৬. দুপুরে খাওয়ার পর

দুপুরে খাওয়ার পর সুযোগ পেলেই একটুখানি গড়িয়ে নেওয়া আমার অভ্যাস। পুরনো বাংলাটার্মে একে বলা হয় ভাতঘুম। সাংবাদিক জীবনে অফিসে সভাসম্মেলনে, এমন কি বিধানসভার চেয়ারে হেলান দিয়ে অনেককে নাক ডাকাতে দেখেছি। এই তো কিছুদিন আগে এক মন্ত্রীমশাইয়ের চেয়ারে শরীর এলিয়ে ঘুমুনোর ছবি আমাদের দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার প্রথম পাতায় বেরিয়েছিল। আমি কোন ছার।

ষষ্ঠীর ডাকে ভাতঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ঘরের ভেতর আবছা আঁধার। সোফা থেকে ধুড়মুড় করে উঠে বসলাম। ষষ্ঠী কফির পেয়ালা রেখে সুইচ টিপে বাতি জ্বালাল। তারপর মুচকি হেসে বলল–বাবামশাই আপনার ঘুম ভাঙাতে বারণ করেছিলেন। নিন। গরম-গরম কোফি খেয়ে বেরেন চাঙ্গা করুন।

বললাম–তোমার বাবামশাই কোথায়?

–বেইরেছেন। বলে গেছেন সাড়ে ছটার মধ্যেই ফিরবেন। আপনাকে অপিক্ষে করতে বলেছেন। যেতে যেতে ষষ্ঠীচরণ পিছু ফিরল। ফের বলল যেন চলে যাবেন না দাদাবাবু! তাহলে বাবামশাই আমাকে বকাবকি করবেন।

দেয়ালঘড়িতে ছটা বাজে। কফি খেতে খেতে সত্যি বেরেন চাঙ্গা হচ্ছিল। মনে পড়ে গেল, কর্নেল প্রসাদজির পি এ যোগীন্দ্র শর্মাকে তখন যেন অপমান করেই তাড়িয়ে দিলেন। কর্নেলের স্বভাব-চরিত্রের সঙ্গে এটা মানায় না। ভদ্রলোক কর্নেলকে অপমানজনক কোনও কথা তো বলেননি। চাকরির দায়ে মালিকের হুকুম পালন করতেই এসেছিলেন। তা হলে তাকে অমন করে ভাগিয়ে দিলেন কেন?

প্রায় মিনিট পনের পরে টেলিফোন বাজল। ওপাশের ঘর থেকে ষষ্ঠী বলল–ফোংটা ধরুন দাদাবাবু।

ফোন তুলে সাড়া দিয়েই কর্নেলের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম–ডার্লিং! আশাকরি ক্লান্তি দূর করার মতো একখানা ঘুম ঘুমিয়ে নিয়েছ। হ্যাঁ, এটা তোমার দরকার ছিল। কফি খাওয়াও শেষ হয়েছে। ব্রেনও চাঙ্গা।

–আপনি দিব্যদ্রষ্টা। সবই দেখতে পাচ্ছেন।

–হিসেব জয়ন্ত, হিসেব! আমি জানতাম তুমি একখানা লম্বা ঘুমই দেবে। তাই ষষ্ঠীকে বলে এসেছিলাম ঠিক ছটায় তোমাকে জাগিয়ে দিতে এবং..

ব্যাখ্যার দরকার নেই। আপনি কোথা থেকে ফোন করছেন?

–হাওড়া স্টেশন থেকে।

–সে কী! ওখানে কী করছেন?

–ফিরে গিয়ে বলবখন। তোমাকে রিং করার কারণ, হাওড়া স্টেশন এমন একটা জায়গা, যেখান থেকে বাড়ি ফিরতে কতক্ষণ সময় লাগবে বলা কঠিন। প্রচণ্ড জ্যাম দেখে এসেছি। এখন জ্যামটা আরও বেশি হওয়াই সম্ভব। কাজেই কথামতো সাড়ে ছটায় ফিরতে পারছি না। যতক্ষণ না ফিরি, তুমি যেন এ বৃদ্ধের ওপর খাপ্পা হয়ে চলে যেও না। তাছাড়া ডার্লিং, সেই লাল মারুতির খপ্পরে পড়তে পারো। সাবধান। লাল জুজু।

কথার ভঙ্গিতে হাসি পেল। বললাম–লাল জুজুর নয়। আপনার খাতিরে আমি অপেক্ষা করব।

আর একটা কথা। আমার কাছে কেউ গেলে তাকে শুধু বলবে, আমি বেরিয়েছি। ফিরতে দেরি হতে পারে। তবু যদি সে অপেক্ষা করতে চায়, বসিয়ে রাখবে। আপ্যায়নের যেন ত্রুটি না হয়।

–সে যদি সেই যোগীন্দ্র শর্মা হয়?

