৬. দুটি রাত প্রায় বিনিদ্র

দুটি রাত প্রায় বিনিদ্র কেটেছে বাবু মিত্তিরের। ছেলের খবর যাওবা পেলেন, কপালের দোষে সেই ছেলেও পড়ে গেল ডেল্টার খপ্পরে। বারবার ট্রাঙ্ককল করছেন আমেদাবাদে। রকির অফিস থেকে জানাচ্ছে, তারা কোনও খবর জানে না। রকি কিছু না জানিয়েই নিরুদ্দেশ হয়েছে। এর অর্থ একটাই হতে পারে। রকি এখন ডেল্টার খপ্পরে। হয় মেরে ফেলেছে, না হলে গুম করেছে। হয়তো মুক্তিপণ হিসেবে ডলার ফেরত চাইবে। ডলার ফেরত দিলেও শেষ অবধি যে রকিকে তারা জ্যান্ত ছাড়বে না তা বাবুর চেয়ে ভাল আর কে জানে!

পরশুই তিনি আমেদাবাদ রওনা হতে চেয়েছিলেন। পলাশ বাধা দিয়ে বলেছে, “ওটা আপনার অচেনা শহর, কোথায় খুঁজবেন তাকে? তা ছাড়া কিডন্যাপ করলেও তারা নিশ্চয়ই আটঘাট বেঁধেই করেছে। আপনি শুধু-শুধু হয়রান হবেন কেন? বরং মাথা ঠাণ্ডা রেখে চিন্তা করুন।”

আজ সকালে আমেদাবাদে আবার টেলিফোন করে একটা সুখবর পেলেন বাবু মিত্তির। রকি নাকি তার অফিসের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেছিল কাল। কোথায় আছে বা গেছে তা বলেনি। শুধু বলেছে, সে কিছুদিন ছুটি চায়। এটা সুখবর বটে, কিন্তু দুশ্চিন্তাও আছে। রকি যদি কলকাতায় তাঁর কাছেই আসবার জন্য রওনা হয়ে থাকে তা হলে কী হবে? আজ সকাল থেকে এই দুশ্চিন্তায় তাঁর বুক কাঁপছে, গলা শুকিয়ে আসছে। মড়ার মতো পড়ে আছেন বসবার ঘরের ইজিচেয়ারে।

পলাশ ঘরে ঢুকে তাঁর হাতে এক টুকরো কাগজ দিয়ে বলল, “কাকাবাবু, আপনার পায়রা এসেছে।”

বাবু মিত্তির চমকে উঠে বললেন, “পায়রা! তুমি পায়রার কথা জানলে কীভাবে?”

পলাশ ম্লান একটু হেসে বলে, “আপনি আমাকে যে পুরোপুরি বিশ্বাস করেন না তা আমি জানি। আপনার মতো অবস্থায় আমিও করতাম না। তবে আমি তো চারদিকে নজর রাখি। তাই পায়রার কথা জানতে অসুবিধে হয়নি।”

বাবু মিত্তির চিরকুটটা পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “কালী আমাকে বাঁচাতে চাইছে। কিন্তু আমার মৃত্যুটা আমার কাছে গৌণ হয়ে গেছে। আমার ছেলেটাকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে পারি তবে সেটাই হবে আমার বেঁচে থাকা। এখন ভয় হচ্ছে, রকি না আমার কাছে চলে আসে!”

পলাশ ভ্রূ কুঁচকে বলে, “রকি আপনার কাছে আসবে বলে আমার মনে হয় না। ডেল্টার বিপদ সম্পর্কে কেউ তাকে অ্যালার্ট করেছে। আর সেজন্যই সে একচুলের জন্য বেঁচে গেছে। রকি পালিয়েছে।”

“কী করে বুঝলে?”

“না পালালে সে গতকাল অফিসে ফোন করত না। আর আগে থেকে খবর না পেলে সে পালাতও না। আপনার মাথা এখন ভালভাবে কাজ করছে না। করলে এই সহজ ইকুয়েশনটা আপনিই কষতে পারতেন।“

“রকি তা হলে কোথায় যেতে পারে?”

“রকির চিঠিটা ভাল করে আবার পড়ন, তা হলেই বুঝতে পারবেন।”

“তুমি বুঝতে পেরেছ?”

“বোধ হয় আন্দাজ করতে পারছি। রকিকে আগে থেকে অ্যালার্ট করেছেন সম্ভবত আপনার বন্ধু কালীপ্রসাদ। এবং খুব সম্ভব রকি এখন কালীপ্রসাদের আশ্রয়েই আছে।”

বাবু মিত্তিরের কথাটা বিশ্বাস হল না। তবৃ আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তুমি বুদ্ধিমান, একথা তো আগেই বলেছি। আবার কি বলতে হবে?”

“না। অনেকবার বলেছেন।”

“কালীপ্রসাদ তার কাছে যেতে লিখেছে। গেলে হয়তো রকির সঙ্গে আমার দেখাও হবে। কিন্তু যাওয়া কি উচিত?”

