২১.
মিসেস ওয়েদারবি ডাকঘর থেকে অস্বাভাবিক দ্রুতবেগে বাড়ি ফিরে এলেন। নিজেকে উনি যতটা অসুস্থ বলে দাবী করেন সেই অনুপাতে ওঁর তৎপরতা অস্বাভাবিক বেশি এখন। কিন্তু বাড়ির দরজায় পা দেওয়া মাত্র হাঁপানো শুরু হল ওঁর এবং সোজা এসে বসবার ঘরে সোফায় গা এলিয়ে দিলেন। যে ঘন্টাটা পরিচারিকাকে ডাকার জন্য, সেটা ছিল হাতের কাছেই। জোরে জোরে সেটা উনি বাজালেন। কিন্তু এল না কেউ। অধৈর্য হাতে মিসেস ওয়েদারবি একটানা ঘন্টা বাজাতে শুরু করলেন। মড উইলিয়ামস এবার ঘরে ঢুকল। সে পরেছিল ফুলকাটা ছাপের একটা ঢোলা জামা। হাতে ঝাড়ন।
-মাদাম আমায় ডাকছিলেন?
–আমি দু-দুবার ঘন্টা বাজিয়েছি। ঘন্টাটা যখন বাজাই তখন এটুকু আশা আমি করি যে, কেউ না কেউ সঙ্গে সঙ্গে আসবে। সাংঘাতিক অসুস্থ হয়ে পড়তে পারতাম আমি।
–অত্যন্ত দুঃখিত আমি মাদাম। একটু ব্যস্ত ছিলাম ওপরে।
–জানি, ওপরে তুমি ছিলে। আমার ঘরে। তোমার পায়ের শব্দ আমি শুনতে পেয়েছি। সব দেরাজগুলো টেনে টেনে তুমি খুলে দেখছিলে। কেন যে তা জানেন ঈশ্বরই, জিনিসপত্র সব আমার ঘাঁটাঘাঁটি করা নিশ্চয়ই তোমার কাজ নয়?
-মাদাম এ সব আমি লুকিয়ে করছিলাম। ছড়ানো ছিটানো জিনিসগুলো আপনার গুছিয়ে রাখছিলাম।
বাজে বোকো না। তোমাদের মত প্রতিটি কাজের লোকের এরকম বদভ্যাস আছে। আমি বরদাস্ত করব না এসব। ভীষণ শরীরটা খারাপ লাগছে আমার। বাড়িতে কি ডীডার আছে?
-কুকুটাকে নিয়ে উনি একটু হাঁটতে বেরিয়েছেন।
-যত্তো সব মূখের ব্যাপার। খেয়াল রাখা ওর উচিত যে, আমার ওকে দরকার হতে পারে। একটা ডিম দুধে গুলে তাতে একটু ব্র্যাণ্ডি দিয়ে নিয়ে এস। খাবার ঘরের পাশের দিকের তাকে একটা ব্র্যাণ্ডির বোতল আছে দেখ।
-কিন্তু ডিম মাত্র তিনটে আছে, কাল লাগবে প্রাতঃরাশে।
–একজন কেউ ডিম খাবে না কাল। নাও, তাড়াতাড়ি কর। হাঁ করে ওখানে দাঁড়িয়ে আমায় কি দেখছ? তুমি বড় বেশি সাজগোজ কর। এটা ঠিক না।
কুকুরের ডাক শোনা গেল হলঘরে। কুকুর নিয়ে ডীডার বসবার ঘরে ঢুকল। ঘর থেকে মড বেরিয়ে গেল।
ডীডার দ্রুত নিঃশ্বাসে বলল, তোমার গলা শুনলাম আমি। ওকে তুমি কি বলছিলে?
–কিছু না।
–ওকে খুব রাগী রাগী দেখাচ্ছিল।
–শুধু ওকে আমি সামান্য শায়েস্তা করে দিয়েছি। অবাধ্য মেয়ে।
-মামণি, খুব কি বকুনি দেবার দরকার ছিল? আজকাল তোক পাওয়া কি মুশকিলের ব্যাপার জানোই তো। আর ও বেশ রান্না করতে পারে ভালো।
–আর ও যে দুর্ব্যবহার করল আমার সাথে তাতে বুঝি কিছু এসে যায় না? আমি খুব অসুস্থবোধ করছি। বোধহয় হাঁটাটা বড্ড বেশি হয়ে গেল।
-মামণি তোমার বেরোনো উচিত হয়নি। আমায় তো বলনি যে, তুমি বেরোবে?
–ভাবলাম বাইরের হাওয়া লাগলে হয়ত ভালো লাগবে একটু। যা গুমোট ভেতরে। যাকগে, কিছু এসে যায় না। যদি আর পাঁচজনের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়াই, তাহলে কোনো মানেই হয় না বেঁচে থাকার।
–আমাদের কাছে তুমি তো মামণি বোকা নও। তুমি না থাকলে আমি তো মরেই যাব।
-লক্ষ্মী মেয়ে তুমি, সোনা আমার। কিন্তু আমি তো জানি কারণে অকারণে কত উৎপাত করি তোমাকে।
-না না। কক্ষনো মুখে আনবে না এসব বাজে কথা।
মিসেস ওয়েদারবি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চোখ বুজলেন।
–আর কথা বলতে পারছি না আমি, বরং চুপ করে একটু শুয়ে থাকি।
-যাই, তোমার খাবার দেবার জন্য মডকে তাড়া দিই গিয়ে। দৌড়ে ঘর থেকে ডীডার বেরিয়ে গেল। ওর কনুইয়ের ধাক্কায় যাবার সময় পেতলের একটা ছোট্ট মূর্তি টেবিলের ওপর থেকে মেঝেয় গড়িয়ে পড়ল।
–এত তাড়াহুড়ো করে মেয়েটা।
মিসেস ওয়েদারবি মন্তব্য করলেন।
খুলে গেল দরজাটা। ঘরে ঢুকলেন মিঃ ওয়েদারবি।
দু-এক মুহূর্ত অপেক্ষা করার পর চোখ খুললেন মিসেস ওয়েদারবি।
-ওঃ, রজার তুমি।
–কিছুতেই আমি ভেবে পাই না এত গোলমাল হয় কেন? নিশ্চিন্ত হয়ে এ বাড়িতে একটু পড়াশুনো করারও উপায় নেই।
যাওয়ার সময় ডীডার টেবিলে ধাক্কা লেগে শব্দ হয়েছে। ও এইমাত্র কুকুর নিয়ে ফিরল।
পেতলের মূর্তিটাকে মিঃ ওয়েদারবি উঠিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, অকারণে হুড়োহুড়ি না করার মত বয়স নিশ্চয়ই ডীডারের হয়েছে।
–জানোই তো, ও একটু অন্যরকম।
হতে পারে। কিন্তু ওর এই বয়সে আর একটু শান্ত, সুশৃঙ্খল হওয়া দরকার। ও কি ওর কুকুরটাকেও একটু চুপ করাতে পারে না?
–ওকে আমি বলে দেব, রজার। যদি এ বাড়িতে ও থাকতে চায়, তাহলে ইচ্ছে অনিচ্ছেগুলো আমাদের মেনে চলতে হবে। তাছাড়া এ বাড়িটা ওর নিজের বলে মনে করাও বাঞ্ছনীয় নয়। ও যেন না ভাবে যে, ওর যা খুশি তাই করতে পারে এ বাড়িতে।
ডীডার চলে গেলেই হয়ত তুমি খুশি হতে রজার।
অর্ধনিমীলিত চোখে লক্ষ্য করছিলেন ভদ্রমহিলা স্বামীকে।
-না না, তা নয় ও আমাদের সঙ্গে নিশ্চয়ই থাকবে। ওর কেই বা আছে। ওকে আমি বলবখন একটু ভালোভাবে চলাফেরা করতে। এডিথ তুমি কি বেরিয়েছিলে?
–হ্যাঁ। এই ডাকঘরের দিকে একটু গিয়েছিলাম।
নতুন কোনো খবর পেলে, মিসেস আপওয়ার্ডের ব্যাপারে? এখনো পুলিশ জানতে পারেনি কার কীর্তি এটা।
–কোনো কর্মের না পুলিশ। কোনো কারণ পেয়েছে কি খুন করার? কে পাবে ওঁর টাকা পয়সা?
নিশ্চয়ই ওঁর ছেলে। তাহলে এটা বাইরের কোনো ছিঁচকে চোরের কাণ্ড মনে হয়। তোমার বলে রাখা উচিত কাজের মেয়েটিকে যাতে আমাদের বাড়ির সদর দরজাটা বন্ধ করে রাখে সব সময়। বিশেষত সন্ধ্যের পর কেউ এলে চেন লাগিয়ে তবে যেন ছিটকিনি খোলে দরজার। লোক আজকাল বড় নির্মম হয়ে যাচ্ছে।
-যতদূর শুনেছি মিসেস আপওয়ার্ডের কোনো কিছুই খোয়া যায়নি।
–আশ্চর্য।
–মানে মিসেস ম্যাগিনটির বেলায় যা হয়েছিল; সে ধরনের কিছু নয়।
-মিসেস ম্যাগিনটি? ও সেই মহিলাটি। মিসেস আপওয়ার্ডের ওখানে উনি কাজ করতেন।
–এডিথ বোকার মত কথা বোলো না। তাতে হয়েছেটা কি?
চোখ বন্ধ করলেন মিসেস ওয়েদারবি। ঘর থেকে মিঃ ওয়েদারবি বেরিয়ে যেতে উনি একটু আপনমনেই হাসলেন। খানিকক্ষণ বাদে চমকে চোখ খুললেন। মড একটা গ্লাস হাতে ওঁর সামনে দাঁড়িয়ে।
মাদাম, আপনার পানীয়। মডের পরিষ্কার চাঁছাছোলা গলা। নিস্তব্ধ বাড়িতে কথাটার প্রতিধ্বনি শোনা গেল স্পষ্ট। ওর দিকে মিসেস ওয়েদারবি সতর্কভাবে ভাবলেন। কি লম্বা, ঋজু এই মেয়েটি। দীর্ঘদেহী ছায়ামূর্তির মত ও দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে–ওঁর মনে হল এ কথায়। আবার এ কথাটা হঠাৎ কেন মনে এল, ভেবে অবাক হলেন নিজেই।
কনুইতে ভর দিয়ে উঠে গ্লাসটা উনি হাতে নিলেন। মড ধন্যবাদ।
ঘুরে দাঁড়িয়ে মড দরজার দিকে এগিয়ে গেল। মিসেস ওয়েদারবিকে কেন কে জানে, মনে হচ্ছিল একটু চিন্তাক্লিষ্ট বলে।
.
২২.
