দাদু ঘড়ি নিয়ে ফিরেছে, এতে লাটু নিশ্চিন্ত হতে পারেনি। ঘড়িটা সম্পর্কে তার কৌতূহল বরং দশগুণ বেড়েছে। নিত্য দাসের কথায় একটু আভাস পেয়েছিল লাটু। তারপর জটাইদাদুর থানে যে কাণ্ড দেখল, তা কহতব্য নয়। সেখানে চুরুটের গন্ধ ছিল। অর্থাৎ জটাইদাদুর কাছে গর্ডনসাহেব গিয়েছিল অবশ্যই। এর পরই খবর পাওয়া গেল, গর্ডনসাহেব তার কুকুরগুলো সমেত অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে ওয়ার্কশপে। সবচেয়ে বড় কথা হল, এইসব রহস্যজনক কাণ্ডের সঙ্গে ঘড়িটার কোথাও একটা যোগসূত্র থেকেই যাচ্ছে।
সুতরাং লাটু তক্কে তক্কে ছিল। আড়াল থেকে সে দাদু আর ঠাকুমার কথা সবই শুনেছে। দাদু যে ঘড়িটা লোহার আলমারিতে রেখে চাবি কোমরে গুঁজল, এটাও সে লক্ষ করেছে। অ্যানুয়াল পরীক্ষার পর এখন ইস্কুলে লম্বা ছুটি। দুপুর আর কাটতেই চায় না। তবু মটকা মেরে পড়ে থেকে সে দুপুরটা কাটাল। হারানচন্দ্র যখন বিকেলে বেরোনোর জন্য তৈরি হতে উঠলেন, তখন সেও উঠে পড়ল।
একটা সুবিধে হল এই যে, হারানচন্দ্রের বড় ভুলো মন। কাপড় বদলানোর সময় চাবির গোছাটা যে টেবিলে রাখলেন, সেটা পরক্ষণেই বেমালুম ভুলে গেলেন। সুতরাং দাদু বেরিয়ে যাওয়ার পর লাটু গিয়ে টেবিলের ওপর চাবিটা পেয়ে আলমারি খুলে ঘড়িটা বের করল।
ঘড়িটা বেশ বড়সড়। সাধারণ ঘড়ির মতো নয়। দেখতে ভারী বিদঘুঁটে। বারোটার জায়গায় চব্বিশটা ঘর। তাছাড়া ডায়ালের ওপর আরও কয়েকটা ছোট ডায়াল এবং কাঁটা রয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও সময়টা ধরতে পারল না লাটু।
কোনও রহস্যময় কারণে বাড়ির সব ঘড়িই দুপুর থেকে উল্টোবাগে চলছে। লাটুর দুই কাকা রজোগুণহরি আর বহুগুণহরি বার বার ঘড়িতে দম দিয়ে এবং মিলিয়ে কিছুই করতে পারছে না। শুধু দাদুর এই ঘড়িটা ঘড়ির মতোই সমানে চলছে বটে, কিন্তু ঘর বেশি থাকায় সময় ধরা যাচ্ছে না।
লাটুর একটা নিজস্ব টুলবক্স আছে। তাতে খুদে স্কু-ড্রাইভার, উকো, হাতুড়ি নানারকম যন্ত্রপাতি। বাক্সটা নিয়ে লাটু সোজা গিয়ে ঢুকল বড়কাকার ডার্করুমটায়।
ডার্করুমে ঢুকে লাটু দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর বাতি জ্বালানোর সুইচের দিকে হাত বাড়ায়। কিন্তু মজা হল, দরজা বন্ধ করার পর ডার্ক রুম যেরকম ঘুটঘুঁটে অন্ধকার হয়ে যাওয়ার কথা, তেমন অন্ধকার হয়নি। বেশ স্নিগ্ধ একটা আলোয় ঘরের সব কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
লাটু সুইচ টিপতে হাত বাড়িয়ে অবাক হয়ে থেমে চারদিক চেয়ে দেখতে থাকে। এই ডার্করুমে সে প্রায়ই ঢোকে এবং কাকার ফোটোগ্রাফির অনেক কাজে সাহায্য করে। কাজেই ঘরটা তার খুবই পরিচিত। এত আলো এ-ঘরে থাকার কথা নয়। এরকম আলোও লাটু কখনও দেখেনি।
