দু’জনে পথে বেরোতেই কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে লাগল। মুখোমুখি যার সঙ্গেই দেখা হচ্ছে সেই তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে তাদের নমস্কার করে চট করে রাস্তার পাশে সরে যাচ্ছে। কেউ কেউ গাছপালার আড়ালে লুকিয়েও পড়ল। চণ্ডীমণ্ডপের কাছটায় এক মহিলা বছর পাঁচেকের একটা ছেলেকে হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, টক করে সে নিচু হয়ে ছেলেটার চোখে হাতচাপা দিয়ে বলল, “ওরে, ওদের দিকে তাকাসনি, গুণ করে ফেলবে।”
ফটিক বলল, “এসব কী হচ্ছে বল তো!”
নিতাই মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু, বোঝা যাচ্ছে না।”
আজ কালীমাতা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে ঢুকতেই কালো আর মোটামতো মালিক তাড়াতাড়ি ক্যাশবাক্স ছেড়ে উঠে হাতজোড় করে বলল, “আসুন, আসুন! কী সৌভাগ্য! ওরে, হাতলওলা চেয়ারদুটো এগিয়ে দে।”
ফটিক আর নিতাই একটু মুখ-তাকাতাকি করে নিল, গরম কচুরি আর জিলিপি খাওয়ার পর দাম দিতে যেতেই মালিক জিভ কেটে বলল, “আরে ছিঃ ছিঃ! দাম কীসের? দামটাম দিতে হবে না, বরং গরম সন্দেশ হয়েছে, কয়েকখানা করে খেয়ে যান।”
ফটিক মৃদুস্বরে ডাকল, “নিতাই!”
নিতাই মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু, এখনও বোঝা যাচ্ছে না।” নটবর রায়ের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আজ ভোজপুরি দরোয়ানটা অবধি অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়ায় একটা লম্বা মিলিটারি স্যালুট দিল।
গাঁয়ে চক্কর মেরে যখন তারা নুটুবাবুর লঙ্গরখানায় খেতে ঢুকল তখন সেখানে বেজায় ভিড়, কিন্তু ওই ভিড়ের মধ্যেও তাদের সবাই খাতির করে পথ তো ছেড়ে দিলই, তার ওপর লঙ্গরখানার ম্যানেজারমশাই তাদের দেখেই শশব্যস্তে উঠে হাঁকডাক শুরু করে দিলেন, “ওরে ও জগা, শিগগির ওপরের ঘরে জলের ছিটে দিয়ে দুটো আসন পেতে দে আর ভি আই পি-দের জন্য রাখা কাঁসার থালা-গেলাস বের কর। ঠাকুরকে বেগুন ভাজতে বল, আর ঘি-টা গরম করে দিতে যেন ভুল না হয়, দেখিস বাবা।”
“নিতাই।”
“উঁহু, বোঝা যাচ্ছে না।”
খেয়েদেয়ে বেরোনোর সময় ম্যানেজার হাত কচলে বললেন, “রাতে আপনাদের জন্য একটু পোলাও আর কষা মাংস হচ্ছে। হেঁঃ হেঁঃ। একটু দই মিষ্টিও-”
“আচ্ছা, আচ্ছা।” বলে দু’জনে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল। বাজারের কাছ বরাবর একটা দোকানঘরের পেছন থেকে একটা লোক ফস করে বেরিয়ে এসে ভারী বিগলিত মুখে সামনে দাঁড়াল, “পেন্নাম হই বাবারা, দণ্ডবত, তা আপনিই তো ষোলো নম্বর ফটিক ঘোষ বাবা! তাই না?”
ভারী ছোটখাটো চেহারার, ধুতি আর হাফশার্ট পরা লোকটাকে দেখে ফটিক অবাক হয়ে বলে, “ষোলো নম্বর হতে যাব কোন দুঃখে? আমি শুধু ফটিক ঘোষ।”
“তবু দেগে রাখা ভাল। নইলে এত ফটিক ঘোষের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলব যে!”
“অ! আর কিছু বলবেন?”
