৬. মৃত্যুর মুখ থেকে ঘোষাল ফিরল

মৃত্যুর মুখ থেকে ঘোষাল ফিরল। ফিরত না, যদি না শবর ঝাঁপিয়ে পড়ত ডাক্তার এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ওপর। সামান্য অবহেলা, সামান্য দেখভাল এবং সময়োচিত ব্যবস্থার নড়চড় হলেই মারা পড়ত ঘোষাল। শবর সেটা হতে দেয়নি।

তিনদিন বাদে ঘোষালের বেডের পাশে সকালে দাঁড়িয়ে ছিল শবর।

কীরকম আছেন?

দুর্বল গলায় নিস্তেজ ঘোষাল বলল, বাঁচাটা বাঁচার মতো না হলে বেঁচে কী লাভ?

বেঁচে থাকাটাই লাভ। আপনি মরলে যে আরও দুটি প্রাণী ভেসে যায়।

সে আর কী করা যাবে। আমি বেঁচে থাকতেও কি যাবে না?

ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্তোত্বিষ্ট পরন্তপঃ।

ঘোষাল মৃদু একটু হাসার চেষ্টা করল, গীতা?

নয় কেন? আমি রোজ পড়ি।

তাতে জোর পান?

পাই। খুব পাই। গীতা আমার চোখ খুলে দেয়, মাথা থেকে অনেক চিন্তার ভূত তাড়িয়ে দেয়।

আগে পড়েছি কয়েকবার। আজকাল আর হয়ে ওঠে না।

রোজ গীতা পড়ুন ঘোষালবাবু, ইট উইল হেল্প। হতো বা প্রান্স্যসি স্বর্গং জিহ্বা বা ভোক্ষসে মহীম। তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়।

যুদ্ধ! আমার যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে মিস্টার দাশগুপ্ত। আই অ্যাম এ রুইনড ম্যান।

ওরকম মাঝে মাঝে মনে হয়। আপনি রুইনড ম্যান নন, আপনি উইক ম্যান। আর সেটার কারণ আপনার অত্যধিক পুত্রস্নেহ।

পুত্রস্নেহ কি দুর্বলতা?

না। পুত্রস্নেহ কার নেই? কিন্তু তা থেকে অকারণ উদ্বেগ, অশান্তি টেনশন হলে বুঝতে হবে আপনি শক্ত মানুষ নন, অবসেসড।

ওরা যদি আমার ছেলেকে মেরে ফেলত? কী হত তা হলে বলুন। তার চেয়ে চাকরি যাওয়া ভাল।

আপনি কেসটা ঝেড়ে ফেললেন, আপনার ছেলেও বেঁচে গেল। কেমন তো! এবার বলুন, এইসব ক্রিমিন্যালরা যদি টিকে থাকে তা হলে আরও কতজনের ছেলে বিপন্ন হবে। আপনার পর যে-অফিসার কেসটা হাতে পাবে তারও হয়তো ছেলেমেয়ে আছে, তাকেও ওরা হয়তো ওরকম হুমকি দেবে। তার মানে কি আমরা সবাই একে একে হাত গুটিয়ে নেব?

আপনি লজিকের কথা বলছেন। লজিক আমি মানছি, কিন্তু আমি এ কাজের অযোগ্য। আপনি ঠিকই বলেছেন, আমি দুর্বল।

ঘোষালবাবু, বিপদ কি একবার আসে? কিছু মনে করবেন না, আপনি আজ নয় চাকরি ছাড়লেন, কিন্তু কাল যদি আর একটা গ্যাং আপনার ছেলেকে কিডন্যাপ করে মুক্তিপণ চায়

তখন কী করবেন?

অ্যাঁ! বলে বড় বড় চোখ করে ঘোষাল তাকাল।

এরকম তো হতে পারে!

পারেই তো। আর এইসব টেনশনের জন্যই তো আমি মরতে চেয়েছিলাম। বেঁচে থাকার যোগ্যতাই আমার নেই!

