৬. কারুকার্যখচিত মুখোশ
ঈশ্বরী প্রিমা বললেন, রিহান, তুমি বস।
রিহান চমকে উঠে ঈশ্বরী প্রিমার দিকে তাকাল। একজন ঈশ্বর বা ঈশ্বরী কখনোই সাধারণ একজন মানুষকে তার নাম দিয়ে সম্বোধন করেন না, কখনোই তাদেরকে তার সামনে বসতে অনুরোধ করবেন না। রিহান তার বিস্ময়টুকু গোপন করে ঈশ্বরী প্রিমার নির্দেশ মতো তার সামনের চেয়ারটিতে বসল। এখন তাদের দুজনের ভিতরে দূরত্ব একটি পাথরের টেবিল। ঈশ্বরী প্রিমা তার সেই কারুকার্যময় মুখোশটি দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছেন। হালকা নীল রঙের পোশাকটির ভেতরে কিশোরীর মতো হালকা ছিপছিপে দেহের অবয়বটি দেখা যাচ্ছে। ঈশ্বরী প্রিমার সামনে বসে রিহান এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করে, তিনি কেন তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন সে জানে না। নিশ্চয়ই সে বড় কোনো অপরাধ করে নি, তা হলে তাকে নাম ধরে ডাকতেন না, তাকে বসতে বলতেন না।
ঈশ্বরী প্রিমা দীর্ঘ সময় মুখোশের ভেতর দিয়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, একজন ঈশ্বর বা ঈশ্বরী সম্পর্কে তুমি কতটুকু জান রিহান?
রিহান এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব করে, নিচু গলায় বলে, আমি বেশি কিছু জানি না ঈশ্বরী প্রিমা।
তুমি কেন সাধারণ একজন মানুষ রিহান আর আমি কেন ঈশ্বরী প্রিয়া তুমি বলতে পারবে?
রিহান মাথা নাড়ল, বলল, পারব না ঈশ্বরী প্রিমা। শুনেছি অসংখ্য মানুষের মাঝে একজন দুইজন ঈশ্বরের ক্ষমতা নিয়ে জন্মান। তাদেরকে খুঁজে বের করে ঈশ্বরের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তাদেরকে কেমন করে খুঁজে বের করা হয়?
আমি জানি না ঈশ্বরী প্রিমা। রিহান কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, যখন। আপনার চলে যাবার সময় হবে তখন আপনি নূতন একজন ঈশ্বরকে দায়িত্ব দেবেন। আপনি নিশ্চয়ই জানেন কে ঈশ্বর হয়ে জন্ম নিয়েছে।
ঈশ্বরী প্রিমা মুখোশের আড়ালে হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠলেন, মুখোশটি হাসছে না, শুধু মানুষটি হাসছে বিষয়টি রিহানকে এক ধরনের বিভ্রান্তির মাঝে ফেলে দিল। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি কেন হাসছেন ঈশ্বরী প্রিমা?
ঈশ্বরী প্রিমা হাসি থামিয়ে বললেন, কেন? শুধু তোমরা মানুষেরা হাসবে আনন্দ করবে আমরা ঈশ্বর এবং ঈশ্বরীরা চার দেয়ালের মাঝে কঠিন মুখ করে বসে থাকব সেটি কেমন নিয়ম?
আমি সেটা বলি নি ঈশ্বরী প্রিমা।
আমি জানি তুমি সেটা বলে নি।
আমি বলেছিলাম–।
তুমি বলেছিলে তুমি ঈশ্বরের কোনো অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস কর না।
রিহান মাথা নিচু করে বলল, আমার ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন ঈশ্বরী প্রিমা।
তুমি বলেছিলে তুমি একজন ঈশ্বরীকে করুণা কর, তার জন্যে দুঃখ অনুভব কর
রিহান ব্যস্ত হয়ে বলল, আমি সেভাবে বলি নি
তুমি বলেছ একজন ঈশ্বর কিংবা ঈশ্বরী খুব নিঃসঙ্গ।
রিহান মাথা নিচু করে বলল, হ্যাঁ। আমি সেটা বলেছিলাম। আমার সব সময় মনে হয়েছে
ঈশ্বরী প্রিমা রিহানকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললেন, এটি কোন বিচার যে তুমি রিহান হয়ে জীবনকে উপভোগ করবে আর আমি ঈশ্বরী হয়ে চার দেয়ালের মাঝে বন্দি হয়ে থাকব?
