৬. ভোর রাতে সিদ্ধিনাথের খুব জ্বর এল

ভোর রাতে সিদ্ধিনাথের খুব জ্বর এল। সে ভুল বকতে শুরু করল।

হেলথ সেন্টারে চিকিৎসার ব্যবস্থা খুব ভাল নয়। তবে ডাক্তার লোক ভাল। নিজের ঘর থেকে ওষুধপত্র এনে দিলেন। কেটেরহাটের মেলা-লোক রাত জেগে বসে রইল বাইরে, এই সাঙ্ঘাতিক শীতের মধ্যেও।

ভোরবেলা ডাক্তার এসে নবীনকে বললেন, “সিদ্ধিনাথের অবস্থা ভাল নয়। বিকারের মধ্যে সে কিছু বলছে। কথাগুলো আপনি এসে একটু শুনুন।”

নবীন গিয়ে দেখল, সিদ্ধিনাথ চিত হয়ে পড়ে আছে। মুখখানা নীলবর্ণ। মাঝে-মাঝে অস্ফুট ‘উঃ আঃ’ করছে। মাঝে-মাঝে কথা। বলে উঠছে।

নবীন কাছেই একটা চেয়ার টেনে বসল।

সিদ্ধিনাথ খানিকক্ষণ নিঝুম হয়ে থেকে হঠাৎ বলে উঠল, “নবীনের বাড়ির পশ্চিম কোণ…কালীবাড়ির দক্ষিণে..ওঃ, কী অন্ধকার! বাঘ ডাকছে…বাবা রে! …ওরা কারা? ..যাটটা সিঁড়ি আছে.. সদাশিবকতাকে বলো, এরা ভাল লোক নয়..”

নবীন কিছুই বুঝতে পারল না। তবে কথাগুলো মনে রাখল। সিদ্ধিনাথ ফের বলল, “পাতালঘর…নবীনের পাতালঘর..কেউ ঢুকতে পারবে না…”

নবীন পাতালঘরের কথায় সিদ্ধিনাথের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ল।

“সিদ্ধিনাথ খুড়ো! কী বলছ?”

সিদ্ধিনাথ আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

নবীন ডাক্তারের দিকে চেয়ে বলল, “কী মনে হচ্ছে ডাক্তারবাবু? বাঁচবে?”

“বাঁচতে পারে। তবে বাহাত্তর ঘন্টার আগে কিছু বলা যায় না। শুনছি, সদাশিববাবু কলকাতা থেকে ডাক্তার আনাবেন, দেখা যাক, তারা যদি কিছু করতে পারে।”

“কী করে আনাবে?”

“সদাশিববাবুর ঝিলের বাড়িতে কারা ভাড়া এসেছে। তাদের গাড়ি আছে। একজন সেই গাড়ি নিয়ে কলকাতা রওনা হয়ে গেছে।”

নবীন শুনে নিশ্চিন্ত হল।

বেলা আটটা নাগাদ কলকাতার ডাক্তার, ওষুধপত্র, অক্সিজেন সিলিন্ডার, সবই চলে এল। কেটেরহাটের লোকেরা ধন্য-ধন্য করতে লাগল। চাকরবাকরের জন্য মনিবেরা তো এত করে না। সদাশিববাবু নিজেই ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে এলেন।

নবীনের দিকে চেয়ে সদাশিব বললেন, “বুঝলে নবীন, সিদ্ধিনাথ আমাদের পরিবারে আছে এইটুকু বয়স থেকে। তার জন্য দু-চার-পাঁচ শো টাকা খরচ করাটা কোনও বিরাট মহত্ত্ব নয়।”

নবীন মাথা নেড়ে বলল, “যে আজ্ঞে। তবে সিদ্ধিনাথের কিছু গোপন খবরও জানা আছে। সেটা বেশ মূল্যবান খবর।”

সদাশিব মৃদু একটু হেসে নবীনের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “গোপন খবর মানে কি সেই দিঘির তলায় মন্দির? আরে পাগল! সেটা তো কিংবদন্তি।”

নবীন মাথা নেড়ে বলল, “কিংবদন্তির মধ্যে অনেক সময় সত্য লুকোনো থাকে। সিদ্ধিনাথ নিশ্চয়ই কিছু জানতে পেরেছিল। নইলে কেন ওকে কেউ মারবে, বলুন?”

