৬. বুড়ো লী যদিও খুব আগ্রহ নিয়ে

বুড়ো লী যদিও খুব আগ্রহ নিয়ে আমার মুখ থেকে কথা শুনবে বলে আমাকে ডেকে আনল কিন্তু আমি যখন বলতে শুরু করলাম সে খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনছে বলে মনে হল না। মাঝে মাঝেই সে অন্যমনস্ক হয়ে যেতে লাগল,এবং তার প্রশ্নগুলি হল অনাবশ্যক এবং সংগতিহীন। যখন ক্রিস্টালটি কমিউনিকেশান্স মডিউলে দিয়ে দেখানো হল, সে আধাবোজা চোখে পুরোটা দেখে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সময় হয়ে গেছে।

লেন জিজ্ঞেস করল, কীসের সময়?

যার জন্যে এই প্রস্তুতি।

কীসের প্রস্তুতি?

এই যে মহাকাশযানটিতে সবাইকে ঘুম থেকে তুলে আনা হচ্ছে, নিজেদের ভেতরে হানাহানি তৈরি করা হচ্ছে তার একটা কারণ আছে। সেটা কী আমি বলতে পারব না, তোমাদের নিজেদের ভেবে বের করতে হবে। তবে–

তবে কী?

তোমরা যে আটটা শিশুকে নিয়ে এসেছ সেটি মহাকাশযানের সব হিসেবকে গোলমাল করে দিয়েছে। কাজেই এই মহাকাশযানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তোমরা জড়িয়ে গেছ। তোমরা চাও কি নাই চাও তোমাদের এখন পেছানোর উপায় নেই।

লেন ভয় পাওয়া গলায় বলল, তার মানে কী? কী হবে এখন?

আমি জানি না কী হবে। কিন্তু কিছু একটা হবে। বুড়ো লী খানিকক্ষণ চুপ থেকে আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, তুমি মুক্ত এলাকা থেকে যে ক্রিস্টালটা এনেছ সেখানে তোমাদের পালানোর খবরটা আছে। পুরোটুকু নেই কারণ পুরোটুকু কেউ জানে না। তোমরা যে আটজনকে নিয়ে পালিয়ে এসেছ তারা যে শিশু সেটাও সবাই জানে না।

আমি মাথা নাড়ালাম, না জানে না।

ক্রিস্টালে আরো কিছু ছোট ছোট তথ্য আছে তার মাঝে তোমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনটি মনে হয়েছে কি?

আমি বুড়ো লীয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমার কাছে?

হ্যাঁ।

আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে মিয়ারা সম্পর্কে তথ্যটি। মিয়ারাকে গত আঠারো ঘণ্টা কেউ দেখে নি।

বুড়ো লী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, খুব ধীরে ধীরে তার মুখে হাসি ফুটে উঠতে থাকে। তার কুঞ্চিত মুখে হাসিটি হঠাৎ কেমন জানি বিচিত্র দেখায়। লেন অবাক হয়ে একবার আমার দিকে আরেকবার বুড়ো লীয়ের দিকে তাকাল তারপর একটু অধৈৰ্য্য গলায় বলল,আমি কিছু বুঝতে পারছি না, কেন মিয়ারাকে দেখা যাচ্ছে না?

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, যারা মিয়ারাদের তৈরি করেছে তারা মিয়ারাকে নিয়ে গেছে। আমার মনে হয় শুধু মিয়ারা নয়, মহাকাশযানের অন্য নেতাদেরকেও এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না।

বুড়ো লী মাথা নেড়ে বলল, তোমার ধারনা সত্যি কিহা। আমি হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে চোখ রেখেছি, গত বারো ঘণ্টায় নেতাদের কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।

লেন ভয় পাওয়া গলায় বলল, কেন দেখা যাচ্ছে না? তারা কোথায়?

বুড়ো লী পূর্ণ দৃষ্টিতে লেনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার ধারণা যদি ভুল না হয় তাহলে তোমরাও সেখানে যাবে।

আমরা?

