৬. কুঠিবাড়ির খাওয়াদাওয়া উঁচু থাকের

অধ্যায় ৬

বলতে নেই, কুঠিবাড়ির খাওয়াদাওয়া বড্ডই উঁচু থাকের। সকালের জলখাবার থেকে নৈশভোজ, সবক’টাই রাজকীয় বললেই হয়। খগেন মাল খাইয়ে মানুষ, উপেন হাজরার মতো পেটরোগা নয়। কিন্তু এই চল্লিশের চৌকাঠে এসে সে টের পায় যে, একটু নেয়াপাতি ভুঁড়ির আভাস যেন পাওয়া যাচ্ছে। যদিও এখনও খগেনের চেহারা পালোয়ানের মতোই, রীতিমতো ডনবৈঠক করা শরীর। কিন্তু এত সুখাদ্যের ঠেলায় যে শরীর বেশিদিন এমন থাকবে না, তাও সে জানে। তাই ইদানীং প্রাতঃভ্রমণের মাত্রাটা বাড়াতে হয়েছে। মাইলপাঁচেক হাঁটে, তারপর ফিরে এসে ডনবৈঠকও করে।

আজ সকালেও বেরিয়েছিল। সাবধানের মার নেই বলে আজ কাঁধে বন্দুকটাও নিয়েছিল। অবশ্য তার ভয়ডর বরাবরই কম। খুব চোটেপাটে হাঁটতেই ভালবাসে সে। প্রথম চোটেই একদমে মাইলতিনেক পেরিয়ে গোহাটা হয়ে যখন কুলতলির পেল্লায় মাঠের কাছাকাছি হয়েছে, তখনই দেখল খোলকত্তাল সমেত একটা ছোটখাটো কেত্তনের দল আসছে। কেত্তন খগেনের প্রিয় জিনিস। সে নিজেও মাঝে-মাঝে একাই কেত্তন গায়। কেত্তনের দলটাকে পথ ছেড়ে দিতে সে রাস্তার ধারের দিকে সরে দাঁড়িয়েছিল। দলটা তাকে ছাড়িয়ে যেতে গিয়েও হঠাৎ একজন হাত বাড়িয়ে “আসুন দাদা…” বলে তার হাত ধরে কেত্তনে সামিল করে নিল।

এদিকে বেলা দশটা অবধি খগেন মর্নিং ওয়াক থেকে না ফেরায় লোকে খুঁজতে বেরোল। কিন্তু কোথাও তার পাত্তা পাওয়া গেল না।

বিরুবাবু আর তার তিন শিকারি বন্ধু বৈঠকখানায় বসা। বিরু গম্ভীর মুখে বললেন, “আপনারা কিছু বুঝছেন?”

গিরিধারী মাথা নেড়ে বলে, “আমি ভাল বুঝছি না। খগেনের কিছু একটা ঘটেছে। আমার পাশের ঘরটাই তো খগেনের, রোজ সকাল সাতটায় ফিরে সে ডনবৈঠক করে। কোনও কামাই নেই।”

উপেন হাজরাও মাথা নেড়ে বলে, “আমারও তাই মত।”

দুপুরে কোদণ্ড গম্ভীর মুখে এসে বসলেন। কপালের ঘাম রুমালে মুছে বললেন, “অপহরণই হয়েছে, নাকি নিজেই চলে গিয়েছেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই তো!”

বিরু গম্ভীর হয়ে বলেন, “না। খগেনবাবু আমাকে না বলে যাবেন না। তা ছাড়া তাঁর সব জিনিসপত্রও পড়ে আছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তাঁকে এখন গোকুলের ডেরায় পাওয়া যাবে।”

কোদণ্ড বলেন, “বিরুবাবু, আমাদের সার্চপার্টি গোকুলের ডেরা ঘুরে দেখে এসেছে। সেখানে নেই।”

কুঠিবাড়ির আবহাওয়াটা হঠাৎ করেই পালটে গেল। আড্ডা নেই, হাসি নেই, কথাবার্তা কমে গিয়েছে।

বিকেলের দিকে বাড়ির নিরিবিলি লনটাতে বেতের চেয়ারে বসে ছিল গুঁফো বলাই। মনটা আড় হয়ে আছে, তাই দুপুরে ভাতঘুমটা হয়নি। গাছপালায় ঘেরা লনটায় বসে ঠান্ডা হাওয়ায় বেশ ভালই লাগছিল। এমন সময় একটা ষোলো-সতেরো বছরের মেয়ে একটা চিনেমাটির বাটিতে গরম ঘুগনি এনে তার হাতে দিয়ে বলল, “গোবিন্দদা পাঠিয়ে দিলেন।”

