৬. জলে–স্থলে মৃত্যুফাঁদ
অরণ্যপথে হেঁটে চলেছেন চন্দ্রগুপ্ত ও ক্ষুদ্রক। পৃথিবীর বুকে আগুন ছড়িয়ে হাসছে মধ্যাহ্নের প্রখর সূর্য। একসময়ে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে উপবেশন করল তারা। ক্ষুদ্রক জানাল সে ক্ষুধার্ত। চন্দ্রগুপ্ত বললেন তার অবস্থাও সঙ্গীর মতন, তবে তাদের সাময়িক আস্তানায় পৌঁছেও ক্ষুধানিবারণের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়কারণ, যাবতীয় খাদ্য নিঃশেষ, ভাণ্ডার একেবারেই শূন্য। ক্ষুদ্রক পিঠের শরপূর্ণ তুণীর ও ধনুক নামিয়ে রেখেছিল, এখন আবার ধনুর্বাণ পৃষ্ঠদেশে স্থাপন করে উঠে দাঁড়াল, বজ্রকে ছেড়ে দেওয়া উচিত হয়নি। সে থাকলে অনায়াসে মাংসাহারের ব্যবস্থা করত। আমি শিকারে তার মতো দক্ষ নই। আমার তীরে বিদ্ধ হয়ে কখনো কখনো সম্বর বা বরাহ ধরাশায়ী হয়নি, গভীর অরণ্যে আহত অবস্থায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। কিন্তু বজ্রের হাতের লাঠি বজ্রের মতোই অব্যর্থ শরাহত শিকার পলায়ন করার আগেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ে লাঠির আঘাতে তাকে ভূপাতিত করে।
চন্দ্রগুপ্ত জানালেন তার নিক্ষিপ্ত শর অগ্রাহ্য করে আজ পর্যন্ত কোনো হরিণ বা বরাহ পলায়ন করতে সমর্থ হয় নি তবু শিকারের সন্ধানে বনে বনে ভ্রমণ করার ধৈর্য তার নেই; খাদ্যের চাইতে বিশ্রামের প্রয়োজন এই মুহূর্তে তিনি বিশেষ ভাবে অনুভব করছেন। সংগঠন ও সেনা সংগ্রহের জন্য কয়েকটি স্থানে বজ্রকে প্রেরণ করা হয়েছে, বন্ধুদের জন্য মাংস সংগ্রহের চাইতে ওই কাজগুলি অনেক বেশি প্রয়োজনীয়। অতএব ক্ষুদ্রক যদি নিতান্তই আহার্যের জন্য ব্যাকুল হয়, তাহলে তাকেই ফলমূল সংগ্রহ করতে হবে এবং ফলাহারে রুচি না থাকলে উদ্যোগী হয়ে ধনুর্বাণ নিয়ে যাত্রা করতে হবে শিকারের সন্ধানে। সংক্ষেপে ক্ষুদ্রককে তার বক্তব্য জানিয়ে অবসাদভরে চন্দ্রগুপ্ত নিমীলিত করলেন নিদ্রাকাতর দুই চক্ষু…।
ক্ষুদ্রক অতিশয় মাংসপ্রিয়। নিতান্ত নিরুপায় না হলে সে ফলমূল দিয়ে উদর পূরণ করতে রাজি হয় না। তাই ধনুকে বাণ চড়িয়ে সে প্রবেশ করলো গভীর বনের মধ্যে….