হ্যাঁ লেন। শিশুগুলিকে প্রয়োজন। যেহেতু তোমরা শিশুগুলিকে নিয়ে পালিয়ে এসেছ তোমাদেরও শাস্তি দেয়া প্রয়োজন। প্রতিহিংসা সৃষ্টিজগতের প্রাচীনতম অনুভূতি।

আমি দেখতে পেলাম লেন হঠাৎ করে শিউরে উঠল। বুড়ো লী নরম গলায় বলল, তোমাদের হাতে সময় বেশি নেই কিহা। তোমরা কী করবে ঠিক করে নাও।

আমি বুড়ো লীয়ের দিকে তাকালাম। লেন জিজ্ঞেস করল, তুমি তোমাদের হাতে সময় নেই কেন বলছ? আমাদের হাতে সময় নেই কেন বললে না?

বুড়ো লী জোর করে একটু হেসে বলল, আমার গলার স্বরটা একটু ভারি হয়েছে লক্ষ করেছ?

লেন মাথা নাড়ল, না, করি নি।

আরেকটু পর আরো ভারি হবে। আমাকে একটা ভাইরাস আক্রমণ করেছে, কয়েকঘন্টার মাঝে ভোকালকর্ডে সাময়িক একটা ইনফেকশান হয়, গলার স্বরটা ভারি হয়ে যায়। আবার নিজে থেকে কয়েকঘন্টার মাঝে সেরে যায়। তোমাদেরও নিশ্চয়ই হবে। খুব ছোঁয়াচে।

লেন বিভ্রান্ত মুখে বলল, তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না।

ভাইরাসটি অত্যন্ত নিরীহ ভাইরাস, কয়েকঘণ্টার জন্যে গলার স্বরটা একটু ভারি করা ছাড়া আর কিছুই করে না। কিহা এই ভাইরাসটি সাথে করে এনেছে। ইচ্ছে করে আনে নি, তার শরীরে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে

সোনালী চুলের মেয়েটা? কনুইয়ে যে জ্বালা করে উঠল?

হ্যাঁ। সম্ভবতঃ তখনই। এটা পাঠানো হয়েছে আমাকে উদ্দেশ্য করে। কয়েকঘন্টার জন্যে আমার গলার স্বরটা একটু পরিবর্তন করতে চায়। কেন জান?

লেন ফ্যাকাসে মুখে বুড়ো লীয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, না, জানি না।

আমি নিচু গলায় বললাম, আমি জানি।

কেন?

তোমাকে এর আগে কেউ স্পর্শ করে নি। কারণ শক্তিকেন্দ্রের পারপাশে তুমি বিস্ফোরক লাগিয়ে রেখেছ। তুমি সেটা ইচ্ছে করলে তোমার গলার স্বর দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারবে। কয়েকঘণ্টার জন্যে তোমার গলার স্বর এখন পাল্টে যাচ্ছে। এই সময়টাতে তুমি ইচ্ছে করলেও কিছু করতে পারবে না।

বুড়ো লী মাথা নাড়ল, চমক্কার। আমি মোটামুটিভাবে বিশ্বাস করে ফেলেছি যে তুমি নিনীষ স্কেলে অষ্টম মাত্রার বুদ্ধিমান। এখন কী হবে বলে মনে হয়?

আমি বুড়ো লীয়ের চোখের দিকে তাকালাম, সেখানে কোনো ভীতি বা আতংক নেই। শান্ত চোখে হয়তো সূক্ষ্ম এক ধরনের কৌতুক। আমি সেই শান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, যে কয়েকঘণ্টা তোমার গলার স্বর অন্যরকম থাকবে তার মাঝে কেউ এসে তোমাকে হত্যা করবে।

লেন শিউরে উঠে বলল, কেন? হত্যা করবে কেন?

আমি ত্রিশ বছর থেকে ভরশূন্য ঘরে ভেসে আছি, আমার শরীরের সমস্ত মাংসপেশী অচল হয়ে গেছে। আমাকে এর বাইরে নেয়া সম্ভব না। আমি সেখানে বাঁচব না, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় মারা যাব। তা ছাড়া

তা ছাড়া কী?