খুব হেঁ হেঁ করে হেসে হাত-টাত কচলে লোকটা বলে, “অধমের নাম রসিক বৈরাগী। এই পেন্নাম জানাতেই আসা। এত বড় দু’জন গুনিন এসেছেন গাঁয়ে, পেন্নাম জানাতে হবে না? তা বাবা, ভূতের মন্তর তো দেখলুম আপনাদের জলভাত, আর মারণ-উচাটন বশীকরণ তো ধরছিই না, ও তো আপনাদের নস্যি। বলি বাবা, এই বাটি-চালান-ঘটি-চালাননখদর্পণ, ডাকিনী বিদ্যে এসবও কি আসে বাবা?”
ফটিক অবাক হয়ে বলল, “ভূতের মন্তর জানি না তো! আর যা যা বললেন সেসবও জানি না।”
“হেঁঃ হেঁঃ, কী যে বলেন বাবা! বিদ্যে কি লুকোনো যায়? জলবসন্ত হলে কি গুটি লুকোনো যায়? না কি সর্দি লাগলে কাশি লুকোনো যায়? না কি আমাশা হলে বেগ চেপে রাখা যায় বাবা? বিদ্যে হল ওই জিনিস, ও বেরিয়ে পড়বেই। কাল যখন আপনারা
গাঁয়ে এসে ঢুকলেন বাবা, তখনই আমি গন্ধটা পেয়েছিলুম।”
নিতাই অবাক হয়ে বলে, “কীসের গন্ধ?”
“আজ্ঞে, অনেকটা মাছের চারের গন্ধ। বড় বড় গুনিনের গায়ে থাকে, ওই গন্ধে ভূত-প্রেত-অপদেবতারা সব তফাত যায়। বাতাস শুকে তখনই আমি আমার ছোট শালাকে ডেকে বলেছিলুম, ওরে রেমো, এই যে দু’জন মানুষ এসে গাঁয়ে ঢুকল এরা যেমন তেমন মনিষ্যি নয় রে। চেহারা দেখে বোঝবার জো নেই, কিন্তু ছুঁচো যেমন গায়ের গন্ধ চেপে রাখতে পারে না, গুনিনরাও তাই।”
ফটিক বলল, “বটে!”
“হেঁঃ হেঁঃ, যতই নিজেকে লুকিয়ে রাখুন বাবা, বিদ্যে লুকোনোর উপায় নেই। গড়াইবুড়ি মরে ইস্তক ও বাড়ির ত্রিসীমানায় কি কেউ যেতে পেরেছে, বলুন তো! কত বড় বড় ওস্তাদ, গুনিন, ওঝা এসেছে, কেউ পারেনি। ঢিল পাটকেল খেয়ে সব পালানোর পথ পায় না। আর আপনারা কেমন ছুঁচ হয়ে ঢুকলেন, আর ফাল হয়ে বেরিয়ে এলেন, গায়ে আঁচড়টিও পড়ল না, বিদ্যে না থাকলে কি হয় এসব? আমরাও ছোটখাটো বিদ্যের চাষ করি কিনা, তাই জানি।”
নিতাই বলল, “তা আপনার কী করা হয়?”
ভারী লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ঘাড় চুলকে রসিক বলল, “সেকথা মুখ ফুটে বলতে লজ্জাই করে বাবা। পেটের দায়ে রাত বিরেতে বেরোতে হয়। ছোটখাটো হাতের কাজ আর কী! তাও কি শান্তি আছে বাবা? সতীশ দারোগা এসে ইস্তক আমাদের ব্যবসাই লাটে উঠবার জোগাড়। কখন যে কোন রূপ ধরে কোথায় উদয় হবেন তার কোনও ঠিক নেই। বোষ্টম সেজে, কাঁপালিক সেজে, পুরুত সেজে, এমনকী চোর-ডাকাত সেজেও ঘুরে বেড়াচ্ছেন।”
ফটিক বলল, “বটে! দারোগা যে আবার চোর-ডাকাত সেজেও ঘুরে বেড়ায়, এ তো কখনও শুনিনি।”
“আর কবেন না বাবা, তাকে জাম্বুবান বললেও কম বলা হয়, তক্কে তক্কে থাকেন, কখন যে ফাঁক করে কার ঘাড় ধরে তুলে নিয়ে যান, সোঁদরবনের বাঘের মতো, তার ঠিক নেই। অথচ দেখুন, দু পা
এগিয়ে মনসাপোতার মোড় পেরোলেই গজপতি দারোগার এলাকা। যেমন তাঁর নাদুসনুদুস চেহারা, তেমনই হাসিখুশি মুখোনি। দেখলেই বুক ঠাণ্ডা হয়। চোর-ডাকাতের মা-বাপ। যা খুশি করুন কেউ ফিরেও তাকাবে না। যত অবিচার সব এই সতীশ দারোগার এলাকায়। এই আমরা দু-চারজনই মাটি কামড়ে পড়ে আছি, যত বড় কারিগররা সব ওই গজপতির এলাকায় গিয়ে সেঁদিয়েছে।”
“তা আপনি যাননি কেন?”
