গোবিন্দ ছোঁড়া যে লোক সুবিধের নয় তা কি আর পীতাম্বর জানে না! কিন্তু ছোঁড়াটার ওপর বড্ড মায়া পড়ে গেছে পীতাম্বরের। চারদিকে কত গবেট মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে, ফুর্তি করছে, তারা কি কেউ কখনও পীতাম্বরের গন্ধ পায়? না শব্দ পায়? না দেখা পায়? কারও গেরাহ্যিই নেই পীতাম্বরকে। তা এতকালের মধ্যে ওই গোবিন্দ ছোঁড়াই যাহোক একটু দাম তো দিল তার। মায়াটা সেইজন্যই। আর মুশকিলও সেইখানেই, কারণ, গোবিন্দর নানা অপকর্মে তাকে সাহায্য করতে হচ্ছে।
ভজনবুড়ো যখন মাঝরাতে চালাকি করে বিপিনকে নিয়ে পালাল তখন দিগভ্রান্ত গোবিন্দ আর গোপাল হাটখোলার দিকে। ছুটে গিয়েছিল। আর একটু হলেই বিপদ বাধাত। কারণ, নবীন মুদির জ্ঞান ফিরে এসেছে মাঝরাতে। তার চেঁচামেচিতে লোকে এসে দরজা ভেঙে তাকে উদ্ধার করেছে এবং বৃত্তান্ত শোনার পর হাটখোলার লোকেরা এ-দু’জনকে ডাণ্ডা হাতে খুঁজে বেড়াচ্ছে চারদিকে।
গোঁয়ারগোবিন্দের মতোই গোপাল আর গোবিন্দ যখন হাটখোলার দিকে যাচ্ছিল তখন শীতলাবাড়ির মোড়ে গোবিন্দ ফট করে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, “কে আমাকে ডাকছে বলো তো?”
“কে ডাকবে?”
“কেউ যেন ওদিকে যেতে বারণ করছে।”
“তোর মাথা! আজ কি তোকে ভূতে পেল?”
“ভূতই হবে। কিন্তু সে উপকারী ভূত। না গোপালদা, ওদিকে যাওয়া ঠিক হবে না।”
“কিন্তু ভজনবুড়ো যে পালিয়েছে, তার কী হবে? সাত ঘড়া মোহর, সাত কলসি হিরে।”
“আমার মন বলছে, ভজনবাবু এদিকে যায়নি।”
“মন বলে কি আমারও কিছু নেই রে? সেও কি কথা কয়?”
“শোনো গোপালদা, ফিরে গিয়ে চলো একটু চুপ করে বসি, কেউ আমাকে যেন কিছু বলতে চাইছে।”
গোপাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “শেষে তুইও সিদ্ধাই হলি!”
গোবিন্দ যে তার কথা শুনতে পাচ্ছে এবং সেইমতো চলছে এতে পীতাম্বর খুব খুশি। পরিশ্রম সার্থক।
দু’জনে ফিরে এসে ফের খড়ের গাদির মধ্যে সেঁধিয়ে বসার পর পীতাম্বর চারপাশটা দেখে এল। ভজনবুড়ো বিপিনকে নিয়ে মধুবনির জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে তাও পীতাম্বর জানে। এমনকী সাত ঘড়া মোহর আর সাত কলসি মণিমানিক সে দেখেও এসেছে। হায় রে! বেঁচে থাকতে ওসবের সন্ধান পেলে কত ভাল হত!
সে না পাক, এখন গোবিন্দ পেলেও তার দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে। কিন্তু মুশকিল হল ভজনবুড়ো বিপিনকে সব সুলুকসন্ধান দিয়ে ফেলেছে। তাদের কাছ থেকে সব কেড়েকুড়ে নিতে পারবে কি দুধের বাছা গোবিন্দ? বিপিন কৃপণ লোক, কৃপণেরা ধনসম্পত্তি বাঁচাতে জান লড়িয়ে দেয়। তার ওপর ভজনবুড়ো আছে। যেমন ধূর্ত তেমনই পাষণ্ড, তেমনই গুণ্ডা। গোবিন্দ আর গোপাল তার কাছে দুধের শিশু। পীতাম্বর ভাবিত হয়ে পড়ল।
.
