গোবিন্দ ঘোষের সঙ্গে যে মন্টুরাম সিংহের চিরকালের আড়াআড়ি, এ কে না জানে। কিন্তু গোবিন্দ ঘোষের কপালের দোষে তাঁর বাড়িটা ওই মন্টুরামের বাড়ির একদম লাগোয়া। গোবিন্দ ঘোষের ফলন্ত মধুগুলগুলি আমগাছের সবচেয়ে বেশি আম ধরে যে ডালটায়, সেটাই মন্টুরামের বাগানের দিকে ঝুঁকে থাকে, গোবিন্দ ঘোষের নারকোলগাছের নারকোল প্রায়ই গিয়ে পড়ে মন্টুরামের বাগানে। ছাদে শুকোতে দেওয়া গোবিন্দ ঘোষের গেঞ্জি আর লুঙ্গি কতবার যে হাওয়ায় উড়ে মন্টুরামের বাড়ির ছাদে গিয়ে পড়েছে, তার হিসেব নেই।
আর ওদিকে মন্টুরামের বাড়িতে মাংস রান্না হলে সেই গন্ধ এসে গোবিন্দ ঘোষের বাড়িতে দাপাদাপি করে বেড়ায়। গোবিন্দ দাঁত কিড়মিড় করেন। মন্টুরামের বাড়িতে বিরিয়ানি হচ্ছে। তার গন্ধ গোবিন্দর বাড়িতে লুঠেরার মতো ঢুকে সব তছনছ করে দেয়। মাছের মুড়ো দিয়ে সোনামুগের ডাল রান্না হলে তো গোবিন্দকে নাকে চাপা দিতে হয়। গন্ধগুলো যেন এসে তাঁকে মুখভেংচি দেয়, বক দেখায়, মাথায় চাঁটি মেরে বলে যায়, “দুয়ো রে গোবিন্দ, দুয়ো!”
গোবিন্দ একদিন মন্টুরামকে উচিত শিক্ষা দিতে তাঁর গিন্নি বাসন্তীকে বললেন, “হ্যাঁ গা, আজ একটু শুঁটকি মাছ রাধা তো।”
বাসন্তী চোখ কপালে তুলে বলেন, “শুঁটকি মাছ! বলো কী। আমরা তো কস্মিনকালেও শুঁটকি মাছ খাই না!”
“আহা, খাওয়ার কথা উঠছে কেন? খাওয়ার জন্য নয় গিন্নি, গন্ধটা ছড়ালে মন্টুরামকে একটু শিক্ষা দেওয়া হবে।”
বাসন্তী রাগ করে বলেন, “আ মোলো, অন্যকে শিক্ষা দিতে গিয়ে শুঁটকি বেঁধে মরি আর কী।”
“তা হলে এক কাজ করো। শুনেছি চামড়া পোড়ালে কী বিচ্ছিরি গন্ধ হয়। তা হলে আমার পুরনো ঘেঁড়া পাম্পশুটা নিভন্ত উনুনে গুঁজে রাখো। দেখি, ব্যাটা দাপিয়ে বেড়ায় কি না।”
বাসন্তী বললেন, “মন্টুবাবু দাপিয়ে বেড়াবে কি না জানি না বাপু, তবে চামড়া-পোড়া গন্ধে আমরাই কি বাড়িতে টিকতে পারব?”
তাই তো! এ কথাটা তো খেয়াল হয়নি! গোবিন্দবাবু খুব ভাবনায় পড়লেন। গত ত্রিশ বছর ধরে গোবিন্দ ভেবেই চলেছেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত মন্টুরামকে শিক্ষা দেওয়ার মতো তেমন কিছুই করে উঠতে পারেননি।
এক রাতে গোবিন্দ ঘোষের বাড়িতে চোর ঢুকেছিল। টের পেয়ে গোবিন্দ ঘোষ প্রচণ্ড রেগে গিয়ে তেড়ে উঠলেন, “এটা তোদের কীরকম একচোখোমি বল তো! পাশেই মন্টুরামের বাড়ি ছেড়ে আমার বাড়িতেই কেন ঢুকেছিস? এ কীরকম বিচার তোদের?”
চোরটা ভড়কে গিয়ে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।
গোবিন্দ ঘোষ মশারি তুলে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে হাত-পা ছুঁড়ে বলতে লাগলেন, “লজ্জা করে না তোদের? ঘেন্না হয় না? যার বাড়িতে সোনাদানা উপচে পড়ছে, টাকা রাখার জায়গা নেই, দামি দামি জিনিস ছড়িয়ে পড়ে থাকে, তার বাড়ি ছেড়ে কোন লজ্জায় এ বাড়িতে ঢুকেছিস?”
