ভুতুর মরণ-দৌড় সফল হতে-হতেও হল না। মাত্র হাত-দশেক চোরাবালি পার হতে বাকি ছিল। ভুতু গড়াতে-গড়াতে যখন পৌঁছে যাওয়ার মুখে তখন বালির গ্রাস তার কোমর অবধি গিলে ফেলল। কিন্তু শরীরে তার বেজায় ক্ষমতা। তাই ডুবতে-ডুবতেও সে শরীরটাকে ওলট-পালট খাওয়াতে লাগল। সেই সাঙ্ঘাতিক ছটফটানি ডাঙায় সাঁতার দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টার মতো। কিন্তু ভুতু তাতে আরও দু-চার হাত এগিয়ে যেতে পারল। একটা লতার মতো জিনিস বালিতে মুখ ডুবিয়ে আছে। একটু তফাতে। ভুতু প্রাণপণে নিজেকে সেদিকে ঠেলে দিতে লাগল। শরীর এবং মন একসঙ্গে একযোগে একরোখা হয়ে উঠলে তাকে ঠেকানা শক্ত। দুর্জয় চেষ্টায় বালিতে ঝড় তুলে ভুতু উপুড় হয়ে হাত বাড়িয়ে কোনওক্রমে লতাটা ধরে ফেলল। বেশ শক্ত আর মোটা একটা লতানে গাছ। সেটা প্রাণপণে চেপে ধরে নিজেকে বালির ওপর দিয়ে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে গিয়ে সে ডাঙায় উঠল।
যে জায়গায় ভুতু ডাঙায় উঠল সেটা বন্য গাছপালায় ছাওয়া এবং জমি খুব উঁচু-নিচু। এখান থেকে বাড়িটা দেখা যায় না। সামনেই একটা টিলার মতো কিছু রয়েছে।
ভুতু বসে বসে কিছুক্ষণ হাঁফ ছেড়ে নিল। তারপর উঠে দাঁড়াল।
সে জানে আগেকার দিনে শত্রুর আক্রমণের ভয়ে দুর্গের চারদিকে পরিখা থাকত, থাকত ড্র ব্রিজ। এখানে পরিখার বদলে আছে চোরাবালি। এবং ড্র ব্রিজ বলতে কিছুই নেই। কিন্তু পরিবর্তনশীল একটা পথ আছে। সেই পথ কার ইচ্ছায় চলে তা বোঝবার উপায় নেই। ভুতু এও বুঝতে পারল, এখান থেকে বেরোবার কোনও উপায় নেই। পরিবর্তনশীল পথটি খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব।
ভুতু মাথা ঠাণ্ডা রেখে জায়গাটা ভাল করে দেখল। সামনে টিলার ওপর একটা মস্ত বটগাছ ঝুরি নামিয়ে জায়গাটা অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে আছে। এদিক সেদিক মেলা ঝোঁপঝাড়।
ভুতু চট করে ওপরে উঠল না। সে একটু আড়ালেই থাকতে চায়। আগে বোঝা দরকার, এখানে কারবারটা কী।
স্কাউট-ছুরিটা বুদ্ধি করে পকেটে রেখেছিল ভুতু। সেটা হাতে নিয়ে সে চারদিক ঘুরে-ঘুরে দেখতে লাগল। ঝোঁপঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে মেলা পাথরের চাঁই পড়ে আছে। এরকম জায়গায় পাথরের চাঁই থাকতেই পারে। কিন্তু কয়েকটা পাথরের চাঁই অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল। যেন ভিতর থেকে আলো বেরোচ্ছে। সে উজ্জ্বল পাথরগুলোকে স্পর্শ করল না। বরং একটু দূর থেকে লক্ষ করল।
অনেকক্ষণ লক্ষ করার পর ভুতুর মনে হল, পাথরগুলো একটা জ্যামিতিক নকশায় সাজানো। যদি সরলরেখা দিয়ে যুক্ত করা যায় তা হলে একটা ষড়বাহু-ক্ষেত্র তৈরি হবে। ভুতু এও লক্ষ করল, পাথরগুলোর রং একরকম নয়। লাল নীল সবুজ হলুদ বেগুনি আর কমলা। কিন্তু রং খুব ফিকে। ভাল করে লক্ষ না করলে বোঝা কঠিন।
ভুতু অঙ্ক বা জ্যামতিতে খুবই কাঁচা। কিন্তু সেটা তার বুদ্ধির দোষ নয়, সে পড়াশুনো করতে ভালবাসে না, তাই সবাই তাকে কাঁচা বলে জানে। কিন্তু আজ তার মনে হল, ওই উজ্জ্বল পাথরগুলোর জ্যামিতিক নকশায় একটা কোনও সঙ্কেত আছে। প্রত্যেকটা পাথর পরস্পরের চেয়ে সমান দূরত্ব রয়েছে। ভুতুর আন্দাজ এই দূরত্বে চার ফুটের মতো হবে।
ভুতু খানিকক্ষণ ভাবল। তারপর যা হওয়ার হবে ভেবে নিয়ে সে গিয়ে ওই ষড়ভুজের ভিতরে ঢুকে একেবারে মধ্যবিন্দুতে দাঁড়াল।
কিছুই ঘটল না।
ভুতু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারদিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগল। কোনও পরিবর্তন নেই। কিছুই ঘটল না।
ভুতু সাহস করে পাথরগুলোকে নাড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু এক চুলও নড়াতে পারল না।
সে আবার একটু দূরে গিয়ে ষড়ভুজটাকে ভাল করে লক্ষ করল। ছটা ছ’রঙের পাথর জ্বলজ্বল করছে। কী মানে এর? কে এদের এভাবে মাটিতে সাজিয়ে রাখল? এর মধ্যে কি কোনও রহস্যের ইঙ্গিত রয়েছে?
ভুতু হতাশ হল না। কিন্তু ভাবতে লাগল।
পৃথিবীতে যা-কিছু আছে এবং যা-কিছু হয়, সবই যুক্তিপূর্ণভাবে। কোনও কিছুই অযৌক্তিক নয়। এমনকী ভূতও যদি থেকে থাকে তবে তার পিছনেও কোনও না কোনও যুক্তি এবং বিজ্ঞানও থাকবেই। ভুতু এটা বরাবর দেখেছে। সুতরাং এই ছ’টা পাথরের পিছনেও যুক্তি আছে। কিন্তু কী সে যুক্তি?
