ভজবাবুকে খুঁজতে বেরিয়ে বাড়ির লোকজন শহরের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
সররাজের হাতে একটা হকি স্টিক আর মননজের হাতে একটা ক্রিকেটের স্টাম্প। দুজনে শহরের উত্তর ধারে চলে এসেছিল।
জায়গাটা আগাছা আর জঙ্গলে ভরা। রাত নিশুত। এ অঞ্চলে লোকজনের বসবাস খুবই কম। শোনা যায়, এ অঞ্চলের বাসিন্দারা খুব একটা ভাল লোক নয়। দিনের বেলাতেও ভয়ে লোক এদিকে আসে না।
মনোজ হঠাৎ সরোজের হাত টেনে ধরে বলে, “এই দাদা!”
সরোজ থমকে গিয়ে বলে, “কী?”
“গান শুনছিস?”
সোজ কান পেতে শোনে। ঝিঁঝির ডাক, গাছের পাতায় বাতাসের শব্দ আর ঘুম ভাঙা পাখির অস্পষ্ট ডাক, মাঝে মাঝে শেয়ালের “হুয়া, হুয়া”। এইসব ভেদ করে অনেক দূর থেকে ক্ষীণ একটা গানের শব্দ আসছে বটে। কে যেন গাইছে, “ভাঙব লোহার কপাট ভাই, আর তো কোনও শঙ্কা নাই.”
সরোজ বলল, “এ দিকেই আসছে!”
মনোজ খানিকটা গান শুনে বলল, “মেজকাকার গলা।”
“যাঃ!”
“দেখিস। ওই শোন আরও কাছে এসে গেছে। ওই দ্যাখ মশালের আলো! দাদা, লুকিয়ে পড়।”
দুই ভাই তাড়াতাড়ি গাছপালার মধ্যে লুকিয়ে পড়ে চেয়ে রইল। তারপর যা দেখতে পেল তা প্রত্যয় হয় না। তারা দেখল, ভজবাবু গান গাইতে গাইতে বিশাল এক দল ডাকাত নিয়ে চলেছেন।
দলটা দুই ভাইয়ের একেবারে নাকের ডগা দিয়েই যাচ্ছিল।
সরোজ বলে, “মেজকাকার হাতে খাঁড়া।”
মনোজ বলে, “মেজকাকার চোখ চকচক করছে।”
সরোজ বলে, “মেজকাকার হল কী?”
মনোজ হঠাৎ মেজকাকার পাশে মশাল হাতে মেজ সদারকে দেখতে পেল। একটু চমকে উঠল সে। কিন্তু শব্দ করল না।
ডাকাতের দল তাদের ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। ভজবাবু তখন গাইছেন, “বুকের ভিতরে ঘোড়া ছুটে যায়, ওরে তোরা ছেড়ে দে ছেড়ে দে আজ আমারে…”
সরোজ একটু ভেবে চিন্তে বলে, “মনে হচ্ছে, ডাকাতরা মেজকাকাকে কোথাও ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তাই ছেড়ে দেওয়ার জন্য গান গাইছে মেজকাকা।”
মনোজ মাথা নেড়ে বলে, “মেজকাকাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে না, মেজকাকাই ডাকাতদের নিয়ে যাচ্ছে।”
সরোজ বলে, “কিন্তু মেজকাকার যে দারুণ চোর-ডাকাত আর ভূতের ভয়!”
একটু দূর থেকে ভজবাবুর গলার গান ভেসে আসছিল, “সামনে রাজার বাড়ি, চল যাই তাড়াতাড়ি, বিবাদ-বিসম্বাদ থামা রে…”
মনোজ সবরাজের হাত চেপে ধরে বলল, “দাদা, ডাকাতদের নিয়ে মেজকাকা রাজবাড়ির দিকে যাচ্ছে। এক্ষুনি ছোটকাকাকে খবরটা দেওয়া দরকার।”
সরোজ বিরক্ত হয়ে বলে, “অত ঝামেলায় কী হবে? চল তার চেয়ে মেজকাকাকেই গিয়ে ধরলেই তো হয়। বলব, শিগগির বাড়ি চলো, বাবা ডাকছে। বাবা ডাকছে শুনলেই সুড়সুড় করে চলে আসবে।”
মনোজ মাথা নেড়ে বলে, “দূর, তুই মেজকাকাকে ভাল করে দেখিসনি। দেখলি না, মেজকাকার চোখ কেমন চকচকে, মুখটা ফোলা ফোলা, হাতে খাঁড়া, গলায় গান! এ সেই মেজকাকাই নয়, দেখলে আমাদের চিনবেই না। আর ডাকাতরাই বা ছাড়বে কেন? চল, বাড়ি গিয়ে ছোটকাকাকে ডেকে আনি।”
দুই ভাই বাড়ির দিকে দৌড়তে থাকে। বাড়ির ফটকেই ঠাকুরঝি। তাঁর সাদা থান তিনি মালকোঁচা মেরে পরেছেন, হাতে টর্চ, লাঠি, আর কোমরে দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা হাত দা। ঠাকুরমা উঠোনের দরজায় চুপটি করে বসে চোখের জল মুছছেন। মা তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে।
সরোজ আর মনোজ ফটকের দিকে গেল না। ছোটকাকা হারাধন বলেছিল, ভাল করে তৈরি হয়ে বেরোতে তার কিছু দেরি হবে। দুই ভাই তাই গিয়ে ল্যাবরেটরিতে ঢোকে।
ঢুকতেই দেখে, হারাধন তৈরি হয়ে বেরোচ্ছে। একটা গোরিমানকে শিকলে বেঁধে নিয়েছে হারাধন, অন্য হাতে একটা টস্তল (টর্চ+পিস্তল, এটা হারাধনের নিজের আবিষ্কার, একই সঙ্গে টর্চ এবং পিস্তলের কাজ করে), আর তার কাঁধে সেই বদমাশ কাকটা বসে আছে। পাখির ঘরে পাখিগুলো খুব চেঁচাচ্ছে।
মনোজ হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, “ছোটকাকা, মেজকাকা ডাকাতের দল নিয়ে রাজবাড়ি লুট করতে যাচ্ছে। শিগগির চলল। “
হারাধন আকাশ থেকে পড়ে বলে, “মেজদা! ডাকাতের দল নিয়ে! রাজবাড়ি! আর কী বললি?”
সরোজ : “লুট করতে…”
মনোজ : “যাচ্ছে…”
হারাধন চোখ বুজে দাঁড়িয়ে বলল, “আবার বল। এবার একটু আস্তে আস্তে।”
সরোজ আর মনোজ পালা করে বলল। পাখির ঘরে পাখিরা খুব চেঁচাচ্ছে এখনও। হারাধন পিছনে ফিরে ঘরটা দেখে নিয়ে বলল, “পাখিগুলোর আজ হল কী? যাকগে। যা, রাজবাড়ি। রাজবাড়িই বললি তো!”