চোরটা মিনমিন করে বলল, “তা কী করব মশাই, মন্টুরামবাবুর বাড়িতে যে সড়ালে কুকুর আছে, পাইক-বরকন্দাজ আছে।”
গোবিন্দ খাপ্পা হয়ে বললেন, “ওঃ যেন পুষ্যিপুতুর এলেন! কুকুর আছে, পাইক-বরকন্দাজ আছে। আর তাতেই বাবুর জারিজুরি বেরিয়ে গেল! পাইক-বরকন্দাজ আর কুকুরকেই যদি ভয়, তা হলে চুরি ছেড়ে বোষ্টম হলেই পারিস। তোদের মতো চোরকে কুলাঙ্গার বললে কম বলা হয়। এই যদি তোর এলেম, তা হলে গলায় দড়ি দিগে যা। জলে ডুবে মরগে যা। ছিঃ ছিঃ, তোদের মুখদর্শন করলে পর্যন্ত পাপ হয়।”
চোরটা তখন পালাতে পারলে বাঁচে। তবে হঠাৎ এই সেদিন নৈরাশ্যের মধ্যে একটু আশার আলো দেখতে পেলেন গোবিন্দ ঘোষ। গাঁয়ের চৌকিদার ভজহরির কাছে শুনলেন যে, মন্টুরামের বাড়িতে একদিন একটা চোর ঢুকেছিল। কপালের ফেরে সে কিছু চুরি করতে পারেনি, সারারাত একটা আলমারির মধ্যে আটকে থেকে পরদিন মন্টুরামের হাতে ধরা পড়ে যায়। তবে মন্টুরামের বউ হরিমতী তাকে দয়া করে ছেড়ে দেন।
গোবিন্দ ঘোষ খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “চোরটার নাম-ধাম কী জানো? মন্টুরামের বাড়িতে যে ঢুকতে পারে, সে কিন্তু সোজা চোর নয়।”
ভজহরি বলল, “সেটা খুব ঠিক কথা গোবিন্দবাবু। সুধীর গায়েন একজন নাটা চোর বটে, কিন্তু কাজের লোক। চোর দেখে দেখে তো আমার চোখ পেকে গিয়েছে, তাই দেখলেই চিনতে পারি।”
“তা সে কোথায় থাকে বলো তো?”
“এ গাঁয়ের লোক নয়, তবে এখানে-সেখানে খুঁজলে পেয়ে যাবেন। চার ফুটিয়া চোর। রোগা চেহারা। কালও দেখেছি দুপুরে কালীবাড়ির চাতালে বসে মুড়ি-তেলেভাজা খাচ্ছে।”
এ চোরকে খুঁজে বের না করলেই চলছে না। সুতরাং গোবিন্দ ঘোষ তক্কেতক্কে রইলেন। দিন দুইয়ের মাথায় প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে রথতলা বাজারে কেষ্ট সাহুর দোকানের সামনে পেয়েও গেলেন তাকে। ছোটখাটো মানুষ, বসে মুড়ি আর ঘুগনি খাচ্ছে।
“সুধীর গায়েন নাকি হে তুমি?”
সুধীর একটু অবাক হয়ে বলে, “যে আজ্ঞে।”
বেঞ্চে তার পাশেই জুত করে বসে গোবিন্দ ঘোষ বললেন, “ওহে সুধীর, ইংরিজিতে একটা কথা আছে জানো? ট্রাই-ট্রাই-ট্রাই এগেন। ওর বাংলা করলে দাঁড়ায় একবারে না পারিলে দ্যাখো শতবার।”
সুধীর কথাটা একরকম স্বীকার করে নিয়ে বলল, “তা তো ঠিকই গোবিন্দবাবু।”
“তুমি কি আমাকে চেনো নাকি হে?”
“গাঁয়ের সবাইকেই চিনি। না চিনলে আমাদের কাজকারবার চলবে কী করে?”
“অতি সত্যি কথা, অতি সত্যি কথা।”
“মন্টুরাম সিংহের পাশের বাড়িটাই তো আপনার। ছাদের দরজার ছিটকিনিটা একটু আলগা আছে। টয়লেটের জানালার গ্রিল একটু নড়বড়ে, তিনটে স্কু নেই। দরদালানের দেওয়ালে নোনা ধরেছে। আপনার সোনাদানা ব্যাঙ্কের লকারে।”
আহ্লাদে গোবিন্দ ঘোষের চোখে প্রায় জল এসে গেল। গদগদ কণ্ঠে বললেন, “এই না হলে গুণী মানুষ! আহা, বড় আনন্দ হচ্ছে। আজ। এই নাও সুধীর, এই একশোটা টাকা রাখো। আজ একটু ভাল-মন্দ খেয়ো। এটাকে বকশিশ বলে ভেবো না কিন্তু, বলতে পারো গুণীর নজরানা।”
সুধীর টাকাটা পকেটস্থ করে বলে, “তা গোবিন্দবাবু কথাটা কী?”
