পুরো একটা মিনিট চুপ হয়ে রইল তিনজনেই। তাকিয়ে রয়েছে র্যানসম নোটটার দিকে। যেন ওটাতেই রয়েছে সমস্ত রহস্যের জবাব।
কিশোরের কথার প্রতিধ্বনি করেই যেন অবশেষে রবিন বলল, কর্মীদের কেউ বেন ডিলনকে কিডন্যাপ করেছে?
কিংবা কোন অভিনেতা, বলল কিশোর। সিনেমার লোক, এ ব্যাপারে আমি শিওর। সাধারণ চোরডাকাতে ভ্যারাইটি পড়ে না। বেশি পড়ে সিনেমার লোকে। তাদের কাছে ওটা বাইবেল। খুব জরুরী সূত্র এটা। বড় একটা ধাপ এগোলাম। T_ তার মানে, মুসা বলল, এমন একজন লোক দরকার, যার ওপর সন্দেহ হয়, যার মোটিভ আছে। আর দরকার জানা, কোথায় আটকে রাখা হয়েছে ডিলনকে।
আস্তে আস্তে, কিশোর বলল, তাড়াহুড়া করলে ভুল হয়ে যাবে। শান্ত হয়ে মাথা খাঁটিয়ে একেকটা প্রশ্নের জবাব বের করতে হবে। তদন্ত চালিয়ে যেতে হবে। সাফোকেশন টু-র শ্রমিক কর্মী অভিনেতা সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। জানতে হবে কে ডিলনের শত্ৰু, কে মিত্র। আমি অ্যাঞ্জেলা ডোভারকে দিয়ে শুরু করতে চাই।
করো। কিশোরের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল রবিন, কিন্তু আগে ওকে কেন?
ডিলন নিখোঁজ হওয়ার আগের দিন তার সঙ্গে অভিনয় করেছে সে। আরও একটা ব্যাপার আছে। মুসার বাবা বললেন ওদের মাঝে মন দেয়ানেয়ার ব্যাপার থাকতে পারে।
পারে?
হ্যাঁ। তিনি শিওর নন।
তোমার জন্যে একটা দুঃসংবাদ আছে, কিশোর, মুসা বলল। অ্যাঞ্জেলা ডোভার বড়ই মুখচোরা স্বভাবের, বাবা একথাও বলেছে। সহজে কথা বলতে চায়। না। ছদ্মবেশে থাকতে পছন্দ করে। এমন ভাবে থাকে, যাতে কেউ তাকে চিনতে না পারে। ফিল্ম স্টারদেরকে লোকে জ্বালাতন করে তো, বেরোতে পারে না। ঠিকমত…
বাধা দিয়ে কিশোর বলল, ছদ্মবেশ, না? ভাবছি, হ্যালোউইনের রাতে কোথায় ছিল সে?
.
পরদিন বিকেলের আগে সময় করতে পারল না মুসা। কমলা ভেগাটা চালিয়ে নিয়ে। এল পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে। হর্ন বাজাতে বাজাতে ডাকল, এই কিশোর! বেরোও! ওকে পেয়েছি!
ইলেকট্রনিক ওঅর্কশপ থেকে বেরিয়ে এল কিশোর। কি হয়েছে?
এসো, গাড়িতে ওঠ। এইমাত্র একটা গরম খবর শোনাল বাবা। অ্যানহেইমের বাড়িতে গিয়ে ডুব দিয়েছে অ্যাঞ্জেলা ডোভার, পরের ছবিটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার জন্যে।
অ্যাঞ্জেলা ডোভার? দাঁড়াও, এখনি আসছি! বাড়ির দিকে দৌড়ে চলে গেল কিশোর। দশ মিনিট পরেই ফিরে এল পরিষ্কার জামাকাপড় পরে। নতুন জিনসের প্যান্ট, ইস্ত্রি করা অক্সফোর্ড ড্রেস শার্ট। চল। রবিনদের বাড়িতে গিয়েছিলে?
ও আসতে পারবে না। ট্যালেন্ট এজেন্সিতে জরুরী কাজ আছে, খবর পাঠিয়েছেন বার্টলেট লজ। সেখানে চলে গেছে।
হু! গুঙিয়ে উঠল কিশোর। মাঝে মাঝে মনে হয়, তিন গোয়েন্দা আর নেই আমরা, দুই গোয়েন্দা হয়ে গেছি! ওর এই ট্যালেন্ট এজেন্সির চাকরিটা বাদ দিতে পারলে ভাল হত!
ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছে। ইঞ্জিন স্টার্ট দিল মুসা। না দিলে নেই। আমরা দুজনেই চালাব। ও তো আজকাল আর তেমন সাহায্য করতে পারে না, আমাদেরকে।
তা ঠিক, কিশোর বলল, সবাইকেই একসময় একলা হয়ে যেতে হয়। সব সময় তো আর সবাই একসঙ্গে থাকতে পারে না। এমনও হতে পারে, অন্য কোন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তুমিও চলে যাবে। তখন একলা চলতে হবে না আমাকে? গোয়েন্দাগিরি তো ছাড়তে পারব না কোনদিনই। আনমনা হয়ে গেল সে। ওই যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে গেছেন না, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলরে… বেসুরো গলায় গুনগুন করে গাইতে লাগল সে।
পুরো একটা ঘন্টা চালানর পর একটা তিনতলা বাড়ির সামনের পার্কিং লটে এনে গাড়ি ঢোকাল মুসা। একটা রিটায়ারমেন্ট কমপ্লেক্স। সাইনবোর্ড লেখা রয়েছেঃ সিলভান উডস রেস্ট হোম। কিশোর বলল, সব ফাঁকিবাজি, মিথ্যে বিজ্ঞাপন। উডস মানে তো বন, এখানে বন কোথায়? সিলভানই বা কই? ওরকম। বনদেবতা থাকার প্রশ্নই ওঠে না। একটা ফ্রিওয়ে শুধু দেখতে পাচ্ছি।
বন, দেখতে তো আর আসিনি আমরা, মুসা বলল, নায়িকার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। অ্যাঞ্জেলা ডোভারকে পেলেই হলো। তাকিয়ে রয়েছে কিছু লোকের দিকে, সবাই বৃদ্ধ, চুল সাদা হয়ে গেছে। এখানে ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা কঠিন হবে ওর জন্যে।
মনে হয়।
খুঁজতে লাগল ওরা। গেম রুম, টিভি রুম, কার্ড রুম, সব জায়গায় উঁকি দিল। হোমের বয়স্ক বাসিন্দারা হয় চেয়ারে বসে খেলছে, কথা বলছে, নয়ত ছড়ি হাতে হাঁটাচলা করছে শরীরটাকে আরও কিছুদিন সচল রাখার অদম্য আকাঙ্ক্ষায়। যতই বুড়ো হোক, মরতে তো আর চায় না কেউ। মহিলারা কেউ সেলাইয়ের কাজ করছে, কেউ বই পড়ছে, দুএকজন গিয়ে ফুল গাছের যত্ন করছে বাগানে। কিশোর আর মুসাকে সবাই দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু কেউ কথা বলছে না। অন্তত শুরুতে বলতে চাইল না।
তারপর ডাক দিল একজন, এই ছেলেরা, শোনো।
ঘুরে তাকাল দুজনে। বড় একটা পাম গাছের ছায়ায় বেঞ্চে বসে আছে এক বৃদ্ধা। ধূসর চুল ছড়িয়ে রয়েছে বিশাল এক হ্যাঁটের নিচে। আঙুল বাকা করে ওদেরকে কাছে যেতে ইশারা করছে মহিলা। কোলের ওপর ফেলে রেখেছে হালকা একটা কম্বল, পা ঢেকে রেখেছে।
এগিয়ে গেল দুই গোয়েন্দা।
বেঞ্চে চাপড় দিয়ে ওদেরকে পাশে বসতে ইশারা করল মহিলা। মুখের চামড়ায় অসংখ্য ভাঁজ। হাসলে সেগুলো আরও বেশি কুঁচকে গম্ভীর হয়ে যায়। বলল, আমার নাম পলি। কাউকে খুঁজছ মনে হয়?
