৬. বন্যা এল

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – বন্যা এল

শংকরীপ্রসাদের দেউড়ির পারে সুরকি বিছানো পুরনো পথ কখন অজ্ঞাতে ফেলে এগিয়ে এসেছে শরদিন্দু। স্টেশনের পথ ধরেছিল। দুপাশে হেলেপড়া জীর্ণ মাটির ঘর—রাজবংশীপাড়া পেরিয়ে গুপ্তযুগের বানানো মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। দেবী চণ্ডালিকার স্মৃতির প্রতীক মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। পত্রপল্লবঘন বটগাছের ছায়ায় ঢাকা ইতিহাসের মুখ। ফলকে উৎকীর্ণ লিপিটা পড়ার চেষ্টা করল সে। পারল না। এগিয়ে গেল ফাঁকা মাঠের পথে। চণ্ডালিকা স্টেশনের লাল লাল ঘরগুলো যে পথের শেষে। গাড়ি এগারোটায়। এখন দশটা পনেরো।

একটা সিগ্রেট ধরাতে ভারী শখ। সিগ্রেট কেসটা আনতে ভুলে গেছে। মনে পড়ল, গত সারাটি রাত্রি একটিও সিগ্রেট ঠোঁটে ওঠেনি তার। বড্ড জটিলতার তরঙ্গ চলেছে গত রাত্তিরে। এখন খেতে ইচ্ছে করে। হালকা মেজাজকে আরও খানিক স্বচ্ছন্দ করে তুলতে চায়। ওয়েটিং রুমের পেছনের দেয়াল সংলগ্ন দোকানটার দিকে এগিয়ে গেল সে।

—নান্তুদা!

ঘাড় ফিরিয়ে দেখে শরদিন্দু। চমকে ওঠে। মৃন্ময়ী! কমলা রং কীজন্যে এত পছন্দ মেয়েটির। ব্রাউনটাও বেরিয়ে আছে ওয়েটিং রুম থেকে ঘুরে দাঁড়ায় শরদিন্দু। এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর প্রস্তুতির প্রয়াস।

—মৃন্ময়ী না?

—হ্যাঁ, মিনু। হেসে উঠেছে মৃন্ময়ী। চললেন কোথায়, কলকাতা?

—না। তুমি?

—আমি নই, আমরা। মা আছেন সঙ্গে। গ্রামের মেয়ে একা যাব, তবেই হয়েছে।

আঁচলের কোণটা আঙুলে জড়িয়ে রাখা ওর অভ্যাস নাকি? একটু ফাজিল বুঝি। শরদিন্দু গম্ভীর হয়। ও, আচ্ছা।

এটা যেন একটা রুক্ষ কর্কশ বাস্তবতার আচমকা আঘাত। এগিয়ে যেতে যেতে ভাবে শরদিন্দু। যা খানিক চমকপ্রদ, অস্বস্তিকর অথচ মৃদুভাবে সুদূর। মানসিক প্রস্তুতি ঘটানো কঠিন বলে নির্ভেজাল অহমিকার পাঁচিল তুলে সরে আসতে চায় সে।

—নান্তু দা!

মনের কপটতা বুঝি ধরা পড়ে গেছে নিজের কাছে। শরদিন্দু ফিরে দাঁড়িয়ে সহজ হয়।

—কিছু বলবে মিনু?

মৃন্ময়ী এগিয়ে আসে। হ্যাঁ, বলব অথবা শুনব।

ভঙ্গি দেখে হাসি পায়। চিঠি—লেখা অস্বস্তিকর মেয়েটি নয়। কীজন্যে এখন ওই গোড়াবাঁধানো পিপুল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে কথা বলতে ইচ্ছে তার? তাই এগিয়ে যায়। বলে, চলো, তোমার কাছেই শোনা যাক।

—আমার চিঠি পেয়ে খুব রেগেছিলেন, না?

—সে কথা পরে আরেকটা চিঠিতে জানতে চাইলে ভালো হত। শরদিন্দু মৃদু হাসে।

—সুযোগ পাইনি।

—আমি অবিশ্যি তোমার কথা রাখতে পারিনি।

—জানি।

—মেজাজ ঠিক রাখতে পারিনি।

—জানি।

—মেজাজ ঠিক রাখতে পারিনে।

—শরদিন্দুর আকস্মিক গাম্ভীর্যে মৃন্ময়ী হাসে। আপনি বুঝি ভাবেন, খু—উ—ব ভয় করি আপনাকে, না?

—কেন?

—এমনি। ভয় অবশ্যি করি। তবে সে আপনার ক্যাম্পকে। বাবাঃ যেসব লোক পুষে রেখেছেন ষণ্ডামার্কা! কে বলছিল নন্দীভৃঙ্গী না কী নাম সব।

—হ্যাঁ। মহাদেব বনে গেছি বলতে পারো।

একটু চুপ করে বুঝি কথা খোঁজে মৃন্ময়ী। শরদিন্দু বলে, শত্রুপক্ষের সঙ্গে কথা বলছ, ধমক খাবে যে!

চমকে ওঠে মৃন্ময়ী। আপনি শত্রুপক্ষ, একথা জানিনে তো।

অপ্রস্তুত হয় শরদিন্দু। হঠাৎ একথা বলা উচিত হয়নি। তাই লঘুকরণের জন্যে বলে, নয় কি? তোমার বাবা আমার সঙ্গে কো—অপারেটিভ করতে ভয় পাচ্ছেন।

মৃন্ময়ী বলে, আচ্ছা নান্তুদা, বাবাকে বাদ দিয়ে কি আপনার কো—অপারেটিভ করা যায় না?

—যাচ্ছে না তো।

—আমাকে বুঝিয়ে বলবেন?

মৃন্ময়ী বদলেছে। শরদিন্দু সিরিয়স হয়,—আসল কথা কি জানো, তোমার বাবা মত দিলে এলাকার সব লোকই মানে যাদের ওখানে জমি আছে, স্রেফ রাজি হয়ে যাবে।

—তাই বুঝি বাবার উপর এত রাগ আপনার?

—ভুল বলছ মিনু। বরং তিনিই আমাকে হেয় করার তালে আছেন।

মৃন্ময়ী জবাব দিতে পারে না। শরদিন্দু আবার বলে, মিনু, তুমি কো—অপারেটিভ সম্পর্কে জানো কিছু?

—আগে জানতাম না। আপনাদের পাল্লায় পড়ে ক’দিনে জেনে ফেলেছি সব। মিনু হঠাৎ উচ্ছ্বসিতা।

—বই পড়ে?

—না। দেখেশুনে।

—তুমি চাইলে আমি ভালো কিছু বই পাঠাতে পারি। শরদিন্দু উৎসাহিত।

মৃন্ময়ী সে কথার জবাব না দিয়ে বলে, টিকিট কেটেছেন? গাড়ির সময় হল যে।

শরদিন্দু ঘড়ি দেখে। এখনও দেরি আছে। বলে, একটা কথা মিনু এসব কোনো রাগের কথা নয়। মানে তোমার বাবার সঙ্গে যে ব্যাপারটা চলছে—

বাধা দেয় মৃন্ময়ী, জেদের ব্যাপার!

—না। তাও হয়তো নয়।

—তবে?

—তুমি বুঝবে না।

—হয়তো তাই। কিন্তু নান্তুদা, বাবা রাজি হলেই আর সব লোকে রাজি হয়ে যাবে এ বিশ্বাস কীভাবে মনে আসে আপনার?

—রাজা শংকরীপ্রসাদকে পরগনার লোক কী চোখে দেখে তুমি কী জানো না তাঁর মেয়ে হয়ে?

—ওটা ভুল। আপনি দেশের লোকগুলোকে চেনেন না নান্তুদা। এরা জমির ব্যাপারে ভয়ানক স্বাতন্ত্র্যবাদী। অবশ্যি এ আমার ধারণা। কোনো বইতে পড়ে বলছিনে!

শরদিন্দু একটু বিস্মত হয়ে চেয়ে থাকে। মৃন্ময়ী এগুলো ভাবে তাহলে?

—তাহলে আমি কি করব বলতে পার?

—বা রে, আমি কীভাবে জানব?

শরদিন্দু মৃদু আঘাত দেয় প্যান্টের পকেটের কাছে হাতের আঙুলে। বলে, বড্ড বিশ্রী হয়ে যাচ্ছে সব। যেন নিজের মনেই বলে বিরক্তি প্রকাশ করতে চায়।

—টিকিট কাটুন, গাড়ি এল যে!

—মিনু!

—বলুন।

—তাঁর শর্তে আমি রাজি হলে অমত ছিল না তোমার বাবার। সে কথা তুমিই জানিয়েছিলে। আশা করি ভুলে যাওনি।

মৃন্ময়ী মুখ নত করে। তার গালে আকস্মিক রক্তোচ্ছ্বাস। নত মুখে পথ চলে। পাশে পাশে আসে শরদিন্দু। কথা আদায় করতে চায় এভাবে বলে, কথা বলছ না যে!

—যে কথার জবাব আগেই লিখেছি, আবার মুখে শুনে খুশি হবেন নান্তুদা?

—আমি জবাব চাচ্ছিনে।

—তবে কী? (মৃন্ময়ী কি কেঁদে ফেলবে। কী লজ্জা!)

—সমস্যাটা পরিষ্কার করে দিচ্ছি। শরদিন্দু সংযত হয়ে ওঠে এবার।

ত্রিলোচনী বেরিয়েছেন ওয়েটিং রুম থেকে। তুমি নান্তু, না?

বেঁচে যাবার আনন্দে পায়ে হাত রেখে প্রণাম করে শরদিন্দু। আজ্ঞে হ্যাঁ। একটু কথা বলছিলুম মিনুর সঙ্গে।

—অ। দূর থেকে তোমাকে কখনো দেখেছি বাবা, কাছে ডেকে দুটো কথা বলার সুযোগ পাইনে। তাতে নানান জনের নানান কথা।

শরদিন্দু এগিয়ে গিয়ে টিকিট কেটে আনে। ত্রিলোচনী বলেন, চলো একসঙ্গেই যাওয়া যাক। ওরে কপিল, বাবুকে বলিস তাহলে, আমরা গেলাম। আগে বলে বাড়ি যাস বাবা।

কপিলেশ্বর কুনাই অবাক হয়ে শরদিন্দুর মুখের দিকে চেয়েছিল। থতোমতো খেয়ে বলে, আজ্ঞে রানিমা! যতক্ষণ না গাড়ি ছাড়ে অধরোষ্ঠ বিস্ফারিত করে চেয়ে চেয়ে দেখে। ঘটনাটার মাধুর্য আর উত্তাপ গ্রাস করে ব্যাকুলচিত্তে। গাড়ি ছাড়লে তখনও নড়ে না।

ছেলেবেলায় ত্রিলোচনীকে দেখেছে নান্তু। জমিদার ঘরের মহিলা। এ পরগনায় চণ্ডালিকার রানিমার ভারী নামডাক। বিদেশ থেকে ফিরে অবশ্যি এত কাছাকাছি কোনোদিন দেখেনি। আজ দেখল তার অভিজ্ঞ মন দিয়ে। মৃন্ময়ীর মতোই মুখের আদল। যৌবনের সৌন্দর্য এখনও নিটোল হয়ে আছে শরীরে। কপালে লাল ফোঁটাটা ভারী উজ্জ্বল। চওড়া পাড় সাদা তাঁতের শাড়ি পরেছেন। হাতে দু’গাছি শাঁখা আর লৌহ কঙ্কন ঘিরে আরও দু’গাছি সোনার বালা। কানে মার একটু সাদাপাথর বসানো সোনা। নিরাভরণ শরীরে স্নিগ্ধ পড়ছে। শরদিন্দুর সালংকারা মায়ের পাশে দাঁড় করাতে গিয়ে আড়ষ্ট হয়ে ওঠে শরদিন্দু। এই শান্ত কমনীয় সৌন্দর্যের সুমুখে অভিভূত সে।

আর আশ্চর্য, শরদিন্দু এখন হিংসা হারানো নির্জীব শেয়ালের মতো নিজেকে লুকোতে চায় সবার চোখ থেকে। এদের সঙ্গে কীজন্যে উঠল সে! ত্রিলোচনীর ব্যক্তিত্ব! নিজের দুর্বলতা! কী জন্যে মনের তিলে গড়ে ওঠা যান্ত্রিক অভ্যাসের গতি ধারাবাহিক রাখা গেল না আর! শুধু এখন নয়। গত ফাংশনের পর তার একটা অদ্ভুত রূপান্তর ঘটছে ভেতরে ভেতরে। তাই এত পরস্পর বিরোধিতার হিড়িক। দুটো শক্তির যুদ্ধ চলেছে মনের মধ্যে। মৃন্ময়ীর চিঠির মধ্যে কী ছিল যা এই বিপ্লবের উপাদান! কিছুতেই খুঁজে মেলে না। শরদিন্দু নিজের মনের সবটুকু ভাষা বোঝে বলে যে গর্ব সঞ্চয় করেছিল, সবই ফাঁকি আর আত্মপ্রবঞ্চনা? এ বিরোধ ঘটছে ভেতরে, তাকে বুঝতে পারছে সে; অথচ এড়িয়ে গেলে মনে হচ্ছে তারপর বুঝি অকূল অথই শূন্যতার গহ্বর।

তখন আড়চোখে চেয়ে দেখে মৃন্ময়ীর মুখ। জানালার প্রান্তে ঠেস দিয়ে কনুইয়ে ভর করে গালে তার লম্বা আঙুলগুলো চুল অবধি ছুঁয়ে আছে। ত্রিলোচনী বলেন, সরে আয়। চোখে কয়লা পড়বে।

মুখখানি যতটুকু দেখা যায় দেখে শরদিন্দু। কোনো লোভে নয়। স্বভাবের কোনো গূঢ়ৈষায় নয়। ও—মুখের আকৃতি খোঁজে আপন মনভুবনে। স্মৃতির জটিল বনানী জুড়ে সে আকৃতির কোনো ফুল, একটুখানি পাপড়ি, কোনোকিছু? অথচ ছিল কিছু। আছে কোথাও। কোনো ঘটনা। কোনো সংগুপ্ত ক্ষত। নইলে এমন কীজন্যে হয়? এ বিশ্বাস কিছুতেই ঘোচে না। ডিক্টেটর শরদিন্দু চক্রবর্তী চণ্ডালিকা পরগনার মাঠে পড়ে সিক্তপক্ষ ঝড়োকাকের মতো উৎকণ্ঠায় অধীর। মানুষ কতটা পরিমাণে পরস্পর বিরোধী?

মৃন্ময়ীর মন। দেশবিদেশে দেখা চেনা অচেনা আধুনিক মেয়েদের সঙ্গে তুলনা করে দেখা মৃন্ময়ীর মনকে। এক গ্রাম্য কন্যা—হয়তো ঘরে বসে লেখাপড়া শিখেছে খানিক, হয়তো বুঝেছে অনেক বেশি তার বর্তমান জগৎকে; নিজেকে। নাঃ এসব স্থূলতা পরিহার্য। নড়ে বসে সে। মৃন্ময়ী মুখ ফেরায় এদিকে। দেখে শরদিন্দু চেয়ে আছে তার দিকে। শরদিন্দু লজ্জা পায়। এবার কানে আসে কথা। কি মুশকিল, ত্রিলোচনী অনেকক্ষণ থেকে তার সঙ্গে কথা বলছেন, বুঝতে পারে সে।

—তোমার জন্যে আমাদের গর্ব ছিল বাবা। দেশে এলে খুব খুশি হয়েছিলাম।

মৃন্ময়ী বলে, এখন খুব দুঃখিত হয়েছ মা?

—কথা শোন। আমি কি তাই বলছি? এই এক মেয়ে বাবা নান্তু। বড্ড দুষ্টু মেয়ে। একেবারে গেছোমেয়ে বলতে পারো। সামনে মাঘে বাইশে পা দেবে। এখনো দস্যিপনা গেল না। কাজের মধ্যে রাত্তির জেগে বইপড়া আর দিনে পায়রা ওড়ানো। গানের মাস্টার রেখেছিলাম ছেলেবেলায়। শিখল না। এখন আবার নিজে শখ করে গান শিখছে। একটিমাত্র মেয়ে।

মেয়ের গল্প করে চলেছেন ত্রিলোচনী। বুঝি সার্টিফিকেট ছড়াচ্ছেন শরদিন্দুর সুমুখে। মৃন্ময়ী হাসি চাপতে পারে না। শরদিন্দু কী বলতে গিয়ে দেখে ঝিকটিপোতার সিগনাল পোস্ট পেরিয়ে গেল সাঁ করে।

ত্রিলোচনী বলেন, হ্যাঁ বাবা নান্তু, বিলেতে ঠাকুর বামুন মেলে, না নিজে রান্না করতে?

মৃন্ময়ী মুখে হাত চেপে হাসছে। শরদিন্দুও হাসি চেপে বলে, মেলে বইকি।

—আমার বোনপো বিলেতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেছে।

প্লাটফরমে গাড়ি ঢুকছে। বড্ড ভীড় আজ। উঠে দরজার দিকে এগোয় শরদিন্দু।

ত্রিলোচনী বলেন, একদিন ওখানে এসো বাবা। নেমন্তন্ন নিয়ে লোক যাবে বুঝলে?