–হোক না।

ফোন ছেড়ে দিয়ে সিগারেট ধরালাম। টেবিল থেকে নেচার পত্রিকা তুলে নিলাম। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বোধগম্য কোনও নিবন্ধ খুঁজছিলাম। পেলামই না। এক সময় ষষ্ঠী পর্দার ফাঁকে মুখ গলিয়ে জানতে চাইল আর কোফি খাব কি না। খাব না শুনে তার মুখটা অদৃশ্য হয়ে গেল।

বরাবর লক্ষ্য করেছি, কারও জন্য প্রতীক্ষায় থাকার সময়টা বড্ড বিরক্তিকর। সেকেন্ডগুলো অসম্ভব দীর্ঘ হয়ে যায়। পৌনে সাতটায় ডোরবেল বাজল। কর্নেল ভেবেই ষষ্ঠী যাওয়ার আগে হন্তদন্ত উঠে গিয়ে দরজা খুললাম।

কর্নেল নন। একজন রোগা চেহারার বয়স্ক ভদ্রলোক। উস্কোখুস্কো চেহারা। মুখে ক্লান্তির গাঢ় ছাপ। আস্তে বললেন–আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

বললাম– কর্নেল সরকার একটু বেরিয়েছে ফিরতে দেরি হতে পারে।

–কিন্তু আমার যে খুবই জরুরি দরকার। কদিন থেকে টেলিফোনটা খারাপ। তাই ফোনে যে যোগাযোগ করব, তার উপায় নেই। তা ছাড়া ব্যাপারটাও কনফিডেনশিয়্যাল। তাই শেষ পর্যন্ত কষ্ট করে আসতে হল।

–আপনি কোথায় থাকেন?

বাগবাজার এরিয়ায়। এই আমার নেমকার্ড।

নেমকার্ডে লেখা আছে জে কে সেন। তার পাশে কোনও ডিগ্রির সাংকেতিক পরিচয়। নীচে বোল্ড টাইপে ছাপা : মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার। ব্র্যাকেটে রিটায়ার্ড। অমনি বনানীর কথা মাথায় ভেসে এল। দ্রুত বললাম বনানীর কোনও বিপদ হয়নি তো?

-উনি চমকে উঠলেন।–আপনি বনানীকে চেনেন?

চিনি। মানে, বনানী কর্নেলের কাছে এসেছিলেন। আপনি ভেতরে আসুন।

–আমি বনানীর বাবা। বলে ভদ্রলোক আমার সঙ্গে কর্নেলের ড্রয়িং রুমে এলেন। সোফায় বসে শাদা অবিন্যস্ত চুলে হাত বুলিয়ে ক্লান্তভাবে বললেন– আপনি কি কর্নেল সায়েবের ছেলে?

না। আমার নাম জয়ন্ত চৌধুরি। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক।

বনানীর বাবা নমস্কার করে বললেন–আমার সৌভাগ্য। আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালই হল। নিউজপেপারে এটা ফ্লাশ হওয়া দরকার। আজকাল পুলিশকে দিয়ে কিছু করানো কঠিন। নিউজপেপারে লিখলে অথরিটির যদি টনক নড়ে, একটা আসকারা হওয়ার চান্স থাকে।

উত্তেজনা চেপে বললাম–আপনি ব্যাপারটা খুলে বললে নিশ্চয় কাগজে ফ্লাশ করব।

বনানীর বাবা শ্বাস-প্রশ্বাসে মিশিয়ে বললেন, কিছুদিন থেকে কয়েকটা উড়োচিঠি পাচ্ছিলাম। তত গ্রাহ্য করিনি। বাড়িতে অবিবাহিতা মেয়ে থাকলে এ ধরনের চিঠি আজকাল আসে। আমার পাশের ফ্ল্যাটের এক ভদ্রলোকও পাড়ার মস্তানদের উড়ো চিঠির পাল্লায় পড়েছিলেন। শেষে মেয়ের বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত। হয়েছিলেন। কিন্তু আমার মেয়ে–একমাত্র মেয়ে, মোটামুটি ভাল একটা চাকরি করে এবং আমার স্ত্রী বেঁচে নেই কাজেই ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে তো আমি যেতে পারি না।

উড়ো চিঠিতে কী লেখা থাকে?

–সব চিঠিতে একই কথা। হারামজাদারা নীচের লেটারবক্সে ফেলে যায়। আপনাকে দেখাচ্ছি।

ভদ্রলোক বুকপকেট থেকে একটা খাম বের করে আমাকে দিলেন। খামটা মহাবীর ট্রেডিং এজেন্সির। খামটা নিশ্চয় বনানীর কাছে থেকে নিয়েছেন। খানপাঁচেক চিরকুট বেরুল ভেতর থেকে। লাল ডটপেনে লেখা একটিমাত্র বাক্য :

যতীনবাবু, বনানীকে বলবেন, আমার সঙ্গে যেন শিগগির দেখা করে।

একই হাতের লেখা। চিরকুটগুলো খামে ভরে বললাম বনানীকে আপনি এগুলো দেখিয়েছেন?

