাকে অনুসরণ করল কুকুরের দল। এইভাবে গাছ থেকে গাছে ঝাঁপ খেতে খেতে একেবারে সারির শেষ গাছটার উপর পৌঁছে গেল মোগলি। এইবার সংগৃহীত রসুনগুলো নিয়ে সে সারা শরীরে মাখতে লাগল।

নেকড়ের ভাষায় কথা-বলা গেছো বাঁদর, ঢোলের দল চেঁচিয়ে উঠল, তুই কি ভেবেছিস রসুনের গন্ধ দিয়ে তোর গায়ের গন্ধ চাপা দিবি? আমরা তোকে ছাড়ব না। তোর মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত আমরা তোর পিছনে তাড়া করব।

এই নে তোর ল্যাজ, মোগলি সজোরে ছুঁড়ে দিল কাটা ল্যাজটা, রক্তের গন্ধ পেয়ে ঢোলের দল কাটা ল্যাজের পিছনে কিছুটা ছুটে গেল, এইবার চল আমার পিছন পিছন যমের বাড়িতে!

গাছ থেকে সড়াৎ করে নেমে এসে হাওয়ার বেগে ছুটল মোগলি মৌমাছিদের পাথুরে আস্তানার দিকে। ঢোলরা ভাবতেই পারেনি গেছো বাঁদরটা এত চটপট গাছ থেকে নেমে তাদের মুখে এসে পড়বে- মহা-উৎসাহে তারা একসঙ্গে গর্জন করে ছুটল মোগলির পিছনে। বুনো কুকুর দলবদ্ধ হয়ে যাকে তাড়া করে, সে পালিয়ে বাঁচতে পারে না। পলাতক জানোয়ার কুকুরদের চাইতে দ্রুতগামী হলেও একসময়ে তার দম ফুরিয়ে যাবে এবং অনুসরণকারী সারমেয়বাহিনীর কবলে সে পড়বেই পড়বে। কুকুরদের দম অফুরন্ত, বনের কোনো জানোয়ার দমের লড়াইতে তাদের হারাতে পারে না। অতএব, বুনো কুকুররা বুঝে নিল শেষ পর্যন্ত মোগলিকে তারা পাকড়াও করতে পারবে আর মোগলিও বুঝল রক্তের নেশায় উন্মত্ত দলটাকে সে মরণফঁদের মধ্যে টনে নিয়ে যেতে সমর্থ হবে। এখন মোগলির একমাত্র কর্তব্য হচ্ছে, অনুসরণকারী দলটাকে টানটান উত্তেজনার মধ্যে ভুলিয়ে রাখা– সারমেয়বাহিনী যেন শেষ মুহূর্তে বিপদ বুঝে ফিরে না যায়।

ছুটছে মোগলি; তার ঠিক পাঁচ গজ পিছনে ছুটছে সর্দার-ঢোল, আর তারও পিছনে প্রায় সিকি মাইল জুড়ে অর্ধবৃত্তাকারে ছড়িয়ে ছুটছে হত্যার নেশায় অন্ধ ঢোলের দল। মোগলি জানে এই পথটুকু সে দম রাখতে পারবে, তাই গতিবেগ সে কিছুটা সংযত রেখেছে– মৌমাছিদের পাথুরে আস্তানা ডিঙিয়ে যাওয়ার সময়ে সে প্রয়োগ করবে তার সমস্ত ক্ষমতা দুই পায়ের উপর তার আগে নয়…।

সন্ধ্যা আগত, ঘুমিয়ে পড়েছে ক্ষুদ্র জনগণ– কিন্তু যে-মুহূর্তে মোগলির ধাবমান পদশব্দ বেজে উঠল ফাঁকা পাথুরে জমির বুকে, তৎক্ষণাৎ জাগল এক অস্ফুট গুঞ্জনধ্বনি মনে হল মাটির তলা থেকে উঠে আসছে সেই ভয়াবহ গুন গুন শব্দ। মোগলি তখন যে দৌড়টা দিল, তেমন জোরে সে কখনো দৌড়ায়নি। এক! দুই! তিন! ছুটতে ছুটতেই সে পায়ের ধাক্কায় সংগৃহীত পাথরের তিনটি স্থাপকে ছিটকে ফেলে দিল মধুর গন্ধে ভরা অন্ধকার খাদের ভিতর এবং সঙ্গেসঙ্গে তার কানে ভেসে এল গিরিগুহার ভিতর সমুদ্রগর্জনের মতো চাপা গম্ভীর শব্দ! আড়চোখে তাকিয়ে সে দেখতে পেল তার পিছনে জমাট কালো একটা মেঘ ভেসে উঠছে হাওয়ায় ভর করে মৌমাছির ঝাঁক!