সরোজ আর মনোজ পালা করে বলল। পাখির ঘরে পাখিরা খুব চেঁচাচ্ছে এখনো। হারাধন পিছনে ফিরে ঘরটা দেখে নিয়ে বলল, “পাখিগুলোর আজ হল কী? যাকগে। তাঁ, রাজবাড়ি। রাজবাড়িই বললি তো!”
সরোজ আর মনোজ একসঙ্গে–”হ্যাঁ হ্যাঁ, রাজবাড়ি।”
“মেজদা?”
সরোজ আর মনোজ–”মেজকাকা। গান গাইতে গাইতে যাচ্ছে।”
“রাজবাড়ি!” বলে হারাধন তবু ইতস্তত করে। ঠিক এ সময়ে হারাধনের পিছন থেকে কে যেন বিরক্তির গলায় বলে ওঠে, “শ্যা মশাই, রাজবাড়ি। রাজার বাড়ি, যাকে বলে ষষ্ঠীতৎপুরুষ সমাস। জলের মতো সোজা।”
সবাই অবাক হয়ে দেখে, শালিখের খাঁচার পিছন থেকে দুঃখবাবু বেরিয়ে আসছেন।
হারাধন বলে, “আপনি এখানে?”
দুঃখবাবু দুঃখের সঙ্গে বলেন, “আর কোথায় লুকোব বলুন, কিন্তু এই বদমাশ পাখিগুলোই কি লুকিয়ে থাকতে দেয়। তখন থেকে চেঁচাচ্ছে।”
“লুকিয়ে ছিলেন কেন?”
দুঃখবাবু রেগে গিয়ে বলেন, “লুকোব না? একে তো খুনি, তার ওপর পুলিশ, তিন নম্বর হনুমান, চার নম্বর এই রাতে ভজবাবুকে খুঁজতে যাওয়া। চাকরি করতে এসে তো আর প্রাণটা দিতে পারি
মশাই।” হারাধন বলল, “কিন্তু পাখিগুলো এখনও চেঁচাচ্ছে কেন?”
“গণেশবাবুও আছেন যে!” বলতে না বলতে টিয়ার খাঁচার পেছন থেকে গণেশবাবু বেরিয়ে আসতে আসতে বললেন, “গান গাইলেই হল না কি না! সবাই যদি গান গাইতে পারত তবেই হয়েছিল আর কি!”
হারাধন অবাক হয়ে বলে, “হঠাৎ গানের কথা কেন?”
গণেশবাবু বললেন, “ওই তো শুনলেন সরোজ আর মননজের মুখে, ভজবাবু নাকি গান গাইতে গাইতে ডাকাতি করতে যাচ্ছেন। ডাকাতি করা খারাপ কাজ বটে, কিন্তু যে গানের গ জানে না তার গান গাওয়া ডাকাতির চেয়েও খারাপ কাজ।”
হারাধন বলে, “তা বটে, কিন্তু মেজদা তো কখনও ভুলেও গান গায় না।”
গণেশবাবু গায়ের ধুলো-টুলো ঝেড়ে বললেন, “আপনার এই চিড়িয়াখানাটা বড় জব্বর জায়গা মশাই। যে ঘরেই লুকোতে যাই সে ঘরেই ডিসটার্বেন্স। এ ঘরে গেলে হনুমান দাঁত খিচোয়, ও ঘরে সাপ ফোঁস ফোঁস করে, সে ঘরে ব্যাং ডাকে, এ ঘরটায় পাখিদের কী কিচির মিচির বাবা! এর চেয়ে ভজবাবুর গান শোনা ভাল। চলো দেখি সরোজ মনোজ, তোমাদের মেজকাকু কেমন গাইছে সেটা শুনে আসি।”
দুঃখবাবু মনের দুঃখে বলে, “সবাই গেলে আমিই বা একা থাকি কী করে? এ বাড়ি খুব সেফ নয়। চলুন আমিও না হয় একটু ঘুরে আসি।”
.
রাত্রিবেলা রাজা গোবিন্দনারায়ণের ভাল ঘুম হয় না। তার কারণ হল, শোওয়ার আগে তিনি কোমরে একটা মোটা ঘুনসিতে রাজবাড়িতে যত চাবি আছে সব বেঁধে নিয়ে তবে ঘুমোতে যান। রাজবাড়ির চাবির সংখ্যা কম নয়। দেউড়ির চাবি থেকে শুরু করে ভাঁড়ারের চাবি মিলিয়ে ছোট বড় শত খানেক তো হবেই। কোমরের চারধারে গোল, মোটা, লম্বা, ছোট বড় হরেক চাবি ঝুলিয়ে রাজা যখন শোন তখন সেগুলো গায়ে ফোটে। তার ওপর একটু নড়লে চড়লেই চাবিগুলোর ঝনঝন করে বিকট শব্দ হয়।
গোবিন্দনারায়ণের আজ রাতে ঘুম না হওয়ার একটা তৃতীয় কারণও আছে। গোয়েন্দা বরদাচরণের কাছ থেকে তিনি আজই। জানতে পেরেছেন যে, চোরকুঠুরির জমানো টাকাগুলো সবই অচল। তাঁর অবশ্য বিশ্বাস হয়নি। তাই সন্ধের পর তিনি চোরকুঠুরি থেকে দুটো টাকা বের করে চাকরকে বাজারে পাঠিয়েছিলেন মুড়ি কিনে আনতে। চাকর এসে টাকা দুটো ফেরত দিয়ে বলেছে, “দোকানদার জিজ্ঞেস করল এ নোট দুটোয় কি উটের ছবি ছাপা আছে?”
গোবিন্দনারায়ণ তখন থেকে শোকমগ্ন। তার ওপর হাড় হাভাতে গোয়েন্দাটা মহা জ্বালাতন শুরু করেছে তখন থেকে। কেবল বলছে, “আপনি আমার মাস মাইনেটা কি ওইসব টাকা দিয়ে দেবেন নাকি? আপনার মতলব তত ভাল ঠেকছে না।“
গোবিন্দনারায়ণ তাকে যতই ধমকান সে কিছুতেই শোনে না। কেবল বলে, “ও হোঃ হোঃ, আমি যে অনেক আশা করে কেসটা হাতে নিয়েছিলাম!”
তর্কে বিতর্কে রাত হয়ে যাওয়ায় বরদাচরণ আর বাড়ি ফেরেননি, তিনি রাজা গোবিন্দনারায়ণকে বলেছেন, “সকাল হলে আমি রাজবাড়ির রূপোর বাসন নিয়ে গিয়ে বাজারে বেচে দেব।” এই বলে গোয়েন্দাটা রাজার হেঁসেলে রাতের খাওয়া সেরে বাইরের দরবার ঘরে ঘুমোতে গেছে।
সেই থেকে গোবিন্দনারায়ণের ঘুম নেই। চোর কুঠুরির সব টাকা অচল। গোয়েন্দা সকালবেলা রুপোর বাসন নিয়ে যাবে। ভাগ্নেটা গাওয়া ঘিয়ের লুচি খেয়ে গেল।
.