“সেখানে যে বড্ড ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে যাচ্ছে বাবা! অত কারিগর জুটেছে তো, আমাদের মতো চুনোর্পটির সেখানে সুবিধে হচ্ছে না।”
“তা হলে তো আপনার খুব মুশকিল হয়েছে দেখছি।”
“খুব, খুব, দিনকাল মোটে ভাল যাচ্ছে না। এই এখন আপনারা দুটিতে এসেছেন, যদি মারণ-উচাটনবাণ বশীকরণ দিয়ে সতীশ দারোগাকে একটু ঢিট করতে পারেন তা হলে গরিবের বড় উপকার হয়।”
নিতাই বলল, “সে আর বেশি কথা কী? দেব’খন ঢিট করে।”
“আর একটা কথা বাবা। দুলুবাবু আপনাদের সঙ্গে একটু দেখা করতে চান। বড় মনস্তাপে ভুগছেন।”
ফটিক অবাক হয়ে বলে, “দুলুবাবু কে?”
রসিক হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলে, “প্রাতঃস্মরণীয় মানুষ, লোকে বলে এ-তল্লাটের নবীন হুড না কী যেন।”
“রবিনহুড নাকি?”
“আজ্ঞে, তাই হবে।”
“তা তাঁর মনস্তাপ কীসের?”
“বড্ড মনস্তাপ। ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে আর বলছেন, ওরে মহাদেব, তুই এটা কী করলি? চিঠিখানা নিয়ে চলে এলি? আর অবোধ ছেলে দুটো চিঠিখানা দেখাতে পারেনি বলে কী হেনস্থাটাই না হল।”
ফটিক ফুঁসে উঠে বলল, “মানে! কোন চিঠি?”
“আমি তো অত জানি না বাবা, যা শুনেছি তাই বলছি, কী একখানা চিঠি নাকি আপনাদের কাছ থেকে দুলুবাবুর শাগরেদ মহাদেব দাস নিয়ে এসেছিল, আর তাতে নাকি আপনাদের বড় নাজেহাল হতে হয়েছে।”
“সে তো বটেই। মহাদেব দাস অতি পাজি লোক।”
“আজ্ঞে, সেই চিঠিখানা দুলুবাবু ফেরত দিতে চান, আমাকে ডেকে বললেন, ওরে, ছেলে দুটোকে সাঁঝের পর একটু আসতে বলিস তো, ওদের কষ্ট দিয়ে আমার বড় পাপ হচ্ছে।”
ফটিক বলে, “তা সাঁঝের পরে কেন, এখনই যাচ্ছি চলুন।”
জিভ কেটে রসিক দাস তাড়াতাড়ি বলল, “দিনমানে তাঁর সুবিধে নেই কিনা, দিনমানে তিনি গা-ঢাকা দিয়ে থাকেন।”
“কেন বলুন তো!”।
রসিক একটু হেঁ হেঁঃ করে হেসে নিল।
ফটিক আর নিতাই মুখ-চাওয়াচাওয়ি করে নিল। রসিক বৈরাগী মিটমিট করে চেয়ে বলল, “দিনমানে ঘরের বাইরে পা দেওয়ার কি জো আছে তাঁর? অত বড় গুণী মানুষ, চারদিকে এত নামডাক। লোকে একেবারে ঘেঁকে ধরে, হাঁ করে চেয়ে থাকে, পায়ের ধুলো নিতে কাড়াকাড়ি, অটোবায়োগ্রাফি চায়।”
“অটোবায়োগ্রাফি? না অটোগ্রাফ?”