–নাহ্। দেখানো উচিত মনে করিনি। আসলে ও একটু জেদি আর সাহসী টাইপ মেয়ে। এ নিয়ে হইচই করবে, লোকেরা জেনে যাবে–এও একটা আশঙ্কার কারণ ছিল।

–তো এই সামান্য ব্যাপারে আপনি কর্নেলের কাছে ছুটে এসেছেন কেন? কাগজেই বা কী ফ্ল্যাশ করতে চাইছেন।

যতীনবাবু এতক্ষণে উত্তেজিতভাবে সোজা হয়ে বসলেন না। শুধু চিঠির ব্যাপারটা নিয়ে আমার ছুটে আসার কারণ ছিল না। আজ বিকেলে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় মোড়ে রাস্তা পার হওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ একটা গাড়ি আমার পাশে এসে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে একটা লোক বেরিয়ে চাপা গলায় আমাকে বলল, যতীনবাবু আপনার মেয়ে আমার সঙ্গে দেখা করছে না কেন? বাড়ি ফিরেই বলবেন আজ রাত নটার মধ্যেই যেন দেখা করে। বলে দেবেন, এটা আলটিম্যাটাম।

তারপর?

–আমি তো হকচকিয়ে গেছি। কিছু বলার আগেই লোকটা গাড়িতে ঢুকে পড়ল। তারপর গাড়িটা জোরে বেরিয়ে গেল। বাড়ি ফিরে বনানীর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। বনানীর ফিরতে দেরি হয়। কোনও দিন বেশি দেরি হলে ফোন করে জানিয়ে দেয়। তো আমার ফোনটা খারাপ। পাশের ফ্ল্যাটে অমরবাবুর ফোনটা ঠিক আছে। অমরবাবুর স্ত্রী এসে জানিয়ে যান আজ ওর ফিরতে দেরি হবে। ওঁদের ফ্ল্যাটে গিয়ে বনানীর অফিসে রিং করলাম। তখন প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে। বনানীর সাড়া পেয়ে ওকে শিগগির বাড়ি ফিরতে বললাম। ও বলল, ফিরতে দেরি হবে। অগত্যা ফোনে ওকে সংক্ষেপে ব্যাপারটা জানিয়ে দিলাম তখন ও কর্নেল সায়েবের ঠিকানা দিয়ে আমাকে শিগগির গিয়ে দেখা করতে বলল। আমি বললাম আজ যত দেরি হোক ওয়েট করবি। আমি গিয়ে তোকে নিয়ে আসব।

চুপচাপ শোনার পর বললাম–গাড়িটার নাম্বার দেখেছিলেন?

–না। ওই যে বললাম আমি ভীষণ হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। তবে গাড়িটা লাল রঙের একটা মারুতি।

চমকে উঠলাম।–লাল মারুতি?

–হ্যাঁ। লাল মারুতি।

–লোকটার চেহারা কেমন?

–বেঁটেমতো। মুখে দাড়ি আছে। বনানী কারও সঙ্গে হয় তো এমোশনাল সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। তারপর সম্পর্কটা ছিন্ন করেছে। তাই হয়তো সেই ছেলেটি ব্যাপারটা আমার কানে তোলার চেষ্টা করছে।

–যাকে দেখেছিলেন, তার চেহারা মনে আছে?

 চোখে কালো চশমা। বয়স আন্দাজ করা কঠিন। তবে গলার স্বরে মন হল ইয়ং নয়।

আমার মনে পড়ে গেল মহাবীর ট্রেডিং এজেন্সির করিডোরে দেখা ঠিক এই রকম চেহারার লোকটার কথা। নীচের পার্কিং জোনে তার গাড়িটাই তা হলে পার্ক করা ছিল। কে সে?

যতীনবাবুর জন্য ষষ্ঠীকে কফি আনতে বললাম। তারপর যতীনবাবুকে বললাম–আপনি বনানীর অফিসে রিং করে দেখুন তো উনি আছেন কি না।

যতীনবাবু ব্যস্তভাবে উঠে গিয়ে ডায়াল করলেন। তারপর সাড়া পেয়ে ইংরেজিতে বললেন-বনানী সেনকে দেবেন প্লিজ? আমি ওর বাবা জে কে সেন বলছি।….বেরিয়ে গেছে?….কতক্ষণ আগে?…..আচ্ছা, ধন্যবাদ।

ফোন রেখে যতীনবাবু বিষণ্ণ ভঙ্গিতে বললেন-বনানী মিনিট পাঁচেক আগে অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে। খুব ভাবনায় পড়ে গেলাম। ওকে বলেছিলাম, কর্নেল সায়েবের সঙ্গে দেখা করে ওর অফিসে যাব। অদ্ভুত মেয়ে তো।

–আচ্ছা যতীনবাবু, আপনি ইন্দ্রজিৎ রায় নামে কাকেও চেনেন?

–ইন্দ্রজিৎ রায়? যতীনবাবু ভুরু কুঁচকে স্মরণ করার চেষ্টা করছিলেন। একটু পরে বললেন–নামটা শুনেছি মনে হচ্ছে। কে সে?

–কালকের কাগজে তার খবর বেরিয়েছিল।

কী খবর বলুন তো?