একজন মহিলাকে খুঁজছি, কিশোর বলল।
আমিও তো মহিলা, হেসে বলল পলি। দ্রুত ওঠানামা করল কয়েকবার চোখের পাতা।
রসিকতায় কিশোরও হাসল। তা তো নিশ্চয়। আরও কম বয়েসী একজনকে খুঁজছি।
অ্যানিটার কথা বলছ না তো? ওর বয়েস কম, আটষট্টি।
আমরা খুঁজছি একজন তরুণীকে, অভিনেত্রী।
সাংবাদিক-টাংবাদিক নাকি তোমরা?
না, আমরা গোয়েন্দা, জবাব দিল মুসা।
ও, গোয়েন্দা? সাথে হিটার আছে? রড? গ্যাট? পিস্তল-বন্দুকের পুরানো সব নাম ব্যবহার করল মহিলা। চোর-ডাকাতেরা এখনও কেউ কেউ এই নাম বলে, বিশেষ করে রড।
না, আমরা টিভি ডিটেকটিভ নই।
আমরা তাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই, কিশোর বলল। আমাদের সাহায্য চেয়েছে একজন। তার ব্যাপারেই আলোচনা করতাম। মহিলার চোখের দিকে তাকাল সে। আপনি আমাদেরকে সাহায্য করবেন, মিস ডোভার?
হ্যাটটা ঠেলে পেছনে সরাল পলি, ধূসর উইগ সরে গিয়ে বেরিয়ে পড়ল নিচের কোকড়া কালো চুল। অল্প বয়েসীদের চুল আর বুড়ো মানুষের মুখ নিয়ে এখন। অদ্ভুত লাগছে তার চেহারা। কি করে বুঝলে? গলার স্বর তরুণ হয়ে গেল হঠাৎ করেই।
আপনার ডায়লগ শুনে। হিটার আছে? রড? গ্যাট? দি ফ্রেঞ্চ অ্যাজেন্ট ছবিতে আপনি ওই ডায়লগ বলেছিলেন। ছবিটা আমি দেখেছি।
চোখ কান খোলা রাখো তুমি! সোজা হয়ে বসেছে অ্যাঞ্জেলা, বুড়ো মানুষের মত কুঁজো হয়ে বসার আর প্রয়োজন নেই। কোলের ওপর থেকে কম্বলটা সরিয়ে নিয়েছে। নীল জিনস পরেছে।
আমার পরের ছবিটায় আমি পল্লির রোল করব, আশি বছর বয়েস। আশি বছর হলে কি করে মানুষ, না জানলে অভিনয় করতে পারব না, সে জন্যেই এখানে। এসেছি কাছে থেকে দেখার জন্যে। এখানে ওই বয়েসের প্রচুর মানুষ আছে। ভাল অভিনয় করতে হলে দেখার ক্ষমতা খুব ভাল থাকা লাগে। কিশোরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, অভিনয় করার কথা কখনও ভেবেছ?
ভেবেছে মানে? মুসা বলল, কিশোর তো•..
জোরে কেশে উঠল কিশোর। মুসাকে শেষ করতে দিল না কথাটা। মোটুরামের অভিনয় করেছে, এটা নিয়ে কোন গর্ব তো নেইই, শুনতেও ভাল লাগে না তার। মুসাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল, বেন ডিলনের ব্যাপারে কথা বলতে চাই আমরা, মিস ডোভার।..
মাথা নাড়ল অ্যাঞ্জেলা। ব্যক্তিগত আলোচনা হয়ে যাবে।
স্ক্যাণ্ডাল নয়, আমরা চাই তথ্য। শেষ কখন ডিলনের সঙ্গে দেখা হয়েছে আপনার? কি কি কথা হয়েছে? কেউ তাকে হুমকি দিচ্ছে এরকম কি কিছু বলেছে? আপনাদের মাঝে রোমান্টিকতা কর কি আছে না আছে জানতে চাই না আমরা।
বেঞ্চে নড়েচড়ে বসল অ্যাঞ্জেলা। আঙটি দিয়ে আলতো টোকা দিতে দিতে বলল, এক বছর ধরে আমার সঙ্গে প্রেম করার পর আমাকে ফেলে গেল সে। এটা নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা হয়েছিল। খুব কষ্ট পেয়েছি আমি। এতটাই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল, কাজকর্মই বাদ দিয়ে দিয়েছিলাম।
তারমানে, কিশোর বলল, ডিলন মারাত্মক বিপদে পড়লেও আপনার কিছু এসে যায় না?