পোয়ারো ব্রডহিনিতে ফিরলেন একটা ভাড়া গাড়িতে করে। তিনি অসম্ভব ক্লান্তিবোধ করছিলেন অতিরিক্ত চিন্তার চাপে। এত চিন্তা করেও কোনো কূলকিনারা পাচ্ছেন না। একটা অদৃশ্য নকশার অস্তিত্ব চোখের সামনে অনুভব করছেন অথচ সেটা সূক্ষ্মতার জন্য কিছুতেই তার চোখে ধরা পড়ছে না। পথে সামারহেসদের স্টেশন ওয়াগানটা বিপরীত দিক থেকে তার মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র অন্যমনস্ক থাকার দরুন সামারহেস বা ওর সহযাত্রিনীটিকে তিনি খেয়ালই করলেন না।
লং মিডোস-এ পৌঁছে সোজা বসবার ঘরে ঢুকে গেলেন। একটা শাকের বাটি ছিল চেয়ারের ওপর। ওটাকে সরিয়ে আরাম করে বসলেন।
টাইপরাইটারের খটখট শব্দ ওপর থেকে কানে আসছিল। ওর সদ্য লেখা নাটক নিয়ে রবিন ব্যস্ত। পছন্দ হয়নি বলে তিন তিন বার টাইপ করেও ছিঁড়ে ফেলেছে। ওকে নিশ্চয়ই মায়ের মৃত্যু যথেষ্ট আঘাত দিয়েছে। কিন্তু নিজেকে ছাড়া অন্য বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ভাবা স্বভাব নয় ওর। অবশ্য মুখে বলে, চালিয়ে যাচ্ছি নিজের কাজ, দেখলে শান্তি পাবে মায়ের আত্মা। এ ধরনের কথা অনেকেই বলে থাকে। পোয়ারো দেখেছেন নিজের আন্তরিক ইচ্ছেটা অনেকে মৃতের ইচ্ছে বলে চালিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করে। সেটাই সুবিধেজনক। তবে এক্ষেত্রে রবিন একথা বলতে পারে কারণ ছেলের ওপর অগাধ আস্থা ছিল মিসেস আপওয়ার্ডের এবং গর্বও কম ছিল না।
চোখ বুজে পোয়ারো ভদ্রমহিলার কথাই ভাবছিলেন। উনি কেমন প্রকৃতির মানুষ ছিলেন? ওঁর ওরকম একগুঁয়ে ভাবের কারণটা কি হতে পারে?
হঠাৎ জিনিসপত্র ভাঙার জোরে আওয়াজ হল। আলুথালু বেশে মরিন উপস্থিত হলেন।
–কিছুতেই তো আমি বুঝে উঠতে পারছি না যে কি হল জনির? সেই যে ডাকঘরে পার্সেল নিয়ে গেছে, আর ফেরার নামটি নেই। কাজ তো বহুক্ষণ আগেই হয়ে যাবার কথা, এদিকে আজ মুরগির খোয়াড়ের দরজাটা মেরামত না করলেই নয়।
যথার্থ একজন ভদ্রলোকের পক্ষে মুরগির খোঁয়াড়ের দরজা সারানো অসম্মানজনক পোয়ারোর মতে। নিজে হলে তিনি কখনো রাজী হতেন না। এখন তার অনেক কাজ। দু দুটো খুন, তার ওপর মিসেস আপওয়ার্ডের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
–দেখুন মঁসিয়ে পোয়ারো, এর ওপর আবার কৃষি বিভাগের ছাপানো ফর্মটা পাচ্ছি না, খুঁজে দেখলাম সব জায়গায়।
–শাকের বাটিটা আপনার ওখানে আছে।
কোনো উৎসাহ দেখা গেল না মরিনের। কথা চালিয়ে গেলেন, ফর্মটা গত সপ্তাহে এসে গেছে। কোথায় যে রাখলাম। পুলওভার জনির মেরামত করছিলাম, সেটার সঙ্গেই হয়ত রয়ে গেছে।
দেরাজের কাছে গিয়ে দ্রুত গতিতে সেটা খুলে ভেতরের সমস্ত জিনিস মেঝেয় টান মেরে মেরে ফেললেন। পোয়ারো মোটে এরকম অগোছালো ভাব সহ্য করতে পারেন না।
হঠাৎ মরিন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন–এই তো পেয়েছি।
মরিন ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই নিজের চিন্তায় পোয়ারো ফিরে যেতে চাইলেন। কিন্তু ঘরের বিশৃঙ্খল চেহারা অসহিষ্ণু করে তুলছিল তাকে। তিনিই দেরাজের কাছে গিয়ে একে একে সব গুছিয়ে তুলতে লাগলেন। পুলওভার, মোজা, উল তারপর আরেকটাতে মোম, ফটো, চিঠির গোছা….।
বেজে উঠলো টেলিফোন। ফোন ধরলেন পোয়ারো।–হ্যালো, হ্যালো।
স্পেন্স উল্টোদিকে কথা বলছিলেন।
–ও, মঁসিয়ে পোয়ারো আপনি। আপনাকেই চাইছিলাম।
আত্মবিশ্বাসের বদলে স্পেন্সের গলায় দ্বিধাগ্রস্তভাব ধরা পড়ল।
তিনি বললেন, আবার এক কাণ্ড ঘটেছে। একে তো আপনি অন্য ফটোর কথা বলে গেলেন। আবার এদিকে ব্রডহিনির ডাকঘরের কর্মচারী মেয়েটি নতুন তথ্য জানাচ্ছে। ওকে এইমাত্র মেজর সামারহেস আমার এখানে নিয়ে এসেছেন। মিসেস আপওয়ার্ড খুন হন যে রাত্রে, সেই রাত্রে তার বাড়ির উল্টোদিকের ফুটপাথে এই মেয়েটি দাঁড়িয়েছিল। বাড়ির ভেতরে এক ভদ্রমহিলাকে রাত সাড়ে আটটা থেকে নটার মধ্যে ঢুকতে দেখেছে। যাকে দেখেছে সে কিন্তু মিস হেণ্ডারসন নয়, এমন কেউ যার চুলের রং হালকা। আবার আমরা সন্দেহভাজনদের তালিকায় নাম পাচ্ছি দুজনের ইভা কার্পেন্টার আর শেলা রেগুল। এখন একটাই প্রশ্ন–কোন জন?
কথা বলার জন্য পোয়ারো মুখ খুলেও কিছু বললেন না। রিসিভার সাবধানে নামিয়ে রাখলেন, সামনের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
টেলিফোন বেজে উঠল আবার, হ্যালো, হ্যালো।
–মঁসিয়ে পোয়ারোর সঙ্গে কি আমি কথা বলতে পারি?
–বলছি।
–আমি মড উইলিয়ামস। একবার ডাকঘরে আসতে পারবেন ১৫ মিনিটের মধ্যে?
–আমি এক্ষুনি আসছি। পোয়ারো মাথায় টুপিটা দিয়ে রওনা দিলেন।
রাস্তায় ল্যাবারনাম থেকে সদ্য আগত স্পেন্সেরই একজন সহকারী পথ আটকালো তার।
সুপ্রভাত, মঁসিয়ে পোয়ারো। সু প্রভাত৷
খুব উত্তেজিত দেখচ্ছিল সার্জেন্ট ফ্লেচারকে।
ভালো করে আরেকবার তদন্ত করার জন্য সুপার আমায় পাঠিয়েছিলেন। বহু ছোটোখাটো জিনিস অনেক সময় এড়িয়ে যায় আমাদের চোখ। সব দেরাজগুলো তন্নতন্ন করে দেখেছি। ওখানে গোপন দেরাজও নেই। সমস্ত বইগুলো দেখেছিলাম যদি কোনো চিঠিপত্র ভুলে রেখে যায় ওর মধ্যে।
এবং আপনি কিছু একটা পেয়েছেন?
-না, চিঠি জাতীয় কিছু নয় তবে যথেষ্ট চমকপ্রদ কিছু, মানে অন্তত তাই মনে করি আমি। এই দেখুন।
খবরের কাগজের মোড়ক খুলে একটি জীর্ণ বিবর্ণ পুরনো বই ফ্লেচার বের করলেন।
–এটা রাখা ছিল একটা বইয়ের তাকে। পুরনো বহুদিন আগে ছাপা, কিন্তু দেখুন
ফ্লেচার প্রথম পৃষ্ঠাটা দেখালেন। পেনসিলে আড়াআড়ি ভাবে লেখাইভলিন হোপ।
–এই নামটা, নিশ্চয়ই মনে আছে আপনার যে…
–হ্যাঁ। ইভা কেন ইংল্যাণ্ড ছাড়বার আগে এই নামটা নিয়েছিল, মনে আছে আমার।
–মনে হয় যে ফটোটা মিসেস ম্যাগিনটি সনাক্ত করেন সেটা মিসেস আপওয়ার্ড। সব কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
-হ্যাঁ বাজি ফেলে আমি বলতে পারি যে যখন এটা আপনি মিঃ স্পেন্সকে দেখাবেন তখন উনি নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে বাকি রাখবেন না।
আশাকরি অতি ভয়ংকর কিছু হবে না।
উত্তর দিলেন না পোয়ারো। তার গন্তব্যস্থলের দিকে তিনি এগিয়ে গেলেন।
ডাকঘরে পৌঁছে দেখলেন মড দেখছে ডিজাইনের বই। স্ট্যাম্প কিনে ডাকঘর থেকে প্রায় ঝড়ের বেগে পোয়ারো বেরিয়ে এলেন। কিছু দূর এগিয়ে রাস্তায় মডকে ধরে ফেলে হাঁটতে লাগলেন তার পাশাপাশি।
এই দৃশ্য ডাকঘরের জানলা দিয়ে দেখে মিসেস সুইটিম্যান স্বগতোক্তি করলেন, বিদেশীদের এরকমই কাণ্ডকারখানা। লোকটা তো মড উইলিয়মসের ঠাকুর্দার বয়সী।
-ইয়ে, আমায় কিছু বলবেন আপনি?
-দেখুন মঁসিয়ে, আমি জানি না কতটা জরুরী ব্যাপারটা। কেউ একজন মিসেস ওয়েদারবির ঘরের জানলা দিয়ে ভেতরে ঢোকবার চেষ্টা করেছিল।
-কখন?
–আজ সকালে। বেরিয়েছিলেন ভদ্রমহিলা। মেয়েটিও তার কুকুর নিয়ে গিয়েছিল বাইরে। যথারীতি বুড়ো ভদ্রলোক নিজের পড়ার ঘরে ব্যস্ত ছিলেন। আমিও অন্যান্য দিনের মত রান্নাঘরে ছিলাম। পড়ার ঘরের মত রান্নাঘরটাও অন্য দিকে। কিন্তু সুযোগ পেয়েছিলাম আজ…. বুঝলেন তো?
সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন পোয়ারো।
–তাই আমি ওপরে ভদ্রমহিলার শোবার ঘরে হানা দিয়েছিলাম। একটা মই দেখি জানলার ঠিক পাশেই–একটা লোক মই-এর ওপর উঠে জানলার ছিটকিনিটা খোলবার চেষ্টা করছে, খুনের ঘটনার পর থেকে ভদ্রমহিলাটি তো আবার যাবতীয় দরজা-জানালা আষ্টেপৃষ্ঠে বন্ধ করে রাখেন। বদ্ধ ঘর। লোকটা আমাকে দেখতে পেয়েই নেমে গেল তাড়াতাড়ি আমাদের মালির মইটা দিয়ে। মালি আজ মইয়ে উঠে আইভির ঝাড় ছাঁটছিল। তারপর বোধহয় বিশ্রাম নিতে যায়।
–কে লোকটা? বর্ণনা দিতে পারেন কোনো?