চোখ কচলে লাটু ফের ভাল করে তাকাল। চারদিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করল। আসলে আলোটা কীরকম তা সে বুঝতে পারল না। সূর্যের আলোর রং সাদা, ফ্লুরোসেন্ট বাতির রং নীলাভ, বাবের আলো হলুদরঙা। কিন্তু এই আলোটার কোনও রং নেই। এমন কী, আলোটা যে জ্বলছে তাও বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু এক আশ্চর্য কার্যকারণে ঘরের প্রত্যেকটা জিনিসই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
লাটু অবাক হল, একটা ভয়-ভয়ও করতে লাগল। খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে সে ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করে।
হঠাৎ খুব কাছ থেকে কে যেন বলে ওঠে, “ওরা সব পাজি লোক। ওরা সব পাজি লোক।”
লাটু এত চমকে ওঠে যে, হাত থেকে ঘড়িটা প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। ভাল ক্রিকেট খেলে বলে এবং কখনও ক্যাচ ফশকায় না বলে পড়ো-পড়া ঘড়িটাকে ফের ধরে ফেলল সে। তারপর তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বেরোনোর চেষ্টা করতে গেল।
খুব মোলায়েম গলায় কে যেন ফের বলে ওঠে, “ভয় পেও। তোমার সঙ্গে কথা আছে।”
লাটুর বুকের ভিতরটায় দমাস-দমাস শব্দ হতে থাকে। গলা শুকিয়ে যায়। সে-চারদিকে চেয়ে কাউকেই দেখতে পায় না। হাত-পা ঝিমঝিম করছে ভয়ে। সে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
অশরীরী গলার স্বর ফের বলে ওঠে, “দরজার ছিটকিনিটা তুলে দাও।”
লাটুর হাত-পা যদিও ভয়ে কাঁপছে, তবু তার মনে হয়, এই আদেশ পালন না করলেই নয়। সে লক্ষ্মী ছেলের মতো ছিটকিনিটা তুলে দেয়।
ফের আদেশ হয়, “চেয়ারে বোসো।”
লাটু ডার্করুমের কাঠের চেয়ারটায় কাঠের পুতুলের মতোই বসে পড়ে।
“এবার ঘড়িটার দিকে তাকাও।”
লাটু হাতে ধরা ঘড়িটার কথা একদম ভুলে গিয়েছিল। ঘড়িটা তার মুঠোতেই ধরা রয়েছে। সে মুঠো খুলে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে ভারী অবাক হয়ে যায়। ঘড়ির মস্ত ডায়ালটার চেহারা একদম পাল্টে গিয়েছে। কাঁটাগুলো আর দেখা যাচ্ছে না। ঘড়ির কাঁচটা একদম ঘষা কাঁচের মতো অস্বচ্ছ। তবে কাঁচটা খুব উজ্জ্বল।
লাটু ঘড়িটার দিকে মুখ নিচু করে চেয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন নিবিষ্ট হয়ে পড়ে। তার মনে হয়, এক্ষুনি একটা কিছু ঘটবে। কী ঘটবে তা সে অবশ্য জানে না।
ঘড়ির উজ্জ্বল কাঁচটা ধীরে ধীরে হলুদ রং ধরল, ফের আস্তে আস্তে নীলচে হয়ে গেল, তারপর সাদাটে হতে লাগল।
লাটু হাঁ করে চেয়ে থাকে। একবার ভয়ে ঘড়িটা ফেলে দিতে যাচ্ছিল, সেই অশরীরী স্বর সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, “ফেলো না। তাকিয়ে থাকো। আমাকে দেখতে পাবে। ভয় নেই।”
“আপনি কে?”
“আমি? আমি একজন। চিনবে না।”
“আপনি কোথা থেকে কথা বলছেন?”
“অনেক দূর থেকে।”
“কত দূর?”
“সেটা তুমি ধারণাও করতে পারবে না।”
“আমি ভয় পাচ্ছি যে।”
“ভয় নেই। তুমি হবে আমার প্রতিনিধি।”
“প্রতিনিধি? কিসের প্রতিনিধি?”
“আমার প্রতিনিধি হয়ে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।”
“ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে বলছেন কেন?”