সদাশিব গম্ভীর হয়ে বললেন, “সেটা ঠিক। তবে যেই মারুক, সে রেহাই পাবে না। আমি পুলিশে খবর দিয়েছি, তারা এল বলে।”

পুলিশের কথায় নবীন খুব নিশ্চিন্ত হল না। কেটেরহাটে থানা নেই। আছে দু’ মাইল দূরে। পুলিশ এত দূর থেকে খুব বেশি কিছু করতে পারবে বলে তার মনে হয় না। কিন্তু মুখে সে কিছুই বলল না।

কলকাতার ডাক্তার সিদ্ধিনাথকে পরীক্ষা করে বেরিয়ে এসে বললেন, “লোকটার বয়স হয়েছে বটে, কিন্তু খুব শক্ত ধাতের লোক।”

সদাশিব জিজ্ঞেস করলেন, “বাঁচবে?”

“বাঁচবে বলেই মনে হয়। তবে ভাল হয়ে উঠতে সময় লাগবে। দিন তিনেক একদম কাউকে কাছে যেতে দেবেন না।”

নবীন নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি এসে নেয়ে-খেয়ে ঘুম দিল। সারা রাত ঘুমোয়নি।

বিকেলে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানল, সিদ্ধিনাথ ঘুমোচ্ছে। একটু ভালর দিকে।

নবীন লাইব্রেরিতে গিয়ে খানিকক্ষণ বই-পত্র নাড়াচাড়া করল। উঠতে যাবে, এমন সময় বিলু এসে হাজির।

“নবীনদা!”

“আরে, বিলু!”

“তোমাকেই খুঁজছি কখন থেকে। চলো, কথা আছে।”

“কী কথা?”

“চলো না, বাইরে দিদি দাঁড়িয়ে আছে।”

নবীন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল। “কী ব্যাপার বলো তো?”

অনু বলল, “নবীনদা, আমরা জঙ্গলের মধ্যে যাব। তোমার সঙ্গে।”

“এই রাত্রে?”

“রাতেই তো যা ঘটবার ঘটে।”

“কিন্তু সদাশিববাবু শুনলে যে রাগ করবেন।”

“করবেন না। আমরা যাত্রা শুনবার নাম করে বেরিয়েছি। ভুজঙ্গদা সঙ্গে যাবে।”

নবীন তবু দোনোমোনো করে বলল, “ও জায়গাটা ভাল নয় যে! তোমরা ছেলেমানুষ। যাওয়াটা ঠিক হবে না।”

অনু তার গায়ের ওভারকোটটা খুলে পিঠ থেকে স্লিং-এ ঝোলানো একটা বন্দুক বের করে বলল, “দেখেছ? আমি বন্দুক ভালই চালাতে পারি। আমি কাউকে ভয়ও পাই না। তবে বিলুটা একটু ভিতু।”

বিলু সঙ্গে-সঙ্গে দিদির হাত খিমচে ধরে বলল, “আরশোলা দেখে তোর মতো কি আমি চেঁচাই?”

নবীন বন্দুক দেখে বেশ ঘাবড়ে গেল। অনু বাচ্চা মেয়ে, তার কাছে বন্দুক থাকাটা সমীচীন নয়। সদাশিববাবু যদি জানতে পারেন যে, এই ঘটনাকে নবীন প্রশ্রয় দিয়েছে, তা হলে ভীষণ রেগে যাবেন।

নবীন তাই ভালমানুষের মতো বলল, “জঙ্গলে আজ রাতে গিয়ে লাভও হবে না। পুলিশ সেখানে গিজগিজ করছে। একটু আগে আমাদের মহাদেব দেখে এসেছে কিনা। সারা জঙ্গল বড়-বড় লাইট ফেলে তল্লাসি হচ্ছে। বাইরের কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না।”