ভুতু কাছেপিঠে পড়ে-থাকা পাথরগুলোর ভিতর থেকে একটা পাথর তুলে নিল। একটু দূরে দাঁড়িয়ে মাথার ওপর পাথরটা তুলে নীল রঙের পাথরটার ওপর খুব জোরে ছুঁড়ে মারল সে। সঙ্গে-সঙ্গে চড়াক করে একটা মৃদু বজ্রাঘাতের শব্দ আর খানিকটা নীলচে আলো ঠিকরে উঠল পাথরটার থেকে। আর কিছু হল না। সে আবার লাল পাথরটার গায়ে একইরকমভাবে পাথর ছুঁড়ল। একইরকম শব্দ হল তবে এবার ঠিকরে বেরোল লাল আগুনের হল্কা। একে-একে পঞ্চম পাথরটার গায়েও পাথর ছুঁড়ল সে। বাকি শুধু হলুদটা। শেষবার পাথর তুলে প্রাণপণে ছুঁড়ে মারল সে। সেই শব্দ আর সেই আগুন।
তারপরেই সে হঠাৎ দেখতে পেল, ছ’টা পাথর থেকেই ছ’রকমের আলোর রেখা বেরিয়ে পরস্পরের সঙ্গে ছ’টা বাহুর মতো লেগে গেছে। একটা অদ্ভুত সুন্দর নিখুঁত আলোর ষড়ভুজ। ভুতু মুগ্ধ হয়ে দেখল। ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে গেল। তারপর দেখল, ষড়ভুজের মাঝখানে একটা রন্ধ্র। ভেতরে আলো জ্বলছে। একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে।
ভুতু সময় নষ্ট না করে সিঁড়ি দিয়ে নামল। বেশি দূর নয়। মাত্র কয়েক হাত। সিঁড়ির সঙ্গেই একটা মাঝারি মাপের ঘর। চারটে মসৃণ দেওয়াল। কোনও আসবাব নেই। সিঁড়ির ঠিক বিপরীত দিকের দেওয়ালে ফুট-চারেক উচ্চতায় একটা কালো বৃত্ত। অনেকটা ফুটবলের মতো বড়। ভুতু সেটার কাছে এগিয়ে গেল। কাছাকাছি যেতেই সে হঠাৎ একটা চুম্বকের মতো আকর্ষণ টের পেল। কিছু যেন তাকে টানছে। প্রচণ্ড টানছে। ভুতু সামলাতে পারল না, যেন একটা স্যাকশন যন্ত্র দিয়ে টেনে ধরে রেখেছে তাকে। দেওয়ালের খুব কাছাকাছি গিয়ে সে থামতে পারল। সে বোধ করল, একটা অদৃশ্য বলয়ের মধ্যে সে দাঁড়িয়ে আছে।
কারও কোনও কথা শুনতে পেল না ভুতু। কিন্তু তার মাথার মধ্যে যেন কেউ একটা সঙ্কেতবার্তা পাঠাল, “তোমার যে কোনও ইচ্ছে প্রকাশ করো, পূর্ণ হবে।”
ভুতু জবাবে বলল, “আপনি কে কথা বলছেন?”
“আমি কেউ নই।”
“আপনি কি ভূত?”
“না। আমি ইচ্ছা।”
“কার ইচ্ছা?”
“আমার নিজেরই।”
“তার মানে? আমাকে বুঝিয়ে দিন।”
“কিছু বুঝতে পারবে না।”
“তা হলে ইচ্ছে প্রকাশ করতে বলছেন কেন?”
“আমার যে তাই কাজ।”
“ওই ছ’টা পাথর কিসের?”
“একটা হেক্সাগন।”
“ওটা দিয়ে কী হয়?”
“ওটা একটা কম্বিনেশন। একটা দণ্ড আছে, তা দিয়ে ছটা পাথরকে পর্যায়ক্রমে স্পর্শ করলেই দরজা খুলে যায়। তুমি অবশ্য পাথর ছুঁড়ছ।”
“তাতে কি ক্ষতি হয়েছে?”
“না। পাথরগুলো ভাঙা যায় না। অ্যাটমবোমা দিয়েও না।”
“জয়পতাকাবাবু কোথায়?”
“কেল্লায়।”
“উনি কি নিরাপদ?”
“এখন পর্যন্ত।”
“তারপর কী হবে?”
“কেউ বাঁচবে না।”
“কেন?”
“এখানে কেউ এসে বাঁচে না।”
“আমি?”
“তুমি? তোমার কথা আলাদা।”
“কেন?”
“তুমি যে কম্বিনেশনটা বের করেছ।”
“জয়পতাকাবাবু বাঁচবেন না?”
“না।”
“কিন্তু আমি যে ওঁকে উদ্ধার করতে এসেছি।”
“উনি সাহেবের কেল্লায় ঢুকেছেন। ডিনার খেয়েছেন। ওঁকে উদ্ধার করা অসম্ভব।”
“এই যে বললেন আমার সব ইচ্ছা পূর্ণ হবে।”
“হবে।”
“জয়পতাকাবাবুকে উদ্ধার করাই যে আমার ইচ্ছা।”
“ওসব নয়। তোমার নিজের সম্পর্কে ইচ্ছা কী? সেটা পূর্ণ হবে।”
“সাহেব কে?”
“আমাদের প্রভু।”
“তিনি কোথায় থাকেন?”
“তিনি নেই।”
“তার মানে?”
“তিনি বহুকাল আগে মারা গেছেন।”
“তা হলে আপনি কে?”
“আমি কেউ নই। শুধু তাঁর পুঞ্জীভূত ইচ্ছা।”
“আমি বুঝতে পারছি না। বুঝিয়ে দিন।”
“বুঝতে পারবে না। তোমার মস্তিষ্ক তত উন্নত নয়।”
“আমার মস্তিষ্কের উন্নতি কী করে হবে?”
“হবে।”
“কী করে?”
“অপেক্ষা করো।”
ভুতু পরিষ্কার টের পেল, দুটো হাত দেওয়াল থেকে বেরিয়ে এল তার মাথার দুদিক দিয়ে। তারপর বাক্সের ডালা খোলার মতো তার মাথার খুলি খুলে ফেলল। সে বিন্দুমাত্র ব্যথা টের পেল না। কয়েক সেকেণ্ড শুধু মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ-চমকের মতো কিছু ঘটতে লাগল। তারপর হাত দুটো আবার দেওয়ালে ঢুকে মিলিয়ে গেল।
“এটা কী করলেন?”
“ছোট একটা অপারেশন।”
“কই আমার মস্তিষ্কের তত উন্নতি ঘটল না?”
“ঘটেছে। অপেক্ষা করো, টের পাবে।”
“কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।”
“বেশিক্ষণ নয়। তোমার ধূসর কোষ জাগ্রত হয়েছে। সমন্বয়ের অপেক্ষা। তাড়াতাড়ি করলে তুমি মারা পড়বে। তাড়াতাড়ি এসব জিনিস হয় না।”
“কেন হয় না?” “মস্তিষ্কের ক্রিয়া হঠাৎ বেড়ে গেলে তুমি তাল সামলাতে পারবে না।”
“ডিনার ব্যাপারটা কী বলবেন? আমি বাতাসে বারবার ডিনারের কথা শুনেছি।”
“ডিনার হল খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সাহেব কখনও একা ডিনার খেতে পারতেন না। কিন্তু তাঁর সঙ্গী ছিল না। খুব কষ্ট হত ডিনারের সময়।”
“তারপর?”
“তারপর আমরা ডিনারের সময় লোক হাজির করতাম। কিন্তু তারা এত নিবোধ যে সাহেবের সঙ্গে সমান পর্যায়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলার যোগ্য ছিল না। সাহেবের ডিনার মাটি হত।”
“তারপর? সেই লোকগুলোর কী হত?”
“এক রাত্রি তারা খুব আদর-যত্ন পেত। কিন্তু পরদিন সকালে উঠেই তারা দেখতে পেত, কেল্লার জায়গায় একটা ধ্বংসস্তূপ। চারদিকে চোরাবালি। তারা বেশিরভাগই পালাতে চেষ্টা করে চোরাবালিতে ডুবে মারা গেছে।”
“কেল্লাকে তারা ধ্বংসস্তূপ দেখত কেন?”