“ওই হল। যাঁহা বাহান্ন, তাঁহা তিপ্পান্ন। আসল কথা হল, দুলুবাবু যখন-তখন হুট বলতে দেখা দেন না। একটু আবডালে থেকে নানা কলকাঠি নাড়াচাড়া করেন। আমি ওঁরই শ্রীচরণের আশ্রয়ে থেকে তালিম নিচ্ছি কিনা।”
ফটিক বলল, “বুঝেছি, চিঠিটা আমাদের খুব দরকার। তা কোথায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হবে?”
“এই পুবদিকের রাস্তায় গিয়ে বটতলা থেকে ডাইনে মোড় নিয়ে দু’ ফার্লং, একখানা শিবমন্দির আছে। সেইখানে। তা বাবারা, আমি সাঁঝের পর এখানে হাজির থাকব’খন, পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব।”
“তা হলে তো খুবই ভাল হয়।”
রসিক বৈরাগী বিদায় নেওয়ার পর নিতাই বলল, “কাজটা কি ঠিক হবে রে ফটিক? দুলু গোসাঁইয়ের কথা যা শুনলুম তাতে খুব সুবিধের ঠেকছে না।”
“চিঠিটা যখন ফেরত দিতে চাইছে তখন একবার গিয়ে দেখলে হয়।”
“চিঠিটা তো রসিকের হাত দিয়েই পাঠাতে পারত।”
ফটিক একটু ভেবে বলে, “তা ঠিক। তবে চিঠিটা পেলে পিসির সঙ্গে দেখাটা হয়, নইলে ফিরে গিয়ে বাবাকে কী বলব বল তো?”
এই দোনোমোনো ভাব নিয়েই সন্ধের পর দুজনে ফের বাজারের কাছটায় আগের জায়গায় এসে দাঁড়াল। তারা যে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেছে তা লোকজনের হাবভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। তাদের দেখতে পেলেই মানুষজন তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে হেঁঃ হেঁঃ করে সরে পড়ছে।
“লোকে কি আমাদের একটু ভয়ও পাচ্ছে রে নিতাই?”
“তা পাবে না? ভূতের মন্তর জানি যে।”
“জীবনে কখনও কেউ আমাকে ভয় পায়নি, খাতিরও করেনি। নিজেকে এখন বেশ কেউকেটা মনে হচ্ছে।”
সন্ধে গড়িয়ে একটু রাত হওয়ার পর যখন দোকানের ঝাঁপটাপ বন্ধ হতে লাগল, লোকজন কমে গেল, তখনই একটা দোকানঘরের আড়াল থেকে চাপা গলায় ডাক এল, “বাবারা এই ইদিকে আসুন। বেশি সাড়াশব্দ করার দরকার নেই।”
তারা নিঃশব্দে কাঁচা রাস্তাটা ধরে রসিকের পিছু পিছু চলতে লাগল। কিছুটা যেতেই ঘরবাড়ি শেষ হয়ে ঝোঁপজঙ্গল শুরু হল। ঝিঁঝির শব্দ, প্যাঁচার ডাক আর ঘোর অন্ধকার।
ফটিক বলল, “আর কতদূর, ও রসিকবাবু?”
“এই আর একটু বাবা।” কম করেও মাইলখানেক রাস্তা পেরিয়ে তারা যেখানে এল সেটা রীতিমত জঙ্গল। সামনে বিশাল একটা বটগাছ।
“এই বটতলা বাবা। এবার ডাইনে। চিন্তা নেই, আমার পিছু পিছু চলে আসুন।”
ডানদিকের রাস্তায় ঢুকতেই ফটিক আর নিতাইয়ের গা ছমছম করতে লাগল। বিশাল বড় বড় ঝুপসি গাছের ছায়া, দু’ধারে দেড় মানুষ সমান উঁচু আগাছার জঙ্গল। প্যাঁচা ডাকছে, তক্ষকের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। একঝাঁক শিয়ালের দৌড়, পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। অন্ধকারে হোঁচট খেতে হচ্ছে বারবার।
ফটিক ভয়ে ভয়ে বলল, “এ কোথায় আনলেন রসিকবাবু?”