এক পলক মাত্র আমি দেখেছি। আমাকে দেখা মাত্র পালিয়ে যায় লোকটা। মুখ দেখতে পাইনি।
-আপনি কি নিশ্চিত যে, যাকে দেখেছেন সে একজন পুরুষ?
চিন্তা করল মড।
–মানে সেই রকম সাজপোশাক। মাথায় একটা পুরনো ফেল্টের টুপি ছিল। অবশ্য পুরুষের ছদ্মবেশে কোনো মহিলাও হতে পারে।
-খুব চমকপ্রদ ব্যাপার। আর কিছু?
-এখন পর্যন্ত নয়। খুব জাঁহাবাজ ভদ্রমহিলা, ওর ঘরে ঢুকেছিলাম। হাতে নাতে ধরে ফেলে গঞ্জনা দিয়েছেন মা। হয়ত ওঁকে আমি এবার খুনই করে বসব। খুনই হওয়াই উচিত ওঁর। কি দজ্জাল, বাস্।
পোয়ারো মৃদুস্বরে বললেন, ইভলিন হোপ।
–কি বললেন? বিদ্যুৎগতিতে মড ফিরে তাকালো।
–তাহলে আপনি নামটার সঙ্গে পরিচিত?
–কেন? ও হ্যাঁ, ইভা কি যেন নামটা? সে এই নামটা অষ্ট্রেলিয়া যাবার আগেই নিয়েছিল। এ খবর তো সানডে কম্প্যানিয়নে ছিল।
অন্যের কথা সানডে কম্প্যানিয়ন লিখলেও একথাটা কিন্তু লেখেনি। মিসেস আপওয়ার্ডের বাড়িতে পুলিশ একটা বইয়ের মধ্যে পেয়েছে এই নামটা।
চেঁচিয়ে উঠল মড। তাহলে ওই ভদ্রমহিলাই। তাহলে উনি মারা যাননি অষ্ট্রেলিয়ায় ঠিকই বলেছিল মাইকেল….
–মাইকেল?
অচমকা মড বলে উঠল, আর আমি অপেক্ষা করতে পারছি না। আমাকে মধ্যাহ্নভোজে পরিবেশন করতে হবে। ওভেনে রান্না বসিয়ে এসেছি, নষ্ট হয়ে যাবে সব।
প্রায় দৌড়ে চলে গেল মড।
মডের গমন পথের দিকে পোয়ারো একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।
এদিকে ডাকঘরের জানলায় মুখ রেখে মিসেস সুইটিম্যান তখন পোয়ারোর চরিত্রের ভালোমন্দ বিচার করছিলেন।
.
পোয়ারো লং মিডোস-এ ফিরে নিজের চিন্তায় ডুবে গেলেন।
কয়েকটা ছোটোখাটো জিনিস তার চোখ এড়িয়ে গেছে। নকশার আদলটা বুঝতে পারছেন,শুধু সাজিয়ে নেওয়ার অপেক্ষা…..
মরিন গ্লাস হাতে স্বপ্নবিষ্ট স্বরে কথা বলছে–কি যেন জিজ্ঞেস করল…মিসেস অলিভারের রেপ-এ সন্ধ্যা কাটানোর গল্প।….সিসিল? মাইকেল?
পোয়ারো নিশ্চিত যে, মিসেস অলিভার একটা নাম উল্লেখ করেছিলেন, ইভা ক্রেন, মিঃ ক্রেগের বাড়ির গভর্নেস…. ইভলিন হোপ….
নিশ্চিতভাবে ইভলিন হোপ।
.
২৩.
পোয়ারোর খোঁজে ইভ কার্পেন্টার সামারহেসদের বাড়িতে এলেন।
পোয়ারোকে ভদ্রমহিলা বললেন, আমি শুনেছি আপনি একজন নামী গোয়েন্দা। আমি ভাড়া করতে চাই আপনাকে।
–মাদাম দেখুন, আমি ট্যাক্সি নই যে আমাকে ভাড়া নেবেন আপনি।
–আপনি তো বেসরকারী গোয়েন্দা। শুনেছি ইচ্ছেমত নাকি তাদের নিয়োগ করা যায়।
–সেই রকম বলা যায় বটে।
-তা আমি তো সেই কথাই বলছি। আমার প্রয়োজনে আপনাকে নিয়োগ করতে চাই। এ জন্যে যত টাকা লাগে দেব আমি।
-কিন্তু কেন? আপনার জন্য আমি কি করতে পারি? ইভ কার্পেন্টার রাগে ফেটে পড়লেন।
-আমাকে আপনি পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। যত্রতত্র ওরা আমার পিছু নিচ্ছে। ওদের ধারণা বোধহয় মিসেস আপওয়ার্ডকে আমিই খুন করেছি। যখন তখন ধরে যা তা প্রশ্ন করছে। আমি এ সব অত্যন্ত অপছন্দ করি। আমার মাথাটাই খারাপ হয়ে যাবে এবার।
পোয়ারো মহিলাটির দিকে তাকালেন। উনি এ কথাটা সত্যি বলেছেন। দেখে মনে হয় কদিনের মধ্যে অনেক বেড়ে গেছে ওঁর বয়স। চোখের নিচে কালি, মনে হয় অনেক রাত দুশ্চিন্তায় ঘুমোননি। যে হাতে ধরে আছেন সিগারেট, সেটাও অল্প অল্প কাঁপছে।
মঁসিয়ে পোয়ারো, এসব আপনাকে বন্ধ করতে হবে।
–এতে কি করার আছে আমার বলুন?
–যে ভাবেই হোক, এ সব আটকান। যেমন মানুষ আমার স্বামী, উনি নিজের হাতে ব্যাপারটা নিলে কবেই শায়েস্তা করে দিতেন ওদের।
–অথচ কিছুই করছেন না উনি?
না, ওঁকে আমি কিছুই বলিনি। শুধু পুলিশকে উনি আমার নিরাপত্তার কথাই বলবেন। উনি সেই রাতে একটা রাজনৈতিক সভায় উপস্থিত ছিলেন।
–আর আপনি?
–একলা বাড়িতে বসে আমি রেডিও শুনছিলাম।
–সে কথার প্রমাণ আপনি দিলেই পারেন।
–কিন্তু কেমন করে? আমাদের পরিচারক ক্রফটকে আমি একরাশ টাকা দিয়ে হাত করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে আহাম্মকটা প্রত্যাখ্যান করল।
–এঃ হে, আপনি এটা ঠিক করেননি।
–কেন?
-এতে আপনার চাকরবাকর ভাববে আপনি খুন করে এখন ধামাচাপা দিতে চাইছেন ব্যাপারটা।
-কিন্তু ক্রফটকে তো আমি টাকা দিয়েছি…
–কিসের জন্য?
–না, কিছু না।
–মাদাম, ভুলে যাচ্ছেন আপনি; আমার সাহায্য চাইতে এসেছেন আপনি।
–না না, তেমন কিছু নয়। ভদ্রমহিলার কাছ থেকে খবরটা ক্রফটই এনেছিল কিনা।
–মিসেস আপওয়ার্ডের কাছ থেকে?
–হ্যাঁ। সেই রাতে উনি ওঁর কাছে আমাকে যেতে বলেছিলেন।
–আপনি যাননি?
–কেনই বা যাব? ওই বৃদ্ধাকে অসহ্য লাগে। শুধু শুধু বকে বাজে সময় নষ্ট।
–কখন এসেছিল খবরটা?
–তখন আমি বাড়ি ছিলাম না। পাঁচটা থেকে ছটার মধ্যে হবে। ক্রফটই খবরটা নেয়।
–আর টাকা দিয়ে আপনি তার মুখ বন্ধ করলেন? কিন্তু কেন?
–আঃ বুঝতে কেন পারছেন না, এ সবের মধ্যে আমি নিজেকে জড়াতে চাইনি।
-আপনি তার ওপর আরও টাকা দিলেন যাতে আপনার অ্যালিবাই ওরা সমর্থন করে? স্বামী স্ত্রী ওরা কি ভাবল বলুন তো?
-তাতে কি এসে যায় কার?
–আদালতের এসে যায়।
–সত্যি কি আপনি সেরকম মনে করেন নাকি?
–হ্যাঁ।
–শেষ পর্যন্ত ওরা চাকরবাকরের কথাই শুনবে, আমার কথা নয়?
মিসেস কার্পেন্টারের দীঘল নীল চোখের দিকে পোয়ারো তাকালেন। এত কম ভদ্রমহিলার দূরদর্শিতা।
-মাদাম, চশমা পরেন না কেন আপনি?
–মাঝে মাঝে পরি তো। ছোটবেলাতেও পরতাম।
–আর রিং পরতেন দাঁতে, না?
–হ্যাঁ, কেন বলুন তো?
–নাঃ সেই একদা কুৎসিত হাঁসের রাজহাঁসে পরিণত হওয়ার মত।
–সত্যি। জানেন, ছোটবেলায় আমি বেশ বিশ্রী দেখতে ছিলাম।
–আপনার মাও কি তাই মনে করতেন আপনাকে?
-মায়ের কথা আমার মনে নেই। আপনি ঠিক কি বলতে চান বলুন তো? আমার প্রস্তাব আপনি গ্রহণ করবেন কি করবেন না?
–দুঃখিত আমি। আমি পারব না।
কারণ?
কারণ আমি জেমস বেন্টলীর হয়ে কাজ করছি।
–বেন্টলী? মানে সেই বুদ্বুটা যে মিসেস ম্যাগিনটিকে খুন করেছে? মিসেস আপওয়ার্ডের কি সম্পর্ক তার সঙ্গে?
–হয়ত কিছুই নয়।
–তবে? টাকা পয়সা? চান কত?
–আপনি এখানেই মাদাম বড় ভুল করছেন। আপনি সবকিছুই মাপতে শিখেছেন টাকা দিয়ে। অনেক টাকা আছে আপনার তাই বলে এই রকম আপনি।
–এক সময় আর্থিক সাচ্ছল্য একেবারেই ছিল না আমার।
–হ্যাঁ, সেই রকমই ভেবেছিলাম আমিও। যাক গে…..
.