সর্বৈব মিথ্যে কথা। তবে কাজ হল। একথায় ভাই-বোন একটু মুষড়ে পড়ল। রহস্যময় নৈশ অভিযান তা হলে তো সম্ভব নয়।

নবীন বলল, “আজ বাড়ি গিয়ে চুপটি করে থাকে। কাল জঙ্গলে যাওয়া যাবে।”

অনু আর বিলু হতাশ গলায় বলল, “আচ্ছা।”

নবীন দু’জনকে বাড়ির পথে খানিকদূর এগিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে এল।

নবীনের মাথাটা বড্ড এলোমেলো। অল্প সময়ের মধ্যে এত ঘটনা ঘটে যাওয়ায় সে ঠিক তাল রাখতে পারছে না। কিন্তু কেটেরহাটের নিস্তরঙ্গ জীবনে যে হঠাৎ একটা বড় রকমের ঘটনা ঘটতে চলেছে, তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

নবীন তাদের এগিয়ে দিয়ে ফিরে যাওয়ার পরই বিলু আর অনু দাঁড়িয়ে পড়ল।

অনু বলল, “দ্যাখ বিলু, আমার মনে হল, নবীনদা আমাদের ভাগিয়ে দেওয়ার জন্যই পুলিশের কথাটা বানিয়ে বলল।”

“আমারও ঠিক তাই মনে হচ্ছে রে দিদি। বড়রা তো এ রকমই হয়, ছোটদের পাত্তা দিতে চায় না।”

“তা হলে আমাদের কী করা উচিত? নবীনদাকে বাদ দিয়েই যাব কি না ভাবছি। শুধু ভুজঙ্গদা সঙ্গে থাকবে।”

বিলু মাথা নেড়ে বলল, “ভুজঙ্গদা রাজি হয়েছে বটে, কিন্তু শেষ অবধি ভুজুং-ভাজাং দিয়ে যাওয়া আটকে দেবে।”

অনু একটু ভেবে নিয়ে বলল, “ঠিকই বলেছিস। ভুজঙ্গদা কেমন যেন ‘আচ্ছা-আচ্ছা-হবে-হবে’ বলে এড়ানোর চেষ্টা করছিল। তা হলে কী করা উচিত?

“তুই আর আমি মিলে যাই, চল।”

“তোর ভয় করবে না তো?”

“না। আমাদের তো বন্দুক আছে। ভয় কী?”

অনু রাস্তাটা ভাল করে দেখে নিল। কেউ নেই। কেটেরহাটে এমনিতেই লোকজন কম। তার ওপর এবারকার সাঙ্ঘাতিক, শীতে বিকেলের পর আর রাস্তা-ঘাটে বিশেষ লোক থাকে না।

অনু বলল, “তা হলে চল।” দুই ভাই-বোন অতি দ্রুত আবার উলটো দিকে হাঁটতে লাগল। একটু বাদেই ঝিলের ধার ঘেঁষে তারা জঙ্গলের পথে পা দিল।

“দিদি! বাঘটা তো আসল বাঘ নয়! না?”

“না।”

“ঠিক তো?”

“তাই তো ভুজঙ্গদা বলছে। ভুজঙ্গদা সাকাসে ছিল, বাঘের ডাক ভালই চেনে। তোর কি ভয় করছে?”

“না তো! ভয় কী? বন্দুক আছে না?”

অনু একটু হেসে বিলুর হাতটা চেপে ধরে বলল, “বাঘ হলেই বা কী? আমি ভয় পাই না।”

“আমিও না।”

জঙ্গলের মধ্যে নিবিড় অন্ধকার। ঢুকবার আগে দু’জনে একটু দাঁড়াল। পরস্পরের দিকে একটু তাকাল। তার পর দু’জনে দু’জনের হাত ধরে ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকল।

প্রথমটায় পথ দেখা যাচ্ছিল না। মাঝে-মাঝে টর্চ জ্বালতে হচ্ছিল।

অনু বলল, “টর্চ জ্বালাটা ভাল হচ্ছে না। যদি পাজি লোক কেউ থেকে থাকে এখানে, তবে সে টের পেয়ে যাবে।”

“অন্ধকারে কী করে হাঁটবি?”