অনেক নীচে তার চোখে পড়ল ওয়েনগঙ্গার বহমান তীব্র জলস্রোত আর সেই জলের উপর ভাসমান একটা তেকোণা চ্যাপ্ট মাথা তৎক্ষণাৎ শূন্যে ঝাঁপ দিল মোগলি। তার কাঁধের কাছেই একজোড়া দাঁতাল চোয়াল সশব্দে বন্ধ হল, ল্যাজকাটা সর্দার-ঢোল মোগলিকে লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিয়েছে এবং ফসকে গেছে তার দাঁতের কামড়! মোগলির সঙ্গে সেও ছিটকে পড়েছে জলে আর তীব্র স্রোতে ভেসে গেছে অনেক দূরে।

একটাও হুল বিদ্ধ হয়নি মোগলির শরীরে, বুনো রসুনের ঝাঁজালো গন্ধ তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে মৌমাছির আক্রমণ থেকে। অজগর-বন্ধু কা-এর কুণ্ডলীর মধ্যে তীব্র জলস্রোতকে ফাঁকি দিয়ে পরিশ্রান্ত শরীরকে একটু বিশ্রাম দেওয়ার সুযোগ পেল মোগলি। তার আশেপাশে খাড়া পাহাড়ের উপর থেকে জলে এসে পড়তে লাগল মৌমাছির আক্রমণে নিহত কুকুরদের মৃতদেহ। জলে ঝাঁপিয়ে পড়েও তারা ক্ষুদ্র জনগণের বিষাক্ত হুল থেকে আত্মরক্ষা করতে পারেনি। কয়েকটা কুকুর পা ফসকে খাদের মধ্যে পড়েছে এবং অসংখ্য মৌমাছির আক্রমণে জর্জরিত হয়ে সেইখানেই মৃত্যুবরণ করেছে। দলের অধিকাংশ কুকুর অবশ্য বেঁচে গিয়েছিল, মৌমাছির দংশনের জ্বালায় চিৎকার করতে করতে তারা ঝাঁপ দিয়েছিল নদীর জলে।

ধীরে, বন্ধু, ধীরে! কা বলল, তুমি ক-টাকে মারবে? অনেকগুলো ঢোল বিপদ বুঝেই চটপট জলে ঝাঁপিয়েছে, তারা মৌমাছির কামড় খায়নি একেবারেই।

এখানে আর থাকা যাবে না, মোগলি বলল, ক্ষুদ্র জনগণ রাগে পাগল হয়ে গেছে। চলো, পালাই।

মোগলি ডুব দিল। ক্রুদ্ধ মৌমাছিরা নদীর উপর ঝাঁক বেঁধে উড়ছে, জীবন্ত যা-কিছু দেখছে, তার উপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে তারা। মোগলি জলের তলায় গা-ঢাকা দিলেও কা ভেসে রইল। তার চামড়া ভেদ করতে পারে না মৌমাছির হুল।

ডাঙায় থাকলে মৃত্যু নিশ্চিত বুঝে প্রত্যেকটি কুকুরই জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। প্রবল স্রোতে ভেসে যেতে যেতে একটা পাথুরে জায়গায় তীরের উপর আশ্রয় নিতে চেয়েছিল ঢোলের দল- কিন্তু ক্রুদ্ধ মৌমাছিরা সেখানেও তাদের অনুসরণ করল এবং হুলের খোঁচায় জর্জরিত কুকুরগুলো আবার জলে নামল বাধ্য হয়ে। খরস্রোতা নদী তাদের টেনে নিয়ে চলল নেকড়েদের আস্তানার দিকে। মোগলি শুনতে পেল কর্তিত লাঙ্গুল নিয়ে দলপতি তার বাহিনীকে উৎসাহ দিচ্ছে নেকড়েদের উপর আক্রমণ চালাতে।

এবার যা করার তা করবে তোমার জাতভাই, মোগলিকে উদ্দেশ করে বলল কা, আমি চললাম। নেকড়েদের আমি সাহায্য করি না।

নদীতটে দেখা দিল একটি নেকড়ে তিন পায়ে লাফাতে লাফাতে আসছে, তার দুই চোখ জ্বলছে জ্বলন্ত দু-টুকরো কয়লার মতো ওয়ন-টোলা! তার মুখে কথা নেই, সে শুধু ভাসমান কুকুরের দলটাকে ডাঙ্গার উপর অনুসরণ করতে লাগল নিঃশব্দে।

ঢোলরা অনেকক্ষণ সাঁতার কেটেছে, তাদের শরীর আর রোমশ লাঙ্গল জলে ভিজে ভারী হয়ে পড়েছে তারাও ক্লান্ত এবং তাদেরও কণ্ঠ ছিল নীরব।

এটা মোটেই উত্তম শিকার নয়, একটা ঢোল বলল।

উত্তম শিকার, বলেই মোগলি ভেসে উঠল সেই ঢোলটার পাশে এবং ধারাল ছুরিটা কাঁধের উপর বসিয়ে সজোরে ঠেলে দিল মরণোন্মুখ শ্বাপদের মরণ-কামড় এড়িয়ে যাওয়ার জন্য।

তুমি কি ওখানে মানুষের বাচ্চা? নদীর পাড় থেকে জিজ্ঞাসা করল ওয়ন-ঢোলা।

আমার হাতে অনেকগুলো কুকুর মারা পড়েছে, মোগলি বলল, কিন্তু এখনও তোমার জন্য কয়েকটা রয়েছে। আমি কি ওদের পাঠিয়ে দেব তোমার কাছে?