“ফ্রিকোয়েন্সি পালটে দেওয়া হত বলে।”
“বুঝিয়ে বলুন।”
“ফ্রিকোয়েন্সি কাকে বলে জানো?”
“কম্পন।”
“সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কম্পন। পৃথিবীর সব বস্তুরই কম্পন আছে। একটা জিনিসের ওই কম্পন বদলে দিলে সেটা অন্যরকম বা অদৃশ্যও হয়ে যেতে পারে। এসব উন্নত বিজ্ঞানের কথা।”
“কিন্তু আমি বুঝতে পারছি।”
“তোমার মস্তিষ্কের উন্নতি ঘটেছে। কী বুঝতে পারছ?”
“একটা জিনিস দৃশ্য বা অদৃশ্য হতে পারে কিন্তু তার অস্তিত্ব মুছে যায় না। তবে তার কম্পন আমাদের কম্পনের সমানুপাতিক হলে আমরা সেটাকে বোধ করতে পারি না।”
“অনেকটা বুঝেছ। কিন্তু কী করে তা ঘটানো হয় তা জানো।”
“একটু একটু আন্দাজ করছি।”
“কী আন্দাজ?”
“সাহেব কিছু প্রাণহীন বস্তুর মধ্যে নিজের বোধ বুদ্ধি ও ইচ্ছা সঞ্চার করতে পেরেছিলেন।”
“বিশ্বজগতে প্রাণহীন কিছু নেই। সবই প্রাণময়। তবে তোমাদের বিজ্ঞান দিয়ে তা বুঝে ওঠা অসম্ভব।”
“সব বস্তুর মধ্যেই কি প্রাণ আছে?”
“আছে।”
“কিন্তু বুদ্ধি বা কর্মকুশলতা তো নেই।”
“না।”
“সাহেব সেইসব বস্তুর মধ্যে সেটা সঞ্চার করেছিলেন, তাই তো!”
“তাই। আমরা আজ্ঞাবাহী ছিলাম।”
“আপনাদের স্বাধীন ইচ্ছা কি আছে?”
“প্রোগ্রাম আছে।”
“বুঝতে পারছি। অনেকটা কম্পিউটারের মতো, কিন্তু আরও অনেক উন্নত।”
“অনেক। তুমি বুদ্ধিমান।”
“আমার লাঠিটা কে কেড়ে নিয়েছিল?”
“ইচ্ছা।”
“আমার পথ কে মুছে দিয়েছিল?”
“ইচ্ছা।”
“বালিতে কার পায়ের দাগ পড়েছিল?”
“তুমি খুব সাহসী।”
“আবার জিজ্ঞেস করছি, বালিতে কার পায়ের দাগ পড়েছিল?”
“তুমি খুব সাহসী ও বুদ্ধিমান। তোমার জিদও প্রচণ্ড।”
“কিন্তু এ-প্রশ্নটার জবাব দিচ্ছেন না কেন? বালিতে কার। পায়ের ছাপ পড়েছিল?”
কিছুক্ষণ নীরবতা।
“বলব না।”
“তা হলে বলব, আপনি জানেন না।”
কণ্ঠস্বরটা হঠাৎ যেন ভয় খেয়ে একটু কেঁপে গেল, “অন্য প্রশ্ন করো।”
“আমি এই প্রশ্নেরই জবাব চাই।”
“আমি এই প্রশ্নের জবাব দেব না। আমি তোমার আজ্ঞাবাহী নই।”
“আপনি কি রাগ করেছেন?”
“আমাদের রাগ নেই। রাগ অযৌক্তিক ব্যাপার।”
“আমার মনে হয়, বালিতে যার পায়ের ছাপ পড়েছিল আপনি তাকে ভয় পান।”
“অন্য প্রশ্ন করো।”
“আপনার সাহেবের নাম কী?”
“আলফাবেট।”
“এটা কী ধরনের নাম?”
“সাহেব তোমাদের মতো মানুষ ছিলেন না।”
“তিনি কীরকম মানুষ ছিলেন?”
“অনেক উন্নত।”
“তিনি কি অন্য কোনও গ্রহের মানুষ?”
“তিনি একটা অঘটন।” ভুতু বুঝল, এ প্রশ্নেরও জবাব পাওয়া যাবে না। সে তাই অন্য প্রশ্ন করল।
“তিনি কতদিন আগে মারা গেছেন?”
“চার বছর।”
“সাহেবের শরীরটার কী হল?”
“অন্য প্রশ্ন করো।”
“এই দুৰ্গটা কতদিনের?”
“দুশো বছর।”
“সাহেব কি দুশো বছর আগে এখানে ছিলেন?”
“না, এটা পটাশগড়ের এক রাজা বানিয়েছিল। দুর্গ কালক্রমে ধ্বংস হয়ে যায়। সাহেব দুর্গা দখল করে ছিলেন।”
“বুঝলাম। দুর্গে কি আমি একবার যেতে পারি?”
“তুমি ইচ্ছা করলে সবই পারো। কিন্তু দুর্গে কাউকেই পাবে না।”
“কেন? জয়পতাকাবাবু কি দুর্গে নেই?”
“আছে, একা নয়, সঙ্গে আরও তিনজন লোক আছে। কিন্তু তুমি ওদের দেখতে পাবে না।”
“কেন পাব না।”
“ওদের ফ্রিকোয়েন্সি আলাদা হয়ে গেছে। তোমার সঙ্গে মুখোমুখি হলেও তুমি ওদের দেখতে পাবে না। তোমরা পরস্পরকে ভেদ করে যাবে, কিন্তু কেউ কারও অস্তিত্ব টের পাবে না।”
“কী সর্বনাশ? এর কোনও উপায় নেই?”
“না। ওরা চিরকাল এখানেই থেকে যাবে। যদি বেরোতে চায় তা হলে চোরাবালিতে ডুবে মরবে।”
“আর আমি?”
“তোমার কথা আলাদা। তুমি ইচ্ছা করলেই ফিরে যেতে পারো। বিপদ হবে না।”
“জয়পতাকাবাবুর সঙ্গে আর কে কে আছে?”
“জয়ধ্বনি, শ্যাম লাহিড়ী আর ব্যোমকেশ।”
“সর্বনাশ! এরা যে সবাই আমার ভীষণ চেনা।”
“দুঃখিত, ওদের জন্য কিছুই করার নেই।”
“ষড়ভুজটার অর্থ কী?”
“ষষ্ঠ ইকোয়েশন। মানুষ বুঝতেই পারবে না।”
“ইকোয়েশন আমি জানি।”
“এটা কঠিন। কেউ জানে না। সাহেব জানতেন।”
“এতে কী হয়?”
“ওই ইকোয়েশনেই বিশ্ব রহস্যের, চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে, যে কষতে পারে সে দারুণ সব কাজ করতে পারে।”
“আমি কি ইকোয়েশন মিলিয়েছি?”
“না। তুমি শুধু কম্বিনেশনটা করতে পেরেছ। ওটা সোজা, তবু সবাই পারে না।”
“আমাকে কতক্ষণ আটকে রাখবেন?”
“তুমি চাইলেই ছেড়ে দেব।”
“আমি আর-একটা কথা জানতে চাই। পটাশগড়কে সকলে দেখতে পায় না কেন?”