“আমাকে দেখতে পাবে। তাকিয়ে থাকে। আমার ছবি ফুটে উঠবে।”
লাটু তাকিয়ে থাকে। কয়েক সেকেন্ড বাদে ধীরে ধীরে ঘড়ির কাঁচে একটা মুখের আদল ফুটে উঠতে থাকে। ভারী অদ্ভুত মুখ। খুব লম্বা, গালভাঙা, কর্কশ একটা মুখ। চোখ দুটো গর্তের মধ্যে। মাথায় একটা হুডওলা টুপি কপাল ঢেকে আছে। মানুষেরই মুখ, তবে এরকম মুখ সচরাচর দেখা যায় না। অনেকটা আব্রাহাম লিঙ্কনের মতো। তবে আরও ধারালো, আরও বুদ্ধিদীপ্ত। কিন্তু মুখটার মধ্যে একটা অমানুষিকতাও আছে।
লাটু ভয়ে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে সম্মোহিতের মতো ঘড়ির পর্দায় চেয়ে থাকে।
ছবির মুখটা নড়ল এবং স্পষ্ট ও পরিষ্কার স্বর কানে এল লাটুর। “আমাকে দেখতে পাচ্ছ?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“আমি তোমাদের ভাষা জানি না। আমি যে ভাষায় কথা বলছি সেটা কি তোমার ভাষা?”
“হ্যাঁ। আপনি বাংলা ভাষায় কথা বলছেন।”
লোকটা হাসল। বলল, “মোটেই নয়। আমি নিজের ভাষায় কথা বলছি। তবে একটা অনুবাদ্যযন্ত্র আমার সব কথা তোমার ভাষায় অনুবাদ করে দিচ্ছে। তোমাদের ভাষা শিখতে যন্ত্রটার বেশ সময় লেগেছে। এত বিদঘুঁটে ভাষা কেন তোমাদের?”
লাটু কী বলবে? সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুধু চেয়ে থাকে। লোকটা জিজ্ঞেস করল, “দাড়িওয়ালা ফর্সা আর লম্বা চেহারার যে লোকটার কাছে এ ঘড়িটা এর আগে ছিল, সে কে বলো তো!”
লাটু বলল, “গর্ডন সাহেব।”
“আর তার আগে লম্বা চুল আর দাড়িওলা লোকটা?”
“জটাই তান্ত্রিক।”
“ওরা কেমন লোক?”
“ভাল লোক।”
ছবির লোক্টা হাসল। বলল, “ওরা দুজনেই আমাদের এই ঘড়িটা খুলবার চেষ্টা করেছিল।”
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ। কিন্তু এটা খুব বিপজ্জনক। তুমি কখনও ঘড়িটা খুলবার চেষ্টা কোরো না। যদি করো তাহলে যন্ত্রই তার প্রতিশোধ নেবে। যেমন ওদের ওপর নিয়েছে।”
“ওদের কী হয়েছে?”
“খুব বেশি কিছু নয়। আমরা ওটাকে বলি যন্ত্র-সম্মোহন। আমাদের যন্ত্র ওদের সম্মোহিত করে রেখেছে। যতদিন সম্মোহন থাকবে, ততদিন ওরা আমাদের ভাষায় কথা বলবে, আমাদের যন্ত্র যেরকম তরঙ্গ সৃষ্টি করবে, সেই রকমই চিন্তা করবে। ওদের নিজস্ব সত্তা থাকবে না।”
“সম্মোহন কাটবে না?”
“কাটবে। সে ব্যবস্থা আমরা করব। চিন্তা কোরো না। কিন্তু তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।”
“বলুন।”
“আমাদের হয়ে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।”
“কী কাজ?”