স্যুইসাইড করার খবর।

 যতীনবাবু শ্বাস ফেলে বললেন–কিছুদিন থেকে খুঁটিয়ে খবর পড়া হয় না। উড়ো চিঠির ঝামেলায় অস্থির ছিলাম। তা ইন্দ্রজিৎ রায়ের কথা কেন জিজ্ঞেস করছেন জানতে পারি?

–আপনার মেয়ে তাকে চেনেন।

যতীনবাবু একটু অবাক হলেন।–আই সি! একজন ভদ্রলোক বনানীর সঙ্গে কিছুদিন আগে দেখা করতে গিয়েছিলেন মনে পড়ছে। বনানীর অফিসের কাজেই গিয়েছিলেন। তিনিই সুইসাইড করেছেন না কি? এখানে কালকের কাগজ আছে? খবরটা পড়া উচিত। বলে মাথার চুলে হাত বুলিয়ে স্বগতোক্তি করলেন–হ্যাঁ, ইন্দ্রজিৎ রায়। মনে পড়েছে এবার।

ষষ্ঠী কফির ট্রে রেখে গেল। বললাম–আগে কফি খেয়ে নিন। আমি কাগজটা খুঁজে দেখি।

কাগজটা খুঁজে পেলাম না। সম্ভবত কর্নেল ওটা কোথায় রেখে দিয়েছেন। যতীনবাবু কফি খাওয়ার পর বললেন–একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না। বনানী কেন কর্নেলসায়েবের কাছে এসেছিল? আর কর্নেল সায়েবের কাছে আমাকেই বা পাঠাল কেন? কর্নেলসায়েবের সঙ্গে কি হাবীর ট্রেডিং এজেন্সির কোনও সম্পর্ক আছে? বড্ড মিসটিরিয়াস ব্যাপার। বনানী কী যে করে আমি বুঝি না। একটু হেসে বললাম–অপেক্ষা করুন। উনি এলেই সব জানতে পারবেন।

কর্নেল এলেন প্রায় আধঘণ্টা পরে। কিন্তু ওঁর সঙ্গে যে এল, তাকে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। যতীনবাবুও অবাক হয়ে বললেন–বনি! তোর অফিসে ফোন করেছিলাম।

বনানী গম্ভীর মুখে বলল–কর্নেল সায়েবের সঙ্গে বেরিয়েছিলাম। আলাপ করিয়ে দিই, ইনিই কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

যতীনবাবু আড়ষ্টভাবে নমস্কার করলেন। কর্নেল হাঁকলেন–ষষ্ঠী! শিগগির কফি। তারপর ইজিচেয়ারে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–হাওড়া স্টেশনে কুঞ্জবাবুদের সি অফ করতে গিয়েছিলাম। অনেক সাধাসাধি করে একটা শেয়ারের ট্যাক্সিতে এসপ্ল্যানেড–তারপর সোজা বনানীদের অফিসে। বনানী কাজের ছলে আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল। তারপর ওকে নিয়ে মিমিদের বাড়ি গেলাম। গিয়ে শুনি, আজ সন্ধ্যাতেও ওদের বাড়িতে চোর ঢুকেছিল। তাড়া খেয়ে পালিয়ে গেছে। পর-পর-দুদিন সন্ধ্যায় একই বাড়িতে চোর ঢোকাটা। ভারি অদ্ভুত।

পরমেশবাবুর বাড়িতে পর-পর দুদিন ঠিক সন্ধ্যাবেলায় চোর ঢোকা নিশ্চয় অদ্ভুত। কিন্তু তার চেয়ে অদ্ভুত বনানীর বাবাকে লেখা উড়োচিঠি এবং সেই লাল মারুতির উপদ্রব। খামসমেত চিঠিগুলো কর্নেলকে দিলাম। কর্নেল চিঠিগুলো দেখার পর বনানীকে বলেলেন–দেখ তো, হাতের লেখা চেনা মনে হচ্ছে না কি?

বনানী চিঠিগুলোয় দ্রুত চোখ বুলিয়ে বলল–নাহ্। কিন্তু এগুলোর কথা আমাকে বাবার বলা উচিত ছিল।

যতীনবাবু ব্যস্তভাবে বললেন–তোকে তখন ফোনে বললাম তো! আমি ভেবেছিলাম পাড়ার কোনও মস্তান আমার থ্রু দিয়ে তোকে টিজ করছে। বলে পুরো ঘটনাটি তিনি সবিস্তারে কর্নেলকে শোনালেন।

বনানী কর্নেলের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। কর্নেল বললেন–তুমি তখন সঠিক প্রশ্নই তুলেছিলে। তোমার বাবাকে লোকটা প্রকারান্তরে হুমকি দিচ্ছে। উনি যেন ভয় পেয়ে তোমাকে তার সঙ্গে দেখা করতে পীড়াপীড়ি করেন।

বনানী রুষ্টভঙ্গিতে বলল–তার জানা উচিত বাবা আমাকে কোনও ব্যাপারে বাধ্য করতে পারেন না।

