৬. মৃন্ময়ীভবনের গেটের সামনে

মৃন্ময়ীভবনের গেটের সামনেই সেই পালোয়ান দাঁড়িয়ে ছিল। আমাদের দেখতে পেয়ে সেলাম ঠুকে গেট খুলে দিল। অ্যালসেশিয়ান কুকুরটার গর্জন শুনতে পেলাম না। লক্ষ্য করলাম, পুবের লনে কালকের মতো বেতের টেবিল-চেয়ার পাতা আছে। বনশ্রী, সুদেষ্ণা, তন্ময় ও সৌমিত্র বসে উত্তেজিতভাবে কিছু আলোচনা করছে।

কর্নেল বললেন, সেনসায়েব কি বেরিয়েছেন?

হরি সিং বলল, হ্যাঁ সার। কলকাতা থেকে তাঁর দুজন বন্ধু এসেছেন। তাদের নিয়ে কোথায় বেরিয়েছেন।

আচ্ছা হরি সিং, তুমি তো মাঝে মাঝে এ বাড়িতে এসে থাকো?

থাকি সার! দাদা যখন আমাদের গ্রামের বাড়িতে যায়, তখন আমাকে একা এ বাড়ি পাহারা দিতে হয়।

এবার বুঝি দাদার কাছে বেড়াতে এসেছ?

না সার! ছোটসায়েব খবর পাঠিয়েছিলেন, এখানে নাকি চোরের উৎপাত হচ্ছে। তাই আমি এসেছি। হরি সিং হাসল। রামজির কৃপায় চোর-ডাকাত আমার সাড়া পেলেই ভেগে যায়, সার।

আমাদের দেখে সুদেষ্ণা এগিয়ে আসছিল। কাছে এসে সে বলল, কর্নেল শুধু পাখি-প্রজাপতির পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এদিকে এক সাংঘাতিক কাণ্ড! চলুন, বলছি।

পোর্টিকোর সামনে গিয়ে সে চাপাস্বরে বলল, বিকেলে রাম সিং সাইকেলে চেপে বাজারে গিয়েছিল। সেখানে একটা লোক তার হাতে একটা চিঠি দিয়ে বলে, তোমার সায়েবকে দিও। সাংঘাতিক চিঠি। ছোটমামাকে কে হুমকি দিয়ে ইংরেজিতে লিখেছে, বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি মৃত্যু। কাল বেলা বারোটার মধ্যে এক্স ফাইল পার্বতীর মন্দিরে রেখে না এলে কেউ তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। রাম সিং একটা বুন্ধু। সে লোকটাকে ভালো করে তাকিয়েও দেখেনি। শুধু। বলছে, বেঁটে মোটাসোটা লোক। মুখে দাড়ি আর চোখে সানগ্লাস ছিল।

তোমার ছোটমামা কোথায় গেছেন?

ওঁর বন্ধুদের নিয়ে লাখানপুরে পুলিশের কাছে গেলেন। ওঁর এক বন্ধুর সঙ্গে নাকি পুলিশ সুপারের খুব জানাশোনা আছে। আমি আপনার কথা জোর দিয়ে বললাম। ছোটমামা শুনলেন না। আপনারা বসুন। আমি কফির ব্যবস্থা করি।

সে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। আমরা তন্ময়দের কাছে গেলাম। তন্ময় বলল, বসুন কর্নেলসায়েব। তিতি সম্ভবত আপনাকে ঘটনাটা বলেছে।

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। তো তোমরা ভরদ্বাজসায়েব আর সিনহাসায়েবকে কীভাবে আবিষ্কার করলে?

সৌমিত্র একটু হেসে বলল, আমরা ওঁদের আবিষ্কার করার আগেই ওঁরা এখানে আবিষ্কৃত হয়েছেন।

বনশ্রী বলল, হেঁয়ালি কোরো না। সোজা বললেই পারো। ওঁদের ট্রেন লেট করেছিল। বুঝলেন কর্নেলসায়েব! ওঁরা রাত্তিরে রেলওয়ে রেস্ট রুমে কাটিয়ে তারপর জানতে পারেন আজমগড়-লাখানপুর লাইনে ট্রেন বন্ধ। তখন সিনহাসায়েব তার বন্ধু পুলিশ সুপারের বাড়ি যান। আপনারা বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে পুলিশের জিপ দুজনকে পৌঁছে দিয়ে গেল। বনশ্রী হাসল। এদিকে এরা দুজনে খুঁজে নাকাল হয়ে একটু আগে ফিরল।