“আমরা মাঝে-মাঝে পুরো জায়গাটারই স্পন্দন বদলে দিই। তখন দুর্গ অদৃশ্য হয়ে যায়, চোরাবালিও অদৃশ্য হয়ে যায়।”
“জঙ্গলের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গা আছে, সেখানে জঙ্গলের পশুরা কেউ ঢুকতে পারেনি, আমিও না। ওই জায়গাটায় কী ছিল?”
“টাইম বেরিয়ার বললে বুঝবে?”
“না।”
“ওই জায়গাটা তোমার সময়ে নেই। ভিন্ন সময়ে প্রোগ্রাম করা আছে।”
“তার মানে?”
“তুমি যখন জায়গাটা দেখছ, তখন ওটা বর্তমানকালে নেই। পাঁচ বছর অতীতে পিছিয়ে রয়েছে। ওর চারদিকে সময়ের বেড়া থাকায় ঢুকতে পারোনি, ঢুকতে পারলে তোমার বয়স এক মুহূর্তে পাঁচ বছর পিছিয়ে যেত।”
“ঢোকা যায় না?”
“না। লক করা আছে। টাইম বেরিয়ার আছে।”
“আমি যদি যেতে চাই।”
“কেন চাও?”
“আমি পাঁচ বছর আগে কেমন ছিলাম তা জানতে চাই।”
“সত্যিই চাও?”
“খা।”
“তুমি বুদ্ধিমান।” দেওয়াল থেকে একটা হাত বেরিয়ে এল। তাতে একটা ছোট স্ফটিকের দণ্ড।
“এটা নাও। টাইম বেরিয়ারে স্পর্শ করলেই ঢুকতে পারবে।” ভুতু দণ্ডটা নিল। তারপর বলল, “এবার কী করব?”
“ইচ্ছা করো। ইচ্ছা করলেই ওই জায়গায় চলে যেতে পারবে।”
হঠাৎ সাকশনটা বন্ধ হয়ে গেল। ভুতু টের পেল, চারদিকের বলয়টা আর নেই। সে স্ফটিকের দণ্ডটা হাতে নিয়ে চোখ বুজে প্রাণপণ ইচ্ছা করল, “আমি ওখানে যাব।”
না, কোনও ম্যাজিক ঘটল না। তবে ভুতুর সমস্ত শরীরে যেন একটা বিদ্যুতের বেগ শিহরিত হয়ে বয়ে গেল। সে চলতে লাগল। সিঁড়ি বেয়ে উঠে সে সোজা চোরাবালিতে নেমে ছুটতে লাগল। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এঁকেবেঁকে তীরগতিতে সে হাজির হয়ে গেল সেই ফাঁকা ভূমিখণ্ডের সামনে।
স্ফটিকের দণ্ডটা সামনে বাড়াতেই একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ হল। কিছু সরে গেল সামনে থেকে।
ঢুকবার আগে ভুতু ক্ষণেক দ্বিধা করল। তার বয়স পাঁচ বছর কমে যাবে? কী করে হবে সেটা? কেমন লাগবে?
খুব সাবধানে পা বাড়াল ভুতু। খুব ধীর পদক্ষেপে পা রাখল মাটিতে। তারপরেই চমকে থেমে গেল। শরীরের ওপর থেকে কিছু খসে পড়ে গেল যে। যেন একটা খোলস। মাথাটা সামান্য ধাঁধিয়ে গেল।
সামলে উঠে ভুতু দেখল, তার শরীরের দৈর্ঘ্য অনেক কমে গেছে। একটু রোগা হয়ে গেছে সে। পাঁচ বছর আগে সে কি এরকম ছিল?
ভুতু দাঁড়িয়ে চারদিকটা দেখতে লাগল। কিছু নেই। কিন্তু সে জানে, পাঁচ বছর আগে আলফাবেট-সাহেব বেঁচে ছিল। আর এই জায়গাটা নিশ্চয়ই কোনও কারণে সময়ের বাঁধ দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। খুব সম্ভব আলফাবেট-সাহেবের দেখা এখানেই পাওয়া যাবে।
ভুতু চুপ করে একটা ঝোঁপের ধারে বসে রইল। লুকিয়ে থাকাই ভাল।
খুব বেশিক্ষণ বসতে হল না ভুতুকে। আচমকা একটা নীল আলো ঝলসে উঠল আকাশে। একটা তীব্র শিসের শব্দ তার কানের পরদা প্রায় ফাটিয়ে দিতে লাগল। চারদিকে মাটি গুড়গুড় করে কাঁপছে। ভুতু বাতাসে একটা তীব্র কম্পন টের পাচ্ছিল। সে সহ্য করতে পারল না। চোখ বুজে দাঁতে দাঁত চেপে হাত মুঠো করে মূৰ্ছিতের মতো ঢলে পড়ে গেল মাটিতে।
যখন চোখ মেলল, তখন সামনে একজন বিশাল চেহারার মানুষ দাঁড়িয়ে। প্রায় আট ফুট লম্বা, বিশাল দৈত্যের মতো আকৃতি। মানুষটা তাকে দেখছে।
ভুতু ভয়ে সিঁটিয়ে গেল।
লোকটা কথা বলল না, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় একটা বায়ু-তরঙ্গে লোকটা তার মগজে একটা প্রশ্ন পাঠিয়ে দিল, “কী চাও?”
ভুতু সভয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার এক মাস্টারমশাই…”
আবার বায়ু-তরঙ্গ এল। লোকটা যেন বলে পাঠাল, “তোমাকে কিছুই বলতে হবে না। তোমার মগজের সব কথা এবং চিন্তাই আমি ধরতে পারছি।”
“আমি এখন কী করব?”
বায়ু-তরঙ্গ তার মগজে একটা ওলট-পালট ঘটিয়ে বলল, “সমাধান তোমার হাতেই আছে। বুদ্ধি খাটালেই পারবে। তোমার মগজ অনেক বেশি ক্রিয়াশীল। তুমি ষড়ভুজের কম্বিনেশন বের করেছ। পারবে। চেষ্টা করো।”
“ওদের বাঁচানো যাবে?”
“চেষ্টা করো। হয়তো পারবে।”
“আপনি কী কৌশলে কথা বলছেন। এটাই কি টেলিপ্যাথি?”
“হ্যাঁ, তবে অনেক উন্নত ধরনের।”
“আপনি কোন্ গ্রহের মানুষ?”
“অনেক দূরের।”
“বালিতে কার পায়ের দাগ পড়েছিল?”
“নিউমারেলস-এর।”
“সে কে?”
“সে একটা অঙ্ক।”
“অঙ্ক। অঙ্ক কি কখনও হাঁটে। তাও জুতো পায়ে দিয়ে?”
“না, তবে অঙ্ককে শরীরী রূপ দিলে হয়।”
“তাকে কোথায় পাব?”