চলে গেলেন ইভ কার্পেন্টার। নিজের মনে পোয়ারো বললেন, ইভলিন হোপ…।
তার মানে সেই রাত্রে মিসেস আপওয়ার্ড ডীডার হেণ্ডারসন আর ইভ কার্পেন্টার আমন্ত্রণ জানান এই দুজনকেই। হয়ত আরও কাউকে ফোন করেছিলেন তিনি…শশব্যস্ত ফিরে এলেন মরিন।
-মঁসিয়ে, আমি আবার কাচিটা এখন খুঁজে পাচ্ছি না। আপনার বড্ড দেরি হয়ে গেল দুপুরে খেতে। এত বিরক্ত লাগে। তিনটে কঁচির একটাও পাচ্ছি না এখন।
মরিন যথারীতি দেরাজ ঘাঁটতে লাগলেন।
পাওয়া গেল কাঁচিটা। মরিন ছুটে বেরিয়ে গেলেন।
পোয়ারো দেরাজের ছড়িয়ে থাকা জিনিসগুলোর দিকে এগিয়ে গেলেন–মোম, ছোট কাগজ, ঝুড়ি, ছবির গোছা–ছবি
একদৃষ্টে নিজের হাতে ধরা ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইলেন পোয়ারো। হঠাৎ পায়ের শব্দ পাওয়া গেল করিডোরে। তিনি ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেলেন সোফার দিকে। সোফায় ছবিটা রেখে তার ওপর চেপে বসলেন।
ঘরে ঢুকে মরিন বললেন, শাকের বাটিটা যে কোথায় ফেললাম।
-এই যে মাদাম। বাটিটা পোয়ারো এগিয়ে দিতে তাকে ধন্যবাদ জানালেন মরিন।
–ইস। আপনি ওই ভাঙা সোফাটায় কেন বসেছেন?
–মাদাম, ঠিক আছে ঠিক আছে। ওই ছবিটা আমি দেখছি।
পোয়ারোর নির্দেশিত ছবির দিকে তাকিয়ে মরিন বললেন, হ্যাঁ মঁসিয়ে, চমৎকার ছবিটা। ওটা জনির পূর্বপুরুষের ছবি। কিছুতেই দেবে না বিক্রি করতে। খুব গর্ব ওর এটা নিয়ে।
–হ্যাঁ, আপনার স্বামীর গর্ব করার মত সত্যিই কিছু আছে।
.
পোয়ারো প্রায় তিনটের সময় ডঃ রেগুলের বাড়ি এলেন। মিসেস স্কট প্রবীণা পরিচারিকা দরজা খুলে দিল।
মিসেস রেগুলের খোঁজ করলেন পোয়ারো।
প্রথম দিনই মিসেস রেগুলকে ভীরু, স্বামীর একান্ত অনুগত বলে মনে হয়েছিল পোয়ারোর। তাকে আজ আরো ফ্যাকাশে আর রুগ্ন বলে মনে হল।
–মাদাম, আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই আপনাকে।
–নিশ্চয়ই, বলুন।
–মিসেস আপওয়ার্ড কি মারা যাবার দিন আপনাকে টেলিফোন করেছিলেন?
–হ্যাঁ। ফোন ধরেন মিসেস স্কটই, তা প্রায় দুটো আন্দাজ।
–ফোনে উনি কি বলেছিলেন? আপনাকে যেতে?
–হ্যাঁ। আমাকে নাকি উনি জানাতে বলেন যে, রবিন আর মিসেস অলিভার বাড়ি থাকবেন না। বেরোবে পরিচারিকাও। তাই আমি যেন ওঁর সঙ্গে একটু গল্পগুজব করতে যাই।
–যেতে বলেন কটা আন্দাজ?
–নটা বা তারপর।
–গিয়েছিলেন আপনি?
–ভেবেছিলাম যাব। কিন্তু রাতের খাওয়া সারার পর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। যখন ঘুম ভাঙল, প্রায় দশটা তখন, মনে হল দেরি হয়ে গেছে। আর গেলাম না।
–এ কথা পুলিশকে আপনি জানিয়েছেন?
মিসেস রেগুল শিশুর মত সরল চোখ তুলে তাকালেন।
–আমার কি জানানো উচিত ছিল? যাইনি বলে, না জানালেও ভেবেছিলাম চলবে, আসলে একটু অপরাধী বলে এখন মনে হয় নিজেকে আমার, আমি সেই রাত্রে গেলে উনি হয়ত খুন হতেন না।
–ও সব ভেবে মন খারাপ করবেন না। আচ্ছা মাদাম, কিসের এত ভয় আপনার?
–ভয়, কই না তো?
–কিন্তু ভয় পেয়েছেন আপনি।
–কি বলছেন যা তা। ভয় পেতে যাব কেন আমি?
জবাব দেবার আগে পোয়ারো এক মুহূর্ত থামলেন।
মাদাম, আমি ভেবেছিলাম হয়ত আমাকে আপনি ভয় পান…
কোনো উত্তর দিলেন না মিসেস রেগুল। কিন্তু তার চোখ বিস্ফারিত হল। তিনি আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন।
.
২৪.
কথাবার্তা চলছিল স্পেন্স আর পোয়ারোর মধ্যে।
-মঁসিয়ে পোয়ারো, যত শুনছি আপনার কথা ততই সব গুলিয়ে যাচ্ছে। আপনি বলছেন যে, মিসেস আপওয়ার্ড সেই রাতে তিন তিন জন মহিলাকে ফোন করে ওঁর কাছে আসতে বলেছিলেন। কেন তিন জন? উনিও কি নিশ্চিত ছিলেন না যে, কে লিলি গ্যাম্বল? নাকি এটা লিলি সংক্রান্ত কোনো ব্যাপারই নয়? আবার ইভলিন নাম লেখা বইটার কথা ভাবুন। এ থেকে মনে হয় মিসেস আপওয়ার্ড আর ইভা কেন একই মহিলা।
মিসেস ম্যাগিনটির কথা থেকে বেন্টলীও এরকম একটা আন্দাজ করেছিল।
–আবার আমি ভেবেছিলাম নিশ্চিত হয়ে বেন্টলী কিছু বলেনি।
–তা তো বলেইনি। যা চরিত্র ওর তাতে কোনো কিছুই ও তেমন নিশ্চিত করে বলতে পারে না। ও বিশেষ কানও দেয় না মিসেস ম্যাগিনটির কথায়। তা স্বত্ত্বেও যখন ওর মনে হয়েছে মিসেস ম্যাগিনটি মিসেস আপওয়ার্ডের সম্বন্ধেই বলতে চেয়েছিলেন কিছু, তখন তা সত্যি হলেও হতে পারে।
সর্বশেষ খবরে অষ্ট্রেলিয়া থেকে জানা গেছে (যদি অবশ্য, মিসেস আপওয়ার্ড ওখানেই গিয়ে থাকেন, আমেরিকায় নয়) মিসেস হোপ প্রায় কুড়ি বছর আগে মারা যান।
–আগেই শুনেছি সেটা।
–পোয়ারো, সবই জানেন আপনি, না?
এ কথায় পোয়ারো কর্ণপাত করলেন না।
-স্পেন্স, তার মানে একদিকে আমরা দেখছি অষ্ট্রেলিয়ায় মিসেস হোপ মারা গেছেন। আর অন্যদিকে?
অন্যদিকে আমরা জনৈকা মিসেস আপওয়ার্ডকে পাচ্ছি যিনি বিত্তশালী বিধবা, এক পুত্রের জননী। ওঁর স্বামী মারা যান ছেলের জন্মের পরই। শৈশবে ছেলেটির যক্ষারোগ থাকায় বেশির ভাগ সময় ভদ্রমহিলা বিদেশেই থাকতেন।
-এটা কবেকার কথা?
ইভা কেন ইংল্যাণ্ড ছেড়ে যাবার চার বছর পরে। এই ভদ্রমহিলার সাথে মিঃ আপওয়ার্ড পরিচিত হল এবং বিয়ে করেন ওঁকে।
–মিসেস আপওয়ার্ড আসলে ইভা কেন হলেও হতে পারেন। ওঁর কুমারী জীবনের পদবী কি ছিল?
–যতদূর শুনেছি হারগ্রেভস, কিন্তু কি এসে যায় তাতে?
-হ্যাঁ, তা ঠিক। হয়ত ইভা কেন বা ইভলিন হোপ দীর্ঘকাল রোগভোগের পর সুস্থ হয়ে হারগ্রেভস পদবী ধারণ করে।
-আসলে সবই এতদিন আগেরকার ব্যাপার। ওঁকে হয়ত মিসেস ম্যাগিনটি ছবি দেখে সনাক্ত করেছিলেন। তারপর এ সন্দেহ হতেই পারে যে, মিসেস ম্যাগিনটিকে খুন করেন মিসেস আপওয়ার্ড।
হতেও পারে। এমন হতে পারে সে রাত্রে রেডিও বা টি.ভি. প্রোগ্রাম ছিল রবিনের। মনে করে দেখুন, সেই রাতে মিসেস রেগুল মিসেস আপওয়ার্ডের খোঁজে গিয়েও সাড়াশব্দ পাননি কোনো। জ্যানেট তো মিসেস সুইটিম্যানকে বলেছে যে, পঙ্গু দেখায় যতটা, সত্যি করে ততটা পঙ্গু নন মিসেস আপওয়ার্ড।
এ পর্যন্ত বুঝলাম। কিন্তু এরপর তো নিজেই উনি খুন হলেন–ছবি একটা সনাক্তকরণের পর। তাহলে তো এই সিদ্ধান্তে আবার আসতে হয় যে দুটো খুনের মধ্যে কোনো যোগসূত্র নেই।
-না, তা নয়। যোগসূত্র আছে যথেষ্ট।
–আমি মশাই হাল ছেড়ে দিচ্ছি। ইভলিন হোপ। এটাই রহস্যের চাবিকাঠি।
-ইভ কার্পেন্টার, তার কথাই কি বলতে চাইছেন আপনি? আসলে উনি লিলি গ্যাম্বল নন, ইভা কেনের মেয়ে। কিন্তু এবার তাহলে বলতে হয় নিজের মাকে উনি খুন করেছেন।
-না না। মাতৃহত্যার ব্যাপার না এটা।
–মঁসিয়ে পোয়ারো কি হচ্ছেটা কি? এরপর আপনি বলবেন যে ইভা কেন, লিলি গ্যাম্বল, জেনিস কোর্টল্যাণ্ড আর ভেরা ব্লেক–এরা চারজনই ব্রডহিনির বাসিন্দা।
–হিসেবে চারজনের বেশি আসছে। ইভা কেন মনে রাখবেন মিঃ ক্রেগের বাড়িতে তার বাচ্চার দেখাশুনো করত।
–তাতে কি?
-তার মানে এক বা একাধিক বাচ্চাও সেই বাড়িতে নিশ্চয়ই ছিল? তার বা তাদের কি হল?
-একটি ছেলে আর একটি মেয়ে ছিল। তাদের কোনো আত্মীয় নেই।
তাহলে আরো দুজন আসছে হিসেবে। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য এই দুজন ছবিটা রাখতে পারে।
–তা বিশ্বাস হয় না আমার।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন পোয়ারো। তিনি বললেন, মিঃ স্পেন্স এটা আমাদের হিসেবে ধরতেই হবে। মনে হচ্ছে আমার রহস্য আমি উদঘাটন করতে পেরেছি। শুধু একটা খটকা….
-ওঃ, আমার কি আনন্দ হচ্ছে। তাহলে আপনারও খটকা লাগে?