তন্ময় বলল, বাবা একটুতেই নার্ভাস হয়ে পড়েন। পুলিশের জিপের সঙ্গে রেস দিতে ছুটলেন। সিনহাসায়েবও তাই। আমি থাকলে নিষেধ করতাম।

বনশ্রী বলল, না। সিনহাসায়েব আর ভরদ্বাজসায়েবই শ্বশুরমশাইকে তাতাচ্ছিলেন। আমি নিজের কানে শুনেছি।

তুমি যা-ই বলো, বাবার এই রিস্ক নেওয়া ঠিক হয়নি।

বনশ্রী বলল, সুদেষ্ণা কর্নেলসায়েবের সঙ্গে পরামর্শ করতে বলছিল। শ্বশুরমশাই বেচারিকে পাত্তাই দিলেন না।

সৌমিত্র বলল, সনকাকু কেন যে ওই কুকুরটার ওপর এত ভরসা করেন বুঝি না। কাল রাতে টমের যা সাহস দেখেছি!

কর্নেল বললেন, সেনসায়েব টমকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন?

তন্ময় বলল, বাবা বেরুলেই টমকে সঙ্গে নেন। সৌমিত্র টমকে চেনে না। আসলে কাল রাতে কোনও হিংস্র বুনো জন্তু হয়তো পাঁচিল টপকে ঢুকেছিল। ভালুকও হতে পারে। কালো চিতাবাঘও হতে পারে। একসময় এই এরিয়ার বনে-জঙ্গলে জন্তু-জানোয়ারের অনেক গল্প শুনেছি। মাঝে মাঝে বুনো হাতির পালও এসে হানা দিত।

সুদেষ্ণা রাম সিংকে পাকড়াও করার ভঙ্গিতে নিয়ে এল। অবশ্য রাম সিংয়ের হাতে কফির ট্রে ছিল। টেবিলে সে ট্রে রেখে কাচুমাচু মুখে কর্নেলকে সেলাম দিল। সুদেষ্ণা বসে কফি তৈরি করতে করতে বলল, কর্নেলসায়েবকে সব কথা বলো। কর্নেল! আপনি ওকে জেরা করুন।

রাম সিং বলল, আমি বাজারের থলে সাইকেলে লটকে দিচ্ছি, সেই সময় লোকটা আমার হাতে একটা চিঠি দিয়ে বলল, তোমার সায়েবকে দেবে। তারপর চলে গেল।

সুদেষ্ণা বলল, কেমন চেহারা সেটা বলো।

আমার মতো সার! আমি বেঁটে। হরিয়া লম্বা।

কর্নেল হাসলেন। হরি সিং?

হা সার। হরিয়া কুস্তিগির। ওর গায়ের জোর একটা হাতির মতো।

সুদেষ্ণা চোখ পাকিয়ে বলল, খালি ভাইয়ের বড়াই। সেই লোকটার কথা বলো।

দিদি! আমি ভালো করে দেখিনি। মুখে দাড়ি, চোখে কালো চশমা আর মাথায় টুপি ছিল।

কর্নেল বললেন, তার কথা শুনে কি বাঙালি বলে মনে হয়েছিল রাম সিং?

না সার! একটু দেহাতি টান ছিল কথায়।

গায়ের রঙ মনে পড়ছে?

ফর্সা না। তত কালোও না।

আচ্ছা রাম সিং! তোমার বড়সায়েব যখন মারা যান, তখন তুমিই তো ডাক্তার ডাকতে গিয়েছিলে?

হ্যাঁ সার।

বড়সায়েবের দাহ এখানকার শ্মশানে হয়েছিল। তুমি শ্মশানে গিয়েছিলে?

না সার। ছোটসায়েব আমাকে বাড়ি পাহারা দিতে বলেছিলেন।

 বড়সায়েবের লাশ কীভাবে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল?