মহাকাশযানের প্রচলিত নিয়ম ভঙ্গ করে আমি বড় অপরাধ করেছি। আমাকে শাস্তি দিতে হবে। প্রতিহিংসা বড় মধুর অনুভূতি।

লেন কোনো কথা বলল না, স্থির দৃষ্টিতে বুড়ো লীয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। বুড়ো লী চোখ নামিয়ে বলল, আমার গলা স্বর আরো ভারি হয়ে আসছে। তোমাদের হাতে সময় বেশি নেই কিহা এবং লেন।

আমি বুড়ো লীয়ের দিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, তোমার রবোটটাকে আমার দরকার। আমি মন মেশিন নামের একটা জিনিস কিনে এনেছি সেটা ব্যবহার করে একটা অস্ত্র তৈরি করতে চাই।

কী রকম অস্ত্র?

আমি কিছু একটা ভাবব আর সেই ভাবনার সাথে সাথে একটা বিস্ফোরণ ঘটবে। কিছু বিস্ফোরক দরকার খুব ছোট আকারের। তার সাথে থাকবে ডেটনেটর। মন মেশিনের ট্রান্সমিটারটা থাকবে আমার মাথায়, হেলমেট থেকে খুলে সোজাসুজি সেটা আমার করোটিতে বসিয়ে নিতে চাই, সহজে যেন ধরা না পড়ে।

বিস্ফোরকগুলি তুমি কোথায় লাগাতে চাও?

আমি একটু ইতস্তুত করে বললাম, বাচ্চাগুলির হৃদপিণ্ডে।

লেন চমকে উঠে আমাকে আকড়ে ধরল, ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী বলছ তুমি?

আমি মাথা নাড়লাম, ঠিকই বলছি।

বুড়ো লী হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার তাহলে একটা পরিকল্পনা আছে!

না। আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমার সত্যিকার অর্থে কোনো পরিকল্পনা নেই। এটা এক ধরনের সাবধানতা।

লেন আর্ত স্বরে বলল, না, না–এটা হতে পারে না বাচ্চাগুলির হৃদপিণ্ডে আমি তোমাকে কিছু করতে দেব না–

বুড়ো লী সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে বলল, লেন, তোমার এত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। আমার কাছে চোখে দেখা যায় না এরকম ছোট বিস্ফোরক রয়েছে, সিরিঞ্জে দিয়ে শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া যাবে, বাচ্চাগুলির হৃদপিণ্ডে কিছু করা হবে না।

তাই বলে শরীরের মাঝে বিস্ফোরক?

আমি লেনের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললাম, বাচ্চাগুলিকে ধ্বংস করার জন্যে আমি তাদের হৃদপিন্ডে বিস্ফোরক লাগাচ্ছি না, লাগাচ্ছি তাদের বাঁচানোর জন্যে। পুরো ব্যাপারটা তুমি শুনলেই বুঝতে পারবে। এস আমার সাথে আমি তোমাকে বলি।

 

বুড়ো লীয়ের রবোটটা দেখতে অত্যন্ত কদাকার হলেও কাজকর্মে খুব চৌকস। আমি কী করতে চাই ব্যাপারটা জেনে নেবার পর সে কাজে লেগে গেল। মন মেশিনের ট্রান্সমিটারটা নিয়ে খানিকটা কাজ করতে হল। আমার মস্তিষ্কের দু-ধরনের তরঙ্গের সাথে সেটাকে টিউন করা হল। যখনই আমি একটি বিশেষ পদ্ধতিতে মিথ্যা কথা বলব প্রথম শ্রেণীর বিস্ফোরকগুলি বিস্ফোরিত হবে। দ্বিতীয় শ্রেণীর বিস্ফোরকগুলি বিস্ফোরিত হবে যখন আমি বিশাল দুটো প্রাইম সংখ্যাকে মনে মনে গুণ করার চেষ্টা করব তখন। প্রথম শ্রেণীর বিস্ফোরকগুলি রাখা হল খাবারের ক্যাপসুল, তথ্য ক্রিস্টাল কমিউনিকেশান্স মডিউল এ ধরনের আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারী জিনিসের মাঝে। দ্বিতীয় ধরনের বিস্ফোরকগুলি অত্যন্ত ছোট সিরিঞ্জ দিয়ে ছটফটে আটটি শিশুর শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া হল। মন মেশিনের ট্রান্সমিটারটির আকার ছোট করে নিয়ে আসা হল এবং বুড়ো লীয়ের রবোট আমার করোটির উপরে সেটা অস্ত্রোপাচার করে বসিয়ে দিল। সবশেষে বিশেষ ধরনের রাসায়নিক দিয়ে আমার ক্ষত নিরাময় করে দেয়া হল, মাথার ভেতরে একটা ভোতা যন্ত্রণা ছাড়া আর কোথাও তার কোনো প্রমাণ রইল না।

