সেবার অক্টোবরে বিহারের ধরমপুরে বিরল প্রজাতির নীল সারস দম্পতি আমাকে একটি ভয়ংকর এবং শোচনীয় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত করেছিল। সবিস্তারে সেই ঘটনার বিবরণ জার্নালে লিখে রাখলুম। এবার শেষের ঘটনা। লিখছি।
পরদিন ভোরে আমি কিন্তু সত্যিই ধরমপুরে গিয়ে ধারাগাঁও রেলস্টেশনগামী বাস ধরিনি। ধারিয়া নদী উত্তরে গঙ্গা থেকে বেরিয়ে ধরমপুরে পূর্বে বাঁক নিয়ে ধরমপুরের গা ঘেঁষে পশ্চিমে এগিয়েছে। তারপর একটা অববাহিকায় জলাভূমি রেখে দক্ষিণে ঘুরে ধারিয়া ফলস সৃষ্টি করেছে।
ধারিয়া নদীর তীরে ছোটো ছোটো টিলায় অনেক সুদৃশ্য হোটেল আছে। সুন্দর পরিবেশে অপেক্ষাকৃত কম খরচে হোটেল দ্য রিভারভিউ আমি বেছে নিয়েছিলুম। তারপর ওসি শ্যামসুন্দর সিংহের সঙ্গে যোগাযোগ করে মিঃ রায়চৌধুরির বাড়ি থেকে চলে আসার কারণ জানিয়েছিলুম। মিঃ সিংহ বললেন, সুসংবাদ আছে কর্নেল সায়েব। তবে আপনি সব জেনেও আমাকে কিছু খুলে বলেননি কেন, জানি না।
–আমি তখন আমার পুরোনো বন্ধুর বাড়িতে অতিথি ছিলুম। তাই মুখ বন্ধ রাখতে হয়েছিল।
–যাইহোক যে-ঘরে মেয়েটাকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল—
–জানি। ক্লাবঘরে কি আপনারা আর কিছু পেয়েছেন?
–জয়ার একটা ব্যাগ লাইব্রেরি ঘরের টেবিলে পেয়েছি। দুটো বাঁশে ডেডবডির দুই হাত পা বেঁধে রাতের অন্ধকারে খুনি টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছিল। শুক্রবার রাতে। আপনার নির্দেশমতো কাল সন্ধ্যায় বাঁশদুটোর দাগ খুঁজে পেয়েছি। দুটো দাগ জলে ভরা ছিল। বাঁশদুটো ছফুট দুইঞ্চি। দাগের সঙ্গে দৈর্ঘ্য মিলে গেছে।
–খুনিকে ধরতে পেরেছেন কি?
–না। সে গা ঢাকা দিয়েছে। তাকে খোঁজা হচ্ছে।
–তাকে পেয়ে যাবেন আমার বন্ধু অরিন্দম রায়চৌধুরির বাড়িতে। আমার মনে হচ্ছে, মিঃ রায়চৌধুরি এখনও সরডিহা থেকে ফেরেননি। দেরি করবেন না। এখনই বাড়ির চারদিক ঘিরে রেখে বাড়িতে ঢুকে সার্চ করুন। বড়ো একটা পুলিশবাহিনী চাই।
আমি ধারাগাঁও থানা থেকে আরও পুলিশ ফোর্স আনার ব্যবস্থা করছি।
দেরি হয়ে যাবে। আপনার যা ফোর্স আছে, তাই যথেষ্ট। দরোয়ান গোঁয়ার। দরকার হলে অ্যারেস্ট করবেন।
আপনি কি নিশ্চিত কর্নেল সরকার?
নিশ্চিত। ওই বাড়ি খুনির পক্ষে দুর্ভেদ্য দুর্গ।
একমিনিট কর্নেল সরকার।
বলুন?
একটা পয়েন্ট এখনও পরিষ্কার হচ্ছে না। জয়া যাচ্ছিল পাটনা। হঠাৎ সে বেঙ্গল ক্লাবে গিয়ে ঢুকল কেন?
মিঃ রায়চৌধুরির ব্যবসায়ী পুত্র বাচ্চু জানতে পেরেছিল জয়া ইন্টারভিউ দিতে পাটনা যাবে। তাই খুনির হাতে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল। চিঠিতে খুনির হাতে ক্লাবের পিছনের ঘরে লুকিয়ে রাখা একটা প্যাকেট দিতে বলেছিল বাচ্চু। সেই ঘরে ঢুকে খুনি জয়াকে একলা পেয়ে লোভ সম্বরণ করতে পারেনি।
প্যাকেট? প্যাকেট লুকিয়ে রাখার মানে কী?
পুলিশ সুপার মিঃ শর্মা এলে তার সঙ্গে এই হোটেলে চলে আসবেন। প্রমাণ দেখাব। মিঃ সিংহ! দেরি নয়। এখনই ফোর্স নিয়ে চলে যান। খিদে পেয়েছে। ব্রেকফাস্ট এসে গেছে।
.
ব্রেকফাস্টের পর আমি ধারিয়া নদীর তীরে বসে সময় কাটিয়েছিলুম। সাড়ে এগারোটায় ফিরে থানায় রিং করলুম। মিঃ সিংহ তখনই সাড়া দিয়ে বললেন, আপনাকে একটু আগে রিং করেছিলুম।
খবর বলুন।
খোকা বোসকে অ্যারেস্ট করেছি। সে দোতলায় পূর্বদিকের শেষ ঘরটায় শুয়ে ঘুমোচ্ছিল।
ওইঘরে আমি ছিলুম মিঃ সিংহ!
তাই বুঝি। শুয়োরের বাচ্চার কী খাতির! ওর বাবা নাকি ডাক্তার ছিলেন। মরে গিয়ে বেঁচেছেন। ওর দাদা বাইরে চাকরি করে। পুলিশ রেকর্ডে কিছু নেই। খোকা বোস ওরফে শচীন বোস এই অঞ্চলে খোকা পাহলোয়ান নামে কুখ্যাত। ওর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। বুঝতেই পারছেন মিঃ রায়চৌধুরি একজন রাজনীতিক। তার ছেলের নাকি বডিগার্ড। কর্নেল সরকার। ওকে পালানোর সুযোগ দেওয়ার ছলে গুলি করে মারতে পারলে আমি খুশি হতুম। জয়ার ফোটো কি আপনি দেখেছেন?
দেখেছি মিঃ সিংহ! আসলে জয়ার আত্মবিশ্বাস আর সাহসই তার শোচনীয় পরিণামের কারণ। রাখছি। আপনাকে অভিনন্দন মিঃ সিংহ!
না কর্নেল সরকার। আপনাকেই অভিনন্দন।
ফোন রেখে আমি আবার ধারিয়া নদীর তীরে গিয়ে বসলুম। চোখের কোনা দিয়ে লক্ষ করলুম, পাশেই রঙ্গনা ফুলের ঝোপে একটা প্রজাপতি বসে আছে। দেখেই চিনতে পারলুম। বিরল প্রজাতির নয়। কনিষ্ক কানাসে (Kaniska Canace) গোত্র প্রজাতির নাম নিমফালাইদি। ডানার প্রসার দুইঞ্চি। কালচে রং। দুডানার প্রান্তে কারুকার্য খচিত। তবু শরৎকালের রোদে কালচে রং মাঝে মাঝে বদলে রুপোলি হচ্ছে। থাক্। প্রজাপতি ধরার ইচ্ছা করছিল না। শুধু জয়ার রঙিন ছবিটা ভেসে উঠছিল মনে। নীল সারস দম্পতি সত্যিই কোনো দেব-দেবী।…