ছেলের কথা ভেবেই না হয় বেঁচে থাকুন। আপনি না বাঁচলে তার যে কোনও প্রোটেকশন থাকবে না।

না থাকুক। তখন তো আমিও থাকব না, টেনশনও থাকবে না।

তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে তা জানেন?

কী?

তার মানে আপনি একজন সেলফিস ম্যান। ছেলেকে নয়, আপনি ভালবাসেন নিজেকে। নিজের টেনশন, নিজের উদ্বেগ, নিজের দুর্বলতা থেকে মুক্তি চান বলেই আপনি এসব করছেন। নইলে মাত্র আট বছরের একটা ছেলেকে পিতৃহীন করে রেখে যেতে আপনার মনুষ্যত্বে বাধত।

প্লিজ, মিস্টার দাশগুপ্ত। এসব কথা আমি এখন সহ্য করতে পারছি না।

ও কে। আমি আপনাকে আর ডিস্টার্ব করব না। শুধু জানিয়ে যাই, ওই কেসটা কর্তৃপক্ষ সুধাংশু দাসকে দিয়েছে। সুধাংশুরও একটি আট বছরের ছেলে আর দু’বছরের মেয়ে আছে।

ও!

আরও একটা কথা। আপনার রেজিগনেশন লেটারটা আমি সরিয়ে নিয়েছি। আপনি আপাতত অফিসে পেপারওয়ার্ক করবেন, ফিন্ডে যেতে হবে না। বলে-কয়ে এটুকু আমি করতে পারব। ঠিক আছে?

ঘোষাল কোনও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল না। ভাবলেশহীন চোখে চেয়ে থেকে বলল, একটা গীতা দেবেন?

সঙ্গে তো নেই। বিকেলে পাঠিয়ে দিতে পারি।

ঘোষাল গভীর ক্লান্তিতে চোখ বুজল।

ভয়! ভয় নিয়েই ভাবছে শবর ক’দিন ধরে। এখানকার মানুষ কেন এত ভয়-ভীতির শিকার? পৃথিবীতে এখন সুস্পষ্ট দুটো দল, ভীত আর ভীতিপ্রদ।

গোপালকে তার দ্বিতীয় দলের বলেই মনে হল, যখন তাকে বেলা এগারোটায় তার ঢাকুরিয়ার বাড়িতে মুখোমুখি পেল শবর। আজ রবিবার। গোপাল তাই বাড়িতেই ছিল।

আপনি কী করেন?

আমার ফ্রিজ আর এয়ার কন্ডিশনার সারাইয়ের একটা ব্যাবসা আছে ল্যান্সডাউনে।

এ বাড়ি কি আপনার নিজের?

না মশাই, ভাড়া বাড়ি।

নিজস্ব কিছু নেই?

নেই বলি কী করে? হালতুর দিকে ইন্টিরিয়রে দু’কাঠা জমি কিনেছি। কাকা তো আমাদের পথে বসিয়েই গেছে, জানেন তো!

খানিকটা জানি।

আমাদের এজমালি বাড়ি, কাকা নিজের নামে করেছিল। কথা ছিল পরে সকলের নামেই দলিল হবে। টালবাহানা করছিলেনই, শেষে আড়াই লাখ টাকার ফ্যাকড়া তুলে আমাদের অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করলেন। কী ফল হল বলুন। নিজেই তো টেসে গেলেন।

মামলা করেছিলেন আপনারা?

করে কী লাভ? ওঁর নামে দলিল। মামলা করলে উকিলের পকেট ভরত, আর কিছু হত না।

ঝগড়াঝাটি হয়েছিল?

হবে না? একটা জোচ্চোর লোক সব গাপ করে নেবে, আমরা চুপ করে থাকব?

আপনি কি কখনও ওঁকে খুনের হুমকি দিয়েছিলেন?

