৬. কুয়াশা চারদিকে

০৬.

 ভোর সাড়ে ছটা, ধীরে ধীরে আলো ফুটছে আকাশে। কুয়াশা চারদিকে। ওয়ারদিংটন বসে আছে একটি চ্যাটালো পাথরের উপর। ওর সমস্ত শরীর জমে গেছে ঠাণ্ডায়। গারল্যান্ডকে ও এখনো মনে মনে গালি দিয়ে চলেছে। ওর রাগ আরো বাড়ছে গারল্যান্ডের প্রতি মালার আকর্ষণ দেখে। গারল্যান্ড যেন এক দেবতা মালার কাছে।

সবাই ঘুমোচ্ছে তাই কেবিনে কোনো সাড়া শব্দ নেই। আবার ভয় ঘনিয়ে এল ওয়ারদিংটনের মনে। সৈন্যরা আসবে একটু পরে। তন্নতন্ন করে খুঁজবে তারা পাহাড়গুলি। ও যেন অভিভূত হয়ে পড়ল একথা মনে পড়তেই। সে পথ বন্ধ, ও যে আত্মহত্যা করবে। এখন গারল্যান্ডের কাছে ওর পিস্তলের গুলি।

গাছের মাথার ওপর দিয়ে আসছে একটি হেলিকপ্টার আকাশ ফাটানো শব্দ করে। লাফিয়ে উঠল ওয়ারদিংটন। অন্যদিক থেকে আরেকটি হেলিকপ্টার আসছে সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে। ও দৌড়তে লাগল কেবিনের দিকে। গারল্যান্ড ওইয়ান দাঁড়িয়ে রয়েছে কেবিনের দরজায়। গারল্যান্ড চেঁচাচ্ছে, জলদি লুকোও, ভেতরে এস। কেবিনের ভেতর দৌড়ে ঢুকল ওয়ারদিংটন। কেবিনের কাছে একটি গাছের নীচে দাঁড়াল গারল্যান্ড এবং ইয়ান। ওদের দিকেই আসছে সোজা একটি হেলিকপ্টার।

গারল্যান্ড বলল, ওরা কাজে নেমেছে পুরোপুরি তৈরী হয়ে।

কেবিনটা গাছের আড়ালে আমাদের দেখতে পাবে না ওরা। তবে ধরে ফেলবে একটু নড়াচড়া করলেই।

হেলিকপ্টার চলে গেল ওদের গাছের ঠিক ওপর দিয়ে। নিশ্চল দাঁড়িয়ে ওরা। দূরে মিলিয়ে গেল একটু বাদে হেলিকপ্টারের শব্দ। কেবিনে ফিরে এল ওরা। প্রাতরাশ করছে মালা ও ব্লাঙ্কা। রাকা শান্ত এবং নিরুদ্বিগ্ন সন্ত্রস্ত। গারল্যান্ডের কাছে এসে মালা বলল, আমরা পালাতে পারব বলে মনে হয়।

খুব কঠিন হলেও, নিশ্চয়ই পারব। দিনে গা ঢাকা দিয়ে থাকব আমরা এবং রাতেই এখন থেকে শুধু চলাফেরা করব। তোমার কোনো ভয় নেই আমি থাকতে।

গারল্যান্ড চোখ মটকে হেসে ইয়ানের কাছে গেল ওয়ারদিংটনের অগ্নিদৃষ্টি দেখে। দরজায় দাঁড়িয়ে ইয়ান। বলল, তিনটে হেলিকপ্টার এবার।

গারল্যান্ড বলল, নিবিয়ে ফেলাই ভালো আগুনটা। ধোঁয়া তেমন উঠছেনা বটে, যা নিচ দিয়ে যাচ্ছে ওরা, তাতে মনে হয় ধরে ফেলতে পারে।

প্রাতরাশ তৈরী বলে প্লেট এবং কফির পেয়ালা নিয়ে বসে গেল। হেলিকপ্টার গর্জন করে উড়ে চলে গেল হঠাৎ প্রায় কেবিনের ছাদ ছুঁয়ে। চেঁচিয়ে উঠতে গেল মালা। হাতের খাবার প্লেট নামিয়ে রাখল ওয়ারদিংটন ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে।

ধীর গলায় বলল ইয়ান, ওরা নিয়মমতো ফ্লাই করছে ভয় নেই। ঘুরে আসবেই না হয়তো আর এ পথে।

ওয়ারদিংটনের গলা ভেঙে গেল ভয়ে, জানলে কি করে। পড়ে গেছি তো আমরা ফাঁদে, পালানো দরকার এখনি।

শান্ত মৃদু গলায় বলল গারল্যান্ড, ওরা হয়তো ভয় দেখাতে চাইছে হেলিকপ্টার দিয়ে, সৃষ্টি করছে মানকি চাপ। কোনো পথ খোলা নেই আমাদের পালাবার। ঘাবড়িও না। আমি দেখে আসি বাইরে একটা টহল মেরে কি হচ্ছে, তুমিও চল না। থাকুক না ওরা এখানে।

ওয়ারদিংটনের কাপুরুষতা দেখে দাই বিরক্ত হয়েছে এটা যেমন ওয়ারদিংটন বুঝল তেমনি মালাও। নিজেকে বশে আনল জোর করে এবং তারপর বেরোল গারল্যান্ডের সঙ্গে। একটি মালভূমি থেকে উত্রাই নেমে ওরা পৌঁছল আরেকটি মালভূমিতে। হেলিকপ্টারগুলি ঘুরছে আর ঘুরছে গাছের আড়াল দিয়ে। গারল্যান্ড সচকিত হল ইয়ানের খামার বাড়ি দেখে। লরি আর সশস্ত্র সৈন্য সেখানে গিজ গিজ করছে। গারল্যান্ডের একটু মমতা হল ওয়ারদিংটনের ভয় দেখে। নিজে সিগারেট ধরাল ওকে দিয়ে। হাত কাঁপছে ওয়ারদিংটনের।

হেলিকপ্টার আবার। গাছের নিচে শুয়ে পড়ল চিত হয়ে দুজনে। তুমি যে কি ভাবছ আমি তা জানি। ওয়ারদিংটন বলল, আমি ভীতু কাপুরুষ, আমি জানি। আমি কোনোদিন গুপ্তচর হতাম না যদি আমার টাকার দরকার না থাকত। এ অতি সহজ কাজ বলে আমার মনে হয়েছিল প্রথমে। নানা রকম কথা বলতে আমাদের ছাত্ররা। আমি ডোরীকে জানাতাম দরকারী খবরগুলো। বহুৎ টাকাও জমিয়েছিলাম। আমার ভাগ্যে নেই বোধহয় টাকা খরচ করা।

সেটা ভাবছ কেন, খুব সাবধানে যদিও কাজ সারতে হবে, তবে আমরা পালাবই।

আমি বাঁচব না, পালাতে পারব না বলে আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে। একটা উপকার আমার কর শোনো, আমার ষাট হাজার ডলার আছে জেনিভার ক্রেডিট সুইস ব্যাঙ্কে। মালার নামে রেখেছি আমি ওটা। ওই মালা বলে ও গিয়ে শুধু প্রমাণ দেবে। খবরটা দিও ওকে।

নিজেই বল তুমি।

হয়তো রাজী হবে না ও কারণ আমায় ও তেমন ভালবাসে না। ওর জগতে আমার কোনো অস্তিত্বই নেই। ও লজ্জা পেতে পারে বেঁচে থাকতে টাকাটা নিতে। কোনো প্রশ্ন থাকবে না মরে গেলে তখন ধন্যবাদ দেবার। ও খুশিই হবে তখন টাকাটা পেলে। উত্তর দিকে যাচ্ছে সৈন্যবোঝাই ট্রাক, তা দেখে ও বলল, ওরা আমাদের ঘেরাও করছে, জায়গাটা আমি চিনি।

 গারল্যান্ড দেখল, একটি হেলিকপ্টার নামছে ওদের থেকে বিশ কিলোমিটার খানেক দূরে। ও বলল, হেলিকপ্টার নামল কোথায়, চেনতো তুমি ঐ অঞ্চলটা।

একটা বড় মাঠে যা রয়েছে গাছগুলোর পিছনে।

 ফেরা যাক চল।

.

বেজায় খুশি স্মেরনফ। এখন সাতটা বাজতে সাত। ওর কোনো অসুবিধা হচ্ছে না যদিও রাতে ঘুম হয়নি। ওর ঘুমের দরকার হয় না শিকারের সময়। কাজ হয়েছে ওর প্ল্যান অনুযায়ী। সৈন্য দিয়ে এলাকাটি ঘেরাও ভোর ছটা থেকেই। আশ্চর্য তৎপরতায় সম্পন্ন করেছে কুলান ওর দায়িত্ব। তিরিশ কিলোমিটার এলাকা ঘেরাও খামারবাড়ি ঘিরে। ধরা পড়বে ওরা ঠিক সময়েই।

স্মেরনফ নিজে হেলিকপ্টারে বসে এলাকাটা দেখবে সেটাই ভাবল একবার।

|||||||||| একটি হেলিকপ্টারে পেট্রল ভরা হচ্ছে কারণ সেটি নেমেছে। পাশে দাঁড়িয়ে পাইলট লেফটেনান্ট বুড়োভেক। বুড়োভেক স্যালুট করল স্মেরনফকে দেখে।

স্মেরনফ বলল, আছে কোনো খবর?

 কোনো খবর নেই কমরেড। তবে দেখা হয়ে গেছে এদিকটা, তাই এবার যাব ওদিকে।

দেখনি কিছু। ভেবেছিলাম ওরা পাহাড়ে পালাবে।

চোখ চলে না এত গাছপালার জন্য।

কিছুই দেখনি সন্দেহ জনক।

পাহাড়ে একটু ধোয়া দেখলাম বলে একবার মনে হল। চক্করও মারলাম দুবার। দেখিনি হয়তো একথা মনে হল পরে।

আবার দেখে আসি চল। একটি শক্তিশালী বাইনোকুলার পরে নিল স্মেরনফ হেলিকপ্টারে উঠে বসে। জায়গাটা তোমার ঠিক মনে আছে তো। কোথায় ধোঁয়া দেখেছ।

হ্যাঁ কমরেড।

উড়ে চলল হেলিকপ্টার।

.