প্লাটফরমে শরদিন্দু। মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। বলে, আসব।

মৃন্ময়ীর চিবুক জানালার ফ্রেমে। বলে, আসবেন এক শর্তে। ওই নন্দীভৃঙ্গীদের রেখে, একা।

শরদিন্দুর বলতে ভারী ইচ্ছে, শর্ত ছাড়া তোমাদের সঙ্গে মেশা যায় না, বলতে পারে না।

ওদিকে ত্রিলোচনী ধমক দিচ্ছেন মেয়েকে, বয়স বাড়ছে, ধিঙ্গিপনা যায় না। বাবা নান্তু, কথা রইল কিন্তু।

মৃন্ময়ীর চুল উড়ছে মত্ত বাতাসে। গালে পড়ছে এসে। আলগোছে সরিয়ে নিচ্ছে সে। সুডৌল সুন্দর হাত। বাদামি রং কামরার গতিময় জগৎ থেকে উন্মোচিত একখানি হাত। থেমে থাকা একখানি আহ্বান।

শরদিন্দু আরও গম্ভীর হয়। টেলিগ্রাফের তারে একটা ফিঙে পাখি দুলছে আর দুলছেই। কিছুক্ষণ ধরে জমে ওঠা বরফের টুকরোয় আবার জাগছে তার হিংসার উত্তাপ। মিথ্যার সূত্যগ্রে ইমারত বানানোর দুঃসাহস যেন কোনোদিন তার না হয়।

যাবে ছকুলাল। ভগ্নীর কাছে যাবে কলকাতা। প্রাণ জুড়োবে, শান্তি পাবে। দেখতে পাবে তার ছেলের মুখ। তুফানীর আদলে গড়ে ওঠা মুখ। তিন বচ্ছর সে দেখেনি। কত যুগ যেন কেটে গেল কাতর মুহূর্ত দিয়ে ভরা। আনন্দ আদর আরাম থেকে বঞ্চিত বিমুখ বসুমতীর বুকে তার আকুল পদসঞ্চারের শেষে গ্লানির বোঝা নামিয়ে বসবে ছেলের মুখোমুখি। বলবে, এসেছিরে জাদুমণি। অনেক দুঃখ পেয়ে এসেছি। এট্টু গলা ধরে চুমু দে। শেতল হোক প্রাণ। তখন চুমু দেবে রতন। অনেক বড় হয়েছে এখন। দিনে দিনে বুদ্ধি বেড়েছে। জেনেছে তার বাবা আর কেউ নয়—সে এই ছকুলাল কুনাই। চণ্ডালিকার এক জীর্ণ মাটির ঘরের ঠান্ডা মেঝের রতন তুমি প্রথম সুর গেল গেয়েছিলে জীবনের। সেই মেঝের মায়া এক স্বপ্নের মতো মুছে গেল আস্তে আস্তে তোমার বাপের মন থেকে। তোমার বাপকে ওটা আর ধরে রাখতে পারল না। এখন তোমার সুখে সে সুখী হবে বলে তোমার জীবনের প্রান্তে এসে আশ্রয় চাইছে। তুমি তাকে নিরাশ করোনা সোনা।

রতন যদি বলে, বাবাকে না পেলে আমি থাকব না, (ছকুলাল হাসে ভাবতে ভাবতে) সাধ্যি কী কাজলবালার, দাদাকে ঠাঁই না দেয়! ছেলেকে ভালো করে শিখিয়ে দেবে সে দূরে ডেকে নিয়ে গিয়ে। ইস্কুলে ইংরেজি পড়া ছেলেটা বুঝবে না নাকি আসল কথাটা, ছকুলাল তার মাকে যেদিন হারিয়েছে, অন্তত সেদিন থেকেই রতন ছাড়া কেউ রইল না তার? তখন বলবে ছেলে, এতদিন তবে আসোনি কীজন্যে? মামা বলতে গিয়ে একটু থমকে যাবে সে, তখন মুখের ভঙ্গিটা কীরকম হবে? উচ্ছ্বসিত আনন্দের আবেগে বিহ্বল কল্পনার সময় এখন। শীর্ণ অবশ্রান্ত শরীরে বেগ এল। এল রক্তের অরণ্যে ঝড়। একতারাটা ধরে আছে হাতে। এখন ওটা ফালতু এক বোঝা। সকালে বাঁধতে গিয়ে তার ছিঁড়ে গেছে। সোনাডাঙার মনকির ফকিরকে গছিয়ে দিতে হবে। কিছু দাম পাওয়ার আশা। কলকাতা যাওয়ার খরচ মোট চার টাকা ক’আনা। চণ্ডালিকা অবধি টিকিটের দাম বাদে হাতে আছে মাত্র বারো আনা পয়সা। একতারার দাম হাঁকবে কমপক্ষে এক টাকা। শেষমেশ বারো আনা। তাহলে জমল দেড় টাকা। বাকি তিন টাকা। দেখা যাক গ্রামে ফিরে। শারীরিক পরিশ্রমে সে বড় অপটু হয়ে গেছে। মজুর খাটতে পারবে কি? তাতে রাত্তিরে জ্বর কাশি শ্লেষা। শরীর দিনে দিনে বোঝার মতো, শুধু অকারণ বয়ে বেড়ানো। পৌঁছোনো যাক তো ঘরে। কলঙ্গিনী ওলাং—এর কেনা সর্বসুন্দরী পেতলের ঘড়া আর মায়ের আমলের কাঁসার বাসনখানা তো আছেই। আরও কিছু টুকিটাকি। বেচে দেওয়া যাবে। চিরযাত্রার ব্যাপার। চণ্ডালিকা, খুশি মনে বিদেয় দিস বাছা। তুর বুকে জন্মে অনেক লাঞ্ছনা সইলেম। তাই কাজলের মতো তুকে বেসজ্জন দিলেম মোন হতে।

ওঃ হো! সর্বনাশ!

স্টেশনের এলাকা পেরিয়ে মনে পড়ে গেছে। গায়ের চাদরখানা ট্রেনে ফেলে এসেছে দুর্বুদ্ধি আর কাকে বলে। পাছার হাড়ে (শুকনো কাঠ তো বেঞ্চিটা!) ব্যথা পাচ্ছিল বলে ওটা গদী বানিয়েছিল। সর্বনাশ, এই শীতকালের হিমে! রাক্ষুসী রাত্তির আসছে। দিনে না হয় রোদ্দুরে কাটানো! রাত্তিরে? ঘরে ওলাং—এর সুটকেশটা আছে। কাজলের দেওয়া সুটকেস আর শাড়ি ক—খানা। একখানা গায়ে দেবে। বাকি দুখানা? পাঠিয়ে দেবে ওলাংকে? এতদিনে কুলটার সন্তানটা বেশ বেড়ে উঠেছে। হাসতে শিখেছে। চোখ মেলে চাইতে শিখেছে সেই পাপের ফুল!

দেশদেশান্তর ঘুরে চার মাস পরে গ্রামে ঢুকছিল ছকুলাল। আবার লম্বা চুল ঘাড় ছুঁয়ে ছুঁয়ে হিমার্দ্র বাতাসে দুলছে। পশ্চিম মাঠে ধান হলুদ রং সোনা এখন। পীরপুকুরের ঘনচ্ছায়া কিনারা থেকে নতুনকণ্ঠ জাগালের হাঁক। তাই ধূসর স্মৃতির পৃথিবীতে রোমাঞ্চ ঘনিয়েছে। হু হু করে উঠেছে বুক। যোগীবরকে মনে পড়েছে। বায়তুল্লাকে। জাম্ভু আর নেত্যকে। রক্তের সম্পর্ক দীনুপদকে। বায়তুল্লা এবার মাঠে নেই। ভাগচাষি হয়ে গেছে। ছকুলাল বিলের দিকে তাকায়। এক নিষ্ফল আহ্বান উত্তর বাতাসে দোল দিয়ে দিয়ে টিট্টিভের ডাকে আকাশের বুকখানা জরোজরো করে তুলেছে সেখান থেকে।

চণ্ডালিকার মাঠে শুধু কান্না আর কান্না। চলো তবে দূরে, অনেক দূরে শহর কলকাতার নিশ্চিন্ত সুখের মধ্যিখানে, কাজল যেখানে সুখী, সুখী তাকে পেয়ে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ সন্তান, আর আনন্দিত কলকাতা একটি কচি মুখের কলকাকলীতে। সেখানে মেটাও তুমি আপন জীবন কামনা।

উঠোনে পা বাড়িয়ে শিমুল গাছের পানে তাকায়। তিনটে শকুন রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে বসে আছে ডালে। হেসে ওঠে ছকুলাল, তুমরাও আছো তাহলে! থাকো থাকো। স্বত্ব বসে যেয়েছে, নাড়ির টান জন্মেছে। ছেড়ো না ভিটেটুকু। তুমরা তো ছকু কুনাই লও, শক্তিমান জীব। নখ আছে, ধারালো ঠোঁট আছে।

ঘরের তালা খুলতে গিয়ে চমকে ওঠে সে। কবে কে ভেঙে ফেলে আলতো আটকে রেখেছে শেকলে। আস্তে ঘরে ঢোকে। একরাশ উগ্র পরিচিত গন্ধ থেমে—থাকা অপেক্ষা—করে থাকা অন্ধকার, স্তব্ধ হতবাক অন্ধকারের স্পর্শের মতো ছুটে আসে। টিকটিকিরা এ বাড়ির জমাট স্মৃতির গা গেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায়। এবার ডাকল দেয়ালের ফাটল থেকে বেরিয়ে। ওরাও চায় না, এই নিশ্চিন্ত অন্ধকারের পরতে পরতে জমে ওঠা এ বাড়ির নরনারীদের কথা—কান্না—হাসি বাইরের আলো লেগে ভেঙে যাক, মুছে যাক।

আলোর জগতে অভ্যস্ত চোখ খানিক অন্ধ হয়ে থাকে হঠাৎ অন্ধকারের এই অন্তস্থলে এসে। তারপর একটু করে ফুটতে থাকে দৃষ্টি। ছকুলালের হাত থেকে একতারাটা পড়ে গিয়ে আর্তনাদ করে ওঠে।

বেচে পয়সা মেলে, এমন জিনিস একটুও নেই। ওলাং—এর সর্বসুন্দরী ঘড়া। মায়ের স্মৃতিতে ভরা কাঁসার বাসন, কোদাল একখানা, বাপ নাথুলালের কৃষাণ বাহুর প্রতীক,—আর কীসব কিনেছিল ওলাং। কিছু এখনও বন্ধক আছে। কিছু বন্ধক দিয়েছিল, পরে ছাড়িয়ে নিয়েছিল। কিছু বেচে খেয়েছিল। আর ছিল যা অবশিষ্ট।

সুদামসখীর কান্নার স্বর বাইরে। ওর মায়ের কাল হয়েছে। সেই খবর তার সুরেলা কান্নায়।

ছকুলাল খুঁজছিল ওলাং—এর সুটকেসটা। সিন্দুকের ভেতর রেখেছিল সে। ডালাভাঙা ছোট সিন্দুক। সুটকেস নেই।

স্তম্ভিত ছকুলাল। উঠোনে দাঁড়িয়ে সুদাং পলকে টের পেয়ে গেছে সব। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছকুলাল বাইরে বেরোয়। বলে, বসুমতীর বুকে এত ফসল রে সুদাং, তবু তো মানুষের ওদর ভরে না!

মুকুন্দ নায়েকের অস্থিসার কঠিন বুক থেকে মুখ তোলে টগর। আত্তির বুঝি ফুরোলো। ছেড়ে দাও কলবাবু।

নিস্তেজ সাপের মতো তাকায় নায়েক। যাবে?

—যাবো না তো কি আখতে পারবেন কলবাবু? ফিস ফিস করে কথা বলে ওরা।

—যদি পারি!

—উ অনেক দেখেছি। পেত্থম পেত্থম বলে সবাই। ক্ষিদে মিটলে…

—আমার ক্ষিদে অনেক বেশি।

—ছাড়ুন। আঁধার পাতলা হচ্ছে। কে আবার না দেখলে বাঁচি। উঠে দাঁড়ায় টগর। চুল বাঁধে। পুরুষের বুকে সমুদ্দুর জাগানো একটি নারীদেহের স্পর্শ আস্তে আস্তে মুছে যায়। হাত দুটো তুলে কবরী বানায় টগর। নিরাবরণ বুকের থেকে থাকা দুটি তরঙ্গ শীর্ষ স্বচ্ছ অন্ধকারে আবার দুলিয়ে দিচ্ছে নায়েকের মন। তরণীবিলাসের স্মৃতি আবার শেষবারের মতো তীব্র হয়ে ওঠে। সেই সময় জানালার পাশ দিয়ে বারান্দা—চর নদেচাঁদের শিখাপুচ্চ চলে যায় রান্নাশালের দিকে। উনুনে আঁচ দিয়ে যাবে সে খালের ওদিকে। নিত্যকার এই অভ্যেস। মুকুন্দ দেখে মাত্র। কিছু বলে না টগরকে। টগর নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়! বিধ্বস্ত সৌন্দর্যকে সুঠাম বিন্যাসে আবার গড়ে তোলে। নিপুণ ঠাটে পা ফেলে দাঁড়ায় গিয়ে কাঁটাতারের বেড়ার প্রান্তে। চারপাশ চেয়ে নেয় একটু (মুকুন্দর মুখ জানালায়)। তারপর ডিঙিয়ে মাঠে নামে। কুয়াশা ভেঙে এগিয়ে চলে চণ্ডালিকার দিকে।

তবু দেখল নদেচাঁদ। খালের ব্রিজে দাঁড়িয়ে। ছুটে এসে শরদিন্দুর ঘরের পাশে দাঁড়াল। শরদিন্দু তখনো ওঠেনি। ডাকল সে হাসিমকে। হাসিম আড়মোড়া তুলে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসে দেখল টগরকে। হিমস্পৃষ্টা খেঁকশেয়ালের মতো ছুটেছে টগর কোনোদিকে না চেয়ে। বড্ড দেরি হয়ে গেছে তার।

ভারী মজা বটে ঠাকুরের পুত্তুর! আনন্দে নদেচাঁদর হাত টিপে ধরে হাসিম। পিছিয়ে আসে নদেচাঁদ। এই ব্রাহ্মমুহূর্তে বেজাতের ছোঁওয়া, ধর্মভীরু নদেচাঁদ খালের দিকে চলে যায় আবার। হাসিম, শরদিন্দু না ওঠা অবধি তার দরজায় টুলে বসে থাকে।

সুযোগ মোক্ষম। টগরের স্বামী কপিলেশ্বর ক’দিন আগে গেছে বর্ধমান। মাটিকাটার মজুর হয়ে, গয়জদ্দির ভাইপো আব্বাস আলী ঠিকেদারের সঙ্গে; পাড়ায় অনেকেই গেছে, সেই সময় চলেছিল এসব, কাকপক্ষীটিও টের পেত না, পাড়ায় এলোকেশীও না।

সকাল হল এক সময়। টগর বাসন মাজতে নামল রায়দিঘির ঘাটে। সেই সময় ছকুলাল এল সেখানে। বনমালী নাপিতের বাড়ি চুলগুলো কেটে ফেলবে বলে চলেছে সে, তাকে দেখে চমকে উঠল টগর। ছকুদা কখন এলো গো? বিনোদিয়ায় ছিলা বুঝি?

হাসে ছকুলাল, না রে ভগ্নী। কত দ্যাশ ঘুরলাম, সি কি ইখেনে? তাপরে আছো কেমন? ভালো? জলের নীচে বাসন সমেত নেমে যাচ্ছে টগর। স্নান করবে বুঝি। ছকুলাল পাড় দিয়ে হেঁটে যায়। মনকির ফকির মাত্র চার আনা দাম দিচ্ছিল একতারাটার। দেয়নি সে, ফিরে এসে দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছে, চুল কেটে একবার যাবে ক্যাম্পে। যদি কিছু কাজ মেলে। পাড়ার লোক, তার পুরনো সঙ্গী নীলকান্ত ওখানে চাকরি করছে। সেই সুবাদে নিশ্চয় কিছু রোজগার হবে। তারপর টাকাপয়সা গুছিয়ে, নিজেও একটু সেজে গুজে যাবার চেষ্টা করবে। ইস্কুলেপড়া ছেলের বাবা। বাপবেটায় খানিক মানানসই হওয়া চাই, তাই যাবে একবার রাজাবাবুর বাড়ি একটু বস্তরের জন্য। রাজাবাবু তো ধমক দেবেন, যাবে তখন রানিমার কাছে। দয়াবতী রানি। আর আছে অগত্যা সে ফুলের মতো মিষ্টি, দেখন হাসি মেয়ে রাজকন্যে।

বনমালীকে ডাক দিয়ে বাইরে উঁচু দাওয়ায় বসে থাকে ছকুলাল, আর সেই সময় বনমালীর মেয়ের কাঁধে তার হারানো সর্বসুন্দরী ঘড়া।

লাফিয়ে নামে দাওয়া থেকে। ছুটে গিয়ে ধরে ফেলে ঘড়াটা। বনমালীর মেয়ে ফ্যান্সীর কাংস্যনিনাদে পাড়ার আকাশ বিতিকিশ্রী হতে থাকে। বনমালী বেরোয়, ছকুলালকে বেদম থাপ্পড় কিল ঘুঁষি চালায়। সে এক অনাচ্ছিষ্টি ব্যাপার। ছকুলাল মাটিতে লম্বা হয়ে পড়ে বুকে ঘড়াটা ধরে আছে প্রাণপণে। পিঠে বাপ—মেয়ে মরিয়া হয়ে প্রহার করে চলেছে, লোক জমে গিয়ে ছাড়িয়ে দেয় একসময়, সারা শরীরে রক্তের ছিটে। নখের কামড়ের চিহ্নও, ছেঁড়া কাপড়ের খুঁটে মুখ মোছে ছকুলাল। নিষ্পলক লাল চোখে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে, সে বিশীর্ণ বুক বিকৃত পেট হাপরের মতো লাফাচ্ছে অবিশ্রাম।

চতুর বনমালী। ডেকে নিয়ে যায় বাড়ির ভেতর হাত ধরে টেনে। শান্ত করতে চায়, চেঁচায়, ও ফ্যান্সী, একঘটি জল দে তোর গায়েন কাকাকে। নাও হে, হাত মুখটা ধুয়ে নাও গায়েন। কেন, আগে আমাকে চুপ করে বললেও তো হত, আমি কি করে জানব বলো। আমি কিনেছি অপরের কাছে নেয্য মূল্য দিয়ে।

অবোলা পশুর মতো তাকায় ছকুলাল।

কানের কাছে মুখ আসে। ঘড়া তোমার হতে পারে ভায়া, তুমি বলছ, কিন্তু ব্যাপারটা কি জানো? তোমাদের পাড়ার ওই মাগি গো, টগরেশ্বরী, ওর হাতে ভাই পেইছি জিনিসটে। একথা তুমি কোর্টে উঠে বলতে বলো, একশোবার বলব।

মাথা নাড়ে ছকুলাল। কপিলেশ্বরের এ বদনাম আছে বটে।

হঠাৎ গর্জায় বনমালী। হারামজাদি বেশ্যা, এখন বাবুর ক্যাম্পে মৌ ভাণ্ডার খুলেছে। ওকি আমার—, রান্নাঘরের দিকে চেয়ে থেমে যায় সে। ছকুলালের হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে যায়। নির্জনে দাঁড়িয়ে বলে টগরের সঙ্গে তার দীর্ঘ প্রণয় বৃত্তান্ত। টগরের বিশ্বাসঘাতকতা। ক্যাম্পের কাহিনী। তুমি কেস করো গায়েন ভায়া, আমি সাক্ষী দেব। মাগিকে আমি ছ’বচ্ছর পানিশমেন দেব। চলো, এখুনি থানা চলো।

শান্তকণ্ঠে ছকুলাল বলে, পেয়োজন নাই।

থামে না বনমালী। গাঢ় স্বরে বলে, ভাই ছকু, তুমি আমার সমবয়সি বটে। বলতে লজ্জা নাই, টগর আমার অতটুকু বয়েসের সঙ্গী হে। আজ কল্লে কী ব্যাপার দ্যাখো। যে ক্যাম্পে তাদের মানসম্ভ্রম নষ্ট হল, সেখানে এখনও পা বাড়াস রে ছোট জাতের মেয়ে। ছি,ছি,ছি! আজ রাত্তিরে ভাই ধরেছি শালীকে। বাড়ি যেইছিলাম, দেখলাম নাই বাড়িতে। গেল কতি? শেষে ভোর বেলায় দেখি ঘর ঢুকছে। আমি তখনো আসিনি ভাই। অনুসন্ধানে ছিলাম। তাপরে শোন, চরণ দুখানি দেখেই ধরলাম। শিশিরে ভেজা পা। ঘাসের ফুলগুলো লেগে আছে। একেবারে মাঠে যাওয়ার চিহ্ন। তা মুখে আবশ্যি প্রকাশ করলাম না। দেখি না তার দৌড়টা কতদূর?

