গভীর ঘুম থেকে যখন আস্তে-আস্তে চোখ মেললেন বাঞ্ছারাম, তখন এক অদ্ভুত অনুভূতি হল তাঁর। তাঁর সমস্ত চেতনা জাগ্রত। তাঁর বিস্মৃতি আর নেই। সব কিছুই তাঁর আশ্চর্য স্পষ্টভাবে মনে পড়ছে। তিনি একজন বৈজ্ঞানিক। তাপ বিবর্ধক যন্ত্র আবিষ্কারের জন্য তিনি সচেষ্ট ছিলেন। এমন কী এই কেবিনঘরটার কথাও তাঁর মনে পড়ল। এও বুঝতে পারলেন, কয়েকজন শয়তান লোক তাঁকে এখানে ধরে এনেছে।
বাঞ্ছারাম চোখ বুজে কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে রইলেন। তারপর আবার চোখ মেললেন।
ডাক্তার এগিয়ে এল। “হ্যাঁলো, তুমি ভাল আছ?”
বাঞ্ছারাম চোখ মিটমিট করে বললেন, “আমি রসগোল্লা খাব।”
ডাক্তার হতাশার ভাব করে আপনমনে বলল, “আবার যে কে সেই। ঠিক আছে বুড়ো, আবার টুথ ইনজেকশনই তোমাকে নিতে হবে।”
বাঞ্ছারাম সবই বুঝতে পারছেন। যে-কোনো কারণেই হোক তাঁর পাগলামি সেরে গেছে, স্মৃতি ফিরে এসেছে। সে হয়তো মারধর খেয়ে, কিংবা এদের উল্টোপাল্টা ওষুধপত্রের ফলে। কিন্তু তা এরা জানে না। তাঁরও ধরা দেওয়া উচিত হবে না। বাঞ্ছারাম চোখ বুজে পড়ে রইলেন।
একটু বাদেই সেই বেঁটে লোকটা এল। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল, “রুগি কেমন?”
“একই রকম।”
“আমরা মাইক্রোফিল্মটা পেয়ে গেছি। এখন সেটা ডিসাইফার করতে হবে। ওকে আর একটু টুথ ইনজেকশন দাও। তারপর আমরা ওকে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যাব।”
ডাক্তার সিরিঞ্জ নিয়ে এগিয়ে এল। বাঞ্ছারাম জানেন এই ইনজেকশন মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে নষ্ট করে দেয়, চিন্তাশক্তিকে দুর্বল করে। কিছু বানিয়ে বলার ক্ষমতা থাকে না মানুষের। এই ইনজেকশন শরীরে ঢুকলে তিনি আর কিছুই করতে পারবেন না। তবু উপায় নেই। হাত পা শক্ত করে বাঁধা। বাঞ্ছারাম চোখ বুজে প্রাণপণে নিজের মনটাকে শক্ত রাখার চেষ্টা করলেন। ডাক্তার সমস্তটুকু ওষুধ ছুঁচের মুখে ঠেলে দিল তাঁর শরীরে।
একটা হুইল চেয়ারে যখন ল্যাবরেটরিতে আনা হল বাঞ্ছারামকে, তখন তাঁর চোখ বিস্ফারিত। মুখ লাল। একটু হাঁফাচ্ছেনও।
বেঁটে লোকটা এগিয়ে এল তাঁর কাছে। তারপর আচমকা কষে একটা চড় মারল তাঁর গালে। তারপর প্রশ্ন করল, “আসল মাইক্রোফিল্মটা কোথায় বুড়ো ভাম?”
চড়টা টের পাননি বাঞ্ছারাম ওষুধের গুণে। কিন্তু প্রশ্নটা তাঁর মস্তিষ্কে গিয়ে ক্রিয়া করল। তিনি শান্তস্বরে বললেন, “ক্যাকটাস গাছের তলায়।”
“ক্যাকটাস গাছের তলায় যা পাওয়া গেছে, তা দেখবে? দ্যাখো।” বলে বেঁটে লোকটা একটা প্রজেকটারের সুইচ টিপল। সামনে একটা পর্দায় ফুটে উঠল আবছা একটা ছবি। হিজিবিজি মাত্র। বেঁটে লোকটা তার নিষ্ঠুর ঠাণ্ডা গলায় বলল, “এটা মাইক্রোফিল্মও নয়। একটা নষ্ট নেগেটিভের কাটা অংশ। এখন কী জবাবদিহি করবে?”