“কোথাও আছে। অঙ্কটা কষলেই পাবে। যেখান থেকে এসেছ, সেখানে ফিরে যাও। অঙ্ক প্রস্তুত আছে।”
আবার নীল আলোর ঝলকানি আর তীব্র শিসের শব্দ। ভুতু ফের চোখ বুজে ফেলল। যখন চোখ খুলল তখন কেউ নেই। তার মাথা ঘুরছিল। তবু সে টাইম বেরিয়ার ভেদ করে বেরিয়ে এল। তারপর ছুটতে লাগল।
যখন সেই ঘরটায় আবার ফিরে এল, তখন অবাক হয়ে দেখল, ঘরে একটা টেবিল আর চেয়ার পাতা, টেবিলের ওপর একটা প্যাড আর পেনসিল। প্যাডে দারুণ ইকোয়েশন।
ভুতু বসে পড়ল। অঙ্কটা তাকে করতেই হবে।
ওদিকে পটাশগড়ের কেল্লায় ডাইনিং হল-এ জয়পতাকা নিয়ে এসেছেন তিনজনকে। দেদার খাবার সাজানো।
জয়পতাকা বললেন, “যত খুশি খাও দাদু, এমন খাবার জীবনে খাওনি।”
জয়ধ্বনি একটু চটে উঠে বললেন, “তোর ঠাকুমার রান্নার চেয়েও ভাল? অত সোজা নয় রে। খাঁটি বিক্রমপুরের রান্না, ওর কাছে কেউ লাগে না। কচুর শাক বলো কচুর শাক, মুড়িঘণ্ট বলল মুড়িঘণ্ট, চাপড়ঘণ্ট বলো চাপড়ঘন্ট, পিঠে-পায়েস–ওসব স্বর্গীয় জিনিস।”
“খেয়েই দ্যাখো না।”
সকলেরই খিদে পেয়েছে। রাত তো কম হয়নি।
খেতে বসেই প্রথম পদটা মুখে দিয়েই জয়ধ্বনি বলে উঠলেন, “এ-হচ্ছে মাংসের সুরুয়া, বেশ বেঁধেছে।”
পরের পদটা খেতে গিয়ে ব্যোমকেশ বললেন, “এ কুমডোর ছক্কা না হয়ে যায় না। তবে খাসা হয়েছে।“
শ্যাম লাহিড়ীই শুধু বিনা মন্তব্যে খেতে লাগলেন।
মাঝপথে একটা পদ আমিষ না নিরামিষ তাই নিয়ে ব্যোমকেশ আর জয়ধ্বনিতে একটু তর্ক বেধে উঠল। জয়ধ্বনি একটা কাঁটা-চামচ বিপজ্জনকভাবে উদ্যত করে ধরায় ব্যোমকেশ মিইয়ে গেলেন।
খেয়েদেয়ে উঠে ব্যোমকেশ বললেন, “আর দেরি নয়। এবার ফেরা যাক। ওদিকে দু-দুটো মিটিং-এর মেলা কাজ বাকি। আমার এখনও বক্তৃতা মুখস্থ হয়নি।”
সকলেই সায় দিলেন।
শুধু শ্যাম লাহিড়ী বললেন, “ফেরা খুব সহজ হবে না।”
জয়পতাকা বললেন, “শক্তও কিছু নয়। আমি তো দিব্যি একটা শেয়ালের পিছু পিছু চলে এলাম। আপনারা এলেন একটা আলো ফলো করে। আমি রং ছাদে গিয়ে দূরবীনটা নামিয়ে আনি। ওটাই হচ্ছে আলোর সোর্স। তা ছাড়া আমার চটিজোড়াও হেলপ করবে।”
জয়পতাকা ছাদে উঠলেন বটে, কিন্তু দূরবীনটা খুঁজে পেলেন না। চটিজোড়াও আগের চেয়ে ভারী লাগছিল।
নিচে এসে জয়পতাকা বললেন, “দূরবীনটা নেই। এখানে খুবই অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে দেখছি। একেবারেই অবিশ্বাস্য।”
ব্যোমকেশ বললেন, “তা হলে আর দেরি নয়। দুগা বলে রওনা দেওয়া যাক।”
সকলে চোরাবালির সীমানায় এসে দাঁড়ালেন। ব্যোমকেশবাবু ধুতিটা একটু ওপরে তুলে বললেন, “তা হলে নামা যাক।”
জয়ধ্বনি বললেন, “ধুতি তুলছ কেন? জল পেরোবে নাকি?”
“তা বটে।” বলে ব্যোমকেশ ধুতি ফের নামিয়ে বললেন, “তা হলে চলুন।”
“তুমি আগে নামো।”
ব্যোমকেশ নামলেন, এবং চোখের পলকে কোমর অবধি হড়হড় করে চলে গেলেন বালির মধ্যে। শ্যাম লাহিড়ী সময়মতো
ধরলে বাকিটাও যেত।
যখন টেনে তোলা হল, তখন ব্যোমকেশ ঘড়ি দেখে বললেন, “সর্বনাশ! এ যে রাত চারটে বেজে গেল! আর কতক্ষণই বা সময় পাওয়া যাবে?”
চারজনে ভাবিত হয়ে পড়লেন। লক্ষণ ভাল নয়।
জয়পতাকা সাহস করে চটিসমেত একটা পা একটু বাড়ালেন। চোখের পলকে চটিটা পা থেকে যেন ইচ্ছে করেই খসে বালির মধ্যে তলিয়ে গেল। জয়পতাকা পিছিয়ে এলেন ভয়ে। ওই সামান্য সুযোগে দ্বিতীয় চটিটা পা থেকে একটা ব্যাঙের মতো লাফ মেরে বালিতে অদৃশ্য হল।
জয়পতাকা বললেন, “যাঃ।”
শ্যাম লাহিড়ী বিষণ্ণ গলায় বললেন, “তার চেয়ে কেল্লায় চলো। ফিরে গিয়ে ভোরের অপেক্ষা করি। দিনের বেলা যাহোক ঠিক করা যাবে।”
একথায় সকলে সায় দিয়ে কেল্লায় ফিরলেন। ডাইনিং হলের এঁটোকাঁটা সব যাদুমন্ত্রবলে পরিষ্কার হয়ে গেছে। সকলে বেশ অস্বস্তি নিয়েই বসে রইলেন। একটু ঢুলুনিও এল। হঠাৎ জয়পতাকা চেঁচিয়ে উঠলেন, “এ কী!”
সবাই চমকে চেয়ে দেখল, কোথায় কেল্লা, আর কোথায় তার। সাজানো ডাইনিং হল। সব ফক্কা। তাঁরা একটা ধ্বংসস্তৃপের ওপর বসে আছেন।
বিস্ময়ে কেউ প্রথমটায় কথা বলতে পারল না। তারপর শ্যাম ১৬
লাহিড়ী ব্যস্ত গলায় বললেন, “এরকম যে হবে তা আমার জানা ছিল। এখান থেকে আজ অবধি কেউ ফিরে যায়নি। কিন্তু বসে থাকলে তো চলবে না। চলো, উপায় একটা বের করতে হবে।”
ধ্বংসস্তূপের ইট-পাথর পার হতে বেশ কসরত করতে হল। ব্যোমকেশ ঘন ঘন ঘড়ি দেখছিলেন বলে দু’বার আছাড় খেলেন।
ধ্বংসস্কৃপের এক জায়গায় চারজনই থমকে দাঁড়ালেন। সেখানে উপুড় হয়ে একটা নরকঙ্কাল পড়ে আছে। হাত-দশেক দূরে আর-একটা।
জয়ধ্বনি শ্যাম লাহিড়ীকে বললেন, “ব্যাপারটা সুবিধের বুঝছি না। সবটাই দুঃস্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে।”
“দুঃস্বপ্নই। তবে জ্যান্ত দুঃস্বপ্ন।” চারদিকে ভোরের সুন্দর আলো ছড়িয়ে পড়েছে। একটু দূরে দেখা যাচ্ছে সবুজ বনভূমি। কিন্তু তাঁরা একটা চওড়া চোরাবালির মধ্যে কুৎসিত একটা ধ্বংসস্তূপে বন্দী।
শ্যাম লাহিড়ী হঠাৎ বললেন, “লক্ষ করেছ, পটাশগড়ে কোনও পাখিও আসে না!”
