নবতারণ পথেই খবর পাচ্ছেন, বিজয়পুরের জমিদারমশাই মাধবের সন্ধানের জন্য পুরস্কারের টাকা বাড়িয়ে পঞ্চাশ হাজারে উঠেছেন।
সুতরাং নবতারণ দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে জঙ্গল তোলপাড় করে ফেলতে লাগলেন। কিন্তু হেতমগড়ের পাজি জঙ্গলও কিছু কম যায় না। অত সেপাই লোকলশকর সবই যেন ক্রমে-ক্রমে জঙ্গলের মধ্যে পরস্পরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে লাগল।
নবতারণের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত ছিল ভজহরি আর পুটিম। কিন্তু একসময়ে তারাও তাল রাখতে পারল না। নবতরণ সন্ধের মুখে-মুখে দেখলেন, তিনি ভয়াবহ জঙ্গলটায় একেবারে একা। ওদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। পথের চিহ্নও নেই। ঘোড়ার মুখে ফেনা উঠেছে।
ক্লান্ত নবতারণ একটা জলার ধারে ঘোড়া থামালেন। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে ঘোড়ার লাগাম ধরে খুব সাবধানে পাথরের চাইতে পা রেখে রেখে জলের ধারে গিয়ে দুজনে জল খেলেন। জল খেতে গিয়েই নবতারণ হঠাৎ দেখতে পেলেন কাদায় মানুষ আর বাঘের পায়ের ছাপ। তিনি বোক। লোক নন। বুঝলেন, আশপাশেই আসামীদের ঠিকানা মিলবে। বাঘকে তার বিশেষ ভয় নেই। সঙ্গে গুলিভরা দুটো রিভলভার আছে। আর আছে টর্চ।
নবতারণ ঘোড়ার পিঠে চেপে আস্তে-আস্তে চারদিকটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। এবং হঠাৎই তার নজরে পড়ল, একটা জামগাছে ভাঙা মৌচাকের দগদগে দাগ। তাজা মধুর ফোঁটা পড়ে মাটি ভিজে আছে। মধুর ফোঁটার একটা লাইনও গিয়ে জঙ্গলে ঢুকেছে। মধুর চিহ্ন ধরে এগিয়ে গেলেন অসম-সাহসী নবতারণ। দু-একবার ভুল পথে গেলেও অবশেষে দেখতে পেলেন, একটা পুরনো ইদারার মধ্যে একটা লতা নামানো রয়েছে।
নবতারণ নিঃশব্দে ঘোড়া থেকে নামলেন। লতাটার জোর পরীক্ষা করে নিশ্চিন্ত হয়ে নেমে পড়লেন ইদারার মধ্যে। টর্চের আলোয় সুড়ঙ্গের মুখটা পেতেও তাঁর দেরি হল না।
সুড়ঙ্গে ঢুকে টর্চ ফেলে ব্যাপারটা বুঝে নিতে তার মোটেই সময় লাগল না। লখনউয়ের ভুলভুলাইয়ায় তিনি বহুবার ঢুকেছেন। এ সুড়ঙ্গ সে-তুলনায় ছেলেমানুষ।
মাত্র মিনিট পনেরোর মধ্যেই তিনি গুপ্ত কুঠুরির দরজায় পৌঁছে ভিতরে টর্চের আলো ফেললেন এবং রিভলভার তুলে ধরে বললেন, “মাধববাবু! বনমালী! হাস আপ।”
দুই ফেরারি আসামী হাত তুলে বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল দেখে নবতারণ একটু আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বললেন, “কোনো চালাকি করার চেষ্টা করবেন না। আমার ফোর্স জায়গাটা ঘিরে ওপরে অপেক্ষা করছে। খুব সাবধানে হাত তুলে বেরিয়ে আসুন।”
ঠিক এই সময়ে মাধবের নাক দিয়ে নন্দকিশোর উঁকি মারে, “ছ্যাঃ ছ্যাঃ! এ যে একেবারে কেচ্ছা করলে হে মাধবচন্দ্র। তীরে এসে ভরাডুবি! তা ঐ ভিতুর ডিম দারোগাটাকে ভয় খাওয়ারই বা কী আছে? তুমি তো বাপু গায়েগতরে কিছু কম নও, লাফিয়ে পড়ে জাপটে ধরে পেড়ে ফেল না।”
মাধব ভয়ে ভয়ে বললেন, “কিন্তু আমার যে দারোগা-পুলিসকে ভীষণ ভয়!”