“একটু দাঁড়িয়ে থাকলে ধীরে-ধীরে চোখে অন্ধকার সয়ে যাবে।”

দু’জনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। ক্রমে-ক্রমে চার দিককার নিবিড় জঙ্গল তাদের চোখে আবছা ফুটে উঠতে লাগল।

“এবার চল।”

অনু আর বিলু এগোতে লাগল। হঠাৎ বিলু চাপা গলায় বলল, “দিদি!”

“কী রে?”

“কিছু দেখলি?”

“না তো! তুই দেখলি?”

“বাঁশবনের মধ্যে একটা ছায়া সরে গেল যেন!”

“ও কিছু নয়, শেয়াল।”

মুখে ‘শেয়াল’ বললেও অনু চার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। কী তারা খুঁজতে বা জানতে এসেছে, তা তারা নিজেরাও ভাল জানে না।

অনু ভাইয়ের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, “কালীবাড়ি আর বেশি দূরে নয়। সাবধানে আয়। কোনও শব্দ করিস না।”

আরও মিনিট কয়েক নিঃশব্দে হাঁটার পর অনু বলল, “দাঁড়া।”

“কেন রে দিদি?”

“মনে হচ্ছে অন্ধকারে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি।”

“তা হলে কী হবে?”

অনু বলল, “ভয় পাস না। বিপদে ভয় পেলে বিপদ আরও বাড়ে। চল এগোই। রাস্তা ঠিক পেয়ে যাব।”

অনু তার কবজির ঘড়িটা দেখল। উজ্জ্বল ডায়াল, অন্ধকারেও সময় বুঝতে অসুবিধে নেই। রাত মোটে পৌনে ন’টা বাজে। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে মনে হচ্ছে নিশুত রাত।

দু’জনে এগোতে লাগল। এবং কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারল, তাদের পায়ের নীচের কুঁড়ি-পথটা আর নেই। তারা ঝোঁপ-ঝাড়ের মধ্যে বিপথে এসে পড়েছে।

অনু টর্চটা জ্বালাল, তার পর বলল, “আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি।”

“চল, ফিরে যাই।”

“ফিরে যাওয়ার পথটাও তো খুঁজতে হবে। তার চেয়ে চল, এগোতে থাকি। এক সময়ে জঙ্গল শেষ হয়ে যাবে।”

“চল।”

দু’জনে সম্পূর্ণ আন্দাজে হাঁটতে লাগল। পায়ের নীচে লতা-পাতা, চার দিকে ঝোঁপঝাড়, মাঝে-মধ্যে বাঁশবন, বড়-বড় গাছের জড়াজড়ি।

“কোথায় যাচ্ছি রে দিদি?”

“চল না?”

“জঙ্গলটা কত বড়?”

“বেশ বড় বলেই শুনেছি। সুন্দরবনে গিয়ে মিশেছে।”

“ও বাবা!”

অনু পিঠ থেকে বন্দুকটা খুলে হাতে নিল। তার পর বলল, “ভিতু কোথাকার! তোকে না-আনলেই হত।”

“মোটেই ভয় পাইনি। চল না! আমার পকেটে গুলতি আছে।”

দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে যত এগোচ্ছে, তো জঙ্গল গভীর আর ঘন হচ্ছে। ঘাস-ঝোঁপ প্রায় বুক-সমান উঁচু। লতা-পাতায় বারবার পা আটকাচ্ছে। দুবার পড়ে গেল বিলু। তেমন চোট লাগল না অবশ্য। অনু পড়ল একবার।

“দিদি, খরগোশ না?”