জয়ধ্বনি বললেন, “হা, জায়গাটা অস্বাভাবিক নিস্তব্ধ।”
শ্যাম লাহিড়ী কেল্লার চারদিককার ঝোঁপ-জঙ্গল, গাছপালা লক্ষ করলেন ঘুরে-ঘুরে। চেনা গাছ খুবই কম। জলের ব্যবস্থা নেই বললেই হয়। একটা পুরনো ইদারায় অনেক নিচে জল। তাও ওপরে থিকথিক করে ময়লা ভাসছে।
ব্যোমকেশ হঠাৎ বললেন, “একটা নৌকো পেলে হত।” জয়ধ্বনি অবাক হয়ে বললেন, “নৌকো! নৌকো কেন?”
“নৌকো যখন জলে ভাসতে পারে, তখন বালিতে ভাসবে এ-আর বেশি কথা কী?”
“তা নৌকো পাবে কোথায়?”
“সেটাই ভাবছি।”
“ভাবো, কষে ভেবে ফ্যালো। মিটিং-এর এখনও ঢের দেরি।”
“আচ্ছা গাছপালা দিয়ে একটা ভেলা বানিয়ে নিলে মন্দ হয় না?”
“খুব হয়। চেষ্টা করে দ্যাখো৷”।
ব্যোমকেশ উদ্যোগী পুরুষ। সঙ্গে সঙ্গে কাজে লেগে গেলেন। জয়পতাকা বিশুষ্ক মুখে তাঁকে সাহায্য করতে লাগলেন। যদিও তাঁর সন্দেহ হল, নৌকো বা ভেলা চোরাবালিতে ভাসবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কিন্তু আশা জিনিসটাই ওরকম। যা অসম্ভব তাও মানুষ আশা করে।
শ্যাম লাহিড়ী আর জয়ধ্বনি একটু তফাতে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন।
জয়ধ্বনি বললেন, “দ্যাখো লাহিড়ী, বুড়ো হয়েছি। আমাদের দিন শেষ হয়ে এল। কিন্তু নাতিটা এমন বেঘোরে মরবে এটা যে সহ্য করতে পারছি না। আমার প্রাণ দিয়েও যদি ওকে বাঁচানো যায়।”
“প্রাণ তো এমনিতেও দিতে হবে, অমনিতেও দিতে হবে। কিন্তু প্রাণটা দিলেই তো আর বাঁচানো যাবে না। এখানকার গাছপালায় কোনও ফলটল দেখছি না। জল নেই। এভাবে দু-দিন বাঁচা যাবে হয়তো। তারপর ধুকতে ধুকতে মরতে হবে।”
“বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রেখে ভাবতে হয়। এটা পুরনো কেল্লা, কোথাও সুড়ঙ্গ-টুড়ঙ্গও তো থাকতে পারে।
“সেকথা আমিও ভেবেছি। কিন্তু থাকলেও সেটা এতদিনে বুজে যাওয়ার কথা। তাছাড়া এই বিশাল ধ্বংসস্তূপে সরিয়ে সুড়ঙ্গ বের করাও তো অসম্ভব ব্যাপার।”
“হাল ছেড়ে দিচ্ছ? মরতে যখন হবেই, তখন চলল, চেষ্টা করে দেখি।”
“আমার আপত্তি নেই। চলো।”
দুজনেই ধ্বংসস্তৃপ, সরানোর কাজে লেগে গেলেন। কিন্তু এই পরিশ্রমে এবং রাত জাগার ফলে চারজনেরই দুপুর নাগাদ সাঙ্ঘাতিক খিদে এবং তেষ্টা পেয়ে গেল। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর ভেলা একটা ডালপালা দিয়ে তৈরি প্রায় হয়েছে বটে, কিন্তু সেটার ছিরি দেখে কারও ভরসা হল না।
জয়পতাকা বয়সে তরুণ। তাঁর খিদেও বেশি। তিনি আর কিছু না বলে গাছের কয়েকটা পাতা চিবিয়ে নিলেন। তারপর ওয়াক থুঃ বলে ফেলে দিলেন। যম তেতো। বিশ্রী গন্ধ।
সবাই মিলে আরও কয়েকটা গাছের পাতা চিবোনোর চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু সুবিধে হল না।
শ্যাম লাহিড়ী বললেন, “কেউ বেশি কথাটথা বোলো না। বেশি কথা বললে তেষ্টা পায়। জলের বন্দোবস্ত নেই। কাজেই সাবধান হতে হবে।”
ব্যোমকেশ ভেলার বাঁধা-ছাঁদা একরকম শেষ করে বললেন, “তা হলে এটাকে ভাসানো যাক এবার। জয়ধ্বনিদা সবচেয়ে প্রবীণ মানুষ, উনিই আগে উঠুন।”
“কেন, আমাকে চোরাবালিতে ডুবিয়ে মেরে তোমার লাভ হবে কোন অষ্টরম্ভা? ওতে আমি উঠবার পাত্র নই। তুমি ওঠো গে।”
ব্যোমকেশ দমবার পাত্র নন। বললেন, “এবার একটা বৈঠা বা লগি দরকার। তা হলেই কেল্লা ফতে।”
লগির অভাব নেই। লম্বা একটা গাছের ডাল জোগাড় হয়ে গেল। তারপর ব্যোমকেশ ভেলাটা বালির দিকে ঠেলে নিয়ে গিয়ে উঠে পড়লেন।
লগিটা ছিল বলে রক্ষা। কারণ, বালিতে পড়েই ভেলাটা ব্যোমকেশসহ অদৃশ্য হয়ে গেল। ব্যোমকেশের হাতে ধরা লগিটার ডগা শুধু উঁচু হয়ে ছিল। সেইটে চেপে ধরে শ্যাম লাহিড়ী পয়লা চোট সামলালেন। তারপর তিনজনে মিলে টেনে তুললেন ব্যোমকেশকে।
ব্যোমকেশ প্রাণে বেঁচেও কিছুক্ষণ জীবন্মাতের মতো বসে রইলেন। সর্বাঙ্গে বালি। এমন কী তাঁর দাঁতেও বালি কিচকিচ করছে, চোখে বালি কচকচ করছে। এমনকী তিনি কিছুক্ষণ মিটিং-এর কথাও ভুলে গেলেন।
ক্রমে বেলা বাড়তে লাগল। খিদে এবং তেষ্টাও বাড়তে লাগল। তারপর দেখা গেল চারজনই ঝিমোচ্ছেন।
জয়ধ্বনি হঠাৎ ঝিমোতে-ঝিমোতে সোজা হয়ে উঠে বললেন, “লাহিড়ী?”
“বলো।”
“এভাবে হার মানা কি উচিত হবে?”
“কী করতে চাও?”