প্রতিভাবানের লক্ষণ হল তারা কোনও ঘটনাতেই ঘাবড়ে যায় না বা বিভ্রান্ত হয় না। মূল ঘটনা থেকে তারা কখনও মনঃসংযোগও হারায় না। কী ঘটতে পারে বা কী ঘটতে যাচ্ছে সেই সম্পর্কে তাদের দূরদৃষ্টি থাকে। লোকচরিত্র অনুধাবনেও তারা অতিশয় দক্ষ। এতসব গুণ আছে বলেই না আজ দশটা গাঁয়ের দুষ্টু লোকেরা চিতেনকে দেখলে সেলাম ঠোকে।
তবে হ্যাঁ, ভজনবুড়োর মতো ধূর্ত লোককে বিশ্বাস কী? চিতেন যদি ডালে ডালে চলে তো ভজনবাবু চলেন পাতায়-পাতায়। ধূতামিতে ভজনবাবু তাকে টেক্কা দিতে পারেন বলে একটা ভয় ছিলই চিতেনের। তাই রাত তিনটের সময় যখন সদর দরজাটা টুক করে খুলে একটু ফাঁক হল, তখনই চিতেন বুঝে গেল, এবার খেল শুরু হচ্ছে।
কিন্তু চালটা ভজনবাবু দিলেন বড়ই সোজা। ভজনবাবুকে খুঁজে না পেয়ে বিপিনবাবু যখন কান্না জুড়লেন এবং লোজন চারদিকে ভজনবাবুকে খুঁজতে ছুটল তখনও চিতেন অনুমান করল, ভজনবাবু ঘরেই আছেন। কারণ পেছনের দরজায় চিতেন তালা লাগিয়ে রেখেছে। ভজনবাবু তো মশামাছি নন যে জানলার ফাঁক দিয়ে উড়ে যাবেন। তাঁকে এই সদর দিয়েই বেরোতে হবে।
প্রতিভাবানদের আরও গুণ হল, তারা যখন দৌড়ায় তখন পায়ের শব্দ হয় না, তারা সহজে হাঁফিয়ে যায় না, শিকারের দিকে তাদের তীক্ষ্ণ নজর থাকে, তারা হোঁচট খেয়ে পড়ে না, বেড়া বা ছোটখাটো দেওয়াল অনায়াসে ডিঙোতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রতিভাবানেরা গা-ঢাকা দিতেও ওস্তাদ। এসব গুণের জন্যই চিতেন ভজনবাবু আর বিপিনদাদার পিছু নিয়ে মধুবনির জঙ্গলে পৌঁছে গেল। এটুকু আসতেই বিপিনদাদার দম বেরিয়ে গেল বটে, কিন্তু চিতেনের গাও গরম হল না।
জঙ্গলের মধ্যে অন্ধকার থাকায় আর গাছপালার বাড়বাড়ন্তর ফলে চিতেনের ভারী সুবিধে হয়ে গেল। অন্ধকারে প্রতিভাবানরা ভালই দেখতে পায়, চিতেনও দিব্যি সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। পিছু নিতে তার কোনও অসুবিধে হল না।
ভজনবাবু যেখানে বিপিনবাবুকে এনে হাজির করলেন সে জায়গাটা মোটেই সুবিধের মনে হল না চিতেনের। ভাঙা বাড়ি, গাছপালা, গহিন বনের নির্জনতা থাকা সত্ত্বেও চিতেনের মনে হচ্ছিল, এখানে আরও একটা কোনও ব্যাপার আছে।
পেছন থেকে কে যেন আস্তে করে বলল, “আছেই তো।”
চিতেন সাধারণ ছিচকে চোর হলে চমকাত বা শিউরে উঠত। কিন্তু অতি উঁচুদরের শিল্পী বলে সে স্থির রইল এবং সি-হাসি মুখ করে পেছনে তাকাল।
যে-দৃশ্যটা চিতেনের চোখে পড়ল তা দেখে অন্য লোক মূর্ছা যেত। কিন্তু চিতেন অন্য ধাতুতে গড়া বলেই গেল না। পেছনে একটা ছোট গাছের ডালে অনেকটা টিয়াপাখির মতোই একটা পাখি বসে আছে। তবে আকারে অনেক বড়। আর খুবই আশ্চর্যের কথা যে, টিয়াপাখিটার ঠোঁটের নীচে অন্তত ইঞ্চিছয়েক ঘন কালো দাডি এবং মাথায় কালো চুল আছে।
চিতেন একটু গলাখাঁকারি দিয়ে খুব বিনয়ের সঙ্গেই বলল, “কথাটা কে বলল?”