“খরগোশ আছে, শেয়াল আছে, শজারু আছে। ওগুলো কিছু করবে না।”

“জানি।”

ক্রমে-ক্রমে চলাটাই অসম্ভব হয়ে পড়তে লাগল। এতক্ষণ কাঁটাঝোঁপের বাড়াবাড়ি ছিল না। কিন্তু এবার কাঁটাঝোঁপ পথ আটকাতে লাগল।

দু’জনের গায়েই পুরু গরমজামা আর মাথায় কান-ঢাকা টুপি থাকায় তেমন আঁচড় লাগেনি, কিন্তু এগোতে বাধা হচ্ছিল।

“কী করবি দিদি?”

অনু তার ওভারকোটের পকেট থেকে একটা বড় ফোল্ডিং ছুরি বের করে তাই দিয়ে সামনের পথ পরিষ্কার করতে করতে বলল, “এগিয়ে যাব।”

“কিন্তু কালীবাড়ি?”

“দেখাই যাক না।” ঘাসবন ক্রমে উঁচু হতে-হতে তাদের মাথা ছাড়িয়ে গেল। কাঁটাঝোঁপ এত নিবিড় হল যে, আর এগোনোই যায় না। এদিকে বিলুর ভীষণ জলতেষ্টা পেয়েছে। একটু খিদেও পাচ্ছে।

“দিদি?”

অনু দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “যারা নতুন দেশ আবিষ্কার করেছে, যারা বড় বড় পাহাড়ে উঠেছে, যারা মরুভূমি পার হয়, যারা যুদ্ধ করে, তারা এর চেয়েও লক্ষ গুণ বেশি কষ্ট করে, তা

জানিস।”

“জানি।”

“ভয় নেই, আমি যতক্ষণ সঙ্গে আছি, ততক্ষণ কেউ তোর কিছু করতে পারবে না। খিদে-তেষ্টা একটু সহ্য কর।”

“রাত বাড়লে যে ঘুম পাবে।”

“তখন আমার কোলে শুয়ে ঘুমোস।”

“হুঁ! তোর কোলে শোব কেন? আমি কি কচি খোকা?”

“তা হলে কচি খোকার মতো তেষ্টা পেয়েছে, খিদে পেয়েছে করছিস কেন? আমার তো পথ হারিয়ে বেশ মজাই লাগছে। কলকাতায় কি এ রকম অ্যাডভেঞ্চার হয়?”

বিলু সভয়ে চার দিক চেয়ে দেখল। এখানে জঙ্গল এত নিবিড় যে, আকাশ একটুও দেখা যায় না। চারদিকে ভুতুড়ে নির্জনতা। টর্চের আলো ছাড়া এগোনো অসম্ভব। কিন্তু টর্চের আলো ক্রমে ফুরিয়ে আসছে। এর মধ্যেই আলোটা লাল আর ম্যাড়মেড়ে হয়ে গেছে।

অনু হঠাৎ বলল, “অনেকক্ষণ হেঁটেছি। আয়, দুজনে বসে একটু জিরিয়ে নিই।”

এ কথায় বিলু খুশি হল। তার আর এই দুর্ভেদ্য জঙ্গলে হাঁটতে ইচ্ছে করছিল না। অন্ধকারেই সে টের পাচ্ছিল, হাতের দস্তানা ছিঁড়ে গেছে কাঁটায়, আঙুলও ছড়ে গিয়ে জ্বালা করছে। গায়ে আঁচড় লেগেছে।

“কোথায় বসবি?”