দেখুন মশাই, ওরকম পরিস্থিতি হলে হুমকি আপনিও দিতেন, প্রমোটারকে যখন কাকা বাড়িটা দিয়ে দিলেন তখন আমরা গিয়ে বললাম, কাকা, আমাদের তো পথেই বসালেন, এবার প্রমোটারকে অন্তত বলুন যাতে আমাদের দুটো ফ্ল্যাট দেয়। উনি তাতে এমন চেঁচামেচি করতে লাগলেন যেন বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। কার রক্ত ঠান্ডা থাকে বলুন! আমরা আবার বরিশালের বাঙাল, রক্ত একটু গরম। আমি তখন বলেছিলাম, আপনার লাশ নামানোর ব্যবস্থা করছি, দাঁড়ান।

উনি তখন কী করলেন?

উনি একটা লাঠি নিয়ে তেড়ে এসেছিলেন। সঙ্গে অকথ্য গালাগাল। হুমকিতে টলার পাত্র তো ছিলেন না।

উনি যেদিন মারা যান সেদিন আপনি ওঁর ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন।

যাব না কেন? শত হলেও কাকা তো। বাবাকেও বঞ্চিত করেছিলেন, তবু বাবা কেঁদেকেটে একশা।

আপনারা কি পুরনো দাবি আবার তুলবেন?

তুলে খুব একটা লাভ হবে না। তবে কাকিমা লোক ভাল। উনি আমাকে দেখা করতে বলেছেন। হয়তো কিছু কমপেনসেট করতে চান।

তেরো তারিখে–অর্থাৎ বাসুদেববাবু যেদিন মারা যান সেদিন সন্ধে সাড়ে ছ’টা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে আপনি কোথায় ছিলেন?

গোপাল একটু হাঁ করে চেয়ে থেকে বলে, কেন বলুন তো।

আপনি কি মনে করতে পারবেন?

সন্ধেবেলা আমি তো দোকানেই থাকি। কাজকর্ম থাকে। অনেক রাত অবধি দোকানেই থাকতে হয়।

সেদিনও ছিলেন?

হ্যাঁ।

ঠিক মনে আছে?

আছে।

আপনার দোকানে কতজন কমর্চারী?

তিনজন।

তারাও সেদিন সন্ধেবেলা ছিল?

ওরা ছ’টার মধ্যে চলে যায়। বেশি রাত পর্যন্ত আমি একাই থাকি।

আপনি কি ড্রিঙ্ক করেন? গোপাল হাসল, আমরা মিস্ত্রি মানুষ, খাটতে-পিটতে হয়।

একটু-আধটু খাই।

সেদিন ক’টা অবধি দোকানে ছিলেন?

এগারোটা হবে।

আপনার গাড়ি আছে?

স্কুটার আছে।

আপনি কি জানেন যে, আপনার কাকার মৃত্যুটা একটু অস্বাভাবিক?

জানি। লিফট খারাপ ছিল বলে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে হার্ট অ্যাটাক হয়।

ঠিক কথা। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেদিন লিফট খারাপ ছিল না।

তা হলে?

কেউ ওটা সাজিয়েছিল যাতে বাসুদেববাবুকে বাধ্য হয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়।

গোপাল স্পষ্টতই অস্বস্তিতে পড়ে বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। তার মানে কি কাকাকে খুন করা হয়েছে?

সেরকমই সন্দেহ।

সর্বনাশ। আপনি কি সেজন্যই জেরা করছেন?

হ্যাঁ। তবে ঘাবড়াবেন না। এটা রুটিন প্রসিডিওর।

গোপাল ভয় পেল কিনা বোঝা গেল না। তবু বলল, লাশ নামানোর হুমকিটার কথা ভেবেই কি সন্দেহ করছেন আমাকে? ওরকম হুমকি তো লোকে রেগে গেলে কতই দেয়।

সেটা আমরা জানি। আর একটা প্রশ্ন।

বলুন।

আপনার কাকার একটি অবৈধ ছেলে আছে, জানেন?

জানি। আরও থাকতে পারে।

তার মানে?