বিজ্ঞের মতো নন্দকিশোর বলে, “ভয়টা কোনো কাজের কথাই নয়। তোমার সাহসের থলি আমি ফুলিয়ে দিয়ে এসেছি। এখন যে ভয়টা পাচ্ছ সেটা আসল ভয় নয়, এ হল গিয়ে ভয়ের স্মৃতি।”
মাধব বললেন, “আজ্ঞে ঠিক ভয় নয় বটে। কিন্তু যেন সাহসও পাচ্ছি না। হাতে পিস্তল রয়েছে তো। তা আপনার গায়ে তো গুলি লাগে না শুনেছি, আপনিই কাজটা করে দিন না?”
একথায় রেগে গিয়ে নন্দকিশোর বলে, “সবই যদি আমি করে দেব তাহলে ভগবান তোমাকে হাত-পা-মগজ দিয়েছে কেন শুনি। আচ্ছা অপদার্থ তো! কতবার তো বলেছি, ভূতের ক্ষমতা সম্পর্কে যা শোনো তা সব গাঁজাখুরি গল্প।”
এইসব যখন হচ্ছে তখন বনমালী আর নবতারণ হাঁ করে মাধবকে দেখছে। নবতারণ বললেন, “মাধববাবু, আপনার নাক থেকে সাদা মতো ওটা কী ঝুলে আছে? নাকের পো নাকি?”
লজ্জিত হয়ে মাধব বললেন, “আজ্ঞে না। ইনি হলেন নন্দকিশোর মুনসি। অতি ভদ্র একজন ভূত। পাতুগড়ের আমবাগান থেকে আমার পিছু নিয়েছেন।”
“বলেন কী!” বলে চোখ কপালে তোলেন নবতারণ। নন্দ কিশোরের পাল্লায় তিনিও পড়েছিলেন। ফলে নবতরণের গায়ে কাঁটা দিল এবং হাত-পা অবশ হয়ে পড়ল। রিভলভারটা ঠকঠক করে কাপছিল হাতে।
মাধব তাই এগিয়ে গিয়ে খুব স্নেহের সঙ্গে নবতারণের হাত থেকে এবং খাপ থেকে দুটো রিভলভারই নিয়ে নিলেন। পিস্তল মাধবের হাতে যেতেই নিয়মমতে নবতারণ দুহাত ওপরে তুলে দিলেন। মাধব তাঁর হাত ধরে টেনে মেঝের ওপর বসিয়ে দিয়ে বললেন, “একটু বিশ্রাম করুন, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি বরং ওপরে আপনার ফোঁসকে খবর পাঠাচ্ছি।”
করুণ মুখ করে নবতারণ একটা শ্বাস ফেলে বললেন, “ফোর্স নেই। মিথ্যে কথা বলেছিলুম।”
“তাহলে?” মাধব জিজ্ঞেস করলেন।
নবতারণ বললেন, “আমি সারেণ্ডার করছি। কিন্তু আপনি একটু তাড়াতাড়ি করুন। আপনার স্ত্রী আত্মহত্যার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন।”
পরদিন সন্ধেবেল বিজয়পুরের জমিদারবাড়িতে কান্নার রোল উঠেছে। বাড়িভর্তি আত্মীয়-স্বজন। মেয়ে-জামাই ছেলেপুলে যে যেখানে ছিল সবাই ঝেটিয়ে এসেছে। রায়বাহাদুরের ছোট মেয়ে আর একটু বাদেই বিষ খাবে। মেয়ের ঘরের বন্ধ দরজার সামনে পড়ে আছেন মা, পিসি, মাসি, দাসীরা। রায়বাহাদুর নিজে বাইরের বারান্দায় খড়ম পায়ে পায়চারি করছেন। একটু আগেই মাধবের জন্য তিনি এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। উকিল, মোক্তার ডাক্তারে বাড়ি গিজগিজ করছে, কিন্তু কারও মুখে কথা নেই। বাইরের মস্ত আঙিনায় প্রজা এবং কর্মচারীরা জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সকলেরই কঁচুমাচু মুখ। খবর এসেছে, হেতমগড়ের জঙ্গলে নবতারণের পুলিস-বাহিনীর সবাই গায়েব হয়ে গেছে। কারও কোন খোঁজ নেই।
পরশুদিন থেকে পায়চারি করতে করতে রায়বাহাদুর এ পর্যন্ত বোধহয় পঞ্চাশ-ষাট ক্রোশ হেঁটে ফেলেছেন। এখন হাপসে পড়ে বারান্দায় আরামকেদারায় বসে হাঁক দিয়ে তামাক চাইলেন। বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল। অপদার্থ জামাইটার জন্য এক লাখ টাকা পুরস্কার খুবই বেশি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাও সেই ব্যাটার টিকির নাগাল পাওয়া গেল না। জামাইটাকে হাতের কাছে পেলে এখন খড়মপেটা করবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন। সেই সঙ্গে উজবুক নিষ্কর্মা নবতারণ দারোগাকেও দেশছাড়া করবেন। রাগে দুঃখে দাঁত কড়মড় করছিল তাঁর। তামাকের নলের মুখটা চিবিয়ে প্রায় ছিবড়ে করে ফেললেন। এখনো তার নামে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়, এখনো তিনি হক মারলে মাটি কেঁপে ওঠে, সেই তাকেই কিনা ঘোল খাওয়াচ্ছে অপোগণ্ড ভ্যাগাবণ্ড জামাই মাধব!