বলাই খুশিই হল। দুপুরে খাওয়াটা জমেনি। এই পরিস্থিতিতে জমার কথাও নয়। গোবিন্দ এ বাড়ির রাঁধুনি। বড় ভাল তার রান্নার হাত। যা রাঁধে তাই যেন অমৃত। ঘুগনিটাও বড্ড ভাল বানিয়েছে। গুঁফো বলাই ভারী তৃপ্তি করে খেল। আর ঘুগনিটা পেটে যেতেই আরামে ঘুম পেয়ে গেল তার। একটু তফাতে বসে গুণেন মিস্তিরি একটা হুইল ব্যারোর ভাঙা চাকা সারাই করছিল। হঠাৎ উঠে হুইল ব্যারোটা ঠেলে নিয়ে এসে চোখের পলকে পাঁজাকোলায় বলাই জানাকে হুইল ব্যারোটায় তুলে সেটাকে গড়িয়ে নিয়ে কামিনী ঝোপটার আড়ালে রেখে এল। আর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই দুটো মুনিশ গোছের লোক একটা লতানে গোলাপের জটিল ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ব্যারোটা ঠেলে পিছনের ফটকের বাইরে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

যথারীতি বিকেল গড়াতে না-গড়াতেই চাউর হয়ে গেল খবরটা। বলাই জানা হাপিশ। বিরুবাবু রাগে গরগর করতে লাগলেন। কোদণ্ড আবার এসে দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, “আমরা সব রকম চেষ্টা করছি। ভাববেন না।”

সন্ধেবেলা নিজের জিনিসপত্র সুটকেসে গুছিয়ে ফেলছিল গিরিধারী। তার চোখেমুখে প্রবল উদ্বেগ। রাখোহরি এসে বলল, “আমাকে ডেকেছিলেন গিরিধারীবাবু?”

গিরিধারী বলে, “হ্যাঁ ভাই, কাল আমি সকালের ট্রেন ধরব। সকাল ছ’টার মধ্যে গাড়ির বন্দোবস্ত করে দাও ভাই।”

রাখোহরি অবাক হয়ে বলে, “আপনি কি চলে যাচ্ছেন?”

“হ্যাঁ ভাই, আমি হার্টের রোগী। উত্তেজনা আমার সহ্য হয় না। এখানে থাকলে আমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। আমাকে বাঁচাও ভাই।”

রাখোহরি বলল, “ঠিক আছে।”

সকালেই কথামতো রওনা হয়ে গেল বটে গিরিধারী, কিন্তু গাড়ির ড্রাইভার ফিরে এসে জানাল, রাস্তায় একটা গাছ পড়ে গিয়েছিল বলে তাকে গাড়ি থামাতে হয়েছিল। নেমে সে গাছটা সরানোর চেষ্টা করতে যায়। ফিরে এসে সে আর গিরিধারীবাবুকে খুঁজে পায়নি। তিনি গাড়িতে বা আশপাশে কোথাও ছিলেন না।

কুঠিবাড়ি আরও থমথমে হয়ে গেল।

যথারীতি কোদণ্ড এলেন। অবাক হয়ে বললেন, “এসব হচ্ছে কী বলুন তো! আমার ফাঁড়িতে স্টাফ খুব কম, তবু আমি যথাসাধ্য নজর রাখছি। গোকুলের আস্তানায় আসমানির চরে দিনরাত আমার লোক মজুত আছে। তবু তিন-তিনজন লোক হাওয়া হয়ে যায় কী করে?”

বিরুবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, “জবাবটা তো আপনাকেই দিতে হবে, কোদণ্ডবাবু।”

কোদণ্ড গভীর উদ্বেগের সঙ্গে বললেন, “এ তো ভূতুড়ে কাণ্ড মশাই! জবাব দেব কী, আমি নিজেই মাথা ঠিক রাখতে পারছি না। উপেনবাবু, আপনি একটু সামলে থাকবেন। এবার বোধহয় আপনার পালা।”

উপেন অত্যন্ত চিন্তান্বিত মুখে বলে, “আমি কাউকে সুযোগ দিতে রাজি নই। চব্বিশ ঘণ্টা সঙ্গে পিস্তল থাকে।”

“খুব ভাল মশাই। সিটিজ়েনরা নিজের দায়িত্ব নিতে শিখলে পুলিশ হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।”

কোদণ্ড চলে যাওয়ার পর দু’জনে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। চিন্তিত,উদ্বিগ্ন। অনেকক্ষণ বাদে উপেনবাবু বললেন, “নেটওয়ার্কটা খুব ভাল।”

“কার কথা বলছেন?”