রাম সিং তাকাল। আমার মনে হলো, প্রশ্নটা তাকে বিব্রত করেছে। একটু পরে শ্বাস ছেড়ে সে বলল, ডাক্তার পাণ্ডেজির বাড়িতে টেলিফোন আছে। উনি সৎকার সমিতিকে খবর দিয়েছিলেন। ভোরবেলা তাদের গাড়ি এসেছিল।

তন্ময় বলল, আসলে বাবা নিশ্চিত হতে পারেননি ডাক্তারের কথায়। বাবার কাছে শুনেছি, অ্যাম্বুল্যান্স এসেছিল লোকাল হেলথ সেন্টার থেকে। তারপর সেখান থেকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়।

রাম সিং বলল, তা হবে। আমি ভেবেছিলাম সৎকার সমিতির গাড়ি।

বলে সে সেলাম ঠুকে চলে গেল। তন্ময় বলল, রাম সিং একটা বুদ্বু। কিছু বুঝিয়ে বলতে পারে না।

সুদেষ্ণা বলল, ওসব পুরনো কথা থাক। চিঠিটা আমি পড়ে দেখেছি। তোমরা দেখনি। ওতে এক্স ফাইল বলে একটা কথা আছে। সেটা কী বুঝতে পারছি না।

আমি বললাম, আপনি কাল বলছিলেন আপনার বড়মামার উদ্ভাবিত কোনও ফরমুলার কথা। এক্স ফাইল সেই ফরমুলার ফাইল হতেও পারে।

তন্ময় একটু চটে গেল। তিতির মাথায় যত রাজ্যের উদ্ভট থিওরি। গোয়েন্দা উপন্যাস পড়ে আর বিদেশি থ্রিলার ছবি দেখে ওর মাথায় কত কী গজায়।

সুদেষ্ণাও চটে গেল। জয়ন্তবাবু বলছিলেন টুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন। অস্বীকার করতে পারো? বড়মামা কত সব এক্সপেরিমেন্ট করতেন তোমার জানা উচিত।

বনশ্রী বলল, তর্কাতর্কি থামাও। আলো কমে গেছে। হিম পড়বে এবার। তিতি! চলো দেখি, কিচেনে গিয়ে সুপারভাইজ করা যাক। আজ রাতে আরও দুজন গেস্ট। ওঠ!

দুজনে চলে গেল। বাড়িতে আলো জ্বলে উঠেছে। সৌমিত্র উঠে দাঁড়াল। বলল, ভীষণ ক্লান্ত। আমরা কিছুক্ষণ গড়িয়ে নিই গে। আয়!

তন্ময় উঠে তার সঙ্গে হাঁটতে লাগল। কর্নেল বললেন, আমরাও উঠছি। তন্ময়! কফির সরঞ্জাম এখানে পড়ে থাকলে সেই জন্তুটা আবার এসে হানা দেবে। ওর হানা দেওয়ার কারণ আমি বুঝতে পেরেছি।

তন্ময় দাঁড়াল না। সৌমিত্র ঘুরে দাঁড়িয়ে একটু হেসে বলল, আপনি হয়তো ঠিক বলেছেন। তারপর সে তন্ময়ের সঙ্গ ধরল।

কর্নেল আস্তে বললেন, একটু বসো জয়ন্ত! চুরুটটা শেষ করে নিই।

বললাম, বি কে সেনের মৃত্যুর ব্যাপারটা কেমন যেন গোলমেলে। রাম সিং আপনার প্রশ্নে কেমন হকচকিয়ে গিয়েছিল।

ওসব কথা থাক। চুরুটটা শেষ করে নিই। তারপর—

 কর্নেল হঠাৎ থেমে গেলে বললাম, তারপর কী?

 তারপর একটা কথা আমাকে জেনে নিতে হবে।

কার কাছে?

সুদেষ্ণার কাছে।

বলে কর্নেল চুপচাপ চুরুট টানতে থাকলেন। দিনের আলোর ধূসরতা ক্রমে যত কালো হয়ে আসছিল, আমার অস্বস্তি তত বেড়ে যাচ্ছিল। কাল রাতে একটা অদ্ভুত জন্তু আমাদের পেছনে ফুলের ঝোপের আড়ালে ওত পেতে বসে। ছিল। বারবার তাই পেছনের দিকটা দেখে নিচ্ছিলাম। বাড়িতে যে আলোগুলো জ্বলছে, তার ছটা এতদূরে পৌঁছচ্ছে না। হঠাৎ মনে হলো, যে-বাড়িতে প্রায়ই চোর হানা দেয় এবং গত রাতেও হানাদারি ঘটেছে, সেই বাড়ির পারিপার্শ্বিক এমন অন্ধকার করে রাখা হয়েছে কেন? এটা কি ইচ্ছাকৃত? নাকি কারও মাথায় আসেনি যে, উজ্জ্বল স্পটলাইট চারদিক থেকে জ্বেলে রাখা দরকার?