রাগের চোটে আবার হঠাৎ. দাঁড়িয়ে পায়চারি শুরু করতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় হঠাৎ খুব কাছেই বাজ পড়ার মতো একটা শব্দ হল, ভ্রাম! আর সঙ্গে সঙ্গে সামনের মাঠে ‘বাবা রে! মা রে! বলে খুব একটা শোরগোল তুলে লোকজন ছোটাছুটি করতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে ফাঁকা হয়ে গেল আঙিনা।
রায়বাহাদুর একটু চমকে উঠেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ভয় খাওয়ার বান্দা তিনি নন। বারান্দার দুধারে দুজন বন্দুকধারী দারোয়ান দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের একজন শব্দ শুনে মূর্ছা গেছে। তার বন্দুকটা তুলে নিয়ে রায়বাহাদুর সিঁড়ির মাথায় বুক চিতিয়ে দাঁড়ালেন।
এইসময়ে ফটক পার হয়ে আঙিনায় একটা জংলি চেহারার লোক এসে ঢুকল। তার দু হাতে দু-দুটো বন্দুক, কাঁধে একটা মস্ত বাঁদর, পাশে একটা বিশাল চিতাবাঘ। লোকটার হাবভাব বেশ বেপরোয়া। গটগট করে এসে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, “আমার স্ত্রীকে এক্ষুনি ফেরত চাই। সে যদি আত্মঘাতী হয়ে থাকে তবে এ-বাড়ির কাউকে জ্যান্ত রাখব না।”
রায়বাহাদুরের হাত-পা কাপছিল। বাঘটা তাঁর গা শুকছে। বাঁদরটা মুখ ভ্যাংচাচ্ছে। বন্দুকটা হাত থেকে খসে পড়ে গেল যখন দেখলেন, জামাইয়ের কানের লতি ধরে ঝুল খাচ্ছে বিঘতখানেক লম্বা সাদামতো একটা ভূত। রায়বাহাদুর হাতজোড় করে বললেন, “না, এখনো আত্মঘাতী হয়নি। এসস বাবাজীবন।”
বলা বাহুল্য, সেই রাতে শ্বশুরবাড়িতে আর মাধবকে কেউ সুপুরি-ভরা নাড় দেওয়ার সাহস পেল না। তবে দিলে খুব একটা অসুবিধেও হত না। কারণ নন্দকিশোরের হাতের গুণে মাধবের দিব্যি কচি-কচি দাঁত গজিয়ে গেছে। খুবই শক্ত দাঁত, আর ভারী সুরসুর করে সবসময়ে। শক্ত কিছু চিবোতে ইচ্ছে করে।
পরদিন থেকেই হেতমগড়ের জঙ্গল হাসিল করে পুরনো বাড়ির জায়গায় নতুন বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করলেন মাধব। অগাধ মোহর আর হীরে জহরত পেয়ে এখন তিনি এ-তল্লাটের সবচেয়ে বড়লোক। তাই বাড়ি তৈরি করেই ক্ষান্ত রইলেন না, মাধব। পুরনো হেতমগড় আবার গড়ে তুললেন। সড়ক বানালেন, পুকুর আর দিঘি কাটালেন, ইস্কুল-পাঠশালা খুলে দিলেন। হেতমগড় আবার জমজমাট হয়ে উঠল। হেতমগড়ের দারোগা হয়ে এলেন সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ নবতারণই। বনমালীর স্যাঙাতরা চাষবাস করে খায়, বনমালী নিজে মাধবের বাগান তদারক করে। সেই চিতাবাঘ, ঘটোৎকচ আর নন্দকিশোরও মাধবের বাড়িতেই আছে। তাদের আর কেউ ভয় খায় না।