“কোনও ভয় নেই বাবা, এ রাস্তায় আমার দিনে-রেতে যাতায়াত।”
“আর কতদূর?”
“এই আর একটু।”
নিতাই জিজ্ঞেস করে, “দুলুবাবু লোকটি কেমন বলুন তো!”
“আহা বড় দুর্ভাগা লোক। সব থেকেও কিছু নেই। কপালের ফেরে আলায় বালায় ঘুরে জীবন কাটছে। অতবড় সম্পত্তি পড়ে আছে, অত টাকা, কিন্তু সেই কার যেন ভাজা শোলমাছ হাত ফসকে পালিয়ে গিয়েছিল। দুলুবাবুর সেই অবস্থা।”
“তা বিষয়সম্পত্তির কী হল?”
“সে বড় দুঃখের কথা বাবা। তিনি ছিলেন রায়মশাইয়ের পুষ্যিপুত্তুর। যেমন-তেমন নয়, লেখাপড়া করা পুষ্যিপুত্তুর। পাঁচ বছর বয়সে পুষ্যিপুত্তুর হলেন, আর কুড়ি বছর বয়সেই ত্যাজ্যপুত্তুর।”
পুষ্যিপুত্তুর শুনে ফটিক চাপা গলায় বলল, “হ্যাঁ রে নিতাই, নদিয়াদা না এক পুষ্যিপুত্তুর সম্পর্কে সাবধান থাকতে বলেছিল?”
কথাটা শুনতে পেয়ে রসিক থমকাল, “কার কথা বলছেন বাবা?”
নিতাই বলল, “নদিয়া নামে কাউকে চেনেন? আপনাদের লাইনেরই লোক।”
অবাক গলায় রসিক বলে, “না তো, এ নামে তো কেউ নেই। কোথায় দেখা হল তার সঙ্গে?”
“কাল রাতে, চণ্ডীমণ্ডপে।”
“চেহারাটা কেমন বাবা?”
“অন্ধকারে আবছা দেখা। লম্বাচওড়া বলেই মনে হল।”
রসিক হঠাৎ “দাঁড়ান বাবা, পেছনের দিকটা একটু দেখে আসি” বলে ফস করে অন্ধকারে উলটোদিকে মিলিয়ে গেল।
ফটিক চাপা গলায় বলে, “আমার একটু ভয়-ভয় করছে।”
“সে আমারও করছে।”
“পালাবি?”
“এই অন্ধকারে পালানোও কি সোজা? যদি পালাই তা হলে ঘটনাটা জানাও হবে না।”
রসিক ফিরে এসে বলল, “চলুন বাবা।”
“পেছনে কী দেখে এলেন?”
“দিনকাল ভাল নয় বাবা, কেউ পিছুটিছু নিয়েছে কিনা সেটাই একটু দেখে এলুম।”
ফটিক জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা এই রায়মশাইটি কে বলুন তো?”
“আজ্ঞে নটবর রায়, আপনার পিসেমশাই।”
ফটিক অবাক হয়ে বলে, “তার আবার পুষ্যিপুস্তুরও ছিল নাকি?”
“যে আজ্ঞে। রায়মশাইয়ের ছেলেপুলে নেই, অগাধ ধনসম্পত্তি, তাই হরিরামপুরের আশুবাবুর ছেলেকে দত্তক নিয়েছিলেন। তিনিই দুলুবাবু।”
“তা বলে ত্যাজ্যপুত্তুর করলেন কেন?”
“সেও দুঃখের কথা বাবা। রায়মশাইয়ের মায়াদয়া বলে কিছু নেই। পনেরো বছর পেলে পুষে তারপর ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেন। দোষের মধ্যে দুলুবাবু একটু ফুর্তিবাজ ছিলেন আর কী।”
“শুধু সেইজন্য?”