“খুবই উচিত। কারণ রকির চিঠি ডেল্টাও পড়েছে। তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান। রকি যে কালীপ্রসাদের কাছেই যাবে এটা বুঝতে তাদের দেরি হবে না।”

“সর্বনাশ! তা হলে তো আমার এখনই সেখানে যাওয়া উচিত!”

পলাশ একটু হেসে বলল, “যাওয়া উচিত তো ঠিকই। কিন্তু আপনি এখন আর সেই আগেকার অলিম্পিক বক্সার নেই। গায়ের জোরে রকিকে বাঁচাতেও পারবেন না। আর আমার মনে হয় কালীপ্রসাদ অত্যন্ত বুদ্ধিমান লোক। যদি পারেন তা হলে তিনিই হয়তো পারবেন রকিকে বাঁচাতে।”

একটু দোনোমোনো করে বাবু মিত্তির বললেন, “তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে?”

“আপনি কি আমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেন?”

বাবু মিত্তির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বিশ্বাস না করেও কোনও লাভ নেই। তুমি যদি ডেল্টার লোকও হয়ে থাকো তবু তুমি তো সবই জানো।”

“এবার ঠিক কথাই বলেছেন। আপনি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিন। কালীপুরে যেতে হলে তাড়াতাড়ি রওনা হওয়া ভাল। আপনার

অনুপস্থিতিতে রাখাল বাড়ি আগলে থাকতে পারবে।”

ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় লাগল না। বাবু মিত্তির পলাশকে নিয়ে কালীপুর রওনা হয়ে গেলেন। প্রকাশ্যে বেরিয়ে পড়তে আর কোনও চিন্তা ছিল না বাবু মিত্তিরের। প্রথমত, তেজস্ক্রিয় শলাকা বিছানায় রেখে ডেল্টা ধরেই নিয়েছে যে, অচিরেই বাবুর ক্যানসার হবে। ডেল্টা তিল তিল করে মারতে চাইছে। ফন্দিটা যে খাটেনি তা ডেল্টা এখনও জানে না। বাবু বিছানা পরিপাটি করে পেতে চাঁদরের নীচে অবিকল আর-একটা ছুঁচ রেখে এসেছেন। ডেল্টা সরেজমিনে তদন্তে এলেও ক্ষতি নেই, যদি না তারা তেজস্ক্রিয়তা পরীক্ষার জন্য গাইগার কাউন্টার যন্ত্র আনে। দ্বিতীয়ত, আপাতত তারা বাবুকে না মেরে প্রথমে মারতে চাইবে রকিকে। সুতরাং বাবুর এখন ভয় নেই। ৬৮

পথে কোনও ঘটনাই ঘটল না, শুধু একজন বুড়ো বাউল কামরায় সবাইকে ছেড়ে বাবু মিত্তিরের সামনে এসে একটু নেচে নেচে যখন গাইছিল, “পিঁজরার পাখি রে ডাকিছে গগন, ছাড়িয়া দাও তারে এইবারে …” তখন বাবু মিত্তির চাপা গলায় বলে উঠলেন, “ডেল্টা!”

পলাশ বলল, “ডেল্টা কি এভাবে নিজেকে এক্সপোজ করবে?”

“তা বটে।” বাউলটা মাঝপথে নেমে গেল। বাকি পথটায় আর কোনও ঘটনা ঘটল না। যখন কালীপুরের ঘাটে এসে নামলেন তখন বিকেল হয়-হয়। প্রায় এক যুগ পরে রকির সঙ্গে দেখা হবে ভেবে বাবু মিত্তিরের বুকটা আনন্দে এত ধড়ফড় করছিল যে, ভাল করে শ্বাস নিতে পারছিলেন না। শরীরটা যেন বেহাল। আবার মনে হচ্ছে, রকির এখানে থাকা কি সম্ভবপর? এতই সহজ হবে কি ব্যাপারটা?

সুন্দরবনে গাড়িঘোড়া, রিকশা কিছুই নেই। নৌকো আর হাঁটাপথ। কিছু-কিছু জায়গায় রিকশা-ভ্যান চলে। কালীপুরে তাও নেই। অনেকটা হাঁটতে হল। কিন্তু হাঁটাটা বাবু মিত্তিরের পক্ষে মঙ্গলজনকই হল। বুকের ধড়ফড়ানি কমে গিয়ে স্বাভাবিক বোধ করতে লাগলেন।

কালীপ্রসাদের বাড়ির ফটকে ঢুকতে যেতেই কোথা থেকে একটা মুশকো লোক ইয়া বড় এক মুগুর হাতে সামনে উদয় হল। চোখে কটমটে দৃষ্টি। ঢুকতে দেবে না। বাবু মিত্তির খুঁসি বাগিয়ে ফেলেছিলেন, কিন্তু পলাশ বাধা দিয়ে বলল, “এ তো কালীপ্রসাদেরই লোক হতে পারে। দাঁড়ান দেখছি কথা বলে।”