–স্বীকার করহি পারেন না। কর্নেল একটু হেসে বললেন ফের–কিন্তু সে ভেবেছিল, প্রথম চিঠিটা পেয়েই তোমার বাবা তোমাকে দেখাবেন। তুমি বিব্রত বোধ করবে। যে লোকটা তোমার অফিসে টেলিফোনে প্রায়ই দেখা করতে বলেছে, অথচ তুমি তার কথা গ্রাহ্য করোনি, সে তখন তোমার বাবাকে উড়োচিঠি লিখতে শুরু করেছে। তাতেও কাজ হল না দেখে তোমার বাবাকে আজ মুখোমুখি হুমকি দিয়ে গেছে। বনানী, এই হুমকির একটাই অর্থ হয়।

যতীনবাবু শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন–লোকটা বলল, ওকে বলে দেবেন, এটা আলটিম্যাটাম।

কর্নেল বলবেন–হ্যাঁ। আলটিম্যাটাম। চরম হুমকি। তার মানে, আজ রাত নটার মধ্যেই তার সঙ্গে বনানী দেখা না করলে সে সাংঘাতিক কিছু করবে। বনানী, আমি আশঙ্কা করছি, তোমার বাবা বিপন্ন।

বনানী চমকে উঠল। যতীনবাবু নিষ্পলক চোখে পাথরের মূর্তির মতো তাকিয়ে রইলেন। আমি এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলাম। এবার বললামকর্নেল! আপনি পুলিশকে বললেই তো লাল মারুতির মালিককে মোটর ভেহিক ডিপার্ট থেকে খুঁজে বের করতে পারবে।

 কর্নেল বললেন–পুলিশ খোঁজ নিয়েছে। নাম্বারটা ভুয়া। তোমার এবং আমার দেখা নম্বরের লাল মারুতির মালিক নামী একজন প্রাক্তন ফুটবল প্লেয়ার। এখন কোচ হিসেবে কাজ করেন। নামটা তুমি শুনে থাকবে। বিশ্বনাথ ব্যানার্জি। ফুটবল অন্ত প্রাণ যাকে বলে। তাঁর সম্পর্কে পুলিশের কোনও খারাপ রেকর্ড নেই। বাই দা বাই, যতীনবাবু কি লাল মারুতিটার নাম্বার লক্ষ্য। করেছিলেন?

যতীনবাবু বললেন– না। আমি খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। গাড়ির নাম্বারের দিকে তাকানোর মতো মানসিক অবস্থা ছিল না। কিন্তু আমি বিপন্ন বলছেন কেন কর্নেলসায়েব? আমি তো জীবনে কারও কোনও ক্ষতি করিনি। তা ছাড়া এ-ও বুঝতে পারছি না, বনিকেই বা ওই লোকটা ওভাবে দেখা করতে বলবে কেন? বনিকে সে অফিসে গিয়ে কিংবা আমার বাড়িতে নিজেই দেখা করতে পারে। রাস্তাঘাটেও দেখা করতে পারে।

ষষ্ঠী কফি আনল। কর্নেল কফিতে মন দিলেন। বনানী হাত নেড়ে ষষ্ঠীকে জানিয়ে দিল সে কফি খাবে না। আমি বললাম–যতীনবাবু। দেখা করতে বলার নিশ্চয় কোনও অন্য মানে আছে। দেখা করাটা নিছক দেখা করা নয়। সেটা যে কী, সম্ভবত বনানীই জানেন।

যতীনবাবু তার মেয়ের দিকে তাকালেন। বনানী মুখ নামিয়ে রইল। কর্নেল মুচকি হেসে বললেন–তোমাকে গোয়েন্দা হালদার মশাইয়ের চেলা হতে বলেছিলাম জয়ন্ত! তুমি ওঁর সঙ্গী হলেই পারতে। সাংবাদিকরা অনেকসময় গোয়েন্দারীতিতে কাজ করে বটে, তবে তার স্থানকালপাত্র আছে।

কর্নেলের কথায় একটু ভড়কে গিয়ে বললাম–আমি কোথায় গোয়েন্দাগিরি করলাম? নেহাত একটা ধারণা মাথায় এল।

কর্নেল যতীনবাবুর দিকে ঘুরে বললেন–আপনাকে বিপন্ন বলেছি। এ জন্য আপনার ভয় পাওয়ার কারণ নেই। বনানী যদি লোকটার কথামতো আজ রাত নটায় তার সঙ্গে দেখা করে, তা হলে আর আপনি বিপন্ন থাকছেন না।

যতীনবাবু নার্ভাস মুখে বললেন তার সঙ্গে কোথায় বনিকে দেখা করতে হবে তা তো আমাকে বলেনি সে। বনিকে সে টেলিফোন করেছিল বললেন। টেলিফোনে কি বলেছিল কোথায় দেখা করতে হবে?

–মেট্রো সিনেমার সামনে। এবং সময়ও রাত নটা।

 যতীনবাবু মেয়ের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন বনিকে আপনি দেখা করতে বলেছেন?