“গোকুলের কথা। আপনারও কি মনে হয় না, গোকুল একজন ভাল অর্গানাইজ়ার? মৃগদাবে গিয়ে হরিণ মারার আইডিয়াটা কার ছিল বলুন তো!”

“খগেনবাবুর।”

“ভেরি কাওয়ার্ডলি আইডিয়া।”

“এখন আর ভেবে লাভ কী? তির একবার ছুড়ে ফেললে তা তো আর ফেরানো যায় না।”

“আপনি আমাকে আপনার পরামর্শদাতা হিসেবে রেখেছেন, কিন্তু কার্যত আমার পরামর্শ কিন্তু আপনি কানেই তোলেন না। আপনারা এখনও মেজাজে সামন্তই আছেন তো, তাই নিজের সিদ্ধান্তকে অভ্রান্ত ভাবেন সবসময়। আমি আপনাকে মৃগদাবে গিয়ে হরিণ মারতে নিষেধ করেছিলাম কি না!”

বীরবাহু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “হ্যাঁ, আপনি বারণ করেছিলেন। আপনার কথা শুনলে হয়তো আজ এই পরিস্থিতি হত না। কিন্তু এখন তো আমাদের পিছু হাঁটবার পথ নেই। গোকুলকে শিক্ষা দিতেই হবে। প্রথম রাউন্ডে সে হয়তো জিতে গিয়েছে, কিন্তু পরের রাউন্ডে তা হবে না।”

উপেন হাজরা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর বলল, “একটা জিনিস কি আপনি টের পান?”

“কীসের কথা বলছেন?”

“আপনি কি টের পান যে, এই কুঠিবাড়িতে আপনার প্রকৃত বন্ধু কেউ নেই?”

বীরবাহুর মুখে রাগের একটা রক্তিমাভা ফুটে উঠল। ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠলেন, “কী যা তা বলছেন? এরা বেশির ভাগই আমাদের অনেক পুরনো কর্মচারী। এরা আমার জন্য প্রাণ দিতে পারে।”

“তা হয়তো পারে। এরা যে আপনার অনুগত, তাতেও সন্দেহ নেই। কিন্তু আনুগত্যও দু’রকমের। একটা হল বেতনভুকের আনুগত্য, আর-একটা হল ভালবাসার আনুগত্য। দুটোয় অনেক তফাত। এদের আনুগত্য বেতনভুকের।”

বীরবাহু ধৈর্যচ্যুত হয়ে তীব্র গলায় বলেন, “বাজে কথা। আপনার চেয়ে ওদের আমি বেশি চিনি।”

“রাগ করবেন না। ভাল করে ভাবুন। খগেন আর গিরিধারীর কথা বাদ দিচ্ছি, কিন্তু বলাইয়ের ঘটনাটায় আমার খটকা লাগছে। তাকে এই বাড়ি থেকেই তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাও দিনেদুপুরে, সকলের নাকের ডগা দিয়ে। অথচ আপনার কর্মচারীরা সবাই বলছে যে, কেউ কিছু দেখেনি। আপনার এতগুলো কর্মচারীর কারও চোখে কিছু পড়ল না, এটা কী করে হয়? আমার তো সন্দেহ হয় অপহরণটা হয়েছে এদের যোগসাজশেই।”

বিরু প্রায় গর্জন করে উঠলেন, “অসম্ভব! হতেই পারে না!”

উপেন হাজরা চুপ করে গেল। অনেকক্ষণ বাদে বলল, “একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

বিরু অন্যমনস্কভাবে বলল, “বলুন।”

“গোকুলেশ্বর লোকটা ঠিক কেমন, জানেন?”

বীরবাহু ধৈর্য হারিয়ে বিরক্তির গলায় বলে, “একজন ডাকাত আর কেমন হবে? ডাকাতরা যেমন হয় তেমনিই। আমি তো এখানে থাকি না, মাঝে-মাঝে আসি। গোকুল সম্পর্কে আমার তেমন কিছু জানা নেই। এ কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?”