কিন্তু বিপদ হল, লোকটা বোবা। কথা বলতে পারে না, কিন্তু কটমটে চোখ দুটোই ওর কথা। বলতে চাইছে, কেটে পড়ো।

বাবু মিত্তির একটু রাগের গলায় বললেন, “ওহে পলাশ, চৌকাঠই যে ডিঙোতে পারছি না। আমি বরং একে আস্তে করে একটা আপারকাট মেরে দিই, নইলে ঢুকতে দেবে না।”

পলাশ বাধা দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু বাবু মিত্তিরের তর সইল না। রকির সঙ্গে দেখা হবে, তিনি কাঁহাতক ধৈর্য রাখতে পারেন। তিনি সোজা এগিয়ে গিয়ে তাঁর বহু-বিখ্যাত খুঁসির একটি চালিয়ে দিলেন।

আশ্চর্যের বিষয়, এখনও বাবু মিত্তিরের খুঁসির বহর দেখবার মতো। বিরাট চেহারার লোকটা ঘুসি খেয়ে প্রায় শূন্যে উঠে ছিটকে পড়ল মাটিতে। বাবু মিত্তির হাত দুটো নেড়ে বললেন, “দেখলে?”

“দেখলাম!” কথাটা যে বলল সে পলাশ নয়। অন্য একজন। ফটকের পাশ থেকে ছিপছিপে চেহারার একটি দীর্ঘকায় যুবক বেরিয়ে এল সর্পিল গতিতে। কেউ কিছু বুঝে উঠবার আগেই সে সামনে পলাশের চোয়ালে একটা বিদ্যুৎগতির ঘুসি মারল। পলাশ ধানুর মতোই খানিকটা শূন্যে বিচরণ করে ছিটকে পড়ে গেল এবং পড়েই রইল। ছোঁকরার দ্বিতীয় খুঁসিটা অবশ্যম্ভাবী বাবু মিত্তিরের মাথা লক্ষ্য করে সাপের ছোবলের মতোই এল। বাবু মিত্তির অভ্যস্ত সাইড স্টেপ করে সরে গিয়েই বাঁ হাতে বিষাক্ত একখানা জ্যাব করলেন। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, ডেল্টা তার জন্য এখানেই অপেক্ষা করছিল। ডেল্টার ওপর তার সুগভীর রাগ। সামনে যাকে পান তাকেই খুন করেন। এটাও বুঝতে পারছেন, পুরো ব্যাপারটাই একটা চক্রান্ত। রকির চিঠি, পলাশের ব্যাখ্যা, এখানে তাঁকে নিয়ে আসা, সবই যেন চক্রান্তের একটা অংশ।

তাঁর জ্যাবটা ছেলেটা হাতেই ব্লক করে দিল। তারপর ডান হাতে চমৎকার একটা নক-আউট পাঞ্চ করল বাবুর চোয়ালে। কিন্তু বাবু মুখটা সরিয়ে ঘুসিটাকে বাতাসে ভাসিয়ে দিয়ে ব্যাক স্টেপ করে সরে এলেন। বহুকাল পরে উপযুক্ত প্রতিপক্ষ পেয়েই যেন বাবু মিত্তিরের রক্ত টগবগ করে ফুটতে লাগল। শিরায়-শিরায় গরম রক্ত পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে। বাবু মিত্তির তার প্রতিপক্ষের বয়স ও ক্ষিপ্রতাকে উপেক্ষা করেই দ্রুত দুই পা এগিয়ে ডান হাতে একটা ভূয়ো ঘুসি মেরে ছেলেটার ভারসাম্যে গোলমাল ঘটিয়ে বাঁ হাতে আসল খুঁসিটা মারলেন। কিন্তু ছেলেটা ভালই শিখেছে। দু হাতে ব্লক করে খুঁসিটা আটকে দিয়ে মাথাটা নিচু করে বাঁ হাতটা উঁচুতে তুলে চমৎকার পায়ের কাজ দেখিয়ে এগিয়ে এসে পর-পর অতি দ্রুত তিনটে ঘুসি মারল বাবুকে। বাবু মনে-মনে তারিফ করলেন আর তিনটে মোচড়ে শরীরকে তিনদিকে তিনবারে হেলিয়ে ঘুসিগুলোকে কাটিয়ে দিলেন। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলেন, ছেলেটার বাঁ হাতটা সাপের ছোবলের মতো উঁচু করে রাখাটা অবিকল তাঁরই মতো। আর সেইজন্যই তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল কোব্রা। তাঁরও বাঁ হাত সামান্য ওপরে ভোলা থাকত আর সেটা গোখরোর ফণার মতো দোল খেত।

বাবু অস্ফুট গলায় বললেন, “কাম অন ডেল্টা!”

