খানিকক্ষণ শুয়ে থেকে ভাল করে দম নিল হরি। তারপর ধীরে-ধীরে উঠে বসল। অদূরে একটা গাছের গোড়ায় টুলুর রোগা শরীরটা নেতিয়ে পড়ে আছে।
হরি গিয়ে টুলুকে নাড়া দিয়ে ডাকল, “এই টুলু, টুলু, তোমার কি খুব লেগেছে?”
টুবলুও ধীরে ধীরে উঠে বসল। মুখে ক্লিষ্ট একটু হাসি। বলল, “লেগেছে তো ভাই খুব। মুখে একটা ঘুসি মেরেছিল জোর। কিন্তু আরও সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড হতে পারত। পাগলা-সাহেবের জন্য বেঁচে গেছি।”
গায়ের ধুলো ঝেড়ে দু’জনে উঠে দাঁড়ানোর পর হরি জিজ্ঞেস করল, “এই পাগলা-সাহেব কে বলো তো!”
টুলু মাথা নেড়ে বলল, “জানি না।”
“লোকটা মানুষ, না ভূত?”
“তাও জানি না। শুধু জানি, মাঝে-মাঝে পাগলা-সাহেব দেখা দেয়।”
“তা হলে আর-একটা কথার জবাব দাও। পাগলা-সাহেবের কবর বলতে এখানে কিছু আছে কি?”
টুবলু মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক বলতে পারব না। তবে শুনেছি, এরকম নামের একটা কবর কোথাও আছে। তবে সেটা কোথায় তা কেউ জানে না।”
“সেই কবরের কোনও মাহাত্ম্য আছে কি?”
টুলু মাথা নেড়ে বলল, “জানি না। তবে শুনেছি, কবর থেকে পাগলা-সাহেবের কফিনটা যদি কেউ তুলে ফেলতে পারে তবে আর মোতিগঞ্জে পাগলা-সাহেবকে কখনও দেখা যাবে না। আর…”
টুবলু হঠাৎ চুপ করে যাওয়ায় হরি বলল, “আর কী?”
“পাগলা-সাহেবের গলায় একটা মুক্তো বসানো সোনার ক্রস আছে। সেটার দাম লাখ-লাখ টাকা।”
হরি একটু চুপ করে থেকে বলল, “তাই বলো।”
টুবলু মুখের রক্ত হাতের পিঠে মুছে নিয়ে বলল, “তোমার খুব লাগেনি তো!”
“না। মাস্টারমশাইদের বেত খেয়ে-খেয়ে আমার হাড় পেকে গেছে। শোনো, তোমাকে আর আমার সঙ্গে যেতে হবে না। তুমি বাড়ি ফিরে যাও। এটুকু আমি একাই যেতে পারব।”
টুবলু বলল, “আচ্ছা।” তারপর দুজনে দুজনের কাছে বিদায় নিল।
বাড়ি ফিরে এসে হরি হাতমুখ ধুয়ে ব্যথার জায়গায় একটু মলম ঘষল। বাঁ কাঁধটা ফুলে শক্ত হয়ে উঠেছে। কোমরটাও টনটন করছে। কিন্তু প্রবল মানসিক উত্তেজনায় সে শরীরের ব্যথা তেমন টের পাচ্ছিল না।
পড়তে বসেও সে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। কানে বাজছিল ঘোড়ার পায়ের সেই টগবগ শব্দ। কে পাগলা-সাহেব? কোথা থেকে উঠে আসে? কোথায় চলে যায়?
হঠাৎ খুব কাছ থেকে কে যেন বলে উঠল, “খুব ঠ্যাঙানি খেলে আজ যা হোক! ওঃ, তবু অল্পের ওপর দিয়ে গেছে!”
হরি একটু চমকে উঠে চারদিকে তাকাল। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল। জানালা ফাঁকা, আশেপাশে জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই। অথচ পটল দাস। যে ভূত নয় তা সে জানে। অথচ গলাটা পটল দাসেরই।
“পটলদা? তুমি কোথায়? অদৃশ্য-ফদৃশ্য হয়ে যাওনি তো?”
