গটমট করে ঘরে ঢুকে গেল লিলি। পেছনে দড়াম করে লাগিয়ে দিল দরজাটা।
এটাই তোমার শেষ সুযোগ! চিৎকার করে বলল পাইক।
বোকা মেয়ে! শুয়োরের মত ঘোঁৎ ঘোঁৎ করল নিরেক। তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে বলল, ওকে বোঝাও গে। তোমাদের তো বন্ধুই মনে হয়। বলো, পাইকের প্রস্তাব মেনে নিতে। এরকম একটা জায়গা থেকে এর বেশি আর কি আশা করে ও? শুনলাম, ঘোড়াটাও নাকি হারিয়েছে?
খারাপ কথা বাতাসের আগে চলে, আনমনেই বলল রবিন।
রাগে ঠোঁটে ঠোঁট চাপল নিরেক। দামি যেটা ছিল সেটাও গেল। শুকনো কয়েকটা গর্ত আর ধসে পড়া বাড়ি ছাড়া শেষে আর কিছুই থাকবে না। ব্যাংক আর একটা কানাকড়িও দেবে না। সময় ফুরিয়েছে ওর।
ইউনিকর্নের কথা ভাবল কিশোর। সাংঘাতিক দামি একটা জানোয়ার।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে থামল নিরেক, ঘুরে তাকাল কিশোরের দিকে। শীতল এক চিলতে হাসি ঠোঁটে ফুটেই মিলিয়ে গেল। আরেকটা কথা, ঘোড়াটা পালিয়েছে একথা আমি বিশ্বাস করি না। লিলি নিজেই চালাকি করে এ কাজটা করেছে, যাতে ওটা পালাতে পারে।
কেন একাজ করবে? প্রশ্ন করল মুসা।
পাইকের দিকে তাকাল একবার নিরেক। বীমার টাকার জন্যে। অনেক টাকা বীমা করান হয়েছে ঘোড়াটার। কিন্তু লাভ হবে না। আমি নিজে চেষ্টা করব, যাতে সমস্ত শয়তানী ফাঁস হয়ে যায়, টাকা আদায় করতে না পারে কোম্পানির কাছ থেকে। জালিয়াতিটা ব্রা পড়লে জায়গা-সম্পত্তি তো যাবেই, জেলেও যেতে হবে। ওকে।
স্থির দৃষ্টিতে লোকদুটোর নেমে যাওয়া দেখল কিশোর।
ওগুলো মানুষ না কি! ঘৃণায় মুখ বাঁকাল রবিন।
জায়গাটা ওর এত দরকার কেন? নিজেকে প্রশ্ন করল যেন কিশোর। র্যাঞ্চের কি অভাব পড়ল নাকি এই এলাকায়? জায়গা তো আরও আছে।
হয়ত এরকম আর নেই, মুসা বলল।
হু! দুজনের দিকে তাকাল কিশোর। ইউনিকর্ন যেখানে লাফিয়ে পড়েছিল সে জায়গাটা দেখতে যাচ্ছি আমি। আসতে চাও?
নিশ্চয়, বলতে এক মুহূর্ত দেরি করল না রবিন।
মুসা মাথা নাড়ল। যাওয়ার তো খুবই ইচ্ছে। কিন্তু কেরোলিন আন্টিকে যে কথা দিয়ে ফেলেছি, বিকেলে রান্নাঘরে তাকে সাহায্য করব। পরে গেলে হয় না?
দেরি করা উচিত না, কিশোর বলল।
তাহলে আর কি করা, নিরাশ ভঙ্গিতে হাত ওল্টাল মুসা। তোমরাই যাও।
রওনা হলো কিশোর আর রবিন। গোলাঘরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে রবিন বলল, লুক যদি দেখে ফেলে কি বলব?
জানি না। তবে ওর কাছে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই আমরা।
.
ঘোড়ায় করে সেই শৈলশিরায় চলে এল ওরা, যেখান থেকে হারিয়েছে ইউনিকর্ন। মাটিতে নিজের বুটের আর ঘোড়াটার খুরের ছাপ দেখা গেল। গর্তের কিনারে যেখান থেকে লাফ দিয়েছে সেখানেও রয়েছে, কিন্তু তার পরে আর নেই। একেবারে যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে।
মুসা হলে এখন জিনভূতের কাজ বলেই চালিয়ে দিত, কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল রবিন।
নদীটা না থাকলে সত্যিই অবাক হতাম। নদীর কিনার দিয়ে হাঁটতে শুরু করল কিশোর। পানি খুব কম। এটাতে লাফিয়ে পড়ে পানিতে পানিতে হেঁটে চলে যাওয়াটা ওর মত ঘোড়ার পক্ষে একেবারে অসম্ভব নয়।
এই চালাকি একটা ঘোড়া করল? প্রশ্ন তুলল রবিন। তীরে উঠে আবার মুছে দিয়ে গেল সব চিহ্ন?