“চলো। চেষ্টা করি।”
“চলো”, বলে শ্যাম লাহিড়ী উঠে পড়লেন। দুজনে আবার ধ্বংসস্তূপ সরাতে লাগলেন। কিন্তু পণ্ডশ্রম বাড়তে লাগল। কিছুক্ষণ পরই দুজনই নেতিয়ে পড়লেন। হাঁফাতে লাগলেন।
বেলা গড়িয়ে বিকেল। তারপর সন্ধে। চারদিক অন্ধকার হয়ে এল।
ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর চারজন মাটিতে শুয়ে পড়লেন ক্লান্ত হয়ে। কারও মুখে কথা নেই।
ক্রমে রাত হল। রাত গভীর হল। চারজনই একটা ঘোরলাগা তন্দ্রার মধ্যে ঝিম মেরে পড়ে রইলেন। বুক ফেটে যাচ্ছে তেষ্টায়। পেট জ্বলে যাচ্ছে খিদেয়।
মাঝরাতে হঠাৎ ব্যোমকেশ তড়াক করে উঠে বসে বেশ চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, “মানুষ কী করে নরমাংস খায় আমি জানি না। কিন্তু আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছে।”
একথা শুনে জয়ধ্বনি তাড়াতাড়ি লাঠি বাগিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “খবর্দার, আমার নাতির দিকে নজর দেবে না।”
ব্যোমকেশ আবার শুয়ে পড়ে বললেন, “আমি ঠাট্টা করলুম।”
“এই অবস্থায় কারও আবার ঠাট্টাও আসে নাকি? তোমার মতলব আমি বুঝেছি। যদি তেরিমেরি করো, তা হলে তিনজনে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গিয়ে তোমাকে বালিতে ফেলে দেব।”
ব্যোমকেশ আর কথা বললেন না। গুনগুন করে একটু গান গাওয়ার চেষ্টা করে ব্যাপারটাকে হালকা করতে চাইলেন বোধহয়। কিন্তু সুরটা গলায় খেলাল না।
ফের ভোর হল। কিন্তু চারজনের কারওই আর উঠে বসবার মতো অবস্থা নেই। খিদের চেয়েও তেষ্টা প্রবল। শ্যাম লাহিড়ী উঠে কাঁপতে কাঁপতে ইদারার ধারে গিয়ে উঁকি দিয়ে বললেন, “বালতি আর দড়ি থাকলে ওই জলই খানিকটা খেতাম।”
ক্রমে বেলা বাড়ল। চারজন আজ আর উঠলেন না। পড়ে রইলেন মাটিতে। শ্বাসের কষ্ট হচ্ছে। শরীরে আর এক রত্তি জোর নেই। মাঝে মাঝে এক-একজন “জল জল” বলে কাতরে উঠছেন।
বেলা গড়াতে লাগল। বিকেল হল। ফের রাত্রি ঘনিয়ে এল।
প্রথমে জয়ধ্বনি, তারপর ব্যোমকেশ তারপর জয়পতাকা মূৰ্ছিত হয়ে পড়লেন। শ্যাম লাহিড়ীর জ্ঞানটা লুপ্ত হল না। কিন্তু তিনিও বেশিক্ষণ লড়তে পারবেন বলে তাঁর মনে হল না।
রাত্রি গভীর হল।
.
ইকোয়েশনটা করে যাচ্ছে তো করেই যাচ্ছে ভুতু। শেষ আর হয় না। পাতার পর পাতা সে একটা অঙ্কই করে চলেছে। প্রতি পদক্ষেপেই নতুন নতুন মোড় ফিরছে অঙ্কটা। এসে যাচ্ছে নানা নতুন সংখ্যা, নতুন সঙ্কেত। কিন্তু ক্রমে ক্রমে বীজাকার ইকোয়েশন পরিণত হচ্ছে মহীরূপে। মস্ত মোটা প্যাডের পাতা ক্রমে-ক্রমে ফুরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অঙ্কটা বেড়ে যাচ্ছে তত বেড়েই যাচ্ছে।
ভুতুর কোনওদিকে খেয়াল নেই। তার মাথা চমৎকার খেলছে। অঙ্কের মধ্যে ডুবে গেছে সে। একসময়ে অঙ্কটাকে সে যেন অনুভব করতে পারল, অর্থাৎ তার মনে হল, এটা শুধু অঙ্কই নয়। অঙ্ক যেন এক ব্যক্তি, তার আলাদা সত্তা আছে, শরীর আছে।
কোথা দিয়ে রাত গেল, কোথা দিয়ে দিন, তা বুঝতে পারল না ভুতু। তেষ্টা পেলেই সে শুধু বলে “জল!”
অমনি কোথা থেকে জল এসে যায়। খিদে পেলেই সে বলে, “খাবার।”
অমনি খাবার এসে যায়।
ভুতু কোনওদিকে তাকায় না। একমনে অঙ্ক কষতে থাকে। কষতে কষতে প্যাডের পাতা শেষ হয়ে এল। একদম শেষ পাতায় চলে এল ভুতু।
কিন্তু অঙ্কটা কি শেষ হবে, ভুতুর মনে হচ্ছে, আরও বহুদূর গড়াবে অঙ্কটা।
কিন্তু প্যাডের শেষ পাতাটা যেই শেষ হল, অমনি সে বুঝতে পারল, তার চারদিকে সেই ঘেরাটোপ নেমে এসেছে। তার মাথার ভিতরে কেউ বার্তা পাঠাচ্ছে।
ভুতু কলম থামিয়ে উৎকৰ্শ হল। “আমি সংখ্যা। কী চাও?”
“অঙ্কটা কি হয়েছে?”
“অঙ্কটার কোনও শেষ নেই। যত কষবে তত বড় হতে থাকবে।”
“তা হলে কী হবে? প্যাডের পাতা যে শেষ হয়ে গেল!”
“তাতে কি? অঙ্কটা প্রাণ পেয়েছে। বাকিটা সে নিজেই করবে। করে যাবে।”
“কোথায় শেষ হবে?”
“শেষ বলে কিছু নেই। হয়ে চলবে। হতে থাকবে। ঠিক এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের মতো। অসীমের মতো।”
“কিন্তু আলফাবেট-সাহেব বলেছিলেন…”
“জানি। সাহেব বলেছিলেন, ইকোয়েশনটা করতে পারলে তুমি নিউমারেলসের নাগাল পাবে।”
“হ্যাঁ তাই।”
“আমি এসেছি।”
“আমি এই কেল্লার রহস্য ভাঙতে চাই।”
“পারবে না।”
“বালিতে কার পায়ের ছাপ পড়েছিল?”
“অবান্তর প্রশ্ন। এখানে যা কিছু ঘটে তার লৌকিক ব্যাখ্যা নেই। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। সে তুমি বুঝবে না।”
“জয়পতাকাবাবুর কী হবে?”
“তিনি মৃত্যুর কাছাকাছি।”
, “আমি তাঁদের ফিরিয়ে নিতে চাই।”
“তাঁরা অন্য তরঙ্গে রয়েছেন। দেখা হবে না।”
“আমি তাঁদের তরঙ্গে ঢুকতে চাই।”
“তা হলে তোমারও ওই দশা হবে। তরঙ্গ বদলালে আর আমাদের সাহায্য পাবে না।”
“চোরাবালির মধ্যে পথ আছে, আমি জানি।”
“আছে। সরু পথ। সে পথ ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরে যায়।”
“ঠিক ঘড়ির কাঁটার মতো?” নিউমারেলস প্রথমে জবাব দিল না। তারপর বলল, “এ্যা মিনিটের কাঁটা।”
“এখন কটা বাজে?”