রিহান কোনো কথা না বলে অবাক হয়ে ঈশ্বরী প্রিমার দিকে তাকাল। তার কারুকার্যময় মুখোশের আড়ালে এই মুহূর্তে কী অনুভূতি খেলা করছে সেটি দেখতে পাচ্ছে না। সেখানে কি ভয়ংকর ক্রোধ? তীব্র অভিমান? নাকি গভীর বিষাদ?
ঈশ্বরী অরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, তুমি জান ঈশ্বরী হবার জন্যে আমার কী ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে?
না। জানি না।
আমার বাবা–মা ছিল। ছোট দুজন ভাই ছিল। সবাইকে ছেড়ে এখানে আসতে হয়েছে।
আমি দুঃখিত ঈশ্বরী প্রিমা।
দুঃখ বলতে কী বোঝায় সেটা তোমরা জান না রিহান। আমি ঈশ্বরী হয়ে এখানে আসার পর যে আমার বাবা–মা ছোট ছোট দুজন ভাই দুর্ঘটনায় মারা গেছে সেটি কি শুধু দুর্ঘটনা? নাকি হত্যাকাণ্ড?
রিহান কোনো কথা না বলে বিস্ফারিত চোখে ঈশ্বরী প্রিমার দিকে তাকিয়ে রইল।
ঈশ্বরী প্রিমা ভাঙা গলায় বললেন, আমি তো ঈশ্বরী হতে চাই নি। আমি তো সাধারণ মানুষ হয়ে বড় হতে চেয়েছিলাম। আমি ছোট একটা সংসার চেয়েছিলাম, ভালোমানুষ একজন স্বামী চেয়েছিলাম। ছোট একটি সন্তান চেয়েছিলাম। তাকে গভীর ভালবাসায় বুকে চেপে ধরতে চেয়েছিলাম। তা হলে কেন আমাকে চার দেয়ালের মাঝে বন্দি হয়ে তোমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে?
রিহান কোনো কথা না বলে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ঈশ্বরী প্রিমার দিকে তাকিয়ে রইল। ঈশ্বরী প্রিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আমি আমার নিজের জীবনকে গ্রহণ করে ফেলেছিলাম। পুরো জীবন ঈশ্বরী হয়ে থেকে তোমাদের সুখ শান্তি আর নিরাপত্তার জন্যে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়েছিলাম। নিজের ভিতরে মানুষের সব অনুভূতি মুছে সেখানে ঈশ্বরের কাঠিন্য নিয়ে এসেছিলাম। তখন, ঠিক তখন–
তখন কী ঈশ্বরী প্রিমা?
তখন তুমি এসে বললে তুমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস কর না! ঈশ্বর তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে নি। ঈশ্বরের কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নেই–শুধু তাই না, তুমি বললে তুমি জান যে ঈশ্বরী আসলে নিঃসঙ্গ।
রিহান কোনো কথা না বলে ঈশ্বরী প্রিমার কারুকার্যখচিত মুখোশটির দিকে তাকিয়ে রইল। ঈশ্বরী প্রিমা একটি নিশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি না জেনে আমার জীবনকে ওলটপালট করে দিয়েছ। আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছি। আমাদের কমিউনে তুমি যেটা করতে চেয়েছ আমি তোমাকে সেটা করতে দিয়েছি।
আমি সেজন্যে আপনার কাছে কৃতজ্ঞ ঈশ্বরী প্রিমা।
আমার ধারণা, সেটি আমাদের কমিউনের জন্যে খুব চমৎকার একটি ব্যাপার হয়েছে। ঈশ্বরীর সাহায্য না নিয়ে তোমরা বড় বড় সমস্যার সমাধান করেছ!
রিহান মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। করেছি।
একজন ঈশ্বর কিংবা ঈশ্বরীর প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে কমিউনের সব মানুষকে সর ব্যাপারে তার ওপর নির্ভরশীল রাখা, নিশ্চিত করা মানুষ যেন কখনোই নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারে। কিন্তু আমি তাদেরকে পায়ে দাঁড়াতে দিয়েছি, আমি সবাইকে একজন ঈশ্বর ছাড়া, বেঁচে থাকা শেখাতে চাই।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
কিন্তু রিহান আজকে আমি তোমাকে ডেকেছি একটি সত্য কথা বলার জন্য।
রিহানের বুক কেঁপে উঠল, জিজ্ঞেস করল, কী কথা?