বলেছি। এখনও বলছি। কিন্তু একটা সমস্যা আছে। বনানীর দেখা করতে যাওয়াটা আপনার ওপর নির্ভর করছে।

–আপনি ওকে গার্ড দিলে আমার আপত্তির কারণ নেই।

কর্নেল বললেন। বনানী যে আপনার আপত্তি মানবে না, তা তো আপনি ভাল বোঝেন। একটু আগে সে-কথা বনানী নিজেই বলেছে। অথচ সমস্যাটা থেকে যাচ্ছে।

কী সমস্যা?

কর্নেল কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে চুরুট ধরালেন। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন–ইন্দ্রজিৎ রায়কে আপনার চেনার কথা। সে বনানীর সঙ্গে আপনার ফ্ল্যাটে গিয়েছিল। তা ছাড়া মাঝে মাঝে বনানীকে চিঠি লিখত।

যতীনবাবু আস্তে বললেন–হ্যাঁ। এই সাংবাদিক ভদ্রলোকের কাছে শুনলাম, সে নাকি সুইসাইড করেছে।

–ইন্দ্রজিতের ব্রিফকেসে বনানীর লেখা একটা চিঠি আমি পেয়েছি। বলে কর্নেল টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা খাম বের করলেন। বনানীকে সেটা দেখিয়ে বললেন–তোমার চিঠি। খামে তোমার হস্তাক্ষর। তাই না? শংকর হাজরা নামেই ইন্দ্রজিৎ বাহারিনের মানামায় ছিল। কাজেই সেই নামে তুমি চিঠি লিখতে।

বনানী শুধু মাথা নাড়ল। তাকে হতচকিত দেখাচ্ছিল।

–এই চিঠিতে তুমি ইন্দ্রজিৎকে লিখেছিলে,… হ্যাঁ, সেই গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকু পড়ে শোনাচ্ছি। বলে কর্নেল টেবিলবাতির সুইচ অন করে দিলেন। তারপর চিঠিটা বের করে দ্রুত চোখ বুলিয়ে পরের পাতায় গেলেন। আমার সন্দেহ, বাবা আমার চিঠি খুলে পড়েন। তুমি আর বাড়ির ঠিকানায় চিঠি লিখবে না। অফিসের ঠিকানাতেও লেখা ঠিক নয়। বরং মিমির কেয়ার অবে চিঠি পাঠাবে। মিমিকে আমি বলে রাখব। তুমি লিখেছ, আগের লেখা চিঠির সঙ্গে তোমার কোন বন্ধুকে লেখা একটা মেসেজ ছিল। আমি কিন্তু চিঠিটাই পাইনি। বাবাকে জিজ্ঞেস করেছি। বাবা কেন রেগে গেলেন বুঝতে পারছি না। যাই হোক, তোমার বন্ধুকে সরাসরি তার ঠিকানায় মেসেজ পাঠানোর কি কোনও অসুবিধা আছে? যদি থাকে, আমার চিঠির সঙ্গে আবার পাঠিও। আমি পৌঁছে দেব। কর্নেল চিঠি ভাঁজ করে খামে ঠোকালেন। তারপর যতীনবাবুর দিকে তাকালেন।

যতীনবাবু পাথরের মূর্তির মতো বসে ছিলেন। এবার ঠোঁট ফাঁক করে কিছু বলার জন্য। কিন্তু বললেন না। বনানী ঠোঁট কামড়ে ধরে মুখ নামাল।

কর্নেল বললেন–যতীনবাবু। আপনার মেয়েকে লেখা ইন্দ্রজিতের চিঠিটা আপনি রাগের বশে ছিঁড়ে ফেলতেই পারেন। কিন্তু ইন্দ্রজিতের বন্ধুকে লেখা মেসেজটি না ছেঁড়ারই কথা। আমি অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ছি না যতীনবাবু! আমার যুক্তিবোধ আমাকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিচ্ছে।

এবার যতীনবাবু গোমড়ামুখে শার্টের ভেতর পকেট থেকে একটা হলদে রঙের ভাঁজ করা কাগজ বের করলেন। তারপর সেটা কর্নেলের দিকে এগিয়ে দিলেন। তার হাত কাঁপছিল। গলার ভেতর বললেন–এক চোর আরেক চোরকে চিঠি লিখছে। পড়ে দেখলেই বুঝবেন কেন আমি ওটা ছিঁড়ে ফেলিনি। পুলিশের হাতে তুলে দিতাম। শুধু বনির কথা ভেবেই

বনানী ফুঁসে উঠল। তা হলে সত্যি তুমি আমার চিঠি খুলে পড়তে?