কাকা উওম্যানাইজার ছিলেন। বহু মহিলার সঙ্গেই সম্পর্ক ছিল। সুতরাং আরও দু-একটা থাকা বিচিত্র নয়।

আপনি কি এরকম আর কোনও ছেলেমেয়ের কথা জানেন?

না, আন্দাজে বলছি।

আন্দাজটা উহ্য রাখবেন। একজনের কথা তো জানেন।

হ্যাঁ। অজাতশত্রু বসু। কাকা ঢাকুরিয়ার বাড়িতে তার নামে একটা ফ্ল্যাট দিয়েছেন। শুনছি একটা মোটা টাকার পলিসির নমিনি করে গেছেন।

ছেলেটিকে আপনি চেনেন?

না মশাই। খেয়েদেয়ে কাজ নেই, কাকার অবৈধ ছেলের খোঁজ করব।

আপনি কি শুনেছেন যে, আপনার কাকার শ্রাদ্ধ তার ছেলেরা করতে রাজি হচ্ছে না?

তাও জানি। আমি পরশুদিনই তো কাকিমার কাছে গিয়েছিলাম। উনি খুব কান্নাকাটি করলেন। আমরা ভাবছি, অর্ক আর বুদ্ধ যদি না করে তা হলে আমি কালীঘাটে গিয়ে করে আসব। আমার বাবা আমাকে বলেছেন, শ্রাদ্ধ না করাটা ঠিক হচ্ছে না।

বাসুদেববাবুর সঙ্গে আপনার শেষ কবে দেখা হয়েছিল?

মাস তিন-চার আগে বোধহয়।

তখন কী কথাবার্তা হয়েছিল?

গোপাল হাসল, কী আর হবে! কাকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক তো মধুর ছিল না।

আপনার দোকানের কর্মচারীরা কতদিনের পুরনো?

কেন বলুন তো!

বলুন না!

বেশ পুরনো। বছর দশেক তো হবেই।

তারা বিশ্বাসী?

হ্যাঁ।

আপনার আর্থিক অবস্থা কীরকম?

মোটামুটি। চলে যায় আর কী।

কাকার মৃত্যুতে আপনি কোনওভাবেই লাভবান হয়েছেন কি?

না মশাই, আর কোনও আশা নেই।

এই যে বললেন, কাকিমা কমপেনসেট করতে চান। কাকার মৃত্যুতে তো সেটাই আপনার লাভ।

গোপাল উদাস গলায় বলল, কাকিমা আর কতই বা দেবে? হয়তো বিবেকের দংশন এড়াতে পাঁচ-দশ হাজার অফার করবে। তাও যদি অর্ক আর বুদ্ধ দিতে দেয়। আমি অবশ্য ঠিক করেছি, পাঁচ-দশ হাজার দিতে চাইলে নেব না। ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করব কেন মশাই? ঢাকুরিয়ার বাড়ির ভ্যালুয়েশন জানেন? অন্তত ত্রিশ লাখ টাকা। বাবারা তিন ভাই। ভাগ করলে পারহেড দশ লাখ করে পড়ে।

বুঝেছি।

আমাদের জ্বালাটাও বুঝবার চেষ্টা করুন।

শবর একটু হেসে উঠে পড়ল। বলল, আবার হয়তো দেখা হবে।

অজাতশত্রুকে পাওয়া গেল তার জিম-এ হাজরা রোডে তাদের ফ্ল্যাটের কাছাকাছিই বেশ ঝা চকচকে আধুনিক মাল্টিপল জিম। কালো শর্টস পরা গায়ে সাদা তোয়ালে জড়ানো অজাতশত্রু একটি ফুটফুটে কিশোরীর পাশে বসে কোল্ড ড্রিঙ্কস খাচ্ছিল। মুখে ঘাম।

কিশোরীটিকেও লক্ষ করল শবর। তারও পরনে শর্টস, গায়ে একটা ঢিলা কামিজ। মাথায় থোপা থোপা কোকড়া চুল বয়কাট করা। ছিপছিপে, নাতিদীর্ঘ, তেজি চেহারা।

শবর বিনা ভূমিকায় অজাতশত্রুর সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

আমি আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

ছেলেটা অবাক হয়ে চাইল। বলল, আমার সঙ্গে!