আমি এই কমিউনের মানুষকে কেন নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াতে দিয়েছি তুমি জান? কেন ঈশ্বরের সাহায্য ছাড়া তাদের বেঁচে থাকতে শিখাচ্ছি?
তাদের ভালোর জন্যে, তাদের ভবিষ্যতের জন্যে
না–না–না। ঈশ্বরী প্রিমা তীব্র কণ্ঠে কথা বলতে বলতে মাথা নাড়লেন, আমি এটা করেছি আমার নিজের জন্যে।
নিজের জন্যে?
স্যা। আমার নিজের জন্যে! আমি আর ঈশ্বরী প্রিমা থাকতে চাই না। আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই। তুচ্ছ একজন মানুষ, অকিঞ্চিতকর একজন মানুষ! আমার ছোট একটা ঘরে ছোট একটা শিশু থাকবে, সাদাসিধে একজন স্বামী থাকবে, আমরা সারা দিন খেটেখুটে একমুঠো খাবার খাব–মাথার উপর একটা আচ্ছাদন থাকবে
ঈশ্বরী প্রিমা হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। মুখ তুলে রিহানের দিকে তাকালেন, বললেন, রিহান, তুমি একজন ঈশ্বরীকে মানুষ হবার স্বপ্ন দেখিয়েছ! দোহাই তোমার, তোমাকে এই স্বপ্ন পূরণ করে দিতে হবে।
রিহান হতচকিত হয়ে বলল, আমাকে?
হ্যাঁ। তুমি বলেছ একজন ঈশ্বর বা ঈশ্বরীর কাছে কিছু তথ্য থাকে যেটা অন্য কারো কাছে থাকে না।
আমি সেটা অনুমান করেছিলাম।
তোমার অনুমান সত্যি। আমি তোমার মতো একজন সাধারণ মানুষ–শুধু একটা পার্থক্য আমার কাছে এমন তথ্য আছে যেটা কোনো মানুষের কাছে নেই!
রিহান অবাক হয়ে বলল, কোথায় আছে সেই তথ্য? কেমন করে আছে?
আমি সব তোমাকে বলব। কিন্তু তুমি আমাকে কথা দাও আমাকে আবার মানুষের মতো বাচতে দেবে।
ঈশ্বরী প্রিমা, আপনি যেটা বলছেন সেটা অনেক বড় একটা দায়িত্ব। আমি কি সেটা পারব?
আমি একা যদি এতদিন সেটা পেরে থাকি তুমি সবাইকে নিয়ে সেটা পারবে না?
আমি এখনো সেটা জানি না ঈশ্বরী প্রিমা। কিন্তু আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি আমি চেষ্টা করব। আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করব।
ঈশ্বরী প্রিমা কাঁপা হাতে তার কারুকার্যময় মুখোশটি খুলে নিলেন, রিহান বিষয়ে হতবাক হয়ে গেল, মুখোশের আড়ালে একটি তেরো-চৌদ্দ বছরের কিশোরী মেয়ের মুখ। বড় বড় নিষ্পাপ চোখ, সেই চোখে ব্যাকুল একটা দৃষ্টি, পাতলা গোলাপি ঠোঁট, সেখানে বিষণ্ণতার একটা ছাপ। রিহান কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, তু–তু–তুমি ঈশ্বরী প্রিমা?
ঈশ্বরী প্রিমা মাথা নাড়ল।
তুমি তো ছোট একটি মেয়ে!
হ্যাঁ। আমি ছোট একটি মেয়ে। আমি খুব ভীতু আর দুর্বল ছোট একটি মেয়ে। কিশোরী মেয়েটি কার গলায় বলল, বলল, তুমি আমাকে রক্ষা করবে। বলো–কথা দাও।
রিহান নিজের অজান্তে উঠে দাঁড়াল, তারপর কিশোরী মেয়েটির কাছে গিয়ে তার হাত স্পর্শ করল, বলল, ঈশ্বরী প্রিমা
না। মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল, ঈশ্বরী নয়, বলো প্রিমা। শুধু প্রিমা।
প্রিমা–আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি তোমাকে আমি রক্ষা করব।
কিশোরী মেয়েটি যে কিছুক্ষণ আগেও সর্বশক্তিমান ঈশ্বরী প্রিমা ছিল, রিহানের দুই হাত ধরে আকুল হয়ে কেঁদে উঠল। রিহান এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর খুব সাবধানে মেয়েটির মুখটাকে দুই হাতে ধরে হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, তোমার কোনো ভয় নেই প্রিমা! কোনো ভয় নেই।
.