টিয়াপাখিটা গাছ থেকে একটা ফল ঠোঁট দিয়ে ছিঁড়ে কপ করে গিলে ফেলে বলল, “আমিই বললাম, কেন কোনও দোষ হয়েছে?”
টিয়াপাখি এত স্পষ্ট করে কথা বলতে পারে তা জানা ছিল না। চিতেনের।
পাখিটা তার দিকে চেয়ে বলল, “আমি যে টিয়াপাখি তা কে বলল তোমাকে?”
চিতেনকে ফের উত্তেজনা কমাতে গলাখাঁকারি দিতে হল। সে বলল, “আপনি তবে কী পাখি?”
“সে তোমার বুঝে কাজ নেই। তোমার মতলব তো জানি। গুপ্তধন খুঁজতে এসেছ তো! যাও, পাবে। অনেক আছে।”
চিতেন একটু থতমত খেয়ে বলল, “আপনি কি অন্তর্যামী?” পাখিটা হিহি করে হেসে পটাং করে উড়ে গেল।
শক্ত ধাতুর চিতেনের মাথাটা একটু ঝিমঝিম করছিল। স্বপ্ন দেখছে নাকি?
কে যেন মাথার ওপর থেকে বলল, “না, স্বপ্ন হবে কেন? ঠিকই দেখেছ।”
চিতেন ধীরে মুখটা ওপরে তুলে দেখল, একটু ওপরে গাছের ডালে অনেকটা হনুমানের মতো দেখতে একজন বসে আছে। হনুমানই, তবে এরও বেশ দেড়হাত লম্বা দাড়ি আর বড় বড় বাবরি চুল। মুখে একটু বিদ্রুপের হাসি।
“কিছু বুঝলে চিতেনবাবু?”
“আজ্ঞে না।”
“মাথা ঝিমঝিম করছে নাকি?”
“করছে।”
“তবু বলি বাপু, তুমি বেশ শক্ত ধাতের লোক। তোমার হবে।”
“কী হবে?”
“যেমন হতে চাও।” এই বলে হনুমানটা চটপট গাছ বেয়ে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ভুতুড়ে কাণ্ড নাকি? চিতেন নিজেকে সামলাতে একটু চোখ বুজে রইল। তারপর চোখ মেলে সে সেই আশ্চর্য গাছটা দেখতে পেল। সোজা সরল, ডালপালাহীন বিশাল উঁচু গাছ। পাতায় ঢাকা।
এরকম গাছ সে জীবনে দ্যাখেনি। চিতেন চারদিকটা ফের ভাল করে দেখল। না, এ জায়গাটা ভুতুড়েই বটে! তার ক্ষুরধার বুদ্ধি দিয়েও সে কিছু বুঝতে পারছে না।
একটু আগে বিপিনদাদাকে নিয়ে ভজনবাবু ভাঙা বাড়িটার ভেতরে ঢুকেছেন। সেখানে কী হচ্ছে কে জানে! চিতেন খুবই চিন্তিত মাথায় ধীরে ধীরে গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে বাড়িটার দিকে এগোতে লাগল। তবে দুটো বিচিত্র অভিজ্ঞতায় তার হাত-পা মগজ আর আগের মতো কাজ করছে না। ধন্দ লাগছে।
একটু এগিয়ে বাড়িটায় ঢুকবার মুখে দাঁড়িয়ে সেই অদ্ভুত গাছটায় হাতের ভর রেখে দাঁড়াতে গেল চিতেন। অমনই সমস্ত শরীরটায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। চিতেন ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে। কী থেকে কী হল সে বুঝতেই পারল না।
কে যেন খুব কাছ থেকে বলে উঠল, “অত বুঝবার দরকারটাই বা কী?”
চিতেন প্রায় কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসে দেখল, একটা দাড়ি আর চুলওয়ালা খরগোশ, তা হাত দুই লম্বা হবে, তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে সামনের দু’খানা পায়ে ধরা একটা পেয়ারার মতো দেখতে ফল খাচ্ছে।
চিতেন আর অবাক হল না। কাহিল গলায় বলল, “আপনারা কারা?”