বনমালীর স্বর নাকি হতে থাকে ক্রমশ। ছকুলাল ক্যাম্পে যাবে বলে মাঠের পথে নেমে পড়ে।

কিছুদিন পরে।

শংকরীপ্রসাদ প্রাঙ্গণের সুরকি জড়ানো পথে পায়চারি করছিলেন।

চণ্ডালিকা পরগনার অতীতকালের বুক থেকে এখন উঠে এসেছে পুরনো দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজা শংকরীপ্রসাদ রায়, যার চাবুক পরগনার মাটিতে অনেক চিহ্ন রেখেছিল এক সময়। কিছুক্ষণের জন্যে এই পুরনো মনকে জাগিয়ে তুলে তৃপ্তি খুঁজছেন শংকরীপ্রসাদ। জমিদারি চলে যাওয়ার পর এ চেহারা কোথাও দেখতে পাওয়া সম্ভব ছিল না। দেখানোও লজ্জার ছিল—যে—কোনো শংকরীপ্রসাদের কাছে। অথচ আজ একমাত্র আরামের বস্তু। শীতকাতর একটুখানি উত্তাপের কামনা।

টগরের মামলা ফেঁসে গেছে। শয়তানি ক্যাম্পে রাত্রি কাটিয়ে আসত। অবশেষে ধরা পড়ল। ধরে ফেলল শরদিন্দু। থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়াল ব্যাপার। সাক্ষী বনমালী নাপিত, নীলকান্ত কুনাই, ছকুলাল কুনাই। নীলকান্ত শরদিন্দুর লোক। কিন্তু বাকি দুজনকে নস্যাৎ করা যায় না। তাছাড়া টগর নিজেই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলল, সবই বানানো। অন্যের পরামর্শে পড়ে—অভাগিনী ছোট জাতের সরলা মেয়ে তারা—এসব ঘটিয়েছে। বলল, লুকোতে চায় না সে কিছু। রাজাবাবু তাদের শিখিয়ে পড়িয়ে এসব করিয়েছেন শরদিন্দুকে জব্দ করার জন্যে। শরদিন্দুকে জব্দ করে কী লাভ তাঁর? তাও বলল টগর। ওঁর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সায়েববাবু রাজি হননি, সেই ক্রোধ।

শংকরীপ্রসাদের মানমর্যাদা জীবনে এই প্রথম ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। উন্মাদ হয়ে উঠেছেন। গত রাত্রি ঝিকটিপোতা থেকে ফিরে একটিবারও জলস্পর্শ করেননি। কারা দেখা করতে চেয়েছিল, বাইরে থেকে ভাগিয়ে দিয়েছেন। ত্রিলোচনী ব্যর্থ হয়েছেন। মৃন্ময়ীর কান্না বিচলিত করতে পারেনি তাঁকে।

সেই সময় এল ছকুলাল। সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে জোড় হাতে দাঁড়াল। রাজাবাবুর চেহারা দেখে ভয় পেল। সরে আসতে চাইল। কিন্তু ততক্ষণে গর্জে উঠেছেন শংকরীপ্রসাদ।

—কী চাই তোমার?

—এজ্ঞে, এট্টু রানিমায়ের কাছে যাবো।

—কেন?

—এট্টু পাত্থনা। একখান বস্তরের জন্য।

আচমকা তার চুল ধরে মুষ্ট্যাঘাত করে বসেন শংকরীপ্রসাদ। ছকুলাল আর্তনাদ করে পড়ে যায়। উদভ্রান্তভাবে লাথি মেরে চলেন। কেন, কেন তুমি এখানে আসো। কে আসতে বলে তোমাকে?

ছুটে পালিয়ে যায় ছকুলাল। পিছনে শংকরীপ্রসাদের গর্জন শোনে, ফের যদি কোনোদিন এ মাটিতে পা দাও, খুন করে ফেলব তোমাকে। আহাম্মক জরোদগব, পাপ কোথাকার।

চোখে আগুন, উদ্দাম স্পন্দন দেহে। মৃন্ময়ী এসে ধরে ফেলে বাবাকে, তুমি পাগল হয়ে যাচ্ছ বাবা! চলো, ভেতরে চলো।

হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় মৃন্ময়ী। সিঁড়িতে উঠতে উঠতে বলে, নান্তুবাবু যা খুশি করুন, তোমার তাতে কী বাবা! তুমি কোথাও যেয়ো না। দেখি সে কেমন করে আমাদের মর্যাদায় হাত বাড়ায়।

নিঃশব্দে চেয়ে আছেন শংকরীপ্রসাদ আরাম কেদারায় বসে। দেখছেন হেলেপড়া জীর্ণ তোরণটা। ছকুলালের দাঁতে হাতের কোথাও একটু ছড়ে গেছে। জামার আস্তিনে সেই রক্তের ছোপ। ঝুঁকে পড়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন।

বুকখানা দুহাতে চেপে ধরে দৌড়ে গেল ছকুলাল। রায়দিঘির পাড়ে গিয়ে ভাগাড়ের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় বসল। এমনি আরেকদিন দেখা করতে এসেছিল সে। এমনি মার খেয়ে এসে বসেছিল ওই জিয়ালা গাছের ডালে। দীনুপদ টেনে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল তাকে। আজ আর দীনুপদ নেই। সে এখন কবি কিশোরীমোহনের দলে ভিড়ে ঘুরছে দেশান্তরে। তার জামাই দাদা এসে ছেলে দুটোকে এতদিন পরে নিয়ে গিয়েছিল। দীনুপদ মুক্তি পেয়েছে। এবার ছকুলালের পালা।

কিন্তু কেন তাকে এমন করেন রাজাবাবু!

কেন তার মার কাছ হতে জোর করে ছোট বাকসোটা কেড়ে নিয়েছিলেন? মা যার দুঃখে চৌকাঠে মাথা ভেঙে রক্তাক্ত করে ফেলত কপালখানি!

কাকে অভিশাপ দিত আমোদিনী?

দেবী চণ্ডালিকার মন্দিরের দুর্গম রহস্যের অন্ধকারে তলিয়ে গেছেন কত পণ্ডিত, ঐতিহাসিক, সত্যের সন্ধানী কত গবেষক। চণ্ডালিকার অতীতকালের দূর ধূসর কাহিনীতে যা ছিল, জানে ছকুলাল। চণ্ডালিকার চণ্ডাল মেয়ে দেবী চণ্ডালিকার মন্দিরের শিলাচত্বরে মাথা ভাঙত; রক্তে ভাসত আলুলায়িত মেঘবরণ কেশ। চন্দনচাঁপার গন্ধে বর্ণে ভরা তপঃক্লিষ্ট শীর্ণ অঙ্গে ক্লান্ত শিথিল চরণ ফেলে এগিয়ে যেত নিরিবিলি সন্ধ্যার লগ্নে। আর বিলাপের বিলম্বিত করুণ স্বর ধেয়ে যেত মন্দির চূড়ার স্বর্ণালি লাবণ্য পার হয়ে। আকাশজোড়া পূরবীর কাতর মূর্ছনায় মিশে থাকত।

আবহমানকালের শাশ্বত বিলাপ। প্রণয় আর বঞ্চনা। রক্ত আর অশ্রু। তারপর শুধু বিলাপ। মহাকালের সজাগ প্রহরীর চোখে তন্দ্রার অলস—মায়া—জাগানো মানব। আর অসহায় বিলাপ। কেউ শোনে না, কেউ দেখে না। কালের দণ্ড খসে পড়ে না। ইতিহাস পাথর ভেঙে পথ গড়ে এগিয়ে চলে অনির্বাণ কামনার দীপশিখা জ্বালিয়ে। দেখে শুধু নির্জন জাগর রাত্রির স্তরে স্তরে লুকিয়ে থেকে কোটি কোটি কীটপতঙ্গ সরীসৃপ আর দেয়াশিনী জোনাকী কন্যারা।

রায়দিঘির গহন জলে ডুবে এল ছকুলাল। শীত গায়ে লাগে না।

কালই কলকাতা যাবার দিন তার।

প্রায় কানে কানে মন্ত্রদান করে শ্রীনিবাস।

—বুঝলেন স্যার, প্রথম কথা ট্রিকস। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, তাকে কাজে লাগানো। আজ পঁচিশ বছর কো—অপারেটিভ নিয়ে আছি। তাতে অন্য কিছু না হোক, একটা বড়ো লাভ হয়েছে যে মানুষ জিনিসটের রহস্য আমি টের পেয়ে গেছি।

শরদিন্দু ভ্রূ কুঞ্চিত করে তাকায়, রহস্য?

—ইয়েস স্যার, রহস্য। ওটুকুই সংসারের বীজমন্ত্র বলতে পারেন। তারপর যা বলছিলাম। আমার অভিজ্ঞতার কথা। অভিজ্ঞতা আমাকে বলে, ট্রিকস কাজে লাগাতে হলে মেশো মানুষের সঙ্গে। মেশার মতো মেশো। আই মিন, লাইক এ পাঁকাল মাছ। কাজে নামতে হবে, মিশতে হবে মানুষের সঙ্গে। অবিশ্যি অন ওয়ান কনডিশন। তাদের ধরনে চিন্তা করে কথা বলে, চলে ফিরে অ্যান্ড তাদের পদ্ধতিতে কাজ করে আগে তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে হবে। সেইজন্যেই তো আজকাল যত্রতত্র শুনবেন, ফোক, পিপল জনসাধারণ, জনগণমন ইত্যাদির স্লোগান ছুটছে বন্যার মতো।

চিন্তিত মুখে শরদিন্দু বলে, ঠিক তাই ঘটছে।

আরও উৎসাহিত হয় শ্রীনিবাস। ইয়েস স্যার, এভরিহোয়্যার থ্রু আউট দি হোল ওয়ার্লড। জনসাধারণের জন্যে জনসাধারণের মধ্যে বুদ্ধিমান লোকেরা সেঁটে গেছেন। সেঁধিয়ে বুঁদ হয়ে গেছেন। পাবলিক বিশ্বাস করছে কিনা, এই হচ্ছে সবার লক্ষ্য। বিশ্বাস অর্জনের পয়েন্ট পরে বলছি, রেজাল্টটা বলি। বিশ্বাস করলে টিকলেন, নইলে কী হবে জানেন; যাকে কো—অপারেটিভ ল্যাংগুয়েজে বলে কিনা লিকুইডেশন! হাঃ হাঃ হাঃ।

হাসি শেষ করে বলে, সুতরাং অ্যাজ এ হোল সূত্রটা দাঁড়াচ্ছে এই যে, বিশ্বাস অর্জন। আর জনসাধারণের বিশ্বাস সহজ কথা নয়, মাইন্ড দ্যাট। তার জন্যে কী করা উচিত বলি। শতকরা নাইনটি নাইন পারসেন্ট ধাপ্পা দিতে হবে, ইয়েস স্যার, গুল ঝাড়তে হবে। হাফ পারসেন্ট অ্যাডভান্স লভ্যাংশ দিতে হবে। বাকি হাফ বেড়ালের সুমুখে শিকেয় তোলা খাবারের মতো রাখতে হবে। এযুগে একা একা কিচ্ছু হবে না স্যার। কেবল জল ঘোলানোই সার। তাই পিপলকে আপনার দরকার। পাচ্ছেন না। কো—অপারেটিভটা হচ্ছে না।

খানিক চুপ করে শ্রীনিবাস তার কথার ফলাফল লক্ষ্য করে যেন। তারপর আরও একটু ঝুঁকে পড়ে বলে, তাহলে কথা হচ্ছে, ফার্স্ট পয়েন্ট : আপনাদের জমিগুলো পার্ট বাই পার্ট ভুয়া নামে হস্তান্তর করুন। রেজিস্ট্রেশন হয়ে যাক। তারপর সেকেন্ড পয়েন্ট: জনসাধারণের সঙ্গে কিছু কাজে নেমে বিশ্বাস অর্জন। দু’টোই একসঙ্গে চলতে আপত্তি কি?

—কীভাবে? বুঝতে পারে না শরদিন্দু।

—যা হয় কিছু নিয়ে নেমে পড়ুন। মামলা একটা গেছে, বাকিটাও যাবে। সেইজন্য অ্যাংজাইটির কিছু নেই। কিন্তু তৈরি করতে থাকুন।

—অর্থাৎ!

—ইলেকশনে দাঁড়ান। সেভেন্টি পার্সেন্ট ভোট গ্যারান্টি রইল। এখনও ঝাড়া ওয়ান ইয়ার টাইম। সাফিসিয়েন্ট ফর ক্রিয়েটিং ইওর ফিল্ড।

—সে তো দাদার ব্যাপার। তিনি সম্ভবত কংগ্রেস টিকেট পেতে পারেন।

—বেশ কথা। ভালো কথা। তাহলে ছোট ভাইকে এখন থেকে কাজে লাগতে হয়।

—সে হবে।

—ওই তো যত গলদ স্যার।

—কেন?

এবার চোখ বুজে ধ্যানস্থ হওয়ার ভান করে শ্রীনিবাস। তারপর বলে, প্লিজ ডোন্ট ডিসক্লোজ এনিহোয়্যার। আমার সংবাদের সত্যতা স্টিল আন্ডারডার্কনেস। আমি শুনেছি রাজাবাবু ইলেকশনে দাঁড়াচ্ছেন।

—হোয়াট! বাঘের মতো লাফিয়ে ওঠে শরদিন্দু!

—ইয়েস। আই গট দি ইনফরমেশন ফ্রম এ ভেরী রিলায়েবল সোর্স।

—কোন পার্টির থেকে?

—যদ্দূর ধারণা কংগ্রেস টিকেট না পেলে লেফটিস্ট গ্রুপ থেকে। অবিশ্যি বাইরের প্রচার হবে স্বতন্ত্র বলে। অর্থাৎ টিকি মুখ বেঁকালে দাড়ির পক্ষে। দাড়ি চোখ পাকিয়ে চাইলে টিকির নীচে।

—ফ্যাকট?

—নাইনটিনাইন অ্যান্ড হাফ পারসেন্ট।

—কী করা উচিত আমার? শরদিন্দু অসহায়ের মতো নিজেকে সঁপে দিতে চায় শ্রীনিবাসের কাছে।

—ক্যাম্প ছেড়ে বেরুতে হবে। গ্রামাঞ্চলে যেতে হবে। এ জমির স্বত্ব নিয়ে যারা বিরূপ তাদের কাছেই যেতে হবে। স্তোকবাক্য ছাড়তে হবে রাশি রাশি। নাছোড়বান্দা হয়ে পেছনে লাগুন। দেখবেন সব গলে জল হয়ে গেছে। এই তো আসল ব্যাপার স্যার। আসলে আমাদের দেশের কেন—সব দেশেরই জনসাধারণ তত খারাপ নয় মোটে, বরং ভয়ানক ভালো, ভেরি অনেস্ট। কেননা জনতা সবসময় ডিজনেস্ট হলে এতদিন পৃথিবী থেকে মানুষের বংশ লোপ পেয়ে যেত। ব্যক্তি সবসময় ডিজনেস্ট থাকতে পারে থ্রুআউট হিজ লং লাইফ। কিন্তু জনসাধারণ তা থাকতে পারে না। তাই জনসাধারণের সেন্টিমেন্টটা বুঝে চলতে হয়। এই যে আপনার উন্নত চাষব্যবস্থা, আপনার এই আইডিওলজি, কো—অপারেটিভ, এগুলো তারা কি মন্দ বলে বলবে কোনোদিন? না। অথচ বিরূপ আপনার প্রতি। কেন না সেন্টিমেন্টের প্রশ্ন আছে। এখন ওখানে মলম দরকার।

হেমন্তের হলুদ রোদ্দুর ফিকে লাল হয়ে আসছে। শ্রীনিবাসের কথা ক্যাম্পের হিম বাতাসে উষ্ণতা আনে।

—তাছাড়া আসল মজা কি জানেন? আপনাদের মতো হোমরা—চোমরা লোক যদি ওই অমুক সেখের বাড়ি—কিংবা ধরুন অমুক সদগোপের দোরগোড়ায় হাজির হন, তাদের পরলোকস্থ চৌদ্দপুরুষ কবরখানায় মাটি ঠেলে শ্মশানের ছাই ফুঁড়ে করজোড়ে বেরুবে। বাজে কারণ জনগণের ভব্যতা বোধ; মূল কারণ—আপনি একজন বিরাট লোক। আসলে মানুষ অর্থবানকে যেমন ঈর্ষা করে, প্রলুব্ধও হয় ততখানি। জনগণের ওই এক মতিগতি। টাকাপয়সার বড় সম্মান দিয়ে বসে। গুণীজ্ঞানীর সম্মান না দেওয়া নয়। কিন্তু ওটা বাইরে বাইরে। সেই ভব্যতাবোধের জন্য। যাক সে কথা। আপনি ওদের সঙ্গে মিশলে, ওরা মুক্তকচ্ছ হয়ে তিরিশ মাইল রান দেবে একথা আমি হলফ করে বলতে পারি স্যার। আর প্র্যাকটিক্যালি হচ্ছেও তাই। যাঁদের একটু পাদনখকণা দর্শন দুর্লভ ছিল, আজ তাঁরা হাসু সেখের দোরগোড়ায় ধুলো পায়ে নমস্তে ঠুকছেন একেবারে। হাঃ হাঃ হাঃ।

মাথা নাড়ে শরদিন্দু।

—যে যুগ পড়ে গেছে স্যার। এ কথা মানতেই হবে যে পিপল ইজ দি ওনলি ভাইটাল থিং। থাউজ্যান্ডস অফ অ্যাটম বোম্বস—এর চেয়ে মারাত্মক। একবার ঘোরে যদি, ফেরায় কে। অথচ পিপল ইজ কোয়াইট আনকনসাস টু দি পয়েন্ট। তাই ট্যাক্টফুলি ম্যানেজ করতে পারলে একেবারে ইনকিলাব জিন্দাবাদ। তখন কিছুদিন নাকে তেল দিয়ে ঘুমুন, হু ইজ ডু ডিসটার্ব ইউ? ইফ পিপল বার্ক, গিভ দেম সাম ফুড। ফুডের উপাদান বলে দিই স্যার। অনেক রকম ফুড আছে। ইহকাল পরকাল দুই—ই প্লিজড হয় যেখানে—সেই রকম ফুড চাই।

শরদিন্দু অভিভূত। পুঁথিপাঠের জ্ঞান কী হাস্যকরভাবে ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। মানবতা, প্রগতি, মুক্তি—সব বিশুদ্ধ আদর্শবাদের নীচে এক কুটিল রাক্ষসের অক্টোপাশ বাহুবিস্তার। আসল কথা ক্ষমতা পরিতৃপ্তির মধ্যে দিয়ে ব্যক্তিগত ভোগেচ্ছার চরম তুষ্টি। ভাঁওতার উপর ফাঁকির ভিতে আদর্শবাদের ইলিউসান স্তম্ভের মতো তুলে ধরা। এমনি করে আবহমানকাল ধরে ইতিহাসের সভ্যতার ইমারত রচনা চলেছে। ধসে পড়েছে, আবার গেঁথে তোলা হয়েছে। ডারউইনের ‘যোগ্যতমের উদবর্তন’ আর ফ্রয়েডের ‘ইদ’। দুজন পণ্ডিতকে এক জায়গায় একাঙ্গে মেশোতে ইচ্ছে করছে শরদিন্দুর।

আর মার্কস?