বাঞ্ছারাম দৃঢ় শান্তস্বরে বললেন, “মাইক্রোফিল্ম আছে ক্যাকটাসের তলায়।”
“নেই! নেই!” বলে চেঁচিয়ে ওঠে বেঁটে লোকটা। এই প্রথম উত্তেজিত, হতাশ এবং কুদ্ধ দেখায় তাকে। বাঞ্ছারামের দুটো কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিতে-দিতে সে বলে, “সত্যি কথা বলো! নইলে খুন করে জলে ফেলে দেব।”
ডাক্তার এগিয়ে এসে বেঁটে লোকটার কাঁধে হাত রেখে বলে, “ডগলাস, এরকম কোরো না। ও যা বলছে সত্যি কথাই বলছে। টুথ ইনজেকশনের পর কোনো মানুষের পক্ষেই বানিয়ে কথা বলা সম্ভব নয়।”
ডগলাস পাগলাটে চোখে ডাক্তারের দিকে চেয়ে বলে, “তাহলে কোথায় গেল মাইক্রোফিল্ম?”
এই প্রশ্নের জবাব এল সম্পূর্ণ অন্য অচেনা এক কণ্ঠ থেকে। “মাইক্রোফিল্ম আমার কাছে আছে।”
ডগলাস চমকে উঠে তাকিয়ে দেখে, দরজার কাছে লম্বা গড়নের মজবুত ছিপছিপে চেহারার একজন ভারতীয় যুবক দাঁড়িয়ে আছে। জাহাজ মাঝ-সমুদ্রে, চারিদিকে নিজস্ব লোকজন, তাই ল্যাবরেটরির দরজায় পাহারা রাখা প্রয়োজন মনে করেনি ডগলাস। এখন আচমকা ভূত দেখার মতো এই ছেলেটিকে আবির্ভুত হতে দেখে সে বিস্ময়ে হাঁ করে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে ঠাণ্ডা হিসেবি গলায় বলল, “তুমি কে?”
রতন তার বাবাকে দেখিয়ে বলল, “আমি ওঁর ছেলে। ওঁকে নিয়ে যেতে এসেছি।”
ডগলাস একটু কূর, শুকনো হাসি হেসে বলল, “ওয়েলকাম। কিন্তু কী করে এলে সেইটেই শুনতে চাই।” এই বলে ডগলাস একটু সরে এসে একটা টেবিলের পায়ায় লাগানো বোতামে চাপ দিল। চোখের পলকে দুজন লোক এসে হাজির হল দরজায়। তাদের চেহারা বিশাল এবং মুখ খুনির মতো ভয়ংকর। ডগলাস জ্ব কুঁচকে তাদের দিকে চেয়ে বলে, “তোমাদের মতো দক্ষ লোক থাকতেও এই ছেলেটি মাঝ-সমুদ্রে নোঙর করা একটা জাহাজে এসে উঠেছে। তোমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। এর জন্য তোমাদের জবাবদিহি পরে শুনব। আগে ছেলেটিকে সার্চ করো এবং দরজা বন্ধ করে বাইরে পাহারায় থাকো।”
সার্চ করে কিছু পাওয়া গেল না। লোকদুটো শুকনো মুখে দরজা বন্ধ করে দিল বাইরে থেকে।
ডগলাস স্থির দৃষ্টিতে রতনকে দেখছিল। তার বাঁ হাতে কখন যে জাদুবলে একটা ছোট্ট খেলনার মতো বাইশ বোরের রিভলভার উঠে এসেছে, তা কেউ টের পায়নি। এখন রিভলভারটা আবার কাঁধ থেকে ঝোলানো গুপ্ত হোলস্টারে রেখে ডগলাস একটা নিশ্চিন্তির শ্বাস ফেলে বলল, “তুমি চালাক চতুর। খুবই বুদ্ধিমান। কী করে তুমি জাহাজে এসে উঠলে, তা পরে জানলেও চলবে। এখন বলো মাইক্রোফিল্মটা কোথায়।”
রতন মাথা নেড়ে বলল, “সেটা এখনই বলতে পারছি না, ডগলাস। আমার বাবার মুক্তির পর বাড়ি ফিরে গেলে তবেই তা বলা যাবে।”
ডগলাস বিন্দুমাত্র চঞ্চল বা বিরক্ত হল না। খুব ঠাণ্ডা গলায় বলল, “তোমার বা তোমার বাবার মুক্তির কোনো প্রশ্নই আসে না। আমার চেহারাটা দেখে ভুল কোরো না। আমার বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কেউই কোনো লড়াই জেতেনি। তোমার মঙ্গলের জন্যই বলছি, মাইক্রোফিল্মের সন্ধানটা তোমার জানিয়ে দেওয়াই ভাল। নইলে আমাদের টর্চার চেম্বার আছে, টুথ ইনজেকশন আছে। তোমার তো মিলিটারি ট্রেনিং নেই, একটু বাদেই আমরা তোমার মুখ থেকে সত্যি কথাটা টেনে বের করে নেব। মাঝখানে খামোখা কেন কষ্ট পাবে?”