আচম্বিতে অরণ্যের স্তব্ধতা ভঙ্গ করে বেজে উঠল রমণীকণ্ঠে তীব্র আর্তনাদ। শিকারের কথা ভুলে শব্দ লক্ষ্য করে ছুটল ক্ষুদ্রক। আর্তনাদ ভেসে আসছে নিকটবর্তী নদীর দিক থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নদীতীরে উপস্থিত হয়ে ক্ষুদ্রক দেখল তীব্র জলস্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক রমণীকে। একমুহূর্ত ইতস্তত করল ক্ষুদ্রক, তারপর ধনুক ও তুণ নামিয়ে রেখে চিৎকার করে রমণীর দৃষ্টি আকর্ষণ করল, ভয় নেই, আমি আসছি।
পরক্ষণেই জলে ঝাঁপ দিল ক্ষুদ্রক…
অতিকষ্টে রমণীকে খরস্রোতা নদীর গ্রাস থেকে উদ্ধার করে ক্ষুদ্রক এসে পৌঁছাল নদীর পাড়ে। সিক্তবসনার দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে সে বুঝতে পারল মেয়েটির বয়স বেশি নয়। নিতান্তই কিশোরী কিন্তু তার সুগঠিত দেহ ও সুন্দর মুখের উপর আভিজাত্যের স্বাক্ষর অতিশয় স্পষ্ট;- একনজর দেখলেই অনুমান করা যায় তার জন্ম অভিজাত বংশে। মেয়েটির পোশাক-পরিচ্ছদ মূল্যবান, যদিও জলে ভিজে সেই পরিচ্ছদের অবস্থা হয়েছে শোচনীয়। মেয়েটিকে প্রশ্ন করে ক্ষুদ্রক জানতে পারল সে বিদর্ভ রাজ্যের রাজকন্যা, নাম চন্দ্রাবতী। অতঃপর চন্দ্রাবতী যা বলল তা হচ্ছে নিম্নবর্ণিত কাহিনি
গ্রীকসম্রাট আলেকজান্ডার বিদর্ভরাজ সুযোধনকে তার বশ্যতা স্বীকার করতে বলেন। কিন্তু গর্বিত সুযোধন গ্রীসের অধীনতা স্বীকার করতে চাইলেন না। অতএব, যুদ্ধ বাধল। রণকুশল বিশাল গ্রীকবাহিনীকে প্রায় সাত দিন ঠেকিয়ে রেখেছিল বিদর্ভের ক্ষুদ্র সেনাদল, তারপর আর অসম্ভবকে সম্ভব করা গেল না- বিদর্ভরাজ্যের পতন ঘটল। রাজা সুযোধন রাজকোষ থেকে স্বর্ণমুদ্রায় পরিপূর্ণ দুটি থলি নিয়ে সীমান্তের নিকটবর্তী গভীর অরণ্যে আত্মগোপন করলেন। কিন্তু তার গতিবিধি গ্রীকদের অজানা রইল না, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে তারা বনের মধ্যে তার অনুসন্ধান করতে লাগল। বিদভরাজের ইচ্ছা ছিল বনের ভিতর গা-ঢাকা দিয়ে প্রতিবেশী দ্বিরদরাজ্যে উপস্থিত হয়ে আত্মপরিচয় গোপন করে কিছুদিন বসবাস করবেন তারপর সুযোগ বুঝে আবার হৃতরাজ্য বিদেশির কবল থেকে উদ্ধার করতে সচেষ্ট হবেন। কিন্তু অনুসরণকারী গ্রীকদের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠছে দেখে রাজকুমারী বৃদ্ধ পিতাকে বনের মধ্যে এক জায়গায় লুকিয়ে রেখে ইচ্ছা করেই সৈন্যদের দৃষ্টিপথে ধরা দিল। মহা উৎসাহে সৈন্যরা রাজকন্যাকে তাড়া করল। ভুলপথে পরিচালিত করে বনমধ্যে লুক্কায়িত বিদর্ভরাজের থেকে অনেক দূরে গ্রীকদের নিয়ে এল রাজকন্যা চন্দ্রাবতী এবং একসময়ে তাদের অগোচরে ঘাট থেকে একটি ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে নদী পার হওয়ার চেষ্টা করল। চন্দ্রাবতী জানত কাউকে না পেয়ে হতাশ গ্রীকসেনা শিবিরে ফিরে যাবে। পরে সন্ধ্যার সময়ে আবার নৌকার সাহায্যে এপারে এসে সে পিতার সঙ্গে মিলিত হবে এবং সমগ্র রাত্রি বনের মধ্যে কাটিয়ে ভোর হতে না হতেই নির্দিষ্ট লক্ষ্য অভিমুখে যাত্রা করবে। পরিকল্পনা ভালোই ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় খরস্রোতা নদীতে অনভ্যস্ত নৌকা সামাল দিতে পারল না রাজদুহিতা চন্দ্রাবতী- নৌকো নিমজ্জিত হল নদীগর্ভে! সন্তরণে দক্ষ হলেও তীব্র স্রোতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে সে যখন অবসন্ন দেহে মৃত্যু আসন্ন বলে মনে করেছে, সেইসময়ে অভাবিতভাবে অকুস্থলে উপস্থিত হয়ে রাজকন্যাকে নিশ্চিত সলিলসমাধি থেকে উদ্ধার করল ক্ষুদ্রক।
সবিস্তারে পূর্বকথা জানিয়ে রাজকন্যা চন্দ্রাবতী ক্ষুদ্রকের সাহায্য প্রার্থনা করল। অবশ্য তার আগে সে উদ্ধারকর্তার পরিচয় জানতে চেয়েছিল। ক্ষুদ্রক হেসে বলল, রাজকুমারী আমি মৃগয়াজীবী ব্যাধ, শিকারের সন্ধানে বনমধ্যে ভ্রমণ করতে করতে আপনার আর্তনাদে আকৃষ্ট হয়ে অকুস্থলে এসে পড়েছিলাম। এই মুহূর্তে এইটুকুই আমার পরিচয়। এখন আপনার পিতার কাছে আমাকে নিয়ে চলুন। কিন্তু তার আগে আমার ধনুক ও শরপূর্ণ তুণীরটিকে উদ্ধার করা দরকার। জলে ভিজে ধনুকের ছিলা অকেজো হয়ে যেতে পারে এবং তীরগুলিও নদীর তীব্রস্রোতে ভেসে যেতে পারে বলে ধনুক ও তুণীর নদীর পারে একজায়গায় শক্ত মাটির উপর রেখে এসেছি। নদীর তে আমাদের ওই স্থান থেকে বহুদূরে নিয়ে এসেছে। এখন সর্বাগ্রে ওইগুলিকে উদ্ধার করতে হবে। ধনুর্বাণ সঙ্গে থাকলে এই অরণ্যের মধ্যে একটি বৃহৎ বাহিনীকেও আমি একক প্রচেষ্টায় বিদ্ধস্ত করতে পারি। এই বনের অন্ধিসন্ধি আমার নখদর্পণে– অতএব ধনুর্বাণে সজ্জিত হলে আপনাকে ও আপনার পিতাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেওয়া আমার পক্ষে আদৌ কঠিন হবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, রাজকন্যা।
চন্দ্রাবতী বলল, তোমার কথা শুনে আশ্বস্ত হলাম।
ধনুর্বাণ উদ্ধার করার পর যথাসম্ভব শীঘ্র পিতার কাছে যাওয়া প্রয়োজন। তাকে যেখানে রেখে এসেছি, অনুসরণকারী শত্রুদের পক্ষে সেখানে তার সন্ধান পাওয়া খুবই কঠিন। তবু বলা তো যায় না, যে-কোনো সময়ে অভাবিত দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
পরিত্যক্ত ধনুর্বাণের উদ্দেশ্যে পদচালনা করতে করতে ক্ষুদ্রক বলল, আপনার কথা সত্য। দুর্ঘটনার সম্ভাবনা অবশ্যই আছে। রাজকুমারী! আমায় বলুন, কোথায় লুকিয়ে আছেন বিদর্ভরাজ সুযোধন?