অবদমিত দলিত মানবাত্মা মুক্তির কান্না কাঁদল যুগযুগ ধরে। মেলেনি মিলবে না। কেননা, (শরদিন্দু সিগ্রেট ধরায়, শ্রীনিবাসকে দেয় একটা কৃতার্থ শ্রীনিবাস) বিশ্বলোকের জড়প্রবাহে প্রাণচৈতন্যের আবির্ভাব এক দৈবাৎ হাস্যকর ঘটনা। বিরাট নিখিলের এক অকিঞ্চিৎকর ব্যাপার। জড়দেবতার পাষাণচত্বরে মাথা ভেঙে বিলাপই একমাত্র শেষ কথা।

শ্রীনিবাসের কথা ফুরোয় না। ইয়েস স্যার, ওই মোক্ষম কথা হচ্ছে কালচার। প্রত্যহ কাগজ খুলে দেখুন, লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা খরচ করে কোথায় কোন কালচারাল ভবন, কালচার রক্ষণ—পোষণ—কর্ষণের বড় বড় বিল্ডিং, এলাহী কাণ্ডের চমকপ্রদ সব খবর। তার জন্যে জ্ঞানী লোকের মস্ত মস্ত বাহবা ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং পিপল তাতে হাইলি প্লিজড। ফলটা কী হয়? প্র্যাকটিক্যাল কতটা লাগে তা জীবনের আসল প্রয়োজনে? চণ্ডালিকের হারু কুনাই ম’ল আর বাঁচল, তাতে কালচারের কী স্যার? অ্যান্ড হিসট্রি রানস দিস ওয়ে। শ্রীনিবাস শূন্যে ঘুঁষি ছুঁড়ে মারে।

শরদিন্দু একটু অবাক হয়ে লক্ষ্য করে তাকে। এ লোকটাও এসব ভাবে?

হিমানি বইছিল সকাল থেকে। একটু একটু কুয়াশা হেমন্তের শুরু থেকে জমছিল। বছরটা যেন কেমন নতুন—নতুন। ছকুলাল বেরুলো বাড়ি থেকে। সাতুই অঘ্রান। চারদিকে চারবার প্রণাম করে বেরুলো। ভিটেমাটির কাছে বিদায় ব্যথা জানিয়ে চিরজীবনের জন্যে যেন বেরুলো।

নীলকান্তর কাছে জামা আর ধুতি চেয়ে নিয়েছে। চাদর নাইবা রইল। চুল কাটা হয়নি। পাঁচ টাকা কয়েক আনা সম্বল করে চাপল বেলা এগারোটার গাড়িতে চণ্ডালিকা স্টেশনে। ভীড় কম আজ। একটা কোণ দেখে স্বচ্ছন্দে হাত—পা ছড়িয়ে আরাম করে বসল। জানালায় মুখ বাড়িয়ে চেয়ে রইল বাইরের পিছিয়ে যাওয়া পৃথিবীর পানে।

পাশেই বউ নিয়ে চেপেছে একটি যুবা। বেশ সুন্দরী বউ। টুকটুকে ডাগর ডোগর। ভাবে ছকুলাল, রতন কুমার বড় হয়ে পাশ করে বেরুলে অমন একটি জুটিয়ে দেবে। কল্পনা করে মনে মনে তার যুবক ছেলের চেহারা। ভারী সুখ পায়। মানাবে উত্তুম বটে।

কলকাতায় গিয়ে আপাতত ছেলেকে দেখে প্রাণ শীতল করবে সে। তারপর বংশীবাবুকে বলেকয়ে কাজের জোগাড়। সেখানে মিলে না কী? বাঘের দুধ চাও। তাও। কিন্তু বনবে না হয়তো কাজলের সঙ্গে। ছেলেকে সে মিশতে দেয় না বাপের সঙ্গে। কী কুচ্ছিত আচরণ! সব হয়ে থাকবে সে। কাজ পেলে তখন কেড়ে নেবে রতনকে। কোথাও বাসা খুঁজে দুজনে একসঙ্গে কাটাবে সুখী জীবন। আর ঘরনির প্রয়োজন নেই। এখন শুধু ছেলের মুখ।

না, কাজল বড্ড বদ মেয়ে। কুনাই কুড়রের ছেলে ব্রাহ্মণকে বাবা বলে! এর প্রতিফল অবশ্যই পাবে কাজল। ধর্মজ্ঞান তো কোনোদিন হল না। ছকুলাল ভালো মানুষ, নিরীহ লোক বলেই রক্ষে। অন্যকেউ হলে সইতো এসব!

রূপপুর স্টেশন পার হল গাড়ি। ভীড় বাড়ছে একটু করে। টুকটুকে বউটি একেবারে গা ঘেঁষে বসেছে। সসম্ভ্রমে যথাসাধ্য সরে আসে ছকুলাল। কী সোন্দর গন্ধ গো মেয়ের অঙ্গে। হঠাৎ মনে পড়ে যায় ওলাং—এর কথা ওই গন্ধের আভাষে। ওলাং—এর গায়ে অমন গন্ধ পেত। লালরঙের কী দামী সাবান কিনত ওলাং। নাকি আপন রোজগারের টাকায় কিনত? কে জানে! একটু আত্মস্থ হতে গিয়েও পারা যায় না। কীজন্যে এই চলমান গাড়ির গতি আর গাড়ির ভেতর কোলাহল এ সব কিছুর সঙ্গে নিজের অস্তিত্বকে মেশানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে এতক্ষণে। কিছু কি ফেলে যাচ্ছে সে?

বাঁকের মুখে ট্রেনের ঘনঘন বাঁশি। এইবার ঝিকটিপোতা স্টেশন। বিনোদীয়া গ্রাম। এক মুখর জাগর রাত। আকাশের তখনকার একটি মোটা তারার মতো ওলাং—এর কপালে লাল টিপটা মনে পড়ল। মনে পড়ল পীরপুকুরের পাড়ে ছায়ায় বসে থাকা ক্লান্ত শ্রান্ত বিবশ অঙ্গ এক ঘুঁটেকুড়োনি মেয়েকে। তার জন্যে রান্না করে এসে ডাকত, চল, ভাত বেড়েছি। বেশ তো ছিল স্বচ্ছন্দ মধুময় জীবনের ছন্দ।

হারাল সব। চণ্ডালি বাঁধার বিলে তার বুকের রক্তের মতো, ওলাং—এর সিঁথির সিঁদুরের মতো রাঙা লাল শাড়ি ডুবে গেল চিরদিনের জন্যে। সে শাড়ি আর কোনোদিন উঠবে না কোনো যুবতী এয়োতির তনু দেহে। লাবণ্যে লালিত্যে পূর্ণ হতে পারবে না।

বিন্দুর কথাটা কীজন্যে মনে আসে। তুমার চোখের ভুল গায়েন, চোখের ভুল তুমার। না বিন্দু। আপন চোখ আমার, নিজের চোখ।

ওলাং তাকে অবিশ্বাস করেছিল বিন্দুর জন্যে। কুটিলমনা মেয়েরা সংসারকে দেখে তার আপন মনের নিরিখে।

কিন্তু ছকুলাল কি সত্যি চিনেছিল ওলাংকে। স্টেশনে গাড়ি পৌঁছালো আকুল বিকুল খোঁজে সে। সেই ঘটনাটা স্মৃতির অন্ধকার থেকে তুলে এনে ঝেড়ে মুছে বর্তমান বুদ্ধির আলোয় বিচার করতে চায়। পাপ কি নিজের চোখে মানুষের?

কলকাতায় নিজের ব্যবস্থা সেরে একদিন সে আসবে বিনোদীয়া। ওলাং—এর সন্তানের মুখ পরখ করবে। আঃ যদি সত্যি সে—ছেলের মুখ তার নিজের মতো হয়। ওলাং—এর চরণ ধরে ক্ষমা চাইবে। নারীজাতি জননী জাতি।

কিন্তু যদি হয় অন্যরূপ…

এখন ভেবে লাভ কী। তবু সে আসবে একবার বিনোদীয়া। জানালার বাইরে তাকাল ছকুলাল। বিনোদীয়ার গেটের মুখে পরিচিত লোক খুঁজল। তারপর এগিয়ে চলে ট্রেন।

লাইনের ধারে কয়লা কুড়নো ঝুড়ি কাঁখে রেখে ময়লা শতচ্ছিন্ন কাপড় পরে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। ট্রেন তার কাছে পৌঁছল। মুখ ফেরাচ্ছে সে। ছকুলাল মাথাটা বের করে দেয়। তাকে পার হতে হতে সম্পূর্ণ মুখটা দেখে ফেলল সে। ওলাং! সেই ওলাং!

এত শুকিয়ে গেছে ওলাং! প্রেতিনীর মতো একটি মেয়ে জিজ্ঞাসু চোখে—ব্যাকুল অশ্রুবিহ্বল চোখে (নাকি সবই ছকুলালের কল্পনা) চেয়েছে তার পানে। ছকুলাল এইমাত্র দেখেছে তাকে। পলকে পার হয়ে এসেছে অতীত জীবনের একটি ছোট্ট কীটে কাটা ফুল। অথচ বুকের মধ্যিখানে আচমকা এক ঝাঁকুনি লেগেছে, যা এই গতিময় ধাতব আস্ফালন চেয়েও ভারী, নির্মম, অসহনীয় অনেকটা গিয়ে আবার মুখ ফিরিয়ে দেখল ছকুলাল।

সেই অর্ধনগ্ন শীর্ণ চেহারাটা এদিকপানে চেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রকাণ্ড কাঠের মতো। তার পিঠে একফালি অঙ্গারের চিহ্ন এতদিনে কতটুকু অবশিষ্ট আছে?

ভুল। সবই ভুলের উপর গড়ে ওঠা। বেঁচে থাকা আনন্দ পাওয়া সুখী হওয়া সবই ধাঁধার মতো। আর এই দুঃখ বেদনা অশান্তি। এই জীবনের সত্য। বাঁচতে হলে আরাম পেতে হলে সংসারের একটা—না—একটা চাবুক সইতেই হবে। সইতে না পারো মরে যাবে। কার অনির্দিষ্ট ইচ্ছার অনিয়ন্ত্রিত স্বেচ্ছাচারী বিধানের নীচে দাসখত দিয়ে জীবদেহ লাভ? কোনোদিন কি এ লাঞ্ছনা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না?

সন্ধ্যায় পৌঁছলো হাওড়া। লোকগুলো নেমেই এত ছুটছে কীজন্যে। বরাবরের মতো অবাক ছকুলাল। চুম্বকের টান টানছে কলকাতা। টেনেছে তাকেও। হেঁটে হেঁটে দুপাশের আলো ঝলমল ঐশ্বর্য আর কীর্তিগুলো গিলতে গিলতে চলে সে। কলকাতায় এসেছ। শুধু চোখে দেখো কদিন, কমাস ধরে তারপর কান পাতো। শোনো। বোঝো বিত্যেন্ত। আগে দেখ। এত দেখার আছে সংসারে। মানুষ এত শক্তিমান, অথচ….

যাকগে দুঃখুর কথা। ছকুলাল দেখতে দেখতে যায়।

গ্যাস কোম্পানির চিমনি। উঁচু পাঁচিল আর ব্রিজ থেকে ঢালু হয়ে আসা কালো পথটা চেনা তার। চেনা বাড়ির দরজায় প্রত্যাশী কণ্ঠে গলাটা ঝেড়ে নিয়ে ডাকে সে, কাজল। কাজলবালা!

একটু থেমে থাকে। পরিচিত একটি শিশুকণ্ঠ শুনতে পাবে বলে চুপ করে খানিক। তারপর ডাকে, কাজল, আমি তুমার বড় দাদা ছকু গো!

কোনো সাড়া নেই।

ও, ভুলে গিয়েছিল সে। কলকাতার দরজায় ডাকতে নেই। কড়া নাড়তে হয়। জোরে কড়া নাড়ে সে। একটি অপরিচিত মুখ উঁকি দেয়। কে? কাকে চায়?

ভড়কে যায় ছকুলাল। বলে, আজ্ঞে কাজলবালাকে।

—কে কাজলবালা?

—ই বাড়িতে থাকে বাছা।

—ও নামে কেউ এখানে থাকে না।

—থাকে না!

—না।

তবে কি…শরীরে প্রচণ্ড কম্পন। বলে ছকুলাল, খোঁজটা দিতে পারেন না এট্টু হুজুর?

দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। কাঁপতে কাঁপতে ফিরে আসে ছকুলাল। তবে কি কাজল যা লিখেছিল তাই করল? রতনকে নিয়ে এমন জায়গায় চলে গেছে, যেখানে সে কোনোদিনই পৌঁছতে পারবে না? কাজল, নিষ্ঠুরা কাজল, কীজন্যে চিরজীবন আমাকে এমন করে রাখিস?

পাশ দিয়ে একটা ট্যাক্সি ছুটে গেল। পেছনে লাল আলোটুকু যেন ছকুলালের মগজের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।

শরদিন্দুর রক্তে দোলা জেগেছিল একদিন। আজ তা বন্যধারার দুকুলপ্লাবী উচ্ছ্বাসে উদ্দাম।

শ্রীনিবাস এ কথাই বলে অন্যভাবে। দাদা অর্ধেন্দু বলে, সভ্যতার বিকেন্দ্রীকরণ একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। সুতরাং নাও টু স্টার্ট ফ্রম দি পয়েন্ট।

হার্ভেস্টার কম্বাইনের অবিশ্রান্ত গর্জনে সেই ভাবীযুগের শঙ্খনাদ। স্তূপীকৃত ফসল গুদামে ভরে তুলছে মজুরেরা। সব সময় ধরে শব্দের ভারে উতরোল ক্যাম্পে বিজয়ীর মতো ঘুরছে শরদিন্দু। মুকুন্দর বিষাদ পলকে উড়ে গেছে এই প্রখর কর্মের উত্তাপে। নীলকান্ত তার পাশেই ট্রাকটরে চেপে গভীর আগ্রহে লক্ষ্য করে চলেছে নিয়ন্ত্রণের খুঁটিনাটি যন্ত্র।

ট্রা…….রা…….রা…….রা……

মাটি কেঁপে উঠেছে চাকার নীচে। শরদিন্দু আরেকটা ট্রাকটরে বসে স্টীয়ারিং ঘুরিয়ে কী ভীষণ বেগে উঠে যাচ্ছে ক্যাম্পে। ব্রেক কষেছে একেবারে এদিকের গেটের মুখে গিয়ে। ডাকছে নীলকান্তকে হাত ইশারায়। নীলকান্ত ছুটে যায়।

ট্রাকটরটা ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে নামে শরদিন্দু। নিজের ঘরে গিয়ে ঢোকে।

—নায়েককে বলো, ব্রিজের ওপারে বড় অসুবিধে হচ্ছে। মাটি উঁচু হয়ে গেছে দুপাশে। এস্কেভেটারে আগে ওটা প্লেন করে দিক।

নীলকান্ত দৌড়ে ফিরে আসে মুকুন্দর কাছে। পথে পরখ করে যায় জায়গাটা। ভারী চাকার চাপে দুপাশে খাল হয়ে গেছে। নরম মাটি। মধ্যিটা উঁচু হয়ে আছে। ওটা কেটে খাল বুজিয়ে দিলে সব ঠিক।

—ও নায়েকদাদা!

নায়েক চোখ পাকায়। হোয়াট ম্যাটা? এই শীতেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

—উই পথটা পেলেন কত্তে বললেন সার।

—ডোজার লাগাও না।

—শিখিয়ে দিলেন না তো। নীলকান্ত বোকার মতো হাসে।

—অত সোজা নয় চাঁদ। মগজে কিছু খাঁটি মাল চাই। হাতের রিস্টে তাকত চাই। বুঝলে? এইসা এইসা চ্যাঙড় যখন উথলে উঠবে, স্টিয়ারিং বোঁ করে ঘুরলেই হেঁঃ হেঁঃ। পতন ও মূর্চ্ছা। বিচিত্র কায়দায় হাতের তালু উপুড় করে ভঙ্গি প্রদান করে মুকুন্দ।

তা বটে। লাঙল দেওয়ার সময় হ্যারোগুলোর আস্ফালন দেখে ভয় পেত নীলকান্ত। সামান্য লাঙলের ফলা। অথচ তেজটা কী। সুমুখে গাছ পেলে শেকড়সুদ্ধ উলটে দেয়।

ট্রাকটরের সুমুখে ছোট্ট এস্কেভেটরটা জুড়ে দেয় মুকুন্দ। বুনো শুয়োরের মতো পিছিয়ে যায়। তারপর লম্বা দাঁত উঁচিয়ে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে ছুটে গিয়ে মাটিতে সমান্তরালভাবে ঢুকে পড়ে। একরাশ নরম মাটি নিয়ে একটু পিছিয়ে আসে। আবার এগিয়ে কাত হয়ে ঢেলে দেয় গর্তে। নীলকান্ত ভয়ে চোখ বোজে।

টগর এলোকেশী নেই। মুকুন্দ কাজের মধ্যে ডুবে থেকে আরাম চায়। ঝাব্বু সিং গোডাউনের দরজায় দাঁড়িয়ে হুংকার ছাড়ে মজুরদের। হাসিম সেখ শরদিন্দুর ঘরের সুমুখে ফুল বাগিচার বেড়ায় ঠেস দিয়ে টুলে বসে রোদ্দুর পোহায়। নদেচাঁদের রান্না শেষ। গামছা ঘাড়ে অকারণ ছুটে বেড়াচ্ছে। ক্যাম্পের আকাশে নীলধূসর মেঘের আড়ালে সূর্যের মুখ। অনেক উঁচুতে চক্রাকারে উড়ছে একটা চিল।

গ্রামে যাওয়া শুরু করেছিল শরদিন্দু। সোনাডাঙা, সুঁদিপুর, রতনপুর, চৈতনগঞ্জ, পলাশ গাঁ অবধি। সাইকেলে। সঙ্গে শ্রীনিবাস। এলাকায় শ্রীনিবাসের খাতির দেখে অবাক হয়েছে সে। বউঝিরা ঘোমটার ফাঁকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। শরদিন্দু কো—অপারেটিভের কথা বলে। বলে বিক্ষিপ্ত টুকরো জমির চাষের ফলাফল। যন্ত্র সহযোগে কৃষি উন্নয়ন। আর বাতলে দেয় ফসলের শত্রুনিবারণ পন্থা। শুধু একারণেই ক্যাম্পের লোক যাতায়াতে বিরাম নেই। লেড আর্সেনেটের পুঁজি শেষ হয়ে যাচ্ছে দেখে হাসিম রেগে লাল। ওটা ওর ভারী প্রিয়। ফসলে ফুলের গাছে যেখানে পোকার অস্তিত্ব টের পাবে, হাসিম সযত্নে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে পরম তৃপ্তিতে ওষুধটা ছড়াবে। কৌটো কৌটো গ্যামাক্সিন নিঃশেষ। হাসির কথা, সেদিন কে এসেছিল সফট সোপ চাইতে। সারের জোরে কিংবা বেশি রসে গাছের পাতা কুঁকড়ে ছোট হতে থাকলে, ওটা জলে গুলে দিলে অনেক সময় উপকার পাওয়া যায়। বুঝিয়ে দিল শরদিন্দু। সফট সোপ মানে যে—কোনো গায়ে মাখা সাবান।

হাসিম ঝেড়ে দিল একচোট। বিল্লীর বাচ্চা, মাগের কাছে খুঁজগে যা।

কারা কাগজে সই দিয়ে ছোট্ট স্প্রেটা নিয়ে গেছে তিনদিন। কথামতো ফেরত দিয়ে যায়নি বলে, হাসিম তাদের গ্রামের লোককে যা একচোট নিল। শরদিন্দু না থামালে হয়তো কী হয়ে যেত। দিনে দিনে বড় মেজাজ চড়ছে হাসিমের। কথা বলে কম। চুপচাপ ঝিমোয় শুধু। ডাকলে বেজার। কী হয়েছে তার?