 যতীনবাবু অমনি খাপ্পা হয়ে গেলেন। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললেন–ওই বখাটে হারামজাদার কথা মিমি ধানবাদে থাকতে আমাকে অসংখ্যবার বলেছে। আমি ওর হিস্ট্রি আদ্যোপান্ত জানি। মিমির মায়ের কাছেও কম কেচ্ছা শুনিনি। সেই হতচ্ছাড়াকে সঙ্গে করে একদিন তুই যখন গেলি, আমি ইচ্ছে করেই সব চেপে গিয়েছিলাম। কিন্তু মনে মনে ঠিক করেছিলাম আর নয়। এবার তোকে মুখোমুখি সাবধান করে দেব। ওর সব কীর্তি ফাঁস করে দেব।

কর্নেল কাগজটা পড়ছিলেন। বললেন–প্লিজ যতীনবাবু, উত্তেজিত হবেন না।

যতীনবাবুর মধ্যে যেন এতদিনের চাপা রাগের বিস্ফোরণ ঘটেছিল। উঠে। দাঁড়িয়ে বললেন–ভাববেন না, ওটা আমি কোনও অসৎ উদ্দেশ্যে এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলাম। একদিন-না-একদিন ওটা পুলিশের হাতেই তুলে দিতাম। এবার আপনারা ওটা নিয়ে যা খুশি করুন, আমার মাথাব্যথা নেই। শুধু একটা অনুরোধ, আমার নির্বোধ মেয়ে যেন বিপদে না পড়ে–অনুগ্রহ করে একটু দেখবেন। বনানীর বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল কাগজটা ভাজ করে পকেটে ঢুকিয়ে ঘড়ি দেখে বললেন–মিনিট কুড়ি পরে আমরা বেরুব। তার। আগে একটা জরুরি টেলিফোন করে নিই।

কর্নেল টেলিফোনের ডায়াল করতে থাকলেন। সেই ফাঁকে বনানীকে জিজ্ঞেস করলাম–আচ্ছা মিস সেন, ইন্দ্রজিৎবাবু কলকাতায় আসার পর ওঁর বন্ধুকে পাঠানো ওই মেসেজ সম্পর্কে আপনাকে কিছু বলেননি?

বনানীকে আড়ষ্ট দেখাচ্ছিল। একটু চুপ করে থেকে বলল–না।

আপনি কিছু জিজ্ঞেস করেননি?

–আমার মনে পড়েনি।

–আপনাকে টেলিফোনে কেউ দেখা করতে বলছে, ইন্দ্রজিৎকে কি সেটা জানিয়েছিলেন?

বনানীর মুখে বিরক্তিকর ছাপ ফুটে উঠল। আপনি তো সাংবাদিক। আজকাল ইভটিজিং কতভাবে হয় আপনার জানার কথা। আমি ন্যাচারালি কোনও ইভ-টিজারের কথাই ভেবেছিলাম। তাই ওনিয়ে মাথা ঘামাইনি।

ওঁর কথায় যুক্তি আছে। কাজেই চুপ করে গেলাম। কর্নেল টেলিফোনে চাপা গলায় কার সঙ্গে কথা বলার পর ঘুরে বসলেন। একটু হেসে বললেন–জয়ন্তের মুখ দেখে বুঝছি, ইন্দ্রজিতের মেসেজে কী আছে জানার জন্য অস্থির হয়েছ। বনানীরও কৌতূহল জাগা স্বাভাবিক। তবে বনানীর বাবা বলে গেলেন, এক চোর আরেক চোরকে চিঠি লিখছে। এ থেকে দুজনেই আঁচ করতে পারছ মেসেজে কী থাকা উচিত। বিশেষ করে দুজনেই যখন মানামার মুক্তোব্যবসায়ী শেখ সায়েবের মুক্তোচুরির কথা জানো। জয়ন্ত গোড়া থেকেই জানো। বনানী জেনেছে আজ সন্ধ্যায় আমার কাছে।

বনানী কিছু বলার আগেই আমি বললাম–ইন্দ্রজিতের সেই বন্ধুর নাম ঠিকানা ওতে নিশ্চয় আছে?

–আছেই তো। না থাকলে বনানী তাকে মেসেজ পৌঁছে দেবে কেমন করে?

কে সে?

 বনানীও আমার প্রশ্নের সঙ্গে বলে উঠল–তা হলে সে-ই আমাকে মেট্রো সিনেমার সামনে দেখা করতে বলছে। আপনি আগেই তাকে পুলিশে ধরিয়ে দিন।

কর্নেল চুরুট অ্যাশট্রেতে গুঁজে বললেন ইন্দ্রজিতের সেই বন্ধুর তোমাকে ওভাবে দেখা করতে বলার কারণ থাকতে পারে না। ইন্দ্রজিৎ সম্প্রতি কলকাতা এসেছিল। তার সেই বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়া স্বাভাবিক। কাজেই মেসেজটার আর কোনও গুরুত্ব তার বন্ধুর কাছে থাকার কথা নয়।

বললাম–সেই বন্ধুটি কে?

–মহাবীর ট্রেডিং এজেন্সির ডেটা রিসার্চ সেকশনের ইনচার্জ এবং বনানীর বস্ ডঃ সুন্দরম।

বনানী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বললাম–তা হলে বলতে চান, কোনও থার্ড পার্টি মেসেজটা হাতাতে চাইছে?