ছেলেটাও. অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, “আই শ্যাল ডিল উইথ ইউ ডেল্টা।”

কেউই কারও কথা শুনতে পেল না। বাবু মিত্তির পর-পর চারটে ঘুসি মারলেন। চারটেই কেটে গেল। ছাো মারল পাঁচটা। বাবু মিত্তির পাঁচটাই কাটালেন।

হারজিত হচ্ছে না। দুজনেই দক্ষ, সতর্ক। একজনের সঙ্গে অন্যজনের তফাত শুধু বয়স ও তৎপরতায়, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানে। বাবু মিত্তির ছেলেটাকে একটু সময় দিলেন, তারপর হাত দুটো নামিয়ে প্রলুব্ধ করলেন ঘুসি মারতে। ছেলেটা সেই ফাঁদে পা দিল না। অপেক্ষা করল। তারপর চমৎকার দ্রুত সাবলীল গতিতে এগিয়ে এসে বাবুর ব্লকের ফাঁক দিয়ে দারুণ তৎপরতায় একটা খুঁসি চালিয়ে দিল। খুঁসিটা পুরোপুরি এড়াতে পারলেন না বাবু। মাথা স্পর্শ করে ঘষটে গেল। বাবু তলা থেকে হাতটা ওপরে তুলে পালটা একটা শর্ট পাঞ্চ করলেন। ছেলেটার বাঁ চোয়ালে সেটা লাগল, তবে জোরে নয়।

হঠাৎ কাছ থেকে কে যেন বলে উঠল, “এ কি সোরাব-রুস্তম হচ্ছে নাকি? ওরে রকি, থাম! ও তোর বাবা।”

রকি থামল। বাবু বেকুবের মতো চেয়ে রইলেন। সামনে কালীপ্রসাদ।

কালীপ্রসাদ ক্ষুব্ধ গলায় বললেন, “তোরা কছিসটা কী? আর এ-দুটোই বা এ-অবস্থায় পড়ে আছে কেন?”

বাবুর কানে কোনও কথাই ঢুকছে না। তিনি হাঁ করে ছেলেটাকে দেখছেন। এই কি তাঁর ছেলে রকি?

রকিরও বাহ্যজ্ঞান নেই। সেও চেয়ে আছে বাবার দিকে। এই কি তার বাবা বাবু মিত্তির?

কয়েক সেকেন্ডের বিহ্বলতার পরই দুজন দুজনকে জাপটে ধরল। “রকি!”

“বাবা!”

পলাশ উঠে বসে চোয়াল ঘষতে-ঘষতে দৃশ্যটা দেখে বলে উঠল, “দু’জনেই গুণ্ডা।”

কিছুক্ষণ বাদে খাওয়ার টেবিলে বসে রকির দিকে চেয়ে বাবু বললেন, “তুই বক্সিং কোথায় শিখলি?”

রকি খুব লজ্জা-লজ্জা মুখে বলল, “আমেরিকায়। ফ্লয়েড প্যাটারসনের কাছে।“

“বলিস কী! প্যাটারসন তোকে শিখিয়েছে? তাই অত ভাল শিখেছিস! যা শিখেছিস অলিম্পিকে স্বচ্ছন্দে যেতে পারিস।”

রকি মাথা নেড়ে বলে, “না বাবা। বক্সিং আমার জান-প্রাণ নয়। তুমি আমাকে জোরজবরদস্তি বক্সার বানাতে চেয়েছিলে। আমার তাতে কষ্ট হত। আমি শিখেছি শখ করে। প্যাটারসনও বলতেন, আমি ন্যাচারাল বক্সার। কিন্তু প্রফেশন্যাল নই। আমি বক্সিংয়ের চেয়ে লেখাপড়া বেশি পছন্দ করতাম।”

“তোকে বক্সার হতে বলছি না। কিন্তু গুণটা নষ্ট করলি। তুই তো বোধ হয় হেভিওয়েট নোস, তাই না?”

“না বাবা, আমি লাইট হেভিওয়েট। তোমারই ক্যাটেগরি।” বাবু মিত্তিরের মুখটা খুবই উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। পুত্রগর্বে গৌরব বোধ করছিলেন।

পলাশ টেবিলের অন্য ধার থেকে বলল, “রকিবাবু, আপনার খুঁসি খেয়ে পেট ভরে গেছে, খেতে পারছি না।”

রকি লজ্জিত হয়ে বলে, “আমি ফটক পাহারা দিচ্ছিলাম। বাবা ধানুকে অ্যাটাক করায় আমার মনে হয়েছিল, আপনারাই ডেল্টার লোক।

তবে আসলে ডেল্টার লোকও বোধ হয় ধারেকাছেই আছে। আজ সকালে তারা সিনেমার শুটিং করার অছিলায় এসেছে। আমরা খোঁজ নিয়েছি কাছাকাছি কোথাও শুটিং হচ্ছে না।”

বাবু মিত্তির বললেন, “সর্বনাশ! তা হলে কী হবে?”

কালীপ্রসাদ বললেন, “যা হওয়ার হবে। আমরা একসঙ্গে আছি, ভয় কিসের?”