রাত্রিবেলা রিহানের চোখে ঘুম আসছিল না। ঈশ্বরী প্রিমাকে আজ সে যেভাবে দেখে এসেছে সেটি কিছুতেই ভুলতে পারছে না। কিশোরী মেয়েটি যখন আকুল হয়ে কাঁদছিল গভীর একটি দুঃখে তার বুকটা ভেঙে যাচ্ছিল। এখনো তার বুকের ভিতরে সেই কষ্টটি রয়ে গেছে, কিছুতেই সেটা দূর করতে পারছে না।
রিহান বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে করতে একসময় নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে গেল।
কে যেন ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে–রিহান চোখ খুলে তাকাল। গ্রুস্তান উদ্বিগ্ন মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রিহান হঠাৎ ধড়মড় করে জেগে উঠল, কী হয়েছে গ্রুস্তান?
ঘুম থেকে ওঠ তাড়াতাড়ি।
কেন?
ঈশ্বরী প্রিমা জরুরি খবর পাঠিয়েছেন।
রিহান চমকে উঠে বলল, কী জরুরি খবর পাঠিয়েছেন?
এই মুহূর্তে তোমাকে যেন সরিয়ে নেওয়া হয়।
আমাকে? রিহান অবাক হয়ে বলল, কেন?
জানি না। কিন্তু ঈশ্বরী প্রিমার আদেশ এটা।
কেন এরকম আদেশ দিয়েছেন?
গ্রুস্তান গম্ভীর মুখে বলল, নিশ্চয়ই তাঁর কাছে কোনো জরুরি খবর আছে।
কীসের জরুরি খবর?
বাইরে এসে দেখ।
রিহান বাইরে এসে স্তম্ভিত হয়ে গেল। চারদিকে বিন্দু বিন্দু আলো কাঁপছে, তার সাথে চাপা গুঞ্জন। তাদের কমিউনের দিকে শত শত মোটরবাইক ছুটে আসছে। বিন্দু বিন্দু আলোগুলো মোটরবাইকের হেডলাইটের আলো, গুঞ্জনটি বহুদূর থেকে ভেসে আসা শক্তিশালী ইঞ্জিনের গুঞ্জন। রিহান কয়েক মুহূর্ত হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, তারপর ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করে, কী হচ্ছে এখানে?
আমাদের আক্রমণ করতে আসছে।
কারা?
সবাই।
রিহান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, সবাই?
হ্যাঁ সবাই। এই এলাকায় যতো কমিউন আছে তাদের সবাই।
সে কী? কেন?
জানি না। কিন্তু আমার ধারণা তোমার জন্যে।
আমার জন্যে?
গ্রুস্তান গম্ভীর হয়ে বলল, একজন ঈশ্বর তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল–তুমি সেই মৃত্যুদণ্ড থেকে পালিয়ে এসেছ। তোমাকে সেই মৃত্যুদণ্ড পেতে হবে। যদি না পাও তা হলে সেই ঈশ্বর অর্থহীন হয়ে যায়। অসত্য হয়ে যায়। সেটি কেউ মেনে নিতে পারছে না।
রিহান কাঁপা গলায় বলল, মেনে নিতে পারছে না?
ঈশ্বরী প্রিমা ছাড়া। ঈশ্বরী প্রিমা তোমাকে বাঁচাতে চান। তাই তোমাকে সরে যেতে বলছেন।
রিহান হঠাৎ কঠিন মুখে বলল, আমি সরে যাব না।
তুমি কী করবে?
আমি এখানে থাকব।
কেন?
ওদের সাথে যুদ্ধ করব।
গ্রুস্তান কাঠ কাঠ স্বরে হেসে উঠে বলল, তুমি এই কয়েক হাজার মানুষের সাথে যুদ্ধ করবে?
তা হলে আমরা কী করব?
সেটা ঈশ্বরী প্রিমাকে সিদ্ধান্ত নিতে দাও।
ঈশ্বরী প্রিমা কী সিদ্ধান্ত নেবেন?