ওখানে বদলেছে নীলকান্ত। সপ্রতিভ তেজি ছোকরা এখন সে। অন্তত বাইরের লোকের সুমুখে। রসিকলাল ক্ষত্রিয়ের হাত থেকে স্টিয়ারিং কেড়ে নেবে সে। তারপর একসিলেটারে পা রেখে টপ গীয়ারে চালাবে তার লুণ্ঠিত জীবনের দামী ট্রাকখানা। (সর্বনাশী নেত্যবালা!) ক্রোধ উদগীরণ করে ফেলে নীলকান্ত। ও নায়েকদাদা, ইসব মেসিনের নীচে পড়লে কী অবস্তা হবে বল দিকিন?

—কী হবে তুমিই একটু বুঝে দেখ, ডার্লিং।

—হাড়গোড় ভাঙা দ হয়ে যাবে। না?

—পড়ে দেখ।

—উঃ চোখ বোজে নীলকান্ত। ভারী সাংঘাতিক জন্তি বটে নায়েকদাদা। তবু কেমন মানুষের বশ মানছে।

—বশ মানছে বলেই তোমার সারের….

থেমে যায় মুকুন্দ। হাবাটাকে কিছু বিশ্বাস নেই। শরদিন্দুর কান ভারী করবে।

বিকেলে এল ঝামেলা। হাসিম কাকে তুঁতে গুঁড়ো করে গাছের পাতায় ছড়াতে উপদেশ দিয়েছিল পোকা নিবারণের জন্য। সকালে বেচারার গাছগুলো সব পাতা পুড়ে শুকিয়ে সাবাড়। হাসিমের দাঁত বের করে উচ্চহাস্য। শরদিন্দু বিরক্ত হয়ে ওঠে সেই সময় এল শ্রীনিবাস। সঙ্গে একটি মেয়ে। শরীর কেমন পুরুষালি ঢঙের। কিন্তু মুখখানি ভারী মিষ্টি। উজ্জ্বলে কোমলে মেশা। শরদিন্দুর বিরক্তি ঘুচে ভালো লাগল দৃশ্যটা। ভালো লাগল যুবতী মেয়ে বলে নয়। ক্যাম্পে আসবে, সব বুঝতে জানতে চাইবে, এ সাধ তার কত গভীর। বিদেশে যেমন দেখেছিল সে।

শ্রীনিবাস পরিচয় করিয়ে দেয়। শ্রীমতী বিন্দুবাসিনী বাগদিনী। নিবাস সাকিম সুঁদিপুর। তারপর দুরূহ ভাষায় গুণাবলীর বর্ণনা করে চলে খানিক। শোনায় ছকুলালের ঘটনা।

বিন্দু সলজ্জ হাসে নতমুখে। শরদিন্দু কাহিনী শুনে অবাক;

আড়ালে ডেকে নিয়ে যায় শ্রীনিবাস। বলে মেয়েটির আগমনের হেতু। উল্লাস মামলা মিটিয়ে নেবে। মেয়েটির সঙ্গে একটু ইয়ে আছে ইত্যাদি।

শরদিন্দু বুঝতে না পারে ব্যাপারটা।

—ট্রিকস স্যার। সিম্পলি মাই ট্রিকস। সহজে কী রাজী হয় উল্লাস? বলে, ঘোষকাকা অর্থাৎ নাডু ঘোষ বেঁকে যাবে। আমি বললাম, দ্যাখ বাবা উল্লেস, এই পাঁচ সাত খানা গ্রামের মধ্যে তুই একটা বীর পালোয়ান। তুই একবার লাঠি ধরলে একশোজনের মাথা ঘিরবি। তোর আবার ভয়। তাতে আমি আছি। আপনার নাম করে বললাম সায়েব আছেন, ভাবনাটা কী।

শরদিন্দু উৎসাহিত হয়।

—তা’, সহজে ঘাড় কাত করে না। গয়লার পো। ষাট বছরের নাবালক। তখন ধরলাম ইনিকো। দিস বিউটিফুল লেডি। ভেরি বিলাভেড ডার্লিং অফ দ্যাট ঘোষ। ভালো করে বুঝিয়ে দিতেই লেডি বলে, চলো আম্মো যাই সায়েবের কাছে। বুঝে আসি।

মেয়েটির স্বার্থ কী? শরদিন্দু সিরিয়াস হয়।

—শী ইজ ভেরি এ্যাংসাস ফর উল্লাস। ঐ যে প্রতিজ্ঞা না কী করেছিল, সেই ব্যাপারে। নাও শী ওয়ান্টস দ্যাট যদি এসব চুকেবুকে যায়, তাহলে শী উইল গেট হিম উইদাউট এনি বদারেশন। মানে, নির্বিঘ্নে কাটবে দিনগুলো। পীসফুল হনিমুন বলতে পারেন। রসিয়ে রসিয়ে হাসে শ্রীনিবাস। আবার বলে, তাছাড়া ওদের দাম্পত্য জীবনে, সরি, ভুল বল্লাম, ইয়ে জীবনে ওসব একটা মারাত্মক ব্যারিকেড তো। মনে উদ্বেগ নিয়ে কোনো লাভ ম্যাটারই জমে না হাঃ হাঃ হাঃ।

শরদিন্দুও গলা মিলিয়ে হাসে।

বিন্দু দূরে দাঁড়িয়ে হার্ভেস্টারগুলোর কার্যকলাপ লক্ষ্য করে। মধ্যে মধ্যে কানে হাত চেপে রাখে। ফুলগুলো বেড়ার ভেতর হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করে। বেড়ার চারপাশে ঘুরে ফিরে দেখে। ঝাব্বু সিং লোলুপ দৃষ্টে চেয়ে আছে। এত সুঠাম দেহবল্লরী কোনো মেয়েরই সে দেখেনি। ক্যাম্পের নিরানন্দ জীবনে (বিন্দুর সিঁথি লক্ষ্য করে সিন্দূর দেখল না সে।) আবার বুঝি কোনো নয়া জমানা আবির্ভূত হচ্ছে এবার। ঝাব্বু সিং আশান্বিত।

কাছে আসে শরদিন্দু। বলে, দাঁড়িয়ে কেন তুমি? বসো বেঞ্চে। নদেচাঁদ, বেঞ্চটা দিয়ে যাও। মাটিতে বসে বিন্দু। অত সুন্দর উজ্জ্বল চোখের দিকে চাইতে পারে না। শরদিন্দু যেন মর্তের দেবতা। মাটিতে চোখ রেখে বলে, আপনার কাছে এলাম সায়েববাবু।

শরবিন্দু বলে, শুনেছি সব। ঠিক আছে। আমিও যাব না হয় একদিন। উল্লাসকে সব বুঝিয়ে বলব।

বিন্দু মৃদুকণ্ঠে বলে, আপনি সেদিন দয়া করে ওকে সেবাশুশ্রূষা না করে পাঠালে উ বাঁচতো না সায়েববাবু।

শরদিন্দু হাসে। ভুল যখন হয়ে গেছে একটা, শোধরানো দরকার তো। যাক, তুমি ওকে বুঝিয়ে বলো। তোমাকেই ভার দিচ্ছি আমি। বলো ক্ষতিপূরণ—টাকাপয়সা বা যা কিছু চায় আমি দিতে রাজি আছি।

বিন্দু বলে, লোকটা খুবই সাদাসিদে হুজুর। কু’লোকের পরামর্শে পড়ে এই দশা। তবে দোষও আছে। লাঠিহাতে মাঠে নামলে দিকদিশে বাছে না। ওই এক বদ অব্যেস।

শরদিন্দু শ্রীনিবসাকে বলে, হাউ ফানী। শী ইজ প্রেজেন্টিং হারসেলফ অ্যাজ হিজ লিগ্যাল ওয়াইফ।

—ইয়েস স্যার। আমি ভাইটাল পয়েন্ট ছাড়া হাত দিইনে।

বিন্দু বলে, তা স্যাক ভাই কাজটা বড় ভালো কল্লে না। মাছমারা করে বিঁধলে মানুষটাকে।

বিন্দুর কথা শুনেছে হাসিম। এগোয় হাসতে হাসতে। দোষ আমারও কিছু একা নয় বাপধোন, আঁতুরে না বিঁধলে আমাকেই সাপমারা করত ঠেঙিয়ে। তা থাক গে। যা হয়েছে, হয়েছে। এক কোশ পথ নাক ঘসলেও শোধ হবে না। তুমি আমার হয়ে বলে উল্লেসকে, উর হাতে ধরে মাপ লিয়ে দোস্তালি পাতাবো। মরদ মরদের সঙ্গেই কুটুম পাতায়। তুমি বলো গো বাছা, হাজার হোক হেঁদু মোছলমান দ্যাশের ভাই। রাত পোহলে চোখে চোখে পড়বে আর ইটা জানিয়ে দিয়ো, হাসিম স্যাক যাকে কথা দেবে, তাকে জাত দেবে। বুঝেছ?

নিষ্পলক চেয়ে আছে বিন্দু হাসিমের মুখের দিকে। মুখ টিপে হাসল শ্রীনিবাস।

ওরা চলে গেলে হাসিমের কথা ভাবছিল শরদিন্দু। মানুষ এত ভালো? না, সবই শ্রীনিবাসের চতুর কৌশলে জিয়ানো সাময়িকভাবে বেঁচে ওঠা মানবিকতার শিথিল বিবশ চারাটা?

শ্রীনিবাসের সঙ্গে ফিরে গেল বিন্দু। শ্রীনিবাস সারা পথ অনেক বকবক করেছে। অনেক অস্পষ্ট ইঙ্গিত তুলে ধরেছে তার আর উল্লাসের সম্পর্কে বানানো মধুর ভবিষ্যতের। বিন্দু শুধু শুনেছে। কথা বলেনি। কেউ টের পাবে বলে নদীর আগেই দুজনা আলাদা পথ ধরল। তখন সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এসেছে।

অলক সুখেশ্বরীর বাড়ি থাকার কথা। তাই ওখানে ঢুকল বিন্দু। সুখেশ্বরী লম্ফ জ্বেলে দিয়েছে।

অলক আপন পড়ার নেশায় বিভোর। বিন্দু পিঠে হাত রাখল।

—তুমাকে উল্লেস খুঁজছিল মা।

যুগপত চমক আর লজ্জা মনে। বিন্দু বলে, চল। বাড়ি গিয়ে পড়বি।

অলক জমে গিয়েছে আপন বই নিয়ে। উঠতে ভালো লাগে না। বলে, তুমি যাও। কাকির কাছে থাকব আমি।

মৃদু হাসে বিন্দু। মোন চাইলে থাক বাবা।

সুখেশ্বরী পেছন পেছন আসে। ফিসফিস করে বলে, আবার উ পাপের সঙ্গে কেনে মিশছো দিদি?

—কে রে?

—উই উল্লেস।

—কখন মিশলাম? অবাক হয় বিন্দু। সেই হাসপাতাল থেকে এসে আর উল্লাসকে দেখেনি সে। উল্লাসও আসেনি। আজ ক্যাম্প থেকে ফিরে তার যাবার ইচ্ছে ছিল উল্লাসের কাছে। মামলা তুলে নেওয়ার কথা বুঝিয়ে বলতে।

—তুমি যাওয়ার পরই এসে খুঁজেছিল। আমি বলতাম না তুমার সন্ধান। কিন্তুক উই যে নামুনেটা, বুদ্ধিজ্ঞেনহীন এক পাপিষ্টি আমার ঘাড়ে বসেছে, বলে দিলে। আমি অবশ্যি উল্লেসকে দুটো ভালোরকম বচন দিইছি গো! নজ্জার ঘাটে মুখ ধোয়নি কিনা!

কপট ক্রোধে বলে বিন্দু, ভালো করেছিস। দুষ্টু লোক। ঘরে যদি আগুন দেয়, আর ছাইতে পারবি পোড়ামুখী।

সুখেশ্বরী সত্যি সত্যি ভয় পায়। কী হবে দিদি তাহলে?

—হাতে পায়ে ধরগে যা। বেরিয়ে যায় বিন্দু।

সুখেশ্বরী ছুটে সঙ্গ নেয়। তুই এট্টু বুঝিয়ে বলিস দিদি। তুর কথা আখবে।

—যা আটকুঁড়ি সতীন মাগি। খিল খিল করে হেসে উঠে ওর পিঠে এক থাপ্পড় কসে দেয় বিন্দু। সুখেশ্বরী আশ্বস্ত হয়ে অলকের কাছে বসে পড়ে। ছবিওলা পাতায় চোখ রাখে। অলকের পড়ার নেশা কেটে যাচ্ছে বুঝি। বলে, ও কাকি, একটা গল্প বলবি?

—আমি গল্প জানি নে বাবা। তুই একটা বল না। এত বই, কেমন সোন্দর ছবি। উই গল্প বল একটা শুনি।

অলক গল্প পড়ে। বাদশাহ শেরশাহের বাঘমারা গল্প। সুখেশ্বরী মাথা নাড়ে।

—ঠিক, ঠিক। মোছলমানের জাতটাই অমনি ধারা বাছা। দ্যাখ না, উল্লেসকে কীভাবে কোমর শ্যাকের পো মাছবেঁধা কল্লে। আহা!

আচমকা বিন্দুর বাড়ি থেকে চিৎকার আর কান্নার শব্দ। দৌড়ে চলে যায় সুখেশ্বরী। উঠোনে দাঁড়িয়ে নাডু ঘোষ ফোকলা দাঁতে কীসব বলছে যা নিশ্চিতরূপে শ্রুতিসুখ আনে না আর বিন্দুর মুখে খিস্তির ঝাল। লোক জমে গেছে দস্তুরমতো। কে একজন নাডু ঘোষকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। বিন্দু হাতে (এতক্ষণে দেখতে পায় সুখেশ্বরী) একখানা চেলা কাঠ। বিন্দু হাঁপাচ্ছে ক্রোধে চোখমুখ বিস্ফারিত করে।

বুঝতে পারে না সুখেশ্বরী। বিন্দুকে গিয়ে ধাক্কা দেয়। কী হল দিদি, ঝগড়া কেনে?

ফেটে পড়ে বিন্দু। উই নামুনে গয়লা আমাকে এসে শাসায়। এত বড়ো উর শক্তি। মাথাটা টেলিয়ে দিতাম কেউ না ধল্লে।

—কেনে গো?

—আমি মামলা মেটাতে কেম্পে যেইছিলাম। উই রাগে। লিমেগে সব্বনেশে দাঁতভাঙা যখ। এতকাল পরের সব্বোনাশ করে আমার পেছনে লেগেছে।

—তুকে মাত্তে এসেছিল দিদি?

—হ্যাঁরে, সাওসটা কী দ্যাখ!

এবার সুখেশ্বরীর অশ্লীল চিৎকার গাব গাছ থেকে একটা পেঁচা প্রাণভয়ে বুঝি পালিয়ে গেল। কোমরে কাপড় জড়িয়ে উঠোনময় তার ছুটোছুটি। বিন্দুর মতোই চেলা কাঠ খুঁজে বেড়ায়। পটলা পৌঁছেছে ততক্ষণে। টানতে টানতে নিয়ে যায়। অলক নির্বিকারচিত্তে তখনও বসে বসে বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছে।

বিন্দু দাওয়ায় বসে পড়ে ধপ করে। খুঁটিতে শরীর এলিয়ে দেয়। সেই সময় উঠোনে দীর্ঘ শরীর কার। চমকে উঠে বিন্দু, কে?

—আমি।

—উল্লেস?

উল্লাস! আশ্চর্য, যাকে সে মন থেকে মুছে অবিশ্রান্ত চেষ্টা করে চলেছে, তারই মঙ্গলের জন্যে সে ক্যাম্পে গিয়েছিল। শ্রীনিবাসের পরামর্শ ভারী ভালো মনে হয়েছিল। আর তার সঙ্গে গিয়েছিল এই ভেবে যে উল্লাস কি তার কথা অমান্যি করতে পারে কখনো? উল্লাস—যার কাছে একদিন জীবন যৌবন সঁপে দিয়েছিল তার এ মঙ্গলটুকু করার কী আকুল সাধ! মঙ্গল। কেননা সে যা বুঝেছে শুনেছে, মামলায় উল্লাসের হার সুনিশ্চিত। বরং খেসারতি দিতে হবে হয়তো। সব সাক্ষীই শ্রীনিবাসের দলে ভিড়েছে ক্রমে ক্রমে। হাসনাবাদের খোয়াড়ওলা আবার স্বয়ং সোনাডাঙায় ইনতাজের মামাতো ভাই। হাসিমেরও কুটুম্ব। এ অবস্থায় আগে থেকে মিটিয়ে নিলে কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ সায়েব বাবুই দিতে রাজি একথা জানিয়েছিল শ্রীনিবাস। ভারী ভালো কথা। ফিরে এসে সে উল্লাসকে বলতো, এবার বিয়ে করো, ঘর গেরস্থালি পেতে সুখে দিন কাটাও। ক্ষতিপূরণের টাকায় তুমার বিয়ে—সংসার রাজ্যিপাট সব হয়ে যাবে উল্লেস। ঠিক এই শব্দগুলোই বলত সে। উল্লাস শুনত। খুশি হত, মানত। আর সেই উল্লাস তাকে খুঁজে গেছে শুনে বড়ো আশান্বিতা হয়ে সুখেশ্বরীর বাড়ি থেকে পা বাড়িয়েছিল বিন্দু।

উল্লাস ধীরে ধীরে ডাকে, বিন্দু।

—বলো। বিন্দুর স্বর কাঁপছে।

—তুমি কেম্পে যেয়েছিলে?