“ওই যে গাছটা দেখা যাচ্ছে, আয়, ওর তলায় বসি।”

মস্ত গাছ। টর্চের আলো ফেলে অনু দেখল, বটগাছ। চার দিকে অজস্র ঝুরি নেমে গাছটা নিজেই জঙ্গল হয়ে আছে।

দুজনে ধীরে ধীরে গাছটার কাছে এগোতে লাগল। আশ্চর্যের বিষয়, গাছটার চারধারে ঝোঁপঝাড় বিশেষ নেই।

অনু টর্চ জ্বেলে অবাক হয়ে দেখল, বটগাছের তলাটায় তো জঙ্গল নেই, আর মূল কাণ্ডের চারদিকটা বড়বড় চৌকো পাথর দিয়ে বাঁধানো।

অনু বলল, “বাঃ, এখানে শোওয়াও যাবে রে।”

বিলু পাথরের ওপর শোওয়ার প্রস্তাবে তেমন খুশি হল না। কিন্তু একটু বসতে পাবে, এটাই যা আনন্দের কথা।

দু’জনে পাথরের বেদীতে পাশাপাশি বসল। অনু টর্চ জ্বেলে চারদিকটা দেখতে লাগল।

“এ জায়গাটা কী ছিল বল তো বিল?”

“জানি না তো?”

“আন্দাজ করতে পারিস না?”

“না। খিদে পেলে আমার মাথাটা একদম কাজ করতে চায় না।”

অনু উঠে চার দিকটায় আলো ফেলে ঘুরে-ঘুরে দেখল। তার পর বিলুর পাশে এসে বসে বলল, “এখানে বহুকাল আগে লোকের আনাগোনা ছিল। একটা মস্ত ইদারার মুখ দেখলাম! তাতে আবার সিঁড়ি লাগানো। মনে হয়, ওটা ফাঁসি দেওয়ার কুয়ো।”

বিলু ভয় খেয়ে বলল, “ফাঁসি?”

অনু মাথা নেড়ে বলল, “আমাদের পূর্বপুরুষেরা ডাকাত ছিল জানিস তো! দাদুর কাছে শুনেছি, তারা বিশ্বাসঘাতকদের ধরে জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে বিচার করত। তার পর ফাঁসি দিত।”

বিলু বলল, “ও বাবা!”

অনু আর বিলু খানিকক্ষণ জিরোল। তার পর অনু বলল, “এভাবে রাতটা কাটিয়ে দিবি নাকি রে, বিলু?”

“একটু ভয়-ভয় করছে রে, দিদি।”

“তা হলে আয়, চার দিকটা ভাল করে দেখি। ওই কুয়োটা আমার আর-একটু ভাল করে দেখার ইচ্ছে।”

“তোর সাঙ্ঘাতিক সাহস!”

“বিপদে না পড়লে মানুষের সাহস হয় না। আমার সব ভয়-ডর কেটে গেছে। আয় আমার সঙ্গে।

“কুয়োর মধ্যে কী আছে?”

“জানি না। তবে ভিতরে কুয়োর গা বেয়ে অনেক দূর পর্যন্ত সিঁড়ি নেমে গেছে। কেন, তা দেখতে হবে।”

অনুর পিছু পিছু বিলু এগোতে লাগল। ঝোঁপঝাড়ের ভিতর দিয়ে খানিকটা এগোতেই কুয়োটা দেখা গেল। এই জায়গায় বহুকাল লোকজন আসেনি, বোঝাই যায়। ইটে বাঁধানো কুয়োটা বেশ খানিকটা উঁচু। কুয়োর ওপর এক সময়ে হয়তো ফাঁসির মঞ্চ ছিল। দু ধারে দুটো ভাঙা থাম আজও দাঁড়িয়ে আছে। কুয়োর ধারে উঠবার সিঁড়িও আছে। তবে তা ভাঙাচোরা।

দু ভাই-বোনে কুয়োটার চার পাশ ঘুরে দেখল। “দিদি! এখন কী করবি?”

“আয়, ওপরে উঠব।”

সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে তাদের বেশি কষ্ট হল না। কুয়োর ভিতরে এত আগাছা জন্মেছে যে, সেই সব গাছপালার ডগা ওপর পর্যন্ত উঠে এসেছে। নীচে অন্ধকার। গাছপালার ফাঁক দিয়ে খুব সরু সিঁড়ির ধাপ নীচে নেমে গেছে।

“এর মধ্যে নামতে চাষ দিদি? কিন্তু রেলিং নেই যে!”