গোবিন্দ ঘোষ গলাটা নামিয়ে বললেন, “দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে, লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার। বুঝলে কিছু?”
“বেশ গা গরম করা কবিতা মশাই!”
“তাই তো বলছি ভাল করে একটু তেতে ওঠো তো বাপু। হাল ছেড়ে দিলে তো হবে না। হাল বেশ সাপটে ধরতে হবে।”
“মশাই, আপনি কি মন্টুরামের বাড়িতে ফের ঢুকতে বলছেন? তাতে লাভ কী? আমি যে জিনিসটা খুঁজতে প্রাণ হাতে করে ও বাড়িতে ঢুকেছিলাম, তা কোথায় রাখা আছে, তা না জানলে সুবিধে হবে না। অত বড় বাড়ি, অত ঘর, বিস্তর আলমারি, বাক্সপ্যাঁটরা। মেহনতে পোষাবে না যে!”
গোবিন্দ ঘোষ গম্ভীর হয়ে বললেন, “দ্যাখো বাপু, ও বাড়ির অন্ধিসন্ধি আমার মুখস্থ। গত ত্রিশ বছর ধরে নানা ফাঁক-ফোকর দিয়ে দিনে-রাতে আমি মন্টুরামের উপর নজর রাখি। তার কোন জিনিসটা কোথায় রাখা আছে তা আমার নখদর্পণে। একবার উচ্চারণ করেই দ্যাখো৷”।
সুধীর ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বলল, “সেটা একটা ঘেঁড়াখোঁড়া পুরনো চামড়ার সুটকেস। তাতে দামি জিনিসপত্র নেই বটে, কিন্তু বাক্সটা বড়ই দরকার।”
“ছোঃ, ও একটা জিনিস হল হে বাপু? ও বাড়িতে ঢুকবেই যদি তবে সব চেঁছে-পুঁছে নিয়ে এসো। নইলে যে ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ হবে।”
ভারী লাজুক হেসে হেঁটমুন্ডু হয়ে সুধীর বলে, “তা ঢুকতে পারলে কি আর খালি হাতে বেরোব মশাই? তবে ওই বাক্সখানাও চাই।”
“তার আর চিন্তা কী! যে বাক্সখানার কথা বলছ, সেটা এতকাল মন্টুরামের শোওয়ার ঘরের স্টিলের আলমারির মাথায় অচ্ছেদ্দার সঙ্গে রাখা ছিল। এই দিন কয়েক আগে দেখি সেটাকে মন্টুরাম সরিয়ে নিয়ে ছাদের উপর স্ট্রংরুমের সিন্দুকে রেখেছে। তাতে কোন হিরে-জহরত আছে, কে জানে। কিন্তু রোজই মাঝরাতে উঠে মন্টুরাম বাক্সটা খুলে তাকিয়ে থাকে আর বিড়বিড় করে কথা কয়। একটা পুরনো লজঝড়ে চামড়ার সুটকেস তো?”
সুধীর লাফিয়ে উঠে বলে, “ওইটেই। কিন্তু স্ট্রংরুম তো কঠিন ব্যাপার-স্যাপার মশাই।”
গোবিন্দ ঘোষ বরাভয়ের মুদ্রায় হাত দেখিয়ে বললেন, “ওরে বাপু, লখীন্দরের বাসরেও ছাদা ছিল। বুঝলে? যত বজ্র আঁটুনি, তত ফসকা গেরো। ত্রিশ বছর ধরে মন্টুরামের বাড়িখানা নিয়ে যে গবেষণা করে যাচ্ছি, তা তো আর এমনি নয়। স্ট্রংরুমের দেওয়ালে একখানা একজস্ট ফ্যান লাগানো আছে। ছাদার যা সাইজ, তা দিয়ে অনায়াসে তুমি ঢুকতে পারবে। শুধু একজস্ট ফ্যানটা খুলে ফেলার ওয়াস্তা।”
সুধীর বড় বড় চোখে গোবিন্দ ঘোষের দিকে তাকিয়ে বলে, “মশাই, আপনি তো ইচ্ছে করলেই…?”