সমস্ত কাজ শেষ করে বুড়ো লীয়ের ঘরে ফিরে এসে দেখি সে তার ঘরে একটা ছোট ভোজ সভায় আয়োজন করেছ। কিছু বিশেষ খাবার এবং বিশেষ পানীয় তার আশে পাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের কাজ শেষ।

যা। আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমার এখন খুব সাবধানে কথা বলতে হবে। যখনই আমি একটা মিথ্যা কথা বলব ঠিক তখনই আমাদের সাথে রাখা কোনো একটি টাইমার চালু হয়ে যাবে। ঠিক দুই সেকেন্ডের মাঝে যদি দ্বিতীয় একটা মিথ্যা কথা বলি তাহলে ফুড ক্যাপসুলের বিস্ফোরকটি বিস্ফোরিত হবে। যদি তিন সেকেন্ডের মাঝে তৃতীয় একটা মিথ্যা কথা বলি তাহলে তথ্য ক্রিস্টালে, চার সেকেন্ডের মাঝে হলে কমিউনিকেশান্স মডিউলে।

বুড়ো লী খিক খিক করে হেসে বলল, শেষ পর্যন্ত জোর করে নিজেকে সত্যবাদী তৈরি করে নিলে?

হ্যাঁ। অনেকটা সেরকম।

বুড়ো লী ভাসমান খাবার এবং পানীয়ের বোতলগুলি নিজের কাছে ধরে রাখতে রাখতে বলল, এসো, আমাদের বিদায়ের সময়টা স্মরণীয় করে রাখা যাক, অনেকদিন থেকে এই খাবারগুলি বাঁচিয়ে রেখেছি বিশেষ কোনো মুহূর্তের জন্যে।

আমি এবং লেন কোনো কথা বললাম না। লী সাবধানে বোতলের মুখ খুলে এক ঢোক পানীয় খেয়ে কী একটা কথা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন আমরা ডকিং স্টেশনে এক ধরনের গুম গুম শব্দ শুনতে পেলাম। বুড়ো লী মুখ মুছে অস্পষ্ট স্বরে বলল, ওরা এসে গেছে।

ঘরটির একপাশে চতুষ্কোন হলোগ্রাফিক স্ক্রিনটি নিজে নিজে চালু হয়ে গেল এবং আমরা দেখতে পেলাম একটি ভাসমান যান স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং ভেতর থেকে দশটি নানা আকারের রবোট বের হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রত্যেকটি রবোটের পায়ের নিচে থেকে এক ধরনের জেট বের হচ্ছে, ভরশূন্য পরিবেশে স্বচ্ছন্দে চলাচল করার জন্যে এই রবোটগুলি পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে এসেছে। বাই ভার্বালের সবচেয়ে শেষ আরোহী সোনালি চুলের একটি মেয়ে। তার পিঠে একটি জেট প্যাক বাধা, হাতে ভয়ংকর দর্শন একটি অস্ত্র।

বুড়ো লী হলোগ্রাফিক স্ক্রিনটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কিহা

বল।

রোবট আর মানুষের এই দলটি এখানে প্রবেশ করার আগে তোমাদের একটা কখা বলতে চাই।

কী কথা?