হ্যাঁ। এখানে নয়, বাইরে যেতে হবে।

কেন? কী দরকার?

শবর পকেট থেকে আইডেন্টিটি কার্ডটা বের করে তার চোখের সামনে মেলে ধরে চাপা স্বরে বলল, লালবাজার।

অজাতশত্রুর মুখটা একটু ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তবে সে উঠে পড়ল। মেয়েটার দিকে চেয়ে বলল, ও কে, বাই…

বাই।

শবর বলল, পোশাকটা পালটে আসুন। আমি অপেক্ষা করছি।

পাঁচ মিনিটের মধ্যেই অজাতশত্রু বেরিয়ে এল। গায়ে টি-শার্ট পরনে ট্রাউজার্স, কাঁধে ব্যাগ।

চলুন।

জিপে ড্রাইভারের সিটে বসে শবর অজাতশত্রুকে পাশে বসাল। বলল, কথা বলার পক্ষে এটাই বোধহয় ভাল জায়গা। নাকি আপনাদের ফ্ল্যাটেই যেতে চান?

অজাতশত্রু গম্ভীর মুখে বলল, এটাই ভাল।

ভণিতা না করেই জিজ্ঞেস করছি, আপনি কি আপনার পিতৃপরিচয় জানেন?

অজাতশত্ৰু কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, এখন জানি।

কতদিন আগে জানতে পারেন?

গতকাল। মা আমাকে বলেছে।

জেনে আপনার রি-অ্যাকশন কী?

খারাপ লেগেছে।

আপনি আপনার মায়ের ওপর রেগে যাননি?

না, তবে দুঃখ পেয়েছি। লজ্জা হয়েছে।

শঙ্করবাবুর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কীরকম?

ভালই।

ভাল বলতে?

সো সো। এসব ব্যক্তিগত প্রশ্ন কেন করছেন?

ব্যক্তিগত প্রশ্নও মাঝে মাঝে করতে হয়। আপনি বাসুদেব সেনগুপ্তকে চিনতেন?

হ্যাঁ। আমি ছেলেবেলায় ওঁকে দেখেছি।

উনি আপনাদের বাড়িতে আসতেন?

হ্যাঁ।

তখন আপনার কিছু মনে হত না?

দশ বারো বছর আগেকার কথা, ভাল মনে নেই।

দশ-বারো বছর উনি কি আর আসেননি?

না!

এই দশ বারো বছরের মধ্যে বাসুদেবের সঙ্গে আপনার কখনও দেখা হয়নি?

কী করে হবে? বললাম তো, উনি আসতেন না।

 গতকাল যখন শুনলেন যে, উনিই আপনার বাবা তখন কি ওঁর ওপর আপনার রাগ বা ঘেন্না হল?

অজু কিছুক্ষণ পাথরের মতো বসে থেকে বলল, একটা মিক্সড ফিলিং। ঠিক বোঝাতে পারব না। মনে হচ্ছিল যেন আমার আইডেন্টিটিটাই হারিয়ে যাচ্ছে। না রাগ নয়, হেপলেসনেস।

আপনি কি জানেন যে, বাসুদেব সেনগুপ্ত আপনার জন্য একটা ফ্ল্যাট এবং পাঁচ লাখ টাকার একটা পলিসি রেখে গেছেন!

কাল মায়ের কাছে শুনলাম।

শুনে কীরকম রি-অ্যাকশন হল?

অজু একটা করুণ হাসি হেসে বলল, এসব তো কমপেনসেশন। কিন্তু আমার হেপলেসনেসটা তাতে কমছে না।

যদিও আপনি তখন ছোট ছিলেন, তবু বলুন বাসুদেব সেনগুপ্তকে আপনার কেমন লোক বলে মনে হত?