রতন থমকে গেল। সে টচার বা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কথাটা ভেবে দেখেনি। টুথ ইনজেকশনের কথা সে আবছা শুনেছে। আমতা-আমতা করে সে বলল, “তুমি আমাদের ক্ষতি করতে চাও কেন? আমি তো বলছি মাইক্রোফিল্ম আমি দেব। শুধু আমার বৃদ্ধ বাবাকে ছেড়ে দাও। আমরা পুলিশকে কিছু জানাব না।”
ডগলাস আবার একটু হেসে বলে, “তোমাদের পুলিশকে আমার ভয় নেই। তবে আমাদের কয়েকজন প্রতিপক্ষ আছে। ভয়টা তাদের। কোনোভাবে খবরটা বাইরে যাক, তা আমরা চাই না। সুতরাং, ওহে যুবক, তুমি সাধ করে সিংহের ডেরায় ঢুকেছ। আমাকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা কোরো না। যদি ভালয়-ভালয় মাইক্রোফিল্মটা দিয়ে দাও, তাহলে কথা দিচ্ছি, তোমাদের মৃত্যু হবে যন্ত্রণাবিহীন।”
জন তাকে বলেছিল, “বিপদে পড়লে কোনো দ্বিধা কোরো। সরাসরি আঘাত কোরো। এইসব দুর্জন মুখোমুখি কনফ্রনটেশনের কাছেই বরং কখনো-সখনো হারে।” কথাটা মনে পড়তেই মরিয়া রতন চট করে এক পা এগোল।
কিন্তু পুতুলের মতো ছোট্ট লোকটা জাদুই জানে বুঝি। চোখের পলকে তার হাতে দেখা দিল সেই মৃত্যহিম ছোট্ট রিভলভারটা। সে বলল, “রিভলভারের তাক খুবই অনিশ্চিত। বেশির ভাগ সময়েই তা লক্ষ্যবস্তুর অনেক দূর দিয়ে চলে যায়। তাছাড়া আমার এই ছোট্ট যন্ত্রটা কমজোরিও বটে। তবু তোমাকে বলি, কোনোরকম নির্বোধ কাজ কোরো না।”
সাদা পোশাক পরা ডাক্তার এতক্ষণ নীরবে অবাক চোখে দৃশ্যটা দেখছিল। হঠাৎ বাঞ্ছারাম মৃদু একটা শব্দ করতেই সে এগিয়ে গেল। রুগিকে পরীক্ষা করে সে ডগলাসের দিকে চেয়ে বলল, “টুথ ইনজেকশনের মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই এর চেতনা ফিরবে। কী করব ডগলাস, একে ঘুম পাড়িয়ে দেব?”
ডগলাস এক পলকের জন্যও রতনের দিক থেকে চোখ ফেরায়নি। সেইভাবে থেকেই বলল, “না। একে জাগতে দাও।” তারপর রতনকে বলল, “আমার মনে হয়, তুমি একা আসনি। সঙ্গে আর কে আছে?”