হোঁচট খেয়ে যেন দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। তাই তো! ভাল কথা বলেছ! এই কাজ মানুষ ছাড়া আর কারও পক্ষেই সম্ভব না!
এরপর ভালমত খুঁজতে শুরু করল ওরা। ঘোড়ার চিহ্ন যতটা না খুঁজল তার চেয়ে বেশি খুঁজল মানুষের চিহ্ন। নদীর পাড়ে উজান ভাটিতে বহুদূর পর্যন্ত দেখল। আশপাশের ঝোপ দেখল। কিছুই পাওয়া গেল না। কিছু না। কাপড়ের একটা ছেঁড়া টুকরোও না। কাটা ঝোপে লেগে নেই ঘোড়ার লোম। নদীর পাড়ের নরম মাটিতেও নেই কোন চিহ্ন।
ইউনিকর্নকে বোধহয় এতক্ষণে পেয়ে গেছে লুক, যেন কথার কথা বলল রবিন, গলায় জোর নেই।
কিছুই পেল না ওরা। হতাশ হয়ে ফিরে এল র্যাঞ্চে। রান্নাঘরে মুসা তো আছেই, লিলিও আছে। গলা শুকিয়ে গেছে। দুই গ্লাস সোডা নিয়ে বসল কিশোর আর রবিন। লিলিও সঙ্গ দিল ওদেরকে। একথা সেকথা থেকে চলে এল রোডিও খেলার কথায়। রোডিও রাইডিঙের আশ্চর্য রোমাঞ্চকর সব গল্প লিলির মুখে শুনতে লাগল তিন গোয়েন্দা।
খাইছে! দারুণ খেলা তো! মুসা বলল, আমারও খেলতে ইচ্ছে করছে!
শুনতে যতটা মজা লাগছে, রবিন বলল, নিশ্চয়ই ততটা নয়। খুব কঠিন খেলা।
আসলে এগুলো একেক জনের কাছে একেক রকম। নেশার মত। নইলে এর চেয়ে বিপজ্জনক খেলা খেলে না লোকে? মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও খেলে।
জানালার বাইরে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। আস্তাবলের কাছে দেখা যাচ্ছে লুক। আর জনকে। ইউনিকর্ন নেই ওদের সঙ্গে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে লিলিও তাকাল। তার ঘোড়ার লাগামটা জনের হাতে দিয়ে হাঁটতে শুরু করল লুক।
রান্নাঘরের দরজা ঠেলে ফোরম্যান ঢুকতেই লিলি বলল, তাহলে পাওয়া যায়নি ওকে? রেসের ঘোড়া
নাহ! বুঝতেই পারছি না কোথায় গেল! রুমাল বের করে ভুরুতে লেগে থাকা ঘাম আর ধুলো মুছল লুক। রোদে শুকিয়ে গেছে চামড়া। কিশোরের দিকে তাকিয়ে বলল, আর তো খুঁজতে যাওয়ার চেষ্টা করবে না, নাকি? বুঝতেই পারছ এসব তোমাদের কাজ নয়। নদীর পাড়ে তোমার বুটের ছাপই মনে হয় দেখেছি, কাল রাতের…
ও আমাদের সাহায্য করতে চাইছে লুক, লিলি বলল। আমি সাহায্য। চেয়েছি। শেরিফের অফিসে গিয়েছিলে?
না। ফোনও করিনি।
ভুরু কুঁচকে ফেলল লিলি। কেন?
করে কোন লাভ হত না। বরং খারাপ হত। গুজব ছড়াত বেশি, অনেক বেশি লোকে জানত, বদনাম বেশি হত র্যাঞ্চের।
কিন্তু কারও চোখে পড়লে…।
আশপাশের সব র্যাঞ্চারদের খবর দিয়ে দিয়েছি। কাজ হলে ওদেরকে দিয়েই হবে। লিলির দিকে তাকিয়ে কোমল হলো লুকের দৃষ্টি। ভেব না। সব ঠিক হয়ে যাবে। ওকে পাবই আমরা।
পেলেই ভাল। কোলের ওপর রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে বলল লিলি।
.