–শুধু আমায় একটা কথা আপনি বলুন, মিঃ স্পেন্স। যখন ইভা কেন দেশত্যাগ করে, তখনো মিঃ ক্রেগ-এর মামলার রায় বেরোয়নি, তাই না?
-না। এবং সন্তানসম্ভবা ছিল ইভা?
–হ্যাঁ।
-ওঃ, কি বোকা আমি। জলের মত তো পুরো ব্যাপারটাই সোজা। এ কথা বলার পর তৃতীয় খুনটা অল্পের জন্য হল না। মিঃ স্পেন্স, করতেন এই খুনটা, পোয়ারোকে, পুলিশ হেড কোয়ার্টারে বসে।
.
এরকুল পোয়ারো বললেন, টেলিফোনে আমি মিসেস অলিভারের সাথে একটু ব্যক্তিগত কথাবার্তা বলতে চাই।
যদিও খুব ব্যস্ত ছিলেন মিসেস অলিভার, তবু এসে ফোন ধরলেন। উনি রাগতস্বরে বললেন, আঃ আপনি কি আর ফোন করার সময় পেলেন না? আমি খুনের একটা চমৎকার পরিকল্পনা করছিলাম আমার পরের বইটার জন্য। সব ভেস্তে দিলেন তো।
-এঃ হে। মাদাম বুঝতে পারিনি আমি, তবে আমি যে জন্য ফোন করেছি, তা বেশি জরুরী।
-না। আমার কাছে নয়। অন্তত আমি যতক্ষণ না আমার পরিকল্পনাটার খসড়া শেষ করে ফেলছি….হা, কি বলছেন? ….হ্যাঁ, একটা ছোট্ট থিয়েটার….. লোকেরা? হ্যাঁ, একজনের নাম সিসিল। আর যার সঙ্গে আমি কথা বলছিলাম তার নাম মাইকেল।
–ঠিক আছে। এটাই আমি জানতে চাইছিলাম।
–কিন্তু সিসিল আর মাইকেল কেন?
-মাদাম প্রায় গুটিয়েই এনেছি জাল।
কিছুতেই তো আমি বুঝতে পারছি না কেন ডঃ রেগুলকে আপনারা এখনো ধরছেন না। যদি স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের কী হতাম আমি তাহলে কবেই…..
-হ্যাঁ, মাদাম বুঝেছি। ছাড়ছি এবার।
–ছকটা যেটা কেঁদেছিলাম, তার বারোটা বাজিয়ে দিলেন।
–মাদাম অত্যন্ত দুঃখিত আমি। ফোন নামিয়ে রেখে পোয়ারো মিঃ স্পেন্সের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
-স্পেন্স, এবার আমাদের কালেন কোয়েতে মাইকেল নামে একজন অভিনেতার খোঁজে যেতে হবে। ওখানে সে খুচরো পার্ট করে। ঈশ্বর করুন, সেই যেন আসল মাইকেল হয়।
কিন্তু কি আশ্চর্য…. স্পেন্সকে আর কিছু বলার সময় দিলেন না পোয়ারো।
–আপনি কি জানেন স্পেন্স যে ফরাসী ভাষায় সিক্রেট দ্য পলিসিল কাকে বলে? না
-এটা এক ধরনের এমন গোপন কথা যা জানতে পারে সকলেই। যারা এজন্য একথা জানে না, তারা কোনোদিনই জানতে পারে না। তাদের কেউ বলেও না, কারণ সকলেই ভাবে নিশ্চয়ই একথা অন্যদের জানা আছে।
–পোয়ারো, সত্যিই পারা যায় না আপনাকে নিয়ে।
.
২৫.
শেষ হল মামলার শুনানি। বের হল রায়-এক বা একাধিক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির দ্বারা খুন হয়েছেন মিসেস আপওয়ার্ড।
এরপর মামলার শুনানিতে যারা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের সবাইকে লং মিডোস-এ এরকুল পোয়ারো আমন্ত্রণ জানালেন।
অর্ধচন্দ্রাকারে বৈঠকখানায় চেয়ার সাজানো হয়েছে, বক্তার আসন পোয়ারো এসে অলংকৃত করলেন।
–সমবেত ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলাগণ, প্রথমেই আপনাদের বহুল প্রচলিত একটি ছড়ার কথা বলছি আপনাদের।
মিসেস ম্যাগিনটি অক্কা পেলে, কেমনে তা জানি, হাঁটু ভেঙে ঘাড় মুটকে যেমনি আছি আমি।
আমাকে এটা মিসেস আপওয়ার্ড শুনিয়েছিলেন। আর ঠিক এমনি ভাবে নিজেও মারা যান তিনি।
কথা শুরু করার আগে আবার গোড়ার দিকে আমাদের ফিরে যাওয়া ভালো।
বৃদ্ধা মিসেস ম্যাগিনটি, যিনি টুকটাক কাজকর্ম করতেন অন্যের বাড়িতে শেষ পর্যন্ত তিনি খুন হলেন। আর সেই খুনের দায় বর্তালো তার ভাড়াটে জেমস বেন্টলীর ওপর। কিন্তু কেন জানি না মিঃ স্পেন্সের মনে বেন্টলীর অপরাধ সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। তাই ওঁরই অনুরোধে পূর্ণতদন্তের জন্য আমাকে এখানে আসতে হয়। আমি দীর্ঘ গল্প কাঁদতে চাই না খুনের ব্যাপারে।
আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রথমে এক বোতল কালি। যেদিন মারা যান মিসেস ম্যাগিনটি তার আগের রবিবার সানডে কম্প্যানিয়ন এ চারজন মহিলার ছবি ছাপা হয়, আপনাদের এ পর্যন্ত সকলেরই জানা আছে। তার থেকে একটা ছবির চেহারা মিসেস ম্যাগিনটি সনাক্ত করতে পারেন। অনুমান ছিল তার–তিনি যে যে বাড়িতে কাজ করতে যেতেন, তারই কোন একটিতে ঐ একই ফটো তিনি দেখে থাকবেন। বেন্টলীকেও কথায় কথায় তা বলেছিলেন। কিন্তু সে বিশেষ মনোযোগ দেয়নি তার কথায়। তবুও বেন্টলীর অস্পষ্টভাবে এটুকু মনে পড়ছে যে, ছবিটি মিসেস ম্যাগিনটি মিসেস আপওয়ার্ডের বাড়িতে দেখেছেন–এ রকম একটা ইঙ্গিত যেন দিয়েছিলেন। কারণ তিনি একথাও বলেছিলেন যে, সব জানাজানি হয়ে গেলে সেই মহিলার অহংকার চুর্ণ হবে।
আমি মিসেস আপওয়ার্ডের বাড়িতে চারখানা ফটোই নিয়ে গিয়েছিলাম। নিশ্চিতভাবে উনিও সেগুলোর মধ্যে চিনতে পারেন একজনের মুখ। সে কথা প্রকাশ পেয়েছিলো ওঁর মুখের ভাবে। আমি বারবার অনুরোধ করায় উনি বলেন যে এর কোনো একটির মত ছবি কোথাও তিনি দেখেছেন তবে কোথায় তা স্পষ্ট মনে করতে পারছেন না।
ওঁর এরকম চেনাচেনা মনে হচ্ছে কোন ছবি দেখে তা জিজ্ঞাসা করা হলে তার জবাবেউনি দেখান লিলি গ্যাম্বলের ছবিটি। কিন্তু আপনাদের আমি বলছি উনি সত্যি কথা বলেননি সেদিন। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কোনো কারণে সত্য গোপন করেন আমার কাছে। কিন্তু একজনের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেননি উনি–সে চোখ খুনীর।
পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিল একজন; আসলে মিসেস আপওয়ার্ডের কোন ছবিটা চেনা লেগেছে। ইভা কেনের ছবিখানা, যে ক্রেগ হত্যা মামলায় সর্বপ্রধান চরিত্র ছিল। ঠিক পরের দিন রাত্রে নিহত হন মিসেস আপওয়ার্ড। যে কারণে মিসেস ম্যাগিনটি খুন হন, ঠিক একই কারণে।
মিসেস আপওয়ার্ড মারা যাবার আগে টেলিফোনে তিনজন ভদ্রমহিলা ওঁর নিমন্ত্রণ পান –মিসেস কার্পেন্টার, মিসেস রেগুল আর মিস হেণ্ডারসন। তিনটি আমন্ত্রণেরই এক সারাংশ মিসেস আপওয়ার্ডকে সন্ধ্যের পর সঙ্গ দান করা। সেই রাতে ওঁর পরিচারিকাটি ছুটি নিয়েছিল। ওঁর ছেলে এবং মিসেস অলিভার কালেনকোয়েতে নাটকের ব্যাপারে থিয়েটারে গিয়েছিলেন। তার মানে ব্যাপারটা এই রকমই দাঁড়াচ্ছে অনেকটা যে উক্ত তিনজন মহিলার সঙ্গেই মিসেস আপওয়ার্ড আলাদা আলাদা ভাবে কিছু ব্যক্তিগত কথাবার্তা বলতে চান।
কিন্তু মহিলা তিনজন কেন? তাহলে কি উনি জানতেন যে, কোথায় ইভা কেনের ছবিটা দেখেছেন? নাকি ঠিক কোথায় দেখেছেন তা মনে করতে পারছিলেন না? এই তিনজনের মধ্যে কিছুই আপাতত সাদৃশ্য নেই, শুধুমাত্র তাদের বয়স ছাড়া। এদের সকলেরই বয়স ত্রিশের কাছাকাছি।
আপনারা সকলেই কাগজে পড়েছেন ইভা কেনের দুর্ভাগা মেয়েটির কথা। সেই মেয়ের বয়সও হিসেব করলে ত্রিশের কাছাকাছি দাঁড়ায় এখন। তাই এরকম ধারণা করা খুবই স্বাভাবিক যে ব্রডহিনিতে এমন একজন মহিলা আছেন যিনি মিঃ ক্রেগ এবং ইভা কেনের কন্যা। এবং মেয়েটিও নিশ্চয়ই সেক্ষেত্রে সর্বতোভাবে চেষ্টা করবে তার এই পরিচয় গোপন রাখার, এর জন্য সে দরকার বুঝলে শেষ পর্যন্ত যেতেও প্রস্তুত থাকবে।
যখন মিসেস আপওয়ার্ডকে মৃত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায় তখন দুটো কফির কাপ ছিল টেবিলে। তারই একটাতে তখনো লেগে ছিল হালকা দাগ লিপষ্টিকের।
আসুন, আবার আমরা ফিরে যাই ফোনের প্রসঙ্গে। আমন্ত্রণ পাওয়া সত্ত্বেও মিসেস কার্পেন্টার সেই রাতে ল্যাবারনাম-এ যাননি। উনি সেইরকমই জানিয়েছেন আমাদের। ভেবেছিলাম মিসেস রেগুল যাবেন কিন্তু চেয়ারেই শেষ পর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়েন। কিন্তু মিস হেণ্ডারসন গিয়েছিলেন। সেই সময় বাড়িটা সম্পূর্ণ অন্ধকার ছিল এবং অনেক ডাকাডাকি করে সাড়াশব্দ না পেয়ে ফিরে আসেন উনি।
ওই তিনজনের কাছে এইরকম জবানবন্দী পেয়েছি। কিন্তু তখনো সেই সম্পর্কে আমাদের মনে সন্দেহের অবকাশ ছিল। দ্বিতীয় কফির কাপে লিপষ্টিকের দাগ দেখা গেছে এবং একজন সাক্ষী এডনাকে আমরা পেলাম। সে নাকি হলফ করে বলে যে, একজন মহিলাকে সে ল্যাবারনামের ভেতরে ঢুকতে দেখেছে যার চুলের রং হালকা এর ওপর ঘরের ভেতর দামী সেন্টের গন্ধও পাওয়া গেল। সেন্টের বিশেষ ব্র্যাণ্ড আবার আমাদের মিসেস কার্পেন্টারের কথা মনে করিয়ে দেয়।
চেঁচিয়ে উঠলেন ইভ কার্পেন্টার।
-মিথ্যে কথা, একেবারে ডাহা মিথ্যে কথা। আদৌ আমি যাইনি। গী, কেন তুমি বলছ না যে সত্যিই সেই রাতে আমি বাড়ির বাইরে বেরোইনি?