“কেউ না।”
ডগলাস সেকথা বিশ্বাস করল না। কোণের টেবিলে গিয়ে টেলিফোনটা তুলে নিল। একটুক্ষণ কথা বলেই আবার রতনের মুখোমুখি দশ ফুট দূরত্বে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “তোমার সঙ্গে আরো দুজন এসেছে। তোমরা তিনজনে মিলে আমার তিনজন লোককে ঘায়েল করেছ। তোমার আর দুজন সঙ্গী কোথায়?”
রতন চুপ করে রইল।
ডগলাস বলল, “আমার লোক তাদের খুঁজছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা ধরা পড়বে। সুতরাং তোমার কষ্ট করে না বললেও চলবে।”
রতন পরাজয়ের গ্লানি টের পাচ্ছিল। আসলে চালে একটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে। এখন আর কিছুই করার নেই।
সে তার বাবাকে পিছন থেকে দেখতে পাচ্ছিল। হুইল চেয়ারে বসা, অসহায় বুড়ো একজন মানুষ। যার ভাল মন্দ কোনো বোধ নেই, স্মৃতিশক্তি নেই। তবু এই পাগল অসহায় লোকটাকেও এরা খুন করবেই। কিন্তু বাবার দিকে এক পাও এগোবার উপায় নেই। তাতে দুজনের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করা হবে মাত্র।
ডাক্তার ঝুঁকে বাঞ্ছারামের নাড়ি দেখছিল। বাঞ্ছারাম নানা ধরনের শব্দ করছিলেন–”ওঃ! উঃ! ওরে বাবা! রসগোল্লা খাব।”
বোঝা গেল বাঞ্ছারামের চেতনা ফিরে এসেছে। রতন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কেন যে তার বাবা হিট অ্যামপ্লিফায়ার আবিষ্কার করতে গিয়েছিলেন! সে শুনেছে, তার বাবাও যৌবনকালে একজন ভাল মুষ্টিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি যদি মুষ্টিযোদ্ধাই থেকে যেতেন, বৈজ্ঞানিক না হতেন, তবে পাগলও হতেন না, আজ এই বিপদও ঘটত না।
হঠাৎ ডগলাস বাঞ্ছারামের দিকে চেয়ে বলল, “এই ছেলেটিকে চিনতে পারো? দ্যাখো তো ভাল করে চেয়ে। এ কি তোমার ছেলে?”
বাঞ্ছারাম আস্তে মুখ ঘোরালেন। রতনের দিকে নিষ্পলক চোখে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।
কিন্তু রতন বিস্ময়ে থ হয়ে গেল। ছেলেবেলা থেকেই সে বাবার চোখে যে ঘোলা-ঘোলা, অনিশ্চিত, উদাসীন চাউনি দেখে এসেছে, এই চাউনি মোটেই সেরকম নয়। সে স্পষ্ট বুঝতে পারল, বাবার চোখ অন্যরকম। আগের চেয়ে অনেক বেশি তীক্ষ্ণ, তাতে বুদ্ধির ঝিকিমিকি।
বাঞ্ছারাম চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, “না, না। এ আমার ছেলে নয়। আমি রসগোল্লা খাব।”
ডগলাস রিভলভারটা হোলস্টারে ভরে আবার বেল টিপল। দরজা খুলে সেই দুটো লোক ঘরে ঢুকতে ডগলাস বলল, “বুড়োকে কেবিনে নিয়ে যাও। আর এই ছোকাকে আটকে রাখো।”
লোকদুটো এগিয়ে আসছিল হুইল চেয়ারের দিকে। ডগলাস তীক্ষ্ণ চোখে নজর রাখছিল রতনের দিকে। ডাক্তার তার যন্ত্রপাতি গোছাচ্ছিল। ঠিক এইসময়ে অভাবনীয় একটা ঘটনা ঘটল।