–ঠিক তাই! ভারতে বিদেশ থেকে প্রাকৃতিক মুক্তো আমদানি নিষিদ্ধ। চোরাপথে আসে। সুন্দরম তার কোম্পানির সুযোগ নিয়ে গোপনে ব্যক্তিগতভাবে দালালি করেন। ইন্দ্রজিৎ তাঁকে খদ্দের ঠিক করতে বলেছিল। কাজেই ইন্দ্রজিতের চিঠিটা হাতাতে পারলে ডঃ সুন্দরমকে ব্ল্যাকমেল করা যাবে। ভেবে দেখ জয়ন্ত! ডঃ সুন্দরমের ওপর গণেশলাল প্রসাদের বিশ্বাস নষ্ট হবে এবং তার চাকরি যাবে। কিন্তু এর চেয়ে সাংঘাতিক বিপদ হল, কাস্টমস এবং সি বি আই জানতে পারলে ডঃ সুন্দরমকে জেল খাটতে হবে। কাজেই কেউ ডঃ সুন্দরমকে ব্ল্যাকমেল করার জন্যই চিঠিটা হাতাতে চাইছে।

–কিন্তু ইন্দ্রজিতের চিঠিটার কথা কোনও থার্ডপার্টি জানল কী করে?

 কর্নেল বনানীর দিকে তাকালেন-বনানী, অনেক সময় আমরা জানি না যে আমরা কী জানি। তুমি মিমির কেয়ার অবে ইন্দ্রজিৎকে চিঠি লিখতে বলেছিলে। তারপর নিশ্চয় মিমিকে জানিয়েছিলে ইন্দ্রজিতের চিঠি তার কেয়ার অবে আসবে?

বনানী বলল–হ্যাঁ। বাবার ওই কুঅভ্যাসের কথাও বলেছিলাম।

–ইন্দ্রজিতের একটা চিঠি তুমি যে পাওনি, সে-কথাও কি বলেছিলে?

 বনানী একটু ভেবে নিয়ে বলল-বলেছিলাম। কিন্তু মিমি–

ওর কথার ওপর আমি বললাম–কর্নেল! মিমি কথাটার গুরুত্ব না বুঝেই হয়তো কোনও বয়ফ্রেন্ডকে বলেছিল। সেই বয়ফ্রেন্ডই থার্ডপার্টি। মিমিকে চার্জ করা উচিত।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন–চার্জ করার সময় পরে পাওয়া যাবে। চলো, বেরিয়ে পড়া যাক। আমার এই মার্কামারা চেহারা নিয়ে তোমার গাড়ি থেকে বেরুব না। তুমি–নাহ্। তোমারও বেরুনোর দরকার নেই। আমরা কাছাকাছি। থাকব। বনানী! একটুও ভয় পেয়ো না। কেউ এসে তোমার সঙ্গে কথা বললে তুমি এটা তার হাতে দেবে। দিয়েই কিন্তু চলে আসবে আমাদের গাড়িতে। যা কিছু ঘটুক, তুমি পিছু ফিরে দাঁড়াবে না। সাবধান।

কর্নেল পকেট থেকে ভাঁজ করা সেই হলুদ কাগজটা বনানীকে দিলেন। বনানী সেটা পার্সে ঢোকাল। তারপর আমরা বেরিয়ে পড়লাম। পথে যেতে যেতে কর্নেল বনানীকে জানিয়ে দিলেন আমাদের গাড়ি থাকবে মেট্রো সিনেমার সামনা সামনি উল্টো দিকের ফুটপাতের কাছে।

এস এন ব্যানার্জি রোডের মোড়ে বনানীকে গাড়ি থেকে নামতে বললেন কর্নেল। বনানী নেমে গেলে ডাইনে গাড়ি ঘুরিয়ে চৌরঙ্গীতে গেলাম। মেট্রো সিনেমার সামনা সামনি পশ্চিমে পার্কিং জোনে গাড়ি দাঁড় করলাম। রাস্তায় গাড়ির ভিড়। সিনেমা হলের সামনে কিছু ঘটলেও দেখার উপায় নেই। আমি উদ্বিগ্ন। কিন্তু কর্নেল টুপির আড়ালে চুরুট টানছেন নির্বিকারভাবে।

কতক্ষণ পরে দেখলাম বনানী হন্তদন্ত এগিয়ে আসছে। অনেকগুলো চলন্ত গাড়ি এড়িয়ে সে আমাদের গাড়ির কাছাকাছি এসে পড়ল। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে আমাদের গাড়ি খুঁজতে থাকল। আমি চাপা স্বরে ডাকলাম–মিস সেন! তখন সে গাড়িটা চিনতে পারল।

গাড়িতে ঢুকেই সে উত্তেজিতভাবে বলল–বেঁটেমতো একটা লাল শার্টপরা লোক। মুখে দাড়ি আছে। আমাকে দেখে সে এগিয়ে এসে হাই করল। আমি আপনার কথামতো তার হাতে চিঠিটা দেবার জন্য পার্স খুলেছি, হঠাৎ কজন লোক ভিড় থেকে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অমনি আমি চলে এলাম। চিঠিটা দেওয়া হল না। এই নিন।

কর্নেল চিঠিটা নিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে বললেন–চলো জয়ন্ত! বনানীকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।…