—হ্যাঁ।

—কী জন্যে?

হঠাৎ উঠে আসে বিন্দু। আচমকা উল্লাসকে জড়িয়ে ধরে সেই হিম অন্ধকারে উঠোনে শিশির জমে ওঠা আকাশের নীচে ভেঙে পড়ে কান্নায়। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। উল্লাস অপ্রস্তুত যেন। একটু ঠেলে সরিয়ে দেয় তাকে।

—আমি তুমার মঙ্গলের জন্যেই যেয়েছিলাম উল্লাস। বিশ্বাস করো। উল্লাসের পায়ের কাছে বসে পড়ে বিন্দু। পায়ে উন্মত্তের মতো মাথা ঠুকতে থাকে। বিশ্বাস করো আমাকে, বিশ্বাস করো উল্লেস।

টেনে তোলে উল্লাস। ছিঃ বিন্দু, তুমি না সাহসিনী মেয়ে। কাঁদা তো শোভা পায় না।

—তুমি সেই উল্লেস তো? চোখ মুছতে মুছতে বলে বিন্দু।

—কেনে বিন্দু?

—সত্যি যদি হও, তবে আমার কথা আখবে না?

—কী কথা তুমার?

—মামলা মিটিয়ে ফেলো। ক্ষতিপূরণ যত টাকা লাগে, সায়েববাবু দেবে।

—মামলা তো আমি একা করিনি বিন্দু।

—তবু তুমি মূল। তুমাকে অমান্যি করার সাওস উল্লেস?

—শিনিবাস বলেছে ঈকথা?

—যেই বলুক। আমি জানি ইতে তুমার মঙ্গল হবে।

—সিকথা যাক। পষ্ট কথা কও বিন্দু।

—বলো।

—শিনিবাসের সঙ্গে তুমার এত ভাব কীজন্যে।

শিউরে ওঠে বিন্দু। কী ভেবেছ তুমি গো?

—ছেড়ে দাও আমার ভাবনার কথা। এখন বলো, উর সঙ্গে এত ভাব কেনে তুমার?

বিন্দুর মনে তরঙ্গ জমেছে। তা কান্না, ক্রোধ অথবা কী বুঝতে পারে না সে মুহূর্তে। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে। নিজেকে সামলে নেয়। তারপর পিছিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়ায়। তুমার কী মোনে হয় বলো আগে শুনি।

—আমি মিত্যুর কোল থেকে দ্যাশে ফিরলাম। একদিনও তুমি সাক্ষাৎ দিলে না। আর আমার বুকের উপর দে ঘনঘন উই শালা কলুর বাড়ি…

বাধা দেয় বিন্দু। তুমার কাছে যেতে তুমি তো বারণ করেছিলে।

—হ্যাঁ। আমি করেছিলাম। কিন্তু তুমার মোনটা কীরকম শুনি? কীসের টান তুমার আমার উপরে, বারণ না মেনে যেতে পারেনি একবারটি। তবে বুঝতাম তুমার ভালোবাসার দাম।

—তুমি আমার ভালোবাসার পুরুষ?

উল্লাস ঘেমে ওঠে যেন। কথা জোগায় না মুখে। অপমানে আড়ষ্ট হয়ে ওঠে। তারপর বলে, ও।

—জানলাম তুমার ভালোবাসা লয়, উটা বেবসা। রূপের বেবসা। যৈবনের দোকান খুলে বসেছ।

ফণা তোলে জলচরা সাপিনী। তুমি কি আমার হত্তাকত্তা বিধাতা—পুরুষ, না সাত পাকের জনম সঙ্গী?

—কে, কে তুমার বিধাতা পুরুষ? কি সিটা বলো? শুনি তুমার মুখে। উল্লাসও গর্জে ওঠে।

—যদি না বলি!

—বলতে ডর কেনে সাহসিনী মচ্ছকন্যে? সেই দ্যাশচরা গায়েনটা, না উই শিনিবাস, না সায়েনবাবু?

হু হু জ্বলে ওঠে আগুন। বিন্দুর প্রাণশিক্ষা যেন ইন্ধন পেয়ে মেতে উঠেছে। মিথ্যুক, ডানপিটে রাক্ষস। নজ্জা করে না তুমার, গায়েনকে মেরে বিলে ফেলে দিইছিলে।

—তুমিই তো বুকে বুক রক্তে রক্ত মিশিয়ে জেবন রক্ষে করেছিলেন। তখন বাঘিনীর মতো রক্তের স্বাদ ভারী মধু লেগেছিল বুঝি?

কী নিষ্ঠুর হিংস্র উল্লাস! তার শিঙ বাঁকানো দুরন্ত মহিষগুলোর মতোই। আবার কথা বলে সে। বিন্দু কানে হাত চেপে বসে পড়ে মাটিতে।

—সায়েববাবু কতোগুলান ট্যাকা দিছে মাসে? কখানা রঙচঙে শাড়ি বেলাউজ? কথা বলতে লজ্জা কী গো মচ্ছকন্যে?

আবার স্তব্ধতা। দোরের কাছে পাঁচিলে ঠেস দিয়ে লুকিয়ে শুনছে কারা। সুখেশ্বরী পটলও তাদের মধ্যে হয়তো। ভয়ে কেউ উঠোনে পা বাড়াতে সাহস পায় না।

একসময় উঠে দাঁড়ায় বিন্দু। উল্লেস!

জবাব দেয় না উল্লাস। বিন্দুর আঙিনায় এক নিশাচর বন্যতা যেন রূপ পেয়ে প্রতীক্ষায় আছে পা বাড়ানোর।

—তুমি চলে যাও ইখেন থেকে। তুমাকে আবার বড়ো ঘেন্না হয় উল্লাস।

—আমারও।

বুঝি এ কথাটা বলার জন্য তার এতক্ষণ অপেক্ষা করে থাকা।

দ্রুতবেগে বেরিয়ে যায় উল্লাস।

আর সেই অমানবিক জান্তব অন্ধকারে কচ্ছপের পিঠের মতো কঠোর অথচ পিচ্ছিল উঠোনের মাটিতে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে বিন্দুবাসিনী।

শীতাহত কোনো পাখি গাব গাছ থেকে ককিয়ে ওঠে।

পিঠে হাত রেখে অবরুদ্ধ আবেগে ভাবমন্থর কণ্ঠস্বরে সুখেশ্বরী এসে ডাকে, দিদি, ঘরে চলো।

—মা, তুমি কাঁদছো? লম্ফ হাতে অলক এল এতক্ষণে। বগলে বই রাখা ছোট্ট ব্যাগ।

ছেলেকে বুকে জড়িয়ে চুমু খায় বিন্দু। অলক বুঝতে না পেরে হেসে ওঠে। বিন্দু দেখল সে হাসি।

ম্লান দীপের আলোয় অকারণ অথচ সাবলীল স্বচ্ছন্দ ওই হাসি,……

অবিকল রতিকান্তের।

ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি বেশ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। চৈতাতলি উঠতে দেরি। একটু করে দক্ষিণের বাতাস বইতে শুরু হয়েছে। ফাঁকা ধানের জমিগুলোয় একবার কর্ষণ দরকার হয়েছিল। দুখানা ট্রাকটরে শরদিন্দু আর মুকুন্দ দুপুর অবধি অনেকটা চষে ফেলল। শরদিন্দুর কর্ষণ পদ্ধতি একেবারে নিজস্ব আবিষ্কার। বেশ সময় নিয়ে মাটির বুকে কর্ষণের যে ছবি আঁকে, তা রীতিমতো শিল্প। সেই সঙ্গে উর্বরতার অনুকূল পরিপ্রেক্ষিত সৃষ্টি হয়ে যায়। এ—কায়দা মুকুন্দর তত দুরন্ত হয়নি। তাই কর্ষণের সময় সারাক্ষণ শরদিন্দুকে তার কাছে থাকতে হয়।

শরদিন্দু ক্যাম্পে ফিরল। কে একটি মেয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। ট্রাকটরটা জমিতে দাঁড়িয়ে রইল প্রতীক্ষায়।

শ্যামবর্ণা স্থূলাঙ্গী মেয়ে। বয়সে যুবতী। চেহারায় বেশ একটা কমনীয়তা। কিছুটা যেন বিষাদও—যা অনুভব করা যায় খানিক চেয়ে থাকলে।

—কোত্থেকে আসছেন আপনি?

—মেয়েটি প্রণাম করে একটু হেঁট হয়ে। বলে, কলকাতা থেকে। আপনি আমাকে আসতে লিখেছিলেন।

—তুমিই কাজল? তাই বলো। এসো, এসো। শরদিন্দু ঘরে ঢোকে। বসো ওখানে।

—আড়ষ্ট হয়ে বসে পড়ে কাজল। বলে, আমি নিজে থেকেই আসতাম। কিন্তু ওঁর অসুখ বলে দেরি হয়ে গেল।

হাসিমুখে শুধোয় শরদিন্দু, কী অসুখ?

—ট্রেনের পাদানি থেকে পড়ে পায়ে ফ্যাকচার হয়েছিল। খুব ভুগলেন। এখনও হাসপাতালে।

—তাই নাকি!

—ডাক্তার বলছেন, পা—টা নাকি কেটে বাদ দিতে হবে।

—ভারী দুঃসংবাদ তবে। শরদিন্দু বিছানায় ফেলে রাখা কাগজগুলো সামলাতে ব্যস্ত হয়।

কাজল বলে, এই কাগজগুলো আপনাকে দেখাতে এনেছি।

বিস্মিত শরদিন্দু ঝুঁকে পড়ে।

* * * * * *

—হ্যাঁ। আমিই একমাত্র জানতুম। মায়ের কাছে শুনেছিলুম। তখন অল্প বয়স। কী করা যায় কোনো খেই পাইনি। তারপর রতনকে পেয়ে তার মানুষ হওয়ার আশা করছিলুম। দাদা তো ভবঘুরে বাউণ্ডুলে লোক। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চুপ করে কাজল।

—কিন্তু সম্পত্তি দেখলাম তোমার দাদার নামেই।

—হ্যাঁ। রাখহরি রাজা সেভাবেই দানপত্র করেছিলেন।

—এ সম্পত্তি তোমার দাদাকে দেওয়ার কারণ কিছু জানো?

খানিক নীরবতা। শাড়ির পাড়টা আঙুলে জড়ায় নতমুখী কাজল। তারপর বলে, না।

—কিছু না?

—আজ্ঞে না। জানলে বলতে আপত্তি কী বলুন। তবে মাকে খুব ভালোবাসতেন উনি। মার বিয়েও উনি দিয়েছিলেন।

—আর বাবাকেও উনি কুড়িয়ে পেয়েছিলেন কোন বানের বছর। বিলের কোন গাছে আটকে ছিল বাবা।

—সত্তর বিঘে জমি আছে তোমার দাদার নামে—অবশ্যি সেটলমেন্টে কিছু হয়েছে কিনা আমি জানিনে।

কাজল বলে, যদি হয়ে থাকে, আপনি কি প্রতিকার করতে পারেন না?

শরদিন্দু একটু চুপ করে থাকে। ভাবে। তারপর বলে, তোমার দাদার পাত্তা নেই। সংবাদ নিয়েছো?

—ভারী দুর্ভাবনায় আছি সেজন্য। কাজল দাদার কথা বলে ইনিয়ে বিনিয়ে। ছকুলালের কাছ থেকে রতনকে সরিয়ে রাখার জন্য রাতারাতি বাসা বদলানোর কথাটা শুধু গোপন রাখে।

একসময় কথা শেষ হয়। শরদিন্দু বলে, আমি আজই একবার শংকরীপ্রসাদের কাছে যাব। এ সম্পর্কে আরও কিছু জানার দরকার আমার।

একটু পরে চলে গেল কাজল। শরদিন্দু স্নানে বসল। চণ্ডালিকা পরগনার আকাশে কী বিসদৃশ নীলরঙের বন্যা আজ। মুখে খানিক জল নিয়ে ছুঁড়ে মারল সে আকাশ লক্ষ্য করে। নানা রঙের ছটা জলের উচ্ছ্বসিত কণিকায়। বলল শরদিন্দু, কোঅপারেটিভ পতাকা। এবার চণ্ডালিকার মাঠের এই আসন্ন ভবিষ্যৎ।

আচম্বিতে একটা তীক্ষ্ন আর্তনাদ। আর সঙ্গে সঙ্গে মুকুন্দর চিৎকার। যান্ত্রিক প্রমত্ত হুঙ্কার। মুখ ফিরিয়ে উঠে দাঁড়ায় শরদিন্দু। কোমরে তোয়ালে জড়ানো। ছুটে যায় খাল পেরিয়ে ব্রিজের উপর দিয়ে। খালের ওপারে তার ফেলে আসা ট্রাকটরটা উলটে পড়ে আছে। একপাশের একটা চাকা প্রচণ্ড বেগে ঘুরেই চলেছে।

পেছন দিকে জুড়ে দেওয়া হ্যারোর তল থেকে একটা ছিন্নবিছিন্ন রক্তাক্ত দেহ টেনে বের করছে মুকুন্দ নায়েক।

আনাড়িü হাতে দুঃসাহসী অধৈর্য নীলকান্ত ট্রাকটরে স্টার্ট দিয়েছিল। ধাক্কা খেয়ে ছিটকে চেনফ্রেমের উপর গড়িয়ে পড়ে যায়। তারপর একেবারে হ্যারোর সুমুখে।

ফাল্গুনের আকাশে নবমী চাঁদ।

মন্দগতি বাতাসে বিষণ্ণ উষ্ণতা। আলোছায়ায় মুখ লুকিয়ে রয়েছে চণ্ডালিকার মাঠ জনপদ বনানী। কোনো পাখির ডাক নেই আজ। বিল থেকে হাঁসেরা কবে পালিয়েছে। এখন চণ্ডালিকার আকাশে সোনালি জ্যোৎস্না ধূলিমলিন।

শরদিন্দু গেল শংকরীপ্রসাদের বাড়ি। অশোকগাছের কুটি কুটি ছায়ায় দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করল দেউড়ির ওপারে প্রাঙ্গণের সুরকি—ভরা পথের মধ্যিখানে পায়চারি করেছেন শংকরীপ্রসাদ। সঙ্গে বুঝি মৃন্ময়ী।

প্রস্তুত হয়ে নিল অভ্যাসমতো। আজ সারাদিন অনেক ঝড় বয়ে গেছে। পুলিশ তদন্ত, দেহ মর্গে পাঠানো থেকে শুরু করে নীলকান্তর বুড়ি মাকে শান্ত করা অবধি অনেক ঝামেলা। অবশ্যি শ্রীনিবাস খবর পেয়েই এসেছিল। কোনো অসুবিধে ঘটতে দেয়নি। মুকুন্দ জাব্বু সিং হাসিম সেখ সবে মিলে বিষণ্ণ মুখে বসে একই ঘটনা বারবার আলোচনা করছে। বিশ্লেষণ করছে অনেক রক্ত খেয়েছে এই স্পর্ধিতা রাক্ষসী মৃত্তিকা। ব্যানাবনের নিষ্ফল হাহাকারে বালিয়াড়ির ঘূর্ণাবর্ত তুলে মানুষ থেকে নিরিবিলি দূরে বসে তৃপ্তি পেতে চায় সে। তাকে কোনোভাবে তৃপ্ত করা যায় না কি? কিংবা যেন অসংখ্য মিথ্যা ও ফাঁকির স্তূপে বসানো এই কীর্তির আকাশচুম্বী সৌধের নীচে ইতিহাসের বিধান ফণা তুলে নড়ে উঠেছে এবার। অভ্যুদয়ের শুরুতেই বুঝি পতনের বার্তা ঘনিয়ে এল। তাই আকাশ থেকে মাটি অবধি এই জ্যোৎস্না কার কান্নার মতো মনে হয়।

যার কাছে নীলকান্ত কুনাই—এর ব্যর্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতা কীটের মৃত্যুর চেয়েও তুচ্ছ।

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল শরদিন্দু। তারপর একটু কেশে এগিয়ে গেল। স্বভাবমতো দেউড়ির কাছে মাথা তুলতে ভুলল না।

—কে। নান্তু?

—হ্যাঁ।

—এসো। মিনুমা, ফটিককে বলো দুখানা চেয়ার দিতে।

মিনু চলে যায়। ফটিক চেয়ার আনে। বসল দুজনে মুখোমুখি।

—তোমার ক্যাম্পের অ্যাক্সিডেন্টের খবর পেয়েছি। ভেরি স্যাড।

—হ্যাঁ। সেসব চুকিয়ে এলুম। কী ভেবে আবার বলে শরদিন্দু। পুলিশ বড্ড বিশ্রী ব্যাপার।

—তা ভালো করেছ। চারদিকে শত্রু। মৃদু হেসে ওঠেন শংকরীপ্রসাদ। বলে শরদিন্দু, ধানখাওয়ানো কেসটা সম্ভবত শেষ হয়ে যাচ্ছে।

—শুনেছি। বিন্দুর সাহায্যে। (শংকরীপ্রসাদ জেনেও তামাশা করেন।)

—না। বিন্দুর কথা ওরা শোনেনি।

একটু স্বর বদলায় শরদিন্দু। এখানে এলেই তার কূটনীতিক সাজতে ইচ্ছে করে।

—বিন্দু তোমার ওখানে যায় নাকি এখনও?

ভ্রূ কুঞ্চিত করে শরদিন্দু। বুঝলাম না।

—ওসব নিয়ে যায় নাকি, তাই বলছি।

হাসে শরদিন্দু। ও। না, উল্লাসের সঙ্গে ওর রীতিমতো বিবাদ।

—তাই নাকি? একটু সহজ করে তোলেন পরিবেশ। বলেন, ওসব রাজনৈতিক কথা থাক। বরং দুটো গল্প বলো বিলেতের। আরাম করে শোনা যাক।

—আমি আপনার কাছে এবার অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছি।

উৎকণ্ঠ হাসেন শংকরীপ্রসাদ। কোঅপারেটিভ ছাড়া আর কী প্রসঙ্গ থাকতে পারে তোমার?

—হয়তো তাই। কিন্তু এবার বলব একটু অন্যভাবে।

—বলো।

—আপনি ছকুলাল কুনাইকে চেনেন?

আবছা জ্যোৎস্নায় শংকরীপ্রসাদকে কেমন কাঁপতে দেখা যায়। কেন নান্তু?

—তার জমির দলিল আমার হাতে।

—কে দিয়েছে? একটা প্রেতের কণ্ঠ থেকে দীর্ণ স্বর।

—কাজল। শরদিন্দু বলে।

মুখে ছায়া পড়েছে তাই শংকরীপ্রসাদের মুখভাব টের পাওয়া যায় না।

মৃন্ময়ী এল চা হাতে। একেবারে সিরিয়স টক চলছে দেখি।

শরদিন্দু মৃদু হাসে।

শংকরীপ্রসাদ বলেন, তুই বরং খেয়ে নে মা। আমার শরীর ভালো নেই।

মৃন্ময়ী চলে যায়। শরদিন্দু তাকাতে পারে না সেদিকে।

—নান্তু!

