৬. বিস্ফোরণটা হল শুক্রবার

॥ ৬ ॥

মগনলাল বিষ্যুদবার পর্যন্ত টাইম দিয়েছিল ফেলুদা তার মধ্যে ওর সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ করল না। আর বিস্ফোরণটা হল শুক্রবার সকালে।

আমিও ফেলুদার দেখাদেখি রোজ সকালে যোগব্যায়াম করি। সাড়ে ছ’টায় সে ব্যাপার শেষ হয়েছে। ফেলুদার কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না দেখে আমি তার ঘরের দিকে গেলাম। দরজাটা ভেজানো ছিল। ঠেলে খুলতেই একটা দৃশ্য দেখে থ মেরে গেলাম।

ফেলুদা এখনো ঘুমোচ্ছে। এ যে অভাবনীয় ব্যাপার! এই সময়ের মধ্যে ফেলুদার স্নান ব্যায়াম দাড়ি কামানো সব শেষ হয়ে যায়। সে বসবার ঘরে খবরের কাগজ পড়ে। আজ কী হল?

আমি ফেলুদার দিকে এগিয়ে গেলাম। বার দু-এক ঠেলা দিয়ে আর নাম ধরে ডেকে বুঝতে পারলাম ওর হুঁশ নেই।

আমার দৃষ্টি গোদরেজের আলমারির দিকে চলে গেল। দরজা হাট হয়ে আছে। সামনে মেঝেতে জিনিসপত্র ছড়ানো।

ফেলুদার পাল্‌স দেখলাম। দিব্যি চলছে। দৌড়ে বসবার ঘরে গিয়ে আমাদের ডাক্তার ভৌমিককে টেলিফোন করে ব্যাপারটা বললাম। ভদ্রলোক দশ মিনিটের মধ্যে চলে এলেন। ফেলুদাকে যখন পরীক্ষা করছেন তখনই ও নড়াচড়া আরম্ভ করেছে। ভৌমিক বললেন, ‘ক্লোরোফর্ম জাতীয় কিছু ব্যবহার করা হয়েছে অজ্ঞান করার জন্য। কিন্তু লোক ঘরে ঢুকল কী করে?’

সেটা আমি দু’ মিনিটের মধ্যে বার করে দিলাম। বাথরুমের উত্তর দিকে জমাদার ঢোকার দরজাটা খোলা।

মিনিট পনেরোর মধ্যেই ফেলুদার জ্ঞান হল। ডাক্তার ভৌমিক ভরসা দিয়ে বললেন, ‘কোনো চিন্তা নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবেন। তবে এরা কী ক্ষতি করেছে সেটা একবার দেখে নিন। আলমারি ত দেখছি খোলা।’

‘তোপ্‌শে দেরাজটা একবার খুলে দেখ ত।’

দেখলাম, কিন্তু সেই লাল ভেলভেটের কৌটো কোথাও পেলাম না। অর্থাৎ পিংক পার্ল উধাও।

ফেলুদা মাথা নেড়ে আক্ষেপের সুরে বলল, ‘বাথরুমের দরজা বন্ধ করতে আমার কোনোদিন ভুল হয় না। কালও হয়নি। আসলে ছিট্‌কিনিটা ভালো কাজ করছিল না। কেন যে সারিয়ে নিইনি—কেন যে সারিয়ে নিইনি!’

ডাক্তার ভৌমিক চলে গেলেন।

আমি ফেলুদার অবস্থা দেখেই লালমোহনবাবুকে ফোন করে দিয়েছিলাম। উনি এবার এসে পড়লেন।

‘পিংক পার্ল নেই?’ প্রথম প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক। আমি বললাম, ‘না।’ ভদ্রলোক ফেলুদাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আমাকে হেলাফেলা করার রেজাল্টটা দেখলেন ত? আমি প্রথমেই বলেছিলাম—কাজটা ভালো হচ্ছে না। আপনার যে এই দশা করতে পারে সে লোক কী সাংঘাতিক ভেবে দেখুন। এখন কী করা?’

ফেলুদা উঠে বসে চা খাচ্ছিল। বলল সে এখন হান্ড্রেড পার্সেন্ট ফিট। ‘বড়ালকে দুঃসংবাদটা এখনো দেব না। আগে দেখি মুক্তোটা উদ্ধার করতে পারি কিনা।’

টেলিফোনটা বেজে উঠল। আমি তুলে কথা বলে সেটা ফেলুদার হাতে চালান করে দিলাম। ‘তোমার ফোন।’

ফেলুদা মিনিট তিনেক কথা বলে ফোনটা রেখে বলল, ‘সোনাহাটি থেকে সোমেশ্বর। বড়ালের খবর আছে। সূরয সিং আবার চিঠি লিখেছে। মুক্তো তার চাই। সে সাত দিনের জন্য দিল্লি যাচ্ছে, সেখান থেকে ফিরে সোনাহাটি গিয়ে বড়ালের সঙ্গে দেখা করবে। সে এক লাখ টাকা অফার করছে। এত টাকা পাবে বড়াল ভাবেনি। সে এখন মুক্তোটা বেচে দেবার কথা ভাবছে। ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাওয়াতে মুক্তোটা এখন ওর একটা অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বলছে আপদ বিদেয় করাই ভালো। আমি আর বললাম না যে মুক্তোটা মগনলালের হাতে চলে গেছে।’

‘কিন্তু সেটা ত উদ্ধার করতে হবে,’ বললেন লালমোহনবাবু।

‘তাত হবেই। সেটাই এখন আমাদের কাজ। তোপ্‌শে টেলিফোন ডিরেক্টরি থেকে মগনলালের ঠিকানাটা বার করত।’

‘সাতষট্টি নম্বর চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ,’ বই খুলে নম্বর দেখে বললাম।

‘চা খেয়েই বেরিয়ে পড়ব,’ বলল ফেলুদা।

‘এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বোধ করছেন ত?’ জিজ্ঞেস করলেন জটায়ু।

‘ইয়েস স্যার।’

‘পুলিশে খবর দেবেন না?’

‘কী লাভ? তারা ত অনুসন্ধান করে নতুন কিছু বলতে পারবে না। সবই ত আমার জানা।’

চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউতে মগনলালের বাড়ি যখন পৌঁছলাম, তখন বেজেছে ন’টা দশ। আমরা ভিতরে ঢুকছি আর লালমোহনবাবু বিড়বিড় করছেন—‘আজ আবার কী খেল দেখাবে কে জানে!’

কিন্তু তিনতলায় মগনলালের গদিতে পৌঁছে তাকে পাওয়া গেল না। তারই একজন কর্মচারী বলল, মগনলাল সকালে দিল্লি চলে গেছেন।

‘প্লেনে গেছেন?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

‘না, ট্রেন।’

আমরা আবার নিচে নেমে এলাম। লালমোহনবাবু বললেন, ‘আশ্চর্য ব্যাপার ইনিও দিল্লি গেছেন আর ওদিকে সূরয সিংও দিল্লি গেছেন।’

‘ব্যাপারটা ভেরিফাই করতে হবে,’ বলল ফেলুদা।

চতুর্দিকে ফেলুদার চেনা—রেলওয়ে আপিসেও বাদ নেই। অপরেশবাবু বলে বুকিং-এর এক ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে ফেলুদা জিজ্ঞেস করল, ‘আজ সকালে দিল্লির কী কী ট্রেন আছে?’

‘সোয়া ন’টায় আছে—এইট্টি ওয়ান। পরদিন সকালে দশটা চল্লিশে দিল্লি পৌঁছায়।’

‘এ ছাড়া আর কিছু নেই?’

‘না।’

‘এবার রিজার্ভেশন চার্টটা দেখে বলুন ত মিস্টার মেঘরাজ বলে এক ভদ্রলোক এই ট্রেনে দিল্লি গেছেন কিনা।’

ভদ্রলোক চার্টের নামের উপর চোখ বুলিয়ে এক জায়গায় থেমে বললেন, ‘মিস্টার এম. মেঘরাজ। ফার্স্ট ক্লাস এ. সি.। কিন্তু ইনি ত দিল্লি যাননি।’

‘তা হলে?’

‘বেনারস। বেনারস গেছেন। আজ রাত সাড়ে দশটায় পৌঁছবেন।’

‘বেনারস?’

কথাটা শুনে আমারও আশ্চর্য লাগছিল, তবে এটা ত জানি যে মগনলালের বেনারসেও একটা বাড়ি রয়েছে। সেখানেই ত আমাদের সঙ্গে প্রথম আলাপ।

‘কাল সকালের দিকে বেনারস পৌঁছায় এমন কী কী ট্রেন আছে?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

‘আপনি দুটো সুবিধের ট্রেন পাবেন একটা অমৃতসর মেল, আর একটা ডুন এক্সপ্রেস। প্রথমটা ছাড়ে সন্ধ্যা সাতটা কুড়ি আর বেনারস পৌঁছায় পরদিন সকাল দশটা পাঁচ, আর অন্যটা ছাড়ে রাত আটটা পাঁচ আর পৌঁছায় সকাল এগারোটা পনেরো।’

ফেলুদা না হলে অবিশ্যি আমাদের রিজার্ভেশন পাবার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। সঙ্গে টাকা ছিল না। তাই বাড়ি ফিরতে হল। আবার রেল আপিসে ফিরে গিয়ে বারোটার মধ্যে রিজার্ভেশন হয়ে গেল। লালমোহনবাবু চলে গেলেন তাঁর বাড়িতে বাক্স গুছাতে। ফেলুদা বলে দিল, ‘ক’দিনের জন্য যাচ্ছি কিছু ঠিক নেই মশাই। আপনি এক হপ্তার মতো জামাকাপড় নিয়ে নিন। ওদিকে কিন্তু খুব ঠাণ্ডা—সেটা ভুলবেন না।’

ট্রেনে বলবার মতো একটা ঘটনাই হল। পরদিন সকালে সাড়ে সাতটায় বক্সারে খবরের কাগজ কিনে তাতে একটা জরুরি খবর পড়লাম। আমেরিকা থেকে একটা ব্যবসায়ীদের দল এসেছে, তারা যেসব ভারতীয়দের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করছে তার মধ্যে সূরয সিং একজন। ভদ্রলোকের দিল্লি যাবার কারণটা বোঝা গেল।

মিনিট পনেরো লেট করে আমাদের ট্রেন বেনারস পৌঁছে গেল।