“রাত বারোটা বাজতে দু’মিনিট বাকি।”
“এখন পথটা কোথায় আছে?”
“উত্তর তীরচিহ্নের বরাবর। প্রতি দশ মিনিটে ওখানে ঘুরে আসছে।”
“আমি একটা ঘড়ি চাই।”
“তুমি বুদ্ধিমান।”
“ঘড়িটা দিন।”
“ঘড়িটা তোমার কব্জিতে বাঁধা হয়ে গেছে। দ্যাখো।”
ভুতু অবাক হয়ে দেখল, বাস্তবিকই তার বাঁ হাতের কবজিতে একটা ঘড়ি। বারোটা বাজতে দেড় মিনিট বাকি।
“আমার ফ্রিকোয়েন্সি পালটে দিন।”
“দিচ্ছি। তার আগে একটা কথা।”
“কী কথা?”
“যদি তরঙ্গ না বদলাও তবে তুমি এখানে রাজার মতো থাকতে পারো। তোমার ইচ্ছা সবসময়ে পূর্ণ হবে। এত সুখ ছেড়ে যেতে চাও কেন?”
“আমি একটা অন্যায় করেছিলাম। তার প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে।”
“জানি। ঠিক আছে, তোমার তরঙ্গ পালটে দিচ্ছি।”
ঘরের আলোটা হঠাৎ নিভে গেল। চারদিকে একটা ঝিঁঝির মতো শব্দ। তারপরই ভুতু পড়ে গেল মাটিতে। টেবিল-চেয়ার উধাও হয়েছে।
ভুতু টের পেল, সে একটা ভাঙাচোরা গহ্বরের মধ্যে পড়ে আছে। হামাগুড়ি দিয়ে সে বেরিয়ে এল। তারপর ধীর পায়ে ঢালু বেয়ে উঠল। সামনেই অন্ধকার কেল্লার ধ্বংসস্তূপ। ভুতু কিছুক্ষণ বিষণ্ণ চোখে চেয়ে রইল।
বেশি খুঁজতে হল না। ঝোঁপজঙ্গলের মধ্যে চারজন শুয়ে আছে। জ্ঞান নেই। শক্তি নেই।
“শ্যামদাদু! শ্যামদাদু!” ভুতু জানে একমাত্র শ্যামদাদুই শক্ত লোক।
শ্যাম লাহিড়ী চোখ মেলে বলেন, “কে?”
“আমি ভুতু। উঠুন। আমি আপনাদের নিতে এসেছি।”
ব্যোমকেশ আতঙ্কিত গলায় খোনা সুরে বললেন, “ভূত! আমাদের নিতে এয়েছ! কেন বাবা?”
“ভূত নই। ভুতু।”
শ্যাম লাহিড়ী উঠে বসলেন। অতি কষ্টে! বললেন, “কী ভাবে এলি?”
“পরে বলব। উঠুন।”
ধীরে-ধীরে অবশ মৃতপ্রায় দুর্বল শরীরে সকলেই উঠে বসল। প্রাণের মায়া বড় মায়া।
ভুতু বলল, “খুব সাবধানে আমার পিছু পিছু আসুন।”
জয়ধ্বনি বললেন, “পারবি তো?”
“পারব। কিন্তু পথটা খুব সরু। একটু এদিক-ওদিক হলেই কিন্তু তলিয়ে যেতে হবে।”
উত্তর তীরচিহ্ন কোথায় তা ভুতু জানে না। কিন্তু সে জানে ঠিক বের করবে। তার আত্মবিশ্বাস প্রচণ্ড।
উত্তর দিকে কিছু দূরে এগোল ভুতু। হঠাৎ চোখে পড়ল, চোরাবালির একটা জায়গায় একটা পাথরের টুকরো পড়ে আছে। জ্যোৎস্নায় দেখা গেল সেটার গায়ে তীরের মতো কিছু আঁকা। আশ্চর্যের ব্যাপার, পাথরের গায়ে খোদাই করা তীরচিহ্ন ধীরে ধীরে ঘুরে যাচ্ছে। তীরটা একপাক ঘুরে বালিয়াড়ির দিকে মুখ ফেরাল। ভুতু দেখল, তার হাতঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তীরটা কাঁটায় কাঁটায় মেলানো।
“আসুন।” বলে ভুতু বালিতে পা রাখল। চোখ ঘড়ির দিকে। সেকেণ্ডে সেকেণ্ডে পথটা সরে যাচ্ছে বাঁ থেকে ডাইনে। সরু পথ। প্রতি পদক্ষেপে তাকে হিসেব করতে হচ্ছে।
ব্যোমকেশ একটু পিছিয়ে পড়ায় একটা পা বালিতে গেঁথে গেল। ভুতু চেঁচিয়ে বলল, “সাবধান।”
ব্যোমকেশ প্রায় সাষ্টাঙ্গ হয়ে জয়ধ্বনির কোমর ধরে উঠে পড়ল।
“কেমন বেকুব হে! এই অবস্থায় কেউ কাউকে সাপটে ধরে?”
ঝগড়া লাগলে দুজনেরই বিপদ। পথ সরে যাচ্ছে। ভুতু বলল “সাবধান। একেবারে আমার পায়ে-পায়ে আসুন।”
সবাই নীরবে ভুতুকে অনুসরণ করতে লাগল। বাঁ থেকে ডাইনে ঘুরে কোণাকুণি ভুতু এগোতে লাগল ঘড়ি ধরে। প্রত্যেক পদক্ষেপে অঙ্ক আর জ্যামিতি মেলাতে মেলাতেও।
দশ মিনিট পর তাঁরা সবাই ভুতুর পিছু পিছু ডাঙাজমিতে উঠে এলেন।
ব্যোমকেশ পরিশ্রমে বসে পড়লেন। তারপর শুয়ে পড়ার উপক্রম করলেন।
জয়ধ্বনি শুধু বললেন, “মিটিং! মিটিং! দেরি হয়ে যাবে।”
ব্যোমকেশ সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লেন, “তাই তো! মিটিং আছে ভুলে গিয়েছিলাম। চলুন চলুন, দেরি করা ঠিক হবে না।”
ভুতু একবার কেল্লার দিকে ফিরে তাকাল। দেখল, কেল্লা নেই। বনভূমি বিস্তার লাভ করছে। ভুতু ফিসফিস করে বলল, “তরঙ্গ পালটে গেল। হয়তো আর কোনওদিনই কেল্লাটাকে দেখা যাবে না।”
দিন-সাতেক বাদে ক্লাসে একটা শক্ত অঙ্ক দিলেন জয়পতাকা।
ভুতু অঙ্কটা কষে যখন জয়পতাকার কাছে নিয়ে গেল, জয়পতাকা ঘ্যাঁচ করে কেটে দিয়ে বললেন, “হয়নি, কেন যে অঙ্কে তুই এত কাঁচা!”
ভুতু মাথা চুলকোতে চুলকোতে জায়গায় ফিরে গেল। “নাঃ, অঙ্কই আমাকে ডোবাবে দেখছি!”