আচমকা বৃদ্ধ অশক্ত পাগল বাঞ্ছারাম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। মাত্র এক পা এগিয়ে একটু নিচু হয়ে তিনি ডান হাতে প্রচণ্ড একটা ঘুষি মারলেন ডগলাসকে। সে ঘুষির বহর দেখে রতনও অবাক হয়ে গেল। চেতনা হারানোর আগে ডগলাসও
বোধহয় বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গিয়েছিল। এমন কী, ডগলাসের দুই স্যাঙাত পর্যন্ত থমকে গেল কয়েক সেকেন্ডের জন্য।
বড় ভুল করল তারা। কাছেপিঠে একজন সুদক্ষ মুষ্টিযোদ্ধা থাকলে এরকম চালে ভুল করতে নেই। যে দু তিন সেকেন্ড তারা পাথর হয়ে ছিল, সেই সময়ে রতন সক্রিয় হল। তার দুখানা ঘুষি দেড়মনি পাথরের মতো গিয়ে একজনের চোয়াল ভেঙে দিল।
সে কুমড়ো-গড়াগড়ি হয়ে পড়ে যেতেই অন্যজন ফিরে দাঁড়িয়েছিল রতনের দিকে। তখন পিছন থেকে বাঞ্ছারাম একটা কাঁচের জার বিদ্যুৎ-বেগে তুলে নিয়ে তার মাথায় মারলেন।
এ পর্যন্ত বেশ হল। কিন্তু বাপ-ব্যাটা হঠাৎ দেখল, ডাক্তার লোকটা ডগলাসের রিভলভার বাগিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বলল, “হাত তোলো, পিছনের দিকে সরে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়াও।”
দুজনেই হাত তোলে। কিন্তু রতনের ভিতরে ডগলাসের কথাটা টিকটিক করতে থাকে। রিভলভারের তাক নাকি অনিশ্চিত। প্রায়ই তা লক্ষ্যবস্তুর গায়ে লাগে না। কথাটা সত্যি কিনা তা রতন জানে না। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তার একবার ঝুঁকি নিতে ইচ্ছে করে।
হঠাৎ রতন এক লাফে সামনের দিকে এগোয়। সঙ্গে-সঙ্গেই রিভলভারের “ফটাস” শব্দ হয়।
রতন বেকুবের মতো চেয়ে থাকে। সে ডাক্তারের ধারে কাছেও পৌঁছতে পারেনি। কিন্তু ডাক্তার মেঝের উপর লুটিয়ে পড়ে আছে। রক্তের একটা পুকুর তৈরি হচ্ছে তার বুকের নিচে।
পিছন থেকে জন সান্ত্বনার গলায় বলে, “তোমার সাহসের প্রশংসা করতে হয় রতন, কিন্তু বোকামির নয়।”
জন রিভলভারটা নামিয়ে চারদিকে চেয়ে দেখে। তারপর বলে “বাঃ, রঙ্গমঞ্চ তো দেখছি আমাদের দখলে।”
রতন হুঁশ ফিরে পেয়ে বলে, “না, এখনো নয়। ডগলাসের লোকেরা তোমাদের খুঁজতে বেরিয়েছে। যে-কোনো মুহূর্তে এসে পড়বে।”
“জানি।” জন শান্ত স্বরে বলে, “কিন্তু তারা ডগলাসের ল্যাবরেটরিতে ঢুকবার সাহস পাবে না। রোলো, ভিতরে এসে দরজাটা ভাল করে সেঁটে দাও।”
রতন উদ্বেগের গলায় বলে, “কিন্তু আমরা বেরোব কী করে?”
“রাস্তা আছে।” বলে জন ল্যাবরেটরির একটা টেবিল সরায়। নিচে পাটাতনে একটা ম্যানহোলের ঢাকনার মতো বস্তু। জন সেটা তোলে। বলে, “এসো।”
ঘোরানো একটা লোহার সিঁড়ি বেয়ে তারা নামে। খুব নিচে নয়। মাত্র একতলা নেমে জন অন্ধকারে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। রতনের হঠাৎ খেয়াল হয়, রোলো এখনো নামেনি।
একটু বাদেই অবশ্য রোলো নেমে আসে নিঃশব্দে।
রতন জিজ্ঞেস করে, “রোলো এতক্ষণ কী করছিল জন?”
জন মৃদু ব্যথিত স্বরে বলে, “কেন শুনতে চাও?”
“কেন শুনব না? কী করছিল রোলো?”