বনের উত্তরদিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে চন্দ্রাবতী বলল, ওইদিকে ঘন ঝোপের আড়ালে এক জায়গায় আত্মগোপন করেছেন মহারাজ সুযোধন।
চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ক্ষুদ্রক, সভয়ে বলে উঠল, সর্বনাশ!
তার মুখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেল চন্দ্রাবতী, উদ্বিগ্নকণ্ঠে বলল, সর্বনাশ বলছ কেন? ওখানে কি নরখাদক শ্বাপদের আস্তানা আছে? তবে বৃদ্ধ হলেও আমার পিতা অতিশয় শক্তিশালী, বয়স তাঁর শক্তি হরণ করতে পারে নি। তিনি সশস্ত্র, তাঁর কটিবন্ধে রয়েছে শাণিত তরবার। শ্বপদ আক্রমণ করলেও তিনি আত্মরক্ষা করতে পারবেন বলে মনে হয়।
না, রাজকন্যা। ওই শত্রুর কবলে পড়লে মহারাজ কিছুতেই আত্মরক্ষা করতে পারবেন না। মাংসোলোলুপ হিংস্র ব্যাঘ্র বা সিংহ পর্যন্ত ওই শত্রুকে ভয় পায়, এড়িয়ে চলে। এবার তার কবলে পড়লে অমিতশক্তিধর মত্ত হস্তীরও মৃত্যু অবধারিত।
বলো কী! কে এই দুর্জয় শত্রু?
চোরাবালি। আমরা অর্থাৎ মৃগয়াজীবী বনচর মানুষ ও বন্য পশুর দল ওই বিপদ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন। চোরাবালির মরণফঁদকে আমরা এড়িয়ে চলি। তবে বনপথে অনভ্যস্ত পথিক চোরাবালিতে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে, এমন ঘটনা খুব বিরল নয়
চন্দ্রাবতীর মুখ রক্তহীন হয়ে গেল, সে কিছু বলতে চেষ্টা করল। কিন্তু তার নীরব কণ্ঠ সরব হওয়ার আগেই ভেসে এল তীব্র আর্তস্বর বনের উত্তর দিক থেকে, বাঁচাও! বাঁচাও! বাঁচাও! কে
আছ আমাকে বাঁচাও! আমি ডুবে যাচ্ছি, তলিয়ে যাচ্ছি– বাঁচাও!
চন্দ্রাবতীর দিকে একবারও না তাকিয়ে শব্দ লক্ষ্য করে তীরবেগে ছুটল ক্ষুদ্রক। তাকে অনুসরণ করল রাজকুমারী চন্দ্রাবতী…
ভয়াবহ দৃশ্য! মাটির ভিতর ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে একটি মানুষ, তার কোমর পর্যন্ত গ্রাস করেছে ক্ষুধার্ত মৃত্তিকা! চোরাবালির মরণফাঁদ!
পিতাকে ওই অবস্থায় দেখে চিৎকার করে উঠল চন্দ্রাবতী, তারপর তার দিকে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করতেই বাধা পড়ল, চন্দ্রাবতীর হাত ধরে সজোরে টেনে আনল ক্ষুদ্রক, রাজকুমারী! নির্বোধের ন্যায় আচরণ করবেন না। ওখানে গেলে পিতাকে আপনি উদ্ধার করতে পারবেন না, উপরন্তু আপনিও হবেন চোরাবালির শিকার।
কিন্তু তাহলে পিতাকে রক্ষা করব কেমন করে? শত্রুসেনার হাত থেকে পালিয়ে এসে শেষে কী চোরাবালির গ্রাসেই মৃত্যুবরণ করবেন বিদর্ভরাজ সুযোধন?