একটু ডিস্টার্কিং লাগত। উনি প্রায়ই এসে বিকেলের দিকে বসে থাকতেন। বাইরের কোনও লোক রোজ এলে কি ভাল লাগে?

ওঁর সঙ্গে আপনার কি কথাবার্তা হত?

না। উনি ’র সঙ্গে কথা বলতেন।

আপনার সঙ্গে কখনও বলতেন না?

হয়তো কখনও এক-আধটা বলেছেন, কিন্তু এটা মনে আছে যে, আমি ওঁদের কাছে বড় একটা যেতাম না।

লোকটা সম্পর্কে আপনার কখনও কোনও সন্দেহ হয়নি?

সন্দেহ নয়, একটু বিরক্ত বোধ করতাম হয়তো।

আপনি যখন কাল শুনলেন যে বাসুদেব সেনগুপ্তই আপনার বাবা তখন কি মায়ের ওপর আপনার কোনও রিপালশন হল?

কেন হবে! আজকাল একস্ট্রা ম্যারিটাল রিলেশন তো কোনও ব্যাপার নয়।

নয়?

অজু একটু লজ্জা পেয়ে বলে, ব্যাপার ঠিকই, তবে এরকম তো হতেই পারে। হি ওয়াজ এ স্পোটসম্যান অ্যান্ড পারসোনেবল অলসো।

আপনি আপনার মাকে তা হলে ক্ষমা করেছেন?

মাকে আমি খুব ভালবাসি।

আর শঙ্করবাবুকে?

উনি একজন চমৎকার ভদ্রলোক।

বাবা হিসেবে?

বাবা হিসেবেও খারাপ নন।

তেরো তারিখে সন্ধে সাড়ে ছটা থেকে সাড়ে সাতটা আপনি কোথায় ছিলেন?

প্রশ্নটা ভাল করে শেষ হওয়ার আগেই চটজলদি জবাব দিয়ে ফেলল অজু, আমার এক বন্ধুর বাড়িতে একটা স্পোর্টস প্রোগ্রাম দেখছিলাম ভিডিয়ো-তে।

এত দ্রুত জবাবে একটু অবাক শবর বলল, বন্ধুটি কে?

মাণ্ডবী ঘোষ। উডবার্ন পার্কে থাকে। ওই যে মেয়েটির সঙ্গে আমি একটু আগে কথা বলছিলাম।

ওদের বাড়িতে আর কে কে থাকে?

মা-বাবা।

আর কেউ নয়?

না।

ওইদিন ওর মা-বাবা বাড়িতে ছিলেন?

না। ওঁরা বেরিয়েছিলেন।

তা হলে বাড়িতে ছিলেন শুধু আপনি আর মাণ্ডবী?

হ্যাঁ। উই আর চামস।

বাড়িতে কোথাও কাজের লোকটোক নেই?

আছে। তবে তারা সব ঠিকে। সন্ধের আগেই চলে যায়।

কখন গিয়েছিলেন?

ছ’টা নাগাদ।

ক’টা অবধি ছিলেন?

আটটা।

আপনাকে কেউ ও-বাড়িতে ঢুকতে বা বেরোতে দেখেছে?

তা কী করে বলব?

বাড়ি না ফ্ল্যাট?

বাড়িই বলতে পারেন। দোতলা একটা বাড়ির গ্রাউন্ড ফ্লোরটা নিয়ে ওরা থাকে।

দোতলায় কারা আছে?

সাম সিন্ধি পিপল।

বাড়িটা কি মাণ্ডবীদের?

না। ওরা ভাড়া থাকে। অনেকদিনের পুরনো ভাড়াটে।

মাণ্ডবীর ভাইবোন নেই?

না। শি ইজ অ্যান ওনলি চাইল্ড।

শবর একটু হাসল। তারপর বলল, আপনি কি জানেন বাসুদেববাবু কীভাবে মারা গেছেন?