জন মৃদু স্বরেই বলে, “যা করছিল তা ভদ্রলোকের কাজ নয়। বিপ্লবীদের অনেক সময় এরকম অপ্রীতিকর কাজ করতে হয়।
শত্রুর শেষ রাখতে নেই। সেই কাজটুকু ও শেষ করে এল।”
“তার মানে কি মেরে ফেলল সবাইকে?”
“বলেছিলাম তো, শুনতে চেও না। ডগলাস বেঁচে থাকলে আমাদের কোথাও পরিত্রাণ ছিল না। একজন পুতুলের মতো ছোট্ট মানুষ যে কতখানি বিপজ্জনক হতে পারে, তা যারা ডগলাসকে জানে না, তারা কল্পনাও করতে পারবে না।”
অনেকখানি নিচে নামল তারা। তারপর এক জায়গায়
দেয়ালের গায়ে একটা হুইল ঘোরায় জন। ছোট্ট একটা ফোকর দেখা যায় দেয়ালে। জন উঁকি মেরে দেখে নিয়ে বলে, “জাহাজে লোড থাকলে এই ফোকর থেকে জলের লেভেল মাত্র ছ’ফুট। লোড না থাকলে বিশ ফুট বা তারও বেশি। লোড আছে, সুতরাং বিপদের ভয় নেই। তোমার বাবাকে একটু সাবধানে নামিও রতন। আমাদের স্পীডবোট মাত্র দশ ফুট দূরে রয়েছে। সামান্য একটু সাঁতরাতে হবে। পারবে না?”
“পারব।” রতন বলে। বাইরে কুয়াশা ছিল। চারজন নিঃশব্দে সকলের অলক্ষ্যে এসে বোটে উঠল। জাহাজ থেকে কেউ লক্ষ করছিল না হয়তো। কে জানে!
রোলো বোটে উঠে ছাদ থেকে জাহাজের দড়ির মইটা খুলে ছেড়ে দিল। তারপর কেবিনের পাটাতনের তলা থেকে দুটো স্পার্ক প্লাগ বের করে ইঞ্জিনে লাগিয়ে নিল। দড়ির মইটা খুলে দেওয়াতে বোটটা ঢেউয়ে দুলে সরে এসেছিল একটু। রোলো স্পীডবোটের মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে স্টার্ট দিল। তারপর নক্ষত্ৰবেগে ছুটে গেল উল্টো দিকে।
মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিল রতন। বিমর্ষ গলায় বলল, “সর্বনাশ হয়েছে জন।”
“কী হয়েছে?”
“আমার মোজার মধ্যে সেই মাইক্রোফিল্মটা লুকিয়ে রেখেছিলাম। খেয়াল ছিল না। জলে সেটা বোধহয় গেছে।”
জন বলল, “হায় ঈশ্বর!” রোলোও একটা অদ্ভুত শব্দ করল সামনে থেকে।
জন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “কী আর করা যাবে! আমার ইচ্ছে ছিল তোমার বাবাকে অ্যামেরিকায় নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলব। তারপর ফিরে এসে তিনি হিট অ্যামপ্লিফায়ার নিয়ে কাজ করবেন। আমি হব তাঁর আন্তজাতিক এজেন্ট। তা আর হল না।”
বাঞ্ছারাম চোখ মেললেন। চারিদিকে চেয়ে হঠাৎ বললেন, “মাইক্রোফিল্মেরও দরকার নেই। আমার চিকিৎসারও দরকার নেই।”
বাঞ্ছারাম মৃদু হেসে বলেন, “আমি স্মৃতিশক্তি ফিরে পেয়েছি। হিট অ্যামপ্লিফিকেশনের ফরমুলা আজও ভুলিনি। কাজ কিছু কঠিন হবে না। নিজের ল্যাবরেটরিতে ফিরে গিয়েই কাজ শুরু করব।”
স্তম্ভিত জন বলে, “আপনি কি সুস্থ?”
“পুরোপুরি। হিট অ্যামপ্লিফায়ার নামটা এরকম অদ্ভুত কেন জানো? আমি তাপকে বাড়ানোর জন্য একটা শব্দের সাহায্য নিয়েছি। এই সাইলেন্ট সাউন্ড। মানুষ তা কানে শুনতে পায় না। মৃদু একটা কম্পন মাত্র। সবই আমার মনে আছে।”
আনন্দে জন বাঞ্ছারামকে জড়িয়ে ধরে বলে, “কিন্তু কী করে আপনি সুস্থ হলেন?”