বহুঁ বহুকাল আগে পৃথিবীতে বঙ্গোপসাগরের উপকুলে এক বুদ্ধিমান জাতি দাবা নামে একটা খেলা আবিষ্কার করেছিল। দ্বিমাত্রিক ক্ষেত্রে আটটি করে মোট চৌষট্টি ঘরের দুকে ষোলটি সাদা এবং মোলটি কাল গুটি নিয়ে খেলা হত। সেই খেলায়

আমি জানি। আমি সেই খেলা খেলেছি।

চমৎকার। বহুঁ প্রাচীন কালে হিসাব নিকাশ করার জন্যে কম্পিউটার নামক একটা যন্ত্র আবিষ্কার করা হয়েছিল, মানুষ সেই কম্পিউটারে দাবা খেলা শুরু করেছিল। এখনো তথ্য প্রক্রিয়ার যেসব যন্ত্রপাতি রয়েছে সেখানেও দাবা খেলা হয়। এই সব যন্ত্রপাতি মানুষ থেকে হাজারগুণ কী লক্ষগুণ বেশি দক্ষতা নিয়ে দাবা। খেলতে পারে। তোমার কী মনে হয় এইসব যন্ত্রপাতিক দাবা খেলায় হারানো সম্ভব?

সম্ভব।

অমির উওর গুনে বুড়ো লী আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, কেমন করে তুমি জান?

আমি জানি, কারণ আমি এই ধরনের যন্ত্রপাতিকে দাবা খেলায় হারিয়েছি। কী ভাবে হারিয়েছ?

এই সব যন্ত্রপাতি কখনো ভুল করে না। সেটাই হচ্ছে তাদের দুর্বলতা। আমি এই দুর্বলতা ব্যবহার করে তাদের খেলায় হারিয়েছি।

বুড়ো লী আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল, তার চোখে একটা কৌতুকের ছায়া পড়ল। সে হাত বাড়িয়ে আমার হাত স্পর্শ করে বলল, আমি পৃথিবীর নামে তোমাকে আশীর্বাদ করছি, তুমী জয়ী হও।

কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ গোলাকার দরজা খুলে গেল এবং ঘরে প্রথমে সোনালি চুলের মেয়েটি এবং তার পাশাপাশি অনেকগুলি রবোট এসে ঢুকল। ভরশূন্য পরিবেশে আমরা ওলট পালট খাচ্ছিলাম। কিন্তু যারা এসে ঢুকল তারা সবাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সোনালী চুলের মেয়েটি তার হাতের ভয়ংকর দর্শন অস্ত্রটি উঁচু করে ধরে বলল, বুড়ো লী, মহাকাশযানের কেন্দ্রস্থলে শক্তি কেন্দ্রে বিস্ফোরক বসানোর জন্যে তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।

বুড়ো লী ক্লান্ত, স্বরে বলল, কথা বলে সময় নষ্ট করো না সোনালি চুলের রবোট।

আমি রবোট নই। আমি মানুষ। আমার নাম ইফা।

ইফা, তুমি জান না যে তুমি রবোট। তোমাকে প্রোগ্রাম করা হয়েছে নিজেকে মানুষ বলে ভাবার জন্যে।

মিথ্যা কথা।

বেশ। আমি তোমার সাথে তর্ক করতে চাই না। তুমি গুলি কর। কিহ এবং লেন তোমরা চোখ বন্ধ কর। প্রতিহিংসামূলক হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত ভয়ংকর ব্যাপার।

লেন একটা আর্ত চিৎকার করে আমাকে জাপটে ধরল এবং সোনালি চুলের মেয়েটি ঠিক সেই সময় বুড়ো লীকে গুলি করল, আমি দেখতে পেলাম বুড়ো লীয়ের দেহ চোখের পলকে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। হত্যা করার কত রকম পদ্ধতি থাকার পরেও কেন এখনো মানুষকে এরকম প্রতিহিংসা নিয়ে ভয়ংকর ভাবে হত্যা করা হয় কে জানে। সোনালি চুলের মেয়েটি এবারে অস্ত্রটি আমার এবং লেনের দিকে তাক করল। আমার ভয় পাওয়ার কথা ছিল কিন্তু আমি ভয় পেলাম না, শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এখন কী চাও?

