।। ৬।।
ফেরার পথে রিয়ার ভিউ মিররে তাকিয়ে দেখলাম একেনবাবু ভীষণ গম্ভীরভাবে কিছু চিন্তা করছেন।
“কী এত ভাবছেন?”
“ভাবছি স্যার, মার্ডারটা ঘটেছিল একটা খুব শুভদিনে –আমাদের স্বাধীনতা দিবসে।”
প্রমথ বলল, “সো?”
“কিছুই না স্যার,” বলে হঠাৎ ঘ্যানঘ্যানে গলায় শুরু করলেন, “জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে,—-।”
“থামুন তো মশাই” প্রমথ ধমকে উঠল। “দেখছেন বাপি গাড়ি চালাচ্ছে।”
“থামছি স্যার।”
শব্দটা থামালেন, কিন্তু ওঁর মুখ নাড়ানো দেখলাম বন্ধ হল না। বাস্তবিকই খ্যাপা লোকটা।
“এবারের যাত্রাটা আপনার অকারণেই হল,” প্রমথ বলল। “তবে বারে বারে কী আর পাশ হয়, মাঝে মাঝে তো ফেলও মারতে হয়।”
“তা হয় স্যার, কিন্তু এবার ফেল মেরেছি বলছেন কেন?”
“কারণ অঞ্জনাকে প্রকারান্তরে তাই বলে এলেন।”
“তা এলাম স্যার।”
“সেটা সত্যি নয়।”
“কে জানে স্যার, বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।”
“যেটুকু জানেন, সেটুকুই বলুন না, এখানে আমি আর বাপি ছাড়া তো কেউ নেই।”
“এখন বললেন স্যার বাপিবাবুর কনসেন্ট্রেশন থাকবে না, একটা অ্যাকসিডেন্ট হবে।”
“এই বাপি একটা ধাবায় গাড়ি দাঁড় করা তো। চা খাব আর ওঁর কেরামতির খবর শুনব।”
“আপনি না স্যার, সত্যি।”
.
একটু বাদেই একটা ভদ্রগোছের ধাবা দেখে গাড়ি দাঁড় করালাম।
চা, তাওয়া রুটি আর ডাল মাখানি অর্ডার দিয়ে দূরের একটা বেঞ্চিতে নিরিবিলিতে বসলাম।
“এবার বলুন,” আমি বললাম।
একেনবাবু শুরু করলেন। “গজলালের বিরুদ্ধে কেসটা জোরদার হয়েছে দুটো কারণে। ওঁর কাছে হিরেটা ছিল। উনি অস্বীকার করেননি যে ওটা জগদীশনারায়ণের কাছ থেকে পাওয়া; আর দ্বিতীয় হল গজলের নামটা দেয়ালে মরার আগে সুরেশবাবু লিখে গিয়েছেন। সোজাসুজি নয়, সাংকেতিক ভাবে। তাই তো স্যার?”
“ইয়েস।” আমি আর প্রমথ দু’জনেই একসঙ্গে বললাম।
“কিন্তু স্যার একটা গাছে তো দু’ধরনের ফুল হয়-দেখলেন তো কাল।”
একেনবাবু যে কী বলতে চাইছেন –মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। “হোয়াট ডু ইউ মিন?”
“আমি বলতে চাচ্ছি স্যার, আমরা হয়তো ভাবছি গাছটা লাল, তারপর হঠাৎ দেখলাম বেগুনি।”
“কী হেঁয়ালি শুরু করেছেন মশাই, একটু ঝেড়ে কাশুন না!” প্রমথ ধমক লাগালো।
“যদি ভাবা যায় স্যার, ‘গজলাল’ নামটা সুরেশবাবু লিখতে চাননি। আর কানাইবাবু তো বললেন গজলালের নাম লিখতে চাইলে উনি লিখতেন ‘জগলাল।”
“ননসেন্স! তাহলে কী লিখতে চেয়েছিলেন?” প্রমথ ধমক লাগাল।
“সেটাই স্যার আমি ভাবছিলাম। সংখ্যাগুলো আবার দেখুন,” বলে পকেট থেকে ওঁর ডায়রির একটা পাতা ছিঁড়ে লিখলেন।
“আমরা জানি স্যার, অ্যালফাবেট গুণে গুণে দেখলে-A হল ‘1’, B হল ‘2’, এইভাবে চললে G হল ‘7’, J হবে ‘10’, আর L হবে ‘12’। উনি পেছন ফিরে লিখছিলেন স্যার, তাই পুলিশ ওটাকে ঘুরিয়ে পড়েছিল 7 1 101 12 1 12। তাই পেয়েছিল GAJALAL। ধরুন, আমরা সেটা না করে পড়ি, 12 1 12 1 01 17। তাহলে কী দাঁড়াবে, LALA 01 AG।….”