রাত বারোটার পর গোবিন্দনারায়ণ আর বিছানায় থাকতে পারলেন না। এই শীতেও বিছানাটা গরম ঠেকছে। উঠে চাবির শব্দ তুলে একটু পায়চারি করছিলেন। সে সময়ে শুনতে পেলেন কে যেন দেউড়ির কাছে গান গাইছে, “দরজা খোলো হে, ঝটপট খোলো, দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা…”
গান গোবিন্দনারায়ণের খারাপ লাগে না। তিনি তাই ভাল করে শোনার জন্য দোতলার অলিন্দে এসে দাঁড়ালেন। আর দাঁড়িয়েই মূৰ্ছিত হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।
ভজবাবু উঁচু গায় গাইলেন, “দরজা যদি না খোলো তবে আজ টেনে তুলে নেব চামড়া…”
রাজবাড়ির দুচারজন বুড়ো দারোয়ান এখনও অবশিষ্ট আছে। তারা সব ঘুমোচ্ছিল, গান শুনে উঠে সবাই বাইরে এসে ফটকের বাইরের দৃশ্য দেখে হাঁ।
মেজ সদর বাইরে থেকে গর্জন করে ওঠে, “এই! সব হাঁ করে দেখছিস কী? ফটক খুলে দে!”।
একজন বুড়ো দারোয়ান চাবির জন্য রাজার কাছে দৌড়ে এল। রাজা মূর্ছা ভেঙে বললেন, “দুগা দুর্গতিনাশিনী! গোয়েন্দাটা বসে বসে মাইনে খায়, ওটাকে ঘুম থেকে তুলে দে তো! আর দৌড়ে পিছনের ফটক দিয়ে গিয়ে পুলিশে খবর দে।”
দারোয়ান চলে গেল।
বাইরে ভজবাবু গেয়ে উঠলেন, “লাথি মেরে ভাঙব তালা, দারোয়ান দৌড়ে পালা, বাঁচতে যদি চাস..”
মুহূর্তের মধ্যে চল্লিশ-পঞ্চাশটা মশাল জ্বলে উঠল। সেই সঙ্গে রাজবাড়ির পুরনো মরচে পড়া ফটকে দমাদম লাথি পড়তে থাকে।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ফটক ভেঙে ডাকাতরা রাজবাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়তে থাকে।
.
দারোগাবাবু রাতে কিছু খাননি। দু চুমুক দুধ বার্লি খেয়ে শুয়ে মা কালীর নাম করছিলেন। একটা সেপাই তার গা হাত পা টিপে দিচ্ছিল।
সদ্য ঘুমটা এসেছে এমন সময় থানা থেকে লোক এসে খবর দিল, “রাজবাড়িতে ডাকাত পড়েছে। যেতে হবে।”
শুনে দারোগাবাবু দুঃস্বপ্ন মনে করে এক পাশ থেকে আর এক পাশ ফিরে শুলেন।
কিন্তু থানার লোকটা ছাড়ে না। কেবল ডাকাডাকি করে, “বড়বাবু, উঠুন, রাজবাড়িতে ডাকাত পড়েছে।”
ঘুম-চোখে দারোগাবাবু বললেন, “রাজবাড়ির ডাকাত তো। আমাদের বাড়ির তো নয়! আমাদের কী তাতে?”
“সব লুঠ হয়ে গেল বড়বাবু!”
দারোগাবাবু ফের পাশ ফিরে বললেন, “লুঠ করে যাবে কোথায়? কাল সকলেই সব কটাকে ধরে ফেলব।”
“খুন-খারাবি হবে যে!”
“খুন করতে বারণ করে দে। একটু ভয় দেখিয়ে দিবি। বলবি খুন করলে ফাঁসি হবে। লুঠ করলে জেল।”
লোকটা কাকুতিমিনতি করতে থাকে। অনেকক্ষণ বাদে ঘুমের ঘোর ভেঙে দারোগাবাবু বলেন, “ওঃ বাবা! এক দিনে আর কত হবে। মাডারার, হনুমান, ডাকাত! ব্যাটারা পেয়েছে কী আমাকে। আমি কি ওদের চাকর যে যা খুশি করবে আর আমাকে দৌড়ে বেড়াতে হবে!”
কিন্তু কর্তব্যবশে দারোগাবাবুকে উঠতেই হল। পোশাক পরে মা কালীকে ভক্তিভরে প্রণাম করে বললেন, “মা গো। আমি যাওয়ার আগেই যেন ডাকাতি করে ডাকাতরা সরে পড়ে। ধর পাকড়ের অনেক হাঙ্গামা মা।”
.
বরদাচরে ঘুম কুকুরের ঘুমের মতো পাতলা। গোয়েন্দাদের এটাই গুণ। ফটক ভাঙার শব্দে ঘুম ভেঙে উঠে বসেছেন তিনি। রাজবাড়ি থেকে তাঁকে শোওয়ার জন্য একটা মোটা কুটকুটে কম্বল দিয়েছে, তাই সারা গা চুলকোচ্ছিল।
বরদাচরণ গা চুলকোতে চুলকোতে বেরিয়ে এসেই ভজবাবুর একেবারে মুখোমুখি পড়ে গেলেন। দেখলেন, ভজবাবুর হাতে খাঁড়া, কপালে তেল সিঁদুরের ছাপ, কানে জবাফুল, কণ্ঠে গান। ভজবাবু খাঁড়াটা ঘোরাতে ঘোরাতে গেয়ে ওঠেন, “ছুঁসনে আমাকে, দূরে দূরে থাক, নইলে মাথাটা করব দুফাঁক, ওরে গোয়েন্দা পাজি…”
কিন্তু ভজবাবুকে ছোঁওয়ার ইচ্ছে বরদাচরণের একটুও নেই। ছুঁয়ে হবেটা কী? এত রাতে কারই বা চোর-পুলিশ খেলতে ইচ্ছে যায়? তিনি বললেন, “ভজবাবু, এত রাতে কী ব্যাপার?”
পিছন থেকে ডাকাতরা রে-রে করে ওঠে। বরদাচরণ পিস্তলের জন্য খাপে হাত দিলেন। পিস্তল নেই। আর পিস্তলহীন গোয়েন্দা যে কত অসহায় তা বুঝতে পেরে বরদাচরণ পিছু ফিরে দৌড় লাগালেন।
কিন্তু পারবেন কেন? দৌড়ে হয়তো পারতেন, কিন্তু প্রথমেই সিংহাসনে হোঁচট খেয়ে মেঝেয় পড়লেন। উঠে ছুটতে গিয়ে ফের দেওয়ালে ধাক্কা লাগল।
ভজবাবু এসে দাঁড়িয়ে গাইতে থাকেন, “বলো আজ তুমি কোথায় পালাবে, যেখানেই যাও সেখানেই যাবে দরা তোর পিছনে…”
“হচ্ছে না! সুর হচ্ছে না।” অন্ধকারে কে যেন চেঁচিয়ে বলে ওঠে।
ভজবাবু রেগে গিয়ে বলেন, “কে বলে সুর হচ্ছে না?”