মূল তথ্যকেন্দ্রের আটজন মানুষ কোথায়?

পাশের ঘরে।

ইফা নামের সোনালি চুলের মেয়েটি ইঙ্গিত করতেই চারটি রবোট তাদের স্বয়ংক্রিয় জেট চালিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল। কিছুক্ষণের মাঝেই পাশের ঘরে শিশুগুলির চিঙ্কার এবং নানা কণ্ঠের প্রতিবাদ শুনতে পেলাম। লেন এতক্ষণ আমার বুকে মুখ গুজে রেখেছিল, এবার ভয় পাওয়া গলায় বলল, বাচ্চাগুলিকে কী করবে?

আমি জানি না।

লেন ইফার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি জান মূল তথ্যকেন্দ্রের আটজন মানুষ আসলে শিশু?

শিশু?

হ্যাঁ। তাদের সামলানো খুব সহজ নয়। তারা আমার কথা শোনে। তুমি রোটগুলিকে ওদের স্পর্শ করতে নিষেধ কর, আমি তাদের নিয়ে আসছি।

ইফা এক মুহূর্তে কী একটা ভেবে বলল, ঠিক আছে যাও।

লেন ভেসে ভেসে পাশের ঘরে চলে গেল। আমি ইফার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, আমি তোমাকে মুক্ত এলাকায় দেখেছিলাম, তখন তুমি আমাকে দেখে পালিয়ে যাচ্ছিলে–এখন অনেক সাহস দেখাচ্ছ, কারণটা কী?

ইফা কোনো কথা না বলে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমি নিচু গলায় বললাম, মানুষ ইচ্ছে করলে নিয়ম তৈরি করতে পারে আবার নিয়ম ভাঙতে পারে। রবোটেরা পারে না। তাদেরকে যেভাবে প্রোগ্রাম করা হয় ঠিক সেভাবে চলতে হয়। তোমাকে নিশ্চয়ই এখন সাহসী এবং নিষ্ঠুর হওয়ার জন্যে প্রোগ্রাম করা। হয়েছে।

ইফা ক্রুদ্ধ গলায় বলল, আমি রবোট নই। আমাকে কেউ প্রোগ্রাম করে নি।

তুমি হয়তো রবোট নও, কিন্তু তোমাকে প্রোগ্রাম করা হয়েছে ইফা। একজন। রবোটকে প্রোগ্রাম করা সহজ কিন্তু মানুষকে প্রোগ্রাম করা এত সহজ নয়। কিন্তু একবার যদি মানুষকে প্রোগ্রাম করা হয় সেখান থেকে তার কোনো মুক্তি নেই।

ইফা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি ফিসফিস করে বললাম, তোমার জন্যে আমার করুণা হয় ইফা। অসম্ভব করুণা হয়।

ঠিক এরকম সময় বাইরে থেকে অনেকগুলি রবোট ভেতরে এসে হাজির হল, তাদের একজন মাথা নিচু করে বলল, মহামান্যা ইফা আমরা শক্তিকেন্দ্র পরীক্ষা করে এসেছি। সেখানে কোনো বিস্ফোরক নেই।

বিস্ফোরক নেই?

না।

আমি ইফার দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি সম্পূর্ণ বিনা কারণে বুড়ো লীকে হত্যা করেছ।

বিস্ফোরক রাখা আর বিস্ফোরক রাখার কথা বলা সমান অপরাধ। বুড়ো লী তার কাজের যথাযযাগ্য শাস্তি পেয়েছে।

তোমার ভিতরে কী কোনো অপরাধবোধ জন্ম নিয়েছে ইফা?

অপরাধবোধ?

কেন?

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, তুমি নিশ্চয়ই একজন রবোট। নিশ্চয়ই রবোট।

ইফা ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, না, আমি রবোট নই। আমি মানুষ। মানুষ। মানুষ।

আমি বুড়ো লীয়ের ছিন্নভিন্ন দেহের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, তুমি মানুষ নও। আমি প্রার্থনা করি তুমি মানুষ হও।