“চারদিকে চোখ রাখতে হয় রে ভাই, চারদিকে চোখ রাখতে হয়।”
হরির এবার আর ভুল হল না। পটলের গলার স্বর শোনা যাচ্ছে ঘরের ভিতরেই, তবে ছাদের কাছ থেকে। দেওয়ালে যে বিশাল অয়েলপেন্টিংটা ছিল সেটা আধখানা সরানো। তার পিছনে একটা চৌকো ফোকর। পটল দাস সেই ফোকর দিয়ে মুখ বের করে খুব হাসছে।
ছবির পিছনে যে একটা ফোকর থাকতে পারে, সে-ধারণাও হরির ছিল। সে ডিটেকটিভ বইটইও বিশেষ পড়েনি যে, এসব কল্পনা করবে। তাই সে খুবই অবাক হয়ে গেল। বলল, “তুমি ওখানে উঠলে কী করে?”
পটল দাস বুড়ো মানুষ। কিন্তু ওই উপর থেকে অনায়াসে বেড়ালের মতো একটা লাফ মেরে মেঝেয় নেমে এল। আশ্চর্যের বিষয়, কোনও শব্দও হল না। নেমে ঘরের কোণ থেকে একটা ঝুলঝাড়ুনি নিয়ে ছবিটা আবার যথাস্থানে ঠেলে ফোকরটা ঢেকে দিল।
তারপর হরির দিকে চেয়ে বলল, “এসব পুরনো আমলের বাড়িতে কত সুড়ঙ্গ, পাতালঘর আর গুপ্ত কুঠুরি যে আছে, তার হিসেব নেই। তা আমিও পটল দাস। লোকে যে আমাকে আদর করে ইঁদুর বলে ডাকত, সেটা তো আর এমনি নয়। সব গর্ত, সব ফোকরের খবর রাখি। ওই ফোকর দিয়ে কতবার এবাড়িতে ঢুকেছি।”
“টুকে কী করো?”
পটল দাস একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নেড়ে বলল, “কিছু না রে ভাই, চুরিটুরি আমি ছেড়ে দিয়েছি। শুধু অভ্যাসটা বজায় রাখা। একটু ব্যায়ামও হয়।”
“ওই অত ওপর থেকে লাফ দিয়ে নামলে, তোমার ব্যথা লাগল না?”
“পাগল নাকি। বায়ুবন্ধন করে নিয়েছিলুম না! একবার কুঞ্জবাবু রাগ করে তিনতলার ছাদ থেকে পাঁজাকোলে তুলে ফেলে দিয়েছিল আমাকে। বুঝলে? তা গায়ে আঁচড়টিও লাগেনি। পড়েই ফের ছাদে গিয়ে কুঞ্জবাবুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললুম, ‘কাজটা মোটেই ঠিক করেননি মশাই, ওরকমভাবে ফেলে দিলে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে। কিন্তু কুঞ্জবাবু ভাবলে, আমি ভূত, তিনতলা থেকে পড়ে অক্কা পেয়ে ভূত হয়ে শোধ নিতে এসেছি। তাই আমাকে দেখে গোঁগোঁ করে সেই যে অজ্ঞান হলেন, জ্ঞান ফিরল সাতদিন পরে।”
“আমাকে যখন আজ ছেলেগুলো মারছিল তখন তুমি কোথায় ছিলে?”
পটল দাস একটু হেসে বলল, “কাছেপিঠেই ছিলুম। আজকাল সব পুরনো দিনের কথা খুব মনে পড়ে কিনা। ওই যে কুঞ্জবাবুর কথা বললুম, আজ সেই তেনাদেরই তিনতলার ছাদে বসেবসে পুরনো কথা ভাবছিলুম। কুঞ্জবাবু কবে মরে গেছেন, বাড়িটা চামচিকে আর বাদুড়ের বাসা। ছাদে ঘুরে-ঘুরে পুরনো কথা ভেবে মনটা খারাপ লাগছিল।”
“তা হলে সবই দেখেছ?”
“দেখলুম। তবে অল্পের ওপর দিয়ে গেছে।”
হরি এবার নড়েচড়ে বসে বলল, “অল্পের ওপর দিয়ে গেল কেন বলল তো? ছেলেগুলো আমাকে আর টুবলুকে ছেড়ে হঠাৎ পালিয়ে গেল কেন? ঘোড়ায় চড়ে কে এসেছিল তখন?”