রাজকুমারী! অস্থির হবেন না, আমাকে ভাবতে দিন।
ইতস্তত দৃষ্টিপাত করে হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল ক্ষুদ্রক, অসি কোষমুক্ত করে ছুটে গেল একটি গাছের দিকে। সেই গাছের সঙ্গে জড়িত লতাকে অসির আঘাতে ছিন্ন করে একটি প্রস্তরখণ্ডের সঙ্গে লতাটিকে বেঁধে ফেলল সেতারপর লতায় বাঁধা পাথরটিকে সজোরে ছুঁড়ল চোরাবালির গ্রাসে বিপন্ন মানুষটির দিকে, ধরুন মহারাজ! শক্ত করে চেপে ধরুন। আমি আপনাকে এখনই টেনে আনছি নিরাপদ স্থানে। এই লতা অত্যন্ত কঠিন, ছিঁড়ে যাওয়ার ভয় নেই।
পাথরসমেত লতাটি মহারাজের সামনে এসে পড়তেই তিনি দুহাতে সেটা চেপে ধরলেন। এইবার চলল টানাটানি চোরাবালি সহজে শিকারকে মুক্ত করতে চায় না, নাছোড়বান্দা ক্ষুদ্রকও পরাজয় স্বীকার করতে রাজি নয়!… অবশেষে হার মানল চোরাবালি, এক হ্যাঁচকা টানে বিদর্ভরাজকে শক্ত জমির উপর এনে হাঁপাতে হাঁপাতে ক্ষুদ্রক বলে উঠল, এটা ছিল হলাম। বন্ধু। বজ্রের কাজ। সে থাকলে খুব সহজেই মহারাজকে উদ্ধার করা সম্ভব হতো। এতক্ষণ ধরে টানা-হাচড়ার দরকরা হতো না।
রাজকন্যা চন্দ্রাবতী এতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বিস্ফারিত-নেত্রে যমে-মানুষে টানাটানি দেখছিল, এইবার আশ্বস্ত হয়ে উঠল, বজ্র! কে সে? সে কি তোমার চাইতেও শক্তিশালী?
ক্ষুদ্রক কিছু বলার আগেই রাজা সুবোধন বললেন, বন্দ্রকে আমরা চিনি না। কিন্তু তুমিও অতিশয় শক্তিমান পুরুষ। চোরাবালির ভয়াবহ আলিঙ্গন থেকে কোনো মানুষকে ছাড়িয়ে আনা সহজসাধ্য নয়। যুবক! তোমাকে চন্দ্রা কোথা থেকে সংগ্রহ করল?
এবারও কিছু বলার সুযোগ পেল না ক্ষুদ্রক, রাজকুমারী পিতাকে জানিয়ে দিল কেমন করে তাকে নিশ্চিত সলিলসমাধি থেকে উদ্ধার করে
সব কথা শুনে বিদর্ভরাজ সজলচক্ষে তাকালেন ক্ষুদ্রকের দিকে, তুমি শুধু আমার প্রাণরক্ষা করো নি, প্রাণের চাইতেও প্রিয় আমার কন্যাকে অবধারিত মৃত্যুর কবল থেকে ফিরিয়ে এনেছ। যুবক! কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তোমায় আমি কিছু উপহার দিচ্ছি– গ্রহণ করো।
সব কটিবন্ধে আবদ্ধ দুটি বৃহৎ চর্মপেটিকা থেকে একটি পেটিকা তুলে ক্ষুদ্রকের দিকে প্রসারিত করলেন মহারাজ সুযোধন।
মহারাজের প্রসারিত হস্তকে উপেক্ষা করে বিনীতভাবে ক্ষুদ্রক জানাল সে তার কর্তব্য করেছে, এইজন্যেই কোন পুরস্কার গ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
