।। ৬ ।।
দীপাদেবীর ফিউনারেল হল তিনদিন বাদে। ফিউনারেল হোম থেকে ভৈরববাবুর অনুরোধে আমরা সবাই রাজা-ও-রাণী রেস্টুরেন্টে গেলাম। আমরা মানে– প্রমথ, আমি, একেনবাবু, গেরহার্ট সাহেব আর ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট। শুভ আসতে রাজি হল না। ভৈরববাবুও পেড়াপেড়ি করলেন না। শুভর এক বন্ধু কয়েকদিন ওঁর সঙ্গে থাকবেন বলে এসেছেন। দ্যাটস নাইস অফ হিম। এ সময়ে একজনের কাছে থাকাটা দরকার।
কোনো ফিউনারেল থেকে ফিরলে মনের যে অবস্থা থাকে, আমাদেরও তাই। প্রিয়জন বা পরিচিতকে চিরতরে হারানোর বেদনা তো থাকেই, সেইসঙ্গে জীবনের অসারতা, অনিত্যতা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে মনটা ভারাক্রান্ত করে তোলে। শুভকে বাদ দিলে দীপাদেবীর মৃত্যু প্রফেসর গেরহার্টকে বোধ হয় শোকাপ্লুত করেছে সবচেয়ে বেশি। ভৈরববাবুর মনও যথেষ্ট খারাপ। সেটা কাটিয়ে ওঠার জন্যই নিজেকে নানানভাবে ব্যস্ত রাখছেন। ওয়েটারকে অনেক রকম নির্দেশ দিলেন মেনু নিয়ে।
রেস্টুরেন্টটাকে নতুন করে সাজানো হচ্ছে। নতুন একটা ভিডিও সিস্টেম পার্টিরুমে লাগিয়েছেন। সেটা সবাইকে ডেকে দেখালেন। দেয়ালের ওয়ালপেপার বদলানো হয়েছে। অনেক নতুন ছবি টানানো হয়েছে দেখলাম। আমার এসব ব্যাপারে উৎসাহ নেই, কিন্তু একেনবাবু আর ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট আগ্রহভরে এগুলো দেখলেন, প্রশ্নটশ্নও কিছু করলেন। এরমধ্যেই একটি ওয়েটার এক প্রস্থ স্পেশাল কফি আর মশলা চা নিয়ে এল, সেই সঙ্গে কিছু পেস্ট্রি আর ডেনিশ। ভৈরববাবু জিজ্ঞেস করলেন, টোস্ট বা অমলেট কেউ খেতে চাই কিনা। সবাই ‘না’ বললাম।
একটু বাদে প্রফেসর গেরহার্ট উশখুশ করে আমি আর বসব না’ বলে উঠে দাঁড়ালেন। বারবার ভৈরববাবু অনুরোধ করাতেই উনি এসেছিলেন। সারাক্ষণই অন্যমনস্ক ছিলেন। মানসিকভাবে দীপাদেবীর সঙ্গে যে উনি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন তাতে সন্দেহ নেই।
“একটু বসুন স্যার, আপনি আমায় একটা কাজের ভার দিয়েছিলেন। যদিও দীপাদেবী সেই দায়িত্ব থেকে আমাকে মুক্তি দেন, তবু তার রিপোর্টটা অন্ততঃ আপনাকে দিই।”
“তার কি আর কোনো দরকার আছে?” গলার স্বরেই স্পষ্ট সেটা জানার আগ্রহ ওঁর তরফ থেকে অন্তত নেই।
“আছে স্যার, আপনি শুনলে বুঝতে পারবেন।”
গেরহার্ট সাহেব অত্যন্ত ভদ্রলোক। অনিচ্ছাসত্ত্বেও বসলেন।
একেনবাবু চায়ে একটা চুমুকুদিয়ে হঠাৎ ভৈরববাবুকে প্রশ্ন করলেন, “স্যার আপনি এরমধ্যে দীপাদেবীকে নিয়ে পোকোনোতে গিয়েছিলেন?”
প্রশ্নটা এত আকস্মিক যে ভৈরববাবুর হাত কেঁপে কিছুটা চা চলকে মাটিতে পড়ল।
“ত-তার মানে?” ভৈরববাবু কোনোমতে কথাটা বললেন।
“মানেটা পরে আসছি স্যার, কিন্তু সত্যি কথা বলবেন, কারণ আপনি গিয়েছিলেন কিনা, সেটা টোল-বুথের রেকর্ড থেকে স্টুয়ার্ট সাহেব অতি সহজেই বার করতে পারবেন। তাছাড়া পোকোনোতে আপনাকে দেখেছেন এমন লোকও আছেন।”
চায়ের কাপটা ভৈরববাবু তখনও ধরে আছেন, কিন্তু হাতটা অল্প অল্প কাঁপছে। একটু চুপ করে অনুচ্চস্বরে বললেন, “হ্যাঁ, গিয়েছিলাম।”
“কেন স্যার?”