গল্পেগুজবে, আড্ডায় সন্ধেটা চমৎকার কেটে গেল সকলের। বাবু মিত্তির আসন্ন বিপদ সত্ত্বেও বেশ ঝরঝরে বোধ করতে লাগলেন। অসুস্থতাটা যেন বারোআনাই কেটে গেছে।

ক্রমে রাত হল। খাওয়ার পর কালী প্রসাদ বললেন, “তোমরা সব শুয়ে পড়ো। আমি জেগে থাকব।”

বাবু, রকি, পলাশ সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, “আমরা শুচ্ছি না। রাত জেগে পাহারা দেব।”

যোগেন আর ধানুও শুতে রাজি হল না। কালীপ্রসাদ অগত্যা প্রস্তাবটা মেনে নিয়ে বললেন, “গাঁয়ের কয়েকটা ছেলেকে আমি নানা জায়গায় পাহারা রেখেছি। তোমরাও কেউ এক জায়গায় থেকো না। বাড়ির বিভিন্ন ঘর থেকে চারদিকে নজর রাখো।”

দোতলায় চারটে কোণে চারটে শোওয়ার ঘর। বাবু, রকি, পলাশ আর যোগেনকে চারটে ঘরে মোতায়েন করলেন কালী প্রসাদ। ধানু রইল নীচে আর-একটা ঘরে। ল্যাবরেটরিতে কালীপ্রসাদ। হাতে বন্দুক। কিন্তু নরহত্যা করার ইচ্ছে তাঁর মোটেই নেই। আত্মরক্ষার জন্য করতে হলে করবেন, কিন্তু সেটা খুব অপারগ না হলে নয়।

রাত দশটা বাজল। ধীরে-ধীরে এগারোটা। বারোটা। কিছুই ঘটছিল না। কালীপ্রসাদ দক্ষিণের জানালাটা একটু ফাঁক করে চোখ রেখে বসে আছেন। ঘর অন্ধকার। চোখে অন্ধকার সয়ে গেছে কালীপ্রসাদের।

হঠাৎ কোকিলের ডাকের মতো একটা শিস শুনতে পেলেন। এ হচ্ছে মালোপাড়ার যতীন। জানান দিচ্ছে, গাঁয়ে কেউ ঢুকেছে।

একটু বাদে টিটি পাখির মতো আর-একটা শিস। আমতলায় বিমল মোতায়েন আছে। সঙ্কেত দিচ্ছে, এ বাড়ির দিকে কেউ বা কারা আসছে।

কালীপ্রসাদ একটু মৃদু কাশলেন, ওপর থেকে পালটা একটু কাশির শব্দ শোনা গেল। অর্থাৎ, বাবু সতর্ক আছে।

আরও প্রায় দশ মিনিট নিথরভাবে বসে থাকার পর হঠাৎ কালীপ্রসাদের চোখে পড়ল, একটা ছায়ামূর্তি একটা কামিনী ঝোঁপের আড়াল থেকে আর-একটা ঝোঁপের আড়ালে সরে গেল।

কানের কাছে হঠাৎ একটা মশা চক্কর দিচ্ছে আর পনপন আওয়াজ করছে। কালী প্রসাদ থাবড়া মারতে হাত তুলেও থেমে গেলেন। মশাটা এবার যেন তাঁর কানের গর্তের মধ্যে ঢুকে গিয়ে পিনপিন করে কথা বলতে লাগল।

কালীপ্রসাদ স্থির হয়ে মশার শব্দটা মন দিয়ে শুনতে লাগলেন। মশাটা গুনগুন করে বলল, “নিজেকে খুব বুদ্ধিমান ভাবো নাকি?”

“আজ্ঞে না।”

খুব বিনীতভাবে বললেন কালী প্রসাদ।

“তোমার শত্রুপক্ষ খুবই শক্তিমান। ইচ্ছে করলেই তারা তোমাদের সুন্ধু গোটা বাড়িটাই উড়িয়ে দিতে পারে।”

“যে আজ্ঞে।”

“তোমাদের কাছে যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র নেই, লোকবল নেই, প্রবল শত্রুর সঙ্গে পারবে কী করে?”

“আমাকে পরামর্শ দিন।”

“তুমি যে বন্ধু এবং আশ্রিতজনদের বাঁচানোর জন্য নিজের বিপদ তুচ্ছ জ্ঞান করছ এতে আমরা–তোমার পূর্বপুরুষেরা সন্তুষ্ট। শত্রুদের লক্ষ্য দু’জন। বাবু মিত্তির আর তার ছেলে। ছেলেটাকে মারতেই তারা এসেছে। বাবু মিত্তিরকে তারা মারবে না, দগ্ধে-দগ্ধে মরতে দেবে বুঝেছ?”