গারল্যান্ড উল্টোদিকে একা এবং আরেকদিকে বসে রয়েছে চারজন। ও বলল, কাজ হতে পারে, মাথায় একটা ফন্দি এসেছে, হেলিকপ্টারগুলো নামছে এখান থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে। আমরা কজা করতে পারি ওখানে পৌঁছতে পারলে। চালাতে জানি আমি। সীমান্তের কাছাকাছি এর ফলে আমরা পৌঁছে যেতে পারি, যদি সীমান্ত পেরোতে না পারি। কী বল তোমরা।

ইয়ান বলল উত্তেজিত এবং উৎসাহিত হয়ে, নিশ্চয়, দুঘন্টার পথতো বিশ কিলোমিটার। উৎরাইয়ের পথ, চল যাই।

ওয়ারদিংটন বলল, আমি দেখেছি, সৈন্য গিজগিজ করছে জঙ্গলে।

ছটি বুলেট দিল ওয়ারদিংটনকে গারল্যান্ড ওর পকেট থেকে বের করে। বলল, দরকারে লড়তে যেতে হবে আমি জানি। বুলেট ভরে নিল পিস্তলে ওয়ারদিংটন এই কথা বলে।

ব্লাঙ্কা বলল, পাহারা থাকবে কিন্তু চারদিক হেলিকপ্টারে।

গারল্যান্ড বলল, চেষ্টা করে দেখতে হবে, পিস্তল আছে তো দুজনের কাছে।

মালা বলল, শোন।

কাছে আসছে একটি হেলিকপ্টার। কেবিনের ওপরে থেমে গেল কাছে এসে। সবাই ঘরে সন্ত্রস্ত। পাথর পাথর মুখ গারল্যান্ড ইয়ান এবং ব্লঙ্কার। স্মেরনফ কেবিনটি দেখল হেলিকপ্টার থেকে ঝুঁকে পড়ে। বুড়োভেককে আরো নীচে নামাতে বলল ও হেলিকপ্টারটিকে। হিংস্র হেসে বলল, ধরেছি বোধহয় ওদের। খামার বাড়িতে অপেক্ষা করছিল সুক। স্মেরনফ সুককে খবরটা দিল রেডিও টেলিফোনে। তারপর হেলিকপ্টার বুড়োভেককে চালাতে বলে বলল, ওখানেই গা ঢাকা দিয়েছে ওরা। লেফটেনান্ট আছে বটে তোমার চোখ, বাহাদুর সাবাস।

গারল্যান্ড হেলিকপ্টার সরে যেতেই বলল, আমাদের এখনি পালাতে হবে কারণ ওরা হদিশ পেয়ে গেছে।

ভয়ার্ত কণ্ঠে ওয়ারদিংটন বলল, আমরা ফাঁদে পড়েছি তোমায় বললাম না।

গারল্যান্ড হেসে বলল, এখনোতো গলায় ফাঁস চেপে বসেনি, সবে তো ফাঁদে পড়েছি, যাওয়া যাক চল। সেখানে চলে যাব, পাহাড়ের উত্রাই বেয়ে সোজা হেলিকপ্টার যেখানে নামছে। দুঘন্টা এখনো ওদের এখানে এসে পৌঁছতে। ইয়ান আমার কাছে কাছে থেকো, আমি থাকব আগে। তারপর থাকবে মেয়েরা এবং শেষে থাকবে ওয়ারদিংটন।

ওরা নামছে গাছের নীচে নীচে গা ঢাকা দিয়ে। উড়ছে তো উড়ছেই মাথার উপর হেলিকপ্টার ঘুরে ঘুরে। ওরা নীচের মালভূমিতে নামল। গারল্যান্ড এগিয়ে দেখল সন্তর্পনে। খামারবাড়ি থেকে সারে সারে ট্রাক আসতে আসতে থেমে গেল পাহাড়ের দিকে। পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরুকরল অটোমেটিক অস্ত্রে যারা সুসজ্জিত থাকে সেইসমস্ত সৈন্যরা অফিসারদের সঙ্গে। ইশারায় ডেকে বলল ওইয়ানকে, এসে পড়েছে ওরা। পথ করে নিতে হবে চলতে চলতে, লড়তে লড়তে। নিঃশব্দে করতে হবে। করতে পারবেতো? গারল্যান্ড বলল পিছন ফিরে, এগোলাম আমি এবং ইয়ান। তোমরা আসবে তিন মিনিট সবুর করে। অপেক্ষা করবে গোল বাধলে চুপ করে দাঁড়িয়ে। ওয়ারদিংটনকে বলল, আমাদের হদিশ ওরা পেয়ে যাবে গুলির শব্দে তাই একদম গুলি ছুঁড়বে না।

যখন নামছে গারল্যান্ড ইয়ানের হাত ধরে, তখন ওদের দেখতে পেল স্মেরনফ। ও হুকুম দিল বুড়োভেককে এবং তারপর ওরা যে, নামছে সেটা জানাল সুককে মাইক্রোফোনে। পলাতকদের মাথার উপর নেমে এল হেলিকপ্টারটা বাজপাখির মত। গারল্যান্ড হাত তুলল বিদ্যুৎ গতিতে এবং চারবার গর্জে উঠল ওর ৪৫ ক্যালিবার পিস্তল। টলে সরে গেল হেলিকপ্টারটা। দাঁতে দাঁত চিপে বুডোভেক ঘোরাল হেলিকপ্টারটা নামাবার জায়গার দিকে। রক্ত ঝরছে ওর হাত দিয়ে।

বেশী চোট লেগেছে, স্মেরনফ বলল গাল পেড়ে।

মাথা ঝিমঝিম করছে বুডোভেকের। ও বলল, লেগেছে হাতে তবে নামাতে পারব।

তবে তাই কর।

গারল্যান্ড বলল, আমরা যে এখানে আছি ওরা জানে। চুলোয় যাক। আমাদের সঙ্গ ছাড়ত না ওরা গুলি না চালালে। আমরা এ পথেই নামছি ওরা ভাববে। এখন আবার আমাদের উপরে উঠে অন্য উত্রাই ধরে নামতে হবে। আরেকটি হেলিকপ্টার তখনই ছুটে এসে শিকারী পাখির মতো ওদের মাথার ওপর নেমে পড়ল। অটোমেটিক রাইফেল চালাতে শুরু করল পাইলটের কেবিন থেকে একটি সৈন্য। মাটিতে শুয়ে পড়ল যে যার মতো। পাইলটের মাথা লক্ষ্য করে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে গারল্যান্ড ধীরে এবং একটুও বিচলিত না হয়ে, ট্রিগার টিপল আস্তে করে। সামনে ঝুঁকে গড়িয়ে পড়ল নিহত পাইলট কন্ট্রোল ছেড়ে। আছড়ে পড়ল পাহাড়ের গায়ে হেলিকপ্টারটি। গড়িয়ে পড়তে লাগল পাহাড় বেয়ে সেটি জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ডের মত জ্বলতে জ্বলতে।

চড়াই পথে সকলকে তাড়িয়ে নিয়ে চলল গারল্যান্ড। ধোঁয়া শুধু চারদিকে। আগুন ছড়িয়ে পড়ছে এবং শুকনো গাছের ডালপালায় আগুন লেগেছে। গারল্যান্ড ওয়ারদিংটনকে বলল, ইয়ানকে দাও তোমার পিস্তলটা। ইয়ানকে বলল, চল, আগে যাব আমি আর তুমি।

পাহাড় বেয়ে নামছে ওরা। ধোঁয়ার মেঘ মাথার উপর। ওদের দেখতে পাবেনা হেলিকপ্টার এই মেঘ যদি থাকে। ভীষণ গর্জন করতে করতে গাছ থেকে গাছে আগুন ছড়াতে ছড়াতে যাচ্ছে। সব যেন ঝলসে দিচ্ছে আগুনের আঁচ। শিকারী কুকুরের ডাক শোনা গেল হঠাৎ সব আগুন ছাপিয়ে।

গারল্যান্ড ইয়ানকে বলল, তিন মিনিট বাদে তুমি এস, আগে আমি যাচ্ছি। তিন মিনিট বাদে অন্যরা আসবে। গারল্যান্ড পিস্তল হাতে ক্ষিপ্র পায়ে অসম্ভব হুঁশিয়ার হয়ে নামতে লাগল। এগিয়ে আসছে কুকুরের ডাক। অবশেষে একটি পথ দেখল ঘন ঝোঁপের আড়ালে ও, বন রয়েছে পথের ওপাশে। গাছের পেছনে লুকলো হঠাৎ আওয়াজ শুনে পথে নামতে যাবে সেই সময়। ওর প্রায় গা ঘেঁষে চলে গেল একটি সাঁজোয়া ট্রাক। চারজন সশস্ত্র সৈন্য অটোমেটিক অস্ত্র এবং হেলমেট নিয়ে তাতে বসে রয়েছে। গারল্যান্ড ওপাশের জঙ্গলে লুকোল পিছনে নেমে পথ পেরিয়ে যখন গাড়িটা পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে উঠে গেল।

ইয়ান লুকিয়ে আছে দেখল পথের ওপাশে। আরেকটা সাঁজোয়া ট্রাক যেতে দেখল দুজনেই। গারল্যান্ড ইয়ানকে, ট্রাকটা চলে যেতে বলল, অপেক্ষা কর ওদের জন্য। আমি এগোলাম ওদের নিয়ে এসো। এগোতে লাগল ও। ডাক বেড়েই চলল কুকুরের।

হেলিকপ্টারটা মাটিতে নামিয়ে এদিকে জ্ঞান হারাল বুলোভেক। তিনটি সৈন্যকে বেরিয়ে এসে স্মেরনফবলল, বেরকরওকে, চোট লেগেছেওর। নিজের জিপেরদিকেছুটে গেলএরপর স্মেরনফ। মালিক সেখানেদাঁড়িয়ে। দ্বিতীয় হেলিকপ্টারটা থেকে সৈন্যরা গুলি ছুঁড়ছেদুজনে দেখলওপরপানে চেয়ে। জঙ্গলে আগুন লেগে গেল, একটা গুলিতে হেলিকপ্টারটা আছড়ে পড়াতে।

নিজের সৈন্যদের উদ্দেশ্যে গাল দিয়ে মালিক বলল, আরে এ হল গারল্যান্ড, যত গাধা, বলিনি, কাজ হাসিল সিধে নয় গারল্যান্ড যদি থাকে। বনে আগুন লাগল ওদিকে। কেন ওদের ধরলে না আগে। দেখছ কি প্রচণ্ড আগুন? ওখানে নিয়ে যাবে কি করে এখন সৈন্যদের?

নামতে পারবে না তো গারল্যান্ডরা, পাহাড়ের ওপাশ বেয়ে এখন ওদের নামতে হবে। সেখানে মোতায়েন করে রেখেছি তিনশো সৈন্য এবং শিকারী কুকুর।

কেউ যেন মারা না পড়ে সবাইকে ধরা চাই জ্যান্ত।

অসম্ভব, গারল্যান্ডের মত লোককে জ্যান্ত ধরা।

তুমি দায়ী হবে যদি কায়োর গায়ে আঁচড়টি লাগে। জ্যান্ত ধরতেই হবে ওদের। নইলে উদ্ধার করা যাবে না দরকারী খবর।

বলনি কেন আগে? স্মেরনফ উর্বশ্বাসে রেডিও ট্র্যাকের দিকে ছুটল সৈন্যদের এই নতুন নির্দেশ দেবার জন্য।

ইয়ান ও গারল্যান্ড এখন গাছের আড়ালে লুকিয়ে দেখছেজঙ্গলের পথ ধরে এগিয়ে এসে। একটি মিলিটারী ট্রাক দাঁড়িয়ে পথের পাশে ঘাসের উপর। বন্দুক হাতে তিনটি সৈন্য নামছে। ওদের নির্দেশ দিচ্ছে অফিসার। গারল্যান্ডবলল, একটি ট্রাক নিয়ে আসছেচারটি সৈন্য। ওদেরইউনিফর্ম পরেআমরা সীমান্তে পৌঁছতে পারি ট্রাকটা কজা করে। তুমি ওদের ভাষায় কথা বলতে পার তুমি এগোও। ভয় দেখাও দারুণ। ভয় খাবে কারণ ছোকরাতো ছেলেগুলো, পেছনে আছি আমি।

এগিয়ে গেল ইয়ান, ওর পেছনে রয়েছে গারল্যান্ড। হঠাৎ চেঁচিয়ে বলল ইয়ান, একদম নড়বে না, ঘুরে দাঁড়াও অস্ত্র মাটিতে ফেলে দিয়ে।

অস্ত্র ফেলে দিয়ে চারজন বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। এসে দাঁড়াল, মালা, ব্লঙ্কা এবং ওয়ারদিংটন। ট্রাকে তুলল গারল্যান্ড সৈন্যদের রাইফেলগুলো। ইয়ান হুকুম দিল ওর কথা মতো। ইউনিফর্ম ছেড়ে পালাল সৈন্যরা। ট্রাকের ফ্লোরবোর্ডে তুলল সৈন্যদের দড়ি দিয়ে গারল্যান্ড ও ইয়ান। গারল্যান্ডবলল, বলেদাও যদি ওরা টু শব্দটি করে তবে ওরা গুলি খাবে। মালা, ব্লাঙ্কা এবং ওয়ারদিংটন বসল ট্রাকের ফ্লোরবোর্ডে। রাইফেল ওদের শেষ দুজনের হাতে। গারল্যান্ড ট্রাক চালাতে লাগল চেক ইউনিফর্ম পরে। পাশে ইয়ান, যার কোলে রয়েছে অটোমেটিক রাইফেল।

এগিয়ে চলল ট্রাক ইয়ানের নির্দেশানুসারে। হেলিকপ্টারের গর্জন মাথার উপর। একটি জীপ এগিয়ে এল হঠাৎ উল্টো দিক থেকে। নিজেদের এবং বন্দী সৈন্যদের ইয়ানের নির্দেশে মালারা একটি তেরপল দিয়ে ঢেকে দিয়ে নীচে শুয়ে পড়ল। দুজন সৈন্য এবং একজনমাত্র অফিসার ছিল জীপটিতে। হাত তুলল অফিসারটি। থেমে গেল ওদের ট্রাক এবং জিপ। পিস্তলের সেটিক্যাচ অফ করে তৈরী হল সন্তর্পণে গারল্যান্ড। চেয়ে বলল কটমট করে অফিসারটি, শুনি কোথায় যাওয়া হচ্ছে।

স্যালুট করে বলল ইয়ান, কমরেড লেফটেনান্ট হেডকোয়ার্টারে ফিরে যাচ্ছি ডিভিশনাল কম্যান্ডের হুকুমে।

ডিভিশনাল কম্যান্ডার কে তোমাদের?

কর্ণেল স্মেরনফ।

অফিসারটি বেজায় ঘাবড়ে গেল। বলল, যাও তাড়াতাড়ি যাও, দাঁড়িয়ে রইলে কেন তাহলে।

চলে গেল জীপ। কি বললে? ইয়ানকে বলল গ্যারল্যান্ড।

ইয়ান বলল, হোমরা চোমরা তোক এই স্মেরনফ। কাগজে বহুবার দেখেছি ওর ছবি। ঢিল ড়লাম একটা তাই আঁধারে।

হল বটে কাজ।

একশো কিলোমিটারেরও কম রাস্তা বাকি সীমান্তে পৌঁছতে। তেরপলের পিছনে লুকিয়ে রইল ট্রাকের পিছনের সবাই। বড় রাস্তায় এসে পড়ল ওদের ট্রাক। সারে সারে আর্মি ট্রাক যাচ্ছে ওদের উল্টো মুখে জ্বলন্ত জঙ্গলের দিকে। ওদের পিছু ধরল একটা জীপ। একটি হেলিকপ্টার মাথার উপর নেমে এল। মাথা বের করে হাত নাড়ল ইয়ান। হেলিকপ্টার উপরে উঠে ওর হেলমেট দেখে অন্যদিকে চলে গেল।

বিপদ ঘটল কিছুদূর এসে। দুটো সাঁজোয়া গাড়ি দাঁড়িয়ে পথ আটকে। পিস্তল নিয়ে তৈরী হল গারল্যান্ড এবং ইয়ান। সার্জেন্ট এগিয়ে এল বলিষ্ঠ চেহারার একজন। চেক ভাষায় তাকে কি যেন বলল ইয়ান। তাতে কাজ হল এবার। ওদের পথ ছেড়ে দিল সার্জেন্টটি। আবার ট্রাক চালিয়ে দিল গারল্যান্ড। ইয়ান বলল, বেশ কাজ হচ্ছে কর্নেলের নামে। এ পথে যত গাড়ি যাতায়াত করছে ও জানত না যে এর প্রতিটির খবর রেডিওতে স্মেরনফ পাচ্ছে ঐ সার্জেন্টের মাধ্যমে।

রেডিওতে খবর পাচ্ছে স্মেরনফ ইয়ানের বাগানবাড়িতে বসে। ঘরে পায়চারি করছিল মালিক। স্মেরনফফের তখনি সন্দেহ হল যখন ও শুনল হেডকোয়ার্টারে দুজন সৈন্য ট্রাক নিয়ে ফিরছে কর্নেল স্মেরনফফের হুকুমে। ও একই উত্তর পেল আবার জিজ্ঞেস করে। এ অপারেশান তো চালাচ্ছেন না কর্নেল স্মেরনফ। একই খবর দিল টহলদার হেলিকপ্টারের পাইলটও। উত্তেজিত ভাবে বলল স্মেরনফ হেলিকপ্টারকে, ধাওয়া কর ট্রাকটিকে, কোনদিকে যায় আমাকে জানতে হবে। ট্রাকের আওতায় যেও না কোনো কারণেই।

পাখি পালাচ্ছে মালিক বুঝল। ও বলল, ওরা ভেগেছ তো বোরিস তোমার এত কষ্টের আয়োজন ভেস্তে দিয়ে। তোমার হাল যা হবে ভেবে কষ্ট হচ্ছে ওরা যদি সীমান্ত পেরোয়।

রাগে জ্বলে উঠল স্মেরনফ, বল, নিজের জন্য কষ্ট হচ্ছে। বোল না বাজে কথা। মালিক তোমার কষ্ট হয় নি জীবনে অন্যের জন্য।

.

০৭.

 ঘন জঙ্গল দুপাশে, গারল্যান্ড ট্রাক চালাচ্ছে সরু পথ দিয়ে। ওদেরই অনুসরণ করে চলেছে মাথার উপর হেলিকপ্টারটা, এটা বুঝেছে ও। ইয়ান বলল, আমরা এসে গেছি বর্ডারের কুড়ি কিলোমিটারের মধ্যে। হাতে নঘণ্টা সময় আছে পেরোবার চেষ্টা করার আগে। জঙ্গলে ঢুকলে এবার ভালো হয় ট্রাক রেখে।

মাথা নেড়ে সায় দিল গারল্যান্ড। রেডিওতে খবর পাঠিয়ে চলবে হেলিকপ্টারটা ততক্ষণই যতক্ষণ ট্রাকে আছে। ঘন হয়ে ফিরে আসছে জাল। নিস্তার নেই এখন জঙ্গলে না ঢুকলে। ইয়ান বলল, আরো ৫ কিমি বাদে। ট্রাক থামাও ব্যস। অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ পথ।

আকাশ দেখা যায় না দুপাশের গাছপালার জন্য। ওদের ট্রাকটা আর দেখতে পাচ্ছে না হেলিকপ্টারের পাইলট। নেমে পড়ল ওরা। ইয়ান বলল, পথ খুব খারাপ আমাদের যেতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। এতক্ষণে আমাদের পিছু ধাওয়া করেছে ওরা নিশ্চয়। পিছু পিছু এসো আমার।

কাঁধে রুকস্যাক এবং অটোমেটিক রাইফেল পুরুষদের হাতে। গারল্যান্ডের পিস্তল ব্লঙ্কার হাতে এবং খাবারের টিনের ঝোলা পিঠে। শুধু কম্বল কয়টি মালার কাছে। ট্রাকে পড়ে রইল শুধু ওয়ারদিংটনের সুটকেস। মালাকে সাহায্য করতে লাগল গারল্যান্ড। এখন ওদের দিশারী ইয়ান। ওরা দেখল একটি ছোটো এবং খরস্রোতা নদী মিনিট পনেরো বাদে। নদীতে নামল ওদের নিয়ে ইয়ান। ওদের গন্ধ আর পাবে না কুকুরগুলো যদি জলে নামে। সর্বদা সজাগ ছিল ওদের মনে শিকারী কুকুরের ভয়।

ওরা নদী দিয়ে চলল অমানুষিক পরিশ্রমে দশ মিনিট ধরে। পাড়ে উঠল তারপর আবার। কুকুরের ডাক এবং হেলিকপ্টারের শব্দ শোনা গেল দুরে।

ইয়ান বলল, সুড়ঙ্গ কাছাকাছি আছে খনির বাতাস ঢোকবার জন্য। তোমরা অপেক্ষা কর আমি খোঁজ নিয়ে আসি। ও ঘন জঙ্গলে ঢুকে গেল এই কথা বলে। মাটিতে বসে পড়ল মালা। গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে শ্রান্ত শরীরে দাঁড়াল ওয়ারদিংটন। ইয়ান পাঁচমিনিট বাদে ফিরে এসে বলল, চল, উঠে পড় তাড়াতাড়ি, খুঁজে পেয়েছি।

একটি বিশাল গর্ত মাটিতে ঘনজঙ্গল এবং ঝোঁপের মধ্যে। ইয়ান বলল, খুব গভীর নয় এটি, খনি পর্যন্ত চলে গেছে সিধে। আগে আমি নামছি এবং তারপর একে একে নাম তোমরা, আমি ধরব তোমাদের নিচ থেকে। ওরা সুড়ঙ্গের অন্ধকারে নামল কয়েক মিনিট বাদে এবং দাঁড়াল তারপর। চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে জল দেওয়ালের গা দিয়ে। গারল্যান্ড এবং ইয়ান একটি করে মোমবাতি জ্বালাল। নিচু সুড়ঙ্গ দিয়ে চলল ওরা ইয়ানের পিছন পিছন। নুইয়ে চলতে লাগল সবাই পিঠ। ওরা যেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটছে হাঁটছেই একথা মালার মনে হল এবং হঠাৎ ওরা পৌঁছল বিশাল একটি গুহায়।

ইয়ান রাইফেল নামিয়ে বলল, আমরা পৌঁছে গেছি। আমরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারি এখানে দুদিন। বেজায় বিপদ ঘটবে যদি আজ রাতে সীমান্ত পেরোনোর চেষ্টা করা হয়। রাজী তো তোমরা? সীমান্তে গিয়ে শেষ হয়েছে বেরুবার রাস্তাটা। নিবিয়ে দিলে একটা মোমবাতি, কাজ চলবে অপরটি দিয়ে। খাওয়া যাক এবার কিছু?

ওদিকে হেলিকপ্টারটা স্মেরনফকে খবর দিল যে খাবারের ব্যবস্থা করছে ওরা। রেডিওতে লাগানো ছিল লাউডস্পিকার। সব কথা শুনতে পেল তার ফলে মালিক। ট্রাকটি যে দাঁড়িয়ে আছে ১৫ নম্বর ম্যাপের একটি জঙ্গলে সেই খবরটি এল।

ছত্রিশ ঘণ্টা ঘুমোয়নি স্মেরনফ। বইছে না আর ওর শরীর। ম্যাপ দেখে মালিক বলল, দশ কিলোমিটার বর্ডারের মধ্যে তার মানে ওরা রয়েছে।

হ্যাঁ, ওখানে আরো সৈন্য সুক পাঠিয়েছে। জ্যান্ত ধরতে চাও ওদের তুমি। সুযোগ পাবে এর ফলে ওরা পেরিয়ে যাবার। ওদের যে জ্যান্ত ধরবার হুকুম তুমিই বন্ধু দিয়েছ। এটা মনে রেখ সবসময়। ওদেরই সুবিধে এতে। ভয়ে ওদের গুলি করবে না শাস্ত্রীরা দেখলেওঁ। অটোমেটিক অস্ত্রও তাছাড়া এখন ওদের কাছে আছে। বর্ডার পার হয়ে যাবে ওরা সহজেই।

মূল্যবান খবর আছে ওদের কাছে। জ্যান্ত ধরা অসম্ভব গারল্যান্ডকে একথা তো আমি বলেইছি।

কোভস্কি যে ওকে চুড়ান্ত অসম্মানে ফেলবে একথা ভাবল মালিক। সীমান্ত পেরোয় যদি ওরা। কোভস্কি আবার এটাও জানতে চাইবে যে মালা ও ওয়ারদিংটনের কাছে কি খবর আছে। ও বলল, ঠিক আছে।

ওদের আটকানো যাবেনা আর তাহলে। সেরা রাইফেলম্যান পঞ্চাশজন আছে সুকের কাছে। রাইফেল টেলিস্কোপিক সাইট। সেখানেই ওরা মোতায়েন আছে যেখান দিয়ে পেরোবে। মাইক্রোফোন তুলে বলল স্মেরনফ, হুকুম বাতিল করে দিচ্ছি সব আগেকার, ধরা চাই ওদের মরা বা জ্যান্ত অবস্থায়।