কর্নেল চুরুট শেষ করে জুতোর তলায় ঘষটে নেভালেন। পুরো একটা চুরুট ওঁকে এভাবে কখনও একবারে শেষ করতে দেখিনি। কিছু গভীর চিন্তাভাবনা বা আঁক কষছিলেন মনে মনে?

এগিয়ে যাবার সময় আলোর কথাটা কর্নেলকে বললাম। উনি শুধু বললেন, তোমার প্রশ্নটায় যুক্তি আছে। তারপর আবার চুপ করে গেলেন। লনের মাঝামাঝি রাম সিংয়ের সঙ্গে দেখা হলো। সে টর্চ জ্বালতে জ্বালতে আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আমাদের থাকার ঘরের বারান্দায় উঠে লক্ষ্য করলাম, সে কফির সরঞ্জাম গুছিয়ে নিয়ে আসছে। চেয়ার টেবিলগুলো গত রাতের মতো সেখানেই পড়ে থাকল।

ঘরের দরজা বাইরে থেকে ভেজানো ছিল। আলো জ্বলছিল। ভেতরের দরজা খোলা দেখলাম। কর্নেল বললেন, রাম সিংকে বলো, সুদেষ্ণাকে ডেকে দেবে।

রাম সিং পোর্টিকোর তলা দিয়ে সদর দরজায় ঢুকলে সুদেষ্ণাকে ডাকতে বললাম। দেখলাম, রাম সিং মেঝেয় ট্রে রেখে সদর দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর বিনীতভাবে বলল, এখনই ডেকে দিচ্ছি সার!

সুদেষ্ণা এলো মিনিট পাঁচেক পরে। তার মুখে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট। কর্নেল বললেন, আচ্ছা তিতি, তোমার ছোটমামার বন্ধুরা যখন পুলিশের জিপে এলেন, তখন তুমি কোথায় ছিলে?

সুদেষ্ণা বলল, আমি ওপরে ছিলাম। ছোটমামা নিচে থেকে ডেকে বললেন, তিতি! ওঁরা এসে গেছেন। তখন আমি নেমে এলাম।

তুমি পুলিশের জিপটা দেখেছিলে?

না। তবে জিপগাড়িটা চলে যাওয়ার শব্দ শুনেছি।

তার মানে, তুমি ওই গাড়িটা দেখনি?

সুদেষ্ণা একটু অবাক হয়ে বলল, না। কেন একথা জিজ্ঞেস করছেন?

নিছক কৌতূহল। তো তুমি কখনও তোমার ছোটমামার ওই দুই বন্ধুকে দেখেছ?

কলকাতার বাড়িতে মাঝে মাঝে দেখেছি।

ওঁরা যখন এলেন, তখন বনশ্রী কোথায় ছিল?

ওপরের ঘরেই ছিল। আমরা দুজনে একঘরে থাকি। তন্ময়দা আর সৌমিত্র আলাদা ঘরে থাকে।

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, তুমি নরেশ ভার্মাকে কি তোমার ছোটমামার কাছে কখনও আসতে দেখেছ?

সুদেষ্ণা মাথা নেড়ে বলল, নাহ। আমি বড়মামার মৃত্যুর পর আর তাকে দেখিনি। বলেই সে একটু চঞ্চল হয়ে উঠল। কর্নেল! আপনার কথা শুনে সন্দেহ হচ্ছে, সেই লোকটাই কি ছোটমামাকে ওই চিঠিটা লিখেছে?

আপাতদৃষ্টে তা-ই মনে হচ্ছে। তবে আমি এখনও নিশ্চিত নই।

বনশ্রীর ডাক শোনা গেল, তিতি! তিতি!