“বললাম তো, বেশি জেনে কাজ নেই। গুপ্তধন চাই তো! যাও না, ওই সোজা পথে ঢুকে যাও। মেলা মোহর আর হিরে-মুক্তো পেয়ে যাবে। ওসব দেওয়ার জন্যই তো আমরা বসে আছি।”
এই বলে খরগোশটা ঝোঁপের আড়ালে অদৃশ্য হল। অন্য কেউ হলে চেঁচামেচি করত, দৌড়ে পালাত। কিন্তু প্রতিভাবানরা তা করে না। আর করে না বলেই তো তারা প্রতিভাবান। চিতেন লম্বা, বেয়াড়া গাছটার দিকে একবার ঘাড় তুলে চেয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে লাগল।
ওদিকে বিপিনবাবুর বাড়িতে খড়ের গাদির মধ্যে গোপাল আর গোবিন্দর কী হল সেটাও দেখা দরকার। ভোররাতে খড়ের ওম পেয়ে দুজনেই একটু ঝিমোচ্ছিল। হঠাৎ গোবিন্দ শুনতে পেল, কে যেন খুব ক্ষীণ গলায় বলছে, “পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইল, কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল… ওঠো শিশু মুখ ধোও পরা নিজ বেশ, আপন পাঠেতে মন করহ নিবেশ..রবিমামা দেয় হামা গায়ে রাঙা জামা ওই… ভোর হল দোর খোলো, খুকুমণি ওঠো রে..আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের পর…”
গোবিন্দ রক্তচক্ষু মেলে বিরক্তির সঙ্গে বলল, “কে রে এত ভ্যাজরং ভ্যাজরং করে!”
পীতাম্বর গোবিন্দর ঘুম ভাঙানোর জন্য ভোর নিয়ে যত কবিতা
জানা ছিল আউড়ে যাচ্ছিল এতক্ষণ, কাজ হল না দেখে সে এবার গান ধরল। মুশকিল হল, তার গানের গলা তখনও ছিল না, এখনও নেই। বেসুরো গলাতেই সে প্রভাতী গাইতে লাগল, “প্রভাত যামিনী, উদিত দিনমণি, উষারানী হাসিমুখে চায় রে, জাগি বিহগ সব করে নানা কলরব, হরি হরি হরি গুণ গায় রে..”
গোবিন্দ এবার উঠে বসে বলল, “উঃ, এ যে জ্বালিয়ে খেলে দিলে সকালের ঘুমটার বারোটা বাজিয়ে বেসুরো গলায়।”
পীতাম্বর বেশ রাগের গলাতেই ধমক দিল, “শোনো হে বাপু, ছেলেবেলায় রচনার বইতে পড়োনি, যে শুইয়া থাকে তাহার ভাগ্যও শুইয়া থাকে?”
এবার গোবিন্দ সটান হয়ে বসল, এ তো সেই গলা! এ যে তার উপকারী ভূত।
শশব্যস্তে গোবিন্দ বলল, “কী করতে হবে আজ্ঞে?”
“শিগগির রওনা হয়ে পড়ো। ওদিকে সব সোনাদানা যে হরির লুট হতে যাচ্ছে! কবিতায় পড়োনি, ছুটে চল, ছুটে চল ভাই, দাঁড়াবার সময় যে নাই? ঠিক সেইরকম এখন দম ধরে সোজা ছুটে মধুবনির জঙ্গলে গিয়ে সেঁধোও, তারপর আমি যেমন বলে দেব তেমনই চলবে।”
“যে আজ্ঞে।”
গোবিন্দ গোপালকে ঠেলে তুলে বলল, “চলো গোপালদা, আর সময় নেই। সোনাদানা যদি বেহাতি করতে না চাও তো দৌড়ও।”
খড়ের গাদি থেকে নেমে দুজনেই রওনা হয়ে পড়ল। কখনও ছুটতে লাগল, কখনও হাঁটতে লাগল। একটু হাপসে পড়লেও দুজনেই ভোরের আগেই মধুবনির জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল।
গোপাল বলল, “এবার?”
গোবিন্দ হাত তুলে বলল, “দাঁড়াও, কথা বোলো না। তেনার গলার স্বরটা শুনতে দাও।”
“কার গলার স্বর?”