সুক উজবুক একটা, আমি রেডিও ট্রাক নিয়ে যাচ্ছি ওখানে।

যা খুশি কর।

একটি রেডিও ট্রাকে বসল মালিক। বলল সার্জেন্টকে, যত তাড়াতাড়ি হয় নিয়ে চল আমাকে ম্যাপের ১৫ নম্বর সেকশানে।

লাগবে দুঘণ্টা।

 অন্ততঃ দেড়ঘণ্টা।

কথা বলছিল সুক এবং সুকের সহকারী লেফটেন্যান্ট স্টুর্সা। তরুণ কমুনিষ্ট যেহেতু ঈর্সা তাই ও অত্যন্ত নির্দয় এবং নির্মম হতে পারে কাজের বেলায়। অত্যন্ত উদ্বিগ্ন সুক। বহুক্ষণ ধরে সার্চ শুরু হয়েছে। মালিক ওর চাকরি খতম করে দেবে যদি ও পলাতকদের ধরতে না পারে। ওকে ভরসা দিল র্সা। বলল, ওরা লুকিয়ে আছে জঙ্গলেই। জঙ্গলে ঘিরে আছে সৈন্যবাহিনী এবং শিকারী কুকুর। নদীর ওপারেও সৈন্য মোতায়েন আছে যদিও নদীতে পৌঁছে শিকারী কুকুর ওদের গন্ধ অনুসরণ করতে পারেনি। ঘেরাও বাহিনী আরো এগিয়ে এল সুকের কড়া হুকুমে। পালাতে যেন ওরা না পারে। মালিক যে রওনা হয়েছে সেকথা স্মেরনফ ওকে জানাল রেডিও মারফৎ। ঘাবড়ে গেল এই কথা শুনে সুক। স্মেরনফ বলল, মালিক পৌঁছবার আগে ওদের ধরতে। পারলে মঙ্গল তোমারই হবে, কমরেড সুক।

সুকের বাহিনী কি করছে তা দেখার জন্য ও রেডিও ট্রাক ছেড়ে সাজিয়েছিল নিচু টিলার ওপর। স্টুর্সা বুঝল, এটা একেবারে অসম্ভব কারণ সৈন্য এগোতে পারছে না তাড়াতাড়ি। তার কারণ দুর্ভেদ্য ঝাড়, কাটা বন এবং ঘন বন। কেটে গেল সত্তর মিনিট। নদীর দুপাশে চলে গেল জঙ্গল বেড়ে ঘেরাওকারী সৈন্যরা। কোনো দেখা নেই গারল্যান্ডের।

সুকের মাথা খারাপ হয়ে গেল। ও গালাগালি দিল স্টুর্সাকে। বলে উঠল, যা করবার সবই তো করলে কিন্তু কি হল। এই তো হাজির এখানে সৈন্যরা জঙ্গল ঘিরে এগিয়ে। যাদের ধরবে তারা কোথায়? অপদার্থ মূর্খ। তোমাকে দাঁড় করাব আমি ট্রাইবুনালের সামনে।

হিম শীতল গলায় এই সময় একজন পিছন থেকে বলল, কমরেড সুরু বড় উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে তোমাকে। পিছন ফিরল কমরেড সুক ভয়ে সাদা হয়ে। দাঁড়িয়ে আছে সবুজ চোখে বরফের মত ঠাণ্ডা চাহনি এবং কাঁচের মত চকচকে চোখ নিয়ে মালিক।

সুক বলল, ওরা জঙ্গলে লুকিয়ে আছে স্টুর্সা বলছিল। ওরা নেই দেখেছি কারণ আমরা তল্লাশি করেছি প্রায় পাঁচশো সৈন্য নিয়ে।

ও সুকের চেয়ে কাজের বিশ্বাসযোগ্য লোক তা মালিক বুঝল স্টুর্সাকে দেখেই।

 বলল, লেফটেনান্ট কেন ভাবলে যে এরা জঙ্গলে আছে?

কুকুরগুলো আর গন্ধ পায়নি ট্রাক থেকে এখানে ওদের গন্ধ শুঁকে পৌঁছে। এই কথাটির অর্থ হল, এরা কুকুরদের ধোকা দেওয়ার জন্য জলে নামে এবং জঙ্গলে লুকোয়। কোনো হদিশই অথচ মিলল না ওদের জঙ্গলে। দুটো মুখই বন্ধ করেছি নদীর। পালাতে পারবে না ওরা নৌকার মাধ্যমেও।

বাতাসে যে মিলিয়ে যাবে ওরা ভূত নয় তো। ওরা তার মানে মাটির নীচে সেধিয়েছে যেহেতু গাছের ওপরে জঙ্গলে বা নদীতে নেই।

সার্জেন্ট এগিয়ে এসে বলল, আমি জানি যে কাছেই একটি বাতিল তামার খনিতে বাতাস ঢোকার সুড়ঙ্গ আছে।

সেখানে নিয়ে যেতে পারবে?

পারব।

মালিক বলল সুককে, খবর দাও স্মেরনফকে। আসতে হবে না তোমাকে। ও গেল এগিয়ে ঈর্সা এবং সার্জেন্টের সঙ্গে। ওর ক্ষমতার ক্ষণিক মেয়াদ যে এবার শেষ হল তা বুঝল সুক।

ম্যাপ এঁকে বোঝাচ্ছিল ইয়ান গারল্যান্ডকে গুহার মধ্যে বসে। দুটি সুড়ঙ্গ বেরিয়ে গেছে গুহা থেকে। খনির ভেতর পর্যন্ত গেছে ডানদিকেরটি। জাল বোঝাই সেইটা। মাইনর ফিল্ডে, সীমান্তের মুখে পৌঁছেছে বাঁ দিকেরটি। বুকে হেঁটে যেতে হয় সে পথে। মাইন ফাটবে মাটিতে কাপুনি হলেই। মাইন মাটির নীচে। এতটুকু কম্পন না সৃষ্টি করে মাটির উপর দিয়ে যেতে হবে। দ্বিতীয়: দিন মালা ও গারল্যান্ড এবং তৃতীয় দিন যদি ওয়ারদিংটন যায় তা হলেই ভালো হয়।

সবই বুঝল গারল্যান্ড। ডবল ইলেকট্রিকের বেড়া যে তার পরে আছে তা বোঝা গেল ইয়ানের কথায়। জল বইছে বেড়ার নীচে মাটির তলে। মাটি নরম তার ফলে। শরীরের চাপে মাটি বসে যাবে তারের নিচ দিয়ে বুকে হেঁটে পেরুলে, এবং এর ফলে পেরনো যেতে পারে। মৃত্যু হবে তার ছুঁলেই। দুটি ওয়াচ টাওয়ার ডান পাশে একশো মিটার দূরে এবং বাঁ পাশে তিনশো মিটার দূরে। সর্বদা ঘুরছে তার সার্চলাইট। পেরতে হবে দুটি সার্চলাইটের সংকীর্ণ অন্ধকার জায়গা দিয়ে। যতক্ষণ ওরা বন্দুকের পাল্লায় থাকবে সীমান্ত পেরিয়ে ততক্ষণ গুলি ছুঁড়বে টাওয়ারের শাস্ত্রীরা। মৃত্যু ডেকে আনার সামিল কারণ অসম্ভব দাঁড়িয়ে উঠে দৌড়নো। উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়নো চলবে দুশো মিটার বুকে হেঁটে গিয়ে। তার আগে নয়। গারল্যান্ড বলল, কাজটি দুঃসাধ্য।

আমি সচক্ষে দেখেছি যে এটি দুঃসাধ্য হলেও করা যায়।

আমাকেই আগে যেতে হবেইয়ান। প্যারিসে পৌঁছনোর দরকার আমার কাছের অত্যন্ত গোপনীয় দলিলটির। অন্যদের পালাবার পথ বন্ধ হবে, তোমাদের এতটুকু ভুলের জন্য মাইন ফাটলে।

কঠিন মুখে বলল ইয়ান, আমার স্ত্রীর জীবনের দাম অনেক বেশী তোমার দলিলের চেয়েও। তোমাদের এ পর্যন্ত এনেছি আমরাই। যতক্ষণ না আমরা আগে যাই ততক্ষণ কেউ যেন না যায়। কাল রাতে যাব আমরা। তুমি এবং মালা পরশু যাচ্ছ। ওয়ারদিংটন তরশু।

ইয়ানের সঙ্গে যে তর্ক করা বৃথা তা বুঝল গারল্যান্ড। ও রাজী হল অগত্যা। শুরু করে দিল এদিকে আবার গণ্ডগোল ওয়ারদিংটন। সবার শেষে সে একা যাবে না কিছুতেই। গলার আওয়াজ ভেসে এল হঠাৎ ওদের কানে। কথাবার্তা ও পায়ের শব্দ শোনা গেল সুড়ঙ্গের মুখ থেকে। চুপ করতে বলল সকলকে গারল্যান্ড। ও চলে গেল অটোমেটিক রাইফেল হাতে নিয়ে দ্রুত বাতাস বেরোবার গর্তের মুখের কাছে। স্পষ্ট শুনতে পেল এখন সব কথা।

গর্তটির মুখে দাঁড়িয়ে মালিক সার্জেন্ট ও স্টুর্সা। সার্জেন্টটি বলল, একটা লম্বা সুড়ঙ্গ এবং তারপর একটি গুহা। দুটো সুড়ঙ্গ বেরিয়েছে গুহা থেকে তার জানা নেই যে সেগুলি গেছে কোনদিকে। তখনি সুড়ঙ্গে নামতে চাইল স্টুর্সা। মালিক বলল, ঢোকা উচিত আগে কাঁদানে বোমা মেরে তারপর। অতি সাংঘাতিক লোক এই গারল্যান্ড। তিনটি হাতবোমা ছিল ঈর্সার কাছে। ও বলল, সঙ্গে কাঁদানে বোমা নেই। কমরেড মালিক আমি কন্ট্রোল করছি এ অপারেশান। আমি যাবই যাব ভেতরে।

সবই শুনল গারল্যান্ড। ও সকলকে সীমান্ত মুখে এগতে বলল, তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে। সময় নেই, তাই আর সময় মিলবে না। মেয়েদের তাড়িয়ে নিয়ে ছুটে চলল ইয়ান রুকস্যাক দুটি তুলে নিয়ে। গারল্যান্ডের পেছন পেছন চলল ওয়ারদিংটন নাছোড়বান্দার মত। কিছুই অবশিষ্ট নেই যে ওর ভবিষ্যৎ বলে সেটা ও জানে। ও কাপুরুষ বা দুর্বল নয় এটা একবার অন্তত ও সর্বসমক্ষে প্রমাণ করতে চায়। ও গারল্যান্ডের মতই মরদ কা বাচ্চা এটা ওকে প্রমাণ করতেই হবে। মালা ওকে জীবনেও পাত্তা দেবে না, না হলে। মালার জন্যেই যে ওর শুধু বেঁচে থাকার ইচ্ছা এই কথাটা সত্যি। ও এগিয়ে চলল বন্দুক তুলে নিয়ে।

সুড়ঙ্গের ভেতর লাফিয়ে নামল স্টুর্সা। ওয়ারদিংটন ফিরে যায়নি যদিও গারল্যান্ড ওকে ফিরে যেতে বলেছিল। গারল্যান্ডকে না দেখলেও ঈর্সা ওয়ারদিংটনকে ঠিকই দেখল। ওয়ারদিংটনের পিস্তল গর্জাল।

স্টুর্সা হাতের গ্রেনেড ছুঁড়ল আঘাতে ছিটকে পড়তে পড়তে। বুকে লাগল গ্রেনেডটা ওয়ারদিংটনের। একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে দলা পাকিয়ে গেল ওয়ারদিংটন।

আকাশ ফাটানো শব্দ। স্তম্ভিত হয়ে রইল মুহূর্তের জন্য গারল্যান্ড। হাতড়ে এগিয়ে গেল তারপরে। স্টুর্সা সংজ্ঞাহীন, রক্তার্ত। ওর গ্রেনেড দুটি হাত করল গারল্যান্ড। যদিও ও লাইটার সিগারেটে জ্বাললো কিন্তু তারপরই লাইটার নেবালো ওয়ারদিংটনকে দেখে। সুড়ঙ্গ বেয়ে ফিরে এল তারপর। ইয়ান ফিরে এসেছিল বন্দুক এবং গ্রেনেডের শব্দে। পালাও পালাও গারল্যান্ড বলল। পালাও তোমরা, ওয়ারদিংটন মারা গেছে।

সুড়ঙ্গে যে পথ দিয়ে বাতাস ঢোকে সেই পথের ঢোকার মুখে পরপর ও ছুঁড়ে মারল দুটি গ্রেনেড। সুড়ঙ্গে ঢোকার পথ বন্ধ হয়ে গেল সুড়ঙ্গের মুখ ভেঙে ধ্বস নেমে। গুহাটা ধ্বসে পড়ল বিস্ফোরণে। ইয়ানের কাছে চলে এল গারল্যান্ড। বলল, আমরা যে চাপা পড়ে মারা গেছি, এটা ভাবতে পারে ওরা।

মালিক ক্ষেপে গেল পরপর বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দ শুনে। কি বোকা স্টুর্সা। হয়তো বন্ধই হয়ে গেল সুড়ঙ্গে ঢোকার পথ। জীবন্ত সমাধি হল কি পলাতকদের। অন্য কোনো পথ নেই কি বেরুবার। আরো লোক জোগাড় করতে বলল ও সার্জেন্টকে। রেডিও ট্রাকের দিকে ছুটল ও নিজে। স্মেরনফকে বলল ও রেডিওতে, এমন লোককে খুঁজে বের কর যে জানে খনির এলাকাটা খুব তাড়াতাড়ি। কোনো ম্যাপ পাও কিনা দেখ এই অঞ্চলের। গ্যাস মুখোশ থাকে যেন তাদের সঙ্গে যাদের পাঠাবে। নীচে নামতে হবে ওদের। চাই অ্যাম্বুলেন্সও।

বুঝলাম কিন্তু সময় তো লাগবে।

জলদি কর এই কথা বলে কেটে দিল কানেকশন মালিক।

হাঁটছে পলাতকরা। হাঁটছে তো হাঁটছেই যে শত শত কিলোমিটার পথ বলে মনে হল মালার। হাতে মোমবাতি নিয়ে প্রথমে ইয়ান এবং পরে ব্লাঙ্কা। শেষে মালা এবং গারল্যান্ড। ওয়ারদিংটন যে মৃত একথা মালা বিশ্বাসই করতে পারছে না, ওর হাত ধরে আছে গারল্যান্ড। কাঁদত নইলে ও মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এবার থামল ইয়ান। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল দুজন মেয়ে। ওদের সহ্য হচ্ছে না আর এত ধকল।

ইয়ান বলল, ৪ কিমি আর বাকি। সুড়ঙ্গের মুখে পৌঁছব আর দুঘণ্টা বাদে। ঘন হবে ততক্ষণে অন্ধকার। আগে যাব আমি এবং ব্লঙ্কা। আমরা আর সবুর করতে পারব না যদিও সজাগ থাকবে সীমান্তে শান্ত্রীরা। বেরুবার পথ একমাত্র এটিই। জলে বোঝাই ডানদিকের সুড়ঙ্গটি সেটি সীমান্তের নীচ দিয়ে মাটির তলা দিয়ে ওপরে চলে গেছে। তেলতেলে গন্ধ জল। অসম্ভব সাঁতরে ৪ কিমি যাওয়া। জলে ইঁদুর, গ্যাস সবই আছে। লাশ ভেসে উঠেছিল যখন আমার এক বন্ধু গিয়েছিল গত বছর। লাশটি তেলে চোবানো, জলে চোপসা অর্ধেক খেয়ে নিয়েছে ইঁদুরে।

আবার চলতে শুরু করল ওরা। মালা পড়ে যেত তাই গারল্যান্ড চলল মালাকে জড়িয়ে ধরে।

ফিরে এসেছে মালিক ততক্ষণে বাতাস ঢোকার গর্তের মুখে। স্টুর্সা যে মারা গেছে তাও জেনে নিল আগে একজন সার্জেন্টকে নামিয়ে। মৃতদেহ পড়ে আছে আরেকটি লোকেরও। ধস নেমে বন্ধ সুড়ঙ্গে ঢোকার মুখে। নিচে নামল মালিক। ওয়াদিংটনের মৃতদেহ দেখল টর্চ জ্বেলে। পথ বন্ধ এগোবার। চাপা পড়ে মরল না কি বাকি পলাতকরা। দেখতে হবে খনি থেকে বেরুবার অন্য পথ আছে কি নেই। অসম্ভব এই অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা।

বরবাদ খনির ম্যাপের জন্য খনি মন্ত্রী বিভাগের এক কর্মচারীকে স্মেরনফ ধাতাচ্ছিল্য। কর্মচারীটি বলল, কোনো খোঁজ করা সম্ভব নয় পরদিন সকালের আগে। কোনো কথাই শুনল না কিন্তু স্মেরনফ। সে জানাল, আসছি আমি আগে। তোমায় ভুগিয়ে ছাড়ব যদি আমি ম্যাপ না পাই। বুঝেছ এটা একটা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বের ব্যাপার।

সুড়ঙ্গের মুখে দাঁড়িয়ে তখন পলাতকরা। মুখটি বন্ধ গাছ ও ঝোপে। ওদের মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে রাতের শীতল বাতাস।

ইয়ান বলল, অন্ধকার বেশ ঘন কারণ নটা বেজে গেছে। চললাম আমি আর ব্লাঙ্কা। চার ঘণ্টা লাগবেকম করে এই মাইন ফিল্ড পেরোতে। সেইমতো পার হয়ে আমি বলছি যেইভাবে। এক মিটার যাবে পাঁচ মিনিটে। বুঝলে খুব আস্তে। কি ভাবে আমরা পার হই সেটা দেখ। নরম মাটি পাচ্ছ তারপরে ইলেকট্রিক তারের বেড়ার তলায়। তার ছুঁলেই মারা যাবে সেই কারণেই খুব সাবধান।

বুঝেছি বলল গারল্যান্ড।

দুজন দুজনকে গুড লা বলল। পরস্পরের কাছে বিদায় নিল মালা এবং ব্লঙ্কা। মালা কাঁপছে। ভয় পেও না, রাক্কা বলল। তোমায় দেখবে গারল্যান্ড। ও একেবারে ইয়ানের মতই। এই কথা বলে ওরা চলে গেল।

গারল্যান্ডকে ধরল মালা কেঁপে উঠে। জড়িয়ে ধরে বলল ওকে গারল্যান্ড। ভয় কি, আমি তো আছি নাতি নাতনীদের কি একখানা গল্প শোনাতে পারবে ভাবতো।

ওরাও এগুল ইয়ান এবং ব্লাঙ্কার পিছন পিছ। উঁচু ঘাস সামনে। ইলেট্রিক তারের বেড়া রয়েছে একটু দুরে। পরস্পরকে চুমু খেল, ইয়ান ও ব্লাঙ্কা। গারল্যান্ডকে বলল ইয়ান দেখা আবার হবে অস্ট্রিয়ায়।

অসহনীয় এই উত্তেজনা। মালার শরীর কাঁপছে এবং ঘাম ঝরছে গারল্যান্ডের শরীর বেয়ে।

সার্চ লাইটের অনুসন্ধানা চোখ সীমান্তের অন্ধকার চিরে ফেলেছে। অন্ধকার চিরছে আলো ঘুরে ঘুরে।

ইয়ান আর ব্লাঙ্কা খুব আস্তে এগোচ্ছে। ভাঙন ধরেছে যেন গারল্যান্ডের অদম্য সাহসে। দেখতে পারছেনা আর মালা। ও মুখ লুকিয়ে রয়েছে গারল্যান্ডের বুকে। সন্তর্পণে এগোচ্ছে ইয়ান আরব্লাঙ্কা।

কি যেন ঘটে গেল হঠাৎ যা ঠিক বুঝল না গারল্যান্ড। সরাসরি ঠেকেছিল হয়তো ইয়ানের শরীরে কোনো মাইন। ইয়ানের শরীর হাওয়ায় ছিটকে দুম্ করে পড়ে গেল আকাশ ধাঁধানো আওয়াজ আর ধোঁয়ার বিস্ফোরণের মধ্যে। ফাটল আরেকটি মাইন। চেঁচিয়ে উঠল মালা, ছুটছে ব্লাঙ্কা উঠে ইয়ানের দিকে। মেশিনগান গর্জে উঠল দুটি ওয়াচ টাওয়ারের। রাক্কা ঝাঁঝরা হয়ে গেল গুলিতে।

মেশিন গানের গুলি ছিন্নভিন্ন করে দিল সমস্ত সীমান্তের মাটি। আকাশ দীর্ণ করল সাইরেনের কান্না। অন্ধকার রাত ভয়াল হয়ে উঠল বর্বর হিংস্রতায়।

.

০৮.

 ক্ষ্যাপা রাগে টগবগ করছে মালিক রেডিও ট্রাকে বসে। খবর শুনছে এক সার্জেন্ট রেডিও ইঞ্জিনিয়ার কানে হেডফোন লাগিয়ে। প্ৰাগে গেছে স্মেরনফ ম্যাপ আনতে। মাইন ফাটার আওয়াজ এবং মেসিনগানের গর্জন শোনা গেল দূর থেকে। মালিককে বলল সার্জেনটি হেডফোনে খবর শুনে। কমরেড মালিক বর্ডার পেরোতে গিয়ে একটি পুরুষ এবং একজন মেয়ে মারা পড়েছে।

গারল্যান্ড? মালিক বলল জেনে নাও, ওদের চেহারার বর্ণনা। নিস্তব্ধ রেডিও। হঠাৎ গলা ভেসে এল স্মেরনফফের, দুটি পথ আছে বেরুবার জন্য, ম্যাপ পেয়েছি। এর মধ্যে জলে ভর্তি এবং বন্ধ রয়েছে একটি এবং অপরটি গেছে সীমান্তের মাইন-ফিল্ডে।

দুজন মারা পড়েছে পেরোতে গিয়ে, ঠিক বলছ একটা পথ জলে ভর্তি?

হ্যাঁ।

সার্জেন্টকে বলল মালিক, চলে এস ম্যাপটা নিয়ে, কারা মারা পড়ল খোঁজ নাও।

মাইন ফিল্ডের ঠিক মাঝখানে রয়েছে লাশদুটো তাই আনতে সময় লাগবে। মেয়েটির চুল সোনালি এবং পুরুষটির চেহারা ভারি সারি।

এই জল বোঝাই পথ দিয়ে বেরুত গারল্যান্ড যদি বেঁচে থাকত? আটকে পড়েছে কি তবে গারল্যান্ড খনিতে! মালিক বলল, কি রকম সময় লাগবে মাইন ফিল্ড পরিষ্কার করতে?

ওখানে কোনো মাইন ডিটেকটর নেই তাই লাগবে ঘণ্টা পাঁচেক। পাঠানো হয়েছে আনতে।

পাঁচ ঘণ্টা ওই সময়ের মধ্যে কতকি করতে পারে গারল্যান্ড। যদি ও বেঁচে থাকে, এমনকি ইচ্ছা করলে পালাতেও পারে।

দু ঘণ্টার মধ্যে স্মেরনফ এসে পড়ল পাগলের মতো ঝড়ো বেগে গাড়ি চালিয়ে। স্মেরনফ গাড়ির হুডে ম্যাপ বিছিয়ে দিল এবং তারপর টর্চের আলো ম্যাপের উপর ফেলে বলল ম্যাশ দেখিয়ে, দুটো বেরুবার পথ আছে। তিনশো মিটার ভেতরে চলে গেছে দ্বিতীয় পথটা অস্ট্রিয়ান সীমান্ত পেরিয়ে। অব্যবহার্য এই পথটি। জলে ভর্তি ৪ কিমির এই সুড়ঙ্গটি।

ছেলেখেলা ৪ কিমি সাঁতরানো গারল্যান্ডের কাছে।

ইঁদুর কিলবিলে, বদ্ধ পচা এবং তেল বোঝাই জলটা। খেয়ে ফেলবে ওকে জ্যান্ত। গ্যাস বোঝাই সুড়ঙ্গ। গ্যাসটা মারাত্মক পরীক্ষা করে বলেছে বিশেষজ্ঞরা।

উবে যেতে পারে এতদিনে।

ও পথে যাওয়া অসম্ভব বিশেষজ্ঞরা বলেছে। তোমার হাতে এই বিশ্বাস করা বা না করা।

গারল্যান্ড, এ অন্য কেউ নয়, যদি এতটুকু কঁক পায় তো তবে পালাবে।

ম্যাপ দেখিয়ে একটু ভেবে মালিক বলল, আমি গারল্যান্ডের জন্য অপেক্ষা করব এই জলপথে বেরুবার মুখে।

অস্ট্রিয়া ওর টিকি ছোঁবে কি করে, পাগল হয়েছ কি তুমি?

 মাত্র তিনশো মিটার তো বর্ডার থেকে, ওকে খতম করব গারল্যান্ড বেরুনেই। ফিরে আসব অস্ট্রিয়ান গার্ডরা আসবার আগেই।

বদ্ধ পাগলামি একেবারে এটি।

যেতে দেব না গারল্যান্ডকে পালিয়ে।

আমিও সঙ্গে যাব বেশ।

না আমার ফেরার বন্দোবস্ত তুমি নিজে করবে এদিক থেকে। ইলেকট্রিক সুইচ বন্ধ করবে যখনই গুলির আওয়াজ পাবে। আমার ফেরার পথ করে রাখবে মাইন ফিলডের ভিতর দিয়ে

অযথা ঝুঁকি নিচ্ছ তুমি, ওপথেই যাবে কি গারল্যান্ড?

ঝুঁকি আমাকে নিতেই হবে। খনির ভেতর সৈন্য নামাতে হবে ও পথে যদি না বেরোয়। চত সময় নষ্ট করো না। দেখতে হবে লাশগুলো।

ধুলোর ঝড় তুলে বেরিয়ে গেল ওদের গাড়ি।

.

হার মানতে জানে না গারল্যান্ড। ও ঠিক পথ করে নিয়ে পালাত যদি ও একা হত। মালা কাঁদছে কারণ ওর হিস্টিরিয়া হয়েছে। যত বিপদ ওকে নিয়ে মালা ভয়ে দিশেহারা হয়ে কাঁদছে মেশিন গানের আওয়াজ শুনে এবং দুটি লাশের দিকে চেয়ে।

ও পর পর দুটো চড় মারল মালাকে। জোর করে টেনে তুলে দিয়ে। মালা পড়ে গেলে ও আবার মালাকে টেনে তুলল। কি ধাতস্থ তো এখন ও বলল হেসে।

মালাও জোরে মারল ওকে চড়। তারপর ওর সম্বিৎ ফিরতে ও গারল্যান্ডের কাছে ক্ষমা চাইল। হেসে বলল, ক্ষমা করলাম তোমায় কিন্তু পালাতেই হবে আমাদের এখন, জলভর্তি সুড়ঙ্গ দিয়েই যাব। আমরা সবচেয়ে দামী ডিনার খাব আজ থেকে তিনদিনের মাথায় প্যারিসের রেস্তোরাঁয় দেখ না।

ওরা এগোচ্ছে সুড়ঙ্গ ধরে। রাইফেল এবং থলি হাতে গারল্যান্ড। জ্বলন্ত মোমবাতি মালার হাতে। বদ্ধ দুষিত হাওয়া। হালকা হল দুজনে কিছু কিছু পোষাক খুলে। প্যান্ট শুধু গারল্যান্ডের পরনে। জীন্স এবং অন্তর্বাস শুধু মালার পরনে।

সপ্রশংস চোখে গারল্যান্ড বললে, তুমি সত্যিই সুন্দরী। আমরা হয়তো ভালবাসাবাসিও করব তিনদিনের মাথায়।

একটু বসি। আর পারছি না আমি।

পথটা এগিয়ে দেখে আসি আমি।

 দুজনের মনে কি যেন ঘটে গেল সহসা। মোমবাতি নিভে গেল। গারল্যান্ডকে টেনে জড়িয়ে ধরল মালা। এক হয়ে গেল যেন দুটো শরীর। সীমান্ত পেরুবার ভয় এবং দুঃস্বপ্ন, ভয়াবহ সুড়ঙ্গের ভয়। সবকিছুরই সময় যেন থেমে গেল। দুজনকে ভাসিয়ে নিয়ে চলল আশ্চর্য এক সুখ স্রোত।

দুজনে ফিরে এল বাস্তবে একসময় এবং এরপর নিজেকে ধীরে ধীরে ছাড়িয়ে নিল গারল্যান্ড এবং মালাকে ধীরে বলল, রাইফেল তুলে নিয়ে। আমি দেখে আসি কেমন, একটু শুয়ে থাক তুমি চুপটি করে।

গারল্যান্ডের নাকে হঠাৎ তীব্র গন্ধ আসতে ও চোখ চেয়ে দেখল পাঁচ ছয়টি তেলের পিপে ঠেস দিয়ে রাখা দেওয়ালে। খালি অবশ্য পিপেগুলি এবং সেইমাত্রই ওর মনে হল যে পিপেগুলি যেহেতু খালি সুতরাং জলে ভাসবে সেগুলি। ওর পাশে সেই সময় এসে দাঁড়াল মালা।

গারল্যান্ড আর দেরি না করে কালো এবং পচা জলের কিনারায় পিপে এনে একটি একটি করে গড়িয়ে রাখল। একটি মোটা দড়ি পেয়ে গেল ওরা। তিনটি পিপে একত্র করার জন্য। ভেলা তৈরী হল তিনটে পিপে দড়ি বেঁধে।

দূরবীন নামিয়ে মালিক বলল, গারল্যান্ড ও নয়, খনির মধ্যেই আছে তার মানে এখনও গারল্যান্ড। সময় আর নেই তাই আর দেরী করব না। অত সবুর করা সম্ভব নয় ওরা ডিটেকটর এনে মাইন তোলা অব্দি। পেতে দাও টেবিল মাইনের ওপর, চলে যাব হেঁটে তার উপর দিয়ে

কাজটা যে বিপজ্জনক তা ওকে বোঝাল পুলিশ কন্ট্রোলের মেজর। মাইন ফাটবে টেবিলের পায়া লাগালেও। মাইন ফিল্ড পেরুনো বরঞ্চ সম্ভব মোটা হুক লাগানো দড়িতে ঝুলে দোল খেয়ে তাতেই সায় দিল মালিক। স্মেরনফ বলল, যদি গারল্যান্ড ও পথে না বেরোয়? দড়ি ছিঁড়ে যায় যদি, তুমি নেহাৎই গোয়ার্তুমি করছ।

মালিক বলল, তুমি দয়া করে চুপ কর কারণ আমি যাবই। যেতে হবে তিন কিলোমিটার পথ মাইন ফিল্ড পেরুচ্ছি আমি দড়িতে ঝুলে। বন্ধ কর ইলেকট্রিক। হেঁটে চলে যাব তারের বেড়া ধরে। ফিরব ওই পথেই। সব মাইন যেন তখন তুলে ফেলা হয়ে যায় ফিল্ডের।

বন্দোবস্ত হয়ে গেল দড়ির। মালিক হাত মেলাল মেজরের সঙ্গে। স্মেরনফ বলল, মেয়াদ শেষ এবার গারল্যান্ডের। এরপর ওকে দেখা হলে আমি খতম করব কারণ প্রথমেই ওকে আমি হুঁশিয়ার করেছিলাম।

এত উচ্চাকাঙ্ক্ষা কেন তোমার। আমিও যাই, কারণ গারল্যান্ডকে মারা আমার কাজ।

এটা বোঝাপড়ার পালা আমার এবং ওর।

ওয়াচ টাওয়ারে উঠে গেল মালিক মই বেয়ে। তারের বেড়ার ওপারে অস্ট্রিয়ার মাটিতে নামল ও এই দড়িতে ঝুল খেয়ে।

হুগো ভন রাইটেনা যিনি অস্ট্রিয়ান ফ্রন্টিয়ার এবং ক্যাপটেন, তিনি ভিয়েনার আমেরিককান দূতাবাসকে চাইলেন টেলিফোন তুলে। ও ভীষণ রকমের উঁচু ঘরানার, অভিজাত এবং ক্যুনিস্ট বিরোধি এবং ওর বয়স আটত্রিশ। ও মুগ্ধ আমেরিককার জীবনযাত্রা প্রণালীতে। যেই পালিয়ে আসে কম্যুনিস্টদের থাবা এড়িয়ে ও প্রাণ দিতে পারে তাকে বাঁচাতে। ওকে জানিয়েছে গতকাল ভিয়েনার সি.আই.এ এজেন্ট ফ্র্যাঙ্ক হাওয়ার্ড যে সীমান্ত পেরুতে পারে এমন একজন আমেরিককান এজেন্ট। ব্যাপারটা যে গুরুত্বপূর্ণ তা হাওয়ার্ড কিছু বলেনি কিন্তু রাইটেনা আঁচে বুঝেছে।

ফোন ধরল হাওয়ার্ড। রাইটেনাও বলল, প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে সীমান্ত পেরুবার। খবর এসেছে মাইন ফাটার মেশিনগান চলার। আমি যাচ্ছি সীমান্তে। জানাব যদি আর কোনো খবর পাই।

ব্যাপারটা অত্যন্ত জরুরী, তাই ধন্যবাদ। জান জায়গাটা কোথায়?

লেবানন পনেরো স্কোয়ার দুই।

 ঠিক আছে।

দারুণ ব্যস্ততা চলছে গত ছত্রিশ ঘণ্টা ধরে প্যারিসের আমেরিককান দূতাবাসে। ডোরী পায় ব্রুকম্যানের মৃত্যুর খবর। সংকেতে সংবাদ এসেছে প্রাগের আমেরিককান দূতাবাস থেকে যে মনে হয় গারল্যান্ড, মালা রীড এবং ওয়ারদিংটন অস্ট্রিয়ার সীমান্তের দিকে যাচ্ছে। ওদের ধাওয়া করেছে মালিক ও স্মেরনফ।

কালো ছায়া ডোরীর চোখের চারপাশে। ও হ্যালোরানকে দিল ও টেলিগ্রামটি। ও হ্যালোরান বলল, গারল্যান্ডের কাছে এখনো আছে কিনা জানি না টপ সিক্রেট ডকুমেন্টগুলি। ভাবি না ওর জন্যে। এ আমি হলফ করে বলতে পারি যে মালিক আর স্মেরনফকে ও সামলাতে পারবে।

হয়ে গেল তিন দিন। এবার জানি যে কাগজ খোয়া গেছে।

 আগে কিছু কর না দাঁড়াও গারল্যান্ড ফিরুক।

ল্যাটিমারকে প্রাগে ঢুকিয়ে দিয়েছি কারণ ব্যস্ত ছিল মালিক গারল্যান্ডকে নিয়ে। ভণ্ডুল করিনি একেবারে সব। আমাকে ফাসাতে পারে তবে গারল্যান্ড। ওকাগজগুলো দিয়ে নিজের জান বাঁচাবে যদি মালিক ওকে ধরে।

বাঁচবে না কেন ও? কোনো কাজ কোনো দিন করেছি আমরা ওর বিশ্বস্ততা অর্জনের মত। আমি চললাম ভিয়েনা। খবর দিয়েছি হাওয়ার্ডকে। একটি ভালো লোক আছে ও বলেছে সীমান্তে। সহায়তা করবে সবরকম আমাদের।

টিম তুমি যা পার কর তবে পেতেই হবে দলিল।

তা হলে পাবে যদি দলিলটা বার করে আনা হয়ে থাকে প্রাগ থেকে। বেরিয়ে গেল ও হ্যালোরান। ভিয়েনা রওনা হয়ে গেল সে তারপরই একটি দ্রুতগামী মিলিটারী জেট প্লেনে।

.