শুনেছি।

কী শুনেছেন?

মৃত্যুটা স্বাভাবিকভাবে হয়নি।

হ্যাঁ। ওঁর হার্ট খারাপ ছিল। লিফট খারাপ বলে উনি সিঁড়ি ভেঙে উঠছিলেন।

মা সব বলেছে। ইউ আর আফটার দি ম্যান।

ম্যান। উওম্যান নয়?

ছেলেটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, মেয়েরা কি ওসব করে?

কে জানে! আমার পুলিশি অভিজ্ঞতা অন্য কথা বলে।

হতে পারে। মে বি এ উওম্যান।

আপনি হোটেল ম্যানেজমেন্ট শিখছেন?

হ্যাঁ।

প্রসপেক্ট কীরকম?

বুঝতে পারছি না। সব লাইনেই তো ভিড়।

তা হলে পড়ছেন কেন?

কী করব? একটা কিছু করার চেষ্টা তো করতে হবে।

আপনার কি অন্য কিছু করার ইচ্ছে?

ইচ্ছে থাকলেই বা লাভ কী?

কেন, আপনি তো একটা বেশ বড় ফ্ল্যাট আর পাঁচ লাখ টাকার মালিক।

সেটা তো আগে জানতাম না।

জানতেন না?

না। কী করে জানব? ইটস অ্যান আউটরেজিয়াস কোশ্চেন।

ফরগেট ইট। আপনি তো খেলাধুলো করেন বলে শুনেছি।

করি।

কোন ক্লাব?

স্পোর্টিং ইউনাইটেড।

অজিত ঘোষ বলে কাউকে চেনেন?

না। সে কে?

ঢাকুরিয়ার যে বাড়িতে আপনার নামে বাসুদেব সেনগুপ্ত একটা ফ্ল্যাট রেখে গেছেন সেই বাড়ির প্রমোটার।

না, চিনি না। ফ্ল্যাটের কথা তো কালই জানলাম।

অজিতবাবু কিন্তু অন্য কথা বলেন।

তার মানে?

অজিতবাবু বলেছেন আপনি সেই ফ্ল্যাটের কনস্ট্রাকশন দেখতে গত এক বছরে বেশ কয়েকবার সেখানে গেছেন। ইন ফ্যাক্ট, আপনার ডিরেকশন অনুযায়ী ফ্ল্যাটের ভিতরকার কিছু অল্টারেশনও হয়েছে।

অজু বজ্রাহতের মত কিছুক্ষণ বসে রইল। জবাব দিতে পারল না।

অজিতবাবুর সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আপনার বায়োলজিক্যাল বাবা বাসুদেব সেনগুপ্ত।

অজু এবারও চুপ। মুখটা নোয়ানো।

শবর একটা শ্বাস ফেলে বলল, এসব লুকিয়ে কোনও লাভ আছে কি অজাতশত্রুবাবু?

অজু ধীরে মুখটা তুলে শবরের দিকে ফিরে বলল, আমাকে ক্ষমা করবেন। লজ্জা আর সংকোচের বশে আমি কথাটা গোপন করছিলাম।

নাউ, আউট উইথ দি ফ্যাক্টস, প্লিজ।

আমি যখন স্কুলে এইট-নাইনে পড়ি তখনই একদিন উনি আমার সঙ্গে স্কুলের বাইরে দেখা করেন। আমি ওঁকে চিনতাম, কিন্তু বাবা বলে জানতাম না। উনি সেদিন আমাকে একটা ভাল রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে খাওয়ালেন। তারপর আমাকে একটু রেখে ঢেকে ওঁর সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা জানালেন। উনি বলেছিলেন, আমি ওঁরই ছেলে, তবে আমাকে উনি অনেকটা দত্তক হিসেবে শঙ্কর বসু ও রীণা বসুর কাছে দিয়েছেন।

কথাটা আপনি বিশ্বাস করেছিলেন?