পটল দাসের মুখোনা কেমন যেন তোম্বা হয়ে গেল। মাথা নেড়ে বলল, “ঘোড়া! না তো, সেরকম কিছু দেখিনি।”
“চেপে যাচ্ছ পটলদা? তুমি সব জানো।”
“কী দেখব? বলেছি না, চোখে ছানি। প্যালারাম কাটিয়ে দেবে বলেছে। তারপর নাকি আবার সব দেখতে পাব আগের মতো।”
“তা হলে আমার মার খাওয়াটা দেখলে কী করে?”
পটল দাস বিরক্ত হয়ে বলল, “তোমার সঙ্গে কথা বলাটাই বাপু, বড় ভজকট ব্যাপার। ডাক্তারের ছেলে হয়ে যে কেন উকিলের ছেলের মতো জেরা করো।”
হরি হেসে ফেলল। বলল, “পাগলা-সাহেবের কথাটা তা হলে স্বীকার করবে না?”
পটল দাস তাড়াতাড়ি ডান কানে একটা আঙুল ভরে নাড়া দিতে দিতে বলল, “ওই দ্যাখো, সেই শ্যামাপোকাটা ফের কুটকুট করে কামড়াতে লেগেছে। তা ওরা তোমাকে ধরেছিল কেন বলো তো! কী চায় ওরা?”
“সেইটেই তো বুঝতে পারছি না। দু’দিনই ওরা আমাকে ধরল গোপালের খবর জানবার জন্য। গোপাল আমাকে কী বলেছে না বলেছে এইসব। কিন্তু আমাকে কেন ধরে বলো তো! গোপালের খবর তো গোপালের কাছ থেকেই নিতে পারে। আমি গোপালের কী জানি।”
পটল দাস বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল, “সেইটেই তো কথা। তবে কিনা তোমার কপালে আরও কষ্ট আছে।”
হরি চোখ বড় বড় করে বলল, “কেন পটলদা, আমি কী করেছি?”
“তেমন কিছু করোনি বটে, কিন্তু এই বাড়িতে যে এসে জুটেছ, এইটেই অনেকে ভাল চোখে দেখছে না। এই বাড়ির ওপর অনেকের নজর আছে। তার ওপর গোপাল হঠাৎ আলটপকা তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলল কেন, সেটাও ভাববার কথা।”
হরি অবাক গলায় বলল, “এবাড়িতে আছি বলেই বা কী দোষ হয়েছে, আর গোপাল আমার বন্ধু বলেই বা কী অন্যায়টা হল, আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।”
পটল দাস খুব বিজ্ঞের মতো হেসে বলল, “এই মোতিগঞ্জে ষাট-সত্তরটা বছর কাটিয়ে মাথার চুল পাকিয়ে ফেললুম, তবু আমিই এখনও কত কথা বুঝতে পারি না, আর তুমি তিনদিনের ছোঁকরা, সব বুঝে ফেলবে? মোতিগঞ্জ জায়গাটা অত সোজা নয় রে বাপু। এখানে খুব হিসেব কষে থাকতে হয়। এমনিতে বাইরে থেকে দেখে মনে হবে বুঝি বেশ নিরিবিলি, নির্ঝঞ্ঝাট, ঠাণ্ডা, সুন্দর একখানা শহর। কিন্তু যত এখানে থাকবে তত বুঝবে যে, এখানে চারদিকে খুব শক্ত-শক্ত আঁক।”
“আঁক? সে আবার কী?”
“আঁক বোঝো না? আঁক মানে অঙ্ক আর কি। আঁক যেমন শক্ত, এখানে প্রতিটি ব্যাপারই তেমনি শক্ত। চট করে সব বোঝা যায় না। কেন যে কী হয়, তা খুব ভেবেচিন্তে বার করতে হবে। তোমার ব্যাপারটা নিয়েও ভেবে-ভেবে একটা কিছু বের করে ফেলব’খন। তবে দুখিরামবাবু এবাড়িটা কিনে ভাল কাজ করেননি।”
“কেন। এ বাড়ি কিনে খারাপ কী হয়েছে?”
“বললুম না এবাড়িটার ওপর অনেকের নজর আছে।”
“দুখিরামবাবু বাড়িটা কেনার আগে তো বাড়িটা এমনিই পড়ে ছিল। তখন নজর ছিল না?”