তা বলিনি। বিপদ সে ইচ্ছে করে টেনে আনে। মানুষকে ভোগায়। আমাকে ভুগিয়েছে। সিনেমা কোম্পানিকে ভুগিয়েছে। মুসার দিকে তাকাল অ্যাঞ্জেলা, কি ব্যাপার, তুমি কিছু বলছ না?
কিশোরই তো বলছে। গাল চুলকাল মুসা। গত শুক্রবার সকালে ডিলনের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ও বিপদে পড়েছে, বুঝতে পেরেছি।
অ্যাঞ্জেলা বলল, এর আগের রাতে আমি গিয়েছিলাম।
গিয়েছিলেন? ভুরু কুঁচকে তাকাল কিলোর।
ডিনার খেয়েছি ওর বাড়িতে। সেদিন সাফোকেশন ছবিতে আমার কাজ শেষ হয়েছিল। তো, আমাকে জিজ্ঞেস করতে এসেছ কেন? শেষ দেখেছি বলে?
আপনি শেষ দেখেননি। শেষ দেখা হয়েছে কিডন্যাপারদের সঙ্গে।
কিডন্যাপার! আঁতকে উঠল অ্যাঞ্জেলা, অলিংগার জানে?
তার কাছেই পাঠানো হয়েছে র্যানসম নোট, মুসা জানাল।
বেচারা অলিংগার। মরেছে!
ডিলনের সঙ্গে কেমন কাটল আপনার সন্ধ্যাটা, বলবেন? অনুরোধ করল কিশোর।
চমৎকার ডিনারের ব্যবস্থা করেছিল সে। আমার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে ভুল করেছে, একথা শুনিয়ে, বোকার মত রসিকতাও করেছে। মনমেজাজ ভালই ছিল তার।
ডিলনের বন্ধু এবং শত্রুদের কথা কিছু বলবেন?
শত্রুর নাম বলতে শুরু করলে তো মাইলখানেক লম্বা হয়ে যাবে তালিকা। তবে বেশি রেগে যাওয়ার কথা ডট কার্লসনের। সাফোকেশন টু-র নায়কের রোলটা পাওয়ার কথা ছিল তার। হঠাৎ করে ডিলনকে দিয়ে দেয়া হল। ফলে রেগে গিয়ে কিছু একটা করে বসাটা ডটের পক্ষে বিচিত্র নয়। ডিলনের গুরুটাকেও সন্দেহ করতে পার। পটার বোনহেডের কথায় ওঠবস করে ডিলন। যা করতে বলে তাই করে। বোনহেডই কিছু করেছে কিনা কে জানে।
খুব একটা সাহায্য আপনি করতে পারছেন না, কিশোর বলল।
সরি। তেমন কিছু জানিই না, কি করব বল? উইগটা ঠিক করে তার ওপর হ্যাটটা বুসিয়ে দিল আবার অ্যাঞ্জেলা, পলি সাজল। বুড়ো মানুষের গলা নকল করে বলল, ঠিক আছে, কোন কিছুর প্রয়োজন পড়লে এস আবার। দেখি তখন কোন সাহায্য করতে পারি কিনা।
ওর কথার ধরনে হেসে উঠল কিশোর আর মুসা। গুডবাই জানিয়ে চলে এল নিজেদের গাড়ির কাছে। গাড়িতে উঠে কিশোর বলল, কাল স্কুল শেষ করে প্রথমেই স্টুডিওতে যাব, তোমার বাবা যা-ই বলুন।
আমি যেতে পারব না, মুসা বলল। ফারিহার সঙ্গে দেখা করতেই হবে। ও রেগে আছে।
ফারিহার সঙ্গে দুদিন পরে দেখা করলেও চলবে। কিডন্যাপারদের কাছ থেকে হয়ত পরবর্তী নির্দেশ পেয়ে গেছেন অলিংগার। তোমার কাজ তাঁর সঙ্গে কথা বলে তাঁকে ব্যস্ত রাখা।
ব্যস্ত রাখব? কেন?