“সে আছে।”
“তোকে ভূতেই পেয়েছে রে গোবিন্দ।”
“সে তো পেয়েছেই। ভূতের দয়াতেই আমার সব হবে, ভগবানের দয়া তো আর পাইনি।”
পীতাম্বর চারদিকটা দেখে নিয়ে বলল, “সোজা চলো।”
গোবিন্দ জঙ্গল আর আগাছা ঠেলে এগোতে এগোতে বলল, “আমার পিছু পিছু এসো গোবিন্দদা, তিনি পথ দেখাচ্ছেন।”
“বেঘোরে মরব না তো রে গোবিন্দ? দেখিস ভাই।”
পীতাম্বর বলল, “বটগাছটা পেরিয়ে ডাইনে।”
গোবিন্দ “যে আজ্ঞে” বলে ডাইনে মোড় নিল। “এবার ফের ডাইনে।”
“যে আজ্ঞে।”
“এবার বাঁয়ে।”
“ঠিক আছে।”
গভীর জঙ্গলের নিকষ্যি অন্ধকারে আন্দাজে হাঁটতে হাঁটতে গোপাল বলল, “আর কি ফিরতে পারব রে গোবিন্দ?”
“কথা নয়! কথা নয়! তেনার গলার স্বর শুনতে দাও।” পীতাম্বর হঠাৎ বলে উঠল, “সামনে বিপদ!”
“কীসের বিপদ?”
“ওই যে ফাঁকা জমি দেখা যাচ্ছে, ওইখানে! আমাকে একটু গা-ঢাকা দিতে হচ্ছে বাপু। এক ছুটে পার হয়ে যাও জায়গাটা।”
জঙ্গলের মধ্যে ফাঁকা জায়গাটায় পা দিয়েই দুজন থমকে দাঁড়াল। সামনে তিনজন খুনখুনে ডাইনিবুড়ি দাঁড়িয়ে। তাদের মাথার চুল পা পর্যন্ত নেমেছে, পরনে ময়লা কাপড়, ফোকলা মুখে তিনজনই খুব হিহি করে হাসছে।
প্রথম বুড়ি খনখনে গলায় বলে উঠল, “আয় রে আমার গোপাল, আয় রে আমার গোবিন্দ..”
দ্বিতীয় বুড়ি বাঁশির মতো তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “আয় রে আমার সোনা, আয় রে আমার মানিক..”
তিন নম্বর বুড়ি কাঁপাকাঁপা গলায় বলল, “আয় রে আমার রাজা, আয় রে আমার গজা…”
আতঙ্কিত গোপাল বলল, “পালা গোবিন্দ!”
“না গোপালদা, না। তিনি বলেছেন, ছুটে পার হতে হবে। এসো, ছুট লাগাই।”
দু’জনে প্রাণপণে ছুটে তিন ডাইনিকে ভেদ করে ফের জঙ্গলে গিয়ে পড়ল।
পীতাম্বর বলল, “শাবাশ! এই তো এসে গেছি আমরা। ওই যে ভাঙা বাড়ি দেখা যাচ্ছে, যাও ওর মধ্যে গিয়ে ঢুকে পড়ো।”
“যে আজ্ঞে।”
ভাঙা বাড়ির মাটির নীচেকার ঘরে মোহর আর হিরে আর মুক্তো ঘাঁটতে ঘাঁটতে আত্মহারা বিপিনবাবু বললেন, “আহা, কী সরেস জিনিস?”
ভজনবাবু প্রশান্ত গলায় বললেন, “কষ্টিপাথরে ঘষে দেখেছ তো!”
“যে আজ্ঞে। খাঁটি সোনা। সবই কি আমাকে দিচ্ছেন ভজনবাবু! দু-চারখানা নিজের জন্য রাখবেন না?”
“না হে, না। ও নিয়ে আমার আর কী হবে? এবার আমার ছুটি।”
“তা ভজনবাবু, মোহর আর হিরেগুলো কয়েকখানা একটু বাইরে নিয়ে গিয়ে রোদের আলোয় দেখি!”