“যে আজ্ঞে। “

“সুতরাং সকলের মঙ্গলের জন্য তোমার উচিত হবে ছেলেটাকে শত্রুপক্ষের হাতে ছেড়ে দেওয়া।”

কালী প্রসাদ শিহরিত হয়ে বললেন, “সে কী! তা হলে তো চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে।”

মশা যে হাসতে পারে তা জানা ছিল না কালীপ্রসাদের। শুধু হাসি নয়, অট্টহাসি। কালীপ্রসাদ নিজের কানের মধ্যে সেই আশ্চর্য অট্টহাসি শুনতে পেলেন। মশা বলল, “শোনো কালীপ্রসাদ, নিজের বুদ্ধিতে যদি চলো তা হলে আমার পরামর্শের প্রয়োজন তোমার নেই। সেক্ষেত্রে তোমাদের ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।”

“আজ্ঞে, আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন।”

“শত্রুপক্ষের সর্দারের নাম পল। সে নিজে এসেছে। ঢ্যাঙা এবং শীর্ণ চেহারার একটি লোক। সে অত্যন্ত প্রতিহিংসাপরায়ণ। বহুদিন ধরে সে প্রতিশোধের জন্য অপেক্ষা করছে। আজ সে নিজের হাতে বাবু মিত্তিরের ছেলেকে মারবে। নইলে তার বুকের জ্বালা জুড়োবে না।”

কালীপ্রসাদ অবাক হয়ে বললেন, “পল নিজে এসেছে?”

“হ্যাঁ। তুমি সদর দরজাটা খুলে দাও। ওদের আসতে দাও। তার আগে বাবু মিত্তিরের কাছে গিয়ে তার পিস্তলটা চেয়ে নাও কারণ সে গুলি ছুঁড়লে সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে।”

এ কাজ করলে বাবু যে আমাকে আর বিশ্বাস করবে না। আমি বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে পড়ে যাব।”

“তা হলে নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা অনুযায়ী চলো। আমাদের আর কিছু করার নেই।”

কালীপ্রসাদ তাড়াতাড়ি বললেন, “আজ্ঞে, আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আপনার পরামর্শই মেনে নিচ্ছি।”

“তা হলে তাড়াতাড়ি করো। সদর দরজাটা অত্যন্ত দুর্লভ কাঠ দিয়ে তৈরি। ও কাঠ আর পাওয়া যায় না। শত্রুরা দরজাটা ভাঙার আগেই ওটা খুলে দিতে হবে। বুঝেছ?”

“যে আজ্ঞে।”

কালীপ্রসাদ বিষণ্ণ মনে ধীরে ধীরে দোতলায় উঠে বাবু মিত্তিরের ঘরে এলেন।

“বাবু।”

বাবু মিত্তির জানালার ধারে পিস্তল হাতে নিয়ে বসে ছিলেন। ডাক শুনে চমকে ফিরে তাকালেন, “কী রে?”

“তোর পিস্তলটা আমাকে দে।”

“কেন?”

“দে না।”

বাবু মিত্তির সন্দিহান চোখে বন্ধুর দিকে কয়েক পলক চেয়ে রইলেন অন্ধকারে। তারপর দ্বিধাজড়িত হতে পিস্তলটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “কিছু দেখেছিস?”

কালীপ্রসাদ সত্যি কথাটাই বলবার জন্য হাঁ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর হয়ে আর-একটি কণ্ঠ বলে উঠল, “না, কিছু দেখিনি। তুই দেখেছিস?”

বাবু বললেন, “না। কিন্তু পাখির ডাক শুনছি। রাতে পাখি ডাকে নাকি?”

অন্য কণ্ঠটি কালীপ্রসাদের হয়ে বলল, “তা ডাকে। ভয়ের কিছু নেই। এখনও।”

“পিস্তলটা নিচ্ছিস কেন?”

অন্য কণ্ঠটি বলল, “তোর ভালর জন্যই। এখন তোর মাথা ভাল কাজ করছে না। দুম করে চালিয়ে দিলে বিপদ হতে পারে।”

“তা বটে। বুড়ো বয়সে খুনটুন করার ইচ্ছেও আমার ছিল না। কিন্তু ছেলেটাকে বাঁচাতে তো কিছু করতেই হবে।”

অন্য কণ্ঠটি বলে উঠল, “বিপদে মাথা ঠিক রাখতে হয়।”

কালীপ্রসাদ চমৎকৃত হচ্ছিলেন। হুবহু তাঁর গলা নকল করে কে কথাগুলো বলে দিচ্ছে? তিনি কণ্টকিত শরীরে নীচে এলেন। তারপর সাবধানে সদর দরজার খিল খুলে দরজাটা হাট করে দিলেন। তারপর ল্যাবরেটরিতে এসে জানালার কাছে বসে রইলেন।

প্রথমে অনেকক্ষণ কিছুই ঘটল না। বাগানে নড়াচড়া নেই। কানেও মশার শব্দ নেই। কালীপ্রসাদ শুধু চেয়ে রইলেন।

হঠাৎ ওপর থেকে বাবু মিত্তিরের চিৎকার শোনা গেল, “সাবধান! ওরা আসছে!”