সুদেষ্ণা বলল, আমি এখন যাই কর্নেল। বউদিকে সাহায্য করি গে। ভানুমতী যা নোংরা, একটু লক্ষ্য না রাখলেই কেলেঙ্কারি করে ফেলবে। দরজার। দিকে এগিয়ে সে ঘুরে দাঁড়াল। আপনি আরেকবার কফি খাবেন নিশ্চয়?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, খাওয়ার ইচ্ছে হলে তোমাকে জানাব।

সুদেষ্ণা চলে যাওয়ার পর আমি বললাম, সুদেষ্ণাকে আপনি পুলিশের গাড়ি সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। আপনার কি সন্দেহ জেগেছে ভরদ্বাজ এবং সিনহা পুলিশের গাড়িতে আসেননি?

কর্নেল বললেন, কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

কেন?

তুমি একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে। পুলিশের জিপে সেনসায়েবের বন্ধুরা আসবার পর উড়ো চিঠি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তারপর সেনসায়েব দুজনকে সঙ্গে নিয়ে নিজের গাড়িতে বেরিয়ে গেছেন। তখনও তন্ময় এবং সৌমিত্র ফেরেনি। সেনসায়েব যদি লাখানপুর যান, পথে তন্ময়দের সঙ্গে অবশ্যই দেখা হওয়ার কথা। কিন্তু তন্ময় ও সৌমিত্রের সঙ্গে ওঁদের দেখা হয়নি। তার মানে, সেনসায়েব বন্ধুদের নিয়ে অন্য কোথাও গেছেন।

আমি অবাক হয়ে বললাম, তা-ই তো!

তা ছাড়া লাখানপুরের রাস্তায় বেলা তিনটের পর বাস বন্ধ হয়ে যায়। দুর্গম। পাহাড়ি রাস্তা। বুনো হাতির উৎপাত আছে। আজ সকালে বাসস্ট্যান্ডে খবর। নিয়েছি। তোমাকে সে-কথা বলেছিও। বাস-অফিসের লোকটা বলছিল, ওই রাস্তায় ডাকাতরাও মাঝে মাঝে রাহাজানি করে। তাই কেউ পারতপক্ষে সন্ধ্যার পর ওই রাস্তায় গাড়ি নিয়ে যায় না।

তা হলে সেনসায়েব কোন রাস্তায় গেলেন যে তন্ময়দের সঙ্গে দেখা হলো না?

কান্দ্রা বাজারের নিচে বাঁ দিকে লাখানপুরের রাস্তা। ডান দিকে গেছে খনি এরিয়ায় যাওয়ার রাস্তা। কাজেই ধরে নেওয়া যায়, সেনসায়েব খনি এরিয়ায় গেছেন।

কিন্তু আমি জানি, খনি এরিয়ার ভেতর বাইরের লোককে বিনা অনুমতিতে ঢুকতে দেওয়া হয় না।

হয় না। তবে সেনসায়েবরা যদি চালু খনি এলাকার বাইরে–ধরো, পোড়োখনিগুলোর কাছাকাছি কোথাও যান, কেউ বাধা দেবার জন্য পাহারা দিচ্ছে না। একসময় তার ঠাকুর্দার কয়েকটা খনি ছিল। কাজেই ওই এলাকা তার নখদর্পণে।

একটু পরে বললাম, আচ্ছা কর্নেল, এমনও তো হতে পারে, সেনসায়েবের সঙ্গে তার ছেলের রাস্তায় দেখা হয়েছে এবং তিনি।

কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন, এ নিয়ে জল্পনা করে লাভ নেই জয়ন্ত! রাজেনবাবুর মতো মগজ গুলিয়ে যাবে।

মগজ অলরেডি গুলিয়ে গেছে। এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচি।

কর্নেল হঠাৎ খুব আস্তে বললেন, আশা করছি, কাল দুপুরের মধ্যে আমরা পালাতে পারব। পালানোর কথা বলছি একেবারে সত্যিকার অর্থে।

ওঁর মুখের দিকে তাকালাম। মিটিমিটি হাসছেন কর্নেল। বললাম, তার মানে, আমরা এখানে নিরাপদ নই?

সম্পূর্ণ নিরাপদ। আমরা তো রুহা প্রপাতের কাছে দাঁড়িয়ে নেই যে ওপর থেকে পাথর খসে পড়বে।

তাহলে পালানোর কথা বলছেন যে?

বলছি। কারণ আমরা বেড়াতে যাচ্ছি বলে বেরোব। কিন্তু আর এ বাড়িতে ফিরব না।

কর্নেলের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম। কী বলব খুঁজে পেলাম না।