“আমি বলছি,” বলে ডাকাতদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে গণেশবাবু ঘরে ঢুকে বলেন, “গানটা ইয়ার্কি নয় ভজবাবু! শিখতে হয়। ওটা কীরকম গান হল শুনি! সর্বেশ্বর কারফমার ‘দস্যু নৃত্যনাট্য আমি নিজে ডিরেকশন দিয়েছি কতবার। শুনবেন? তাহলে শুনুন।” বলে গণেশবাবু হাত নেড়ে নেড়ে গাইলেন, “বলো আ…আজ তু..উম কোথায় পা..আলাবে…”
ভজবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “কাজের সময় এখন দিক করবেন না তো গণেশবাবু! আমি এখন ডাকাতদের ডিরেকশন দিচ্ছি…”
“এঃ, ডিরেকশন যত খুশি দিন, তা বলে গানের অপমান আমি সহ্য করব না।”
এ নিয়ে একটা ঝগড়া বেধে উঠল বেশ।
মেজ সদার বা অন্য ডাকাতরা এসব ঝগড়া কাজিয়া দেখে ভূক্ষেপ করল না। তারা কাজ হাসিল করতে এসেছে। ঝগড়া কাজিয়া নিয়ে মাথা ঘামালে চলবে কেন?
মেজ সদার গিয়ে সোজা গোবিন্দনারায়ণের গলায় খাঁড়া ধরে বলল, “চাবিগুলো দিয়ে দিন রাজামশাই।”
রাজা গোবিন্দনারায়ণ বললেন, “তাঁতিরাচি গামা হন্ডুরাস।”
মেজসদার অবাক হয়ে বলে, “তার মানে?”
রাজামশাই আবার বলেন, “গিমি গড়গড়ি কেরোসিন বোম।”
মেজসদার হাঁ করে চেয়ে থেকে বলল, “ওরে তোরা শোন তো এসে, রাজামশাই কী ভাষায় কথা বলছে।”
রাজামশাই নিজেও তা বুঝতে পারছিলেন না। তাঁর মনে হচ্ছিল বোধহয় দৈবক্রমে তিনি স্বপ্নাদ্য কোনও নতুন ভাষা শিখে ফেলেছেন। অর্থ না বুঝলেও তাঁর মুখ দিয়ে অনবরত ওই সব কিম্ভুত কথা বেরিয়ে যাচ্ছে। এবার তিনি বললেন, “গমেসি গদাধর ভাগভাগ ফুংকাসুন।”
কানাই খুব মন দিয়ে শুনে বলে, “নাঃ, বোঝা যাচ্ছে না। তেলুগু হতে পারে।”
বিড়ি-চোর বলে, “তেলু টেলু নয়। আমি সেবার পাহাড়ে গিয়ে ঠিক এই ভাষা শুনে এসেছিলাম। তবে মানে বলতে পারব না।”
একটা অল্পবয়সী ডাকাত বলল, “রাজাদের ব্যাপারই আলাদা। তারা কি আর আমাদের ভাষায় কথা বলে নাকি? আর কথায় কাজই বা কী?”
মেজদারও বলে, “ঠিক বলেছিস। এত কথায় কাজ কী? কানাই, রাজামশাইয়ের কোমরের ঘুনসি থেকে চাবির গোছাটা খুলে দে তো।”
কানাই চাবির গোছা খুলে নিল।
রাজামশাই শুধু বললেন, “সামসাদিঘি টক দৈ হামলা খামলা।” বলতে বলতে রাজামশাই তখনও অবাক হয়ে ভাবছেন যে, তাঁর মুখ দিয়ে এসব কথা বেরোচ্ছে কী করে। মনে-মনে তিনি যা ভাবছেন তা বুঝতে তাঁর অসুবিধে হচ্ছে না। কিন্তু যেই সেকথা বলতে চাইছেন অমনি তাঁর জিভ যেন বদমাইশি করে কথাগুলোকে অন্য একটা বিদঘুঁটে ভাষায় ট্রানসলেট করে দিচ্ছে। যেমন তিনি এখন বলতে চাইছিলেন ‘বাবারা, হামলা কোরোনা, যা চাও নিয়ে যাও।’ এর মধ্যে কোত্থেকে সামসাদিঘি বা টক দৈ আসে তা বোধের অগম্য।
ডাকাতরা চাবি খুলে নিয়ে রাজামশাইকে একা রেখে চলে গেল। রাজামশাই দাঁড়ানো অবস্থাতেই মূৰ্ছিত হয়ে রইলেন। এটা অবশ্য তাঁর পুরনো অভ্যাস, দাঁড়িয়ে মূছ যেতে তাঁর কোনও অসুবিধেই হয় না।
অন্দরমহলের একটা বড়-সড় ঘরে রাজমাতা আর রানী-মা দুটো পাশাপাশি খাটে শোন। মাঝখানে মেঝেয় শোয় রাজবাড়ির পুরনো দাসী।
রাজমাতার ভাল ঘুম হয় না। মাথায় রাজ্যের চিন্তা। সারাদিন খুঁটে দেন, সেই ঘুঁটে শুকিয়ে পাহাড়প্রমাণ জমিয়ে রাখেন রাজমাতা খুঁটে বিক্রি করলে নিন্দে হবে, সেইজন্য নিজে না বিক্রি করে বুড়ি দাসীকে দিয়ে বিক্রি করেন। তাতে বেশ দু পয়সা আয় হয় তাঁর। কিন্তু তিনি যতই গোপন করুন রাজ্যিসুব্ধ সবাই জানে যে, রাজমাতার খুঁটের ব্যবসা আছে। ঘুঁটে অবশ্য তিনি ভালই দেন, সেজন্য লোকে তাঁর প্রশংসাও করে। রাজমাতার দুশ্চিন্তা হল সেই খুঁটে নিয়েই। কখন কোন ফাঁকে চোর এসে খুঁটে চুরি করে নিয়ে যায়, তা ভেবে রাতে তাঁর ঘুম হয় না। এ রকম কয়েকবারই চুরি গেছে। কতবার ছেলে গোবিন্দনারায়ণকে বলেছেন, “আমাকে একটা নেড়ী কুকুর এনে দে, পুষি। সে আমার খুঁটে পাহারা দেবে।” কিন্তু তাঁর রাজা-ছেলে সেকথা কানে নেয়নি।
রাজমাতার আরও দুশ্চিন্তা একমাত্র নাতিটার কথা ভেবে। সে যে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে রইল।
এইসব ভেবে তাঁর ঘুম আসে না। রাতবিরেতে জেগে বসে মাথা চুলকোন। বড় উকুন হয়েছে। আজও চুলকোচ্ছিলেন। হঠাৎ হট্টগোল শুনে উঠে বসে ছেলের বউকে ডাকতে লাগলেন, “অ বউমা, ওঠো তো! ও কারা গণ্ডগোল করছে?”