“যে আজ্ঞে। বড় অবিচার হয়েছে বাবা।”
নিতাই বলল, “আর কত দূর?”
“এসে গেছি বাবা, ওই যে শিবমন্দিরের চুড়ো দেখা যাচ্ছে।”
অন্ধকারে জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে আবছা আকাশের গায়ে একটা মন্দিরের চূড়া অস্পষ্ট দেখা গেল। মিনিটখানেক হেঁটে তারা মন্দিরের চত্বরে ঢুকল। চারদিক সুনসান। কোথাও কোনও আলোর রেশমাত্র নেই।
ফটিক সভয়ে বলল, “কই, কেউ তো কোথাও নেই?”
কেউ জবাব দিল না। কিন্তু বাতাসে খুব মৃদু একটা শব্দ হল যেন। আর তারপরেই কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা ভারী লাঠি ফটিকের বাঁ কাঁধে এত জোরে এসে লাগল যে, সর্বাঙ্গে তীব্র ব্যথার একটা বিদ্যুত্তরঙ্গ খেলে গেল তার। চোখে অন্ধকার দেখে সে বসে পড়ল। হঠাৎ চারদিক থেকে ঝপাঝপ লাঠি নেমে আসছিল।
কিন্তু এতসব লাঠি সোঁটার মাঝখানে হঠাৎ ফটিকের হাতেও একটা লাঠি কী করে যেন চলে এল। লাঠিটা হাতে পেয়েই সে লাফিয়ে উঠে দমাদম চার দিকে লাঠি চালাতে লাগল। জীবনে সে কখনও লাঠিস্পর্শ করেনি কিন্তু এখন দিব্যি সে পাখসাট মেরে লাঠি চালাচ্ছে দেখে নিজেই ভারী অবাক হয়ে গেল। আরও আশ্চর্যের বিষয়, অন্ধকারে অন্তত দশ বারোটা লেঠেল তাদের ঘিরে ধরে লাঠি চালাচ্ছে বটে, কিন্তু আর একটাও লাঠি তার শরীরে লাগছে না, হাতে লাঠি বিদ্যুৎবেগে ঘুরে ঘুরে মার ঠেকিয়ে দিচ্ছে।
ফটিক ডাকল, “নিতাই, ঠিক আছিস?”
নিতাই একটু দুর থেকে বলল, “ঠিক আছি। তোর কী খবর?”
ফটিক বলল, “খবর বেশ ভালই। আমি যে এত ভাল লেঠেল কখনও টের পাইনি তো।”
নিতাই বলল, “আমিও পাইনি। চালিয়ে যা।”
ফটিক লাঠির ঘায়ে একজনকে ধরাশায়ী করে চেঁচিয়ে উঠে নিজেকেই বাহবা দিল, “সাবাস!”
নিতাই বলল, “কী হল রে?”
“একটাকে ফেলেছি।”
নিতাই বলল, “ধুস! আমি তিনটেকে ঘায়েল করলাম।”
ফটিকের ভয়-ডর কেটে গিয়ে ভারী আনন্দ হচ্ছিল। সে গুন গুন করে “দুর্গম গিরি কান্তার মরু…” গাইতে গাইতে আর দুজনকে ধরাশায়ী করে বলে উঠল, “নিতাই তোর কটা হল?”
“এই যে চার নম্বরটাকে ফেললাম।”
“চালিয়ে যা।”
ঠকাঠক ঠকাঠক লাঠির শব্দ হতে লাগল। সেই সঙ্গে ফটিকের গান আর প্রতিপক্ষদের মাঝে মাঝে “বাবা রে! মা রে! গেলুম রে।” বলে চিৎকার। নিতাইয়ের লাঠি খেয়ে কে একজন চেঁচিয়ে উঠল, “খুন…খুন করে ফেলল! বাঁচাও…বাঁচাও…”
ফটিক তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, “এঃ, লোকগুলো একেবারে আনাড়ি দেখছি!”