বাঞ্ছারাম মৃদু হেসে বললেন, “বোধহয় শক থেরাপি। ওরা আমাকে প্রচণ্ড মারধর করেছিল, টুথ ইনজেকশন দিয়েছিল। সেই সব শক কখন আমার মাথার ধোঁয়া কাটিয়ে দিয়েছে।” এই বলে বাঞ্ছারাম রতনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমিই রতন?”
রতন উঠে এসে শ্লীপিং ব্যাগে ঢাকা বাঞ্ছারামের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। কান্নায় অবরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, “হ্যাঁ বাবা।”
বাঞ্ছারাম শ্লীপিং ব্যাগ থেকে হাত বের করে রতনের মাথায় রাখলেন। “তুমি যে এত বড় হয়েছ তা আমি বুঝতেই পারিনি। দীর্ঘদিন আমি এক অদ্ভুত মানসিক তন্ত্রায় আচ্ছন্ন ছিলাম। আমার
দিদি কি বেঁচে আছে?”
“আছে বাবা।”
জন আর রোলোকে দেখিয়ে বাঞ্ছারাম জিজ্ঞেস করেন, “এরা কারা? তোমার বন্ধু?”
জন হাত বাড়িয়ে বাঞ্ছারামের হাত চেপে ধরে বলে, “আমরা আপনাদের বন্ধু।”
বাঞ্ছারাম একটু হাসলেন।
তাঁরা বাড়িতে পৌঁছলেন দুপুর পার হয়ে। রতনের পিসি আনন্দে কাঁদতে লাগলেন। রঘু চেঁচাতে-চেঁচাতে লাফাতে লাগল। পাড়া-প্রতিবেশী ভিড় করে দেখতে এল বাঞ্ছারামকে। আসতে লাগল ঝাঁকে ঝাঁকে রিপোর্টার, পুলিশের লোক, বাঞ্ছারামের পুরনো বন্ধু বান্ধবরা।
অনেক রাতে অভ্যাগতরা বিদায় হল। জন আর রোলো ফিরে গেল তাদের হোটেলে। পিসি আর রতন ঘুমিয়ে পড়ল। এখন বাঞ্ছারাম তাঁর সাধের ল্যাবরেটরিতে এসে ঢুকলেন। ভ্রু কুঁচকে চারদিকে চেয়ে দেখলেন একটু। সব আবার সাজিয়ে তুলতে সময় লাগবে কিন্তু তাতে কী? তিনি এখন প্রচণ্ড উদ্যম বোধ করছেন ভিতরে ভিতরে। শত্রুপক্ষ তাঁর অনেক উপকার করেছে।
বাঞ্ছারাম তাঁর জাদু চেয়ারে বসে একটা স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে সেই দশ-বারো বছর আগেকার মতো হাঁক দিলেন, “রঘু! রসগোল্লা।”
হ্যাঁ, তখনো তাঁর মিষ্টি খাওয়া বারণ ছিল। কিন্তু গভীর রাতে রঘু তাঁকে রসগোল্লা সাপ্লাই করত।
হাঁক দিতে না দিতেই রঘু মস্ত টেবিলের তলা থেকে বিরক্ত মুখে বেরিয়ে এসে আলমারি খুলে দশ বারো বছর আগেকার মতোই এক ভাঁড় রসগোল্লা বের করে দিল। তারপর বলল,
“রসগোল্লা আবার একটা খাবার! জিনিস হল চাপড়ঘন্ট।”
“তোকে বলেছে!” গম্ভীর স্বরে ধমকে ওঠেন বাঞ্ছারাম।
রঘু সমান তেজে বলে, “খাচ্ছেন খান, কিন্তু ছিবড়ে ফেলবেন। আমার মেজো পিসেমশাইও রসগোল্লার ছিবড়ে ফেলতেন।”
বাঞ্ছারাম অনেকদিন পর খুব হোঃ হোঃ করে হাসলেন।