রানীমারও ঘুম নেই। এক কথা, ছেলে নিরুদ্দেশ। তা ছাড়া কিপটে রাজার ঘর করেন বলে তাঁকে সব সময় সংসারের নানা দুশ্চিন্তা করতে হয়। ঘুম তাঁরও হয় না। শাশুড়ির গলা শুনে বললেন, “শুনছি মা। মনে হচ্ছে ডাকাত-টাকাত পড়েছে।”
“হায় ভগবান! ডাকাতই যদি পড়েছে তবে শুয়ে আছ কেন? ওঠো দেখি কী হল।”
রানী-মা নিশ্চিন্ত গলায় বললেন, “উঠে হবেই বা কী! ডাকাতরা ঘুরে ফিরে নেওয়ার মতো জিনিস না-দেখে নিজেরাই লজ্জা পেয়ে ফিরে যাবে।”
রাজমাতা মশারি তুলে বেরিয়ে আসতে-আসতে বললেন, “ নেওয়ার জিনিস নেই মানে? এখনও আমার তিন হাজার চারশ পঞ্চান্নখানা খুঁটে জমা আছে, তা জানো?”
“ডাকাতরা ঘুঁটে নিতে আসে না মা।”
“চোর-কুঠুরিতে আমাদের লক্ষ লক্ষ টাকা আছে তা জানো?”
“সব অচল।”
রাজমাতা বিরক্ত হয়ে বললেন, “আহা, না হয় নাই নিল কিছু কিন্তু আমার গোবিন্দকে যদি মারধোর করে? চলো দেখি গিয়ে।”
রানী-মা উঠে পড়লেন। ডাকাতরা যে মারধোর করতে পারে এটা তাঁর আগে খেয়াল হয়নি।
এদিকে দরবার-ঘরে গোয়েন্দা বরদাচরণের অবস্থা খুবই করুণ। মনোজদের বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে দেওয়াল থেকে পড়ে মাজায় ব্যথা পেয়েছিলেন, এখন সেই ব্যথার ওপর আবার সিংহাসনের সঙ্গে ধাক্কা লেগে আরও অচল হয়ে পড়েছেন। যাকে বলে চলচ্ছক্তিহীন। তা ছাড়া, পালাতে গেলে প্রাণ যাবে বলে ভজবাবু শাসিয়ে রেখেছেন। সেকথাটা অবিশ্বাসই বা করেন কী করে? ভজবাবুর হাতে খাঁড়া, ভাবসাবও ভাল নয়।
বরদাচরণ মেঝেয় পড়ে ব্যথায় কোঁকাচ্ছেন আর তাঁর দু পাশে দাঁড়িয়ে ভজবাবু আর গণেশ ঘোষাল প্রচণ্ড ঝগড়া করছেন। ঝগড়া করতে করতে উত্তেজিত ভজবাবু মাঝে মাঝেই খাঁড়া বাঁইবাঁই করে ঘোরাতে থাকেন। তাতে বরদাচরণ ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন, “দোহাই ভজবাবু! খাঁড়া সামলে। নাকে মুখে লেগে যাবে যে!”
কিন্তু কে শোনে কার কথা। ভজবাবু বুক চিতিয়ে বলছেন, “এঃ! বলে সারেগামা জানি না! আপনি জানেন? করুন দেখি সারেগামা।”
গণেশ ঘোষালও বুক চিতিয়ে বলেন, “সারেগামা আমাকে করতে বলছেন, ভাল কথা। কিন্তু করলে বুঝবেন কি? গানের ‘গ’ ও তো জানেন না। অথচ আজ প্রকাশ্যে সুরের অপমান করে সারা শহর ঢি ঢি ফেলে দিয়েছেন।”
রাগে ভজহরিবাবু বাঁইবাঁই করে আরও কয়েকবার খাঁড়া ঘোড়ালেন। আতঙ্কে চিঁ চিঁ করে বরদাচরণ বলতে থাকেন, “খাঁড়া সামলে, ভজবাবু! আর-একটু হলে-”
গণেশ ঘোষাল একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলেন, “হ্যাঁ, ওই খাঁড়া ঘোরানো, পিস্তল দিয়ে ভয় দেখানো, এসবই আপনাকে তবু মানায়। কিন্তু গান নয়। শুনুন” এই বলে গণেশবাবু খুব আবেগ দিয়ে বাঁ হাতে নিজের বাঁ কান চেপে ধরে ডান হাতটা ভজবাবুর মুখের সামনে একটু খেলিয়ে তান ধরলেন, “সা…রে….গা….মা, কোন স্কেলে ধরেছি বলুন তো?”
ভজবাবু একটু থমকে গিয়ে বলেন, “স্কেল? গানের মধ্যে আবার স্কেল কী মশাই? এ কি হাতের লেখা নাকি যে রুল টানতে স্কেল চাই! নাকি গলার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মেপে দেখবেন।”
“হাঃ হাঃ! বেনাবনে মুক্তো ছড়ানো। স্কেল কাকে বলে তাই যখন জানেন না, তখন আর গেয়ে হবেটা কী? তবু গানের মধ্যে যে সম্মোহনী শক্তি আছে তাতে আপনার মতো অসুর লোকেরও হয়তো উপকার হতে পারে। তাই শোনাচ্ছি! শুনুন, সা…রে…গা..মা…”।
ডাকাতদলের প্রচণ্ড চেঁচামেচি, গণেশবাবুর গলা সাধা, বরদাচরণের ক্ষীণ আর্তনাদ মিলেমিশে সে এক বিটকেল কাণ্ড।
মেজ-সদার তার কয়েকজন স্যাঙাত নিয়ে এ-ঘর ও-ঘর খুঁজে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ একবার থমকে দাঁড়িয়ে সদার তার মশালটা তুলে দেয়ালে একটা মস্ত তৈলচিত্র দেখে কানাইকে বলল, “ওটা কার জানিস?”
কানাই বলে, “কার?”
মেজ-সদার শ্বাস ফেলে বলে, “আমিও জানি না। তবে খুব চেনা-চেনা ঠেকছে। এ পুরো বাড়িটাই আমার খুব চেনা লাগছে।”
কানাই উৎসাহ পেয়ে বলে, “তবে চোর-কুঠুরিটা কোথায় তা খুঁজে বের করে ফেল।”
মেজ-সদার ধমক ছেড়ে বলে, “চোপ! চোর কুঠুরি চোর কুঠুরি করে গলা শুকাবি না। আগে আমাকে সব দেখতে দে।”
কানাই ভয় খেয়ে চুপ করে যায়।
অন্য সব ডাকাতরা যে যার নিজের কাজে ব্যস্ত। একটা লোভী ডাকাত রান্নাঘরে ঢুকে জলে ভেজানো ভাত খেতে ব্যস্ত। একজন বাসনকোসন বস্তায় ভরছে। আর-একজন রাজবাড়ির যত জামাকাপড় সরাচ্ছে। চারদিকেই খুব হাল্লা-চিল্লা।
বিড়ি-চোর বলল, “মেজ-সদারের ডাকাতির দিকে মন নেই।” কানাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “বড়সদারও তাই বলে।”
“কী বলে?”