মহারাজ সুযোধন তীব্ৰদৃষ্টিতে ক্ষুদ্রককে নিরীক্ষণ করলেন, যুবক! কন্যার কাছে শুনলাম তোমার নাম ক্ষুদ্রক এবং তুমি মৃগয়াজীবী নিষাদ। তোমার নাম ক্ষুদ্রক হতে পারে, কিন্তু তোমার পেশা সম্পর্কে তোমার বক্তব্য কন্যা বিশ্বাস করলেও আমার কাছে উক্ত বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। তোমার মুখচোখ, ভাবভঙ্গি ও চালচলন লক্ষ্য করলেই অনুমান করা যায় তুমি ভদ্রবংশের মানুষ, সম্ভবতঃ কোনো সম্ভ্রান্ত বংশে তোমার জন্ম বিশেষ কারণে তুমি আত্মপরিচয় গোপন করছ। তবে আমাকে যদি বিশ্বাস করে সব খুলে বলল, তাহলে হয়তো একদিন আমিও তোমার কিছু উপকার করতে পারব। আজ আমি রাজ্যহারা হলেও একেবারে শক্তিহীন নই। আমার বিশ্বস্ত সেনাপতিদের সঙ্গে আমি গোপনে যোগাযোগ রাখার ব্যবস্থা করে এসেছি। তারাও বিভিন্ন স্থানে জনতার সঙ্গে মিশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছদ্মবেশে অবস্থান করবে। আমার প্রজারা আমাকে ভালোবাসে। অতি অল্পদিনের মধ্যেই আমি হৃতরাজ্য বিদেশির কবল থেকে উদ্ধার করতে পারব। যদি তোমার কোনো কাজে লাগতে পারি, কোনোভাবে যদি আমাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ দাও তাহলে আমি যৎপরোনাস্তি সুখী হব।
কিছুক্ষণ নতমস্তকে চিন্তা করল ক্ষুদ্রক, তারপর মুখ তুলে বলল, আপনার কাছে কিছু গোপন করার প্রয়োজন নেই। হ্যাঁ, আপনি অভিজ্ঞ নরপতি, ঠিকই বুঝেছেন– আমি মৃগয়াজীবী ব্যাধ নই। আমি ভদ্রসন্তান, উচ্চবংশে জন্ম; অস্ত্রচালনায় অভ্যস্ত যোদ্ধাও বটে। চন্দ্রগুপ্ত নামক মগধের এক রাজপুত্রের সঙ্গে সখ্যতার সূত্রে বদ্ধ আমাদের সঙ্কল্প প্রথমে মগধরাজ্য অধিকার এবং কুমার চন্দ্রগুপ্ত মহারাজ চন্দ্রগুপ্ত নাম নিয়ে সিংহাসনে অভিষিক্ত হওয়ার পরে পরস্পরবিরোধী বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যকে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে গ্রীকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মিলিত যুদ্ধযাত্রা ও তাদের বিতাড়ন। কুমার চন্দ্রগুপ্ত যে ঐক্যবদ্ধ ভারতের স্বপ্ন দেখেন, আমরা সকলে মিলিত হয়ে সেই স্বপ্নকে সফল করতে চাই। মহারাজ সুযোধন! আপনি যদি আমাদের আদর্শে বিশ্বাস করেন, তাহলে আশা করি যথাসময়ে আপনার সাহায্য থেকে আমরা বঞ্চিত হব না।