বাবু বোধ হয় দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দৃড়দাড় নামতে লাগল। কালীপ্রসাদ আরও তিনজোড়া পায়ের শব্দ পেলেন। সবাই ছুটে আসছে নীচে।

কানে মশাটা বলে উঠল, “হুঁড়োহুড়ি কোরো না। যা ঘটছে ঘটতে দাও।”

কালীপ্রসাদ বললেন, “যে আজ্ঞে।”

বলে উঠে দরজায় এসে দাঁড়ালেন। সামনেই দরদালান। ডান দিকে সদর দরজা। দেখলেন সদর দরজা দিয়ে কয়েকটা ছায়ামূর্তি চটপটে পায়ে ভিতরে ঢুকে সিঁড়িটা আগলে দাঁড়াল।

বাবু সবার আগে নেমে আসছিলেন। অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা তাঁর লোপ পেয়েছে। তিনি চার সিঁড়ি ওপর থেকে ঘুসি বাগিয়ে লোকগুলোর ওপর লাফিয়ে পড়লেন, “তবে রে! আজ সবাইকে শেষ করে ছাড়ব।”

শুধু বাবু নয়, পিছনে রকি, পলাশ, যোগেন। বাবু আর রকি দক্ষ বক্সার। তারা দুমদাম খুঁসি চালিয়ে যেতে লাগল। ছায়ামূর্তিরা একটু বেসামাল হয়ে পড়ল আচমকা আক্রমণে। দু’জন, ঘুসি খেয়ে পড়েও গেল ছিটকে। কিন্তু তারপরেই লোকগুলো ছোট-ছোট ব্যাটনের মতো জিনিস দিয়ে পালটা মারল।

মিনিটখানেকের মধ্যেই লড়াই শেষ হয়ে গেল। সিঁড়িতে আর দরদালানের মেঝেয় চারজনই ভূমিশয্যা নিয়েছে।

লম্বা সুরুঙ্গে চেহারার একটা লোক ভিতরে এসে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখে ঠাণ্ডা গলায় ইংরেজিতে বলল, “ওদের বেঁধে ফেল।”

চটপট বাঁধা হল চারজনের হাত আর পা। লম্বা লোকটা বলল, “চোখেমুখে জল দাও। জ্ঞান ফিরে আসুক।” তাই করা হল। বাবু মিত্তির একটু কাতর শব্দ করে উঠে বসলেন। তারপর সামনে চেয়ে লম্বা লোকটাকে দেখে ভীষণ চমকে উঠে বললেন, “পল!”

“চিনতে পারছ তা হলে? বিশ্বাসঘাতক!” বাবু মিত্তির ডুকরে উঠে বললেন, “বিশ্বাস করো পল, আমি রাউলকে মারিনি। রাউল আমার বন্ধু ছিল। রাউলকে মেরেছিল সিকিউরিটির লোরো।”

“তোমার সাফাই আমার জানা ছিল। পুত্রশোক কিরকম হয় তা জানো? এত বছর ধরে আমি ভিতরে-ভিতরে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছি। তোমাকে সেই জ্বালার একটু ভাগ দিতে চাই।”

“দোহাই পল, একাজ কোরো না। কী প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে বলল। ডলার ফেরত চাও, দেব। সব কিছু করব। শুধু আমার ছেলেটাকে ছেড়ে দাও।”

“রাউল তোমার বন্ধু ছিল, তোমার জন্য সে অনেক কিছু করেছিল। প্রতিদানে তার জুটেছিল কয়েকটা বুলেট। এ-পাপের কী প্রায়শ্চিত্ত হয়। আর যদি হয় তা ঠিক এইভাবেই হয়। পুত্রশোকের ভাগিদার হয়ে সেই প্রায়শ্চিত্তই করতে হবে তোমাকে। তারপর ধীরে ধীরে অশেষ যন্ত্রণা পেয়ে ক্যানসারে মারা যাবে তুমি। আমি এ-দিনটারই অপেক্ষায় ছিলাম।”

বাবু নিজেকে সংযত করলেন। গলা থেকে আবেদন-নিবেদনের ভাবটা মরে গেল। তেজী গলায় বললেন, “পল, আমাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে বলছ? তোমার পাপও কি কিছু কম? অলিম্পিকে সোনার পদক আমার বাঁধা ছিল। কেউ সেবার আমাকে হারাতে পারত না। তুমি রাউলকে পদক পাইয়ে দেওয়ার জন্য আমাকে ফুড পয়জ করেছিলে। বলো, করোনি? তুমি কি জানো একটা অলিম্পিকে একটা সোনার পদক আমার কাছে তখন কতখানি মূল্যবান ছিল?”

পল হাসল, “পদকের শোকের চেয়েও বড় শোক পৃথিবীতে আছে। স্বীকার করছি, আমি তোমাকে রাউলের পথ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু ক্ষতিপূরণও করেছি। তোমাকে অনেক টাকা দিয়েছি।”

“এমনই দাওনি। আমাকে পাপের পঙ্কিল পথে নামিয়েছিলে।”

“দুনিয়াতে পাপ বলে কিছু নেই। ওসব দূর্বলদের কথা। যে-কোনও জীবিকাই জীবিকামাত্র।”

“তুমি পিশাচ।”

“ঠিক কথা। এখন বলো তো, তোমার ছেলের মৃত্যু আমি কীভাবে ঘটাব! পারবে বলতে?”

