ভৌতিক উপন্যাস
ভৌতিক গল্প

৬. দুর্ভেদ্য দুর্গ

।। ছয় ।। – দুর্ভেদ্য দুর্গ

বাড়িতে ভয়ের একটা কালো পর্দা নেমে এসেছে। নোটনের মা সব শুনেছেন। তিনি শুধুই বলেন, কী হবে গো? রাজু শেষ পর্যন্ত কলকাতাতেও ধাওয়া করে এল? তাহলে কি আমাদের বাড়িও খুঁজে পাবে?

এর উত্তর আমি আর কী দেব? যে ভি. আই. পি. রোড পর্যন্ত আসতে পেরেছে সে যে এখানেও আসবে না তা কী করে বলি? তাই চুপ করে থাকি।

মনে মনে এও বুঝেছি, যে আসছে সে এখন আর আমাদের আগের রাজু সুব্বা নয়, যেন অন্য কেউ—আরও হিংস্র—আরও ভয়ানক।

সকালবেলাতেই প্রণবেশ চলে এসেছে আমাদের বাড়ি। লক্ষ করছি ক্রমশই দুর্ভাবনায় ওর মুখের ভাব বদলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার চেয়ে যেন ওরই ভয় বেশি। ওই যেন আমাকে বাঁচাবার সব দায়িত্ব নিয়েছে। আর আমি? আমি যে কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। বন্ধুর ওপরই সব ছেড়ে দিয়ে বসে আছি।

প্রণবেশ সকালে এসেই দার্জিলিঙে অম্বুজ লাহিড়িকে ফোন করেছিল। উনি এখন দার্জিলিঙে রয়েছেন। কিন্তু উনি কোথায় বেরিয়েছেন। ঘণ্টাখানেক পরে আবার ফোন করা হবে।

অম্বুজবাবুকে যে এই পরিস্থিতিটা এখনই জানানো উচিত এটাও আমার মাথায় আসেনি। আমি পুলিশ অফিসার। তাই বোধ হয় ভেবে নিয়েছি, লালবাজার যখন দায়িত্ব নিয়েছে তখন আর ভাবনা নেই। ওরাই আমাকে বাঁচাবে। একটা অতি সত্য ব্যাপার যেন বুঝেও বুঝছি না যে, এটা খুনে ডাকাতের ব্যাপার নয় যে পুলিশ ব্যবস্থা করবে। এ যে কী বিস্ময়কর ব্যাপার তা তো কালকেই স্বচক্ষে দেখলাম। ভাঙা বাড়ির তিনতলার পাঁচিলে শুয়ে থাকতে না দেখলেও ছাদ থেকে বটগাছে লাফিয়ে পড়তে যাকে দেখলাম সে কি আমাদের গ্রামের বাড়ির সেই রাজু সুব্বাই! রাজুও ছাদের পাঁচিলের ওপর দিয়ে হাঁটত। ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আমগাছের ডাল ধরে ঝুলত ঠিকই কিন্তু সে যেন আমার ছেলে নোটনেরই বন্ধু। কিন্তু কাল যাকে মুহূর্তের জন্যে দেখলাম? তার তো মানুষের আকৃতিও নয়। চার ফুট লম্বা কালো একটা বস্তু। অথচ তারই ভারে অত বড়ো বটগাছটা কেঁপে উঠেছিল।

তাহলে গত দু—দিন ধরে গভীর রাতে রাস্তায় যাকে দেখা গিয়েছিল তার মানুষের আকৃতি ছিল। তার বর্ণনা শুনে মনে হয়েছিল সে রাজু সুব্বাই।

তাহলে কাল দুপুরে যাকে দেখা গেল সে কি অন্য কিছু? আর অন্য কিছুই যদি হয় তাহলে সেটা কি?

আশ্চর্য! এই সব প্রশ্ন যখন প্রণবেশকে করেছি ও কোনো উত্তরই দেয়নি। শুধু ওর কপালে দুশ্চিন্তার একটার পর একটা রেখা ফুটে উঠেছিল।

প্রণবেশ এতক্ষণ টেলিফোনের সামনে বসে একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছিল। এবার ঘড়িটা দেখল। বোধহয় এক ঘণ্টা হয়ে গেছে। ও টেলিফোনের দিকে হাত বাড়াল আর তখনই টেলিফোনটা বেজে উঠল। তাড়াতাড়ি রিসিভারটা তুলে নিয়ে সাড়া দিল, হ্যালো! হ্যাঁ, আমি প্রণবেশ। এক ঘণ্টা আগে আপনাকে ফোন করেছিলাম। তারপর ও সমস্ত ঘটনা বলে গেল।

টেলিফোনের শব্দ শুনে আমার স্ত্রীও এসে দাঁড়িয়েছেন, মুখে—চোখে একরাশ উদ্বেগ নিয়ে।

দার্জিলিং থেকে অম্বুজবাবু সব শুনে কিছু বলে যাচ্ছেন আর প্রণবেশ আমার প্যাডে খসখস করে তা লিখে নিচ্ছে।

প্রায় দশ মিনিট পর প্রণবেশ টেলিফোন রেখে আমার দিকে তাকাল। বলল, নষ্ট করার মতো আর একটা মিনিটও সময় নেই। শিগগির একজন ছুতোর ডাকো।

ছুতোর!