প্রদীপ্ত নেত্রে তাকিয়ে সুযোধন বললেন, ক্ষুদ্রক! বৃদ্ধ হলেও আমার বাহু এখনও শক্তিহীন নয়। যদি প্রয়োজন হয়, আমাকে আহ্বান করলেই আমি মুক্ত তরবারি হাতে তোমাদের সাহায্য করতে অগ্রসর হব। আমার মনে হয় কিছুদিনের মধ্যেই আমি এই বিক্ষিপ্ত গ্রীক সেনাদের বিধ্বস্ত করে আমার রাজ্য উদ্ধার করতে পারব। গ্রীকবাহিনী এখন বৃহত্তর অভিযানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, বিদর্ভের ন্যায় ক্ষুদ্র রাজ্য নিয়ে তারা বেশিদিন মাথা ঘামাবে না। তোমাদের সংকল্প কার্যে পরিণত করার জন্য শুধু সৈন্য আর অস্ত্র নয়, প্রচুর অর্থেরও প্রয়োজন রয়েছে। তুমি ব্যক্তিগতভাবে যে অর্থ প্রত্যাখ্যান করছ, সেই অর্থ আমি তোমার হাতে তুলে দিতে চাই ঐক্যবদ্ধ অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বপ্নকে সফল করে তোলার জন্য আশা করি এইবার তুমি আমাকে ফিরিয়ে দেবে না।
না, আর ফিরিয়ে দিল না ক্ষুদ্রক; স্বর্ণমুদ্রায় পরিপূর্ণ চর্মপেটিকাটি হাতে নিয়ে পিতাপুত্রীকে নিরাপদ পথের নিশানা দেখিয়ে সে ফিরে চলল চন্দ্রগুপ্তের কাছে। প্রচণ্ড উত্তেজনায় তার ক্ষুধাবোধ লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, অন্যমনস্কর মতন পথ চলছিল সে। অকস্মাৎ বিজাতীয় কণ্ঠের উল্লাসধ্বনি তাকে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করে তুলল। সচমকে শব্দ লক্ষ্য করে দৃষ্টিনিক্ষেপ করতেই সে দেখল তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছয়টি গ্রীকসৈনিক!
মুহূর্তের জন্য দ্বিধাগ্রস্ত হল ক্ষুদ্রক। একের বিরুদ্ধে ছয়! জয়লাভের সম্ভাবনা নেই কিছুমাত্র, দ্বন্দ্বে প্রবৃত্ত হলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। স্বর্ণমুদ্রায় পরিপূর্ণ গুরুভার চর্মপেটিকা বহন করে দৌড়ের প্রতিযোগিতায় শত্রুদের পরাস্ত করা সম্ভব নয়। থলেটি ফেলে দিয়ে পলায়ন করলে শত্রুরা তাকে ধরতে পারবে না বটে, কিন্তু ওই মূল্যবান বস্তুটিকে শত্রুর হাতে বিসর্জন দিয়ে আত্মরক্ষা করতে রাজি হল না সে। এক দৌড়ে নদীর তীরবর্তী উচ্চভূমির উপর পৌঁছে গেল সে, তারপর থলেটি মাটিতে নামিয়ে তরবারি কোষমুক্ত করে রুখে দাঁড়াল। ক্ষুদ্রক জানত নদীতে লাফিয়ে পড়লে শত্রুরা তাকে ধরতে পারবে না। সেইরকম অবস্থায় স্বর্ণপূর্ণ থলিটিকে ফেলে যেতে হবে। ওই গুরুভার বহন করে খরস্রোতা নদী পার হওয়া অসম্ভব। তবে তলোয়ারের চাইতে শিঙার উপরেই তার বেশি ভরসা শিঙার আওয়াজ শুনেই তার প্রিয় নেতা চন্দ্রগুপ্ত যে এখানে এসে পড়বেন এ বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ- মধ্যবর্তী সময়টুকু শত্রুদের ঠেকিয়ে রাখতে পারলেই কার্যসিদ্ধি অনিবার্য। ধনুর্বাণ সঙ্গে থাকলে প্রিয় নেতাকে সে সাহায্যের জন্য আহ্বান জানাত না কিন্তু তরবারি নিয়ে ছয়টি দুর্ধর্ষ শত্রুকে পরাস্ত করা অসম্ভব জেনেই সে শিঙাটি মুখে তুলে নিল..