গ্রুস্তান কঠিন মুখে বলল, দেখ রিহান, ঈশ্বর এবং ঈশ্বরীর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে তুমি এর আগেও অনেক বড় বিপদ ডেকে এনেছ–এবারে সেটি না হয় নাই করলে।
রিহান গ্রুস্তানের মুখের দিকে তাকাল, হঠাৎ করে পুরো ব্যাপারটি নিয়ে সে কেমন যেন অসহায় অনুভব করে। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, গ্রুস্তান। এরা সবাই যদি আমাকে ধরার জন্যে আসে তা হলে পালিয়ে না গিয়ে আমার এখানে থাকা উচিত। আমাকে পেয়ে সন্তুষ্ট হয়ে তারা চলে যাবে। এখানে আর কারো কোনো ক্ষতি করবে না।
গ্রুস্তান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমারও তাই ধারণা।
কাজেই আমি পালিয়ে যেতে চাই না। আমি এখানে থাকতে চাই।
কিন্তু ঈশ্বরী প্রিমা চান তুমি চলে যাও। কাজেই তোমাকে চলে যেতে হবে।
আমি যাব না।
ঈশ্বরীর নির্দেশ তুমি অমান্য করতে পারবে না। তুমি যেতে না চাইলে তোমাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাবার নির্দেশ আছে।
জোর করে?
হ্যাঁ। গ্রুস্তান বলল, তোমার ঠিক কোথায় আঘাত করলে তুমি দীর্ঘ সময়ের জন্যে অজ্ঞান হয়ে যাবে, ঈশ্বরী প্রিমা সেটাও বলে দিয়েছেন।
রিহান কিছু একটা বলতে চাইছিল কিন্তু তার আগেই কিছু একটা তীব্র শক্তিতে তার ঘাড়ে আঘাত করে। কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ করে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে।
.
রিহান যখন চোখ খুলে তাকাল তখন অন্ধকার কেটে পূর্ব আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। উঠে বসতে গিয়ে হঠাৎ সে মাথায় তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করে। দুই হাতে খানিকক্ষণ তার মাথা ধরে রেখে সে সাবধানে উঠে বসে, ভোরের শীতল বাতাসে সারা শরীর হঠাৎ একটু কেঁপে উঠল। সে কোথায় আছে কেমন আছে মনে করার চেষ্টা করল, এবং হঠাৎ করে তার পুরো ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। শত শত মোটরবাইক হিংস্র পশুর মতো তাদের কমিউনের দিকে ছুটে আসছিল এবং তার মাঝে তাকে অচেতন করে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তাকে কোথায় সরিয়ে নিয়েছে?
রিহান উঠে বসে চারদিকে তাকায়, পাহাড়ি একটা এলাকা–আগে কখনো এখানে এসেছে বলে মনে পড়ে না। রিহান সাবধানে উঠে দাঁড়ায়, বড় বড় কিছু পাথরের আড়ালে তাকে রেখে গেছে। পাথরগুলো ধরে সে বের হয়ে আসে, সামনে একটা বড় উপত্যকা তার অন্যপাশে বহুদূরে আবছাভাবে তাদের কমিউনটি দেখা যাচ্ছে। রিহান ভোরের আবছা আলোতে কমিউনটি ভালো করে দেখার চেষ্টা করল, তার আশঙ্কা হচ্ছিল হয়তো দেখবে পুরো কমিউনটি জ্বালিয়ে অঙ্গার করে দিয়েছে, মৃত মানুষের দেহ আর কালো ধোঁয়ায় সেটি বীভৎস হয়ে আছে। কিন্তু সেরকম কিছু দেখল না। মনে হল কমিউনটির কোনো ক্ষতি হয় নি–ঠিক সেভাবেই আছে। রিহান একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, তার জন্যে পুরো কমিউনটি ধ্বংস করে দেওয়া হলে সে কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারত না।
রিহান একটা বড় নিশ্বাস ফেলে তার কমিউনের দিকে হেঁটে যেতে থাকে।
কমিউনের কাছাকাছি পৌঁছেই রিহান বুঝতে পারল কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। তাকে প্রথমে দেখতে পেল ত্রান, কিন্তু তাকে দেখে ত্রানা অন্যবারের মতো তার কাছে ছুটে এল না, বরং দূরে সরে গেল। রিহান আরেকটু কাছে যেতেই লরি ট্রাক থেকে মানুষজন বের। হয়ে আসতে থাকে কিন্তু কেউ তার সাথে কোনো কথা বলে না, কেমন যেন আতঙ্ক ক্রোধ এবং ঘৃণার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। রিহান কেমন যেন ভয় পেয়ে যায়, কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস পায় না। ঠিক এরকম সময় সে গ্রুস্তানকে দেখতে পেল, একটা ট্রাকের পাটাতনে বিষণ্ণ মুখে বসে আছে। রিহাত দ্রুত পায়ে তার কাছে হেঁটে যায়, গ্রুস্তান তার দিকে তাকাল কিন্তু তার মুখে কোনো অভিব্যক্তির ছাপ পড়ল না।
রিহান ভয় পাওয়া গলায় ডাকল, গ্রুস্তান।
গ্ৰস্তান কোন কথা না বলে শীতল চোখে তার দিকে তাকাল। রিহান জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে গ্রুস্তান?