ডিনার শেষে সেদিন ক্যানু রেসের জন্যে তৈরি হতে লাগল মেহমানেরা। এই সুযোগে আস্তাবলে গিয়ে একবার তদন্ত চালিয়ে আসা যায়, ভেবে খুশি হয়ে উঠল। কিশোর। সুর্য তখনও ডোবেনি। ইতিমধ্যেই কাজের গতি কমে এসেছে। শ্রমিকদের। কয়েকজন ছুটি নিয়ে শহরেও চলে গেছে। শান্ত হয়ে গেছে র্যাঞ্চ। মুসার কানে কানে বলল কিশোর, আমাকে কভার দাও।
কি করবে?
পাহারা দাও তুমি। কয়েক মিনিট লাগবে আমার। ইউনিকর্নের স্টলটায় ভাল করে দেখতে চাই একবার।
ছায়ার মত এসে নিঃশব্দে আস্তাবলটাতে ঢুকল কিশোর। ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল কয়েকটা ঘোড়া। ভেতরে আলো কম, কিন্তু বাতি জ্বালল না সে। বরং পকেট থেকে টর্চ বের করে জ্বালল।
আগের বার যেমন দেখেছিল তেমনি রয়েছে ইউনিকর্নের স্টল। কোন সূত্র নেই। সাবধানে সিমেন্টের মেঝেতে আলো ফেলে দেখতে লাগল সে। আলো ফেলল দেয়ালে, ঘরের আড়ায়। অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়ল না। বেরিয়ে এসে পাশের অন্য স্টলগুলোতে অনুসন্ধান চালাল। নাকি স্বরে ডাকল কয়েকটা ঘোড়া, নাল লাগান খুর ঠকল কঠিন মেঝেতে।
ঘড়ি দেখল কিশোর। পনের মিনিট পার করে দিয়েছে। বেরিয়ে যাওয়া দরকার, নইলে সে কোথায় গেল ভেবে সন্দেহ করে বসতে পারে কেউ।
ফেরার জন্যে ঘুরল কিশোর। হারিকেনের স্টলটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। অস্থির হয়ে আছে ঘোড়াটা। মাটিতে পা ঠুকছে রাগত ভঙ্গিতে।
ঘাড়ের কাছটায় শিরশির করে উঠল কিশোরের। রোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে। এরকম করছে কেন ঘোড়াটা? ওকে দেখে? নাকি অন্য কেউ আছে ভেতরে? টর্চ নিভিয়ে দিয়ে দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল সে। কান খাড়া করে রেখেছে।
বাঙ্কহাউসে হাসছে কেউ। খুর দিয়ে খড় সরাচ্ছে হারিকেন, মাঝে মাঝে নাকি ডাক ছাড়ছে মৃদু স্বরে। এছাড়া আর কিছু নেই। কাউকে দেখা গেল না আস্তাবলে।
কয়েক সেকেণ্ড পরে টর্চ জ্বালল কিশোর। আলো ফেলে তাকাল হারিকেনের স্টলের ভেতর। মাথার সঙ্গে কান লেপ্টে ফেলেছে ঘোড়াটা, বড় বড় করে ফেলেছে। নাকের ফুটো, পেছনে সরে গেছে যতটা সম্ভব। ওর মুখে আলো ফেলল কিশোর, তারপর পায়ে, আরও সরে যাওয়ার চেষ্টা করল হারিকেন।
পেছনে একটা শব্দ হলো। ধক করে উঠল কিশোরের বুক। ফিরে তাকাতে গেল। প্রচণ্ড আঘাত লাগল মাথায়। একই সময়ে খুলে যেতে লাগল স্টলের দরজা। চোখের সামনে হাজারটা তারা জ্বলে উঠল যেন তার।
ফিরে তাকাল সে। মুখে এসে লাগল রুপার বালসওয়ালা একটা বেল্টের বাড়ি। লাফিয়ে পাশে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেও আঘাতটা এড়াতে পারল না।
বেহুশ হয়ে স্টলের ভোলা দরজা দিয়ে ভেতরে পড়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে দেখতে পেল, পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হয়ে উঠছে ঘোড়াটা। প্রবল। বেগে সামনের দুই পা নামিয়ে আনবে হয়ত তার ওপর, খুর দিয়ে গেঁথে ফেলবে পেট, বুক। কিন্তু কিছুই করার নেই তার।