উচ্চভূমির তলদেশে বহমান নদীর দিকে পিঠ দিয়ে প্রাণপণে আত্মরক্ষা করছিল ক্ষুদ্রক, কিন্তু আর বুঝি সে পারে না। অবশেষে সোনায় ভরা চামড়ার থলেটির মায়া ত্যাগ করে সে যখন নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার কথা ভাবছে, সেইসময় তার কানে ভেসে এল প্রিয় নেতার কণ্ঠস্বর, মাভৈঃ! ক্ষুদ্রক, মাভৈঃ! এই ছয়জন গ্রীকসেনাকে আমরা যমালয়ে প্রেরণ করব।
পরক্ষণেই খোলা তলোয়ার হাতে রণস্থলে চন্দ্রগুপ্তের প্রবেশ! শত্রুরা অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ের চমক সামলে ওঠার আগেই তরবারির প্রচণ্ড আঘাতে একজন গ্রীকসেনাকে মাটিতে শুইয়ে দিলেন চন্দ্রগুপ্ত!
নূতন শত্রুর আবির্ভাবে চমকিত পাঁচটি সৈন্য ক্ষুদ্রকের অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে আগন্তুককে আক্রমণের উদ্যোগ করল। আর সেই মুহূর্তের অসাবধানতার সুযোগ নিল ক্ষুদ্রক- বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে এসে আঘাত হানল সে, রক্তাক্ত দেহে ধরাশায়ী হল আরও একজন শত্রু।
তারপর যুদ্ধ হল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। কিছুক্ষণের মধ্যেই যখন আর একটি সৈন্য প্রাণ হারাল এবং হতাবশিষ্ট তিন গ্রীকসৈনিক যখন পলায়নের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে সেইসময় হঠাৎ বনের ভিতর থেকে ভেসে এল তীব্র উল্লাসধ্বনি! যুযুধান উভয়পক্ষ তাকিয়ে দেখল অরণ্যগর্ভ থেকে প্রান্তরের উপর আত্মপ্রকাশ করেছে দশ-বারোটি ধাবমান গ্রীকসৈন্য!
ক্ষুদ্রক বলল, কুমার! এখানে থাকলে মৃত্যু নিশ্চিত। দুঃখের বিষয় স্বর্ণমুদ্রায় পরিপূর্ণ; এই চামড়ার থলেটি এখানেই ফেলে যেতে হবে। থলেটি ভীষণ ভারী ওই গুরুভার বহন করে খরস্রোতা নদী পার হওয়া অসম্ভব।
তার কথা শেষ হতে না হতেই নিকটবর্তী তিনটি সৈন্য তলোয়ার উঁচিয়ে তেড়ে এল। সঙ্গেসঙ্গে চর্মপেটিকা ফেলে রেখেই নদীতে ঝাঁপ দিল ক্ষুদ্রক। পরক্ষণেই তাকে অনুসরণ করলেন চন্দ্রগুপ্ত অবশ্য লাফ দেওয়ার আগে থলেটিকে তুলে নিতে তার ভুল হয়নি!
নিরুপায় গ্রীকরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল পতনের বেগে দেহ দুটি ডুবে গিয়ে আবার ভেসে উঠল, তারপর উত্তাল তরঙ্গের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে চলল ওপারের দিকে।
একজন সেনাধ্যক্ষ হাঁক দিয়ে বলল ওদের অনুসরণ করে ধার সম্ভব। গ্রীকদের মধ্যে অনেকেই সাঁতার জানে না– যারা সন্তরণে পটু, তারাও সেই খরবেগে বহমান নদীর স্রোতে ঝাঁপ দিতে সাহস পেল না।
হঠাৎ একজন গ্রীকসৈন্য চেঁচিয়ে উঠল, নিকটেই ধীবরপল্লী। ওরা স্রোত ঠেলে নদী পার হওয়ার আগেই আমরা ডিঙ্গি নৌকো নিয়ে ওদের অনুসরণ করে ধরতে পারব।
কয়েকজন সৈন্য নদীর তীরবর্তী উঁচু জমিটার উপর দাঁড়িয়ে পলাতকদের উপর নজর রাখতে লাগল, আর সকলে ছুটল নিকটস্ত ধীবরপল্লীর উদ্দেশ্যে…