তুমি এখনো জান না?
না।
গ্রুস্তান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ঈশ্বরী প্রিমাকে ধরে নিয়ে গেছে।
রিহান নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না, বিস্ফারিত চোখে গ্রুস্তানের দিকে তাকিয়ে থাকে। কয়েকবার চেষ্টা করে বলে, ঈশ্বরী প্রিমাকে? ধরে নিয়ে গেছে?
হ্যাঁ।
রিহান মাথা ঘুরিয়ে দেখতে পেল, কমিউনের সবাই ধীরে ধীরে তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই, সবার দৃষ্টি শীতল। সবার মুখে এক ধরনের ঘৃণা। রিহান শুষ্ক গলায় জিজ্ঞেস করল, কেন তারা ঈশ্বরী প্রিমাকে ধরে নিয়ে গেছে?
তোমাকে না পেয়ে।
আমাকে না পেয়ে?
হ্যাঁ। তোমাকে যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, সেটি তোমাকে পেতে হবে তাই। তোমাকে না পেলে ঈশ্বরী প্রিমাকে।
রিহান কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, এখন কী হবে?
আমাদের সবাইকে ভাগাভাগি করে অন্য সব কমিউনে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
কেন?
আমাদের কোনো ঈশ্বর নেই। কোনো ঈশ্বরী নেই। আমরা কেমন করে থাকব?
হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন তীব্র গলায় চিৎকার করে উঠল, সব তোমার জন্যে রিহান। তুমি এসে আমাদের কমিউনে সব নষ্ট করে দিয়েছ। সব ধ্বংস করে দিয়েছ।
রিহান চমকে উঠে তাকাল, অন্য সবাই মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ তোমার জন্যে। তোমার জন্যে নির্বোধ কোথাকার!
রিহান এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে তাকায়, সবাই কেমন যেন ক্ষিপ্ত পশুর মতো মারমুখী হয়ে উঠেছে, মনে হচ্ছে তাকে ধরে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। ঠিক তখন কোথা থেকে জানি নীলন এসে হাজির হল, ভিড় ঠেলে ভিতরে এসে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, শান্ত হও। সবাই শান্ত হাও। ঈশ্বরী প্রিমা তার শেষ কথায় তোমাদের বলে গেছেন তোমরা যেন রিহানকে ভুল না বোঝ। ঈশ্বরী বলেছেন তাকে ক্ষমা করে দিতে
না, আমরা ক্ষমা করব না। কিছুতেই ক্ষমা করব না। তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা রাগে উন্মত্ত মানুষেরা চিৎকার করে বলল, আমরা খুন করে ফেলব। টুটি ছিঁড়ে ফেলব।
নীলন রিহানকে আড়াল করে রেখে বলল, তোমরা শান্ত হও। শান্ত হও–কোনো পাগলামো করো না। আমরা সভ্য মানুষ, সভ্য মানুষের মতো ব্যবহার করতে হবে।
মধ্যবয়সী একজন মানুষ চিৎকার করে বলল, আমি তখনই বলেছিলাম এই মানুষটাকে এখানে ঢুকতে দিও না
একজন মহিলা বলল, যখন আমাদের ঈশ্বরী প্রিমাকে ধরে নিয়ে শেষ করে দেবে তখন রিহান এখানে বেঁচে থাকবে, ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘুরে বেড়াবে সেটি কেমন করে হয়?