“তাতে কী হল। ঠিক নামতে পারব। পড়ে গেলে ব্যথা লাগবে না, গাছপালায় আটকে যাব।”

অনু আগে, পিছনে বিলু। সাবধানে দুই ভাই-বোনে কুয়োর মধ্যে নামতে লাগল। ভারী মজার সিঁড়ি, কুয়োর চার পাশে ঘুরে-ঘুরে নেমে গেছে।

বিলুর প্রথমটায় পড়ে যাওয়ার ভয় হচ্ছিল। কারণ সিঁড়ির ধাপ এক ফুট চওড়া নয়, কিন্তু নামতে গিয়ে দেখল, দিদির কথাই ঠিক। গাছপালাগুলোই দিব্যি রেলিঙের মতো কাজ করছে।

নামতে-নামতে এক সময়ে বিলু ওপর দিকে তাকিয়ে দেখল। “দিদি!”

“কী রে?”

“ওপরটা যে দেখা যাচ্ছে না। আমরা কোথায় নামলাম?”

“ভয় নেই। ওপরটা গাছপালার আড়ালে পড়েছে।” এক সময়ে হঠাৎ থেমে গিয়ে অনু বলল, “বিলু! আর যে সিঁড়ি নেই।”

“তার মানে?”

“সিঁড়ি ভেঙে গেছে।”

“তা হলে?”

অনু একটু ভাবল। তার পর বলল, “গাছ বেয়ে নামতে পারবি? এখানে বেশ মোটা-মোটা লতাপাতা আছে।”

“তার চেয়ে ফিরে যাই চল।”

অনু একদম শেষ ধাপটায় দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ সে একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল, “মা গো!”

জরাজীর্ণ সিঁড়ির শেষ ধাপটা অনুর ভার সইতে না পেরে হঠাৎ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে গেল নীচে।

বিলু অন্ধকারে বিহ্বল হয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ বুক-ফাটা ডাক দিল, “দিদি?”

তলা থেকে কোনও জবাব এল না।

বিলু প্রথমটা ভীষণ ঘাবড়ে গেলেও বুঝতে পারল, এ-সময়ে ঠাণ্ডা মাথায় কাজ না করলে দিদিকে বাঁচানো যাবে না।

তার কাছে টর্চ নেই। সুতরাং নীচের দিকটা সে কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। তার চার দিকেই ঘন অন্ধকার।

বিলু বার কয়েক ডাকল, “দিদি! এই দিদি! শুনতে পাচ্ছিস?”

কেউ জবাব দিল না।

বিলুর চোখ ফেটে কান্না এল। দিদিকে সে ভীষণ ভালবাসে। দিদির যদি কিছু হয়, তা হলে সে থাকবে কী করে?

বিলু হাত বুড়িয়ে খুঁজতে-খুঁজতে একটা মোটা লতা নাগালে পেয়ে গেল। খুব ধীরে ধীরে লতাটা ধরে সে নামতে লাগল নীচে।

কাজটা খুব সহজ হল না। লতাপাতায় এতই নিচ্ছিদ্র হয়ে আছে তলার দিকটা যে, তার হাত-পা ছড়ে যাচ্ছিল। মাঝে-মাঝে আটকে পড়ছিল সে। সে টারজান, অরণ্যদেব, টিনটিন এবং এই রকম সব বীরপুরুষদের কথা ভাবতে লাগল প্রাণপণে। এরা তাৈ কতই শক্ত কাজ করে, তাই না?

আচমকাই বিলুর ধরে থাকা লতাটা হড়াস করে আলগা হয়ে গেল।

অন্ধকারে কী থেকে যে কী হয়ে গেল! ঝোঁপঝাড়, লতাপাতা ভেদ করে বিলু পড়ে যেতে লাগল। একেবারে অসহায়ের মতো।

“বাবা গো!”

তারপর ঝপ করে কিছুর ওপর আছড়ে পড়ল সে। মাথাটা ঘুরে গেল। চোখ অন্ধকার হয়ে গেল তার।