“বলে, মেজটা ভদ্রঘরে জন্মেছিল। তারপর আট-দশ বছর বয়সে বাড়ি থেকে ভেঙ্গে পড়ে। হরিণগড় রেলস্টেশনে গাড়িতে উঠতে গিয়ে পড়ে মাথা ফেটে যায়। সেই থেকে হারানো কথা মনে করতে পারে না। তবে সেই গাড়িতে বড় সদার কাশী যাচ্ছিল তীর্থ করতে। মেজ-সদার কোন্ বাড়ির ছেলে তা সে বুঝতে পেরেছিল। সে-ই টেনে ট্রেনের মধ্যে ছেলেটাকে তুলে নেয়। মাথায় মতলব ছিল যে, ছেলেটাকে লুকিয়ে রেখে তার বাপের কাছ থেকে মোটা টাকা আদায় করবে। কিন্তু সে আর হয়নি। বড় সর্দারের বউয়ের ছেলেপুলে ছিল না, সে ছেলেটাকে নিজের ছেলের মতো করে বুকে আগলে রাখল। পাছে ছেলেটাকে তার মা বাবা কোনওদিন চিনতে পেয়ে দাবি করে বসে সেই জন্য পরে বউয়ের আবদারে তীর্থ থেকে ফিরে এসে ছেলেটার বাড়ি থেকে তার সব ছবি চুরি করে নিয়ে যায়। ওদিকে বড়-সদারের মতি ফেরানোর জন্য তার বউ তীর্থে-তীর্থে ঘুরে বেড়াত খুব। সঙ্গে-সঙ্গে ছেলেটাকেও রাখত। তা বড়সদারের মতিগতি ভালর দিকেই চলে যাচ্ছিল। কিন্তু বছর দুই আগে যেই বউ মরল অমনি আবার পুরনো পোকা মাথায় কিলবিল করে উঠল। সদার আমাকে গোপনে বলেছে, ছেলেটার বাবার অবস্থা এখন পড়তির দিকে। টাকা চেয়েও লাভ হবে না। তার চেয়ে ছেলেটাকে ডাকাতির তালিম দিয়ে ছেড়ে দিলে বুড়ো বয়সে দুটো পয়সার মুখ দেখা যাবে।”
বিড়ি-চোর বড়বড় চোখ করে গল্প শুনছিল। একটা ঢোক গিলে বলে, “তাহলে মেজ-সদার কোন্ বাড়ির ছেলে?”
“সে কথা সদার প্রাণ গেলেও বলবে না।”
“আমার তো সন্দেহ হয়”
“আমারও হয়। কিন্তু কথা চেপে রাখ। নইলে গোলমালে পড়বি।”
মেজ-সদার রাজবাড়ির দেওয়ালে-দেওয়ালে অয়েল পেইন্টিং দেখে দেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পিছনে ডাকাতের দল, কিন্তু তারা সদারের ভাবসাব দেখে কিছু বুঝতে পারছে না। ছবি দেখবে তো পটের দোকানে গিয়ে যত খুশি দেখো, না হয় একজিবিশনে যাও, ডাকাতি করতে এসে ছবি দেখার কথা তারা জন্মে শোনেনি।
একসময়ে ছবি দেখা শেষ করে মেজ-সদার গম্ভীর ভাবে বলে, “হুঁ।”
কানাই গলা বাড়িয়ে বলে, “কিছু বুঝলে সর্দার?”
মেজসদার গম্ভীর মুখে বলে, “চোর-কুঠুরি কোথায় তা এবার জলের মতো বুঝতে পারছি। এই পুব দিকের দেয়ালে এবংশের তৃতীয় রাজা হেরম্বনারায়ণের ছবি। এ ছবিতে হেরম্বনারায়ণের বাঁ হাতের কড়ে আঙুলটা যেদিকে বেঁকে আছে সেটা হল চোর-কুঠরিতে যাওয়ার প্রথম পথ। পথটা অন্দরমহলে গেছে। সেখানে গোঁসাঘরের বাইরের দেওয়ালে পঞ্চম রাজা ভীমনারায়ণের ছবি আছে, তাঁর ডান হাতের তর্জনী চোরকুরিতে যাওয়ার দ্বিতীয় পথটা চিনিয়ে দেবে। সে পথ ধরে গেলে একটা মস্ত শোবার ঘর পাওয়া যাবে। সেখানে দেওয়ালে নবম রাজা পবননারায়ণের ছবিটা ভাল করে দেখলে দেখা যাবে যে, তিনি মেঝের দিকে তাকিয়ে কুঁচকে কী যেন খুঁজছেন। অর্থাৎ আমাদেরও মেঝেতেই খুঁজতে হবে। মেঝেটা ভাল করে খুঁজলে কয়েকটা সূক্ষ্ম চিহ্ন দেখা যাবে। সেগুলো অনেকটা তীরের ফলার মতো। সেই চিহ্ন ধরে হামাগুড়ি দিয়ে এগোলে খাটের তলায় এক জায়গায় গুপ্ত দরজা দেখা যাবে।”
সবাই অবাক। কানাই বলে, “কী করে বুঝলে এত সব?”
মেজ-সদার ভু কুঁচকে বলে, “কে জানে কী করে বুঝলাম! কিন্তু আমার সব মনে পড়ে যাচ্ছে যেন।”
বিড়ি-চোর বলে, “সদারের মাথা খুব পরিষ্কার।” মেজ-সদারের পিছু পিছু ডাকাতরা এগোতে লাগল। ঠিক এই সময়ে একটা বিশাল কালো চেহারা এক তলা থেকে এক লাফে রাজবাড়ির দোতলায় উঠে গেল। দরবার-ঘরের দরজা থেকে একটা টর্চের ঝলকানি এল, সেই সঙ্গে গুডুম করে গুলির শব্দ।
গণেশবাবু ভৈরবীতে চমৎকার বিলম্বিত করছিলেন। গুলির শব্দ হতেই তিনি দড়াম করে মেঝেতে পড়ে নিশুপ হয়ে গেলেন।
ভজবাবু খানিকটা হতভম্ব হয়ে রইলেন। ডাকাতদের কারও বন্দুক পিস্তল নেই, তিনি জানেন। তবে কি পুলিশ? সন্দেহ হতেই ভজবাবু বিপুল বিক্রমে খাঁড়া ঘোরাতে ঘোরাতে বীরদর্পে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন।
কে যেন সতর্ক গলায় ডাকল, “ছোড়দা!”