রাগে গী কার্পেন্টারের মুখ লাল হয়ে গেল।
-মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি আপনাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আপনি অত্যন্ত অপমানজনক কথা বলছেন।
–কি আশ্চর্য! শুধু আমি বলছি যে, আপনার স্ত্রী ওই একই সেন্ট আর লিপষ্টিক ব্যবহার করেন। তাতে হয়েছেটা কি?
–কি বকছেন যা তা। যে কেউ আমার সেন্ট নিয়ে এসে ওঁর ঘরে ছড়াতে পারেন।
হঠাৎ পোয়ারো একগাল হাসলেন।
–ঠিক তাই মাদাম, যে কেউ সেন্ট ছড়াতে পারে ওভাবে, আমাকে এই ধারণাটাই প্রথম আশার আলো দেখায়। কফির কাপ থেকে লিপষ্টিকের দাগ তুলে ফেলা বা কাপটা ধুয়ে রাখা–দুই-ই খুব সোজা কাজ, বিশেষত যখন কেউ বাড়িতে ছিল না। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা করা হয়নি। কেন? একমাত্র এর উত্তর হল–কেউ দেখাতে চেয়েছিল হত্যাটা কোনো মহিলাই করেছে।
যে তিনজন মহিলা ফোন পেয়েছিলেন, তাঁরা কেউই কিন্তু মিসেস আপওয়ার্ডের সংগে সোজাসুজি কথা বলেননি। সুতরাং এমনও হতে পারে যে আদপেই ভদ্রমহিলা কোনো ফোন করেননি। কেউ এমন ফোন করেছিল যার মূল উদ্দেশ্য ছিল কোনো একজন মহিলাকে এই ঘটনার সাথে জড়িত করা। কিন্তু কেন? উত্তরও এর একটাই। মিসেস আপওয়ার্ডকে কোনো মহিলা খুন করেননি যে করেছে নিঃসন্দেহে সে একজন পুরুষ।
এরকুল পোয়ারো সমবেত শ্রোতাদের দিকে তাকালেন। ইভ স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। পোয়ারো বলে চললেন, সুতরাং কোনো একজন পুরুষ মিসেস আপওয়ার্ডকে খুন করেছে এবং মিসেস ম্যাগিনটিকেও। এবং তার জিম্মাতেই নিশ্চয়ই ইভা কেনের ছবিটা ছিল। মিসেস ম্যাগিনটিকে খুন করার পর খুনী ঐ ছবিটা নষ্ট করার প্রয়োজন বোধ করেনি কিন্তু মিসেস আপওয়ার্ডকে হত্যা করার পর তোক জানাজানি হবার ভয়ে সেটা নষ্ট করে ফেলার দরকার হয়ে পড়েছিল। তবু তা নষ্ট করা হয়নি। এ বাড়িরই একটা দেরাজে সেটা আমি খুঁজে পেয়েছি। এই দেখুন, ইভা কেনের ছবি। এর পেছনে আড়াআড়ি ভাবে লেখা আছে দুটো কথা আমার মা।
-মরিন সামারহেসের ওপর স্থির হল পোয়ারোর দৃষ্টি।
মরিন অবাক হল।
–এসব তো কিছুই আমি বুঝছি না।
–না, মিসেস সামারহেস। এসব সত্যিই আপনার বুঝতে পারার পর ছবিটা রেখে দেবার দুটো মাত্র কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, নিছক আবেগপ্রবণতা। কোনোরকম অপরাধবোধই আপনার মনে নেই। কাজেই আপনি ছবিটা রেখে থাকলে সেটা আশ্চর্যের কিছু ছিল না। নিজের মুখেই আপনি ইভ কার্পেন্টারের বাড়িতে আমাদের বলেছিলেন যে ছেলেবেলায় আপনাকে দত্তক নেওয়া হয়। বোধহয় আপনি আপনার প্রকৃত মায়ের আসল নাম পর্যন্ত জানেন না। কিন্তু আর কেউ সেটা জানেন যিনি কিনা বংশগৌরব, চক্ষুলজ্জা, এসবের ভয়ে আপনার পরিচয় গোপন করতে একটা খুনের দায়ও নিজের ঘাড়ে নিতে প্রস্তুত।
এবার চেয়ার ছেড়ে জনি সামারহেস উঠে দাঁড়ালেন।
–কি বাজে বকছেন। আপনার সবই তো মনগড়া কথা। আমার স্ত্রীর সম্বন্ধে এত অসম্মানজনক কথা বলতে আপনার বাধছে না?
–মেজর, শান্ত হোন। কিছুটা শান্ত হলেন মেজর জনি সামারহেস।
–দেখুন মঁসিয়ে পোয়ারো, যে কেউ আমাদের দেরাজে ফটোটা রেখে যেতে পারে।
–ঠিক তাই, মেজর। আর মজাটা হল যে এই ফটোটার ওপর কোনো আঙুলের ছাপ নেই। যদি মরিন রাখতেন তাহলে ছবির ওপর তার আঙুলের ছাপ থাকত।
মরিন চেঁচিয়ে উঠলেন।
–কিন্তু মঁসিয়ে, আমি এ ছবি দেখিনি কখনো জীবনে, একমাত্র সেদিন মিসেস আপওয়ার্ডের বাড়িতে ছাড়া।
-হ্যাঁ মাদাম, ঠিকই বলেছেন আপনি। আমার চোখে পড়ার ঠিক আগেই এখানে রাখা হয়েছে ফটোটা। আমি দু-দুবার দেরাজের ছড়িয়ে থাকা জিনিসপত্র গুছিয়েছি। প্রথমবার ছবিটা ছিল না, কিন্তু দ্বিতীয়বার ছিল। তার মানে দুবার দেরাজ গোছানোর মাঝের সময়টুকুতে কোনো এক সুযোগে ছবিটা ওর মধ্যে রাখা হয় এবং আমি জানি কে এই কাজটা করেছে।
এখন যেন পোয়ারোর চোখে শিকারীর ধূর্ততা।
–এখানে একজন অপরাধী পুরুষ। নিছক টাকার জন্যই খুন করা হয়েছে। মিসেস আপওয়ার্ডের বাড়িতে পাওয়া গেছে একটা বই। তাতে নাম লেখা ছিল ইভলিন হোপ, যে নাম ইভা কেন নিয়েছিল, ইংল্যাণ্ড ছাড়ার সময়। ইভা কেন তার বাচ্চার নামও বোঝা যাচ্ছে নিয়মানুযায়ী ইভলিন রাখে। কিন্তু ইভলিন যেমন মেয়েদের নাম হয়, তেমন আবার ছেলেদেরও হতে পারে। সানডে কম্প্যানিয়ন জানায় যে ইভা কেনের সন্তান ছিল মেয়ে। বাজে কথা। কারণ ইভ তার সন্তানের জন্মের আগেই ইংল্যাণ্ড ছাড়ে। সুতরাং নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না যে, সে কন্যা সন্তানেরই জন্ম দিয়েছিল। আমিও কাগজের খবরে বিভ্রান্ত হয়েছিলাম। প্রকৃত ঘটনা–ওই ইভা কেনের ছেলে ইভলিন হোপ, ইংল্যাণ্ডে আসে। সে যথেষ্ট প্রতিভাবান সুতরাং একজন বিত্তশালিনী মহিলার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, যিনি ওর প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। সদ্যপুত্র বিয়োগ হয়েছিল ভদ্রমহিলার। ধনী মহিলাটি আইনসঙ্গত ভাবে এই ছেলেটিকে দত্তক নেন। আচ্ছা, মিঃ আপওয়ার্ড, আপনার আসল না তো ইভলিন হোপ। তাই না?
তীক্ষ্ণস্বরে রবিন চেঁচিয়ে বলল, নিশ্চয়ই না। কি বলতে চান আপনি?
-আর অস্বীকার করে লাভ নেই। আপনার আসল নাম বেশ কয়েকজন জেনে ফেলেছে। বইয়ে ইভলিন হোপ নামটা আর ছবির পেছনে আমার মা লেখাটা একই হাতের এবং তা আপনার। আপনার জিনিসপত্র গোছানোর সময় ছবিটা মিসেস ম্যাগিনটির নজরে পড়ে। উনি ছবির পেছনের লেখাটাও পড়েন।সানডে কম্প্যানিয়ন পড়ার পর ভদ্রমহিলা আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে কথাও বলেন। কিন্তু উনি জানতেন না যে, আপনি মিসেস আপওয়ার্ডের দত্তক নেওয়া ছেলে। উনি ভেবেছিলেন মিসেস আপওয়ার্ডই সেই ইভা কেন। পরিষ্কার আপনি বুঝতে পারেন যে মিসেস আপওয়ার্ডের কানে এ কথা উঠলে তিনি আপনাকে সত্য গোপন করার অপরাধে কখনোই ক্ষমা করবেন না আর আপনাকে তার বাড়িতেও স্থান দেবেন না। তাই খুন করার সংকল্প নিয়ে আপনি মিসেস ম্যাগিনটির বাড়ি যান এবং ওঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। ঠিক এইভাবে…।
পোয়ারো এই বলে চিনি গুঁড়োবার মুষলটা রবিনের মাথা লক্ষ্য করে তুললেন।
ভয়াবহতা এতই পুরো ব্যাপারটার নৃশংস যে, চিৎকার করে উঠল রবিন। না না, ওকে আমি মারতে চাইনি। আচমকা মাথা গরম হয়ে যাওয়ায় ওকে আমি আঘাত করি।
আপনি তারপর রক্ত ধুয়ে ফেলে অস্ত্রটা আগের জায়গাতেই রেখে দেন। কিন্তু বিজ্ঞানের দৌলতে মুছে ফেলা রক্তের দাগও ধরা পড়ে গেছে।
-কিন্তু সত্যিই আমি ওঁকে মারতে চাইনি। আমি…ভুল করে ফেলেছি। আমার রক্তে আছে খুনের বীজ কিন্তু সেজন্য আমাকে শাস্তি দিতে পারেন না আপনারা।
স্পেন্স বললেন, আমি আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি মিঃ আপওয়ার্ড, এখন থেকে যা যা আপনি বলবেন….
.
২৬.
–ওঃ মঁসিয়ে পোয়ারো, ভাবতেই তো আমরা পারছি না যে, আপনি সন্দেহ করলেন কি করে রবিনকে।
সমবেত শ্রোতাদের দিকে পোয়ারো আত্মপ্রসাদের দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।
–আমার অনেক আগেই সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল। একদিন মিসেস সামারহেস বলেছিলেন, রবিন, নিশ্চয়ই আপনার নিজেকে কারও দত্তক সন্তান হিসেবে ভাবতে ভালো লাগে না, তাই না? এর একটাই অর্থ হয় যে, মিসেস আপওয়ার্ড রবিনের আসল মা ছিলেন না। নিজেও মিসেস আপওয়ার্ড এ বিষয়ে যথেষ্ট সাবধান ছিলেন যাতে কেউ এ কথা জানতে না পারে। তাই তিনি পরিচিত গণ্ডী ছেড়ে এতদূরে বসবাস করতে আসেন। এমন কি রবিনকে যারা তার নিজের ছেলে বলে ভাবত, তাদের ভুলও তিনি ভাঙতে চাইতেন না।
প্রথমদিন ল্যাবারনাম এ যা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সেটা হল মিসেস আপওয়ার্ডের প্রতি রবিনের ব্যবহার। ঠিক এটা আদুরে ছেলের মত ভাবও নয় আবার কর্তব্যপরায়ণ ছেলের মতও নয়, কেমন যেন প্রতিদান দেবার মত ভাব, যেমন করে আমরা অপরকে নিজের কৃতজ্ঞতা জানাই। যদিও মিসেস আপওয়ার্ড রবিনকে ভালোবাসতেন তবু মনে মনে তার গর্ব ছিল যে, তিনি টাকা দিয়ে একজন প্রতিভাবান ছেলেকে কেমন কিনে নিয়েছেন। তারপর এলেন মিসেস ম্যাগিনটি। রবিন চোখে অন্ধকার দেখল। সে এতদিন মিসেস আপওয়ার্ডকে বুঝিয়েছিল যে তার মা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। সুতরাং সে সাহস করল না আর কোনো ঝুঁকি নিতে। একদিন মরিন কথা প্রসঙ্গে মুষলটার দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সেই সুযোগটাই নিল রবিন। মুষল দিয়ে মাথায় বাড়ি মেরে মিসেস ম্যাগিনটিকে খুন করল আচমকা আর মহিলাটির টাকা পয়সা চুরি করে ব্যাপারটা নিছক চোরের কাণ্ড বলে প্রতিপন্ন করতে চাইল। জেমস বেন্টলীর ওপর খুনের দায় বর্তালো। নিশ্চিন্ত হল রবিন।
আমি তারপর মিসেস আপওয়ার্ডকে সানডে কম্প্যানিয়ন এর চারখানা ছবি দেখালে উনি সেগুলোর মধ্যে ইভা কেনকে পরিষ্কার চিনতে পারলেন। কারণ তিনি আগেই এ ফটোটা দেখেছেন রবিনের কাছে। তার মায়ের ফটো সে দেখিয়েছে, তার সঙ্গে এ ছবি হুবহু এক। সন্দেহে রাগে ভদ্রমহিলা দিশেহারা হয়ে গেলেন। অথচ রবিনকেও পুরোপুরি তিনি অবিশ্বাস করতে পারছিলেন না।
ব্যাপারটা জানতে পারার পর আর দেরি করতে পারল না রবিন। থিয়েটারে যাওয়া, জ্যানেটের ছুটি নেওয়া, টেলিফোন, কফির কাপ, লিপষ্টিক, সেন্ট সবই পূর্ব পরিকল্পিত। যখন রবিন মিসেস অলিভারকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে বাড়িতে ঢোকে দ্বিতীয়বার, তখনই সুযোগটা নেওয়া হয়। তার সময় লাগে খুন করতে মাত্র কয়েক মিনিট। আর মৃত্যুর পর মিসেস আপওয়ার্ডের স্বাভাবিকভাবে সব সম্পত্তির মালিক রবিনই। সকলেই ভাববেন যে, একজন ভদ্রমহিলা খুন করেছেন। সব সন্দেহের ঊর্ধে থাকবে রবিন।
কিন্তু মারাত্মক ভুল করেছিল সে দুটো।
প্রথম বই আর দ্বিতীয় ছবিটার ব্যাপারে। তার দুটোই নষ্ট করে ফেলা উচিত ছিল। রবিন ভেবেছিলেন মরিন পালিতা কন্যা সুতরাং ওঁর কাছে ছবিটা পাওয়া গেলে ইভা কেনের মেয়ে বলে ভাবা শক্ত হবে ওঁকে। অবশ্য যখন রবিন জানতে পারল মিস হেণ্ডারসন অকুস্থলে সেই রাতে গিয়েছিলেন, তখন ওর বাড়িতেই ছবিটা রাখা যুক্তিযুক্ত হবে বলে মনে করে। কিন্তু মই বেয়ে উঠে জানলা খোলার চেষ্টা করার সময় মড উইলিয়ামসের নজরে পড়ায় তাকে সেই চেষ্টা বাতিল করতে হয়। এরপর মরিনের দেরাজে সে ফটোটা রাখার সুযোগ পায়। বুঝেছিলাম আমি, যে দুবার আমি দেরাজ দেখেছিলাম তার মধ্যবর্তী সময়ের স্বল্প ফাঁকটুকুতে একজনের পক্ষেই ফটোটা রাখা সম্ভব সে হল রবিন। সেই সময় ও বাড়ির বৈঠকখানার ঠিক ওপরের ঘরটাতেই রবিন ছিল।
ইভলিন হোপ বইতে নামটা দেখে আমি মিসেস আপওয়ার্ড আর রবিন দুজনকেই সন্দেহ করি। পরে অবশ্য একবার যে ইভ কার্পেন্টারের কথা মনে হয়নি তা নয়। তবু শেষ পর্যন্ত হঠাৎ খেয়াল হল যে ইভলিন নামটা, ছেলে বা মেয়ে যে কারুরই হতে পারে।
কালেনকোয়েতে মিসেস অলিভারের সাথে মাইকেল নামে একজন উদীয়মান অভিনেতার আলাপ হয়। ওঁদের দুজনের কথাবার্তার বিবরণী শুনে মনে হয় আমার হয়ত সত্যি কথাটা মাইকেল জানে। যাই হোক আদত ব্যাপারটা অনেক আগেই ধরতে পারা উচিত ছিল আমার। একজন কেউ আমাকে একবার রেল লাইনের ওপর ধাক্কা দিয়েছিল, ভেবেছিলাম ধাক্কা দিয়েছে মিসেস ম্যাগিনটির হত্যাকারীই। কিন্তু স্টেশনে ওই সময় রবিনের উপস্থিতি একান্তই অসম্ভব ছিল।
হেসে উঠলেন জনি সামারহেস, হয়ত ধাক্কাটা কোনো বৃদ্ধ ভদ্রমহিলা অসতর্কভাবে দিয়েছিলেন।
পোয়ারো বললেন তাই হবে। এত প্রবল রবিনের আত্মবিশ্বাস যে, সে গ্রাহ্যই করেনি আমার উপস্থিতি।
মিসেস অলিভার শিউরে উঠলেন।
-মানে আপনি বলছেন যে, আমায় গাড়িতে বসিয়ে রেখে গিয়ে রবিন খুনটা করে এল আর আমি তা ধরতেও পারলাম না।
হাসলেন পোয়ারো।–মাদাম, আপনার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়টা সেই সময় তেমন কাজ করেনি।
.
২৭.
মড উইলিয়মস বলল, আমি আর ব্রিদার অ্যাণ্ড স্কাটল এ ফিরে যাচ্ছি না। বাজে জায়গা।
পোয়ারো বললেন, যাকগে কাজ তো আপনার হয়ে গেছে।
–আপনি কি বলতে চান। মঁসিয়ে পোয়ারো?
–এখানে এসেছিলেন কেন আপনি?
–সবজান্তা তো আপনি। কিছুই কি বুঝতে পারছেন না?
–বোধহয় কিছুটা পারছি।
–কি বলুন তো?
-যদি আমার খুব ভুল না হয়, তাহলে এড়া সেদিন রাতে মিসেস আপওয়ার্ডের বাড়ির সামনে যাকে দেখে সে আপনি। যদিও মিসেস কার্পেন্টার ভেবেছে সবাই।
–কেন, আমি কেন?
–আমার একটা কথার জবাব দিন তো দেখি। আপনার এত কৌতূহল কেন ব্রডহিনির ব্যাপারে? সেদিন কেনই বা রবিনের অটোগ্রাফ চেয়েছিলেন? অটোগ্রাফ শিকারী বলে তো মনে হয় না আপনাকে দেখে। আপনি আপওয়ার্ডের সম্বন্ধে কতটুকু জানেন? কি করেই বা জানলেন যে ইভা কেন ইংল্যাণ্ড ছাড়ার সময় কি নাম নিয়েছিল আর সে অষ্ট্রেলিয়ায় মারা যায়।
-বাঃ চমৎকার কল্পনা শক্তি আপনার। যাকগে আর কিছু লুকাবো না আমি।
মড হাত ব্যাগ খুলে একটা ছোট্ট বিবর্ণ কাগজের কাটিং বের করল। পোয়ারোর খুব চেনা কাগজটা। ইভা কেনের ছবি। আড়াআড়িভাবে ছবির ওপর লেখা আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য এই মহিলাটিই দায়ী…
-মডের হাতে কাগজটা প্রত্যর্পন করলেন পোয়ারো।
মিস উইলিয়মস, আমিও ভেবেছিলাম তাই, আসল পদবী আপনার ক্রেগ, তাই না?