“আমাদের একজন লোক আমাদের সঙ্গে দারুণ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ওই যে যন্ত্রটা তোমার হাতে রয়েছে, ওটা কিন্তু ঘড়ি নয়। অত্যন্ত জরুরি একটা যন্ত্র। বিজ্ঞানের এক আশ্চর্য আবিষ্কার। ওই বিশ্বাসঘাতক যন্ত্রটি নিয়ে পালিয়ে যায়। সে গিয়ে তোমাদের পৃথিবীতে আশ্রয় নিয়েছে। তবে বুঝতে পারছি, পৃথিবীতে নামবার সময় সে কোনও দুর্ঘটনায় পড়ে, এবং যন্ত্রটি তার হাতছাড়া হয়ে যায়। নানা হাত ঘুরে এখন ওটি তোমাদের হাতে এসেছে। আমরা যন্ত্রটা ফেরত চাই।”
লাটু অবাক হয়ে বলে, “বেশ তো, ফেরত নিন।”
ছবির লোকটা হাসল। বলল, “অত সহজ নয়। আমরা এখন মহাকাশের যেখানে রয়েছি, সেখান থেকে তোমাদের গ্রহে পৌঁছোতে অন্তত সাত দিন লাগবে। ততদিনে ওই দুষ্টু লোকটা চুপ করে বসে থাকবে না। সে পাগলের মতো যন্ত্রটা খুঁজে বেড়াচ্ছে।”
লাটু ভয় পেয়ে বলে, “তাহলে কী হবে?”
“তুমি কি খুব ভিতু?”
“আমি ছোট্ট একটা ছেলে তো! গায়ে বেশি জোরও নেই।”
“আমরা ছোট ছেলেই তো চাই। একাজ তোমাদের গ্রহের বড় মানুষেরা পারবে না। বড়দের মনে নানারকম সংশয়, সন্দেহ ইত্যাদি আছে। বাচ্চাদের ওসব নেই। এ কাজে আমরা তোমাকেই নিয়োগ করছি। মাত্র সাত দিন লোকটার চোখে ধুলো দিতে হবে। তোমাদের পৃথিবীর দিনরাত্রির হিসেবে সাতটা দিন।”
“লোকটা কী করতে চায়?”
“লোকটা ওই যন্ত্রটা দখল করতে চায়। একবার হাতে পেলেই সে আমাদের নাগাল এড়িয়ে পালিয়ে যাবে। সে নানারকম প্রযুক্তি আর যন্ত্রবিদ্যা জানে। অসম্ভব ধূর্ত এবং নিষ্ঠুর। সে যে মহাকাশযানটি নিয়ে পালিয়ে গেছে সেটিকে সম্ভবত তোমাদের কোনও সমুদ্রের গর্ভে লুকিয়ে রেখেছে। আমাদের সন্ধানী শব্দতরঙ্গ দিয়ে কিছুতেই সেটার হদিস করতে পারিনি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, পৃথিবীতে নামবার সময় সে কোনও দুর্ঘটনায় পড়েছিল। ফলে ওই মহামূল্যবান যন্ত্রটা তার হাতছাড়া হয়। কিন্তু দুর্ঘটনা খুব গুরুতর নয়। সে বেঁচে আছে।”
“লোকটার নাম কী? দেখতে কেমন?”
“তার নাম অবশ্য সে পাল্টে ফেলেছে। তবে আমরা তাকে রামরাহা বলে ডাকি। দেখতে অনেকটা আমার মতো। কিন্তু সে ইচ্ছেমতো চেহারা পাল্টাতে পারে। তবু বলে রাখি, তোমাদের হিসেবে সে প্রায় ছ ফুট লম্বা। স্বাস্থ্য ভাল। সে ঘণ্টায় একশো মাইল বেগে দৌড়োতে পারে। দশ ফুট উঁচু লাফ দিতে পারে, তোমাদের গ্রহের গড়পড়তা মানুষদের দশজনকে সে একাই কাবু করতে পারে। ব্রুস লি বা মহম্মদ আলি তার কাছে কিছুই নয়। কিন্তু এসব তেমন বিপজ্জনক নয়। তার কাছে যে মারণাস্ত্র আছে, তা দিয়ে সে পৃথিবীকে একেবারে গুঁড়ো-গুঁড়ো করে দিতে পারে। তা ছাড়া তার বুদ্ধি ক্ষুরধার, বিজ্ঞান সে ভালই জানে। যে-কোনও বস্তুর অণুর গঠন বদলে দিয়ে সে অন্য বস্তু তৈরি করতে পারে। মাটিকে সোনা, জলকে পেট্রল বানানো তার কাছে ছেলেখেলা। তার কাছে আছে বিবিধ রশ্মি-যন্ত্র। অর্থাৎ সে নিজের চারধারে এমন রশ্মি সৃষ্টি করতে পারে যাতে তোমরা তাকে দেখতে পাবে, কিন্তু সে তোমাদের স্পষ্ট দেখতে পাবে। তোমাদের যেসব সেকেলে অস্ত্রশস্ত্র আছে, অর্থাৎ বন্দুক, রিভলভার, মেশিনগান বা বোমা সেগুলো তার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। তোমাদের তুলনায় সে অতিমানুষ। শারীরিক গঠন, বুদ্ধি, ক্ষিপ্রতা কোনওটাতেই তোমাদের কেউ তার একশো ভাগের এক ভাগও নও। যন্ত্রবিদ্যায় তোমরা তার হাঁটুর সমান।”
“তাহলে কী করে তার সঙ্গে পারব?”