পটল দাস মাথা চুলকে বলল, “না, তখন ছিল না। এই হালে নজরটা খুব পড়েছে। আর তারা তোক সুবিধের বলেও মনে হচ্ছে না।”
“তুমি আমাকে ভয় দেখাতে চাইছ না তো পটলদা?”
পটল মাথা নেড়ে বলল, “না রে বাপু, তোমাকে ভয় দেখানো ছাড়া কি আমার কাজ নেই। লোকগুলো মোতিগঞ্জের নয়। বাইরের লোক। তারা এখানে ইতিউতি কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওই ‘কুসুমকুঞ্জ’ আর এই ‘গ্রিন ভ্যালি’–এই দু’খানা বাড়ির ওপরেই নজর।”
“তারা কী খুঁজছে পটলদা? পাগলা-সাহেবের কবর নয় তো!”
“রাম রাম, কী যে সব বলো না! ও সব মুখে উচ্চারণও করতে নেই।”
“আমি জানি পটলদা। পাগলা-সাহেবের গলায় একটা দামি ক্রস আছে। আর পাগলা-সাহেবকে কবর থেকে তুলতে পারলেই তাকে আর মোতিগঞ্জে দেখা যাবে না।”
পটল দাস জুলজুল করে কিছুক্ষণ হরির মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, “টুবলু ছোঁড়াটা মহা পাজি। তুমি বাইরের লোক, খামোখা তোমাকে অত কথা বলে দিয়ে বিপদে ফেলা হল। না জেনেই ভাল ছিল।”
হরি কাকুতি-মিনতি করতে লাগল, “খানিকটা যখন জেনেই ফেলেছি পটলদা, তখন পুরোটাই আমাকে জানিয়ে দাও। পাগলা-সাহেবের কবর কোথায়, তা কি তুমি জানো?”
পটল দাস একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়ল, “না রে ভাই, কেউই জানে না। ‘মেঠো ইঁদুর’ বলে সবাই আমাকে ডাকে, তবু আমিও আজ অবধি হদিস করতে পারিনি। অনেক খুঁজেছি।”
“তুমি পাগলা-সাহেবকে দেখেছ কখনও? জ্যান্ত অবস্থায়?”
“জ্যান্ত দেখিনি। পাগলা-সাহেব মরেছে বোধহয় সত্তর-আশি বছর আগে। কোন বাড়িতে যে সে থাকত তাও কেউ নিশ্চয় করে বলতে পারে না। সে মারা যাওয়ার পর তার বিশ্বাসী কয়েকজন চাকর তাকে গোপনে কোথাও কবর দিয়ে দেয়। সে কবরেরও হদিস নেই। তবে ইদানীং পাগলা-সাহেব সম্পর্কে কোন খবরের কাগজে নাকি কী একটা গপ্পো বেরিয়েছে। তারপর থেকে নানারকম খোঁজখবর হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, কুসুমকুঞ্জ আর গ্রিন ভ্যালি, এই দুটো বাড়ি নিয়েই নাকি পাগলা-সাহেব থাকত। গ্রিন ভ্যালিতে থাকত তার চাকরবাকর, খানসামা, বাবুর্চিরা; আর সে নিজে থাকত কুসুমকুঞ্জে। সত্যি-মিথ্যে জানি না। সেই গল্পে আরও লিখেছ যে, পাগলা-সাহেবের গলায় যিশুবাবার যে মাদুলি আছে, তার নাকি লাখ-লাখ টাকা দাম।”
“তুমি কি সেই গল্প শুনেই কবরটা খুঁজতে লেগেছ?”
তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে পটল বলল, “না রে বাবা, না; এ-গল্প আমরা ছেলেবলা থেকেই শুনে আসছি। মোতিগঞ্জের লোকেরা আর যা-ই করুক, পাগলা-সাহেবের কবরে হাত দেবে না। বারণ আছে। সাহেব মোতিগঞ্জের লোকদের জন্য করেছেও অনেক। গরিব-গুবোদের খুব দেখত, চোর গুণ্ডা বদমাসদের ঢিট রাখত, তার ভয়ে গোটা মোতিগঞ্জে কোনও অশান্তি ছিল না। নিজে ছিল সাধু প্রকৃতির। দুটো কয়লাখনি আর একটা মস্ত কাঠের কারবার ছিল তার। দেদার টাকা রোজগার করত, আর দু’হাতে বিলিয়ে দিত। মরলও মানুষের ভাল করতে গিয়ে। একদিন একটা উটকো লোক এসে সাহেবের পায়ের ওপর পড়ে বলল, “হুঁজুর, গাঁয়ের লোকেরা আমার ঘরদোর জ্বালিয়ে দিয়েছে, বউবাচ্চা সব মেরে ফেলেছে, আপনি বিহিত করুন। আমি ছোট জাত, চাষবাস করে গতরে খেটে অবস্থা একটু ফিরিয়েছি দেখে গাঁয়ের লোকের চোখ টাটাচ্ছে।’ সাহেব দুর্বলের ওপর অত্যাচার সইতে পারত না। শুনেই ঘোড়ায় চেপে রওনা হয়ে গেল একা। তা বেশিদূর যেতে হয়নি। শহরের পুব দিকে মস্ত জংলা জমিটায় পড়তেই প্রায় বিশজন লোক সাহেবকে সড়কি বল্লম আর তীর মেরে ঝাঁঝরা করে দিল। চাকরেরা একটু দেরিতে খবর পেয়ে যখন দৌড়ে গেল, তখনও ডাকাতেরা সাহেবের গলা থেকে যিশুবাবার মাদুলিটা খুলে নিতে পারেনি। তাড়া খেয়ে তারা পালিয়ে যায়। চাকরেরা সাহেবকে নিয়ে এসে গোপনে কবর দিয়ে দেয়।”
“গোপনে কেন?”
“কে জানে কেন। তবে সাহেব নাকি তার চাকরদের বলেই রেখেছিল, হঠাৎ তার মরণ হলে এমন জায়গায় যেন কবর দেওয়া হয়, যা কেউ খুঁজে পাবে না।”
“সেই চাকরেরা কোথায় গেল?”
“তা-ও কেউ জানে না। সাহেব মারা যাওয়ার পরদিন থেকেই সব ভোঁভাঁ। পুরনো লোকরা বলে, সাহেব নাকি তাদের বলে রেখেছিল, তিনি মারা যাওয়ার পরেই যেন সকলে গায়েব হয়ে যায়। তা লোকগুলো সাহেবকে একেবারে দেবতুল্য ভক্তি করত। তার কথায় উঠত বসত। সাহেবের আদেশও তারা অক্ষরে-অক্ষরে পালন করে গেছে।”
“কিন্তু একটা কথা পটলদা। সাহেব তো শুনি এখনও যখন-তখন দেখা দেয় আর লোককে বিপদ থেকে বাঁচায়। আজ আমাকেও বাঁচিয়েছে। তা নিজের কবরটা কি সাহেব আর বাঁচাতে পারে না? দুশমনদের তো সাহেব নিজেই তাড়িয়ে দিতে পারে।”
“সেও আর-এক গল্প। মাঘ মাসের শেষ দিকটায় যে-দিনে সাহেব খুন হয়, সেই দিনটায় সাহেব নাকি কবর থেকে বেরোয় না। শুয়ে-শুয়ে মানুষের অকৃতজ্ঞতার কথা ভেবে কাঁদে। সেই দিনটায় যদি কেউ কবর খুঁড়ে তাকে বের করতে পারে তো সাহবকে আর কখনও দুনিয়ায় দেখা যাবে না। সাহেব বলেই গেছে, অচেনা লোক তার কবর ছুঁলে তার আত্মা বহুদূর চলে যাবে, সেই দিনটা পড়বে সামনের অমাবস্যায়। আর সাতদিন বাকি।”
“তা থাক না। ভূত কি ভাল?”
পটল দাস মাথা নেড়ে বলল, “ভূত হোক যা-ই হোক, মোতিগঞ্জের লোক পাগলা-সাহেবকে বড় ভালবাসে। আমরা মোতিগঞ্জের লোকেরা তার কবরটা খুঁজছি কেন জানো? যাতে আমাদের আগে অন্য কোনও বদমাস তা খুঁজে না পায়। আমরা খুঁজে পেলে সেই কবরের চারধারে শক্ত পাহারা বসাব।”
“কী করে খুঁজে পাবে? কোনও চিহ্ন আছে?”