গোবিন্দ মৃদু হেসে বললেন, “ওরে বাপু, চোর আর গোয়েন্দায় তফাত কিছুই নেই। শুধু প্রয়োগ আলাদা।”
সুধীর একটু দোনোমোনা করে বলে, “আমি ধরা পড়ার পর মন্টুবাবু বাড়িতে পাহারা বাড়িয়েছেন। এখন ঢোকা আর একটু কঠিন হবে।”
গোবিন্দবাবু চাপা গলায় বললেন, “তা হলে আর আমি আছি কী করতে? পাহারা সব নীচে। তা ছাড়া পিছন দিকটা, যেদিকে আমার বাড়ি, সেদিকটায় পাঁচিলে মন্টুরাম চোরের ভয়ে শূল বসিয়েছে, নীচের বাগানে ফণীমনসা, বিছুটি আর নানারকম কাঁটাগাছ লাগিয়েছে, যাতে কেউ ঢুকতে না পারে। ফলে ওদিকটায় পাহারা থাকে না। আমার তিনতলার ছাদ থেকে মন্টুরামের ছাদ মাত্র দশ ফুট তফাত। বুঝলে? দু’খানা লম্বা বাঁশ পাশাপাশি ফেললে একেবারে হাওড়ার ব্রিজ হয়ে গেল হে।”
এবার সুধীর গদগদ হয়ে বলল, “একটু পায়ের ধুলো দিন গোবিন্দবাবু।”
“আহা, থাক থাক। ওসব হবেখন। আগে মন্টুরামের গুমর তো ভাঙুক। ত্রিশ বছর ধরে যে জ্বলুনি-পুড়ুনি সইছি, সেই জ্বালা আগে জুড়োক।”
“বাক্সটা কি সিন্দুকে রাখা থাকে বললেন গোবিন্দবাবু?”
“হ্যাঁ। তবে চিন্তা নেই। সিন্দুকের চাবিটা মস্ত আর ভারী বলে ওটা মন্টুরাম স্ট্রংরুমেই দেওয়ালের পেরেকে ঝুলিয়ে রেখে যায়।”
“নাঃ গোবিন্দবাবু, এবার পায়ের ধুলোটা না নিলে পাপ হয়ে যাবে। দেখবেন একদিন আপনার পায়ের ধুলো নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে। সোনার দরে পুরিয়া করে বিক্রি হবে।”
গোবিন্দবাবু একটু তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, “একটা কথা মনে রেখো বাপু, শুভস্য শীঘ্রম। কথাটার মানে হল, ওরে তোর মরা গাঙে বান এসেছে, জয় মা বলে ভাসা তরী। আজ হল গিয়ে কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমী। পঞ্জিকা দেখে রেখেছি, আজ বড় ভাল দিন।”
“যে আজ্ঞে।”
রাত আড়াইটে নাগাদ যখন গোটা চৈতন্যপুর ঘুমে অচেতন, তখন মন্টুরামের পাহারাদাররা সামান্য তন্দ্রায় আচ্ছন্ন, সড়ালে কুকুরেরা থাবায় মুখ রেখে ঝিমিয়ে নিচ্ছে, মন্টুরাম যখন স্ট্রংরুমে মদন তপাদারের সুটকেসটা আরও একবার দেখে দু’নম্বর মন্টুরামের সঙ্গে ঝগড়া করতে করতে নীচে নেমে এসে সবে খাটে শুয়েছেন, ঠিক এই সময়ে জোড়া বাঁশের সাঁকো বেড়ালের মতো পেরিয়ে গেল সুধীর গায়েন। এপাশের ছাদে বাঁশ দুটো শক্ত করে চেপে ধরে রেখে গোবিন্দ ঘোষ খুব হাসছিলেন। আহা, এতদিনে তাঁর একটা সাধ পূরণ হল। তিনি বিড়বিড় করে বলছিলেন, “জয় দুর্গা, জয় কালী, জয় বাবা বিশ্বনাথ, জয় মা শীতলা, জয় তারা, কাজটা ভালয় ভালয় উতরে দাও। মন্টুরামের সব যেন চেঁছে-পুঁছে আনতে পারে ছোঁড়া।”
তা দেবতারা গোবিন্দ ঘোষের ডাকাডাকি বোধহয় আজ শুনতে পেলেন। আধঘণ্টা পরে দেখা গেল সুধীর এক হাতে একটা বাক্স আর অন্য হাতে একটা থলি নিয়ে একটু টলমল পায়ে সাঁকো ডিঙিয়ে আসছে।
উত্তেজনার বশে গোবিন্দবাবু একটু জোরেই চেঁচিয়ে ফেলেছিলেন, “জয় মা দুর্গা দুর্গতিনাশিনী!”
