কুব্জাম্রকের মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে জন্মান্তরের খেলা
কুব্জাম্রক নামে একটা নির্জন স্থান ছিল। সেখানে একটা বিষ্ণু মন্দির ছিল। সেখানে প্রত্যেকদিন বহু ভক্ত আসত বিষ্ণুর পূজা করতে। সেই মন্দিরের একটি কোণে একটি গর্তে সাপিনী থাকত। ভক্তরা পূজার জন্য অনেক ফলমূল আনত। তারা সেই ফলমূলের খোসাগুলো মন্দিরের পাশে ফেলে দিত। সাপিনী সেইগুলো খেয়ে বেঁচে থাকত।
একদিন দুপুরে সবাই পূজা করে চলে গেল। সবাই যখন চলে গেছে তখন সাপিনী গর্ত থেকে বেরিয়েছে। সে বারান্দার দিকে খেতে খেতে চলে এসেছে। এমন সময় ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এল এক নেউল। সাপে নেউলে চিরকালই শত্রুতা, কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। দুজনের দেখাদেখি হতেই বাঁধল লড়াই। উভয়ে উভয়কে কামড় দিল। নেউলের কামড়ে সাপিনী টুকরো টুকরো হয়ে শেষ হয়ে গেল। আর সাপিনীর কামড়ে নেউলেরও সেই একই দশা হল।
পরের দিন ভক্তরা এসে দেখল মন্দির প্রাঙ্গণ রক্তারক্তি হয়ে আছে। আর একটা মরা নেউল ও একটা সাপ টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে।
তারপর অনেক কাল কেটে গেল, সে ঘটনাও সবাই ভুলে গেল।
কোশলের রাজপুত্র রূপে অতুলনীয় ছিলেন এবং তিনি নানা বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন।
প্রাগ জ্যোতিষপুরের রাজকন্যা রূপে, গুণে, নাচ-গানে অদ্বিতীয়া। ভাগ্যচক্রে রাজকন্যা কোশল রাজকুমারকে পতিরূপে লাভ করলেন। নানা ভোগবিলাসে তাঁদের সময় কাটতে লাগল। বনে উপবনে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন দুজনে। এই বয়সে আনন্দ উপভোগ করা ছাড়া আর করবেই বা কি?
একদিন দুজনে উপবনে একটি গাছের গোড়ায় বসে গল্প করছেন। রাজপুত্র দেখলো একটা সাপিনী একটু দূরে দিয়ে চলে যাচ্ছে।
রাজকুমার তাকে দেখেই লাফিয়ে উঠলো। আর হাতে একটা পাথর তুলে নিয়ে সেই সাপিনীকে মারতে উদ্যত হলো।
এই দেখে রাজকন্যা রাজকুমারের হাত চেপে বললো একি? তুমি ওই নির্দোষ সাপিনীকে মারতে চাইছো কেন? সে তোমার কি ক্ষতি করেছে। সে তো তোমাকে দংশন করতে আসেনি যে, তুমি তাকে মারবে।
রাজকন্যার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে রাজকুমার বললেন–সাপ হিংসুটে প্রাণী। সাপকে কখনও ছেড়ে দিতে আছে? কামড়ালে আর রক্ষা থাকবে না।
রাজকুমার এই কথা বলে সাপিনীর মাথা লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ে মারলেন। পাথরের আঘাতে সাপিনীর মাথাটা একেবারে থেঁতলে গেল। ছটফট করতে করতে সে মারা গেল।
রাজকুমারের ব্যবহারে রাজকন্যা খুব দুঃখ পেলো তিনি ঠিক করলেন সে স্বামীর সঙ্গে কথা বলবেন না। তিনি একপাশে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকেন।
এমন সময় ঝোঁপ থেকে একটা নেউল বেরিয়ে এল। দেখামাত্র রাজকন্যা একটা পাথর তুলে মারতে উঠলো তাকে।
রাজকুমার বাধা দিয়ে বললো ও কি! তুমি নেউলটাকে মারতে যাচ্ছ কেন? ও কি তোমার ক্ষতি করেছে।
রাজকন্যা রাজপুত্রের কথার কোনো উত্তর দিলো না। তিনি সেই পাথরটি ছুঁড়ে মারলো। নেউলটার মাথা চৌচির হয়ে গেল। শেষ হল তাদের বেড়ান।
রাজকুমার খুব রেগে গেলো। বললো–তোমাকে নিষেধ করলাম। তুমি আমার কথার কোন উত্তর দিলে না, আমাকে অগ্রাহ্য করে তুমি নেউলটাকে মেরে ফেললে।
এসব রাজকন্যা উত্তর দিলো। আমি ও তো সাপিনীকে মারতে বারণ করেছিলাম, তুমি শুনেছিলে আমার কথা।