“আছে। তবে সে-সব আর জানতে চেও না। বিপদে পড়বে।”
এ-সব কথা বিশ্বাস করবে কি না, তা নিয়ে একটু দ্বিধায় পড়ল হরি। সে কী একটা বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ পটল দাস ক্রুদ্ধ একটা চাপা গর্জন করে জানালার দিক ছুটে গেল!
চমকে উঠে হরি বলল, “কী হল পটলদা?”
পটল জানালার ওপর ঝুঁকে বাইরে কী দেখতে লাগল। জবাব দিল। তারপর মুখটা ফিরিয়ে চাপা গলায় বলল, “তুমি একটি নষ্টচন্দ্র।”
“তার মানে?”
“তখন থেকে নানা কথায় ভুলিয়ে আমার পেট থেকে কথা বের করছ। আর আমারও বুড়ো বয়সে এখন বকবকানিতে পেয়েছে। হুট বলতে যার-তার সঙ্গে বকবক করতে লাগি।”
“তাতে কী হয়েছে?”
“হবে আবার কী? কোন নচ্ছার যেন জানালায় দাঁড়িয়ে আড়ি পেতে আমাদের কথা শুনছিল।”
হরি একটু সিটিয়ে গেল।
পটল দাস মাথা নেড়ে বলল, “গতিক খুব সুবিধের নয় রে বাপু। গোপালটাকে মারল, তোমাদের ওপর হামলা হল, গতিক আমার ভাল ঠেকছে না।”
হরি এবার একটু রাগ করে বলল, “তোমাদের পাগলা-সাহেব তো খুব বীর। কাল রাতে যখন গোপালকে ওরা মারল, তখন তাকে বাঁচাতে আসেনি কেন?”
পটল দাস হরির দিকে কুতকুত করে চেয়ে থেকে বলল, “না বাঁচালে গোপাল বেঁচে আছে কী করে? যারা ইট মেরেছিল, তারা কি সোজা লোক? অল্পে ছেড়ে দিত নাকি ভেবেছ? গোপালের মতো ডাকাবুকো ছেলেকে নাগালে পেলে খুন করে ফেললেই তাদের সুবিধে। করতে যে পারেনি, সে ওই পাগলা-সাহেবের জন্যই।”
“কিন্তু ইটের ঘা-ই বা খেল কেন?”
“অত আমি জানি না। তবে যিশুবাবার যেমন অনেক ক্ষমতা, তেমনি শয়তানেরও অনেক ক্ষমতা। এই ধরো না মোতিগঞ্জের দারোগাসাহেবের ক্ষমতা তো কিছু কম নয়। কিন্তু তবু এই পটল দাসের মতো লোকও তো এখানে বেঁচে-বর্তে করে-কম্মে খাচ্ছে। ক্ষমতা পটল দাসেরও তো কিছু আছে।”
“তা বটে।”
“এও তাই। মোতিগঞ্জের লোকেদেরও ঘরে চুরি হয়, তারা হোঁচট খায়, অপঘাত হয়, মারদাঙ্গা গুণ্ডামি-ষণ্ডামিও মেলা আছে। পাগলা-সাহেব কি সব কিছুতে গিয়ে জোটে? তবে মাঝে-মাঝে দেখা দেয় বটে। সে তার ইচ্ছেমতো। কখন কবর থেকে বেরিয়ে আসবে, তার কিছু ঠিক নেই। লোকটা পাগলা ছিল তো। কিন্তু মেলা কথা হয়ে গেছে। আর নয়। ঝুমরি তোমার ভাত নিয়ে এল বলে। রাতও হয়েছে।”
“কিন্তু গল্পটা যে আমার আরও শুনতে ইচ্ছে করছে!”
“ওরে বাবা! এ গল্প শুনতে বসলে রাতের পর রাত কাবার হয়ে যাবে, তবু শেষ হবে না। আমার খিদেও পেয়ে গেছে খুব। প্যালারামের মা আজ ফুলকপি দিয়ে জব্বর খিচুড়ি রাঁধছে দেখে এসেছি। জুড়িয়ে গেলে খিচুড়িতে আর গোবরে তফাত নেই।”
এই বলে পটল দাস দরজা খুলে সাঁত করে বাইরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
আর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ঝুমরি তার খাবার নিয়ে ঢুকল ঘরে।