“ওয়েট এ মিনিট!” আমি বলে উঠলাম।
“দাঁড়ান স্যার, আমার বলা শেষ হয়নি। সংখ্যাগুলোকে একটু অন্য রকম করে লিখছি 12 1 12 10 11 7- এবার পড়ুন….।”
“LALA 0 KG। ও মাই গড! ওই ঘোষের পো কালীচরণ না কি জানি তার নাম সেটা তো KG হবে!”
“রাইট স্যার।”
“তার মানে তো ওই দুজনকেই খুন করেছে!”
“আপনি আমার পয়েন্ট মিস করছেন স্যার। লালাবাবুর অ্যালিবাই নিশ্চয়ই পুলিশ খতিয়ে দেখেছিল এবং তাতে কোনো ফাঁক পায়নি। যেটা আমি বলতে চাচ্ছি স্যার, সেটা হল সংখ্যাগুলোর মধ্যে নানান জিনিস লুকিয়ে থাকতে পারে। একটা অর্থ খুঁজে বার করে সেটাকেই ধ্রুব সত্য মনে করলে বিরাট ভুল হয়ে যাবার সম্ভাবনা থেকে যায়।”
“এটা মন্দ বলেননি।” আমায় মানতে হল।
“আমার একটা থিওরি আছে,” প্রমথ বলল, “যদিও প্রমাণ করতে পারব না।”
“কী থিওরি?”
“সুরেশবাবু খুন হয়েছেন অবৈধ সম্পর্কের জেরে। সুরেশবাবুর অরিজিনাল স্ত্রী-মানে ওই বাণীবউদি আর অজয়বাবুর মধ্যে প্রেম ছিল। দু’জনে শলা করে সুরেশবাবুকে খুন করেছিলেন। কী একেনবাবু, ঠিক বলছি কি না বলুন?”
“আপনি স্যার আমার ভাত মারবেন।” একেনবাবু প্রমথকে বললেন।
“গুড, এবার প্রমাণ করুন, কেন আমি ঠিক বলছি।”
“সেখানেই মুশকিল স্যার। তবে কিনা সেটা যদি সত্যি হতো, তাহলে সুরেশবাবু ওইভাবে নামের কু দিতেন না।”
“তার মানে?” প্রমথ প্রশ্ন করল।
“মানে স্যার, সুরেশবাবু খুনিকে ধোঁকা দেবার জন্যে এই রকম সংখ্যার কোড ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু অজয়বাবুর কোডটা জানা ছিল, সুতরাং অজয়বাবু খুনি হলে সুরেশবাবু অন্যভাবে খুনির নাম লিখতেন।”
দ্যাট্স ট্রু। কথাটা অযৌক্তিক নয়। আমি ভাবার চেষ্টা করছিলাম, একেনবাবু ঠিক কোনদিকে এগোচ্ছেন।
ধাবার সার্ভিস খুব ফাস্ট। এর মধ্যেই আমাদের খাবার এসে গেল। চায়ে একটা চুমুক দিয়ে রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে একেনবাবু বললেন, “যেটা প্রশ্ন, সেটা হল এই সংখ্যাগুলো সুরেশবাবু অন্য কোনো কোড ব্যবহার করে লিখেছিলেন কি না।”
“অন্য কোনো কোড!”
“কেন নয় স্যার, নইলে খুনিকে ধরাবেন কী করে?”
“খুনিকে ধরাবেন মানে? আপনি কি প্রমথর স্টুপিড থিওরিটা ঠিক বলে ভাবছেন?”