আর একজন বলল, “মেজকাকু।”
মেঝে থেকেই বরদাচরণ বললেন, “দোহাই ভজবাবু।”
ভজবাবু একটু থমকে গেলেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, “নহি দাদা, নহি আমি কারও মেজকাকু। সম্মুখসমরে আত্মীয়তা ঘোর দুর্বলতা। ছাড়ো দ্বার, যাবো অস্ত্রাগারে…”
মেঝে থেকে বরদাচরণ প্রায় কেঁদে ফেলে বললেন, “ভজবাবু, দোহাই আপনার, শিগগির শুয়ে পড়ুন যদি বাঁচতে চান। একটা লাশ পড়েছে, আপনাকেও গুলি করবে।”
দরজার কাছ থেকে হারাধন বলে ওঠে, “কারও লাশ পড়েনি। গুলি আমি ছাদে চালিয়েছি।”
বরদাচরণ বলেন, “তা হলে গণেশবাবু?”
রাজমাতা ডুকরে উঠে বললেন, “ওরে, আমার গোবিন্দকে তোরা কী করেছিস?”
মেজ-সদার গম্ভীর গলায় বলে, “সে ভাববেন না ঠাকুমা, রাজামশাই দাঁড়িয়ে আছেন সামনের দিকের বারান্দায়।”
“আর আমার খুঁটে? কাল যে নন্দী বাড়ির চাকর পাঁচশো খুঁটে নিতে আসবে।”
“দেবেন। খুঁটে আমরা নিই না। আমরা টাকা সোনা আর দামী জিনিস নেব। আপনারা ঘর ছেড়ে দিন। এখন মেলা কাজ আছে আমাদের। চোর কুঠুরির গুপ্ত দরজা খুঁজে বের করতে হবে।”
রানীমা শ্বাস ফেলে বললেন, “সে আর খুঁজতে হবে না বাছা, পূর্ব-দক্ষিণ কোণের ওই খাটটা সরালেই দেখতে পাবে। চোরকুইরির দরজা খোলাই আছে। কিন্তু নেওয়ার কিছু নেই। লাখ লাখ অচল টাকা। যাও নিজেরাই দেখে এসো গে।”
“অচল টাকা?” মেজ-সর্দারের মুখটা খানিকক্ষণ থমথম করে। কী একটু ভাবে সে। তারপর মাথা নেড়ে বলে, “তাই বটে। অচলই হওয়ার কথা। আমি ছেলেবেলায় দেখেছি ওসব টাকা বহুঁকালের পুরনো। তখনই বোধ হয় বাজারে চলত না। এখন তো আরও চলবে না।”
রানী-মা ভ্রু কুঁচকে বলেন, “ছেলেবেলায় দেখেছ মানে? তুমি কি বাবা এবাড়িতে এসেছ কখনও?”
“মনে হয় যেন এসেছি। সবই চেনা লাগছে।”
রানী-মা উদ্বেল হয়ে বললেন, “তুমি একটু কাছে এসো তো বাবা, তোমার মুখোনা একটু ভাল করে দেখি। ও আমার ডাকাত-ছেলেরা, তোমরা একটু মশালগুলো ভাল করে ধরো তো।”
রাজা গোবিন্দনারায়ণের মূর্ছা হঠাৎ ভাঙল। কারণ, কে যেন তাঁর ঘাড়ে আর মুখে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। মূর্ছা ভেঙে তিনি হাই তুলে পিছু ফিরতেই আবার মূর্ছা গেলেন। এবং দাঁড়িয়ে। তামর কারণ হারাধনের কিম্ভুত এবং অতিকায় গোরিমানটা গোবিন্দনারায়ণকে খুঁকে দেখছিল।
গোবিন্দনারায়ণকে ও রকম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গোরিমানটা বিরক্ত হয়ে তাঁকে ছেড়ে ভিতরবাগে চলল। একটা ছ্যাঁচড়া ডাকাত টুলের ওপর উঠে রাজবাড়ির একটা দেয়াল থেকে পুরনো একটা দেয়ালঘড়ি খুলে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। গোরিমানটা পিছন থেকে গিয়ে টুলটা ধরে অল্প অল্প ঝাঁকাতে লাগল। ডাকাতটা পিছু না ফিরেই বলল, “ঝাঁকাস না বাপ! ঘড়িটা বেচে যা পাব তা দু-জনের ভাগ।”
গোরিমানটা আরও জোরে ঝাঁকায়। ডাকাতটা পেল্লায় একটা ধমক দিয়ে ভাল করে না-দেখেই পিছনে একটা লাথি চালিয়ে দিল। সে ভেবেছিল তার স্যাঙাতদেরই কেউ হবে।
গোরিমান লাথি খেতে পছন্দ করে না। তাই সে খুব গম্ভীরভাবে টুলটা টেনে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। ডাকাতটা মাটিতে পড়ে পেল্লায় চেঁচাতে থাকে। বিরক্ত গোরিমান তাকে তুলে বগলে থার্মোমিটারের মতো চেপে ধরে চারদিকে ঘুরে দেখতে লাগল।
রাজবাড়ির ফটকে ততক্ষণে পুলিশের গাড়িটাড়ি সব এসে পৌঁছেছে। একটা জিপগাড়ি থেকে অতি সাবধানে নামতে নামতে নিশি দারোগা বললেন, “কালী, কালী! ওরে, তোরা সব সাবধানে চারদিক দেখে-টেখে এগো। আমার আজ শরীরটা ভাল নেই। বড্ড হাই উঠছে।”
সন্ধেবেলা গোরিমানগুলোর হাতে নাকাল হয়ে সেপাইরাও একটু ঠাণ্ডা মেরে গেছে। বন্দুক বা লাঠি হাতে থাকলেও তারা খুব সাহস পাচ্ছে না। একজন সেপাই বলে উঠল, “বড়বাবু, আপনার শরীর খারাপ হলে আমারও খারাপ। পেটটা তখন থেকে বকম বকম করছে।”
আর একজন সেপাই বলে দিল, “আমরা যখন জাম্বুবানের হাতে ধোলাই খেলাম, তখন আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন বড়বাবু। এবার না জানি আবার কার পাল্লায় পড়ি, এবার দয়া করে আপনি আমাদের সঙ্গে-সঙ্গে থাকুন।”
নিশি দারোগা বললেন, “কালী কালী। চল দেখি।”
বলে খুব অনিচ্ছেয় তিনি টর্চ আর রিভলবার বাগিয়ে সাবধানে রাজবাড়ির ফটক পার হয়ে ঢুকলেন।
ওদিকে রানী-মা চার-পাঁচটা মশাল আর সেজবাতির আলোয় মেজ-সর্দারের মুখ দেখছেন। আর মেজ-সদার, যার ভয়ে গোটা গঞ্জ কাঁপে, ডাকাতরাও যাকে যমের মতো ডরায়, সেই মহাতেজী মেজ-সদার রানী-মার খাটের পাশে মেঝেয় হাঁটু গেড়ে বসে খুব লজ্জা লজ্জা ভাব করে রানী-মাকে নিজের মুখ দেখতে দিচ্ছে।
এসব ব্যাপারে অধৈর্য হয়ে বিড়ি-চোর চোর কুঠুরিতে যাবে বলে খাটের নীচে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকেছিল, কানাই তার ঠ্যাং ধরে টেনে এনে খুব ঘাতক দিয়ে বলল, “সদারের হুকুম হয়নি, তার আগেই ঢুকছিলি যে বড়? দেব গদান নামিয়ে?”