ভজনবাবু চিন্তিত মুখে বললেন, “দেখবে? তা দ্যাখো। তোমারই সব জিনিস, যা খুশি করতে পারো। তবে কিনা বাপু, যেখানকার জিনিস সেখানেই থাকা ভাল।”
“একটু দেখেই রেখে দেব এসে।”
“চলো, আমিও যাচ্ছি।”
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে এসে বিপিনবাবু মোহরগুলো দিনের আলোয় দেখে হতবাক হয়ে গেলেন। কোথায় মোহর? এ যে সিসে! আর হিরের বদলে কিছু পাথরকুচি!
বিপিনবাবু আর্তনাদ করে উঠলেন, “ভজনবাবু! এ কী!”
ভজনবাবু প্রশান্ত মুখে বললেন, “বললুম তো, যেখানকার জিনিস সেখানেই মানায় ভাল। ওপরে আনার দরকারটা কী
৮০
তোমার?”
“দরকার নেই? বলেন কী?”
“তুমি হলে কৃপণ লোক, এসব তো প্রাণে ধরে খরচ করবে না কখনও, সুতরাং ওপরে আনারও দরকার নেই। নীচের ঘরে নিয়ে গেলেই দেখবে, ওই সিসেগুলো ফের খাঁটি মোহর হয়ে গেছে, পাথরগুলো হয়ে গেছে হিরে। এখন থেকে তুমি নীচের ঘরে বাস করলেই তো হয়।”
কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বিপিনবাবু ক্ষীণ গলায় বললেন, “মোহর সিসে হয়ে যাবে কেন মশাই?”
“সে তুমি বুঝবে না। কিন্তু আসলে মোহরের সঙ্গে সিসের কোনও তফাত নেই। ভেতরের গুণ একটু বদলে দিলেই হয়। যাও বিপিন, নীচে যাও। মোহর আর হিরে আর কখনও বাইরে এনো না।”
বিপিনবাবু তেমনই ভ্যাবাচ্যাকা মুখ করে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে দেখলেন, তাঁর এক হাতে মোহর আর অন্য হাতে হিরে ঝলমল করছে।
ব্যাপারটা কী হল তা অবাক হয়ে ভাবছিলেন বিপিনবাবু, ঠিক এই সময়ে হঠাৎ একটা হুহুঙ্কার ডাক ছেড়ে সিঁড়ি বেয়ে মূর্তিমান গোবিন্দ আর গোপাল নীচে নেমে এল। দু’জনের হাতেই মস্ত ছোরা।
বিপিনবাবু সঙ্গে-সঙ্গে রুখে দাঁড়ালেন, “খবরদার! আমার সোনাদানায় হাত দিয়েছ কি কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে।”
গোপাল আর গোবিন্দ দু’জনেই বিপিনের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে ছোরার বাঁট দিয়ে কয়েক ঘা মোক্ষম বসিয়ে দিতেই বিপিনবাবু জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লেন।
তারপর আর কালবিলম্ব না করে দু’জনেই ঘড়া আর কলসির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
পীতাম্বর হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলল, “বেশি লোভ করিসনি, এক-একজন এক-এক ঘড়া মোহর আর এক-এক কলসি হিরে তুলে নে।”
গোবিন্দ বলল, “যে আজ্ঞে।”
সোনার পেল্লায় ওজন। ঘড়া তুলে ওপরে এনে ফেলতে দু’জনেই গলদঘর্ম হয়ে গেল। কলসিরও ওজন বড় কম নয়। তোলার পর দুজনেই হাঃ হাঃ করে হাঁফাতে লাগল।
গোপাল বলল, “একটু জিরিয়ে নিই। তারপর রওনা হওয়া যাবে, কী বলিস! পরে এসে বাকি ঘড়াগুলো একে একে নিয়ে যাব।”
গোবিন্দ কথাটার জবাব দিল না। সরু চোখে সে ঘড়ার দিকে চেয়েছিল। হঠাৎ বলল, “এ কী?”
গোপালও দেখল। বলল, “অ্যাাঁ! এ তো সিসে!”
“হিরেমুক্তোই বা কোথায়? এ তো পাথরকুচি দেখছি!” দু’জনেই হাঁ করে চেয়ে ছিল। নিঃশব্দে চিতেন এসে সামনে দাঁড়াল, গম্ভীর গলায় বলল, “যাও বাপু, যেখানকার জিনিস সেখানে রেখে এসো। নইলে বিপদে পড়বে।”
হাঁ করে চিতেনের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে গোবিন্দ বলল, “কী ব্যাপারটা, বলো তো?”