—বলুন!

—আমি মানে আমার পারিবারিক মর্যাদা বিপন্ন।

—কার হাতে?

—তোমার।

—আমি চেষ্টা করবো, যাতে তা না হয়। এবার আপনি শুধু গয়জদ্দি আর ইনতাজকে…

—কেন, ভয়ে?

—আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন?

—তারা কেউ আমার কথা শুনবে না। জমি তাদের রক্তমাংসের চেয়েও পবিত্র।

—আপনি কি আমাকে একটুও সাহায্য করবেন না?

—আমাকে রেহাই দিতে পারো না নান্তু?

—আই আন্ডারস্ট্যান্ড। উঠে দাঁড়ায় শরদিন্দু।

—কী বুঝেছ তুমি?

—আপনি ভাবছেন আমাকে সাহায্য করলে পরে ইলেকশানে….

—কীসের ইলেকশান?

—আপনি সামনে অ্যাসেমব্রি ইলেকশানে দাঁড়াচ্ছেন, তাই।

—কে বলেছে একথা? শ্রীনিবাস?

—আমি শুনেছি।

শংকরীপ্রসাদ এতক্ষণে উঠে দাঁড়ান। হঠাৎ গর্জে ওঠেন, মিথ্যে, একেবারে মিথ্যে! কী ভেবেছে আমাকে এরা, এই চণ্ডালিকা পরগনার লোকেরা? মিথ্যাবাদী, প্রতারক, জোচ্চোর!

শরদিন্দু লুকিয়ে হাসে। সম্রাট শংকরীপ্রসাদ। হরিবল।

—তাই তুমি আমাকে শাসাতে এসেছ নান্তু? তাই তুমি আমাকে দিয়ে তোমার কাজ করিয়ে নিতে চাও? আমাকে তুমি ভয় দেখাচ্ছ, এমন হয়ে গেছ তুমি নান্তু!

মৃন্ময়ী এসে ধরে ফেলে বাবাকে।

কোমর জড়িয়ে ধরে টেনে নিয়ে যায়। শরদিন্দু এখানে দাঁড়িয়ে শোনে শ্বাসক্লিষ্ট বাস্তুসাপের কণ্ঠস্বর। আর এদেশে থাকবো না মা। এদের কিন্তু বিশ্বাস নেই। এরা সব করতে পারে।

শরদিন্দু বেরিয়ে আসছিল। হঠাৎ পেছনে স্নিগ্ধ কণ্ঠের আহ্বান। পরিচিত স্বর। নান্তু!

—বলুন!

—ভেতরে এসো। ত্রিলোচনা এগিয়ে আসছেন।

শরদিন্দু আমতা আমতা করে। আজ নয়। অন্য একদিন বরং…

—না, এসো।

আড়ষ্ট পায়ে ভেতরে যায় শরদিন্দু।

বেরুল যখন নবমীর চাঁদ অস্ত গেছে। একটা গুরুতর ভার হালকা হয়ে গেছে যেন পৃথিবী থেকে। কান্নার পর এখন শান্ত তন্দ্রার মায়ামুক্ত চরাচরে বুঝি শরদিন্দুর আত্মাও মুক্ত। এখন এই সময় বড় সম্ভাবনাময়। প্রশান্ত পরিচ্ছন্ন। তাই টর্চ জেলে এ অন্ধকারকে ভাঙতে ইচ্ছে নেই। ছকুলাল কুনাই রাজা রাখহরি রায়ের ঔরসজাত অবৈধ সন্তান। আমোদিনীর গর্ভে সে জন্ম নেবার পর উদ্বিগ্ন বৃদ্ধ জমিদার রাতারাতি স্বয়ম্ভর করে বিয়ে দিয়েছিলেন। নাথুলালের সঙ্গে আমোদিনীর প্রণয় ছিল। অথচ সবটুকু জানত বলে নাথুলাল বিয়েতে রাজি ছিল না একেবারে। তাই স্বয়ম্বরের ব্যবস্থা। আর তার আগে এ সম্পত্তি আমোদিনীর গর্ভজাত প্রথম সন্তান যদি বেঁচে থাকে, সে পাবে, এই শর্তে দানপত্র করে দিয়েছিলেন। শংকরীপ্রসাদ তখন বয়সে কিশোর। কিন্তু বড় হবার সঙ্গে সঙ্গেই এটা টের পান। নীলরক্তের চিরকেলে রহস্য।

অশোক গাছের নীচে কে যেন দাঁড়িয়ে। টর্চ না জ্বেলেই এগিয়ে যায় শরদিন্দু। মিনু?

—হ্যাঁ।

—একা এখানে কী করছ! এখনও ঘুমোও নি?

—আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি নান্তুদা।

—কেন?

—আমার কি কোনো কথা থাকতে পারে না?

—পারে। কিন্তু এভাবে?

—সব কথা সবসময় বলা যায় না নান্তুদা।

—বলো তোমার কথা।

খানিক স্তব্ধতা। অশোকগাছের ডালে পাখির স্বর। মৃন্ময়ী কথা বলে। কথা বলে যেন অনেক দূর থেকে এক উদাস বিষাদাতুর অতীত সময়, যা নদীর উজানে অতলের জমে থাকা শৈবালপিচ্ছিল উপলখণ্ডের মতো, এতদূরে স্রোতোবেগ তাদের টেনে আনতে পারেনি, ছুঁয়ে এসেছে শুধু, এখন স্রোতের বুকে তার গন্ধ টের পাওয়া যাচ্ছে গভীরভাবে নিবিড়ভাবে মুখ রেখে।

—তুমি কী বলতে চাও মিনু? শরদিন্দু আবার বলে।

—আপনি চণ্ডালিকা ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে পারেন না? আপনাকে কে না মর্যাদা দিয়ে তুলে নেবে নান্তুদা!

মিনুর কণ্ঠস্বরে কথায় একটা সোজাসুজি আদেশের তীব্রতা যেন। জমিদার কন্যার কণ্ঠস্বর।

এইবার এতক্ষণে ফিরে এল বর্তমান সময়ের শরদিন্দু, জনগণের ডিক্টেটর শরদিন্দু। টর্চ জ্বালাল অকারণ একঝলক। একঝলক আলোয় তার ক্রুদ্ধ আহত মুখ। হৃদয়ের মসৃণ আবরণে জমল বুদ্ধির দুর্নিবার কুয়াশা। এ শরদিন্দু রহস্যময়। বিন্দুর চোখে দেখা নিষ্পাপ দেবশিশু নয় সে।

—কেন? তাতে তোমার লাভ হবে কিছু মিনু?

—হয়তো হবে কিংবা হবে না। কিন্তু বাবার হবে। আমার বড্ড ভয় নান্তুদা, উনি কখন ঝোঁকের মুখে আত্মহত্যা না করে বসেন।

—নাস্তিকরা আত্মহত্যা করে না মিনু। কেননা জীবনমৃত্যুর পার্থক্য তারা ভালো বোঝে।

—নান্তুদা!

—তোমার প্রস্তাবটা অত্যন্ত হাস্যকর মিনু। আমি দুঃখিত।

—আপনি কি লোকাল কাগজগুলো পড়েন না?

—পড়েছি। (শরদিন্দু জানে এসব শ্রীনিবাস আর অর্ধেন্দুর কীর্তি।)

—এরপরও একথা হাস্যকর বলেন?

—তোমার বাবা তো চলে যাবেন বলছেন দেশ ছেড়ে?

—আমি যে এ গ্রাম ছেড়ে কোথাও থাকতে পারিনে।

—সব সয়ে যাবে একসময়।

—এত নিষ্ঠুর হয়ে গেছেন নান্তুদা।

—কেন, তোমার বিয়ের পথে বড় বাধার সৃষ্টি হয়ে গেছে বলে?

—নান্তুদা! মৃন্ময়ী গাছে হেলান দেয়। ভেঙে পড়ল বুঝি। শরদিন্দু ওকে ধরে ফেলে দুহাতে। শরীরে অজানা অনুভূতি।

—ছিঃ মিনু!

অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মিনু বলে, আমার বড় বিশ্বাস ছিল নান্তুদা। হয়তো আমার কথা রাখবেন।

—হয়তো মেয়েদের ওটা বিশেষ বয়সের বিশ্বাস।

—আমারও কি সেই বিশ্বাস? এ ধারণা কী করে সম্ভব হল আপনার? আমাকে আপনি সেই চোখে দেখেন নান্তুদা?

আস্তে আস্তে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে চলে যায় মৃন্ময়ী। কিছুক্ষণ ওর গন্তব্য পথের দিকে চেয়ে থাকে শরদিন্দু। তারপর এতক্ষণ ধরে ঘটতে থাকা ঘটনার আকস্মিকতাটা এতক্ষণে টের পায়। বিমূঢ় হয়ে ওঠে। বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। যেন জীবনের কেন্দ্র অবধি নড়ে যাচ্ছে। সংযত করা যায় না। নিয়ন্ত্রণের অতীত সে কম্পন।

দ্রুত এগিয়ে যায় শরদিন্দু। একখানি পরিচ্ছন্ন, শয্যা নরম উপাধান সবচেয়ে তার লক্ষ্যবস্তু এখন। ক’পা গিয়েই আচমকা শ্রীনিবাসের মূর্তি যেন মাটি ফুঁড়ে ওঠে সুমুখে।

—আপনি;

হাসে শ্রীনিবাস। আমি সর্বচর। আপনার জন্যে অপেক্ষা করে বসে থেকে থেকে বাড়ির পথে পা বাড়াচ্ছিলাম স্যার। হঠাৎ কী মনে হল, ওখানে একা এত রাত্তির অবধি কী করছেন! কোনো হাঙ্গামা হল নাকি! যদিও আপন গ্রাম, কিন্তু সকলেই বিরুদ্ধ পক্ষ কিনা, তাই ভয়। চাই চলে এলাম সন্ধান নিতে।

স্মরণ হয় শরদিন্দুর। তাই তো! বেচারাকে বসিয়ে রেখে এসেছে এক্ষুনি ফিরছি বলে। ফিরে সব জানানোর কথা ছিল। ভেরি সরি। দুঃখ প্রকাশ করে শরদিন্দু। আগে আগে চলে। এক অজানা অনুভূতির রোমাঞ্চ ঝড় তুলেছে তার সমগ্র অস্তিত্বে। মুখর হয়ে উঠেছে প্রতিটি দেহকোষ এক অনাস্বাদিত মধুরতম স্পর্শের স্মৃতিব্যঞ্জনায়। আর সেই স্মৃতির সঙ্গে মেশানো হারানো দুর্লভ তার অতীতকাল!

বোশেখের রোদপোড়া আকাশ সাদা কাচের মতো দেখাচ্ছে। নীচে ধুলোর ঝড়। ঝাঁঝালো তীব্র জ্বালাময়। রাঢ়দেশের দিগন্তবিস্তৃত তরঙ্গিল শূন্য মাঠে রোদ কাঁপছে দূরে।

সেই সময় হেরে গেল নাড়ুঘোষের দল। উল্লাসের জবানবন্দির দিন পরপর তিনদিন পিছিয়ে উল্লাস গরহাজির। আর অর্ধেন্দু ঝিকটিপোতার রৌদ্রস্নাত আবহাওয়ার ছড়িয়ে স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোয় ভাড়াটে লেখক দিয়ে নানা ধরনের প্রবন্ধ খিস্তি খেউড় লিখিয়ে নিয়ে সরগরম করে তুলল মহকুমা। রাজা রাখহরির কীর্তি, শংকরীপ্রসাদের প্রতারণা, সব নিয়ে মেতে রইল কাগজওলারাও। জনগণ খবর চায়। চমকপ্রদ রোমহর্ষক খবর। তারা বাঁচিয়ে রেখেছে কাগজগুলো। তাই এসব হইচই হিড়িক। এক স্থানীয় নিরপেক্ষ’র আবির্ভাব ঘটেছে এতদিনে। শংকরীপ্রসাদ—দুহিতা মৃন্ময়ীর সঙ্গে শরদিন্দু (ম্যুনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানের কনিষ্ঠ ভ্রাতা, যিনি কৃষিবিদ্যায় বিদেশি ডিগ্রিধারী এবং চণ্ডালিকায় কৃষি ফার্ম খুলে অসাধ্য সাধন করেছেন) নিশীথাভিসারের এক পুলকপ্রদ একাঙ্কিকা রচিত হয়ে গেছে। অদ্ভুত রসঘন ব্যঞ্জনায় মধুরতম সংলাপে অনবদ্য সেই নাটিকা পড়ল স্কুল কলেজের ছেলেরা। অভিনীত হতে লাগল নিশ্চিন্ত অবসরে—ক্লাবে কমনরুমে আড্ডায়। শরদিন্দু—মৃন্ময়ী চণ্ডালিকার আকাশ থেকে ঝিকটিপোতার ঊর্ধ্বে নিক্ষিপ্ত হল সেই শিল্প—রটেটে। ওদের চোখে দেখে কী ফল, তার চেয়ে আনন্দ এই যে পটভূমিকা ও চরিত্র একান্ত বাস্তব। নায়ক নায়িকা দুজনেই এক এক দিকে গুণী। শরদিন্দু শিক্ষাদীক্ষায়, মৃন্ময়ী বিখ্যাত রাজপরিবারের ঐতিহ্যে।

সে নাটিকা পড়ল শরদিন্দু। পাঠিয়ে দিল মৃন্ময়ীকে লোক মারফত। আর সেইদিন চণ্ডালিকা আকাশে অশান্ত রোদ্দুর ভেদ করে নেমে এল একঝাঁক শকুন। বসল রায়দিঘির ভাগাড়ের কর্কশ নীরস তৃষিত মৃত্তিকায়। উনিশশো ছাপান্ন সাল। সতেরোই জুন।

মৃন্ময়ীকে কাগজ পাঠিয়ে দিয়ে গেল শরদিন্দু ঝিকটিপোঁতা। দাদার কাছে কৈফিয়ৎ নেবার জন্যে। একটা চরম কিছু হেস্তনেস্ত করতে। ওকে ট্রেনে তুলে দিয়ে ফিরে আসছিল হাসিম সেখ।

খরার দুপুরে জনমানবহীন প্রান্তর। স্টেশন থেকে চণ্ডালিকা ঢোকার একটু আগে পুরনো ধসে পড়া মন্দিরের পাশে একটা সেকেলে পুকুর। তরুতৃণহারী বিশুষ্ক পাড়। ঘুটিঙ আর রাশরাশ কাঁকরে রক্তাভ মাটির বুক বিচিত্রিত কারুকার্যের মতো মনে হয়।

সেই খানে দীর্ঘ লাঠি হাতে অতিকায় দানবের মতো হঠাৎ আবির্ভূত হল সুঁদিপুরের উল্লাস ঘোষ। পাড়ে শান্তশীতল ছায়ায় কেবল একটি মেয়ে হাত—পা ছড়িয়ে বসে আছে। সে এলোকেশী। টগরের সঙ্গে বিবাদ তার। তাই একা একা ঘোরে শুকনো ঘুঁটে আর কাঠ কুড়িয়ে।

—কথা বলোনা কেন স্যাকের পোয়া?

—বলো। তৈরি হয় হাসিম। হাতে মাত্র তিনফুট লম্বা হালকা একটা খেঁটে। উল্লাসের ওই লোহার পাতে বাঁধানো গিটতোলা লাঠির মৃদুতম আঘাতেই গুঁড়ো হয়ে যাবে। বন্দুক আর তাকে দেয় না শরদিন্দু। প্রয়োজন ফুরিয়েছে বলে। সাধারণ্যে মেশার পক্ষে বিশ্রী একটা মানসিক বাধা বলে।

—কলমা পড়ো স্যাকের ছা।

—তুমি মারবা আমাকে উল্লেস?

—না, তুমার কবজির জোরটা এট্টু পরখ করব। আঁতুরের ফলার জোর দেখেছি। এখন দেখবো লাঠির জোর।

—আমার লাঠি নাই। ইটা অচল। শান্ত স্বর হাসিমের। ভেতরে উষ্ণতা এই রোদ্দুরের চেয়ে ভয়াল।

—সিদিন আমারও এমনি অচল ছিল তুমার চেয়ে।

—সি অন্যায় আমি তুমার বেন্দুবাসিনীর কাছে স্বীকার করেছি উল্লেস। দোস্তালি পাতাব বলেছিলাম।

—উল্লেস তার সমজুটি ছাড়া মরদ স্বীকার করে না স্যাক।

—ইটা কি সমজুটির কথা হল রে ভাই? হাসিম মিষ্টি করে কথা বলে। তুমার লাঠির ওজন আমারটার চেয়ে শ’গুণ বেশি।

—তুমার জন্যে লাঠি আনতে যাই, তুমি অমনি দেলা বোঁ।

—তুমি ইখেনে দাঁড়াও উল্লেস। আমি মোছলমান বটে, কোরানের কিরে কচ্ছি, ওই রাজবংশী পাড়া থেকে এক্ষুনি লাঠি আনছি। যদি দুজনে সমান যাই, দোস্তালি পাতাব।

—কথা থো শালা ভাইসাহেব!

গর্জে ওঠে হাসিম। জাত তুলিসনে শালা ষাট বছরে নাবালক গয়লা!

প্রমত্ত গুরুভার পাহাড়ের টুকরো যেন ছিটকে পড়ে এসে। হাসিম লাঠি পাতে মাথা বাঁচিয়ে। ভেঙে যায় টুকরো টুকরো হয়ে। আবার পিছিয়ে যায় উল্লাস। লাফিয়ে এসে হুংকার দিয়ে পড়ে হাসিমের উপর। ‘বাপ’ বলে মাথায় হাত চেপে ধরে বসে পড়ে হাসিম। পরমুহূর্তে ঝোঁক সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। পালাবে ছুটে?