“আবার বলছি, ভয় পেও না। ভয় পেলে বুদ্ধি স্থির থাকে। আমাদের ধারণা, সে এখন তোমাদের কোনও সমুদ্রের গর্ভে তার মহাকাশযানে বিশ্রাম নিচ্ছে। হয়তো টুকটাক কিছু মেরামতও সেরে নিচ্ছে। তারপরই সে ওই যন্ত্রটার খোঁজে বেরোবে। যন্ত্রটা খুঁজে পেতে তার কোনও অসুবিধাই হবে না, কারণ ওই যন্ত্র সর্বদাই শক্তি বিকিরণ করছে আর তার কাছে আছে চমৎকার সন্ধানী যন্ত্র। তবে সে প্রথমেই দুম করে কিছু করে বসবে না। সে জানে, কোনও বিস্ফোরণ ঘটালে বা শব্দতরঙ্গ কিংবা রশ্মিযন্ত্র চালু করলে আমরা তার সন্ধান পেয়ে যাব, কাজেই সে স্বাভাবিক সব পন্থা নেবে। নানারকম বুদ্ধির চাল চালবে।”
“কিন্তু সে তো তাহলে জিতেই যাবে!”
“হয়তো জিতবে। তার তো জেতারই কথা। কিন্তু তোমার একটা বাড়তি সুবিধা আছে। সেটা হল তোমার হাতের ওই যন্ত্র। এই যন্ত্রকে তুমি সব কাজের কাজি বলতে পারো। আমাদের ভাষায় ওর নাম বুত বুত। তুমি ওটার নাম দাও কাজি। যদি বুদ্ধি স্থির রাখতে পারো আর ভয় না পাও, তবে কাজি তোমাকে নানা উপায় বলে দিতে পারবে। কাজির মধ্যে আছে অফুরন্ত মগজ আর অনন্ত উদ্ভাবনীশক্তি যা আমাদেরও নেই। সুতরাং কাজির কথামতো যদি চলো তবে রামরাহা তোমাকে সহজে হারাতে পারবে না। এখন তুমি একটা কাজ করো। যত শিগগির পারো, গর্ডন সাহেবের ওয়ার্কশপে গিয়ে ঘাঁটি করো।”
“গর্ডনের ওয়ার্কশপ! ও বাবা! সেখানে যে অনেক কুকুর।”
“তাতে কী? কাজি কুকুরদের এমন শাসন করে রাখবে যে, তারা তোমার বশংবদ হয়ে থাকবে। তারাই পাহারা দেবে তোমাকে।”
“আর গর্ডন সাহেবের পিসি? সে যে ভারী ঝগড়ুটে!”
“কাজি এমন ব্যবস্থা করবে যে, পিসি ভুলেও ওয়ার্কশপের ধারেকাছে যাবে না। কুকুরেরা তাকেও তাড়া করবে।”
“কিন্তু ওয়ার্কশপে কেন?”
“ওয়ার্কশপই যে দরকার। গর্ডনের ওয়ার্কশপ আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি। খুবই সেকেলে মান্ধাতার আমলের ব্যবস্থা। তবে গর্ডন কিছু উদ্ভট চিন্তা করেছিল। তার ফলে কতগুলো যন্ত্র সে আধখ্যাঁচড়া তৈরি করেছে। তুমি সেগুলো সম্পূর্ণ করে নিতে পারো।”
“আমি? আমি তো বিজ্ঞান কিছুই জানি না।”
“চিন্তা নেই। কাজি তো আছেই। তুমি শুধু তার কথামতো চললেই হবে।”
“একা থাকব ওখানে?”
“একদম একা। কাউকে সঙ্গে নিও না।”
“বাড়িতে কী বলে যাব?”