মাথা নেড়ে চিতেন বলল, “আমিও জানি না। তবে এটা বুঝতে পারছি, এ খুব সোজা জায়গা নয়।”
পীতাম্বর গোবিন্দর কানে-কানে বলল, “ও যা বলছে তাই করো বাপু। খামোখা বিপদ ডেকে এনো না। এখানকার কারবারটা আমিও বুঝতে পারছি না।”
গোপাল আর গোবিন্দ কেমন যেন ক্যাবলার মতো কিছুক্ষণ বসে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠল। ঘড়া আর কলসি বয়ে নীচে নিয়ে গিয়ে জায়গামতো রেখে দিল।
বিপিনবাবু উঠে বসে মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে “উঃ, আঃ” করছিলেন। চিতেন গিয়ে তাঁকে ধরে তুলে বলল, “বাড়ি চলুন বিপিনদাদা, অনেক হয়েছে।”
“কিন্তু মোহর! হিরে মুক্তো!”
চিতেন হাসল, “কোথায় মোহর! ও তো চোখের ভুল ছাড়া কিছু নয়। এই ঘরের বাইরে নিলেই মোহর যে সিসে।”
“তা হলে?”
“ওপরে চলুন বিপিনদাদা। ভজনবাবু চলে যাচ্ছেন, তাঁকে বিদায় জানাতে হবে।”
“ভজনবাবু কোথায় যাচ্ছেন?”
“যেখান থেকে এসেছিলেন, আকাশে।“
চিতেনই সবাইকে নিয়ে এসে সেই কিত প্রকাণ্ড লম্বা গাছটার কাছাকাছি দাঁড়াল। সবাই হাঁ করে দেখল, জঙ্গল ভেদ করে প্রথমে এল তিনটে ডাইনি বুড়ি। তারপর দাড়িওলা খরগোশ, হনুমান, অদ্ভুত টিয়াপাখি। সেই বিশাল গাছটার গোড়ার কাছে। হঠাৎ একটা দরজা ধীরে-ধীরে খুলে গেল। ডাইনি বুড়ির পিছু পিছু অদ্ভুত জীবজন্তুরা ভিতরে ঢুকে গেল।
তারপর একটা ঝোঁপের আড়াল থেকে ভজনবাবু বেরিয়ে এলেন। একই পোশাক, বাঁদুরে টুপিতে মুখোনা ঢাকা। তাদের দিকে চেয়ে ভজনবাবু একটু করুণ হাসলেন। তারপর ধীরে ধীরে ঢুকে গেলেন ভিতরে। দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
হঠাৎ চারদিকে গাছপালায় একটা আলোড়ন তুলে গোঁ-গোঁ আওয়াজ উঠল। সবাই অবাক হয়ে দেখল, লম্বা গাছটা মাটি ছেড়ে আকাশে উঠে যাচ্ছে। প্রথমে ধীরে, তারপর হঠাৎ তীরের মতো ছিটকে লহমায় আকাশের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
বিপিনবাবু কাঁপা গলায় বললেন, “ভজনবাবু আসলে কে রে চিতেন?”
“কে জানে! তবে মনে হয়, তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর মধ্যে ইনিও একজন কেউ হবেন। চলুন, ভজনবাবুকে এখানেই মাটিতে মাথা ঠুকে একটা পেন্নাম করি।”
সঙ্গে-সঙ্গে ধড়াস ধড়াস করে সবাই সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল।
গোপাল চোখের জল মুছে বলল, “গোবিন্দ, আর নয় রে, আর গণ্ডগোলের জীবনে যাব না।”
“যা বলেছ গোপালদা।”
বিপিনবাবু চোখের জল মুছে বললেন, “এবার থেকে রোজ গাওয়া ঘিয়ের লুচি খাব রে চিতেন।”
“হ্যাঁ। আর আমাকেও চুরি ছেড়ে অন্য লাইন ধরতে হবে।”
.
হ্যাঁ, যে-কথাটা বলা হয়নি তা হল, মধুবনির জঙ্গলে সেই সাত ঘড়া মোহর আর সাত কলসি মণিমানিক কিন্তু আজও পড়ে আছে। কিন্তু সে-কথা আর কেউ ভুলেও উচ্চারণ করে না।