রাজকুমার বললো–আমি এদেশের রাজা, কাকে কি সাজা দেবো সেই যোগ্যতা আমার আছে। আমি একটা হিংসুটে প্রাণীকে মেরেছি। আর তুমি নিরীহ প্রাণীকে মেরেছ। আমাকে তুমি নীতিকথা শেখাতে যেও না।
এইভাবে শুরু হল দুজনের মধ্যে বাগবিতণ্ডা, কেউ কম যান না। শেষে রাজকুমার বললো, আমি তোমার মুখ দেখতে চাই না।
রাজকন্যা ভাবলো ঠিক হল, আমি ও চাই না এমন স্বামীর মুখ দেখতে।
প্রাসাদে তাঁরা দু’জনে আলাদা আলাদা ভাবে ফিরে গেলো। দুজনের আলাদা ঘরে শয্যা পাতা হল। কেউ কাউকে দেখতে চান না। রাজকুমার এদিকে যান তো রাজকন্যা ওদিকে।
রাজবাড়ির সবাই জানতে পারলো রাজকুমার ও রাজকন্যার ব্যাপার। কিন্তু এর কারণ কি তারা জানতে পারল না। দুজনের মধ্যে কি নিয়ে যে গন্ডগোল তা কেউ বুঝতে পারল না।
ব্যাপারটা কোশলরাজ জানতে পারলেন। রাজা তো অবাক, ছেলে তার সবদিক দিয়েই সুন্দর। বধূমাতাও তাই। তাহলে তাদের মধ্যে আমোদ-আহ্লাদ নেই কেন। তারা কথাবার্তাও বলে না। এমনকি দেখাদেখি বন্ধ।
একদিন কোশলরাজ রাজপুত্র ও বধূমাতাকে ডেকে পাঠালেন। মুখ তাদের কাছে পুরো ব্যাপারটা জানতে চাইলেন। রাজকুমার সব কথাই বললো। রাজা সব শুনে হাসলেন, বললেন–এই সামান্য একটা ব্যাপারে তোমরা একে অপরের সঙ্গে কথা বল না। বউমার তো কোনো খারাপ ব্যবহার দেখিনি। স্বামী-স্ত্রী একটু আধটু ঝগড়া করে থাকে। কিন্তু এমন রাগ দেখিনি।
রাজকুমার বললো–কথা আপনিই ঠিক বলেছেন। আমি ওর স্বামী। আমি যখন বারণ করেছি, তখন ও আমার কথাকে অগ্রাহ্য করল কেন? যে নারী স্বামীর অবাধ্য হয়, সে স্বামীর কি ভাল লাগে।
রাজকন্যা বললো–আমারও একই বক্তব্য, আমিও নিষেধ করেছিলাম সাপিনীকে মারতে, তা উনিও শোনেন নি। আমিও তো ওনার স্ত্রী, আবার এই রাজ্যের ভাবী রানি। আমাকে অগ্রাহ্য করার অর্থ হল আমাকে অপমান করা।
দুজনের কথা শুনে কোশলরাজ অবাক হয়ে গেলেন। ভাবলেন এই একটা তুচ্ছ ব্যাপারে এমন হতে পারে না। এর আড়ালে নিশ্চয় কোনো রহস্য আছে।
তারপরে রাজকুমারকে ডেকে বললেন–বল কুমার আসল ব্যাপরটা কি? আমার মনে হচ্ছে তুমি কোন কথা গোপন করছ।
রাজকুমার বললেন–এখানে তা বলা যাবে না। কুব্জাম্রকে বলতে হবে।
রাজা বললেন–সেটা তো তীর্থক্ষেত্র, কিন্তু সেখানে যেতে হবে কেন? আমি তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।
কুমার বললো–সেখানে না গেলে কোনো কথাই বলা যাবে না। আর একটা কথা সেখানে আমরা গেলে আর ফিরে নাও আসতে পারি। তাই ছোট ভাইকে সিংহাসনে বসিয়ে তবে আমরা সেখানে যাব।
কোশলরাজ বললেন–বড় থাকতে ছোটকে সিংহাসনে বসানো কি উচিত হবে?
কুমার বললো–আমার রাজ্যে কোনো লোভ নেই, আপনি ছোট ভাইকে সিংহাসনে বসাতে পারেন।
তারপরে রাজা কোনো উপায় না দেখে মন্ত্রীদের ডেকে ছোট ছেলেকে সিংহাসনে বসালেন। তারপরে রাজা-রানি, কুমার, বধূমাতা আরও লোকজন নিয়ে সকলে কুজাম্রের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
সেখানে স্নান করে বিষ্ণু মন্দিরে পূজা দিলেন। তারপরে সকলে বসলেন সেই মন্দিরে।
তারপরে রাজকুমার ও রাজকন্যা তাঁদের পূর্বজন্মের কথা বললেন। তাঁরা পূর্বে সাপিনী ও নেউল ছিলো। এখনো তাঁরা কেউ পূর্বজন্মের আক্রোশের কথা ভুলতে পারেননি।
কাহিনি শুনে সবাই অবাক। সেখান থেকে কুমার ও রাজকন্যা চলে গেলো পৌণ্ডরীক তীর্থে। সেখানে বহু সাধনার পর দিব্য ধামে গমন করলো। আর রাজা রানি মায়াতীর্থে গিয়ে বিষ্ণু সাধনায় রত হলেন।