“যাহোক একটা কিছু বোলো। আমাদের বাড়ি নেই, আত্মীয়স্বজন নেই। কাজেই তোমাদের ওসব সম্পর্কের কথা আমরা জানিই না।”
“তোমার মা বাবা দাদু নেই?”
লোকটা হাসল। বলল “আছে। কিন্তু আমরা তো তোমাদের মতো নই। আমরা অন্যরকম। সে কথা থাক। কাজটা কি শক্ত মনে হচ্ছে?”
“ভীষণ শক্ত, ভীষণ বিপজ্জনক।”
“মাত্র সাতটা দিন আমাদের সহায় হও। তোমাদের স্বার্থেই। রামরাহা তো পৃথিবীকে ধ্বংসও করতে পারে!”
লাটু একটু ভাবল, তারপর বলল, “চেষ্টা করব।”
“শাবাশ! এই তো চাই! কাজিকে সবসময়ে কাছে রেখো। খুব লক্ষ করলে দেখবে ওর নানা জায়গায় খুব সূক্ষ্ম ছিদ্র আছে। ভাল করে দ্যাখো।”
লাটু ঘড়িটা খুব ভাল করে উল্টেপাল্টে দেখল। খুব সূক্ষ্ম কয়েকটা ফুটো নজরে পড়ল তার। বলল, “আছে। দেখলাম।”
লোকটা বলল, “একটা সরু তারের মুখ বা ছুঁচ হাতের কাছে রেখো। একটা ফুটোর ওপরে একটা কাটাকুটি দাগ আছে, সেটাতে যদি ওই তার বা ছুঁচ ঢুকিয়ে চাপ দাও তাহলে কাজি তোমাকে নানা বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া শেখাবে। যে ছ্যাঁদায় ঢ্যাঁড়া আছে, তা তোমাকে শেখাবে লড়াইয়ের পদ্ধতি। যে ছিদ্রটার গায়ে একটা গোল মাকা আছে তা যে-কোনও বস্তুকে খাদ্যে পরিণত করার বুদ্ধি দেবে। আরও আরও বহু গুণ আছে, কিন্তু সেগুলো তোমার জানার দরকার নেই। কাজিকে যেখানে রাখা হবে, তার আশপাশের অন্তত দেড়শো গজের মধ্যে একটা আলাদা অদৃশ্য শক্তির ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যাবে। আলোর প্রতিফলনে বাধা আসবে, ঘড়ি চলবে উল্টো দিকে। কাজেই উদ্ভট কিছু দেখে প্রথমেই ভয় পেও না।”
লাটু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বলল “ওঃ, তাই ওরকম সব হচ্ছিল!”
“এবার বুঝেছ?”
“হুঁ।“
“তাহলে লক্ষ্মী ছেলের মতো যা বলেছি কোরো। রামরাহাকে তুমি হারাতে পারবে না বটে, কিন্তু সাতটা দিন যদি তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারো, তাহলেই যথেষ্ট।”
“আপনি এখন কোথায় আছেন?”
“বললাম তো! অনেক দূরে। এখান থেকে ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ওয়েভ বা আলো তোমাদের গ্রহে পৌঁছতে অনেক সময় নেয়।”
“তাহলে আপনার কথা আমি শুনতে পাচ্ছি কী করে?”
“এ হচ্ছে মেকানিক্যাল টেলিপ্যাথি। তোমরা বুঝবে না। যন্ত্রের সঙ্গে মানসিক ক্রিয়ার এক জটিল সমন্বয়। আমরা আলো বা ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ওয়েভের গতির চেয়ে অনেক বেশি দ্রুতবেগে বার্তা পাঠাতে পারি।”
লাটু দেখল কাজির কাঁচ থেকে ছবিটা মুছে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। লোকটা হাত তুলে বলল, “বিদায়। আবার দেখা হবে।”
“আপনার নাম কী?”
“খ্রাচ খ্রাচ। সাবধানে কাজ কোরো। ভয় পেও না। বুদ্ধি যেন স্থির থাকে।” বলতে বলতেই খ্রাচ গ্রাচের ছবি মিলিয়ে গেল। লাটু হতভম্ব হয়ে বসে ভাবতে লাগল, ঘটনাটা সত্যি না স্বপ্ন!