বেশ কয়েকজন চিৎকার করে বলল, খুন করে ফেলো। খুন করে ফেলল এই হতভাগাকে
রিহান হতচকিত হয়ে এই ক্রুদ্ধ মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তাদের ক্রোধ অর্থহীন নয়, সত্যি সত্যিই তার জন্যে আজ ঈশ্বরী প্রিমাকে ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু শুধু কি তার জন্যে? রিহান বুকের ভিতরে এক ধরনের গভীর হতাশা অনুভব করে। গভীর দুঃখে তার বুক ভেঙে যেতে চায়। সে নীলনকে পাশ কাটিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল, সবার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা আমাকে একটু কথা বলার সুযোগ দাও।
কে জানি চিৎকার করে বলল, না। দেব না। খুন করে ফেলব তোমাকে।
রিহান বলল, তোমরা যদি আমাকে খুন করতে চাও আমি সেটার জন্যেও প্রস্তুত। কিন্তু আগে আমাকে দুটি কথা বলতে দাও।
কী কথা?
তোমরা সবাই বলছ পুরো ব্যাপারটার জন্যে দায়ী আমি। সত্যি কথা বলতে কী আমি এমন কিছু ব্যাপার জানি যেটা অন্য কেউ জানে না! জানলে পুরো ব্যাপারটা তোমরা। অন্যভাবে দেখতে। কিন্তু আমি সেখানে যাচ্ছি না। আমি সমস্ত দোষ স্বীকার করে নিচ্ছি। আমি আমার কাজকর্ম দিয়ে যেসব দুঃখকষ্ট তৈরি করেছি তার জন্যে ক্ষমা চাইছি। তোমরা যদি আমাকে অনুমতি দাও তা হলে আমি এই মুহূর্তে প্রভু ক্লডের কাছে ধরা দেব। তার দেওয়া মৃত্যুদণ্ড মেনে নিয়ে ঈশ্বরী প্রিমাকে তোমাদের কাছে ফিরিয়ে দেবার জন্যে অনুরোধ করব।
রিহানকে ঘিরে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা কেউ কোনো কথা বলল না। রিহান নীলনের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, আমাকে একটা মোটরবাইক দেবে? সাথে কিছু গ্যাসোলিন।
গ্রুস্তান বলল, সেটি সমস্যা নয়।
তা হলে সমস্যা কী?
তুমি কোথায় গিয়ে ধরা দেবে? এই বিশাল এলাকা তুমি চেন, কোন কমিউনটি কোথায় তুমি জান?
রিহান মাথা নেড়ে বলল, না। জানি না।
তা হলে?
নীলন বলল, আমার কাছে একটি ম্যাপ আছে।
সেই ম্যাপে কমিউনগুলো দেখানো আছে?
নেই। কিন্তু ঈশ্বরী প্রিমার কাছে একটা তালিকা আছে। তার ঘরের দেয়ালে টাঙানো থাকে। সেখানে কমিউনগুলোর অবস্থান বলা আছে।
গ্রুস্তান ভুরু কুঁচকে নীলনের দিকে তাকাল, তুমি কেমন করে জান?
নীলন বলল, আমি জানি। আমি তার ঘরে গিয়েছি। তার ঘরের সবকিছু ভেঙেচুরে দিয়ে গেছে। কিন্তু কাগজপত্রগুলো আছে।
রিহান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তা হলে আমাকে ম্যাপটি আর এই কমিউনের তালিকাটি দাও। আমি ঈশ্বরী প্রিমাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য ধরা দেব। এই মুহূর্তে।
কেউ কোনো কথা বলল না। রিহান সবার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা আমার জন্যে শুভ কামনা কর যেন আমি ঈশ্বরী প্রিমাকে ফিরিয়ে আনতে পারি।
কেউ এবারেও কোনো কথা বলল না।
রিহান আবার বলল, তোমরা কি আমার জন্যে শুভ কামনা করবে না?
নীলন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, যে মানুষটি মারা যাবার জন্যে যাচ্ছে তার জন্যে শুভ কামনা করা যায় না। শুভ মৃত্যুদণ্ড বলে কিছু নেই রিহান।
কমবয়সী একটি মেয়ে হঠাৎ অপ্রকৃতস্থের মতো হেসে উঠে বলল, শুভ মৃত্যুদণ্ড হি–হি–হি।
রিহান বিস্ফারিত চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে।