দীর্ঘ সময় কথা বলে তারা সবাই মিলে একটা পরিকল্পনা করল। পরিকল্পনা শেষে বিকনের সুইচটি অন করে নায়ীরা সেটি তিহানের হাতে দিয়ে বলল, এটা এখন তোমার কাছে রাখ।
তিহান সেটা হাতে নিয়ে বলল, ঠিক আছে।
বিজ্ঞান কেন্দ্রের মানুষগুলো এই বিকনের সিগন্যাল অনুসরণ করে আসবে। কাজেই তোমার ওপর এখন অনেক দায়িত্ব।
তিহান বলল, আমি আমার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করব, তুমি নিশ্চিন্ত থাক।
নায়ীরা বলল, আমার হিসাবে দুই ঘণ্টার ভেতর উদ্ধারকারী দল চলে আসবে।
আমরা সবাই প্রস্তুত।
উদ্ধারকারী দল আশা করবে একটি মৃত্যু উপত্যকা। তারা ধরে নেবে তোমরা সবাই মারা গেছ।
তুমি চিন্তা করো না, নায়ীরা। তারা যা আশা করছে ঠিক সেটাই দেখতে পাবে। আমরা সব জায়গায় খবর পাঠিয়ে দিয়েছি। আজ কেউ ঘর থেকে বের হবে না। এখানে কোথাও কোনো প্রাণের চিহ্ন দেখতে পাবে না। যারা বের হবে তারা মৃত সেজে পথেঘাটে পড়ে থাকবে।
চমৎকার! যাদের মৃতের ভূমিকায় অভিনয় করার কথা তারা সবাই কি বের হয়েছে?
হ্যাঁ, বের হয়েছে। মাঠে-ঘাটে, ঘরে-বাইরে তারা আগামী কয়েক ঘণ্টা মৃত মানুষের মতো পড়ে থাকবে। হেলিকপ্টার থেকে দেখে পৃথিবীর মানুষেরা এতটুকু সন্দেহ করবে না।
চমৎকার! মনে থাকে যেন, এটা আমাদের শেষ সুযোগ।
আমরা এ সুযোগ নষ্ট করব না।
নায়ীরা একটা মাটির ঘরের ভেতর আশ্রয় নিয়েছে। হেলিকপ্টার দখল করার সময় একটা সংঘর্ষ হতে পারে, গোলাগুলি হতে পারে, সে তার মধ্যে থাকতে চায় না। কোনোভাবে তার শরীরের এতটুকু কেটে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এখানে যত বড় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হোক না কেন, তার শরীর থেকে কোনো রক্ত বের হতে পারবে না। এক ফোঁটাও না।
নায়ীরা ছোট ঘরটির ভেতর অস্থির হয়ে অপেক্ষা করতে করতে যখন ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেল, ঠিক তখন অনেক দূরে একটা হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পেল। বিকনের সিগন্যাল অনুসরণ করে এটা এগিয়ে আসছে। নায়ীরা মাটির ঘরের ছোট জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে হেলিকপ্টারটা দেখতে পায়, খামের ওপর দুবার ঘুরে সেটা কাছাকাছি একটা মাঠে নেমে এল। ইঞ্জিনটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর দরজা খুলে ডজনখানেক মানুষ নেমে আসে। মানুষগুলোর হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। তারা হেলিকপ্টারটি ঘিরে দাঁড়িয়ে এদিক-সেদিক তাকায়। চারপাশে অসংখ্য মৃতদেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, অবমানবের মৃতদেহ, ঠিক যেরকম হওয়ার কথা।
সশস্ত্র চার জন মানুষ তাদের যোগাযোগ মডিউল হাতে নিয়ে বিকনটির অবস্থান নির্দিষ্ট করে নেয়। দলপতি মাইক্রোফোনে কথা বলে সাবধানে অগ্রসর হতে থাকে। সশস্ত্র মানুষগুলো একটা বড় পাথরের আড়ালে হেঁটে যেতে থাকে। তারা তখনো জানে না যে সেখানে তাদের জন্য তিহান আট জন সুঠাম তরুণকে নিয়ে অপেক্ষা করছে। নায়ীরা নিঃশব্দে তাদের লক্ষ করে, এখনো সবকিছু তাদের পরিকল্পনামতো ঘটছে। আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই চূড়ান্ত আক্রমণটি ঘটে যাওয়ার কথা।
বড় একটা পাথরের আড়ালে ছোট একটা মাটির ঘরের সামনে গিয়ে সশস্ত্র মানুষগুলো থমকে দাঁড়াল, এই মাটির ঘরের ভেতর থেকে বিকনের সিগন্যাল আসছে। সশস্ত্র মানুষদের একজন হাতে অস্ত্র নিয়ে ডাকল, রিশি, তুমি বের হতে পার। তোমার কোনো ভয় নেই, আমরা তোমাকে উদ্ধার করতে এসেছি।
ঠিক সেই মুহূর্তে আট জন সুঠাম তরুণ সশস্ত্র মানুষগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কী হচ্ছে বোঝার আগেই তারা নিচে পড়ে গেছে এবং বিদ্যুগ্মতিতে তাদের অস্ত্রগুলো কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
একই সময় দ্বিতীয় দলটি হেলিকপ্টারের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা অন্যদের আক্রমণ করেছে। কিছু বোঝার আগেই তারাও বন্দি হয়ে গেল। হেলিকপ্টারের ভেতরে যারা ছিল তারা গোলাগুলি করার চেষ্টা করল, কিন্তু কোনো লাভ হল না। এই গ্রামের কিছু তরুণ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে গুলি করতে করতে হেলিকপ্টারটি দখল করে নিয়েছে। নায়ীরাকে সেই খবরটি দেওয়ার জন্য কিছুক্ষণের মাঝেই তিহান নিজে এসে উপস্থিত হল। নায়ীরা নিশ্বাস বন্ধ করে জিজ্ঞেস করল, হেলিকপ্টারটি দখল হয়েছে?
হ্যাঁ, নায়ীরা, দখল হয়েছে।
গোলাগুলির শব্দ শুনলাম, কারো গায়ে কি গুলি লেগেছে?
আমাদের কারো গায়ে গুলি লাগে নি। তাদের দুজন গুলি খেয়েছে।
তাদের কী অবস্থা?
অবস্থা খারাপ নয়। চামড়া স্পর্শ করে গেছে। একেবারেই গুরুতর কিছু নয়।
সবাইকে বেঁধেছ?
হ্যাঁ। সবাইকে বেঁধেছি।
চমৎকার! যারা হেলিকপ্টারে তাদের কী করেছ?
তাদেরকেও শক্ত করে বাঁধা হয়েছে। আমার ধারণা, তাদের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানুষও আছে।
চমৎকার! হেলিকপ্টারে যত বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানুষ থাকবে আমাদের জন্য তত ভালো।
তুমি এখন হেলিকপ্টারটিতে যেতে চাও?
হ্যাঁ, যেতে চাই। কিন্তু আমি খালি হাতে যেতে চাই না। আমাকে একটা ছোট অস্ত্র দাও। কেমন করে সেটা ব্যবহার করতে হয় সেটাও শিখিয়ে দিতে হবে।
তিহান একটু হাসল। বলল, অস্ত্র কেমন করে ব্যবহার করতে হয় আমরাও খুব ভালো জানতাম না। একটু আগে চেষ্টা চরিত্র করে শিখে নিয়েছি। এস তোমাকেও শিখিয়ে দেব।
.
নায়ীরা হেলিকপ্টারে ঢুকে দেখল ভেতরে চার জন মানুষকে তাদের সিটের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। চার জনই খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। বিজ্ঞান কেন্দ্রের প্রধান রুবা, সামরিক বাহিনীর কমান্ডার গ্রুশান, নিরাপত্তা বাহিনীর মহাপরিচালক জিনা এবং চিকিৎসা কেন্দ্রের ড. ইলাক। পাইলটকে বাঁধা হয় নি, কিন্তু তার মাথায় একজন তরুণ একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ধরে রেখেছে। নায়ীরাকে হেলিকপ্টারে উঠতে দেখে বেঁধে রাখা চার জন মানুষ ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। রুবা বলল, তু-তুমি?
নায়ীরা হাসার চেষ্টা করে বলল, হ্যাঁ। আমি। বিজ্ঞান কেন্দ্রের প্রধান রুবা, আমি।
তুমি কেমন করে?
সেটা নিয়ে আলাপ করার অনেক সময় পাওয়া যাবে। নায়ীরা পাইলটের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি এই হেলিকপ্টারটি নিয়ে টেলিস শহরে যেতে চাই। তোমার কোনো আপত্তি আছে?
পাইলট মাথা নাড়ল। বলল, না! নেই।
চমৎকার! তোমাকে শুধু একটা জিনিস মনে করিয়ে দিতে চাই, আমি দু সপ্তাহের ভেতর মারা যাচ্ছি। যে দু সপ্তাহের ভেতর মারা যাবে সে দু সপ্তাহ আগেও মরতে খুব একটা ভয় পায় না, তাকে কোনো রকম ভয়ভীতি দেখানো যায় না। তাই আমি আশা করব তুমি অন্য কিছু করার চেষ্টা করবে না।
পাইলট মাথা নাড়ল। বলল, করব না।
তুমি যদি তোমার কথা রাখ, তা হলে তুমি তোমার সন্তানদের কাছে বলতে পারবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অবিচারটি দূর করতে তুমি সাহায্য করেছ।
আমি বুঝতে পারছি।
সেইসঙ্গে এ কথাও বলতে পারবে যে, পৃথিবীর জঘন্যতম চার জন অপরাধীকে তুমি আইনের হাতে তুলে দিয়েছিলে।
ড. ইলাক দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, তুমি বোকার স্বর্গে বাস করছ। টেহলিস শহরের একটি মানুষও তোমার কথা বিশ্বাস করা দূরে থাকুক, তোমার কথা শুনতেও রাজি হবে না। হেলিকপ্টারটি মাটিতে নামার তিন মিনিটের মধ্যে কমান্ডো বাহিনী তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে। পৃথিবীর কোনো মানুষ তোমাকে খুঁজে পাবে না মেয়ে।
আমার নাম নায়ীরা।
ক্লোনদের কোনো নাম হয় না।
নায়ীরা একটু এগিয়ে তার রিভলবারটি ড. ইলাকের মাথায় ধরল। সেফটি ক্যাচ টেনে বলল, আমার নাম নায়ীরা।
ড. ইলাক হঠাৎ দরদর করে ঘামতে থাকে। নায়ীরা হিংস্র গলায় বলল, আমি ট্রিগার টেনে তোমার মতো নরকের কীটকে হত্যা করে এই মুহূর্তে পৃথিবীটাকে আগের চাইতে একটু ভালো একটা গ্রহে পাল্টে দিতে পারি। আমি কখনো একটি পোকাও মারি নি। কিন্তু তোমাকে হত্যা করতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা হবে না। তুমি দেখতে চাও?
ড. ইলাক ফ্যাকাসে মুখে বলল না, আমি দেখতে চাই না। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি দেখতে চাই না, নায়ীরা।
নায়ীরা রিভলবারটি সরিয়ে এনে বলল, এটি বিচিত্র কিছু নয় যে পৃথিবীর সব অপরাধীই আসলে কাপুরুষ। সে হেলিকপ্টারের ভেতর অস্ত্র হাতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তরুণদের বলল, তোমরা এখন নেমে যাও। আমি এখন রওনা দিতে চাই।
তিহান এগিয়ে এসে বলল, আমি কি তোমার সঙ্গে আসব?
না, তিহান। আমি একা যেতে চাই।
যদি তোমার কোনো বিপদ হয়?
সেজন্যই আমি একা যেতে চাই।
ঠিক আছে। বিদায় নায়ীরা।
বিদায়।
অস্ত্র হাতে তরুণগুলো নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হেলিকপ্টারের ইঞ্জিনটি গর্জন করে ওঠে। গ্রামটির ওপরে একবার পাক খেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে সেটা দক্ষিণ দিকে টেহলিস শহরের দিকে ছুটে যেতে থাকে। নদীতীরের একটি গ্রামে হাতবাধা মোল জন সেনাসদস্য এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে তাদেরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা কৌতূহলী শিশু-কিশোর, তরুণ তরুণীদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা শুনে এসেছে অবমানবরা বিকলাঙ্গ এবং হিংস্র। খুনি এবং রক্তপিপাসু। বিকৃত এবং ভয়ংকর। কিন্তু সেটি সত্য নয়, তারা একেবারেই সাধারণ। তারা সহজ এবং সরল। তারা সুদর্শন এবং সুঠাম। তারা বুদ্ধিমান এবং কৌতূহলী। একজন বৃদ্ধা তাদের পানীয় দিয়ে গেছে, তাদের ক্ষতস্থান ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। তাদের সাময়িক অসুবিধার জন্য ক্ষমা চেয়ে গেছে। কোথাও কিছু একটা গোলমাল আছে, সেটি কী সেনাসদস্যরা তা বুঝতে পারছে না।
.
হেলিকপ্টারের ভেতর পাইলট নায়ীরাকে জিজ্ঞেস করল, টেহলিস শহরে তুমি কোথায় যেতে চাও?
কেন্দ্রীয় প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
পাইলট অবাক হয়ে বলল, কেন্দ্রীয় প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে?
হ্যাঁ, তুমি কি সেখানে একটি খবর পাঠাতে পারবে?
পারব। প্রতিরক্ষা দপ্তরের কমপক্ষে এক ডজন রাডার এই মুহূর্তে আমাদের হেলিকপ্টারটিকে লক্ষ করছে। আমাদের প্রত্যেকটি কথা শুনছে।
চমৎকার! তুমি তাদের বলো আমি কেন্দ্রীয় প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাকাশবিজ্ঞান বিভাগের বিজ্ঞানী নীরা ত্রাতিনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।
হেলিকপ্টারের পেছনে বসে থাকা চার জন ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল। পাইলট ইতস্তত করে বলল, তুমি যদি কিছু মনে না কর নায়ীরা, আমাকে বলবে, কেন তুমি একজন মহাকাশবিজ্ঞানীর সঙ্গে দেখা করতে চাও?
আমি মহাকাশবিজ্ঞানী নীরা ত্রাতিনার সঙ্গে দেখা করতে চাই না। আমি আসলে মানুষ নীরা ত্রাতিনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। তার কারণ আমাকে এই মানুষটি থেকে ক্লোন করা হয়েছে। আমার ধারণা, আমি কী বলতে চাই সেটি তার থেকে ভালো করে কেউ বুঝবে না। কারণ আমি আর সে আসলে একই মানুষ।
পাইলট কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকিয়ে ছিল বলে জানতে পারল না হেলিকপ্টারে সিটে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা বিজ্ঞান কেন্দ্র এবং প্রতিরক্ষা দপ্তরের চার জন সর্বোচ্চ কর্মকর্তার মুখ হঠাৎ করে রক্তহীন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
.
নীরা ত্রাতিনা স্টেইনলেস স্টিলের বায়ুশূন্য চেম্বারে ভাসমান ক্রোমিয়াম গোলকটির দিকে তাকিয়ে থেকে অতিবেগুনি রশ্মির একটি পালস পাঠাল। সিলিকন ডিটেক্টরটি পালসটিকে একটি বৈদ্যুতিক পালস্ হিসেবে তথ্য সংব্রক্ষণকারী কম্পিউটারে সংরক্ষণ করছে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে নীরা ত্রাতিনা সন্তুষ্টির শব্দ করে বলল, চমৎকার! নিখুঁত ডিজাইন।
পাশে দাঁড়িয়ে টেকনিশিয়ান বলল, তোমার ডিজাইন সব সময় নিখুঁত।
উঁহু। তিরিশ সালে স্পেসশিপে একটা বায়ুনিরোধক যন্ত্র তৈরি করেছিলাম, ল্যান্ডিংয়ের সময় ভেঙেচুরে ভয়ংকর অবস্থা।
নীরা ত্রাতিনা ঘটনাটার একটা বর্ণনা দিতে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক তখনই তার টেলিফোন বেজে উঠল। টেলিফোনের স্ক্রিনে মানুষটির চেহারা অপরিচিত। শুধু যে অপরিচিত তা নয়, দেখে মনে হয় মানুষটি সামরিক বাহিনীর। একটু বিস্ময় নিয়ে সে বলল, নীরা ত্রাতিনা কথা বলছি।
প্রফেসর ত্রাতিনা। তোমাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি? কথা দিচ্ছি এক মিনিট থেকে এক সেকেন্ড বেশি সময় নেব না।
ঠিক আছে। বলো।
তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসীদের হাইজ্যাক করা একটা হেলিকপ্টার নেমেছে। আমাদের কমান্ডো দল ভেতরে ঢোকার জন্য রেডি। তাদের অর্ডার দেওয়ার আগে তোমার সঙ্গে কথা বলে নিতে চাইছি।
নীরা ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসীরা কেন হেলিকপ্টার হাইজ্যাক করে নামাবে?
সেটা আমাদের জন্যও একটা রহস্য।
আর যদি নামিয়েই থাকে আইন রক্ষাকারী তাদের নিয়মমতো সিদ্ধান্ত নেবে। আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছ?
সেনা কর্মকর্তা একটু ইতস্তত করে বলল, তার কারণ হেলিকপ্টারের হাইজ্যাকার বলেছে সে তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়!
আমার সঙ্গে? নীরা ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, আমার সঙ্গে কেন?
সেটাও একটা রহস্য। যাই হোক, আমরা আইন রক্ষাকারী দপ্তর আগেও কখনো সন্ত্রাসী বা হাইজ্যাকারদের দাবিদাওয়া মানি নি, এখনো মানব না। আমরা এখনই আক্রমণ করতে যাচ্ছি।
ঠিক আছে কর।
ধন্যবাদ প্রফেসর।
ধন্যবাদ। নীরা ত্রাতিনা টেলিফোনটা বন্ধ করতে গিয়ে থেমে গেল। বলল, অফিসার।
বলো।
হাইজ্যাকারদের পরিচয় কী?
সেনা কর্মকর্তা একটু ইতস্তত করে বলল, সেটা আরেকটা রহস্য।
নীরা ভুরু কুঁচকে বলল, কী রকম রহস্য?
আমরা তার পরিচয় বের করতে পারি নি।
নীরা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল, পরিচয় বের করতে পার নি? ডাটাবেসে তার সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই?
ডাটাবেসে দেখতেই পাচ্ছি না। তার শরীরে ট্রাকিওশান সিগন্যাল নেই।
মানে?
মানে সেটাই। এই হাইজ্যাকারের কোনো পরিচয় পৃথিবীতে নেই।
সেটা কেমন করে হয়?
তা আমরা জানি না। কিন্তু তাই হয়েছে। তবে তুমি এটা নিয়ে চিন্তা করো না। আর দশ মিনিটের ভেতর আমরা এই রহস্যের সমাধান করে ফেলব। জীবিত কিংবা মৃত এই হাইজ্যাকারকে ধরে আনব।
হাইজ্যাকারের বয়স কত?
গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে পনের-ষোল বছরের বেশি নয়।
নীরা ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, এত ছোট?
আরো বেশি হতে পারে। মেয়েদের গলার স্বর শুনে সব সময় বয়স অনুমান করা যায়।
নীরা চমকে উঠে বলল, মেয়ে?
ও আচ্ছা! তোমাকে বলা হয় নি? হ্যাঁ, হাইজ্যাকার একটা মেয়ে।
নীরা শীতল গলায় বলল, তোমার কমান্ডোদের অপেক্ষা করতে বলে। আমি আসছি।
সেনা কর্মকর্তা ব্যস্ত হয়ে বলল, তুমি এসে কী করবে? এটা আইন রক্ষাকারীদের ব্যাপার। আমাদের দায়িত্ব আমাদের পালন করতে দাও।
পনের-ষোল বছরের একটি মেয়ে সেনাদপ্তরের একটা হেলিকপ্টার হাইজ্যাক করে ফেলেছে, তার অর্থ, তোমরা নিশ্চয়ই তোমাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন কর নি। যাই হোক, কেউ যেন হেলিকপ্টারে না ঢোকে। আমি আসছি।
সেনা কর্মকর্তা বিরস মুখে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, নীরা ত্রাতিনা তাকে সে সুযোগ দিল না। টেলিফোনের লাইন কেটে উঠে দাঁড়াল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা টেকনিশিয়ানকে তার যন্ত্রটা দেখিয়ে বলল, তুমি এটাকে ক্যালিব্রেট কর। আমি আসছি।
কেন্দ্রীয় প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে একটা বিশাল হেলিকপ্টার দাঁড়িয়ে আছে। হেলিকপ্টারটি ঘিরে নিরাপত্তা বাহিনীর অসংখ্য গাড়ি। নীরা ত্রাতিনা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা অসহিষ্ণু কমান্ডো দলটিকে দেখতে পেল, সে অনুমতি দেয় নি বলে তারা ভেতরে ঢুকতে পারছে না।
খেলার মাঠটি সেনাবাহিনীর লোকেরা কর্ডন করে রেখেছে, কর্ডনের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা কৌতূহলী চোখে দাঁড়িয়ে আছে। নীরা ত্রাতিনা সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তার কাছে নিজের পরিচয় দিতেই তাঁকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। হেলিকপ্টারের কাছাকাছি দ্বিতীয় একজন কর্মকর্তার দিকে তার দিকে এগিয়ে আসে। নীরা ত্রাতিনা মানুষটিকে চিনতে পারল। একটু আগে এই মানুষটি টেলিফোনে তার সঙ্গে কথা বলেছে। মানুষটি কাছে এসে নিচু গলায় বলল, প্রফেসর, আমি মনে করি তোমার কিছুতেই ভেতরে যাওয়া উচিত নয়। এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। তা ছাড়া—
মানুষটিকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে নীরা ত্রাতিনা বলল, তুমি ভেতরে বাচ্চা মেয়েটিকে জানাও যে, আমি তার সঁঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
মানুষটি বিরস মুখে টেলিফোনে কার সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলল। তারপর তাকে হেলিকপ্টারের কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে বলল, এই সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাও। দরজায় টোকা দিলে খুলে দেবে। তবে আমি শেষবারের মতো বলছি–
নীরা ত্রাতিনা তার কথা শেষ হওয়ার আগেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে দরজায় টোকা দিল, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুট করে খুলে গেল। নীরা ভেতরে ঢুকে চারদিকে তাকাল। বড় একটা হেলিকপ্টারের সামনের চারটা সিটে চার জন মানুষকে বেঁধে রাখা হয়েছে। দুজন পুরুষ ও দুজন মহিলা। হেলিকপ্টারের দরজা যে খুলেছে সে সম্ভবত হেলিকপ্টারের পাইলট। অন্য পাশে একটা মেয়ে হাতে একটা বেঢপ রিভলবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীরা ত্রাতিনা মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়েই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল। মুহূর্তে নীরার। মুখ থেকে রক্ত সরে যায়। সে হেলিকপ্টারের দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে কোনোভাবে বলল, তুমি?
হ্যাঁ, আমি। তুমি আমাকে দেখে নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়েছ। তুমি আরো অবাক হবে, যদি শোন আমি একা নই। আমি যেখান থেকে এসেছি সেখানে আমার মতো আরো দশ জন আছে। আমরা ক্লোন তাই আমাদের কোনো নাম থাকতে হয় না। কিন্তু আমরা সবাই মিলে আমার নাম দিয়েছি নায়ীরা।
নীরা ত্রাতিনা কোনো কথা না বলে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নায়ীরা নামের মেয়েটি আসলে সে নিজে।
নায়ীরা একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি জানতে যে তোমাকে ক্লোন করা হয়েছে?
না। নীরা ত্রাতিনা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, পৃথিবীর আইনে কাউকে ক্লোন করা যায় না।
কিন্তু এরা করেছে। নায়ীরা হাত দিয়ে বেঁধে রাখা চার জনকে দেখিয়ে বলল, এরা বলেছে, তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে না। এরা বলেছে কালো পোশাক পরা কমান্ডোরা এসে আমাকে কোনো কথা না বলার সুযোগ দিয়ে গুলি করে মেরে ফেলবে।
নীরা ত্রাতিনা কোনো কথা না বলে বিস্ফারিত চোখে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থাকে। নায়ীরা বলল, কিন্তু আমি তাদের বলেছি যে, তুমি আসবে। তুমি নিশ্চয়ই আসবে। আমাকে কেউ ডাকলে আমি যেতাম। তুমি নিশ্চয়ই আমার মতন, তাই না?
নীরা ত্রাতিনা মাথা নাড়ল, বলল, আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি এখনো
নায়ীরা বাধা দিয়ে বলল, আমি কেন তোমার কাছে এসেছি সেটা তুমি এখনো শোন নি। সেটা শুনলে তুমি সেটাও বিশ্বাস করবে না।
তুমি কেন আমার কাছে এসেছ?
তুমি কি অবমানবদের কথা জান?
হ্যাঁ, জানি।
তারা ভুলভাবে নিজেদের বিবর্তন ঘটিয়েছে। হিংস্র বিকৃত বিকলাঙ্গ হয়ে গড়ে উঠেছে। মানুষকে ধ্বংস করার জন্য মানববিধ্বংসী অস্ত্র গড়ে তুলেছে। এখন আমাদের আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। তাই না?
হ্যাঁ।
নায়ীরা জোর করে হেসে বলল, তুমি কি জান এটা মিথ্যা? তুমি কি জান অবমানব বলে কিছু নেই? তারা সাধারণ মানুষ। নিরীহ মানুষ। অসহায় মানুষ। তুমি সেটা জান?
নীরা ত্রাতিনা চমকে উঠে বলল, কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ। আমি সত্যি বলছি। আমি নিজের চোখে দেখেছি।
কিন্তু এটা তো হতে পারে না, এটা অসম্ভব।
নায়ীরা নিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ, এটা অসম্ভব।
কিন্তু এই মানুষগুলো সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। তুমি আমাকে বিশ্বাস কর। তুমিও নিশ্চয়ই জান, আমি কখনো মিথ্যা বলব না। আমি তো আসলে তুমি।
হ্যাঁ, আমি জানি নায়ীরা। আমি জানি।
নায়ীরা একটু এগিয়ে এসে হঠাৎ করে কেমন জানি টলে উঠে কাছাকাছি একটা চেয়ার ধরে নিজেকে সামলে নেয়। নীরা ত্রাতিনা জিজ্ঞেস করল, তোমার কী হয়েছে?
আমি আসলে খুব অসুস্থ।
অসুস্থ! কী হয়েছে তোমার?
এরা বলেছে, আমি দুই সপ্তাহ পরে মারা যাব। কিন্তু আমি জানি, আমি দুই সপ্তাহ টিকে থাকব না। আমি টের পাচ্ছি, আমি তার অনেক আগেই মারা যাব। কিন্তু এখন আমার সেটা নিয়ে কোনো দুঃখ নেই। কারণ আমি জানি, তুমি নিশ্চয়ই অবমানবদের রক্ষা করবে। করবে না?
আমার পক্ষে যেটুকু করার সেটা করব। নিশ্চয়ই করব।
আমি জানি, তুমি করবে। আমি হলে করতাম। তুমি আর আমি তো একই মানুষ, তাই না?
নায়ীরা চেয়ারটা ধরে খুব ধীরে ধীরে বসে। ফিসফিস করে বলে, আমি অনেক কষ্ট করে নিজেকে দাঁড়া করে রেখেছিলাম। আর পারছি না। আমি খুব ক্লান্ত। খুব অসুস্থ।
নীরা নায়ীরার কাছে গিয়ে তাকে স্পর্শ করে, তোমার কী হয়েছে নায়ীরা?
অবমানদের হত্যা করার জন্য এরা আমার শরীরে লাখ লাখ কোটি কোটি ভাইরাসের জন্ম দিয়েছে। সেই ভাইরাসগুলো আমার শরীরকে কুরে কুরে খাচ্ছে। কিন্তু তাতে এখন আর কিছু আসে যায় না। নায়ীরা দুর্বলভাবে হেসে হঠাৎ হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল।
নীরা ত্রাতিনা ছুটে গিয়ে তাকে ধরে মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল। এই মেয়েটি সে নিজে। কৈশোরে সে ঠিক এরকম ছিল, সাহসী এবং তেজস্বী। মায়াময় এবং কোমল। গভীর আবেগে তার হৃদয় ছিল ভরপুর। কী আশ্চর্য! কৈশোরের সেই মেয়েটি আবার তার কাছে ফিরে এসেছে?
নায়ীরা নীরা ত্রাতিনার হাত ধরে বলল, আমাকে কোনো মা জন্ম দেয় নি। আমার কোনো মা নেই। কিন্তু আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, মা থাকলে কেমন লাগে।
নীরা ত্রাতিনা নায়ীরাকে শক্ত করে ধরে বলল, আমি তোমাকে জন্ম দিই নি, কিন্তু তুমি আমার মেয়ে। নায়ীরা, মা আমার, তুমি এতদিন পর কেন এসেছ?
নায়ীরা ফিসফিস করে বলল, মা, তোমার ঠিক আমার মতো আরো দশটি মেয়ে এখনো বেঁচে আছে। তারা খুব দুঃখী মেয়ে। তুমি তাদের দেখবে না?
দেখব, নিশ্চয়ই দেখব।
নায়ীরার মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে, সে নীরা ত্রাতিনার হাত ধরে চোখ বুজল।
নীরা ত্রাতিনা নায়ীরার মাথাটা নিজের কোলে রেখে তার পকেট থেকে ফোন বের করে একটি নম্বর ডায়াল করল। কানেকশন হওয়ার পর স্ক্রিনে কঠোর চেহারার একজন মানুষকে দেখা যায়। নীরা ত্রাতিনা নিচু গলায় বলল, আমি প্রফেসর নীরা ত্রাতিনা। আমি মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলতে চাই।
রাষ্ট্রপতি এই মুহূর্তে একটি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত রয়েছেন-
নীরা তাকে বাধা দিয়ে বলল, তাতে কিছু আসে যায় না। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা আছে। তাকে তুমি বলো, তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি আমি তাকে জানাতে চাই।
ঠিক আছে, বলছি।
নীরা ত্রাতিনা হেলিকপ্টারের মেঝেতে নায়ীরার মাথাটি কোলে নিয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকে। হেলিকপ্টারের সিটে শক্ত করে বেঁধে রাখা চার জন বিজ্ঞান এবং সেনা কর্মকর্তার হাত-পা শক্ত করে বেঁধে রাখার কারণে সেখানে ঠিকভাবে রক্ত সঞ্চালন না হয়ে সেগুলো অবশ হয়ে আসছিল, কিন্তু কর্মকর্তাদের কেউই সেই বিষয়টি নিয়ে বিচলিত ছিল না। তাদের বিচলিত হওয়ার জন্য অনেক বড় বিষয় অপেক্ষা করছে, সেটি সম্পর্কে তাদের তখন আর কোনো সন্দেহ নেই।
.
নায়ীরা যখন চোখ খুলে তাকাল সে তখন হাসপাতালের একটি বিছানায় শুয়ে আছে। তার মাথার কাছে অসংখ্য মনিটর। শরীরের নানা জায়গা থেকে অনেকগুলো সেন্সর সেই মনিটরগুলোতে এসেছে। শরীরের রক্ত বিশুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া দিয়ে তার দেহটি ভাইরাসমুক্ত করা চলছে। পদ্ধতিটি কার্যকর, তবে সময়সাপেক্ষ। নায়ীরা মাথা ঘুরিয়ে দেখল, তার মাথার কাছে নীরা ত্রাতিনা দাঁড়িয়ে আছে। নায়ীরাকে চোখ খুলে তাকাতে দেখে সে তার কাছে এগিয়ে এসে তার হাত স্পর্শ করল, জিজ্ঞেস করল, তুমি এখন কেমন আছ?
মনে হয় ভালোই আছি। একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, এখন কয়টা বাজে?
রাত একটা।
এত রাত?
হ্যাঁ, অনেক রাত।
মা, তুমি কি অবমানবদের রক্ষা করেছ?
হ্যাঁ, তাদের রক্ষা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই মুহূর্তে কয়েক শ হেলিকপ্টার অবমানবদের এলাকায় উড়ে যাচ্ছে তাদের সাহায্য করার জন্য।
সেখানে একটা গ্রামে তিহান নামে একটা ছেলে থাকে।
কী করে তিহান?
হরিণ শিকার করে। কিন্তু সে হরিণকে মারতে চায় না, তাই হরিণ শিকার করার সময় মুখে একটা দানবের মুখোশ পরে থাকে।
ভারি মজার ছেলে তো?