কিন্তু হাসিম সেখ—সোনাডাঙার দুর্ধর্ষ হাসিম সেখ। আপন রক্ত দেখে তার মনে জেগে উঠেছে আদিম সনাতম বন্য পিপাসা। দেহকোষের প্রান্তে প্রান্তে জমেছে অপমানের রুদ্র রোষ। আহত গণ্ডারের মতো ঘুরে দাঁড়ায় সে দুহাত তুলে। হাত তুলেই প্রতিহত করতে চায় উল্লাসের প্রচণ্ড আঘাত! আঙুল ভেঙে ছড়ে হাড় বেরিয়ে গেছে। তখন বাহু দিয়ে রুখতে চায়।

পিছিয়ে যায় উল্লাস। দম নেয় বুক ভরে। আবার ছুটে এসে হুংকার দিয়ে লাঠির বাড়ি মারে। বাতাস থেমে গেছে। নিস্তব্ধ হয়ে গেছে চরাচর। চেয়ে আছে শূন্য কঙ্কাল মাঠ। চণ্ডালিকা পরগনার প্রাচীন ইতিহাসের অবশিষ্ট দুই বন্য শক্তি আজ চরম সময়ের মুখোমুখি। তারপর সুমুখে শান্ত দিন। এরা দুটি লোককথার বীর নায়ক এরপর ফিরবে মানুষের মুখেমুখে। যেমন হয়ে এসেছে চিরদিন।

ব্যক্তিগত জিঘাংসার আর প্রতিশোধের আদিম অধ্যায় চণ্ডালিকা পরগনা থেকে এখানেই হয়তো শেষ হতে চলেছে।

খানিক পরে পুকুরে নামছিল উল্লাস। লাঠি আর শরীর থেকে রক্তের ছোপগুলো বুঝি ধুয়ে ফেলার ইচ্ছে। সেইসময় শুয়ে শুয়ে কোনরকমে একটু মাথা তুলল হাসিম। তখনও মরেনি। অতি কষ্টে উচ্চারণ করল, ও উল্লেস, পিতিশোধ আমিও লিবো।

ঘাড় বেঁকিয়ে শুনল উল্লাস। জলে নামতে গিয়ে নামল না। ছুটে এসে সর্বশেষ শক্তি দিয়ে লাঠির ডগায় হাসিমের মুখ লক্ষ্য করে আঘাত হানল। লক্ষ্যচ্যুত হয়ে লাগল ভ্রূর নীচে, নাক আর কপালের জোড়ে। উপড়ে গেল জায়গাটা। একঝলক মগজ আর রক্ত ছিটকে পড়ল চারপাশে। হাসিম একটু নড়ে উঠেই স্তব্ধ হয়ে গেল চিরদিনের মতো।

পশ্চিমে চণ্ডালিবাঁধা বিলের দিকে খরদাহনের মধ্যে দিয়ে টলতে টলতে এগিয়ে চলল উল্লাস।

চণ্ডালিকার লোক ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে এলোকেশীর ডাকে। কিন্তু সেই অতিকায় রক্তপাগল দানবের পেছনে গিয়ে তাকে ধরে ফেলার সাহস বা ক্ষমতা এ পরগনায় কারুর ছিল না।

অনেক, অনেক রাত তখন।

ঘরের দরজায় তালা এঁটে দাওয়ায় শুয়েছিল বিন্দুবাসিনী ছেলেকে পাশে নিয়ে। পাখাটা বুকের উপর পড়ে আছে। শিয়রে বসে চিবুকে হাত রেখে ডাকে উল্লাস, বিন্দু!

সময় হল নাকি! ধড়মড়িয়ে ওঠে বিন্দু। আজ চণ্ডালিবিলের জলায় মৎস্যজীবী সমবায়ের লোকেরা শেষ খেয়া দেবে। ভোরে দলবেঁধে যাবে সকলে। শুতে শুতেই আত্তির ফরসা? চুল বাঁধতে লাগল বিন্দু।

—বিন্দু!

চমকে ওঠে বিন্দু। কে?

—আমি উল্লেস।

পলকে স্বর কঠোর বিন্দুর। কী জন্যে, কী মতলব তুমার?

—শেষ দেখা কত্তে এলাম।

—কেনে? স্যাককে সেরে দিয়েছি আজ।

—ওম্মা, কী বলছো গো! তুমি কি পাগল হয়েছো উল্লেস?

—না বিন্দু। এই দ্যাখো কত রক্ত।

লাফিয়ে ওঠে বিন্দু। কী করেছ, তুমি উল্লেস, কী করেছ গো?

—বাবা যেয়েছে নিরুদ্দেশে ভেসে। আমি যাবো ফাঁসিকাঠে।

উল্লাসকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলতে থাকে বিন্দু, কেনে, কী দুঃখু তুমার উল্লেস? কী জন্যে তুমি অকালে পান বেসজ্জন দিবে গো। আমি তো চেয়েছিলাম, তুমি বিয়ে করো, ঘর গেরস্থালি পেতে সুখে জেবন কাটাও। কেনে তা মনে ধরেনি উল্লেস?

—কী জানি। রক্তের দোষ বিন্দু, তাছাড়া কী বলব। সংসার কী, কোনো দিন বুঝতাম না। তুমার সঙ্গে ভাব হল। বুঝলাম এট্টু এট্টু। নইলে ভাবতাম মানুষের জেবন শুধু রক্ত মাখতে। লাঠি আমার জেবনের সব থেকে অমূল্যধন ছিল বিন্দু, সবচেয়ে খাঁটি বলতে মানতাম ইটাকে। কিন্তু তুমি আমার নেশা কাটিয়ে দিইছিলে।

—কেনে তুমি তবে সহজ পথ ধরলে না? বিয়ে করে সংসার পাতলে না কীজন্যে?

—কী জানি বিন্দু! সি কথার জবাব কে দেবে বলো!

অলক ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরে শোয়। বিন্দু উঠে দরজা খোলে। টেনে নিয়ে যায় উল্লাসকে। উল্লাস ঘরে ঢুকে ধপ করে নগ্ন মেঝেয় শুয়ে পড়ে।

—আজ সারাদিন বিলের জঙ্গলে হেজল ডালে শুয়েছিলাম কখন নিশুতি আত্তির আসবে। দিনে এলে যদি পুলিশে ধরে, তুমার সঙ্গে দেখা হবে না।

বিন্দু কাছে এসে বসে। বুকে হাত রাখতে চায়। সরিয়ে দেয় উল্লাস।

—শেষ কালটায় আর ছলনা করো না বিন্দু।

—আমাকে তুমি কি বিশ্বাস করো না?

—মোন মানে না বিন্দু।

বিন্দু রুদ্ধশ্বাসে অপরিচ্ছন্ন অন্ধকার দেয়ালে ঠেস দিয়ে বলে, আমার জন্যে তোমার কি কোনো আশা ছিল উল্লেস?

—অনেক, অনেক ছিলো। তুমাকে জানতে দিইনি। তাই হাসপাতাল থেকে এসে তুমার খোঁজে যেইছিলাম। যেয়ে শুনি তুমি ক্যাম্পে যেয়েছ শিনিবাসের সঙ্গে।

—আমি তুমার মঙ্গল চেয়েছিলাম।

—তবে আমি তুমাকে ভুল বুঝলাম কেনে বিন্দু? কেনে এখনও তুমাকে বিশ্বাস কত্তে পাচ্ছিনে?

বাইরে ডাক। ও বিন্দুদি বেরোও তবে।

সাড়া দেয় বিন্দু। চলো চলো। এগোও। যেছি আমি।

ভাবতে বসল দুটি নরনারী। সম্ভবপর ভাবনা আর অভিজ্ঞতা দিয়ে জট ছাড়াতে চাইল মানুষের জীবনের। অকূল অথৈ পাতাল সমুদ্দুর শুধু। কোন ঝিনুকে মুক্তোটা লুকিয়ে আছে, কে বলে দেবে তাদের!

আর পূর্বাকাশে যখন স্নিগ্ধ রক্তিম উদয়রাগ, চরাচরে রূপালি লাবণ্য নেমেছে, ঝিকটিপোতার পুলিশের লাল শিরস্ত্রাণে বিন্দুর উঠোনে ফুল ফুটছে। শরদিন্দুও সঙ্গে ছিল তাদের।

গাবগাছের নীচে পত্রপল্লবের ঘন অন্ধকার ভেদ করে একটা তীক্ষ্ন আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ল পূর্বাশার উজ্জ্বল তোরণ দ্বারে। ওখান থেকে একটা কাক আর্তস্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে বাইরে উঠে গেল আকাশের নীল নিঃসীম মহাশূন্যে। যেন আর কোনোদিন ফিরে এসে বসবে না এই গাছে।

ক’মাস পরে। কদিন থেকে ঘনঘোর বর্ষা নেমেছিল। শরদিন্দু ঈষৎ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল। হঠাৎ এক রাতে ঘুম ভেঙে গেল তার। বাইরে বর্ষার শব্দে? লাফিয়ে উঠে বসল সে। এত জলের ঝাপটানি আসে কোত্থেকে। দরজা তো বন্ধ ছিল। জানালাও। ইটেবেড়ার দেয়ালের মাটি কি বৃষ্টির ছাঁটে গলে গিয়েছে।

সর্বনাশ! এত অন্ধকার কীজন্যে?

ওপাশে মুকুন্দ না কে চেঁচাচ্ছে ক্রমাগত। নদেচাঁদের ঘুম সহজে ভাঙে না। ঝাব্বু সিং বুঝি কী বলছে চেঁচিয়ে। তক্তপোশের নীচে পা বাড়ায় শরদিন্দু। তৎক্ষণাৎ আতঙ্কে কাঠ হয়ে যায়। একহাঁটু জল ঘরের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। বুকের স্পন্দন থেমে যায়। রক্ত জমে উঠেছে রুদ্ধ যন্ত্রণায়। লাফিয়ে নীচে নামে সে। অন্ধকারে অনুমান করে দরজাটা খুলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বিকট মুখব্যাদান করে এক উচছ´সিত জলধারা তাকে ঠেলে ধরে। ঠেলে নিয়ে এসে বিছানায় ফেলে দেয়। আবার উঠে দাঁড়িয়ে জল ঠেলে বেরাতে চায়, পারে না। দমকে দমকে জলের উচ্ছ্বাস। বাইরে কী হচ্ছে কিছু বোঝা যায় না। অবিশ্রাম জলকল্লোল বাতাসের শাঁ শাঁ ডাক এতক্ষণে স্পষ্টতম হয়ে ওঠে। চেতনায় চাবুকের মতো আছড়ে পড়ে।

কোনোরকমে বাইরে এসে এককোমর জলে দাঁড়িয়ে চেঁচায় শরদিন্দু, হাসিম!

আঃ কী ভুল। হাসিম সোনাডাঙার কবরখানার নীচে বুঝি উঠে বসেছে দেয়ালে ঠেস দিয়ে। শরদিন্দু চেঁচিয়ে ওঠে, ঝাব্বু সিং, নায়েক।

সাড়া আসে অস্পষ্টভাবে। এগুতে পারছিনে স্যার। নায়েকের কণ্ঠস্বর।

তীব্র স্রোত উচ্ছ্বসিত ঢেউ। বোঁ বোঁ করে ঘুরতে ঘুরতে ধেয়ে আসছে বন্যার জলধারা। আচম্বিতে আবার বেড়ে ওঠে হু হু বেগে। শরদিন্দুকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে ঘরের মাটি গলে যাওয়া উন্মোচিত বাঁশের বাতাস ঠেসে ধরে চাপ দেয়। ক্রুদ্ধ তরঙ্গের নীচে ডুবে গিয়ে একখানা বাঁশ আঁকড়ে ধরে শরদিন্দু। ঘূর্ণাবর্ত এসে ঘরখানার চারপাশে ঘুরে ঘুরে চাপ দিচ্ছে। আর কোনো জান্তব শব্দ নেই। ধরিত্রীর বুক ফেটে চৌচির হয়ে হঠাৎ যেন ভূমিকম্পের বেগে এই গর্জনমুখর প্রমত্ত জলরাশি শরদিন্দুর সবকিছু নিঃশেষ করে দিতে চায়।

ছকুলাল গায়েনের দলিল।

অতিকষ্টে সাঁতার কেটে ঘরে ঢোকে শরদিন্দু। টেবিলে রাখা কাগজপত্র আর সুটকেসটা হাতে নিয়ে আলনায় টাঙানো তোয়ালেতে জড়িয়ে বাঁধে। বেরিয়ে আসে প্রাণপণ হাতখানা তুলে ধরে। কোথায় এক দীর্ণ আর্তনাদ এই প্রাকৃতিক ধ্বংসমুখর শব্দের ভীড় ঠেলে মৃদুভাবে পৌঁছাল কানে, বাঁচাও, বাঁচাও।

ঝাব্বু সিং আর্তনাদ করছে বুঝি!

—নায়েক।

নায়েক কাছেই। মুক্ত করে দেয় শরদিন্দুকে। হয়তো পা দুটো কোমর অবধি কেটে ছড়ে ফালা ফালা হয়েছে। অস্পষ্ট যন্ত্রণা নিয়ে মুক্ত শরদিন্দু এগিয়ে যায়। কোত্থেকে আরেক দমক ঢেউ এসে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় দক্ষিণে। খানিক গিয়ে চণ্ডালিকার কিনারায় আলো লক্ষ্য করে আবার পশ্চিমে ঘোরে।

—আমার ল্যাবরেটারি! মুকুন্দ!

দূরে ক্ষীণ কণ্ঠস্বর বৃষ্টি বাতাসের জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। বাঁচাও! আওয়াজ ফুটে ওঠে না। কালান্তক দানবেরা অক্টোপাশ বাহু তুলে প্রচণ্ডবেগে দাঁত চেপে ওখানে ক্যাম্পের ঘরগুলো ঠেলছে আর ঠেলছেই। গোডাউনের দশইঞ্চি ভিতের কোথাও মাটি দিয়ে গাঁথা ইঁটের দেয়াল বুঝি ধসে পড়ছে এতক্ষণে। চারপাশে কামান গর্জনের মতো মুহুর্মুহু শব্দ বিক্ষিপ্ত গোলাকার একটা তরঙ্গ। অতিকায় যন্ত্রগুলো ভেসে চলেছে অসহায়ভাবে।

আকাশে জমাটি মেঘ। বৃষ্টি এখন কমল। কিন্তু তত বাড়ল জলের বেগ। আদিম প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নীলকান্তর মতোই মুখে রক্ত উঠে মরছে মানুষের বুদ্ধির ঐশ্বর্য। সাঁতার কাটে শরদিন্দু। এত শক্তি তার, এত ক্ষিপ্রতা ও দক্ষতা এখনও অবশিষ্ট। হঠাৎ দেহের পেশীতে পেশীতে জমেছে তারা! অমানুষিক হিংস্রতায় দুলতে দুলতে ক্ষেপে ওঠে শরদিন্দু, নায়েক!

দূরে কোথায় সাড়া আসে, এই যে! কানের ভুল? হাসিমের নীলকান্তর আত্মা বুঝি জেগে উঠে সাড়া দিচ্ছে। ওরা তাকে মৃত্যুর দেশে ডাক দিচ্ছে।

পায়ে মাটি ঠেকেছে। আঃ মাটি, মাটি, মাটি মা আমার। ধর্ষিতা অসম্বৃতবসনা ধরিত্রী! আলো লক্ষ্য করে টলতে টলতে এগোয় শরদিন্দু। জল ক্রমশ কমে হাঁটুর নীচে পৌঁচেছে। আলো একেবারে চোখের সুমুখে। উঁচু চণ্ডালিকা গ্রামের সীমান্তে রায়দিঘির ধারে দাঁড়িয়ে উদ্বেগব্যাকুল নরনারীরা। তীব্র কণ্ঠস্বরে একটা দীর্ণ বিলাপ তুলেই পড়ে যায় সে পিচ্ছিল পাথুরে মাটিতে। কে এসে ধরে ফেলে।

শংকরীপ্রসাদ।

সবল বাহুতে বুকে তুলে নিয়ে গিয়ে ডাকেন, মিনু আলো দেখিয়ে চল মা।

সব শেষ।

মাত্র একটি ঘণ্টার মধ্যে এতদিন ধরে বানানো কাহিনী শেষ। সবকথা থমকে দাঁড়িয়ে গেল এই শেষ রাত্রির শিথিল অন্ধকারের মধ্যিখানে। আর বুঝি আরম্ভ নেই। কথা বলার খেই নেই। শুধু নিরন্ধ্র শূন্যতা। মহাকালের বুক এতটুকু কাঁপে না। এ শূন্যতার সমাপ্তির পর আবার কোন প্রান্তে সৃষ্টির বীজকণিকা খুঁজে পেয়েছে সে?

শরদিন্দু লাল চোখে তাকায় চারপাশে। একমুহূর্ত চুপ করে কী খোঁজে। তারপর চেঁচিয়ে ওঠে শয্যা ছেড়ে, আমার ট্রাকটর, আমার ল্যাবরেটরি! শংকরীপ্রসাদের ঐতিহাসিক দালান গমগম করে ওঠে। পাগলের মতো হাত—পা ছোঁড়ে শরদিন্দু। মুখে হাত রেখে চোঙ বানিয়ে চিৎকার করে ডাকে—ঝাব্বু সিং! হাসিম!

বৃষ্টিশেষ আকাশের রক্তিম দিগন্ত থেকে কে বুঝি সাড়া দিচ্ছে, যাই….ই….ই….ই! আছড়ে পড়ে যায় সে শয্যার উপর। শ্রান্ত অতৃপ্ত নিষ্ফল এক সুন্দর শরীর। মৃন্ময়ী শিয়রে বসে বাতাস করে চলে। বৃদ্ধ অবনী চক্রবর্তী লাঠিতে ভর দিয়ে ফ্যাকাশে চোখে চেয়ে থাকেন ছেলের মুখের দিকে। তারপর হঠাৎ কেঁদে ওঠেন হাউ হাউ করে। ত্রিলোচনী নীরবে অশ্রুবিসর্জন করেন। কাঁদছে বোন অনিমা তার পায়ের কাছে বসে। শরদিন্দুর মা বুঝি কোথায় বেড়াতে গিয়েছিলেন ক’দিন আগে। এখনও ফেরেননি।

জীর্ণ প্রসাদের বুক ঘিরে জমে উঠছে শারদ দিনের রক্তরোদ। হেরে গেছে শরদিন্দু।

চণ্ডালিকার পূর্বমাঠে তার কোনো চিহ্ন রাখতে চাইল না প্রকৃতি। সে বুঝি অন্ধ, সে বুঝি নির্মম, সে যেন জেদি। তার পায়ে কেউ কি শেকল পরাতে পারল না আজও?

সকাল হয়েছে। মেঘমুক্ত নীল আশ্বিনের আকাশে মহাকালের অবিনশ্বর ললাটিকার মতো দীপ্যমান সূর্যশিখা। নীচে দিগন্তবিস্তৃত বন্যাজল হেসে উঠেছে কলস্বরে।

এখন আস্তে আস্তে কান্না থেমেছে। শরদিন্দু ঘুমুচ্ছে।

শংকরীপ্রসাদ বললেন, ওকে ঘুমুতে দাও।

তারপর প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ালেন। বললেন আপনমনে, ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। নির্বোধের দম্ভ!

—বাবা।

—কে কথা বললে?

মৃন্ময়ী দাঁড়িয়ে আছে। এইমাত্র উঠে এসেছে শরদিন্দুর শিয়র থেকে। শংকরীপ্রসাদ তার মাথায় হাত রাখলেন।

শংকরীপ্রসাদ আবার বললেন, কী আশ্চর্য, শরদিন্দুর মতো ছেলে, সেও ওই বাঁকী নদীর বাঁধটার অস্তিত্ব টের পায়নি। একটু এগিয়ে গেলেন। কী ভাবলেন। তারপর এ সবই ছেলেমানুষি ভেবে একটু হেসে উঠলেন।