“আপনি আপনার রিম আর ঝিমের জন্য খুব টেনশনে আছেন বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার একটা কথা মনে হচ্ছে।”

“কী মনে হচ্ছে?”

“আমার অনুমান হচ্ছে, যদিও ভিত্তিহীন অনুমান, তবু মনে হচ্ছে গোকুলেশ্বর আপনার কুকুরদের মারেনি।”

বিরু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “আপনার অনুমানের উপর ভরসা করতে পারছি না। ডাকাত গোকুলেশ্বর খুব নৃশংস ছিল বলে শোনা যায়। তার দাপটে গোটা পরগনা তটস্থ ছিল। সে বদলা না নিয়ে ছাড়বে, এ কথা ভাবলেন কী করে?”

খুব মৃদু স্বরে, প্রায় স্বগতোক্তির মতো গলায় উপেন বলে, “তা হলে লোকটা কি হিপনোটিজ়ম জানে? এতগুলো লোককে কি মন্ত্রে বশ করে ফেলল! কেন আমার মনে হচ্ছে যে, এরা সবাই, এমনকী পুলিশ অবধি ওর হয়ে কাজ করছে?”

বিরু তেতো গলায় বলে, “আপনি একসময়ে পুলিশের গোয়েন্দা ছিলেন বলেই ভাববেন না যে, সব জায়গায় আপনার অনুমান খেটে যাবে। আমার লোকেরা কেউ মরে গেলেও বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, আর পুলিশও নিয়মিত আমার মাসোহারা পায়।”

উপেন গম্ভীর মুখে শুধু বলল, “হুঁ।”

সারাদিনটাই উপেন চুপচাপ রইল। চিন্তা করল। বিকেল হতেই সে উঠে পোশাক পরে বেরিয়ে পড়ল। কুঠিবাড়ির ফটকের দিকে হাঁটা ধরতেই রাখোহরি এসে পথ আটকে বলল, “কোথায় যাচ্ছেন?”

উপেন চিন্তিত মুখে বলে, “একটু বেরোচ্ছি।”

রাখোহরি উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, “সর্বনাশ!”

উপেন হেসে বলে, “ভয় পেয়ো না। আমি সাবধানি মানুষ।”

“তা জানি। কিন্তু একা বেরোনো ঠিক হবে না। দাঁড়ান, সঙ্গে ভুসিরামকে দিচ্ছি।”

“না, তার দরকার নেই। সঙ্গে লোক থাকলেই বরং সমস্যা।”

“পিস্তলটা সঙ্গে নিয়েছেন কি?”

“না হে, পিস্তল কি আর সব সময়ে কার্যকর হয়?”

উপেন বেরিয়ে পড়ল। কুলতলির মাঠটা একটু দূরে। তাড়াহুড়ো করল না উপেন, ধীরেসুস্থে দুলকি চালে হাঁটতে লাগল। পথ নির্জন, গাছপালায় ঢাকা, অন্ধকারমতো। বড় একটা ঝুপসি বটগাছতলা পেরোবার সময়েই হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন ভারী আদুরে গলায় বলল, “পেন্নাম হই কর্তা।”

উপেন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, বেঁটেমতো গোল মুখওয়ালা, গালে খোঁচা-খোঁচা দাড়িওয়ালা একটা লোক মুখে একটু বোকা হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

উপেন একটু হেসে বলে, “কে গো তুমি?”

“আজ্ঞে আমি হলুম গে গন্ধেশ্বর। তিন পুরুষের ছাগলের কারবারি। তা ছাগল খুঁজতে বেরিয়েছেন নাকি কর্তা?”

“হ্যাঁ গো গন্ধেশ্বর, আমি তো ছাগলের খোঁজেই বেরিয়েছি। তা তোমার খোঁজে আছে নাকি ভাল ছাগল?”

“তা আর নেই! কী যে বলেন কর্তা। তিন পুরুষের কারবার মশাই, সব রকমের ছাগল পাবেন।”

উপেন একটু গম্ভীর হয়ে বলে, “দেখো গন্ধেশ্বর, তোমার ওই মরফিন ইনজেকশনের দরকার নেই কিন্তু। আমি নিজেই যাচ্ছি চলো।”

গন্ধেশ্বর ভারী লজ্জা পেয়ে বলে, “কী যে বলেন কর্তা! আপনি হলেন বিবেচক মানুষ, এরকম মানুষের সঙ্গে কাজ কারবার করে সুখ আছে। কী বলেন?”