ভৈরববাবু চুপ।
“প্রফেসর উডের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল, সেটা আমি জানি। কিন্তু কেন গিয়েছিলেন আর কী ঘটেছিল সেখানে, সেটা স্যার আপনার মুখ থেকেই শুনতে চাই। কিছু লুকোনোর চেষ্টা করবেন না, প্লিজ।”
ভৈরববাবু দেখলাম একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেছেন। মুহূর্তের মধ্যে কারও গলা ভেঙে যেতে পারে, সেটা আমি এই প্রথম দেখলাম। ভাঙা ভাঙা গলায় থেমে থেমে ভৈরববাবু বললেন, “সোনাবৌদি পোকোনোতে যেতে চেয়েছিলেন। আমি ভেবেছিলাম বেড়াতে যেতে চান। সেখানে পৌঁছনোর পর উনি প্রফেসর উডের ঠিকানা দিলেন। বললেন ওঁর সঙ্গে দেখা করতে চান। প্রফেসর বাড়িতে ছিলেন না। পাশের বাড়ির একজন বললেন যে প্রফেসর উপরে একটা টিলায় বসে পড়াশুনা করেন। সেখানে সোনাবৌদিকে নিয়ে যেতেই সোনাবৌদি এগিয়ে গিয়ে ওঁর সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করেন। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলাম সব কিছু ভালো শুনতে পাইনি।” এটুকু বলে ভৈরববাবু চুপ করলেন।
“যা শুনেছিলেন তাই বলুন স্যার। আর ঠিক কী কী ঘটেছিল সেটা বলুন।”
“প্রফেসর বেঞ্চে বসে একটা বই পড়ছিলেন। সোনাবৌদি সামনে গিয়ে একটা পাথর প্রফেসরকে দিতে উনি অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। সোনাবৌদি বললেন, এটা আপনার পাথর।
প্রফেসর বললেন, ‘এটা আপনি কোত্থেকে পেলেন?”
সোনাবৌদি বললেন, ‘বলছি, কিন্তু তার আগে বলুন দেবেশ রায়কে মারা হল কেন বা ঐরকম একটা কিছু। প্রফেসর কথাটা শুনে কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন। সোনাবৌদি এগিয়ে গিয়ে পাথর শুদ্ধ ওঁর হাতটা চেপে ধরে বললেন, এই পাথর আপনার, কিন্তু আপনাকে বলতেই হবে কেন আমি আমার স্বামীকে হারালাম?’ তারপর এগোতে এগোতে সোনাবৌদি আরও কিছু বললেন। প্রফেসর পেছোচ্ছিলেন, কিছু একটা বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু আমি ঠিক শুনতে পাইনি। তবে সোনাবৌদির এই মূর্তি আমি আগে দেখিনি। ওঁকে প্রায় উন্মাদিনীর মতো মনে হচ্ছিল। সমস্ত ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটছে যে আমার বোধ-বুদ্ধি লোপ পেয়েছিল। প্রফেসর ওঁর হাত ছাড়াবার চেষ্টা করছিলেন। না পেরে শেষে ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে পালাতে গিয়ে খাদের মধ্যে পড়ে যান। সমস্ত ঘটনাটাই কয়েক মিনিটের মধ্যে শেষ। সোনাবৌদি তখন ভীষণ কাঁদছেন, খালি বলছেন, ‘আমি তো এটা চাইনি, আমি তো এটা চাইনি, এখন কী হবে?’
আমিও পুরো নার্ভাস। কী করা উচিত, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ভীষণ ভয় পেয়ে কোনোমতে সোনাবৌদিকে গাড়িতে তুলে আমি চলে আসি। বিশ্বাস করুন প্রফেসরের মৃত্যুটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট, সোনাবৌদির কোনো দোষ নেই।” কথাগুলো বলে ভৈরববাবু কপালে হাত দিয়ে মাথা নীচু করে বসে রইলেন।
ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট উঠে এসে ওঁর কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, “আপনি আমার সঙ্গে চলুন, পুলিশ স্টেশনে গিয়ে আপনাকে স্টেটমেন্ট দিতে হবে।”
ভৈরববাবু আকুলদৃষ্টিতে একেনবাবুর দিকে তাকালেন।
“ভয় পাচ্ছেন কেন স্যার, যা সত্যি তাই বলবেন,” একেনবাবু বললেন।