গারল্যান্ড পচা দড়ি দিয়ে বাঁধল তিনটে তেলের পিপে। সব জিনিষ বার করল তারপর রুকসাক খুলে। একটি প্লাস্টিকের ব্যাগে ছিল এক টুকরো চীজ। একটি বাসি পাউরুটি, একটি সসেজ। টপ সিক্রেট ডকুমেন্টের খাম সে তাতে ভরল। তাতেই সে ভরল নিজের, ইয়ান, ব্লাঙ্কা এবং মালার ভাগের টাকা। রুকস্যাকে ভরল ব্যাগটি আঁট করে বেঁধে। তেলের পিপের দড়ির সঙ্গে রুকস্যাকের স্ট্র্যাপ বাঁধল। গারল্যান্ড মালাকে চুমু খেল ভেলাটি জলে ভাসিয়ে বলল, যে বিপদই আসুক, আমি সামলে নেব তা ভয় পেও না। আমি প্যারিসের সেরা দামী ডিনার খাচ্ছি তিন দিন বাদে মনে রেখো।

ওরা চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল ভেলায় উঠে। দুটি সামনের পিপের ওপর বসানো জ্বলন্ত মোমবাতি। রাইফেলের কুঁদো দিয়ে দাঁড় টানছে গারল্যান্ড। ওর হাত ভারি হয়ে গেল কিন্তু। ওরা হাত দিয়ে জল ঠেলে ঠেলে চলতে থাকল হাতে রাইফেলটি তুলে নিয়ে।

বিষাক্ত, দুষিত অন্ধকার, কালো পিচ্ছিল এবং দুর্গন্ধ জল। যেতে হবে চার কিলোমিটার। নিচে নেমে এল ক্ৰমে সুড়ঙ্গের হাত। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় কারণ বাতাস ভারি। দুটি চোখ জ্বলে উঠল হঠাৎ মালার কাছে। ও হাত তুলে দিল ভয়ে চেঁচিয়ে। জলের ইঁদুর, তাই গারল্যান্ডও হাত উঠিয়ে নিল। ঝাঁপিয়ে পড়ল ইঁদুরটা, ধাক্কা লেগে পড়ে গেল পিপের গায়ে।

ভেলা থেমে গেল কারণ অসংখ্য ইঁদুর রয়েছে চারদিকের জলে। ভেলা ঠেলে নিয়ে চলল গারল্যান্ড রাইফেলের কুঁদো দিয়ে। রাইফেলের নলের উপর লাফিয়ে উঠল একটি বিশাল ইঁদুর জ্বলন্ত চোখে। গারল্যান্ডবাঁ হাতে ইঁদুরটাকে ফেলে দিল। রাইফেল গর্জে উঠল। বজ্রপাতের মতো ভীষণ শোনল বন্ধ পরিবেশে গুলির শব্দ, ইঁদুরের দল মিলিয়ে গেল নিমেষে।

নতুন চেহারায় এবার বিপদ এল। এত জল বেশি এবং এত নিচে নেমে এসেছে সুড়ঙ্গের ছাদ! সেই ছাদে শরীর ঘষে যেতে লাগল। গারল্যান্ড ভেলা ঠেলে দিয়ে চলল হাতে হাত ঠেলা দিয়ে দিয়ে। ভেঙে পড়ছিল মালা একেবারে। হাতে হাত রেখে ও ঠেলতে থাকল। ভেসে চলল ভেলা জোরে। দূষিত বাতাস, ভেলাকে বুঝি ডুবিয়ে দেয় ছাদ থেকে খোঁচা খোঁচা পাথরের টুকরো। যেন কাটছে না সময়। মালা চেতনা হারাল বিবশ ভয়ার্ত হয়ে।

 ভেলা টেনে চলেছে গারল্যান্ড একাই ছাতে ছাতে ঠেলা মেরে। জল কি এখানে তবে কমে এল। কি হল? হাতে হাত ঠেকাতে হচ্ছে এবার হাত সম্পূর্ণ উঁচু করে গারল্যান্ডকে। ফাঁকায় বেরিয়ে এল হঠাৎ ভেলাটা সুড়ঙ্গ ছেড়ে। ওর শরীর জুড়িয়ে দিয়ে বয়ে গেল এক ঝলক নির্মল হাওয়া। সে বাতাসের স্পর্শ পেল।

গারল্যান্ড চেঁচিয়ে বলল, ওঠ, ওঠ, আমরা পৌঁছে গেছি মালা।

ও হ্যালোরেন সি. আই. এ. এজেন্ট ফ্রাঙ্ক হাওয়ার্ডকে দেখতে পেল মিলিটারী জেট থেকে নেমেই। মিলিটারি হেলিকপ্টারে দুজনে উঠে বসল। ওদের জন্য ডন রাইটেনা অপেক্ষা করছে অস্ট্রিয়া সীমান্তে। সব ঘটনার বিবরণ হাওয়ার্ড ও হ্যালোরানকে দিয়ে বলল গারল্যান্ড দ্বিতীয় সুড়ঙ্গে জলপথে আসবে বলে ওর ধারণা। সুড়ঙ্গের জল যে মানুষখেকো ইঁদুরে বোঝাই ও সেকথাও বলল। তদারকী করছে এদিকে মালিক স্মেরনফ। অনেক বিপদ।

অবিচলিত এবং নিরুদ্বিগ্ন ভাবে ও হ্যালোরান বলল, আমি গারল্যান্ডকে জানি। ও বেরিয়ে আসবেই একশো ডলার বাজি রেখে বলছি।

গারল্যাণ্ডের কথা আমি অনেক শুনেছি, তাই বাবা আমি বাজি রাখছি না।

উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল মালিক, ঘণ্টারও বেশী সময় লেগেছে ওর এখানে আসতে। তৎপরতা বেড়ে উঠছে বলে মনে হচ্ছে অস্ট্রিয়ান সীমান্তে চলাফেরার। ও নিশ্ৰুপে এপারে আসছে অসামান্য সাহসে, সন্তপর্ণে, ঝোঁপ জঙ্গলে অস্ট্রিয়ান শাস্ত্রীদের চোখ এড়িয়ে শিকারী বাঘের মত সাবধানে। আকাশ ফরসা হচ্ছে কারণ ভোর চারটে বেজে গেছে।

জঙ্গল এখন নিস্তব্ধ। খনির সুড়ঙ্গের মুখ দেখা যাচ্ছে। এই মুখ দিয়ে বেরুবে গারলাণ্ড। পিস্তলের পাল্লার বাইরে এই জায়গাটা মালিকের। তার মানে আরো কাছে এগুতে হবে মালিককে। ঝোপে ঢাকা রয়েছে বাঁ দিকের সুড়ঙ্গের মুখের একটি টিলা। পিস্তল ছোঁড়া চলবে ওখান থেকে। ঝোঁপের পিছনে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল মালিক ছুটে গিয়ে টিলায় উঠে।

গলার আওয়াজ পাওয়া গেল সৈন্যদের আবার জঙ্গলে। অস্ট্রিয়ান সৈন্যরা গুলির শব্দে ছুটে আসবে ও যদি গারল্যাণ্ডকে গুলি করে সেটাই মালিকের হঠাৎ খেয়াল হল। আর ফেরা হবে না মালিকের। তার মানে খালি হাতে মারতে হবে গারল্যাণ্ডকে। ও ধরে সেই শক্তি। দাঁড়ানো যাক তবে সুড়ঙ্গের মুখে গিয়ে। ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে মালিক যেই গারল্যাণ্ড বেরোবে। নেমে এগিয়ে চলল ও টিলা থেকে।

তীরে ঠেকল এসে ভেলা। শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছে ভোরের বাতাস, দেখা যাচ্ছে দিনের আলো। গারল্যাণ্ড টেনে তুলল মালাকে। পাড়ে টেনে তুলল ভেলাটিকে। গারল্যাণ্ড উঠল কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে দম নিয়ে, খুলে নিল মেলার সঙ্গে বাঁধা রুকস্যাক। বিপদ কাটেনি এখনো। সশস্ত্র শাস্ত্রী আছে কিনা এ সীমান্তে, তাই বা কে জানে যে কোনো গ্রাম বা শহর আছে কি না।

গারল্যান্ড দাঁড় করাল টেনে মালাকে। খানিকটা আছে এখনো সুড়ঙ্গ। জলশূন্য তবে তা নীল আকাশের আভাস সুড়ঙ্গের মুখে। গারল্যান্ড বলল রুকস্যাক ও রাইফেল নামিয়ে রেখে, এখানে থাক তুমি, বেরুনো নিরাপদ হবে কিনা তা আমি একটু দেখে আসি।

ও দাঁড়াল সুড়ঙ্গের মুখে। চারপাশ বড় শান্ত নিস্তব্ধ। দীর্ঘ ঘাসের ছায়া কাঁপছে। সাদা মেঘ অলস মন্থরতায় ভেসে চলেছেনীল আকাশে। গারল্যাণ্ড থমকে গেল আশ্বস্ত হয়ে মালাকে ডাকতে গিয়ে। একটি পায়ের ছাপ বালির ওপর সামনে, আর কোনো ছাপ যে নেই সেটা ভাল করে দেখল। তবে কেউ এখান দিয়ে গেছে। ছাপটি ডেবে বসেছে বালিতে। যার পায়ের ছাপ এটি সে নিশ্চয় খুব বিরাটকায়, বলিষ্ঠ এবং তার দেহের ওজন খুব ভারি।

নিশ্চয় মালিকের পায়ের ছাপ এটি। এমন সর্বনেশে ঝুঁকি কেউ নেবে না মালিক ছাড়া।

ও ফিরে এল মালার কাছে। বলল, ঝামেলা বাধবে বোধহয়। আমাদের জন্য মনে হচ্ছে ওঁত পেতে বাইরে রয়েছে মালিক।

 আতঙ্কে ওর হাত চেপে ধরল মালা। গারল্যাণ্ড বলল, আমরা জিতবই, তুমি ঘাবড়িও না। রাইফেল চালিয়েছ কখনো, নিশ্চয় চালাওনি। চালানো খুবই সোজা, তুমি এটা রাখো। ট্রিগার টিপবে এই ভাবে ধরে। পর পর চলবে কুড়ি রাউণ্ড গুলি, বাইরে যাচ্ছি আমি। তুমি আকাশের দিকে রাইফেলের নল উঁচিয়ে ট্রিগার টিপবে যেইমাত্র আমি বেরোব। মালিকের সময় লাগবে কোত্থেকে গুলি আসছে সেটা বুঝতে। আমি হদিশ পেয়ে যাব মালিকের। সতর্ক হতে পারবে সীমান্তের সৈন্যরাও।

 তখনো ওর কথা শেষ হয় নি, সেই সময় পিস্তল হাতে মালিক সুড়ঙ্গের মুখে দাঁড়িয়ে বলল, গারল্যান্ড নড়ো না।

রাইফেল ফেলে দিল মালা ভয়ে আর্তনাদ করে। মুখে হাসি নিয়ে গারল্যাণ্ড বলল, মালিক আঁচ করেছিলাম আমি যে ধারে কাছেই তুমি আছ। ঝুঁকি তুমি বেশী নিচ্ছ না কি যে বর্ডার টপকে এসে।

মেয়েটা এখানেই থাকুক, বেরিয়ে এস।

মগজ ছুটে চলল গারল্যাণ্ডের। করছে না কেন মালিক ওদের গুলি, স্বচ্ছন্দে তো করতে পারত। সিধে জবাব, বর্ডারের এপারে এসে গুলি করলে ও নিজে ফাঁদে পড়বে। ওর সাহস হবে না গুলি করার। ও বলল, মালিক, চলে যাও, বরাতজোর থাকলে পালাতে পারবে! জলদি!

বেরিয়ে এস, বলেছিলাম না আবার দেখা হলেই সেটা শেষ মোলাকাৎ হবে।

 মালিক ঝাঁপিয়ে পড়ল চলমান দানবের মত। গারল্যাণ্ড ধারণাও করেনি যে অত দ্রুত ছুটে আসবে ও। ও গারল্যান্ডকে মাটিতে চিৎকরে ফেলে দিল, উঁচু থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাতের পিস্তল ফেলে দিয়ে। মালাকে ফেলে দিল তারপর লাথি মেরে।

মালিকের থাবা দুটো চেপে বসছে গারল্যান্ডের কণ্ঠনালীতে। গারল্যান্ডের চেয়ে দশ কিলোগ্রাম রেশী লোকটার ওজন। দম চলে যাচ্ছে এবং পিষে যাচ্ছে গারল্যান্ড। ওর শেষ শক্তি দিয়ে সাংঘাতিকের সাংঘাতিক ক্যারাটে ঘা হানল ও মালিকের ঘাড়ে। হাত শিথিল হয়ে খসে পড়ল মালিকের। গারল্যান্ডের মুখ লক্ষ্য করে ও একটু পিছিয়ে ঘুষি চালাল। মাথা সরাল গারল্যান্ড ঠিক সময়ে। মাটিতে আছড়ে পড়ল মালিকের মুষ্ঠিবদ্ধ হাত। মালিক যন্ত্রণায় খাস টানল। চুরমার হয়ে গেল হাতের হাড় ভেঙে।

গড়িয়ে সরে গেল গারল্যান্ড। পরস্পরের দিকে চেয়ে রইল দুজনে শুয়ে। উঠে দাঁড়াল মালিক, ওর হাতটা অকেজো হয়ে গেছে। সর্বশক্তি নিঃশেষ গারল্যান্ডের। মালিক গারল্যান্ডের মুখের উপর বুটসুদ্ধ পা তুলল। একটা পাথর নিতে গেল তারপর জুতো নষ্ট করেছে ভেবে। ভেঙে দেবে গারল্যান্ডের মাথার খুলি। পরক্ষণেই থেমে গেল।

অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মালা। মালিক লক্ষ্য।

গারল্যান্ড চেঁচাল, মালা ওকে মেরো না।

 মারবই।

থামো।

উঠে দাঁড়িয়ে গারল্যান্ড, মালার হাত থেকে রাইফেল নিল। তাকিয়ে আছে মালিক, এবারে ওকে মারবে গারল্যান্ড। ফুলে উঠছে বাঁ হাত। কিন্তু নির্বিকার শীতল মালিকের পাথর পাথর মুখ।

গারল্যান্ড মাথা নেড়ে বলল, কমরেড, ঠাণ্ডা হও। তোমার আমার একই অবস্থা তাই আমি গুলি করব না। আমরা গাধার মতো ফাঁদে পড়ি পরের হুকুমে। চলে যাও এই ভেলা করে। অবশ্য ইঁদুর থাকলেও আমি যখন পেরেছি তুমিও পারবে।

মালিকের সবুজ চোখে বিস্ময়, তোমায় আমি মারতে এসেছিলাম তবুও।

বড় বেশী গুরুত্ব দাও তুমি কাজকে। আমায় মারতে চেয়েছিলে তুমি। আমাকেও তার মানে তোমায় মারতে হবে এটা নিশ্চয় নয়। পালাও।

চেয়ে রইল মালিক। বলল, আমাদের আবার দেখা হলে একসঙ্গে বোতল খুলব।

মালিকের এটা ধন্যবাদ জানানোর ভাষা বলেই বুঝল গারল্যান্ড। ও হেসে মালিকের পিস্তল ফিরিয়ে দিল এবং বলল, যেতে পারবে না পিস্তল না থাকলে, কারণ এর আওয়াজে ইঁদুররা ঘাবড়ায়।

তুমি পাগল বলেই জেনে এসেছিলাম, যদিও এখন সে বিষয়ে নিশ্চিত হলাম।

পাগল আমরা দুজনেই কারণ পাগল না হলে এরকম কাণ্ড কারখানা কেউ করতাম না।

গুলি আছে পিস্তলে?

পিস্তল রেখে লাভ হত কিছু যদি গুলি থাকত।

আমায় তুমি পিস্তল দিচ্ছ গুলি সুদ্ধ।

বাপু পালাও, যেতেই পারবে না পিস্তল না থাকলে। একই পেশার লোক আমরা দুজনেই। নোংরা একইরকম পাপচত্রে কাজ করি দুজনেই। নাও, পারবনা কি দুজনেই ভুলে থাকতে বদমাশ ওপরওয়ালাদের।

পিস্তল নিতে মালিক, চেঁচিয়ে উঠল মালা। গারল্যান্ড বললে, আমরা দুজনেই যবনিকার ওপারে দাঁড়িয়ে আছি, তাই ভয় পেও না। গুড লাক মালিক। সেটা একটা ভুল বলে ধরতে হবে।

রাইফেল রেখে চলে গেল ওরা রুকস্যাক নিয়ে। নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল মালিক।

গারল্যান্ড ঢুকল ডোরীর প্যারিসের অফিসে। বলল, অ্যালসার কেমন জ্বালাচ্ছে?

অস্ট্রিয়ার জেলে পচতে তুমি যদি তোমায় আমি ধরিয়ে দিতাম গারল্যান্ড।

 হাসিতে ফেটে পড়ল গারল্যান্ড। বলল, এই ধাপ্পায় ডোরী পাঁচ বছরের খোকাও ভুলবে না। সাহস করবে না তুমি আমায় ধরতে, এটা তুমি জান। আমি সব ফাঁস করে দিতাম ধরালেই। চাকরিটি যেত তোমার। আমি ফাঁদে পড়েছিলাম কারণ তুমি আমায় ফাঁদে ফেলেছিলে। তুমি একবারও ভাবনি আমার কি হবে। এবার তুমি শোধ নিতে গিয়েছিলে গতবার তোমার মাথায় হাত বুলিয়েছিলাম। আমি ভেবে দেখলাম তখনই যখন তুমি আমার হাতে একটি টপ সিক্রেট ডকুমেন্ট গছিয়েছ উজবুকের মত। শেষে ঠিক করলাম যে তোমাকেই ফিরিয়ে দেব। তুমি একটা বিবেকবান উজবুক। তুমি কাজ ভালোই কর। পরের লোকটা হয়তো আরো বেশী উজবুক হবে যদি তুমি কাজ খোয়াও। তোমার ডকুমেন্টটা নাও, এটা আমি নিয়ে বেরিয়ে এসেছি প্রাগ থেকে। যদিও ভীষণ দুঃসাধ্য কাজ তবুও ভেবেছিলাম তোমাকে দেব তাই দিলাম।

ডোর নিশ্চিন্ত হল ডকুমেন্ট খুলে দেখে। বলল, বল কি চাও?

 হাবড়া হয়ে গেলে না কি বুড়িয়ে? ও কাগজ তোমার হাতে এনে দিতাম আমি দাঁত কষাকষির মন থাকলে?

তোমার বেজায় টাকার লোভ গারল্যান্ড আমি জানি, কিন্তু আমি তো ধনী নই, রফা করবে বিশ হাজার ডলারে।

এখনো ভয় আমি সব ফাঁস করে দেব বলে? তুমি হচ্ছ আমার তরকারীতে নুন, বুঝলে বুড়ো ছাগল। আমি আছি প্যারিসে, এ আমি ভাবতেই পারিনা যে তুমি আমার কাছে ছুটে আসছ বোকামি করে। প্যারিসে থাকবেটা কে, তুমি না থাকলে? এটা কি হয় যে আইফেল টাওয়ার নেই অথচ প্যারিস আছে। মনে রেখো তখন খেলা খতম করে দেব পরের বার যদি আমায় ফাঁদে ফেলতে চাও।

ধন্যবাদ আর হবে না মনে রাখব।

পেয়েছিলে এই ত্রিশ হাজার ডলার। তার কি হল?

 হাসিতে ফেটে পড়ে গারল্যান্ড বলল, ডোরী সেই আদি ও অকৃত্রিম। তোমারও কোনো পরিবর্তন মেই আইফেল টাওয়ারের মত।

বেরিয়ে এল ও।

মালা ও গারল্যান্ডের দামী ডিনার খাওয়া হল প্যারিসের সবচেয়ে দামী রেস্তোরাঁয়। মালাকে নরমান্ডি হোটেলে ঘর ঠিক করে দিয়ে সেই ঘর ফুলে ফুলে সাজিয়ে দিয়েছে ও। এমন সুন্দর সুখের জীবন পাবে বলে মালা ভাবেনি। ও অশেষ খাণী গারল্যান্ডের কাছে। গারল্যান্ড মালাকে ওয়ারদিংটনের টাকার কথা বলল ডিনার শেষ করে। বলল, টাকা পাবে জেনিভার ক্রেডিট সুইস ব্যাঙ্কে প্রমাণপত্র দাখিল করলেই। ষাট হাজার ডলার, কম নয়।

দিয়ে গেছে আমাকে। সত্যিই ভালোবেসেছিল ও আমাকে। আমি কিন্তু পারলাম না। আমি কি করব এত টাকা নিয়ে?

একাই বা থাকবে কেন বেশী দিন, টাকাটা ব্যাঙ্কে খাটাবে।

 আমরা একসঙ্গে এত সুখে, তুমি এসো না জেনিভায়।

আমি একা থাকতে ভালবাসি সোনা তাই একাই থাকব।

চোখে জল ভরে উঠল মালার, তাই দুঃখ হল গারল্যান্ডের। তা ওর বোঝা উচিত ছিল যে মালা ওকে ভালবাসবে। জেনিভায় মালা নতুন জীবন শুরু করতে পারে কারণ ওর টাকা আছে, বয়স আছে।

বেরিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে ওরা ট্যাক্সিতে উঠল। এক নিরানন্দ বিষণ্ণতা সন্ধ্যার আনন্দে, ব্যথায় ভারি আসন্ন বিদায়ের।

মালা হোটেলে পৌঁছে বলল, আসবে না ওপরে?

কাল তুমি জেনিভা যাচ্ছ। আমি আর যাব না, তোমার প্লেনের টিকিট নাও, বেছে নিও নিজের মনোমত জীবন। তোমাকে একা থাকতে হবে কেন? তোমার রূপ আছে, টাকা আছে। ভুলে যাও আমার কথা। আমি সুখী করতে পারিনা কোনো মেয়েকে।

মালা নেমে গিয়ে ধন্যবাদ জানাল। হোটেলে পেছন ফিরে ধীরে ঢুকল ও। ওর যৌবন উচ্ছল শরীরে ঢেউয়ের পর ঢেউ দেখল মালা।

ট্যাক্সি ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাব এখন?

তখনো মালাকে দেখছে গারল্যান্ড। ওর হঠাৎ মনে পড়ল গুহার সেই রোমাঞ্চকর সহসা আশ্চর্য অভিজ্ঞতার কথা।

মালার সেই অস্ফুট আর্তনাদ নিজেকে নিঃশেষ করে দিতে দিতে। প্রবল উত্তেজনার তরঙ্গ তুলল ওর শরীর ভাসিয়ে। আবার চাই মালাকে।

কোথায় যাব, কোথাও না। ও নেমে পড়ল ড্রাইভারের হাতে দশ ফ্রার নোট গুঁজে দিয়ে তারপর হোটেলে ঢুকল।

গারল্যান্ড গিয়ে পাশে দাঁড়াল, মালা নিচ্ছে ওর ঘরের চাবি।

মালা মুখ ফিরিয়ে ওর চোখের দিকে তাকাল। ওর হাত তারপর হেসে জড়িয়ে ধরল। লিফটের দিকে দুজনে এগিয়ে গেল।