“তোমাকে দেখেও বেশ হুঁশিয়ার লোক বলে চেনা যায়।”

“তা দিনকাল যা পড়েছে কর্তা, হুঁশিয়ার না হয়ে উপায় আছে? তা এই বড় রাস্তাটা ছেড়ে ওই বাঁদিকের শুঁড়িপথটা ধরলে পথ একটু কম হবে কর্তা।”

“তুমি যা বলবে। এখন তো তোমার হুকুমেই চলতে হবে, কী বলো?”

লজ্জায় জিব কেটে গন্ধেশ্বর বলে, “কী যে বলেন কর্তা, লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। গরিবের আস্তানায় একটু পায়ের ধুলো দিতে যাচ্ছেন বই তো নয়! কত ভাগ্যি আমার বলুন!”

উপেন খুশি হয়ে বলে, “না হে, তুমি সহবত জানো বটে!”

সারারাত বীরবাহুর ঘুম হয়নি। এপাশ-ওপাশ করে রাত কেটেছে। সকালে এসে যখন বৈঠকখানায় বসলেন তখন শরীরে গভীর ক্লান্তি, মনে আদিগন্ত হতাশা। সকালের নরম আলোটাও চোখে অসহ্য লাগছে।

রাখোহরি এসে সামনে দাঁড়াল, “আমাকে কি ডেকেছিলেন, বিরুবাবু?”

“হ্যাঁ, রাখোহরি। তুমি অনেকদিন আমার সঙ্গে আছ, বন্ধুর মতোই মিশেছ, তোমাকে আমি বিশ্বাসও করি সবচেয়ে বেশি। আমাকে একটা কথা বলবে?”

“কেন বলব না? কথাটা কী?”

স্থির দৃষ্টিতে রাখোহরির চোখে চোখ রেখে বিরু বলেন, “অকপটে বলবে তো? মনরাখা কথা নয় কিন্তু!”

“না, মনরাখা কথা বলার সময় বোধহয় এটা নয়।”

“তা হলে বলো তো, আমি কি হেরে গিয়েছি?”

রাখোহরি কিছুক্ষণ নতমুখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল, “সব খেলায় কি জিত হয় বিরুবাবু? হারজিত তো আছেই।”

আরও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিরু বলেন, “বুঝেছি রাখোহরি। তোমাকে ধন্যবাদ। এবার আমাকে বেরোতে হবে।”

রাখোহরি কোমল গলায় বলে, “কোথায় যাবেন?”

“আগেকার দিনে নিয়ম ছিল, হেরে গেলে হার স্বীকার করতে হয়।”

রাখোহরি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “ঠিক আছে, বিরুবাবু।”

ঘণ্টাখানেক বাদে আসমানির চরে বীরবাহুর নৌকো এসে লাগল। বীরবাহু নৌকো থেকে নামলেন। তারপর মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলেন আসমানির চরের সৌন্দর্যের দিকে। সকালের আলোয় আসমানির চর ভেসে যাচ্ছে, চারদিকে সবুজের বন্যা। এত পাখির ডাক যেন কোনওদিন শোনেননি তিনি। কী শান্ত, সমাহিত এক সকাল। সামনে সোনালি একটুখানি বালিয়াড়ি, তারপর আশ্চর্য তৃণভূমি। নির্ভয়ে বিচরণ করছে হরিণ আর হরিণ। একটা হরিণ তৃণভূমি থেকে তার মায়াবী চোখ তুলে দেখছিল বীরবাহুকে। চোখে কোনও ঘৃণা নেই, অসূয়াও নেই। বীরবাহু ধীরে ধীরে বালিয়াড়ির ঢাল বেয়ে উঠতে লাগলেন। বনভূমির ভিতর দিয়ে একটা পায়ে চলার পথ ভিতরের দিকে চলে গিয়েছে।

বনভূমিতে ঢোকার ঠিক মুখেই বেঁটেখাটো খোঁচা-খোঁচা দাড়িওয়ালা হাসিমুখের একটা লোক ভারী আহ্লাদের সঙ্গে বলে উঠল, “পেন্নাম হই কর্তা। আমি হলুম গে গন্ধেশ্বর। ছাগলের কারবারি কর্তা। তিন পুরুষের কারবার। এই যে এদিকে সটান চলে আসুন। কোনও ভয় নেই।”