“চুপ কর, আমার কোনো থিওরি স্টুপিড নয়।” প্রমথ গর্জন করল।
“প্রমথবাবুর থিওরি ঠিক না ভুল জোর করে বলতে পারব না স্যার, তবে আমার নিজের আরেকটা থিওরি আছে।”
“কী সেটা?”
“গজলাল যে জগদীশনারায়ণকে হিরের জন্যে পনেরো লক্ষ টাকা দেবে-সেটা সুরেশবাবু ওঁর প্রাণের বন্ধু অজয়বাবু আর কনকবাবুকে জানিয়েছেন। প্ল্যান ছিল টাকাটা পাওয়া মাত্র ওঁরা তিনজন জগদীশনারায়ণকে খুন করবেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে সুরেশবাবুর উপর পুলিশের সন্দেহটা পড়বে। সুতরাং ঠিক করা হল, সুরেশবাবুকে হাতমুখ বেঁধে সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে আটকে রাখা হবে। সেক্ষেত্রে পুলিশ এসে মনে করবে- ডাকাতরা সুরেশবাবুকে বেঁধে সিন্দুকের চাবি কেড়ে নিয়ে জগদীশনারায়ণকে খুন করে হিরে নিয়ে অদৃশ্য হয়েছে। তবে একটু ভাবলেই বোঝা যায় স্যার, প্ল্যানটা অত্যন্ত কাঁচা। একটা খুনই যদি করতে হয়, তাহলে ডাকাতদের দুটো খুন করতে অসুবিধা কী? এইভাবে বেঁধেহেঁদে একজনকে ঘরে আটকে রাখা অনেক বেশি রিস্কি-পুলিশের মনে সন্দেহ জাগবে।”
যাক সে কথা। এবার জিনিসটা একটু ইন্টারেস্টিং অবস্থায় পৌঁছল। পুলিশ সার্ভেন্টস কোয়ার্টার সার্চ করল না। সুরেশবাবু ওখানেই আটকা পড়ে রইলেন। তখন কনকবাবু আর অজয়বাবু চাইলে পুলিশকে জানাতে পারতেন যে, ওঁরা খুঁজতে খুঁজতে সুরেশবাবুকে পেয়েছেন-উনি সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে বাঁধা পড়ে রয়েছেন। কিন্তু ওঁরা ভেবেচিন্তেই সেটা করলেন না। সুরেশবাবু যদি উদ্ধার হন, পুলিশ গজলালকে আটক করলেও সন্দেহের তীর সুরেশবাবুর ওপরও থাকবে। পুলিশ যদি হঠাৎ সুরেশবাবুর বা সন্দেহবশে ওঁদের বাড়ি সার্চ করে, তাহলে টাকার হদিশ পেয়ে যাবে। সুরেশবাবুর সঙ্গে অজয় এবং কনকও ধরা পড়বেন। ওঁরা তাই কিছুই করলেন না, বন্ধুকে তিলে তিলে মরতে দিলেন।”
“মাই গড!” আমি বললাম।
“দাঁড়ান, দাঁড়ান, আপনি বলতে চান, ওই বাণীবউদি ক্যারেক্টার এই খুনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না! বরকে খুন করে প্রেমিকের ঘর করা তো স্ট্রং মোটিভেটর।”
“হু নোজ স্যার। তবে কি না, সুরেশবাবুর মৃত্যুর পর অজয়বাবু যদি শুধু বন্ধুর বৌকে পেতেন- তাহলে আপনার থিওরিটা জোরদার হত। কিন্তু এক্ষেত্রে অজয়বাবু আর কনকবাবু-দু’জনেই বেশ কিছু টাকারও মালিক হয়েছিলেন। সাইকেল সারানোর ব্যবসা থেকে কনকবাবু লরির ব্যবসা শুরু করেছিলেন। অজয়বাবু চাকরি ছেড়ে তাতে যোগ দেন। এই ব্যবসায় তো অনেক ক্যাপিটাল লাগে। হঠাৎ টাকাগুলো এল কোত্থেকে? তারপর ঐ সুন্দর ছায়ানীড় বাড়িটা- সেটা বানাতেও তো পয়সা লেগেছিল অনেক। না স্যার, আমার মনে হয় টাকার ব্যাপারটাই মুখ্য। যদিও মানি স্যার, এইসব অবৈধ সম্পর্ক থেকে অনেক খুনোখুনি হয়।”
“প্রমথর থিওরি বাদ দিন, আপনি আপনার কথাটা শেষ করুন,” আমি বললাম।
“আমার ধারণা টাকাটা কনকবাবু আর অজয়বাবুর কাছে ছিল। সুরেশবাবুকে উদ্ধার করলে, তাহলেই উনি ভাগ পেতেন। তিনি বেঁচে না থাকায় অজয়বাবু আর কনকবাবুর ভাগটা বাড়ল। একের তিন না হয়ে আধা।
যাই হোক, সুরেশবাবু যখন বুঝতে পারলেন বন্ধুরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তখন মরার আগে দেয়ালে ওদের নাম লেখার চেষ্টা করলেন। এবিসিডি কোড বন্ধুরা জানে। নতুন কী কোড ব্যবহার করা যায়?