“আগে আমাকে মারো পল। এইটুকু দয়া করো।”

পল হাসল। বলল, “ধীরে বন্ধু, ধীরে। তাড়াহুড়োর কী আছে? দুনিয়াটাকে আর কিছুদিন ভোগ করে নাও। আমার খুব ইচ্ছে, তোমার ছেলের ডান হাতটা প্রথমে কেটে ফেলি। ও চেঁচাবে, ছটফট করবে। তুমি চেয়ে-চেয়ে দেখবে। কেমন হবে ব্যাপারটা?”

রকি একটা ঝাঁকি দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে বলল, “আমি তোমাকে একটা কথা বলে নিতে চাই পল। আমি মরতে ভয় পাই না। বেশি নাটক না করে যা করার করে যাও।”

“অত তাড়া কিসের? গাড়ি ধরবে নাকি?” বলে পল খুব হাসল। হঠাৎ তার হাতে ঝিকিয়ে উঠল একটা এক ফুট লম্বা সরু ছুরি।

কালীপ্রসাদের হাত-পা নিসপিস করছিল। তিনি মুঠো বাগিয়ে এক পা এগিয়ে গিয়েছিলেন। কানের মধ্যে মশা পনপন করে উঠল, “করো কী! চুপ করে থাকে। নাটকটা দেখতে দাও।”

প্রায় নিঃশব্দে কালীপ্রসাদ হাসলেন,”যে আজ্ঞে।”

ছুরিটা হাতে নাচাতে-নাচাতে পল বলল, “চেয়ে দ্যাখো বাবু। দু চোখ ভরে দ্যাখো, প্রথমে তোমার ছেলের ডান হাত কেটে নিচ্ছি। তারপর বাঁ হাত। তারপর একটা চোখ উপড়ে নেব। তারপর আর-একটা। তখনও ও মরবে না। চেঁচাবে, দাপাবে। ঘণ্টাখানেক বাদে রক্তক্ষরণে মারা যাবে। দ্যাখো। “

বলে পল গিয়ে রকির সামনে দাঁড়াল।

ঠিক এই সময়ে কালীপ্রসাদ পিস্তলটা তুলতে যাচ্ছিলেন। আর সময় নেই। কিছু একটা না করলে রকি মরবে।

মশাটা কানে পনপন করে উঠে বলল, “ওকাজ কোরো না। তুমি আমাদের শেষ বংশধর। খুনটুন করে বসলে পাপ হয়ে যাবে। তা হলে নিম্নগতি হবে। আমাদের উদ্ধার করবে কে?”

“যে আজ্ঞে।”

ভক করে হঠাৎ বোঁটকা গন্ধটা নাকে এল কালী প্রসাদের। খুবই চেনা গন্ধ। গতকালও পেয়েছিলেন। গন্ধের উৎস খুব কাছেই। কালীপ্রসাদ চারদিকে তাকাতে লাগলেন। হঠাৎ চমকে উঠে দেখলেন, ঠিক তাঁর পাশে, গা ঘেঁষেই বিশাল কেঁদো বাঘটা।

পল ছুরিটা নিপুণ হাতে ধরে রকির কনুইয়ের ওপর চালাতে যাচ্ছে ঠিক এই সময়ে তার দলের লোকেরা আর্তনাদ করে উঠল, “বাঘ! বাঘ!”

পল চকিতে ঘুরে দাঁড়াল, “মাই গড! শুট ইট।”

সঙ্গে-সঙ্গে গোটা-দুই স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র ট্যারা-ট্যাট-ট্যাট করে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছিল বাঘটাকে।

কিন্তু বাঘটা নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে পথের দিকে চেয়ে ছিল। পল ছুরিটা তুলে বিদ্যুৎগতিতে ছুঁড়ল বাঘটার দিকে। কালীপ্রসাদ অবাক হয়ে দেখলেন ছুরিটা বাঘটাকে ভেদ করে দেওয়ালে গিয়ে লাগল।

তারপর যা ঘটল তা অবিশ্বাস্য। বাঘটা একটা চাপা গর্জন করে একটা ঘূর্ণিঝড়ের মতো গিয়ে পড়ল পলের ওপর। তাকে মুখে তুলে নিয়ে একটি লাফে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে গিয়ে পড়ল।

পলের স্যাঙাতরা ছিটকে পড়ল এদিক-ওদিক। সবাই কুমড়ো-গড়াগড়ি।

মশাটা কালীপ্রসাদের কানের মধ্যে বলল, “ওদের বাঁধন খুলে দাও। পাজি লোকগুলোকে বেঁধে ফেল। ওরা এখন নিরস্ত্র।”

কালী প্রসাদ বললেন, “যে আজ্ঞে। কিন্তু বাঘটা কোথা থেকে এল?”

“ওকে চিনতে পারলে না? ও তোমার হালুম।”

“বুঝেছি।” বলে কালী প্রসাদ কৃতজ্ঞতায় চোখের জল মুছলেন। তারপর এগিয়ে গিয়ে চারজনের বাঁধন খুলতে লাগলেন।