হ্যাঁ। অম্বুজবাবু বলছেন ভয়ংকর বিপদ। জীবন্ত কঙ্কালটা এখানে এসে পড়বেই। আর তা আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে। বাঁচার একমাত্র পথ—এর মধ্যে বাড়ির সমস্ত জানলা—দরজায় কাচ বসাতে হবে। অর্থাৎ কাচের দরজা—জানলা। আর জানলা—দরজার ফ্রেমও বদলাতে বলছেন। নতুন করে যে কাঠ দিতে বলছেন তা শুধু তিব্বতেই পাওয়া যায়। সে কাঠ এখানে পাওয়া সম্ভব নয়। তার বদলে নিমকাঠের ফ্রেম করা চলবে। কিন্তু সব জানলা—দরজার ফ্রেম এত তাড়াতাড়ি বদলানো যাবে না। তাই উনি বলছেন প্রত্যেক দরজা—জানলায় এক টুকরো নিমকাঠ লাগিয়ে দিতে। আর দরজা—জানলা রাত্তিরে কোনো কারণেই খোলা রাখা যাবে না।

আমি হাঁ করে ওর কথা শুনছিলাম। ও আমার হাত ধরে টান দিয়ে বলল, আর বসে থাকলে চলবে না। চলো ছুতোরের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ি।

বেলা দশটার মধ্যেই একসঙ্গে পাঁচজন ছুতোর এসে কাজে লেগে পড়ল। সারা দিন—রাত কাজ করবে। ডবলেরও বেশি মজুরি দিতে হবে। আমি তাতেই রাজি হয়েছি। সারা দুপুর কাঠ কাটা, হাতুড়ি ঠোকার খটাখট শব্দ। এদিকে পাড়ার লোকেও সন্ত্রস্ত। তারাও কাগজে জীবন্ত কঙ্কালের খবর পড়েছে। তিনি সল্টলেকের দিকে আসছেন এটা জেনেই ভয়ে কাঁটা। তারপর যখন শুনল কঙ্কালটার টার্গেট আমাদের এই বাড়িটা তখন তাদের মুখের কথাও বন্ধ হয়ে গেল। কঙ্কালটা তাহলে একেবারে তাদের বাড়ির পাশে এসে পড়বে! ভুল করে যদি অন্য কারও বাড়ি ঢুকে পড়ে? তারপর যখন তারা দেখল আমার বাড়ির দরজা—জানলা কাচের করা হচ্ছে তখন তাদের ভয় আরও বেড়ে গেল। আত্মরক্ষার জন্যে যদি একজন পুলিশ অফিসারের বাড়ির দরজা—জানলা হঠাৎ কাচ দিয়ে মুড়তে হয় তাহলে কী ভয়াবহ ঘটনা আজ—কালের মধ্যে ঘটতে চলেছে!

বিকেল চারটে।

আজ ছুটি নিয়ে জানলা—দরজায় কাচ লাগানোর তদারকি করছি—পাড়ার প্রৌঢ় উমেশ সান্যাল এসে দাঁড়ালেন। ভাবলাম আর—সবাইয়ের মতো উনিও বুঝি কাচ লাগানো দেখতে এসেছেন। কিন্তু না—তিনি ভারী গলায় বললেন, বিপদের ওপর বিপদ ডেকে আনতে চান?

আমি অবাক হয়ে তাকালাম। জিজ্ঞেস করলাম, কেন?

শখ করে না হয় ছাদের আলসেতে ফুলগাছের টব বসিয়েছেন। কিন্তু একটা টব যে আলসে থেকে ঝুলছে সে খেয়াল রেখেছেন? কারো মাথায় পড়লে কী হবে?

টবের কথায় চমকে উঠলাম। টবের সারি থেকে একটা টব যে খানিকটা বেরিয়ে এসেছিল ক’দিন আগে তা দেখেছিলাম। তারপর আর খেয়াল করিনি। উমেশবাবুর কথায় তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে যা দেখলাম তাতে চক্ষুস্থির! সেই টবটা লাইন ছেড়ে বেরিয়ে এসে একেবারে কার্নিশের ধারে পৌঁছেছে। আমি এতই ঘাবড়ে গেলাম যে উমেশবাবুর সামনেই চিৎকার করে উঠলাম—কেমন করে এটা সম্ভব?