গান পাগলা মানুষ, হয়তো ওঁর মনে হয়েছিল ১৫-ই অগস্টে খুন হয়েছে।
এই গানটা সেই দিনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত-সুতরাং যাঁরা ওঁর সঙ্কেত বোঝার চেষ্টা করবেন তাঁদের মাথায় সেটা থাকবে। তাও একটা হিন্ট দেবার জন্যে দুটো অক্ষর NA নীচে জুড়ে দিলেন। NA মানে National Anthem।”
“আই সি, কিন্তু তাহলে কী দাঁড়ায়?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। “গুণে দেখুন স্যার, আমি গাইব না, গাইলে প্রমথবাবু আবার বকবেন। এই নিন স্যার, এই ছিল সুরেশবাবুর কোড-7 1 101 12 1 12। তবে কোডটা একটু অন্যভাবে পড়ন। এই ভাবে 71 10 11 2 11 2। সংখ্যাগুলো এক-শুধু দুটো পেয়ার একটু আলাদা ভাবে লিখলাম।”
আমি আর প্রমথ জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে-র অক্ষর গুণে গুণে লিখতে লাগলাম। জ হল 1, ন হল 2, গ হল 3, ণ হল 4, ম হল 5, ন হল 6, অ হল 7, ধি হল ৪, না হল 9, 10 হল য় আর 11 হল ক। তাহলে 7 1 10 11 2 11 2 দাঁড়াচ্ছে: অজয় কনক ২- ও মাই গড!
আমি আর প্রমথ মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম।
“আমার মনে হয় সুরেশবাবু ভাবেননি স্যার যে সংখ্যাগুলো অ্যালফাবেটের পজিশন হিসেবে সাজালে গজলাল হয়ে দাঁড়াবে!” একেনবাবু মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন।
“সাধু, সাধু, প্রমথ বলল। “নাঃ, আপনার কল্পনাশক্তিকে সেলাম না ঠুকে পারছি না। কিন্তু এইরকম আরও কিছু কল্পনাশক্তি লাগালে তো যাকে খুশি তাকেই খুনি বানিয়ে ফেলতে পারেন!”
“তাই তো বললাম স্যার, এটা নিতান্তই থিওরি।”
“তা হোক থিওরিটা মন্দ নয়, এটা সত্যি হওয়াও সম্ভব।” আমি বললাম।
“তোর মুণ্ডু!” আমাকে নস্যাৎ করে প্রমথ একেনবাবুকে বলল, “তা গোয়েন্দামশাই, এই কীর্তির কথা সুবীর আর অঞ্জনাকে বলে এলেন না কেন? ওদের কাছে তো হেরো হয়ে ফিরলেন।”
“কী যে বলেন স্যার। আমার থিওরি ঠিক হলেও ওঁদের বাবাদের কুকর্মের জন্যে তো ওঁরা দায়ী নন। ওয়ান্ডারফুল কাপল স্যার, জাস্ট ওয়ান্ডারফুল!”