–হ্যাঁ। আমাদের একজন সহৃদয় আত্মীয় আমায় মানুষ করেন। কিন্তু আমি তখন নিতান্ত ছেলে মানুষ ছিলাম না। কিন্তু সব কিছুই বুঝতাম। মহিলাটি, ঐ ইভা কেন, এক জঘন্য চরিত্রের নারী। আর নেহাতই দুর্বল চরিত্রের মানুষ ছিলেন আমার বাবা। আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য আসলে ইভা কেনই দায়ী। আমার দুর্বল, ভালোমানুষ বাবা পা দেন ওর ফাঁদে। কতদিন ধরে যে ওই ইভাকে আমি খুঁজে বেড়িয়েছি, এমন কি বড় হয়ে গোয়েন্দা পর্যন্ত লাগিয়েছি, তাদের কাছেই জানতে পারি যে অষ্ট্রেলিয়ায় যায় ইভা, সেখানে ছেলে হয় তার, যার নাম ইভলিন হোপ। অষ্ট্রেলিয়াতেই মারা যায় ইভা। এরপর আমার বন্ধুত্ব হয় মাইকেলের সাথে। তার কাছে জানতে পারি অষ্ট্রেলিয়া থেকে জনৈক ইভলিন হোপ এসেছে এখানে এবং এখন তার নতুন নাম রবিন আপওয়ার্ড, যে নাকি বর্তমানে একজন উদিয়মান নাট্যকার। কিন্তু দমে যায় আমার কৌতূহল যখন শুনি যে সে তার মায়ের সঙ্গে আছে। শুনে অবশ্য মনে হয়েছিল আমার যে তাহলে ইভা মারা যায়নি, উপরন্তু রানীর হালে দিন কাটাচ্ছে। আমি এই অঞ্চলে তখন চাকরি নিই। তারপর আপনার সাথে আলাপ হতে আপনি বলেন বেন্টলীর কথা, আমার তখুনি মনে হয় মিসেস আপওয়ার্ড, ওরফে ইভা কেন, একটা খুন করেছে আবার। বাড়িতে সেই রাতে আর কেউ থাকবে না জেনেই ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমি মোকাবিলা করতে যাই। ছোট্ট একটা পিস্তল ছিল আমার সঙ্গে। নিছকই ভয় দেখাবার উদ্দেশ্য….অথবা…যাক গে, দরজায় ধাক্কা দিয়ে দেখি দরজা খোলা। তারপর আবিষ্কার করি যে ভদ্রমহিলা মৃতা। বড় নাটকীয় দৃশ্য সবটাই। লোক জানাজানির ভয়ে পুরো ব্যাপারটা চেপে যাই। কেউ যে আমায় দেখেছে তা আমি ভাবতেই পারিনি। এবার বলুন, আপনি এখন কি করবেন?
পোয়ারো বললেন, কিছু না। আপনার শুভকামনা করি আমি, ব্যস।
.
পরিশিষ্ট
এরকুল পোয়ারো আর সুপারিন্টেডেন্ট স্পেন্স ভিলি গ্র্যাণ্ডমেয়ার রেস্তোরাঁয় বসে কফি পান করছিলেন।
স্পেন্স বললেন, যাক, তাহলে সব ভালোয় ভালোয় মিটে গেল।
–মিঃ স্পেন্স মনে আছে আপনার, আমি প্রথম দিন এখানেই খাওয়া সেরেছিলাম, আপনি যেদিন প্রথম এসেছিলেন আমার কাছে এই কেসটা নিয়ে?
-হা, মঁসিয়ে পোয়ারো। সব কিছু আপনি কেমন ছবির মত আমাদের বুঝিয়ে দিলেন। শেষ মুহূর্তে রবিন তার স্বীকারোক্তি না দিলে অবশ্য খুব মুশকিল হত আমাদের। যথার্থ প্রমাণ বলতে তো হাতে বিশেষ কিছু ছিল না। অনুমান নির্ভর ব্যাপার সবটাই।
হু হু, ওকে আমি একটু খেলাচ্ছিলাম। ধরেই নিয়েছিল রবিন যে, আমি মরিনকে সন্দেহ করছি। আসলে ও একটা মূর্খ, ভীতু। আমার হাতে মুষলটা দেখায় ভীষণ ভয় ওকে গ্রাস করে ফেলেছিল, আর এই স্বীকারোক্তি তারই দরুন।
-কিন্তু মেজর সামারহেস খুব চটে গিয়েছিলেন, উনি আশাকরি ক্ষমা করে দিয়েছেন আপনাকে।
-হা হা, পরস্পর এখন আমরা ঘনিষ্ট বন্ধু। একটা প্রাকপ্রণালী কিনে মরিনকে উপহার দিয়েছি। আবার ওমলেট ভাজতেও শিখিয়েছি। ওঃ, যা আমার খাওয়ার কষ্ট গেছে।
-কদিন খুব গণ্ডগোল হল। অমন কেন মিসেস কার্পেন্টার চেঁচাচ্ছিল জানেন? একটু গোলমেলে ওঁর অতীতটা। উনি প্রথম জীবনে সস্তাদরের নর্তকী ছিলেন। একগাদা পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে অবাধ মেলামেশা ছিল। এখানে বিয়ের পর সুখী উনি এখন কিন্তু ওঁর খুব ভয় ছিল কেউ যদি বিগত জীবন সম্বন্ধে কিছু জেনে ফেলে।
তারপর ধরুন গিয়ে ওয়েদারবিদের কথা। কি অদ্ভুত মেয়েটি, ওর এক পিসীমা প্রচুর টাকাকড়ি দিয়ে গেছেন। সেগুলো হাত ছাড়া হবার ভয়ে ওর মা আর সৎপিতা ওকে বিয়েও করতে দিতে চান না। কাজকর্মে তো ভদ্রলোকটি একেবারে অপদার্থ। ওই মেয়েটিই সব খরচ করে। স্বামী স্ত্রী কেউই তেমন সুবিধের নন।
পোয়ারো ঘাড় নাড়লেন।–ঠিক, সমর্থন করি আপনার মতামত। ভাগ্যিস টাকা পয়সা আছে মেয়েটির। ওর জেমস বেন্টলীর সংগে বিয়েটা নির্বিঘ্নেই হয়ে যাবে।
সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্পেন্স আশ্চর্য হয়ে গেলেন।
কি বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো জেমস বেন্টলীর সংগে বিয়ে? ডীডার হেণ্ডারসন? কে বলল?
-আমি বলছি। আমিই ঘটকালিটা করলাম বলতে পারেন। আমি বিয়েটাও দেব ওরা দুজন অবশ্য এখনো জানেই না। কিন্তু দুজন দুজনকে পছন্দ করে। অথচ দায়িত্ব ওদের ওপর ছেড়ে দিলে কিছু হবে না। তাই উদ্যোগী হতে হবে আমাকেই। দেখবেন, কি করি শেষ পর্যন্ত।
-ওঃ আপনার আর অভ্যেস গেল না পরের ব্যাপারে নাক গলানোর।
–কি করব বলুন? ওটা যে আবার আপনার দ্বারা হয় না একেবারেই।
–আমায় খোঁচাচ্ছেন আবার। বেন্টলী যেন কেমন ছেলেটা।
–তা যা বলেছেন। এখন হয়ত ও দুঃখে মরে যাচ্ছে ফাঁসিটা হল না বলে।
আপনার কাছে ওর উচিত নতজানু হয়ে কৃতজ্ঞতা জানানো।
–নিজে কিন্তু বেন্টলী তা মনে করেন না।
–হ্যাঁ, যা ছেলে।
-ওর সম্বন্ধে দুটি মহিলা উৎসাহী। আমি তো ভাবছিলাম আপনি ওর বিয়েটা মডের সঙ্গেই লাগিয়ে দেবেন।
বেন্টলীকে পছন্দ করতে দেওয়া হলে ও পছন্দ করবে মিস হেণ্ডারসনকেই বড় ছটফটে মড, বড় বেশি উৎসাহী। ওকে বিয়ে করলে বেন্টলী নিজেকে আরও গুটিয়ে রাখবে।
আমার মাথায় এটা কিছুতেই ঢুকছে না যে কেউ বেন্টলীকে বিয়ে করতে চাইবেই বা কেন?
-সেটাই তো রহস্য মিঃ স্পেন্স।
–যাগগে, যা ভালো বোঝেন করুন। দেখবেন, আপনাকে মিসেস ওয়েদারবি শেষ করে দেবেন।
-ভালো কাজ করতে গেলে বাধা আসবেই।
-শুনুন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি আপনাকে একটা কথা জানাতে চাই, মনে আছে ডঃ রেগুলের কথা?
নিশ্চয়ই।
–ওঁর সম্পর্কে তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারলাম যে, ওঁর প্রথমা স্ত্রী লীডসে মারা যান তখন ওখানেই প্র্যাকটিস করতেন ডঃ রেগুল। পুলিশ কিন্তু উড়ো চিঠি পায়। তাতে বলা ছিল যে, নিজের স্ত্রীকে ডঃ রেগুলই বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছেন। একই কথা বলতেন প্রতিবেশীরাও। বাইরের যে ডাক্তার পরীক্ষা করেন ভদ্রমহিলাকে তিনিও সন্দিহান ছিলেন মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে। মোটা জীবনবীমা ছিল ভদ্রমহিলার। নমিনি ছিলেন স্বামী ডঃ রেগুল, কাজেই বুঝতে পারছেন….।
মিসেস রেগুলের ভয় চকিত দৃষ্টির কথা মনে পড়ে গেল পোয়ারোর। নিজের হাতের উড়ো চিঠির দিকে ভদ্রমহিলা তাকিয়ে বলেছিলেন, আমি এসব বিশ্বাস করি না, বিশ্বাস করি না…
পোয়ারো বললেন, শুধু উড়ো চিঠি পুলিশই পায়নি। স্পেন্স বললেন, তার মানে ভদ্রমহিলাও পেয়েছেন?
জবাব দিলেন পোয়ারো, তাই মনে হয় আমার। ব্রডহিনিতে আমাকে আসতে দেখে মিসেস রেগুল ভেবেছিলেন আমি ওর স্বামীর পিছু নিয়েছি। তাই ভেবেছিলেন ভদ্রলোকও। আমায় ডঃ রেগুলই সেদিন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পেছন থেকে রেললাইনের ওপর ধাক্কা দিয়ে ফেলতে চান।
-বুঝতে পারছি, এই স্ত্রীকেও হয়ত উনি একইভাবে মারবেন।
–হ্যাঁ। বিশেষত যদি জীবনবীমা থাকে মোটা টাকার। কিন্তু যদি উনি বুঝতে পারেন যে, ওঁর ওপর পুলিশ নজর রাখছে, তাহলে আর কোনো ঝুঁকি নেবেন না উনি।
-দেখি, কতদূর কি করতে পারি। ওঁকে আমরা বুঝিয়ে দেব যে, আমাদের নজর আছে ওঁর ওপর।
–আসুন, মিসেস অলিভারের সুস্বাস্থ্য কামনা করে গ্রহণ করা যাক পানীয়টা।
–কেন মিসেস অলিভার?
–ওঁর বরাবরই ডঃ রেগুলের ওপর একটা অদ্ভুত সন্দেহ ছিল।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর ধীরে ধীরে স্পেন্স বললেন, আগামী সপ্তাহে রবিনের মামলার শুনানী শুরু। মঁসিয়ে পোয়ারো, এখনো অল্প অল্প সন্দেহ হচ্ছে যে আমার….
শশব্যস্তে তাকে পোয়ারো থামিয়ে দিলেন।
–মিঃ স্পেন্স, আপনার এখনো সন্দেহ গেল না? রবিন সত্যিই দোষী। আবার তদন্ত শুরু করার দাবী জানাবেন না দয়া করে।
সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্পেন্স এক গাল হাসলেন।
-না না, মঁসিয়ে পোয়ারো সত্যিই রবিন খুনী। আর কোনো সন্দেহই আমার নেই, সব রকম অপকর্মই করা সম্ভব ওর দ্বারা।