আমি অপেক্ষা করব, ওয়ন-ঢোলা বলল, সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত্রি, আর আমিও চোখে ভালো দেখতে পাচ্ছি।

দূর বন থেকে ক্রমশ কাছে এগিয়ে এল সিওনী নেকড়েবাহিনীর চিৎকার। ক্রমশ নদীতীরে দৃশ্যমান হল নেকড়ের দল। এখন আর তাদের মুখে শব্দ নেই, যুদ্ধের উত্তেজনায় জ্বলছে তাদের চোখগুলো। অরণ্য নিস্তব্ধ। শুধু পিছন থেকে ভেসে আসছে ফীয়াল- ভয়ংকর শিবাধ্বনি।

বুনো কুকুরদের ল্যাজকাটা সর্দার তার বাহিনীকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে আদেশ করল। ঢোলের দল অগভীর জল ঠেলে নদীর পাড়ে উঠে পড়ল এবং আক্রমণ করল নেকড়ের দলকে। লড়াই চলল অনেকক্ষণ ধরে, অবশেষে পরাস্ত হল ঢোলের দল। নেকড়েদের মধ্যেও নিতান্ত কম হল না হতাহতের সংখ্যা। শত্রুবধ করতে করতে মৃত্যুবরণ করল ওয়ন-ঢালা। ঢোলদের মধ্যে যারা বেঁচে ছিল তারা এবার পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে সচেষ্ট হল। তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল নেকড়েরা। রক্তাক্ত ছুরি হাতে নদীতীরে বালির উপর দিয়ে ছুটছিল মোগলি। হঠাৎ তার সামনে নয়টি মৃত কুকুরের মাঝখান থেকে ঠেলে উঠল আহত আকেলার প্রকাণ্ড মাথা ও প্রশস্ত স্কন্ধ। দৌড়ে গিয়ে আকেলার পাশে হাঁটু পেতে বসে পড়ল মোগলি।

এটাই আমার শেষ লড়াই, হাঁফাতে হাঁফাতে বলল আকেলা, তোমার খবর কী?

–আমি এখনও বেঁচে আছি। অনেকগুলো, ঢেল মারা পড়েছে আমার হাতে।

ছোট্ট ভাইটি, আকেলা বলল, আমি এবার আমার জাতভাইদের উদ্দেশ্যে কয়েকটা কথা বলব। তুমি কি আমায় একটু তুলে ধরতে পারবে?

খুব সাবধানে ধীরে ধীরে দুই হাতে জড়িয়ে আকেলাকে দাঁড় করিয়ে দিল মোগলি। মৃত্যুর আগে নেকড়েবাহিনীর দলপতিরা মৃত্যুসংগীত গেয়ে থাকে নেকড়েসমাজে এটাই প্রচলিত প্রথা- আকেলাও শুরু করল গান। ধীরে ধীরে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ভেসে গেল সেই জান্তব ধ্বনি বনের বাতাসে বন থেকে বনে, বন-বনান্তে তারপর হঠাৎ মোগলির বাহুবন্ধন ছাড়িয়ে একলাফে শূন্যে উঠল আলো এবং পরক্ষণেই আছড়ে পড়ল তার প্রাণহীন দেহ তারই কবলে নিহত একটি কুকুরের মৃতদেহের উপর।

হাঁটুর উপর মাথা রেখে স্থির হয়ে বসে রইল মোগলি। তার চারদিকে কী ঘটছে, সে-বিষয়ে একটুও সচেতন ছিল না সে। পলাতক ডোলদের এখন অনুসরণ করছে নির্মম লাহিনীর (মেয়ে-নেকড়ে) দল। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্তব্ধ হয়ে গেল লড়াই-এর শব্দ। খোঁড়াতে খোঁড়াতে এক জায়গায় এসে দাঁড়াল হতাবশিষ্ট নেকড়েরা। দলের মধ্যে পনেরোজন নেকড়ে মারা পড়েছে, মেয়ে-নেকড়েদের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে ছয়জন। যারা বেঁচে ছিল, তাদের মধ্যে প্রত্যেকের দেহেই ছিল ক্ষতচিহ্ন– কেউ ফেরেনি অক্ষত শরীরে। কিন্তু দাক্ষিণাত্য থেকে যে ভয়ংকর বুনো কুকুরের দল এই বনে হানা দিয়েছিল যারা গর্ব করে বলত, বনবাসী কোনো প্রাণী তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহস পায় না– সেই দলের দু-শো কুকুরের মধ্যে একটি কুকুরও স্বদেশে ফিরে যেতে পারেনি প্রাণ নিয়ে।