হ্যাঁ মা, সে খুব মজার ছেলে। নায়ীরা একটু অপেক্ষা করে বলল, কিন্তু শুধু মজার ছেলে নয়, সে খুব কাজের ছেলে। আমরা যখন হেলিকপ্টারটা দখল করেছি তখন সে খুব সাহায্য করেছে। তার সঙ্গে যদি তোমার কখনো লেখা হয়, তুমি আমার পক্ষ থেকে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে দিও।
দেব, নিশ্চয়ই দেব।
নায়ীরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, মা।
বলো, মা।
আমার যে আরো দশটি বোন আছে তাদের কী হবে মা?
তাদের উদ্ধার করার জন্য বিশেষ কমান্ডো বাহিনী পাঠানো হয়েছে।
তুমি তাদের দেখলে অবাক হয়ে যাবে। তাদের কথা আমি এক মুহূর্ত ভুলতে পারি না।
আমি সেটা বুঝতে পারি।
তারা কি এখানে আসবে?
হ্যাঁ। আসবে, অবশ্যই আসবে।
নায়ীরা উত্তেজনায় উঠে বসার চেষ্টা করল, নীরা ত্রাতিনা তাকে শান্ত করে শুইয়ে রাখে। নায়ীরা জ্বলজ্বলে চোখে জিজ্ঞেস করল, কবে আসবে?
সবকিছু শেষ করে আসতে আসতে তাদের বেশ কয়েক দিন লেগে যাবে।
ও! হঠাৎ করে নায়ীরার উত্তেজনা দপ করে নিভে গেল। ফিসফিস করে বলল, কয়েক দিন পর তো আমি বেঁচে থাকব না।
তুমি কেমন করে জান?
আমি জানি। এই রাতটি আমার শেষ রাত। আমি জানি।
নীরা ত্রাতিনা কোনো কথা না বলে নায়ীরার হাতটি নিজের হাতে তুলে নেয়। নায়ীরা একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি যদি নাও থাকি তুমি তো থাকবে। তারা একটা বোনকে হারিয়ে একটা মা পাবে। তাই না মা?
ত্রাতিনা কোনো কথা না বলে নায়ীরার হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইল। একটু পর নায়ীরা আবার ডাকল, মা।
বলো নায়ীরা।
পৃথিবীর মানুষ কি সবকিছু জেনে গেছে?
হ্যাঁ, তারা সবকিছু জেনেছে।
তারা কী বলছে, মা?
তারা প্রতিরক্ষা বাহিনীর ওপর ভীষণ রেগেছে। তাদের সদর দপ্তর পুড়িয়ে দিয়েছে।
সত্যি?
হ্যাঁ, সারা পৃথিবী থেকে হাজার হাজার মানুষ অবমানবের দেশে যাচ্ছে তাদের দেখতে, তাদের কাছে ক্ষমা চাইতে।
সত্যি?
সত্যি মা। সারা পৃথিবীতে সবার কাছে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ কে, তুমি জান?
কে?
তুমি।
আমি?
হ্যাঁ।
নীরা আতিনা মিষ্টি করে হাসল, বলল, তুমি কেমন করে অবমানবের দেশে গিয়ে তাদের রক্ষা করেছ পৃথিবীর সব মানুষ সে কাহিনী জানে। টেলিভিশনে এখন তোমার ওপর একটু পরপর বুলেটিন প্রকাশ করছে। পৃথিবীর সকল মানুষ তোমার জন্য প্রার্থনা করছে।
নায়ীরা জ্বলজ্বলে চোখে বলল, সত্যি মা? সত্যি?
হ্যাঁ। এই হাসপাতালের বাইরে হাজার হাজার স্কুলের ছেলেমেয়েরা তোমার জন্য ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
তাদের ভেতরে আসতে দেবে না?
না। তুমি সুস্থ না হলে কাউকে ভেতরে আসতে দেবে না।
নায়ীরার চোখ-মুখের ঔজ্জ্বল্য আবার দপ করে নিভে গেল। সে নিচু গলায় বলল, কিন্তু আমি তো আর সুস্থ হব না মা।
ত্রাতিনা নায়ীরার হাত ধরে বলল, তুমি এখন একটু বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা কর।
নায়ীরা নীরা ত্রাতিনার হাত ধরে চোখ বন্ধ করল।
.
ড. নিশিরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি দুঃখিত প্রফেসর ত্রাতিনা। আমি খুব দুঃখিত।
নীরা ত্রাতিনা হাসপাতালের ধবধবে সাদা বিছানায় শুয়ে থাকা নায়ীরার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী নিষ্পাপ একটি মুখমণ্ডল! সে যখন পনের বছরের একটা কিশোরী ছিল তখন কি তার মুখমণ্ডল এত নিষ্পাপ ছিল? এইটুকুন মেয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অবিচারটির মুখোশ খুলে দিয়েছে, এখনো সেটি নীরা ত্রাতিনা বিশ্বাস করতে পারছে না। অথচ এই মেয়েটিকে বাঁচানো যাবে না?
নীরা ত্রাতিনা ড. নিশিরার দিকে তাকিয়ে বলল, সারা পৃথিবীর মানুষ এই মেয়েটির জন্য প্রার্থনা করছে।
আমি জানি।
হাসপাতালের বাইরে হাজার হাজার স্কুলের ছেলেমেয়ে ফুল নিয়ে এসেছে, তুমি দেখেছ?
দেখেছি।
কিন্তু এই মেয়েটিকে বাঁচানো যাবে না?