বিড়ি-চোরও তেড়িয়া হয়ে বলে, “আমিও গদান নামাতে জানি।”
দুজনে তুমুল ঝগড়া লেগে পড়ল।
সে গোলমালে অবশ্য রানী-মা বা মেজ-সদারের কান নেই। রানী-মা ডাকাতের সদারের মাথায় হাত বুলোতেবুলোতে বললেন, “ভাবতেও ভয় করে, যদি সত্যি না হয়। কিন্তু বাবা, তুমি যদি আমার হারানো ছেলে কন্দর্পনারায়ণ হতে।”
রাজমাতাও বললেন, “আহা, যদি আমার নাতি কন্দু এখন ফিরে আসত।”
ঠিক এই সময়ে পিস্তল হাতে হারাধন, খাঁড়া হাতে গোয়েন্দা বরদাচরণ এবং ছবি হাতে মনোজ ঘরে এসে ঢুকল।
বরদাচরণ মননজের হাত থেকে ছোঁ মেরে ছবিটা কেড়ে নিয়ে
হাঃ হাঃ অট্টহাসি হেসে বললেন, “মহারানী, হওয়া-হওয়ির কথা আর বলবেন না। আপনার সামনে ওই যে ডাকাত দলের সদার বসে আছে, সে-ই হল আপনার হারানো ছেলে কুমার কন্দর্পনারায়ণ। আগে দেখুন এই ছবিটা কুমার কন্দর্পের ছবি কিনা।”
রানী-মা বরদাচরণের মতোই হুবহু ছোঁ মেরে ছবিটা কেড়ে নিয়ে দেখেই বলে উঠলেন, “বলো কী বাবা গোয়েন্দা! এই তো আমার কন্দর্পর ছবি! সেবার আমরা দেওঘরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। কন্দর্প দুধের গেলাশ পাশে রেখে ছবি তুলতে বসেছিল, পিছনের ঘরে পর্দার আড়ালে আমি দাঁড়িয়ে দেখছি। হতচ্ছাড়া বেড়ালটা তখন কোত্থেকে এসে দুধটা খেয়ে যাচ্ছিল…হুবহু সব মনে পড়ে যাচ্ছে যে!”
বরদাচরণ গম্ভীর হয়ে বললেন, “এবার ছবির সঙ্গে ডাকাতের সদারকে মিলিয়ে দেখুন।”
রানী-মা মেজ-সদারকে কাছে টেনে “ও আমার কন্দু রে” বলে কেঁদে ফেললেন।
মেজ-সদার বিড়বিড় করে বলল, “তাই সব এত চেনা-চেনা লাগছিল বটে!”
বরদাচরণ ‘হেঃ হেঃ করে হেসে বললেন, “কত বুদ্ধি খাঁটিয়ে যে ব্যাপারটা ধরতে পেরেছি তা আর বলার নয়।”
হারাধন ধমক দিয়ে বলে, “বেশি বোকো না। মেজ-সর্দারকে রাজকুমার বলে প্রথম যে চিনতে পারে সে হল আমার ভাইপো মনোজ।”
বরদাচরণ লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি বলেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ মননজেরও যথেষ্ট অবদান আছে। এসো মনোজ, এগিয়ে এসো।”
মনোজ এগিয়ে আসে। রানী-মা তাকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করতে করতে বলেন, “সবাই শোনো তোমরা, রাত এখন যতই হোক, আমার ঘরে আজ অনেক ঘি আর ময়দা আছে। গতকাল আমাদের একটা তালুক থেকে জিনিসপত্র অনেক এসেছে। আমি এখন সবাইকে লুচি ভেজে খাওয়াব। আমার ডাকাত ছেলেদের কয়েকজন চলো গিয়ে একটু ময়দা মেখে দেবে।”
ডাকাতরা অবস্থা বুঝে যে যার হাতের অস্ত্রশস্ত্র এদিক ওদিক ফেলে দিয়ে ভাল মানুষের মতো ব্যবহার করছিল। মেজ-সর্দার যে রাজকুমার তা জানলে তারা কক্ষনো রাজবাড়িতে ঢুকত না। কানাই তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলল, “রাত খুব বেশি হয়নি রানী-মা। মোটে সাড়ে বারোটা, ময়দা মাখতে আমাদের বেশি সময় লাগবে না।”
ঠিক এই সময় নিশি দারোগা পিছন থেকে বলে উঠলেন, “হ্যান্ডস আপ।”
কেউ হাত তুলল না। হারাধন বলে উঠল, “আহা দারোগাবাবু, এখানে কোনও গণ্ডগোল হচ্ছে না।”
বরদাচরণও বললেন, “একটা হ্যাপি এন্ডিং হচ্ছে নিশিবাবু, এখানে কোনও গণ্ডগোল হচ্ছে না।”
রানী-মা বললেন, “ও বাবা নিশি, লুচি হচ্ছে, সবাই খেয়ে যাবে।” বলে মহারানী চারজন ডাকাতকে সঙ্গে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন।
দারোগাবাবু খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, আমি সবাইকে হাত তুলতে বলেছি, সেকথা কারও কানে যাচ্ছে না নাকি?”
কিন্তু কেউ নিশিবাবুকে তেমন পাত্তা দিতে চাইছে না। বরদাচরণ তাঁকে বোঝাতে লাগলেন, “আপনার আসবার কোনও দরকারই ছিল না নিশিবাবু, আমি একাই সিচুয়েশনটা সামলে নিয়েছিলাম! হেঃ হেঃ!”
এদিকে রাজামশাইয়ের মূর্ছা আবার ভেঙেছে। ভেঙেছে অন্য কিছুতে নয়, গাওয়া ঘিয়ে লুচি ভাজার গন্ধে। শিউরে উঠে তিনি আপন মনে বললেন, “আবার গাওয়া ঘিয়ের লুচি?”
রাজবাড়ির পুরনো চাকর দৌড়ে এসে খবর দিল, “রাজামশাই, কুমার কন্দর্পনারায়ণ ফিরে এসেছেন। শিগগির যান, রান্নাঘরে রানী-মার কোল ঘেঁষে বসে কেমন লুচি খাচ্ছেন দেখুন গে।”
রাজা গোবিন্দনারায়ণ খানিকটা হতভম্ব থেকে তারপর তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দিকে এগোলেন।