কারণ স্টুডিওতে আমার কিছু কাজ আছে। জানিয়ে করা যাবে না কিছুতেই।
অলিংগারকে ব্যস্ত রাখবে, পরদিন প্রযোজকের অফিসের বাইরে বসার ঘরে বসে কথাটা ভাবছে মুসা, কিন্তু কিভাবে? কথা বলে, নানা রকম কৌশল করে? সেটা রবিন আর কিশোরের কাজ, ওরাই ভাল পারে। জেদ চেপে গেল তার। ওরা পারলে সে পারবে না কেন?
আপাতত অলিংগারকে ব্যস্ত রাখার জন্যে মুসার দরকার নেই। নিজের ঘরে। ব্যস্তই রয়েছেন তিনি। রিসিপশন রুমের চারপাশে চোখ বোলাল সে। আরেকজন লোক বসে আছে, অলিংগারের সঙ্গে দেখা করার জন্যে। ঘন কাল চুল, উজ্জ্বল নীল ফ্রেমের সানগ্লাস পরেছে। আঙুল দিয়ে কখনও চেয়ারের হাতলে টাট্ট বাজাচ্ছে, কখনও নিজের উরুতে। লম্বা বেশি নয়। গায়ে শক্তি আছে বোঝা যায়। মাঝে মাঝে জুতোর ডগা দিয়ে যেন ঠেলে সরানর চেষ্টা করছে পুরু কার্পেট।
বেঞ্চের ফাইট কটায়? মুসাকে জিজ্ঞেস করল লোকটা, দুটো দশে?
দুটো বিশ।
কয়েক মিনিট চুপচাপ থেকে আবার তাকাল মুসার দিকে। পাঞ্জা লড়ার অভ্যেস আছে?
আছে।
এসো, হয়ে যাক…
প্রডিসারের অফিসে?
অসুবিধে কি? বসে থাকার চেয়ে তো ভাল… বলতে বলতেই সামনের টেবিল থেকে কফি কাপ আর ম্যাগাজিন সরিয়ে পরিষ্কার করে ফেলতে লাগল। লোকটা। সোফা থেকে নেমে কার্পেটে হাঁটু গেড়ে দাঁড়িয়ে ডান কনুইটা রাখল টেবিলে, হাতের পাঞ্জা খোলা। ডাকল, এসো।
গিয়ে টেবিলের অন্য পাশে হাঁটু গেড়ে একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ডান হাতের কনুই টেবিলে রেখে চেপে ধরল লোকটার পাঞ্জা। চোখে চোখে তাকাল।
শুরু! বলল লোকটা।
লোকটা চেষ্টা করছে মুসার হাতকে চেপে শুইয়ে দিতে চাপের চোটে কাঁপছে টেবিলটা। মুসা বেশি চাপাচাপি করছে না, শক্তি ধরে রেখে সোজা করে রেখেছে হাত। লোকটার শরীরে শক্তি আছে বটে, কিন্তু বেশিক্ষণ টিকে থাকার ক্ষমতা নেই, এটা বুঝে ফেলেছে সে।
চোখ মিটমিট আরম্ভ হয়ে গেল লোকটার।
ক্লান্ত হয়ে এসেছে, ঢিল পড়ছে হাতের চাপে। সময় হয়েছে! আচমকা হাতের চাপ বাড়িয়ে দিল মুসা। হাত সোজা রাখতে পারছে না লোকটা। কয়েক সেকেণ্ড আপ্রাণ চেষ্টা করল সোজা রাখার, পারল না, কাত হয়েই যাচ্ছে, তারপর পড়ে গেল টেবিলের ওপর। ককিয়ে উঠল সে, ব্যথায় নয়, পরাজিত হওয়ায়।
ঠিক এই সময় দরজায় দেখা দিলেন অলিংগার। রিসিপশন রুমে দুজন লোককে ওই অবস্থায় দেখে দ্বিধায় পড়ে গেলেন।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল লোকটা। ছুটে গেল অলিংগারের দিকে। কত আর অপেক্ষা করবে, ব্রাউন? অনেক তো হলো।
শান্ত হও, ডট, শান্ত হও, অলিংগার বললেন। আমার সঙ্গে ঝগড়া করে কোন লাভ হবে তোমার?
ভেবে দেখো, ব্রাউন, সময় থাকতে, বলল তরুণ লোকটা। ও-ই ডট কার্লসন, বুঝতে পারল মুসা। শুনলাম, ডিলন কেটে পড়েছে। ছবিটাকে ডোবাতে চাও?