না। কারণ ছেলেবেলা থেকেই আমার সন্দেহ ছিল, উনি আমার মায়ের সঙ্গে ইনভলভজ্ঞ। আরও আশ্চর্যের কথা, উনি বলার আগে থেকেই কিন্তু আমার প্রায়ই এ সন্দেহও হয়েছে। যে, আমি ওঁরই সন্তান।

কীভাবে সন্দেহটা হল?

আমার বাবা অর্থাৎ শঙ্কর বসুর আমার প্রতি আচরণ থেকে। তা ছাড়া আমি ওঁদের কথাবার্তা কিছু কিছু ওভারহিয়ারও করতাম। সোজা কথা ব্যাপারটা আমার কাছে গোপন ছিল না। তাই উনি যখন কথাটা বললেন তখন আমি একটুও অবাক হইনি।

তারপর কী হল?

উনি মাঝেমধ্যেই আমার সঙ্গে দেখা করতেন। আমি খেলাধুলোয় ভাল বলে উনি নানাভাবে আমাকে ইন্সপায়ার করেছেন। ক্লাবে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারেও সাহায্য করেছেন।

যতদূর শুনেছি উনি ঠিক এরকম স্নেহপ্রবণ মানুষ ছিলেন না। নিজের পুত্র-কন্যাদের প্রতি ওঁর আচরণ ছিল জঘন্য। কাজেই আপনার প্রতি উনি এত নরম হলেন কেন?

তা ঠিক বলতে পারব না। উনি যে রাগী আর মেজাজি মানুষ ছিলেন তা আমি খানিকটা জানি। মনে হয় আমার পরিবারে আমি খানিকটা আনওয়ান্টেড বলেই উনি একটু সিমপ্যাথেটিক হয়ে পড়েছিলেন। বিশেষ করে আমার বাবা শঙ্কর বসু আমাকে একদমই পছন্দ করেন না। তাই আমি ছেলেবেলা থেকেই পারতপক্ষে ওঁর মুখোমুখি হই না। এটা উনি জানতেন।

শবর চিন্তিতভাবে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, হতেও পারে।

উনিই আমাকে বলেছিলেন, ওঁর একটা পাঁচ লাখ টাকার পলিসি আছে যার নমিনি আমি।

কিন্তু উনি পলিসিটা আপনার বা আপনার মা’র হাতে না দিয়ে সেটা নিজের স্ত্রীর কাছে জমা রাখলেন কেন?

মাথা নেড়ে অজু বলল, তা জানি না। তবে আরও দু’বছর পর পলিসিটা ম্যাচিওর করত। উনি এত তাড়াতাড়ি মারা যাবেন বলে হয়তো ভাবেননি।

এই পলিসিটা উদ্ধার করার জন্য আপনি কিছু করেননি?

না। তবে আমার মা হয়তো শিখাদেবীর কাছে যাবে।

আপনার কথা কি শিখাদেবী জানতেন?

হ্যাঁ।

কী করে বুঝলেন?

বাবা–অর্থাৎ বাসুদেব সেনগুপ্তই আমাকে সেকথা বলেছিলেন।

আপনি কি বাসুদেববাবুকে বাবা বলেই ডাকতেন?

অজু হাসল, ডাকে কী আসে যায়?

জাস্ট কৌতূহল।

না। উনিও চাননি সেটা।

তবে কী বলে ডাকতেন?

ডাকার দরকার হত না। মুখোমুখি কথা হত আমাদের। তাও মাঝে মাঝে। না, ওঁকে বাবা বলে ডাকার কোনও প্রয়োজন হয়নি।

বাবা বলে ভাবতেন কি?

তা ভাবতাম। যা সত্য তাকে অস্বীকার করে লাভ কী? তা ছাড়া উনি তো আমার বেনিফ্যাক্টর ছিলেন।

শবর অন্যমনস্কভাবে বলল, ওঁর মৃত্যুতে আপনি প্রচুর লাভবান হয়েছেন।