বেশ অনেকটা হেঁটে গেলে মৃগদাব, বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। তার ভিতর দিয়েই পায়ে চলার পথ। শেষে একটা ঘাসে ঢাকা বড় উঠোনের মতো। সেখানে সবুজ ঘাসের উপরেই আসনপিঁড়ি হয়ে বসে আছে দীর্ঘকায়, ছিপছিপে চেহারার শ্যামবর্ণ একজন মানুষ। গালে অল্প দাড়ি আর গোঁফ, কাঁধ পর্যন্ত কালো চুল, আর অপরূপ হরিণের মতোই টানা-টানা দুখানি চোখ। বয়স বেশি নয়, চল্লিশের আশপাশে। গায়ে একটা সাদা উড়ুনি, পরনে খাটো ধুতি। আর আশ্চর্য কাণ্ড হল, তার দু’পাশে বসে আছে বশংবদ দুটি কুকুর। রিম আর ঝিম। তারা বীরবাহুর দিকে তাকালও, কিন্তু চিনতে পারল বলে মনেই হল না। জীবনে এত অবাক বোধ হয় বীরবাহু কখনও হননি। তাঁর দিকে চেয়ে মন্দ্রস্বরে গোকুলেশ্বর বলল, “বোসো বিরুবাবু। মাটিতে বসতে যদি আপত্তি থাকে, তা হলে চেয়ারেরও ব্যবস্থা আছে।”

বিনা বাক্যব্যয়ে ঘাসের উপরেই বসে পড়লেন বীরবাহু। নিষ্পলক চোখে গোকুলেশ্বরের দিকে চেয়ে রইলেন।

গোকুলেশ্বর অনুত্তেজিত গলায় বলে, “জমির দলিল কখনও মন দিয়ে পড়েছ, বিরুবাবু? দলিল বড় জটিল ভাষায় লেখা হয়। তবু পড়ে দেখো, জমির মালিক তুমি নও, সরকার। সরকার তোমাকে ভোগদখলের অধিকার দিচ্ছে মাত্র। তুমি উপস্বত্ব ভোগকারী। তলিয়ে ভাবলে জমির মালিক সরকারও নয়, উপরওয়ালা। সুতরাং আসমানির চর তোমারও নয়,আমারও নয়। ভাল করে ভেবে দেখো, তোমার ছেলেমেয়েও কি তোমার? তুমি সৃষ্টিকর্তা তো নও, জন্মদাতা মাত্র। তারাও ওই উপরওয়ালার। তুমি বা আমি রক্ষক মাত্র, যাকে ইংরেজিতে বলো ‘কাস্টোডিয়ান’। আমি তো অনেক পাপ করেছি, লুটতরাজ করেছি, নিয়েছি অনেক। এবার ফিরিয়ে দেওয়ার পালা। তাই দিচ্ছি বিরুবাবু। আসমানির চরে আমি গাছ লাগাই, পশুপাখি পেলেপুষে রাখি। চারদিকে জঙ্গল কমে যাচ্ছে, ওরা তাড়া খেয়ে খেয়ে এখানেই এসে জোটে। ওদের তো দলিল-টলিল নেই, কোথায় যাবে বলো তো!”

বীরবাহু চুপ করে রইলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হচ্ছে, তিনি হেরে গিয়েছেন বটে, কিন্তু খুব একটা গ্লানি বোধ হচ্ছে না তো!

গোকুলেশ্বর শান্ত গলায় বলল, “তোমার বন্ধুদের নিয়ে যাও বিরুবাবু। কিন্তু তোমার কুকুরদুটির বড়লোকের গুপ্তধন পাহারা দেওয়ার চেয়ে অনেক ভাল কাজ আছে। তারা আসমানির চরের পশুপাখিদের পাহারা দেবে।”

এবার বীরবাহু স্খলিতকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি ওদের পোষ মানালে কী করে?”

“আমি মন্ত্রতন্ত্র জানি না বিরুবাবু, শুধু ভালবাসতে জানি। আমার বিশ্বাস পশুপাখি ভালবাসা টের পায়।”

একটু বাদে বীরবাহু আর তাঁর চার শিকারি বন্ধু নিঃশব্দে হেঁটে এসে নৌকোয় উঠলেন। কারও মুখে কথা নেই। হঠাৎ যেন সব কথা ফুরিয়ে গিয়েছে।