তাতে গোটা দুই কাক কা-কা করে উঠল। ভজহরির হাঁক শোনা গেল, “কৌন হ্যায় রে!” একটা সড়ালে কুকুরও যেন সন্দিহান হয়ে বারকয়েক ঘেউঘেউ করে উঠল। গোবিন্দ প্রমাদ গুনলেন। বুক কাঁপছিল। গলা শুকিয়ে আসছিল উত্তেজনায়। চোখ বন্ধ করে ফেললেন।
মাঝপথে একটু পড়ো পড়ো হয়েছিল সুধীর। কিন্তু সামলে নিল। বাঁশে একটু মচাৎ মচাৎ শব্দ হচ্ছিল যেন। তিরে এসে তরী না ডোবে! গোবিন্দ ঘোষ দাঁতে দাঁত চেপে বাঁশ ধরে রইলেন।
সুধীর হাসিমুখে এই ছাদে এসে লাফ দিয়ে নেমে নিচু হয়ে গোবিন্দর পায়ের ধুলো নিল। গোবিন্দ ঝটিতি বাঁশ দুটো টেনে নিয়ে ছাদের একধারে শুইয়ে রেখে বললেন, “শাবাশ! সব চেঁছে-পুঁছে এনেছ তো?”
সুধীর বলল, “তা মশাই কম হবে না। গিনি আর সোনার বিস্কুটে তিন-চার কেজি তো হবেই।”
গোবিন্দ বললেন, “পাঁচ-সাত কেজি হলে ভাল হত হে।”
“সোনাদানা তো জীবনে খুব বেশি ঘাঁটিনি মশাই। সোনার যে এত ওজন, তা কে জানত!”
“যাক গে বাপু, যা হয়েছে তাই হয়েছে। এবার এসো গিয়ে।”
“আজ্ঞে, আপনার ভাগটা রেখে দিন। আধাআধি বখরা।”
গোবিন্দ ঘোষ আঁতকে উঠে বললেন, “সর্বনাশ! ভাগজোখের কথা উঠছে কেন? স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়, পরোধর্ম ভয়াবহ। এর মানে জানো? যার কর্ম তারে সাজে, অন্যের হাতে লাঠি বাজে।”
সুধীর হাঁ করে খানিক চেয়ে থেকে বলে, “এই এত সব আমাকে দিয়ে দিচ্ছেন গোবিন্দবাবু? কিন্তু আপনি যে এত কষ্ট করলেন, মদত দিলেন, এর কি কোনও মজুরি নেই?”
“পাগল নাকি? চোরের ধর্ম আর গেরস্তের ধর্ম আলাদা বাপু।”
“তা হলে আসি আজ্ঞে,” বলে সুধীর তাঁকে প্রণাম করে বিদায় নিল।
গোবিন্দ ঘোষ এসে বিছানায় শুলেন। বুকটা আজ ভারী ঠান্ডা। মনটায় বেশ শান্তি পাচ্ছেন।
সকালবেলায় তাঁর স্ত্রী বাসন্তীদেবী তাঁকে ঠেলে তুললেন, “ওগো, ওঠো! ওঠো! মন্টুরামের বাড়িতে নাকি কাল রাতে মস্ত চুরি হয়ে গিয়েছে?”
গোবিন্দ ঘোষ হাই তুলে ভারী আদুরে গলায় বললেন, “তাই নাকি?”
“হ্যাঁ। মন্টুবাবু দারোগা-পুলিশ নিয়ে ওঁদের ছাদে উঠে আমাদের বাড়ির দিকে আঙুল দিয়ে কী যেন দেখাচ্ছেন!”
আঁতকে উঠে গোবিন্দ বললেন, “আমাদের বাড়ির দিকে? আমাদের বাড়ির দিকে দেখাচ্ছে কেন?”
“তার আমি কী জানি। একটু আগে মন্টুরামের বাঘা কুকুরগুলো এসে আমাদের বারান্দা-দরজা সব শুকছিল। তাদের কী রাগ, যেন ছিঁড়ে খায় আমাদের। ভাগ্যিস শিকলে বেঁধে এনেছিল।”
গোবিন্দ ঘোষ কাহিল গলায় বলেন, “কুকুর কোন সাহসে আমার বাড়ি শুকতে আসে?”
“এই তো পটলা ও বাড়ি থেকে ঘুরে এসে বলল, কানাই দারোগা নাকি আমাদের বাড়িতেও আসবে।”
গোবিন্দ ঘোষ টপ করে উঠে বললেন, “থলিটা দাও, বাজার সেরে আসি।”
বাসন্তীদেবী বললেন, “ওমা! কালই তো বাজার করেছ! আজ আবার বাজার কীসের?”