না প্রফেসর ত্রাতিনা। প্রতিরক্ষা দপ্তরের ভয়ানক মানুষগুলো তার শরীরকে ভাইরাস জন্মানোর জন্য ব্যবহার করেছে। সেই ভাইরাসগুলো মস্তিষ্ক ছাড়া তার প্রত্যেকটি অঙ্গ কুরে কুরে খেয়েছে। তার হৃৎপিণ্ড, যকৃৎ, কিডনি, ফুসফুস কিছুই অবশিষ্ট নেই। এই মেয়েটি কেমন করে এখনো বেঁচে আছে সেটিই একটি রহস্য।
তাকে কোনোভাবে বাঁচানো যাবে না?
না।
কোনোভাবেই না?
না, প্রফেসর লাতিনা, কোনোভাবেই না। এই মেয়েটিকে বাঁচাতে হলে তার শরীরের প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বদলে দিতে হবে। তার দরকার নতুন একটি হৃৎপিণ্ড, নতুন যকৃত, নতুন কিডনি, নতুন ফুসফুস-এক কথায় একটা নতুন দেহ। কোথা থেকে সেটা পাবে?
যদি কেউ দিতে রাজি হয়?
কে রাজি হবে? তা ছাড়া রাজি হলেই তো হবে না। তার শরীরের সঙ্গে সেগুলো মিলতে হবে। সেটি তো সম্ভব নয়। একটি-দুটি অঙ্গ মেলানো যায়, কিন্তু প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ?
ত্রাতিনা ফিসফিস করে বলল, তুমি জান নায়ীরা আমার ক্লোন?
হ্যাঁ, জানি।
তার মানে জান?
ড. নিশিরা ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ভয়ানক চমকে উঠে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ প্রফেসর ত্রাতিনা?
আমি বলতে চাইছি যে, আমার প্রত্যেকটি অঙ্গ নায়ীরা ব্যবহার করতে পারবে। আমি আর নায়ীরা আসলে একই মানুষ। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে আমি চেকআপ করিয়েছি, আমি সুস্থ সবল আর নীরোগ।
ড. নিশিরা খপ করে ত্রাতিনার হাত ধরে বলল, না, প্রফেসর ত্রাতিনা, এটা হতে পারে না! অসম্ভব
নীরা ত্রাতিনা ড. নিশিরার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে বলল, তোমার ছেলেমেয়ে আছে?
হ্যাঁ আছে।
কত জন?
দুজন। কিন্তু তার সঙ্গে এর কী সম্পর্ক?
যদি কখনো এরকম হয়, তাদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য তোমার প্রাণ দিতে হয়, তুমি কি তোমার প্রাণ দেবে?
কাল্পনিক প্রশ্ন করো না প্রফেসর ত্রাতিনা।
এটা কাল্পনিক প্রশ্ন না। আমি জানি তুমি দেবে। একজন মায়ের কাছে তার নিজের জীবন থেকে সন্তানের জীবন অনেক বড়। নায়ীরা আমার সন্তান। তুমি যদি তোমার সন্তানের জন্য প্রাণ দিতে পার, আমি কেন পারব না? ত্রাতিনা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ড. নিশিরা তুমি অস্ত্রোপচারের জন্য প্রস্তুত হও।
না, প্রফেসর ত্রাতিনা, এটা হতে পারে না। তুমি পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী-
একজন মানুষ তার জীবনে যা পেতে পারে আমি তার সব পেয়েছি। নায়ীরা কিছু পায়নি, সে শুধু দিয়েছে। তাকে আমি ছোট একটা জীবন উপহার দিতে চাই।
না, ত্রাতিনা, না
আমি আর নায়ীরা আসলে একই মানুষ। আমার নিজের মধ্যে বেঁচে থাকা আর নায়ীরার মধ্যে বেঁচে থাকা আমার জন্য একই ব্যাপার।
না, না, প্রফেসর ত্রাতিনা। ড. নিশিরা কঠিন গলায় বলল, তুমি এটা করতে পার না।
আমাকে তুমি বাধা দিও না। নীরা ত্রাতিনা একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আর বাধা দিয়েও লাভ নেই, নায়ীরাকে পৃথিবীর সবাই মিলে থামাতে পারে নি। আমাকেও পারবে না। আমি আর নায়ীরা আসলে একই মানুষ, তুমি তো জান।
ড. নিশিরা হতচকিত চোখে নীরা ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইল। নীরা ত্রাতিনা মৃদুস্বরে বলল, বিদায়।
ড. নিশিরা কিছু বলল না, কিন্তু সে জানে কথাটি মুখে উচ্চারণ করা না হলেও এ যুগের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী নীরা ত্রাতিনাকে বিদায় দেওয়া হয়েছে। চিরদিনের জন্যই।
.
প্রফেসর নীরা ত্রাতিনার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে এক রকম চেহারার এগার জন কিশোরী তার কফিনটি বহন করে নিয়ে গিয়েছিল। নায়ীরা তখনো পুরোপুরি সুস্থ হয় নি। হুইল চেয়ারে করে তাকে পিছু পিছু ঠেলে নিয়ে গেছে তিহান নামের একজন সুদর্শন তরুণ।
পৃথিবীর অন্য সব মানুষের সঙ্গে একসময় যাদের অবমানব বলা হত তারাও সেই অনুষ্ঠানটি দেখেছিল। নায়ীরাকে তার চোখের পানি মুছে নিতে দেখে পৃথিবীর অনেক মানুষও তাদের চোখের পানি মুছে নিয়েছিল।
সেই চোখের পানি ছিল একই সঙ্গে দুঃখের এবং ভালবাসার।
মানুষের জন্য মানুষের ভালবাসার।