এই অভিনেতার কথাই অ্যাঞ্জেলা ডোভার বলেছিল, প্রথমে যাকে দি সাফোকেশন টু ছবির জন্যে পছন্দ করা হয়েছিল।
ডট, আমার হাতে আর কিছু নেই এখন। তুমি জানো না। পরে কথা বলব।
ইশারায় মুসাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল ডট, এ কে? ছবিতে অভিনয় করবে?
না।
আরেকবার মুসার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল ডট, আসলেই তাকে অভিনয় করতে আনা হয়েছে কিনা। শ্রাগ করল। তারপর রওনা হয়ে গেল দরজার দিকে।
ক্লান্ত দৃষ্টি ফুটেছে অলিংগারের চোখে। রক্তশূন্য লাগছে চেহারা। কেমন আছ? চমৎকার কাজ করেছ গাড়িটাতে, আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে। আমার সঙ্গে কথা বলতে চাও?
ভারি দম নিয়ে প্রযোজকের পিছু পিছু তার অফিসে ঢুকল মুসা। টেবিলে পড়ে রয়েছে ওর বাবার হাতের আরেকটা কাজ। একটা চোখ, মণিতে কাঁটাচামচ গাঁথা। যতরকম বীভৎসতা সম্ভব, সব যেন ঢোকানোর চেষ্টা হয়েছে এই একটা ছবিতেই।
মিস্টার অলিংগার, বলল সে, কিডন্যাপাররা আর কোন খবর দিয়েছে?
মাথা নাড়লেন প্রযোজক। টেবিলে পড়ে থাকা তিন গোয়েন্দার কার্ডটা তুলে নিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, তোমাদেরকে এই কেস থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম, তাই না? তাহলে ভাল হয়। কিডন্যাপাররা যা যা করতে বলে তাই আমাদের করা উচিত, তাহলে ডিলন ভাল থাকবে।
মাথা ঝাঁকাল মুসা, যেন সব বুঝতে পেরেছে। ব্যাপারটা বড়ই অদ্ভুত। সাধারণত তাড়াতাড়ি যোগাযোগ করে কিডন্যাপাররা, টাকাটা নিয়ে সটকে পড়তে চায়। এরা এত দেরি করছে কেন?
কিডন্যাপারদের ব্যাপারে অনেক কিছু জানো মনে হয়? হাসির ভঙ্গিতে ঠোঁটগুলো বেঁকে গেল অলিংগারের, মুসার কাছে সেটাকে হাসি মনে হলো না।
কিডন্যাপ কেসের সমাধান আরও করেছি আমরা, কিছুটা অহঙ্কারের সঙ্গেই বলল মুসা। আপনি আমাকে সরে থাকতে বলেছেন। কিছু মনে করবেন না, আমার বন্ধু কিশোর পাশাকে নিয়ে এসেছি আজ স্টুডিওতে। ডিলনের পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলাম। কিছু বেরিয়েও যেতে পারে।
পুরু একটা মিনিট ছাতের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন অলিংগার। তারপর মুখ। নামালেন। মুসা ভেবেছিল মানা করে দেবেন, তা করলেন না। আইডিয়াটা ভাল। তা করতে পার। পটার বোনহেডকে দিয়ে শুরু করগে। ওই লোকটাকে আমার বিশ্বাস হয় না।
পকেটের স্ফটিকটার কথা মনে পড়ে গেল মুসার। মনে হতে লাগল, আবার গরম হয়ে উঠছে ওটা।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। অলিংগারের অফিস থেকে বেরিয়ে কিশোরকে খুঁজতে লাগল মুসা।
এক ঘণ্টা খোঁজাখুঁজি করেও ওকে পেল না সে। সাউণ্ড স্টেজে নেই, ক্যাফেটেরিয়ায় নেই। কোথায় গেল? একটা সিনারি শপের মোড় ঘুরে আরেকটু হলেই ওর গায়ে হোঁচট লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল মুসা। খাইছে! বলে চিৎকার। করে উঠল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মেঝেতে চিত হয়ে আছে কিশোর পাশা। গলায় লাল, মোটা একটা গভীর ক্ষত। জবাই করলে যেমন হয়।